তোতা কাহিনী

তোতা কাহিনী

পারস্য দেশের গুণী-জ্ঞানীরা বলেন, আল্লা যদি আরবি ভাষায় কোরান প্রকাশ না করে ফার্সিতে করতেন, তবে মৌলানা জালালউদ্দীন রুমির ‘মসনবি’ কেতাবখানাকে কোরান নাম দিয়ে চালিয়ে দিতেন। এ ধরনের তারিফ আর কোনও দেশের লোক তাদের কবির জন্য করেছে বলে তো আমার জানা নেই।

মৌলানা রুমি ছিলেন ভক্ত। তিনি ভগবানকে পেয়েছিলেন কদম্ববন-বিহারিণী শ্রীরাধা যেরকম করে গোপীজনবল্লভ শ্রীহরিকে পেয়েছিলেন, অর্থাৎ প্রেম দিয়ে। রুমি তাঁর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা মসনবিতে বর্ণনা করেছেন। বেশিরভাগ গল্পচ্ছলে, তারই একটি ‘তোতা কাহিনী’।

ইরান দেশের এক সদাগরের ছিল একটি ভারতীয় তোতা। সে তোতা জ্ঞানে বৃহস্পতি, রসে কালিদাস, সৌন্দর্যে রুডলফ ভেলেন্টিনো, পাণ্ডিত্যে ম্যাক্সম্যুলার। সদাগর তাই ফুরসত পেলেই সেই তোতার সঙ্গে দু দণ্ড রসালাপ, তত্ত্বালোচনা করে নিতেন।

হঠাৎ একদিন সদাগর খবর পেলেন ভারতবর্ষে কার্পেট বিক্রি হচ্ছে আক্রা দরে। তখনই মনস্থির করে ফেললেন ভারতে যাবেন কার্পেট বেচতে। যোগাড়যন্ত্র তদ্দণ্ডেই হয়ে গেল। সর্বশেষে গোষ্ঠীকুটুমকে জিগ্যেস করলেন, কার জন্য হিন্দুস্তান থেকে কী সওদা নিয়ে আসবেন। তোতাও বাদ পড়ল না— তাকেও শুধালেন সে কী সওগাত চায়। তোতা বললে, ‘হুজুর, যদিও আপনার সঙ্গে আমার বেরাদরি, ইয়ারগিরি বহু বৎসরের, তবু খাঁচা থেকে মুক্তি চায় না কোন্ চিড়িয়া? হিন্দুস্তানে আমার জাতভাই কারওর সঙ্গে যদি দেখা হয় তবে আমার এ অবস্থার বর্ণনা করে মুক্তির উপায়টা জেনে নেবেন কি? আর তার প্রতিকূল ব্যবস্থাও যখন আপনি করতে পারবেন, তখন এ সওগাতটা চাওয়া তো কিছু অন্যায়ও নয়।’

সদাগর ভারতবর্ষে এসে মেলা পয়সা কামালেন, সওগাতও কেনা হল, কিন্তু তোতার সওগাতের কথা গেলেন বেবাক ভুলে। মনে পড়ল হঠাৎ একদিন এক বনের ভিতর দিয়ে যাবার সময় একঝাঁক তোতা পাখি দেখে। তখুনি তাদের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বললেন, ‘তোমাদের এক বেরাদর ইরান দেশের খাঁচায় বন্ধ হয়ে দিন কাটাচ্ছে। তার মুক্তির উপায় বলে দিতে পারো?’ কোনও পাখিই খেয়াল করল না সদাগরের কথার দিকে। শুধু দুঃসংবাদটা একটা পাখির বুকে এমনি বাজ হানল যে, সে তৎক্ষণাৎ মরে গিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। সদাগর বিস্তর আপসোস করলেন নিরীহ একটি পাখিকে বেমক্কা বদ-খবর দিয়ে মেরে ফেলার জন্যে। স্থির করলেন, এ মূর্খামি দু বার করবেন না। মনে মনে নিজের গালে ঠাস-ঠাস করে মারলেন গণ্ডা দুই চড়।

বাড়ি ফিরে সদাগর সওগাত বিলোলেন দরাজ হাতে। সবাই খুশি, নিশ্চয়ই ‘জয় হিন্দ্‌’ বলেছিল ব্যাটা-বাচ্চা সবাই। শুধু তোতা গেল ফাঁকি— সদাগর আর ও-ঘরে যান না পাছে তোতা তাঁকে পাকড়ে ধরে সওগাতের জন্য। উঁহুঁ, সেটি হচ্ছে না, ও-খবরটা যে করেই হোক চেপে যেতে হবে।

কিন্তু হলে কী হয়— গোঁপ কামানোর পরও হাত ওঠে অজানাতে চাড়া দেবার জন্য (পরশুরাম উবাচ), বে-খেয়ালে গিয়ে ঢুকে পড়েছেন হঠাৎ একদিন তোতার ঘরে। আর যাবে কোথায়— ‘অস্-সালাম আলাই কুম, ও রহমৎ উল্লাহি, ও বরকত ওহু, আসুন আসুন, আসতে আজ্ঞে হোক। হুজুরের আগমন শুভ হোক’ ইত্যাদি ইত্যাদি, তোতা চেঁচাল।

সদাগর ‘হেঁ হেঁ’ করে গেলেন! মনে মনে বললেন, খেয়েছে!

তোতা আর ঘুঘু এক জিনিস নয় জানি, কিন্তু এ তোতা ঘুঘু। বললে, ‘হুজুর সওগাত?’

সদাগর ফাটা বাঁশের মধ্যিখানে। বলতে পারেন না, চাপতেও পারেন না। তোতা এমনভাবে সদাগরের দিকে তাকায় যেন তিনি বেইমানস্য বেইমান। সওগাতের ওয়াদা দিয়ে গডড্যাম ফক্কিকারি! মানুষ জানোয়ারটা এইরকমই হয় বটে! তওবা, তওবা!

কী আর করেন সদাগর। কথা রাখতেই হয়। দুম করে বলে ফেললেন।

যেই না বলা, তোতাটি ধপ করে পড়ে মরে গেল। তার একটা বেরাদর সেই দূর হিন্দুস্তানে তার দুরবস্থার খবর পেয়ে হার্টফেল করে মারা গেল, এরকম একটা প্রাণঘাতী দুঃসংবাদ শুনলে কার না কলিজা ফেটে যায়?

দিলের দোস্ত তোতাটি মারা যাওয়ায় সদাগর তো হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। ‘হায়, হায়, কী বেকুব, কী বে-আক্কেল আমি। একই ভুল, দু বার করলুম।’ পাগলের মতো মাথা থাবড়ান সদাগর। কিন্তু তখন আর আপসোসে, ফায়দা নেই—ঘোড়া চুরির পর আর আস্তাবলে তালা মেরে কী লভ্য! সদাগর চোখের জল মুছতে মুছতে খাঁচা খুলে তোতাকে বের করে আঙিনায় ছুড়ে ফেললেন।

তখন কী আশ্চর্য, কী কেরামতি! ছুড়ে ফেলতেই তোতা উড়ে বসল গিয়ে বাড়ির ছাদে। সদাগর তাজ্জব— হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন তোতার দিকে। অনেকক্ষণ পরে সম্বিত ফিরে শুধালেন, ‘মানে?’

তোতা এবারে প্যাঁচার মতো গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘হিন্দুস্তানি যে তোতা আমার বদনসিবের খবর পেয়ে মারা যায়, সে কিন্তু আসলে মরেনি। মরার ভান করে আমাকে খবর পাঠাল, আমিও যদি মরার ভান করি, তবে খাঁচা থেকে মুক্তি পাব।’

সদাগর মাথা নিচু করে বললেন, ‘বুঝেছি, কিন্তু বন্ধু, যাবার আগে আমাকে শেষ তত্ত্ব বলে যাও। আর তো তোমাকে পাব না।’

তোতা বললে, ‘মরার আগেই যদি মরতে পারো, তবেই মোক্ষলাভ। মড়ার ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই, মান-অপমান বোধ নেই। সে তখন মুক্ত, সে নির্বাণ মোক্ষ সবই পেয়ে গিয়েছে। মরার আগে মরবার চেষ্টা করো।’

* * *

এই গল্প ভারতবর্ষে বহু পূর্বে এসেছিল। কবীর বলেছেন,

‘ত্যজো অভিমানা শিখো জ্ঞানা
সত্‌গুরু সঙ্গত তরতা হৈ
কহৈঁ কবীর কোই বিরল হংসা
জীবতহী জো মরতা হৈ ॥’

(অভিমান ত্যাগ করে জ্ঞান শেখো, সৎগুরুর সঙ্গ নিলেই ত্রাণ। কবীর বলেন, ‘জীবনেই মৃত্যুলাভ করেছেন, সেরকম হংসসাধক বিরল’)।

আর বাঙলা দেশের লালন ফকিরও বলেছেন,

‘মরার আগে মলে শমন-জ্বালা ঘুচে যায়।
জানগে সে মরা কেমন, মুরশীদ ধরে জানতে হয়।’

1 Comment

এখানে অনেক বানান ভুল আছে। বানানগুলো আরেকবার প্রুফরিড করার অনুরোধ রইলো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *