1 of 2

চিলেকোঠার সেপাই – ৩২

চিলেকোঠার সেপাই – ৩২

বিপুল সংখ্যক ঘোড়ার সমবেত ডাক শুনে আনোয়ারের ঘুম ভাঙে, মনে হয় নৌকার ওপর সে শুয়ে রয়েছে, নদীর ভেতরকার অপরিচিত কোনো আওয়াজে নৌকা দুলছে। ভালোভাবে চোখ মেললে ভুলটা ভাঙে। কোথায় যেন অনেক লোক একসঙ্গে কথা বলছে। কারা? বেলা কি অনেক হয়ে গেছে? মন্টু আজ আগেই উঠে পড়েছে, হঠাৎ ওর এতো সুমতি? আনোয়ার বরং আরেকটু ঘুমিয়ে নেবে। চোখ বন্ধ করতে না করতে একটা মোটা গলা সশব্দ ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ে কানের ওপর, আরে আছে, এটি আছে! নিজের বাড়ি বাদ দিলে তামাম গাওয়ের মদ্যে তার থাকার জায়গা এই বাড়ি ছাড়া আর কোটে আছে গো?
আনোয়ারের মাথা থেকে ঘুমের শেষ তলানিটুকু পর্যন্ত উৰে যায়। বুক ধক করে ওঠে, খয়বার গাজী কোথায়?—পাশে চাদর ঠাণ্ডা, পায়ের কাছে এলোমেলো গোটানো লেপ, সেটাও ঠাণ্ডা। মানে অনেকক্ষণ আগেই সে চলে গেছে। টেবিলে হ্যারিকেন নেভানো। বাইরের দিককার দরজা বন্ধ। ভেতরের বারান্দায় যাবার দরজা দ্যাখার জন্য আনোয়ার উঠে বসলো। দরজা খোলা। কখন খুললো?—শকুনটা এই দরজা দিয়ে উড়ে গেছে। আনোয়ারের এভাবে ঘুমিয়ে পড়াটা মোটেই ঠিক হয়নি। চেংটু, করমালি, বান্দু শেখ, কানা মন্তাজ-এদের কাছে সে কি কৈফিয়ৎ দেবে? আলিবক্স তো মনে হয় তার বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আনবে।
‘খয়বার গাজীক বার করা দ্যাও। বাইরের সমবেত মানুষের চিৎকার ক্রমে স্পষ্ট হয়, কুত্তার বাচ্চা এটি আছে!’
‘বার হ শালা, গোরুচোরের সর্দার বার হয় আয়! তোর গোয়ার মদ্যে আছেলা বাঁশ সান্দায়া দেওয়া হবো, বারা!
আনোয়ার হয়তো এরকমই চাইছিলো। কিন্তু সত্যি সত্যি এরকম হলে তার করার কি আছে তা বুঝতে পাচ্ছে না।
বড়োচাচা এসে বসলো আনোয়ারের খাটে। চোখেমুখ নিদ্রাহীনতার ছাপ। এলোমেলো চুল। চাপা গলায় বলে, অনেক মানুষ। একশো দেড়শোর কম নয়। সব চরের মানুষ। চরুয়ারা ডাকাতি ছাড়া কিছু বোঝে না। ফেরোশাস পিপল! কি করি এখন?
আনোয়ার জিগ্যেস করে, খয়বার চাচা কোথায়? কি জানি?’ বড়োচাচা, খয়বার গাজী সায়েবকে না পেলে এরা যাবে না। কোথায় গেছে? ‘জানি না বাবা। ‘ঘর থেকে বেরিয়েছে ভেতরের দরজা খুলে। আপনি বুঝতেই পারলেন না? আনোয়ারের কথার আঁচে বড়োচাচাও উত্তপ্ত হয়, তোমার পাশেই তো শুয়েছিলো, তুমি টের পেলে না?
এই বাড়ির লোকজনের সাহায্য ছাড়া খয়বার গাজী বেরুতেই পারে না। তার মানে আনোয়ারের ওপর এদের আস্থা নাই; থাকলে তাকে না জানিয়ে খয়বারকে পার করে দেয়? এদের অবিশ্বাস অর্জনকে কৃতিত্ব বলে ধরে নিয়ে আনোয়ার তৃপ্তি পায়; এরা বুঝতে পেরেছে যে আনোয়ার আসলে এদের লোক নয়, সে আছে প্রতিপক্ষের সঙ্গে। এই তৃপ্তি তার রাগের উত্তেজিত স্তরটাকে মুছে ফেলে, পরিণত ও অভিজ্ঞ স্বরে সে জানতে চায়, লোকজন বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়লে কি করবেন?
‘চুকলে তো কাউকে রেহাই দেবে না বড়োচাচ ভয়ে কাপছে, কাপুনির ফলে তার কথা সোজাসুজি বেরুতে পারে না।
ওদিকে সমবেত ধ্বনি ক্রমে উচ্চকণ্ঠ হয়। বড়েচাচার সঙ্গে আনোয়ার নাশতা খাচ্ছে, মন্টু এসে বলে ২৫/৩০ জন লোক ভাঙা দালানের স্তুপে ওঠার চেষ্টা করায় ইট চুন সুরকি সব গড়িয়ে নিচে ছড়িয়ে পড়েছে, এমনকি ওখান থেকে গড়িয়ে পড়ায় একজনের পা পর্যন্ত ভেঙে গেছে। কয়েকজন এসে দাঁড়িয়ে রয়েছে খরগাদার সামনে। আনোয়ার অবাক হয়ে ভাবে লোকজন এখন পর্যন্ত ভেতরে হামলা করে না কেন? একি তাদের ভয়? না বিবেচনাবোধ?
ধীর লয়ে ও নিচু গলায় বড়োচাচী অভিযোগ করে, খয়বার মিয়া মানুষ সোজা নয়। গোলপুকুরের বারো আনা মাছ যায় রশিদের ভোগে। রশিদকে উস্কানি দেয় কে? খয়বার গাজী নিজে। মহিলার মৃদুস্বরের বিলাপ অব্যাহত থাকে। আনোয়ারের বাপচাচার আপন চাচাতো ভাই এই রশিদ মিয়া। তার বাপ মরেছে তার দাদা বেঁচে থাকতে। সে সম্পত্তি পায় কোন আইনে? অথচ, খয়বারের প্ররোচনায় পড়ে নিজের রক্তের সম্পর্কের ভাইদের হেনস্থা করার মতো ফন্দিই সে করে।—দাখো না বাবা, এই খয়বার মিয়ার জন্যে চর এলাকায় আমাদের কোনো জমি উঠলে আমরা তার দখল পাই না, যমুনার মদ্যে কোনো জমি উঠলেই ভোগ করবে খয়বার মিয়া! জমি দখলের ব্যাপারটা আগে একচেটিয়া ছিলো আনোয়ারের দাদা এবং দাদার বাপের। শ্বশুরবংশের হাত থেকে কাজটা ফসকে গেছে বলে বড়োচাচীর আক্ষেপের আর শেষ নাই। বড়োচাচীর চরিত্র বিশ্লেষণ অবশ্য বস্তুনিষ্ঠ। খয়বার গাজীর ভালো দিকটাও তার ক্ষোভের অন্তর্গত হয়। যেমন, মানুষটার একটা বড়ো গুণ, আত্মীয়স্বজন কারো অসুখবিসুখ হলে জান দিয়া খাটে। তোমার বড়োচাচার যেবার নিমুনিয়া হলো, ডাক্তার ডাকা, ওষুধ নিয়া আসা থাকা শুরু করা ঘড়ি ঘড়ি অ্যাসা ওষুধ-পত্র খিলানসব করছে এই খয়বার মিয়া। এরই মধ্যে বেলীকে দিয়ে বড়োচাচী হামানদিস্তায় পান ছেঁচে নেয়, পান খায় এবং আঙুলে চুন নিয়ে জিভে ঘষে। আত্মীয়স্বজনের মদ্যে তাই সহ্য করবার পারে না খালি জালাল মিয়াক। তাই সামনে না থাকলে তাক কয় ঘর-জামাই। আর সামনে থাকলে খালি ঠ্যাঙামারা কথা। আবার দ্যাখো, আল্লার কি কাম, জালাল মিয়া না হলে এতোক্ষণ তার জান থাকে? রাতে জালাল মিয়া না আসলে—।’
আনোয়ার এবার ব্যাপারটা বুঝতে পারে। জালাল ফুপা এসেছিলেন? কখন? কতো রাত্রে?
ফজরের আজান পড়ার আগেই আসছিলো। নাদুর কাছে খবর পায়া নিজে আসছে।’ বাইরে যাবার জন্যে আনোয়ার এবার উঠে পড়ে। বড়োচাচা আস্তে করে ডাকে, ‘আনু, বাবা, খয়বার গাজী হাজার হলেও এই এলাকার একটা মাথা। আমাদের আত্মীয়। তোমার বাপের খুব বাল্যকালের বন্ধু। কথাটা মনে রাখবা। শোনো—।
আনোয়ার আর দাঁড়ায় না। বাইরে এতো লোক আনোয়ারের পা একটু কাপে, এরা তাকেও তো ধরতে পারে। ভাঙা দালানের স্তুপের সামনে সে পৌঁছতে কয়েকজন এসে তাকে ঘিরে দাঁড়ায়, ক্যাগে? বড়োমানষের ব্যাটা! আসামী কোটে? তার কোটে নুকা খুছেন?
সরো, সরো! তোমরা কার সাথে কি কও?’ কানা মন্তাজ দৌড়ে এসে সবাইকে সরিয়ে দেয়, মানুষ না চিনা আও করো? হামাগোরে নিজেগোরে মানুষ। কানা মন্তাজ তাকে নিজেদের মানুষ বলে পরিচিত করায় আনোয়ার অভিভূত হয়ে তার পিঠে হাত রেখে তাকে কাছে টেনে দেয়, চেংটু কোথায়? করমালি কোথায়?
চেন্টু একটা খাচা নিয়া গেছে চন্দনদহ বাজার। খাচার মদে আফসার গাজীকে ধরা আনবো। অনেক মানুষ গেলো, চেংটু কয়, হামি না থাকলে শালাক বক্তাই ককবর দিবো। করমালি সম্বন্ধে খবর দেওয়ার আগেই ওরা এসে পড়ে করমালির সামনে। করমালি বসেছিলো কাঁঠালতলায়, মাটির সঙ্গে বাঁশের খুঁটি দিয়ে গাথা কাঠের বেঞ্চ, বেঞ্চের ঠিক পাশে, খুঁটির সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে। তার বা পা ভাঁজ করা, ডান পা মাটিতে ছড়ানো। ডান পায়ের লুঙিউরু পর্যন্ত গোটানো। ঐ পায়ে হাঁটু পর্যন্ত বড়ো বড়ো ৩/৪ টে ফোস্কা, কয়েকটা জায়গায় ফোস্কা ফেটে লাল দগদগে ঘা।
এ কি? করমালি পা পুড়ে গেছে? ‘পুড়া গেলো ভাইজান। বড়ো বড়ো দাঁতে করমালি হাসতে চেষ্টা করলেও লাল লাল চোখ ও দাত-চাপা ঠোঁটের বেড়িয়ে-পড়া অংশে তার কষ্ট আড়াল করতে পারে না। বান্দু শেখ বলে, হোসেন ফকির ধাক্কা দিয়া আগুনের মদ্যে ফালায়া দিছিলো।
হামিও ছাড়ি নাই। করমালি হাত দিয়ে তার পাদ্যাখায়, এই পাওদিয়াই শালাক লাথি দিয়া আগুনের মদ্যে ফালায়া দিছি। তারপরে সোগলি মিল্যা বাশ দিয়া কোবান দিতে দিতে শালার জান কবচ করা হলো।
করমালির গোঙানি চলতে থাকে, কয়েকজন চিৎকার করে, কৈ? ঐ খানদানি শয়তান কোটে? শালা কোটে সটকালো?
আপনারা কয়েকজন আমার সঙ্গে আসেন। আনোয়ার এদিক ওদিন তাকিয়ে কানা মন্তাজকে ডাকে, মন্তাঞ্জ এসো, বান্দু চলো। করমালি তুমি বরং বাড়ি যাও, এই পানিয়ে ঘোরাঘুরি করো না। একটু থেমে শক্তি সঞ্চয় করে প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সবাইকে নির্দেশ দেয়, চলেন। বেশি চ্যাচাবেন না। খয়বার গাজী আছে জালাল মাস্টার সায়েবের বাড়ি।
করমালি চমকে ওঠে, মাস্টার সায়েবের বাড়ি? মনে হচ্ছে তার জ্যাঠার মৃতদেহ দেখতে না পারার বেদনা বা তার পায়ের আঙুল থেকে হাঁটু পর্যন্ত পুড়ে যাওয়ার কষ্ট মান হয়ে গেছে, ‘না ভাইজান, তার বাড়িতে যাওয়া যাবো না।’
সমবেত মানুষ গর্জন করে, কিসক? করমালি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আনোয়ার বলে, কেন?
না, তাই মানুষটা বড়ো সিধা গো বিপদে আপদে হামাগোরে সাথে সাথে থাকে। তার বাড়িতে যায়া হামলা করাটা—।
জালাল মাস্টার সায়েব কেমন লোক সেটা আমাদের দাখার কথা নয়। তার বাড়িতে এক শয়তানকে তিনি আশ্রয় দিয়েছেন, সুতরাং—।’ আনোয়ারের এই কথা ছাপিয়ে ওঠে একটি ভাঙা গলার বাক্য, আমরা তো তার কোনো লোকসান করতিছি না। খয়বার মিয়াক নিয়া আমরা চলা আসমু। না কি কন আনোয়ার ভাই?
আলিবক্সকে সামনে রেখে এসে কথা বলতে দেখে আনোয়ারের বুকে ছোটো ১টি কাটা বাধে, এখন বোঝা যাচ্ছে যে এই লোকটির জন্যই এতোগুলো মানুষ সংগঠিতভাবে ঘোরফেরা করছে, হঠাৎ খেপে গিয়ে আনোয়ারদের বাড়ির ভেতর হামলা করেনি। এখন আনোয়ারের বিশেষ কি আর করার রইলো? তবে সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা হাল্কা হয়, আলিবক্স থাকলে ঝামেলা অনেক এড়ানো যায়।

আনোয়ার, বাবা তুমি আকবর ভাইজানের পুত্র হয়া, নিজে একজন উচ্চশিক্ষিত সুবিবেচক অধ্যাপক হওয়া সত্ত্বেও নিজের মানুষের সর্বনাশ করতে আসছো? জালালউদিনের মিনতির জবাবে একটি নির্লিপ্ত চেহারা তৈরি করার জন্যে আনোয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে, আমার নিজের মানুষ কে? চোর-ডাকাত-রক্ত-চোষারা আমার নিজের মানুষ হতে পারে না।
খয়বার গাজী বসেছিলো মাথা নিচু করে। তার হাতের সিগ্রেটের মাথায় ছাই জমেছে আধ ইঞ্চিরও বেশি, যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। আনোয়ারের জবাব শুনে ছাই ঝেড়ে সিগ্রেটে সে খুব জোরে টান দেয়, সিগ্রেটের আগুনে আঁচ তার চোখে ঝিলিক দিয়ে উঠে। কিন্তু তার কথায় সেই আঁচ টের পাওয়া যায় না বাবা, যারা নিজেদের মানুষ, তারা নিজেদেরই থাকে। বাপদাদার রক্ত শরীর থ্যাক বার করা দিবার পারো? আনোয়ার জানে বাপদাদার রক্ত শরীর থেকে নিষ্কাশন করা অসম্ভব। কিন্তু খয়বার গাজী বলো আর তার নিজের বাপদাদা বলো—, তারা কতোদিন আগে কিভাবে স্বতন্ত্র রক্তপ্রবাহ তৈরি করলা? একটি প্রবল ভূমিকম্পে ব্ৰহ্মপুত্রের মূল গতিপ্রবাহ পরিবর্তিত হয়। সবার থেকে আলাদা হওয়ার জন্যে তাদের ভূমিকম্পটা ঘটলো কবে?—এসব কথা বলার সময় এখানে নাই। আনোয়ার আরো কঠিন হওয়ার চেষ্টা করে, আপনি হুকুম দিয়ে কতো মানুষ মেরে ফেলেছেন তার হিসাব এই এলাকার অনেকেই জানে। আপনি কয়েক হাজার গোরু চুরি করিয়ে বাথান বানিয়ে রেখেছেন। জমির লোভে আপনি কতো লোককে পথে বসিয়েছেন। আপনি— ’
জমি থাকলেই জমির সখ থাকে বাবা। তোমার বড়োচাচাক জিগ্যাস করা দেখো, তোমার দাদা পরদাদার জমির হাউস কিরকম আছিলো। সিগ্রেট হাতে খয়বার গাজী উঠে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকালে আলিবক্স বলে, গাজীসায়েব, পলাবার চেষ্টা করলে কিন্তু আপনারই লোকসান। এই বাড়ির চার দিকে মানুষ মোতায়েন করা আছে।
‘উনাকে নিয়ে আপনারা কোথায় যাত্রা করবেন? জালাল মাস্টার জানতে চাইলে আলিবক্স হাসিমুখে জবাব দেয়, আপনিও সঙ্গে চলেন না। কাছেই, আপনাগোরে এলাকার মধ্যেই।’
খয়বার গাজী কিন্তু আলিবক্সের দিকে ফিরেও দ্যাখে না। সে সম্বোধন করে জালালউদ্দিনকে, আমি ভয় পাই না। আনোয়ার আছে, যতোই পাগলামি করুক, রক্তের সম্পর্ক তো একটা আছে। ভদরলোকের ঘরের শিক্ষিত ছেলে, চাচার সাথে কতো পাষাণ হবার পারে? জীবনে অন্যায় করি নাই। আমার আল্লা ভরসা।’
দরজার বাইরে এসে খয়বার গাজী থমকে দাঁড়ায়। আনোয়ার কিংবা আল্লার শরণাপন্ন হওয়া থেকে বিরত হয়ে সে তাকায় আলিবক্সের দিকে, বাবা আমি কি দোষ করলাম? চরের মধ্যে কে কি করে, আমার কি দোষ? বুড়া বয়সে আমাক বেইজ্জত করেন কেন?
আলিবক্স আস্তে করে হাত রেখে খয়বারের পিঠে, ভয় পান কেন? আজ আপনার বিচার হবো। বিচারে নির্দোষ প্রমাণিত হলে আপনাক আমরা ইজ্জত করা বাড়ি পৌছাইয়া দিমু| সে ডান হাত দিয়ে খয়বারের বাম হাত ধরে সামনে পা বাড়ায়।
জালালউদিনের বাড়ির বাইরে রাস্তার ধারে মস্ত বড়ো একটা বাশের খাচা। এটা কখন এলো? আলিবক্স বলে, আফসার গাজীকে পাওয়া যায় নাই।’
এর মধ্যে জালাল মাস্টারের বাড়ির সামনে লোকজনের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। খয়বার গাজীকে দেখে সবাই হঠাৎ চুপ করে। তাকে নিয়ে রাস্তায় নামলে কে যেন চিৎকার করে উঠে, শালাক ঐ খাচার মধ্যে তোলো।
চারদিক থেকে এই সমর্থন পাওয়া যায়, তোলো! তোলো!
শালা খানদানী শয়তান গো! বাচার মদ্যে তুল্য জুতা দিয়া সালাম করে।’
আলিবক্স হাত তোলে, দরকার নাই। গাজী সায়েবের বিচার হবো। এখন ইনার শরীলে কেউ হাত দিবা না কলাম।—কৈ চেংটু কৈ?
‘চেংটু গেছে বৈরাগীর ভিটা। জায়গা ঠিক করবার গেছে। বিচার হবো বটগাছের নিচে।
‘খাঁচটা পেলেন কোথায়? আনোয়ারের কৌতুহল দেখে আলিবক্স হাসে, আর বলবেন না, আমাগোরে গায়ের চ্যাংড়াপ্যাংড়ার বুদ্ধি। এর মধ্যে সিন্দুরিয়ার বিডি মেম্বর কাঁদের মণ্ডলেক ধর্যা নিয়া আসছে!’
খাচার ভেতর?
হুঁ! আলিবক্স হাসতে হাসতে বলে যে সিন্দুরিয়ার মৌলিক গণতন্ত্রী আবদুল কাঁদের মণ্ডল মাদারগঞ্জ থানার গোরুচুরির ব্যাপারে হোসেন আলির প্রধান প্রতিনিধি। এ ছাড়া গত আকালের সময় সে এবং তার ছেলে একেকজন চাষাকে ২০ সের ৩০ সের ধান দিয়ে তাদের সর্বস্ব লিখিয়ে নিয়েছে। পরে এই নিয়ে একটু কথাবার্তা বললে ২জনকে সে মেরেও ফেলেছে। তা এইবার লোকটা পড়েছে বেকায়দায়। এই খাচায় করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ডাকাত-মারা চরে। খাচা দেখে চেংটু আবদার করে, এই খাচা তাদের চাই, এর ভেতর ঢোকানো হবে আফসার গাজীকে।
তা আপনাদের ঐ মেম্বরের কি হলো?
আনোয়ারের প্রশ্নের দিকে আলিবক্সের মনোযোগ নাই, আফসার গাজী মনে হয় পলায়া বগুড়ার দিকে গেছে।
‘ঐ মেম্বরের কি হলো, বললেন না?
আফসার গাজীকে ধরবার পারলে কাম হতো। ঐটা ধুরন্ধর শয়তান। বগুড়া থাকা ঢাকাত যাবো, ঢাকাত যায়া একটা ষড়যন্ত্র পাকায়া আসবো।’
আনোয়ার এবার অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে, আরে, সিন্দুরিয়ার মেম্বরকে নিয়ে কি করলেন?
ও হ্যাঁ। আলিবক্সের হঠাৎ মনে পড়ে, সিন্দুরিয়া প্রাইমারী ইস্কুলের মাঠে গণ-আদালতে কাঁদের মণ্ডলের মৃত্যু হইলো। খাচার মধ্যে ভইরা ঐটারে নিয়া গেলাম ডাকাত-মারা চর। ঐ আদালতের রায়ে হোসেন আলিরও মৃত্যুদণ্ড হয়। হোসেন আলির বাথানে আগুন ধরাইয়া দুইটারে একসাথে ফালাইয়া দেওয়া হইলো।’
‘মরে গেছে?
মরবো না? আগুনের মদ্যে ফালায়া চার ঘণ্টা বাদে দুইজনেক আলাদা চেনা যায় না। পুড়া অঙার। ধ্যাবড়া পায়ে জোরে জোরে কদম ফেলে আলিবক্স, তাড়াতাড়ি করেন। সমান তালে পা ফেলতে খয়বার গাজীকে একটু বেগ পেতে হয়। গ্রামের রাস্তায় অনভ্যস্ত পায়ে জোর কদম ফেলতে আনোয়ারেরও একটু অসুবিধা হয় বৈকি। তবে একটু চেষ্টা করে সে বেশ তাড়াতাড়ি হাঁটে। তার সামনে ও পেছনে অনেক মানুষ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *