নীরবতা

দুপুর গলা বাড়িয়ে দেখেছে আমাদের
হৃদয়-পথের জনশূন্যতা,
যেখানে ছায়া মাছের চোখ।
আমাদের দুজনের কথোপকথনের
মুহূর্তগুলো
হাটগামী মানুষের মতো দ্রুতচারী। হঠাৎ মনে পড়ে,
এইতো সেদিন কোদালে ওল্টানো কাঁচা মাটি
আমার আলগা মুঠো থেকে ঝরে মিশে গেল
মাতুলের সদ্য কবরে। কী একটা পাখি
বুকের ভিতরে ডুকিয়ে উঠেছিল। সূর্যাস্তের পরে
ময়ূর নেচে উঠবে এখানে
কলাপ মেলে; আমরা কেউ
থাকবো না। সে দৃশ্যকে নিবিড়
মগ্নতার ধারণ করে শরীরে লাগিয়ে দেবো আগুন।

আবার যখন দেখা হবে, কস্মিনকালেও
সে টের পাবে না কী রকম দগ্ধ হয়েছি, হৃদয় জুড়ে
কত দক্ষযজ্ঞ হয়ে গেছে এরই মধ্যে। আগ্নেয়গিরির লাভা
গা থেকে ঝেড়ে ফেলে আমি যে অসমাপ্ত
কথার খেই ধরতে এসেছি তা বাসা-বদলের
ভাবনার এবড়ো থেবড়ো কিনারে,
তার ধারণার বাইরে। ওর বুকের
ওঠা নামায় আমার কবিতার নিজস্ব ছন্দ খুঁজি।

এ কোন্‌ ঘোড়সওয়ারের হাতের চাবুক আমার পিঠে
বিদ্যুচ্চমক? এই মার থেকে বাঁচার জন্যে
ঝাঁপ দেবো কোন্‌ সরোবরে? আমার হাতের রক্তভেজা
ছাপ তার হৃদয়ে রাখতে চাই না। এভাবে
দিন চলে যেতে থাক শরীর টেনে টেনে।
আমিও যাবো দিগন্ত চিরে, আবার ফিরে এসে
তার মুখোমুখি বসবো। সে মুখ লুকাবে
ফুলের পাপড়িতে। যৌবনের ঘ্রাণে আমি উন্মাতাল।
আমাদের দুজনের কথোপকথনে
ছায়া ফেলে মিরোস্লাভ হোলুবের প্রতি-কবিতা,
বাংলাদেশের রাজনীতির গতিধারা, সড়কদ্বীপের
কবি সম্মেলন আর সোভিয়েত ইউনিয়নে
পাস্তারনাকের উজ্জ্বল পুনর্বাসন আর খাঁচায় পোরা
জ্বলজ্বলে কালো বাঘের মতো
নেলসন ম্যাণ্ডেলার জেগে-থাকা
বন্দি জীবন। আমাদের কথোপকথনের ফাঁকে
যখন আমার অধীর চুম্বনে
ওর দম বন্ধ হয়ে আসে, তখন সে নিজকে
এক ঝটকায় আলিঙ্গন থেকে সরে দাঁড়িয়ে
বলে পাগল হলে না কি? পিছন থেকে
জড়িয়ে ধরে বলি, তোমাকে ছাড়া সুস্থ থাকার ইচ্ছে নেই।
এজন্যেই জরা আর ক্ষয়ের কামড়
বেমালুম ভুলে যৌবনের আঁচল
নিয়ে খেলতে খেলতে
হাসতে গিয়ে কাঁদি, কাঁদার সময়ে হেসে ফেলি। ওকে ঘিরে
যে লৌহ যবনিকা তাকে আমি কখন ভেঙ্গে ফেলবো?

আমার দিকে সে এভাবে তাকায়, যেন এই
তাকানো অন্য কারো
প্রাপ্য নয়। এই দৃষ্টির রশ্মি বেয়ে বহু শতাব্দীর
মায়া আমার বুকের ভেতর
ঘুরে দাঁড়ায় আবার কখনো কখনো
সে এমন হাসি উপহার দেয়,
যা আমাকে মদির মতিচ্ছন্নতায়
খানিক ডুবিয়ে মৃত্যুর কব্জা থেকে
দূরে সরাসরি স্বপ্নময় যৌবনে সাজিয়ে হাত ধরে।
বেড়াতে নিয়ে যায়
সমুদ্র তীরে। খুব কাছে এসে আবার
ছিটকে চলে যায়, যেন শিলাখণ্ডে আছড়ে-পড়া ঢেউ।
আমি কি বুঝিনা ভবিষ্যতের
আনন্দের জন্যে এখন আমার চোখের নিচে ভেজা ছাপ?
আমার হৃদয়ে কবিতার নবজন্ম হবে বলেই
আমাদের কথোপকথনের চৌদিকে এই থমথমে নীরবতা?