মেশেদিনী
আরেক জাহাজে একটি মহিলা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বয়স এই ধরুন চল্লিশের সামান্য এদিক-ওদিক। লিপস্টিক, রুজ, পাউডার মাখলে অনায়াসে পয়ত্ৰিশ বলে চালিয়ে নিতে পারতেন। মুখ আর রঙ দেখে বোঝা গেল ইনি খাঁটি মেম নন, কিন্তু ঠিক কোন দেশী সেটা অনুমান করতে পারলুম না। পরনে পুরনো ধরনের লম্বা ফ্রক আর গায়ে লম্বা-হাতা। ব্লাউজ। চোখে মুখে ভারী একটা প্রশাস্তির ভাব লেগে আছে-একটুখানি কেমন যেন উদাস-উদাস বললেও ভুল বলা হয় না।
কিন্তু তাঁর চেহারা, বেশভুষা, ধরনধারণ সেইটে আসল কথা নয়। তিনি চার দিন যেতে না যেতেই লক্ষ্য করলুম, এ যাবৎ তঁকে কারো সঙ্গে একটি মাত্ৰ কথাও বলতে শুনি নি। সমস্ত দিন লাউঞ্জের এক কোণে একা বসে বসে কাটান; তাঁর টেবিলে অন্য কাউকে এসে কথা বলতেও দেখি নি। ওঁর চেয়ে দেখতে খারাপ, বয়সে বেশি, এমন রমণীরাও যখন প্রৌঢ়দের নেকনজর পাচ্ছেন, দুদণ্ড রসালাপ করবার অবকাশও পাচ্ছেন, তখন ইনিই বা জাহাজ-যজ্ঞশালার প্রান্তভূমিতে সঙ্গরসের উপেক্ষিতা কেন?
কাউকে জিজ্ঞেস করার মত সাহসও খুঁজে পাই নে। উনি আমার মা হতে পারেন, বেশি জিজ্ঞেসবাদ করলে ঠোঁটকোটারা হয়তো বলে বসবে, ইডিপস কমপলেক্স’ কিংবা ঐ ধরনেরই কিছু একটা।
তখন হঠাৎ একদিন দেখি, আমারই পরিচিত এক সহযাত্রী লাউঞ্জের ভিতর দিয়ে যাবার সময় ওঁকে নমস্কার করলেন, উনিও উত্তর দিলেন। তঁকে তখন সুবিধেমত এটা, ওটা, পাঁচটা কথার ফাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, মহিলাটি কারো সঙ্গে কথা কন না কেন? ভদ্রলোক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি করে কথা বলবেন? উনি তো ফার্সী। ভিন্ন অন্য কোনো ভাষা জানেন না। ওঁর বাড়ি মেশেদ’ তারপর বললেন, ‘আপনি না। কাবুলে ছিলেন? সেখানকার ভাষা পশতু না ফার্সী কি যেন?’
আমি বললুম, ফার্সী অনেকখানি ভুলে গিয়েছি; তবে এককালে ফার্সীর মাধ্যমে কাবুলে ইংরিজি পড়িয়েছি।’
আর যাবে কোথায়। আমাকে হিড়হিড় করে হাতে ধরে টেনে নিয়ে চললেন সেই মহিলার দিকে-যেন জলে-ডোবা মানুষকে দম দেবার জন্য বদ্যি খুঁজে পেয়েছেন। আমাকে তাঁর সামনে দাঁড় করিয়ে এমন একখানা মিষ্টি হাসি ছাড়লেন, যেন তিনি এখখুনি আমাকে আপন হাতে গড়ে তৈরি করেছেন। নোবেল-প্ৰাইজ-পাওয়া ব্যাটাকেও বোধ হয় বাপ এতখানি দেমাকের সঙ্গে দুনিয়ার সামনে পেশ করে না।
তারপর বললেন শুধু একটি কথা-‘ফার্সী!’
মহিলাটিও এই হুল্লোড়ের মাঝখানে একটুখানি ভ্যাবাচ্যাক খেয়ে গিয়েছেন। সামলে নিয়ে শুধালেন, ‘আপনি ফার্সী বলতে পারেন?’
আমি সবিনয় বললুম, ‘এককালে পারতুম।’
ভারী একটা পরিতৃপ্তির হাসি হেসে বললেন, ‘বসুন।’
তারপর বললেন, ‘আমি যে বেশি কথা কইতে ভালবাসি তা নয়, তবে এই পাঁচদিন ধরে একটি কথাও বলতে না পেরে হাঁপিয়ে উঠেছি। আমি সমস্ত জীবন কাটিয়েছি ইরানের মেশেদ শহরে। তারপর গেল। আট বছর লন্ডনে।’
আমি শুধালুম, ইংরিজি শেখেন নি সেখানে?’
বললেন, ‘না, লন্ডনে তো আমি ইচ্ছে করে যাই নি। আমার স্বামী মেশেদে সর্বস্বাস্ত হয়ে লন্ডন গেলেন তার কাকার কাছে। আমরা ইহুদি, জানেন তো, আমরা ব্যবসা করি দুনিয়ার সর্বত্র। সেখানে ওঁর দু’পয়সা হয়েছে, কিন্তু আমাদ্বারা আর ইংরিজি শেখা হল না। ইরান ইহুদিরা যে দু’চারজন লন্ডনে আছেন, তাদের সঙ্গেই মেলামেশা করি, কথাবার্তা কই। তবে হাট করতে গিয়ে ‘গ্ৰীন পীজ, কলি-ফ্লাওয়ার, টাপেন্স ত্ৰাপেন্স-হে পেনি’ বলতে পারি, ব্যস।’
আমি বললুম, ইংরিজি তো তেমন কঠিন ভাষা নয়, আর আপনি যে দু’চারটে ইংরিজি বললেন সেগুলো তো খুব শুদ্ধ উচ্চারণে।’
মহিলাটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘কি করে শিখি বলুন? আমার মন পড়ে আছে সেই মেশেদ শহরে। লন্ডন সাফসুৎরো জায়গা, বিজলি বাতি, জলের কল, খাওয়াদাওয়া, থিয়েটার সিনেমা সবই ভালো-কোথায় লাগে তার কাছে বুড়ো গরিব মেশেদ? তবু যদি জানতুম একদিন সেই মেশেদে ফিরে যেতে পারবো, তাহলেও না হয় লন্ডনটার সঙ্গে পরিচয় করার চেষ্টা করতুম, কিন্তু যখনই ভাবি ঐ শহরে আমাকে একদিন মরতে হবে, আমার হাড় ক’খানা বাপ-পিতামোর হাড়ের কাছে জায়গা পাবে না, তখন যেন সমস্ত শহরটা আমার দুশমন, আমার জল্লাদ বলে মনে হয়।’
আমি বললুম, ‘আপনার এমন কি বয়স হয়েছে যে আপনি মরার কথা ভাবতে আরম্ভ করেছেন?’
‘তেমন কিছু নয়, জানি, কিন্তু যখন এ কথাও জানি যে, লন্ডনেই মরতে হবে, তখন যেন বয়সের আর গাছ-পাথর থাকে না।’
আমি শুধালুম, ‘মোশেদে ফিরে যাওয়া কি একেবারেই অসম্ভব? আপনি না বললেন, আপনাদের দু’পয়সা হয়েছে।’
মহিলাটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে অনেকক্ষণ ধরে ভাবলেন। বুঝলুম, সব কিছু আমাকে প্রথম পরিচয়েই বলবেন কিনা, তাই নিয়ে মনে মনে তোলপাড় করছেন। শেষটায় বললেন, ‘দুঃখ তো সেইখানেই। আজ আমাদের যা টাকা হয়েছে, তাই নিয়ে আমরা মেশেদের পুরনো ভিট, জমিজমা সব কিছু কিনতে পারি, নূতন ব্যবসা ফাঁদতে পারি।’
আবার নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘দুঃখ তো সেইখানেই। আমার স্বামী যেতে চান না। লন্ডন তাঁর ভালো লেগে গিয়েছে। ভূতের মত খাটেন, পয়সা কামান আর মোটর-হোটেল, রেস্তরাঁ-ব্লাব, কনসার্ট-কাবারে করে করে বেড়ান। আমার উপরও চোটপাট, আমিও কেন সঙ্গে সঙ্গে হৈ হৈ করি না।’
বললেন, ‘বুঝলেন—এখন তিনি লন্ডনের প্রেমে : বুড়ি মেশেদকে বেবাক ভুলে গিয়েছেন।
জাহাজে যে ক’দিন ছিলুম রোজ দু’একবার ওঁর কাছে গিয়ে বসতুম। ভদ্রমহিলা নিজের থেকেই একদিন বললেন, ‘আপনি যেন না। আবার ভাবেন আমি আপনার এক বোঝা হয়ে উঠলুম। যাঁদের সঙ্গে হৈহল্লা করতে আপনি ভালোবাসেন তাদের বাদ দিয়ে আমার সঙ্গে বেশি সময় কাটাবার কোনো প্রয়োজন নেই।’
আমি আপত্তি জানালুম।
তবু তিনি শান্তভাবে লাউঞ্জে আপনি কোণে বসে থাকতেন; কথা বলার জন্য আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করার কোনো চেষ্টাই করতেন না। আমি কাছে গেলেই মিষ্টি হেসে বলতেন, ‘বসুন’; তার পর শুধাতেন, ‘কি খাবেন বলুন।’ জাহাজে খাবার ব্যবস্থা কুলীন শ্বশুরবাড়ির মত, কাজেই এ স্থলে ‘খাবার’ বলতে পানীয়ই বোঝায়।
আমি একদিন বললুম, ‘প্রতিবারেই আপনি আমাকে কিছু একটা খেতে বলেন কেন, বলুন তো?’
অবাক হয়ে বললেন, ‘কী আশ্চর্য! আপনি মেশেব্দে অর্থাৎ লন্ডনে আমার বাড়িতে এলে আপনাকে ভালোমন্দ খেতে দিতুম না?’
আমি বললুম, কিন্তু এটা তো আপনার বাড়ি নয়।’
তিনি বললেন, ‘সে কি কথা! আমার কাছে এলেন তার মানে আমার বাড়িতে এলেন।’
তারপর বললেন, কিন্তু এখানে দিই বা কি? আচ্ছা বলুন তো, আপনি জাহাজের এই বিলিতি রান্না খেতে ভালোবাসেন?’
আমি বললুম, ‘এ জাহাজের রান্নার খুশনাম আছে। আমি কিন্তু আমাদের দিশী রান্নাই পছন্দ করি।’
হেসে বললেন, তবে আপনার রসবোধ আছে। এই আইরিশ সন্টু আর বাঁধাকপি-সেদ্ধ মানুষ কি করে খায় খোদায় মালুম। সেদিন আবার পোলাও রোধেছিল—মাগো! ছিরি দেখে ভিরমি যাই।’
আমি শুধালুম, ‘মোশেদের লোক পোলাও খায়?’
বললেন, ‘হায়, জাহাজে আপনি রান্নাবান্নার ব্যবস্থা নেই তা না হলে আপনাকে এ্যাসা পোলাও খাইয়ে দিতুম যে জীবনভর তার সোয়াদ জিভে লেগে থাকত। ভালো কথা, আপনি তো বোম্বাই যাচ্ছেন সেখানে আপনাকে আচ্ছাসে পোলাও খাইয়ে দেব।’
আমি বললুম, ‘আমি তো ভেবেছিলুম। আপনি মিশর যাচ্ছেন।’
তিনি বললেন, ‘ওঃ, আপনাকে বলি নি বুঝি, আমি বোম্বাই যাচ্ছি-আমার মেয়ের সেখানে বিয়ে হয়েছে। যে ভদ্রলোক আপনাকে আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন তিনি আমার স্বামীর বন্ধু। উনি বিপদে-আপদে সাহায্য করতে পারবেন বলেই এই জাহাজে যাচ্ছি।’
তারপর একটুখানি লাজুক হাসি হেসে বললেন, ‘আমি যে দিদিমা হতে চললুম।’
তারপর রোজই গল্প হত তার মেয়ের সম্বন্ধে। আমাকে কতবার জিজ্ঞেস করতেন, বোম্বাইয়ে ভালো ডাক্তার-বদ্যির ব্যবস্থা আছে কি না। আমি বলতুম, লন্ডনের মত না, তবে ব্যবস্থা মেশেদের চেয়ে নিশ্চয়ই ভালো। ইস্তেক জর্মনিতে পাস-করা ইহুদি ডাক্তারও বোম্বাইয়ে আছেন।
বললেন, ‘ও কথা বলবেন না, মশাই; মেশেদে আমাদের যে বুড়ি ধাইমা ছিলেন তাঁর হাতে কখনো কোনো পোয়াতী মরে নি, কোনো বাচ্চা কোনো জখম নিয়ে জন্মায় নি। আর তাঁর সব কোরদানি তো শুধুমাত্ৰ দুখানি খালি হাত দিয়ে-ডাক্তারদের যন্ত্রপাতির তো উনি ধার ধারতেন না।’
আমি বললাম, ‘আমাদের দেশে গ্রামাঞ্চলে এখনো এ রকম ধাই আছেন। তবে বোম্বাই শহর, সেখানে সায়েব-সুবোদের ব্যাপার।’
উৎসাহিত হয়ে বললেন, ‘আপনি ঠিক ধরেছেন। কিন্তু আজকের দিনের বড় শহরে কেউ আর একথা মানে না। আমার মেয়েকে চিঠিতে ঐ কথা লিখেছিলুম, সে তো হেসেই ठटिश निल।’
চুপ করে থেকে বললেন, ‘আর দেবে নাই বা কেন? ওর ছেলেবেলা ও মেশেদে কাটিয়েছে কিন্তু মেশেদের জন্য তো ওর এতটুকু দরদ নেই। আমার স্বামীরই মত, লন্ডন প্যারিসের নামে অজ্ঞান।’
আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললুম, ‘আপনি এ নিয়ে এত শোক করেন কেন? সে সব কাল গেছে, জমানা বদলে গিয়েছে। এখনও মানুষ আঁকড়ে ধরে থাকবে নাকি মেশেদ কারবালা, কান্দাহার হিরাত?’
বললেন, ‘কেন, আপনি তো প্যারিস ভিয়েনা লন্ডন বার্লিন দেখেছেন—তবু তো ফিরে যাচ্ছেন কোথাকার এক ছোট শহরে।’
আমি ঘাড় চুলকে বললুম, ‘আমার যে মা রয়েছেন।’
বললেন, ‘একই কথা; মা যা মায়ের শহরও তো।’
***
বোম্বাইয়ে জাহাজ ভিড়েছে। এক সুন্দরী তরুণী আর ছোকরাকে দেখে আমার পরিচিত মহিলা আকুল হয়ে উঠলেন। তারা জাহাজে উঠতেই তিনজনে জড়াজড়ি কোলাকুলি। আমি একটুখানি কেটে পড়লুম।
তা হলে কি হয়, আমার নিষ্কৃতি নেই। আমাকে পাকড়ে ধরে নিয়ে মেয়ে জামাইকে বার বার বলেন, ‘এই আমার বন্ধু দিল-জানের দোস্ত, আমার সঙ্গে ফার্সী কথা কয়েছে, ফুর্তি-ফার্তি হৈ-হল্লা ছেড়ে দিয়ে।’
মেয়ে যতই জিজ্ঞেস করে, জাহাজে ছিলে কি রকম, খেলে কি, বাবা কি রকম আছেন, কে বা শোনে কার কথা, সত্য-সত্যই জাহাজে যেন ‘সমুদ্রে রোদন’। তিনি বার বার বলেন, ‘বুঝলি, নয়মি, একে আচ্ছাসে খাইয়ে দিতে হবে। পোলাওর সব মালমসলা আছে তো বাড়িতে?’
ভেবেছিলুম হোটেলে উঠব। মহিলা শোনামাত্র আমাকে হাত ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চললেন তাদের সঙ্গে, আমাকে কড়া নজরে রাখলেন। কাস্টম অফিসে, যেন আমি চোরাই মদ-পাছে কাস্টমস আমাকে পাকড়ে নিয়ে যায়।
তিন দিন তাঁদের সঙ্গে থেকে অতি কষ্টে নিষ্কৃতি পাই।
সে তিন দিন কি রকম ছিলুম? মাছ যে রকম জলে থাকে। ভুল বলা হল; মাছকে যদি শুধান, ‘কি রকম আছো?’ তবে সে বলবে, সৈয়দের ব্যাটা যে রকম ইহুদি পরিবারে ছিল।‘!!