আজব শহর কলকেতা
আজব শহর কলকেতা ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি। বুড়ো হতে চললুম। তবু তার প্রমাণ পেলুম কমই। তাই নিয়ে একখানা প্রামাণিক প্ৰবন্ধ লিখব ভাবছি। এমন সময় নামল জোর বৃষ্টি। সমীরণে পথ হারানোর বেদনা বেজে উঠল। কারণ যদিও পথ হারাই নি তবু সমস্যাটা একই। ছাতা নেই, বর্ষতি নেই, ট্রামে চড়বার মত তাগদও আর নেই-বাস মাথায় থাকুক,-ট্যাক্সি চড়তে বুক কচ কচ করে; কাজেই বাড়ি ফেরার চিন্তার বেদনোটা ‘পথ হারানো’র মতই হল। এমন সময় সপ্রমাণ হয়ে গেল, ‘কলকেতা আজব শহর’–সামনে দেখি বড় বড় হরফে লেখা ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’।
খেয়েছে! নিশ্চয়ই কোনো ফরাসি পথ হারিয়ে কলকাতায় এসে পড়েছে আর যে দুটি পয়সা ট্যাকে আছে তাই খোয়াবার জন্য ফরাসি বইয়ের দোকান খুলেছে। বাঙালি প্রকাশকরা বলেন, ‘শুধু ভালো বই ছাপিয়ে পয়সা কামানো যায় না, রাদি উপন্যাস গাদা গাদা ছাপতে হয়।’ কথাটা যদি সত্যি হয় তবে শুধু ফরাসি বই বেচে এ দোকানে মুনাফা করবে কি প্রকারে? তাই আন্দাজ করলুম, এই ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ’ বোধ হয়। হাতির দাঁতের মত—শুধু দেখবার জন্য চিবোবার জন্য দাঁত রয়েছে লুকোনো অর্থাৎ দোকানের নাম বাইরে যদিও ‘ফ্রেঞ্চ বুক শপ, ভিতরে গিয়ে পাবো অন্য মাল—’খুশবাই’, ‘সাঁঝের পীর’, লোধ্ররেণু’ ওষ্ঠ-রাগ’।
সেই ভরসায় ঢুকলুম। বৃষ্টিটাও জোরে নেমেছে। নাঃ, আজব শহর কলকেতাই বটে। শুধু ফরাসি বই বেচেই লোকটা পয়সা কামাতে চায়। গাদা গাদা হলদে আর সাদা মলাটওলা এস্তার ফরাসি বই, কিছু সাজানো-গোছানো, কিছু যত্রতত্র ছড়ানো। ফরাসি দোকানদার কলকাতায় এসে বাঙালি হয়ে গিয়েছে। বাঙালি দোকানদারেরই মত বইগুলো সাজিয়েছে টাইপরাইটারের হরফ সাজানো মত করে। অর্থাৎ সিজিলটা যার জানা আছে সে চোখ বন্ধ করেই ইচ্ছেমত বই বের করে নিতে পারবে, যে জানে না তার কোমর ভেঙে তিন টুকরো হয়ে যাবে।
ফুটফুটে এক মেমসাহেব এসে ইতিমধ্যে ফরাসি হাসি হেসে দাঁড়িয়েছেন। পরশুরামের কেদার চাটুজ্যেকে আমি মুরুব্বি মানি। তারই ভাষায় বললুম, ‘সেলাম মেমসাহেব।’ মেমসাহেব ফরাসিতে বললেন, ‘আপনার আনন্দ কিসে?’–অৰ্থাৎ ‘কি চাই?’ মেরেছে। ফরাসি ভাষা কবে সেই প্রথম যৌবনে বলেছি সে কথাই স্মরণ নেই-গোটা ভাষাটার কথা বাদ দিন।
জর্মন ভাষায় একটি প্রেমের গান আছে Dein Mund sagt ‘Nein’ Aber Deine Augen sagen ‘Ja’। অর্থাৎ, তোমার মুখ বলছে ‘না, নো’, কিন্তু তোমার চোখ দুটি বলছে ‘হাঁ হাঁ’।
কিন্তু ফরাসি জর্মনির দুশমন। জর্মন যা করে ফরাসি তার ঠিক উল্টো করাটাই জাত্যাভিমানের কৈবল্যানন্দ বলে ধরে নিয়েছে। তাই মেমসাহেব যতই মুখে ‘ইয়েস ইয়েস’ বলেন ততই দেখি তার চোখে স্পষ্ট লেখা রয়েছে ‘না’ ‘নো’–অর্থাৎ মেমসাহেব আমার ইংরেজি বুঝতে পারছেন না। মহা মুশকিল।
হঠাৎ কখন ফরাসি রাজদূত মসিয়ো ফ্রাঁসোয়া পঁসে’র নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে বোধ হয় কিছুটা ফরাসি বেরিয়ে পড়েছিল, আর যাবে কোথা, মেমসাহেব আদেশ দিলেন, ‘মসিয়ো, ফরাসিতে কথা বললেই পারেন।’
বাঙালি জাত্যাভিমানে বড়ই আঘাত লাগলো স্বীকার করতে যে যদিও ফরাসি ভাষাটা কেঁদেকুকিয়ে পড়ে নিতে পারি, বলতে গেলে আমার অবস্থা। ড্ডনং হয়ে দাঁড়ায়। ভাবলুম, দুগগা বলে ঝুলে পড়ি। এ মেমসাহেব যদি কলকাতার বুকের উপর বসে বাঙলা (এমন কি ইংরিজিও) না বলতে পারে তবে আমি ফ্রান্স থেকে হাজারো মাইল দূরে দাঁড়িয়ে টুটিফুটি ফরাসি বললে এমন কোন বাইবেল অশুদ্ধ হযে যাবে?
দশ বছরের পুরোনো মর্চে-ধরা, জাম-পড়া, ছাতি-মাথা ফরাসি তানপুরোটার তার বেঁধে বরাজলালের মত ইমনকল্যাণ সুর ধরলাম। এবং কী আনন্দ, কী আনন্দ, মেমসাহেবও বুড়ে রাজা প্ৰতাপ রায়ের মত। আমার ফরাসি শুনে কখনো আহাহা বাহাবা বাহাবা’ বলেন, কখনো, ‘গলা ছাড়িয়া গান গাহো’ বলেন। এই হল ফরাসি জাতটার গুণ। হাজারো দোষের মধ্যে একটা কিছু ভালো দেখতে পেলেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে।
আমাকে আর পায় কে?
আপনাদের আশীর্বাদে আর শ্ৰীগুরুর কৃপায় তখন ব্যাকরণকে গঙ্গাযাত্রায় বসিয়ে উচ্চারণের মাথায় ঘোল ঢেলে চালালুম আমার ধেনো মার্ক ফরাসি শ্যাম্পেন। মেমসাহেব খুশা। আম্মো তর।
অতি সযত্নে তিনি আমার বইয়ের ফর্দ টুকে নিলেন, বই আসা মাত্র আমায় খবর দেবেন। সে ভরসাও দিলেন; সঙ্গে সঙ্গে সাত সমুদ্র তেরো নদীর এপারে বিদেশীর সঙ্গে মাতৃভাষায় কথা কইতে পাওয়ার আনন্দে সুখ-দুঃখের দু-চারটা কথাও বলে ফেললেন। মাত্র তিন মাস হল এদেশে এসেছেন, তাই ইংরিজি যথেষ্ট জানেন না, তবে কাজ চালিয়ে নিতে পারেন, বইয়ের দোকান তাঁর নয়, এক বান্ধবীর, তার অনুপস্থিতিতে শুদ্ধমাত্র ফরাসি ভাষা ও সাহিত্যের প্রচার কামনায় দোকানে বসেছেন।
তুলসীদাস বলেছেন—’পৃথিবীর কি অদ্ভুত রীতি। শুড়ি-দোকানে জেঁকে বসে থাকে আর দুনিয়ার লোক তার দোকানে গিয়ে মদ কেনে। ওদিকে দেখ, দুধওয়ালাকে ঘরে ঘরে ধন্না দিয়ে দুধ বেচতে হয়।’
বুঝলুম কথা সত্যি। একদিন পৃথিবীর লোক প্যারিসে জড়ো হত ফরাসি বেচবার জন্য।
সে কথা থাক। ইতিমধ্যে একটি বাঙাল ছোকরা দোকানে ঢুকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কমার্শিয়াল আর্ট সম্বন্ধে কোন বই আছে কিনা?’ আমার মনে বড় আনন্দ হল। বাঙালি তাহলে বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছে। ফরাসি ভাষায় কমার্শিয়াল আর্টের বই খুঁজছে।
ততক্ষণে আমি একটা খাসা বই পেয়ে গিয়েছি। ন্যূরনবর্গের মোকদ্দমায় যেসব দলিল-দস্তাবেজ পাওয়া গিয়েছিল, তাই দিয়ে গড়া হিটলার চরিত্ৰবৰ্ণন। হিটলার সম্বন্ধে তার দুশমন ফরাসিরা কি ভাবে তার পরিচয় বইখানাতে আছে। এ বইখানার পরিচয় আপনাদের দেব বলে লেখাটা শুরু করেছিলুম, কিন্তু গৌরচন্দ্ৰিকা শেষ হতে না হতেই ভোরের কাক কা-কা করে আমায় স্মরণ করিয়ে দিলে, কলম ‘ফুরিয়ে গিয়েছে। আরেক দিন হবে।
বেশ ভালই লাগলো। প্রথমবার পেলাম। দেখা যাক আর কত রত্ন রেখেছেন।