1 of 2

চিলেকোঠার সেপাই – ১৫

চিলেকোঠার সেপাই – ১৫

আনোয়ারদের বাড়ির বাইরে কাঁঠালতলায় কাঠের বেঞ্চ। বেঞ্চের পাশে মাটিতে হাঁটু ভেঙ্গে বসে নাদু পরামাণিক হুকাটানছিলো। ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় তার দাড়ি অরো এবড়োখেবড়ো এবং এলোমেলো হয়ে গেছে। ওদের দুজনের দিকে একবার তাকিয়ে সে ফের হুকা টানে এবং বেশি ধোঁয়া গলগল করে বেরিয়ে ওর মুখকে ক্রমে অস্পষ্ট ও নির্বিকার করে ফেলে। অথচ নাদু কিন্তু এদেরই প্রতীক্ষা করছিলো অনেকক্ষণ ধরে।
আনোয়ার জিগ্যেস করে, আপনি এখনো অপেক্ষা করছেন? নাদু তার দিকে তাকায়। ধোঁয়ামুক্ত হলে নাদুর লাল ও ভোতা চোখের রঙ স্পষ্ট হয়, কিন্তু তাতেও তার ব্যাকুলতা ফোটে না।
কাঁঠালতলায় পশ্চিমে ভাঙা দালানের স্তুপের আড়ালে লুকোচুরি খেলা স্থগিত রেখে বড়োচাচার ছোটো মেয়ে রোজী এসে বলে, আনু ভাই, নাশতা খাবেন না? আম্মা ডাকে।
বেঞ্চে বসতে বসতে জালাল মাস্টার বলে, যাও তোমার চাচীর সাথে সাক্ষাৎ করা আসো। ভেতর বাড়ির দিকে যেতে যেতে আনোয়ার নাদুর মৃদুকণ্ঠ শুনতে পায়, কি কয়।

বিকালবেলা বোঝা যায় যে, নাদুর মেজো ছেলেটা একটু বেয়াদবই বটে। ছেঁড়া বাপের স্বভাব তো পায়ইনি, কিন্তু খয়বার গাজী সম্পর্কে মাঝে মাঝে মন্তব্য যা করে তাতে তার বাপ তো
বটেই, জালাল মাস্টারেরই বুক কেঁপে ওঠে। শেষ পর্যন্ত আনোয়ারকে দেখিয়ে জালাল মাস্টার বলে, এই চ্যাংড়ার পরামর্শে কর্ণপাত করবি তো? কথা কম কলে কি হয়, ঢাকাত যতো আন্দোলন হবা নাগছে, যতো সংগ্রাম—সব কয়টার সাথে আছে। তুই খালি পুটি মাছের লাকান লক্ষঝলপ করিস, এই চ্যাংড়াকে দাখ তো! কথাবার্তা শুন্যা বোঝা যায় যে, ঢাকা থেকে একজন নেতা মানুষের আগমন হছে?
আনোয়ার কোন আন্দোলনের নেতা নয়, কিন্তু জালাল মাস্টারের কথার প্রতিবাদ করলে বেচারা একটু বিব্রত হতে পারে। চেন্টু আনোয়ারের দিকে একবার তাকায়, চেন্টুর চোখ বেশ স্বচ্ছ, রাগ কি ঘৃণা থেকে সেগুলো মুক্ত। কিন্তু অন্যদিকে তাকিয়ে কথা বলতে শুরু করামাত্র তার চোখজোড়া ছোটো হয়ে যায়, আস্তে আস্তে সে বলে, ‘খয়বার গাজী হামাক ঘরত তুলা বন্দুক বার করবো। দোনলা, একনলা, আইফেল, পিস্তল-ব্যামাক কয়টা তাই শান দিয়া খুছে, হামাগোরে উপরে একচেটি নিবো। ঐ খুনীর সর্দারের কাছ যায় কোন শালা? হামি অর ভাত খাই, নাউই হামাক জর্ম দিছে? আর কাছে হামার কিসের ঠ্যাকা?
জালাল মাস্টার রাগ করে, শালা মূৰ্খ কোথাকার! গণ্ডমূর্খ। অশিক্ষিত ভূত। কুবাক্য না কলে শালার মুখ থাকা বায়ু নির্গত হয় না!
নাদুর সেই ঔদাসীন্য কেটে গেছে, মাঝে মাঝে লাফ দিয়ে ছেলের কাছে যায়, চিৎকার করে বলে, আজ তোরই একদিন, কি হামারই একদিন হামি নিজে তোক জবো করমু। মুন্সি লাগবো না, আল্লাহু আকবার কয়া তোর গলাত ছুরি দিমু! একটু হাপাবার পর ফের শক্তিসঞ্চয় করে সে চূড়ান্ত সংকল্প ঘোষণা করে, তোক জবো না করা আজ হামি মুখোত ভাত তুলমু না!
চেংটু জিগ্যেস করে, ভাত তোমার ঘরোতে উথলাচ্ছে? হামাক জবো করলে মিয়ারা তোমাক ভাগের ধান বেশি দিবো? আনোয়ারের পরিবারের প্রতি কটাক্ষ করায় নাদুর পক্ষে রাগ সামলানো আর সম্ভব হয় না। লাফিয়ে এসে ছেলের কাকড়া চুলের ঝুঁটি ধরে ধরে কাকায়। তার নিজের রুক্ষ দাড়ি, বড়ো মোটা নাক ও ভোতা লাল চোখজোড়ায় ছোটোবড়ো ঢেউ উঠতে থাকে। চেন্টু কিছুক্ষণ সহ্য করে, তারপর সামান্য একটু চেষ্টাতেই বাপের মুঠি থেকে নিজের কেশরাশি মুক্ত করে। মাথা ঝাকিয়ে চুল পেছনে ফেলে বাপকে সে ধমক দেয়, অতো নাফ পাড়ো কিসক? পিঠত বিষ সুলক্যা উঠবো না? ঘরোত তোমার মালিস করার তাল আছে এক ছটাক? অতো নাফ পাড়ো কিসক?
চেংটুর এই উক্তিতে তার বাবার পিঠের ডানদিককার ব্যাথার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অনেকদিনের ব্যথা। বহুকাল আগে গোয়ালঘরে ধোঁয়া দিতে গিয়ে ধোঁয়া না দিয়ে নাদু ঘুমিয়ে পড়ায় আনোয়ারের দাদাজীর খুব রাগ হয়েছিলো। সে কি আজকের কথা? নাদুর বয়স তখন ১০/১১ বছর, মিয়াদের বাড়িতে ফাই ফরমাস খাটে, কিষানদের পান্তা নিয়ে ভাত নিয়ে জমিতে যায়, সকালবেলা গোয়াল থেকে গোরু-বাছুর বার করে, সন্ধ্যাবেলা গোয়ালঘরে ধোঁয়া দেয়। তো সেদিন বড়োমিয়ার বড়ো মেয়ের বিয়ে কি পানচিনির উৎসব। সারাটা দিন সবারই খুব ছোটাছুটির মধ্যে কাটে। সন্ধ্যার পর গোয়ালঘরে ধোঁয়া দিতে গেছে নাদু। গোয়ালঘরের পাশেই একটা পীতরাজ গাছের কাটা গুড়ি। আগুন-ধূপের মালসা পাশে রেখে ঐ কাঠের গুড়ির পাশে শুয়ে নাদু ঘুমিয়ে পড়ে। ঐ সময় ওখানে বড়োমিয়ার যাওয়ার কথা নয়। কেন গিয়েছিলো আল্লাই জানে! মনে হয় মেয়ের জন্যে আড়ালে একটু চোখের পানি ফেলার জন্যে জায়গাটা নিরাপদ ছিলো। গোয়ালঘরে মশার কামড়ে ছটফট-করা গোরুদের দেখে বড়োমিয়া আর সহ্য করতে পারেনি। তার কাঠের খড়ম-পরা পা দিয়ে নাদুর পিঠে বড়োমিয়া এ্যাঁয়সা ১লাথি দিয়েছিলো যে, মাস দুয়েক সে আর পিঠ তুলতে পারেনি। আজ বুড়ো হয়ে মরতে বসেছে নাদু, তার সেই ব্যথা আজো তাকে ছেড়ে গেলো না। একটু আঘাত পেলে, পূর্ণিমায় অমাবস্যায়, অসময়ে বৃষ্টি হলে কি শীত পড়লে ব্যথাটা উসকে ওঠে। এ ঘটনা এখানকার প্রায় সবাই জানে। বড়োমিয়া নিজেও ২/১ বার বলেছে। আর নাদুর খুব প্রিয় প্রসঙ্গের মধ্যে এটি ১টি। ঘটনাটি বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলতো, নিন্দের মধ্যে খাব দেখবা নাগছি। কি? না, পাতারের মদ্যে গোরু খুঁজা বেড়াই। ধলা বকনাখান গো, বড়োমিয়ার খুব হাউসের বকনা, সেই বকনাক আর পাই না। ঘড়ি বাদ দেখি, পাতারের উত্তরে মস্ত বড়ো পিপুল গাছটার তলাত খাড়া হয় আছি,-ঝড় নাই, পানি নাই, মোটা একখান পিপুলের ডাল ভাঙা পড়লো হামার পিঠোত। ইটা কি বাবা চ্যাতন পায়া দেখি কোটে পাতার? কোটে পিপুলের ডাল? বড়োমিয়ার বোলআলা খড়মখান পিঠের উপরে। ঘটনাটা সে এমনভাবে বলতো যেন ঘুম ভাঙার পরেও সে স্বপ্লের মধ্যেই ছিলো। এই ব্যথাটিকে নাদু কতোদিন থেকে পুষে আসছে। মিছে কথা বলে লাভ কি? ব্যথাটাকে মূলধন করে বড়োমিয়ার করুণা সে কম আদায় করেনি। এই ব্যথা সারাবার জন্যে বড়োমিয়ার খরচ হয়েছে মেলা, কিন্তু বড়ো কথা হলো এই যে, ব্যথাটা ছিলো বড়োমিয়া ও তার মধ্যেকার সম্পর্কের প্রকাশ। যখনি তার ছটাইয়ের প্রশ্ন আসতে কিংবা ভিটা থেকে উচ্ছেদের সম্ভাবনা দ্যাখ্যা দিতো কি তার কাছ থেকে বর্গাজমি ছড়িয়ে নেওয়ার কথা উঠতো নাদু তখন উসকে তুলতো এই ব্যথাটিকে। বড়োমিয়া আস্তে আস্তে বলতো, থাকা কতোদিনের চাকর অর বাপও কাম করা গেছে। থাকা আহা, নাদুর দেহে বড়োমিয়ার এই চিরস্থায়ী স্পর্শ কি যেন তেন সম্পর্ক হলো? বড়োমিয়া মারা গেলে লাশের পাশে বসে নাদু কাঁদতে কাঁদতে বিলাপ করছিলো, তোমার নথি হামার পিঠোতেই থাকলো গো বড়োমিয়া, তুমি কেটে চলা গেলা
কিন্তু এই লাথির মর্যাদা চেন্টু বুঝবে কোথেকে? বাপের হাতের রেঞ্জের বাইরে দাঁড়িয়ে সে বলে, পিঠতো ভাঙছে একজন, এখন বাকি আছে বুকখান। তুমি গাজীগোরে ঘরত যাও, খয়বার মিয়ার পাও আছে দুইখান, বুকখানা পাতা দিও, খাম করা দিবো বলতে বলতে সে চারদিকে একবার তাকায়, তারপর অপেক্ষাকৃত নিচু গলায় বলে, নথিগুড়ি যা খাবার চাও তাড়াতাড়ি খায় আসো। কুনদিন যায়া শুনবা ব্যাটার দুটা ঠাই ভাঙা দিছে, তখন নাথি দিবো কি দিয়া?
আশেপাশের সবাই একেবারে চুপ। জালাল মাস্টার এই নীরবতা ভাঙে, চেন্টু, মুখ সামলা। বিবেচনা করা কথা কোস! তোর ভাগ্যে কি যে আছে চিন্তা করলেও ভয় লাগে।
এর মধ্যে লোকও জমে গেছে। বেশির ভাগ চাষাভূষা মানুষ, মিয়াবাড়ির আলুর জমির কাজ সেরে কিংবা ধান মাড়াইয়ের কাজ করতে এসে জমায়েত হয়েছে। মিয়াবাড়ির ছেলে আছে কয়েকজন। এদের কেউ কেউ স্কুলে পড়ে। চাষা বা ভদ্রলোক সবাই চুপ করে জালাল মাস্টারের সতর্কবাণী শোনে। কঁঠালতলার পশ্চিমে ভাঙা দালানের স্তুপে বসেছে কয়েকজন। শীতের বেলা দেখতে দেখতে গুটিয়ে যাচ্ছে। একটু দূরের শিমুলগাছের ওপর থেকে ছাইরঙের ১টি ডানা যেন গাঢ় হতে হতে এগিয়ে আসছে এদিকে। দালানের ভাঙা শ্বপ রঙ পাল্টায়।
চেন্টু জবাব দেয়, মুখ সামলাবার হুকুম দিবেন আপনে কয়জনোক? হামি একলা মুখ সামলালে কাম হবো? ডাকাত-মারাচর তাই ভরা ফালাছে গোরু দিয়্যা, এতো গোরু গাজীর ব্যাটা পালো কোটে?
ছাইরঙ আরো গাঢ় হয়। মস্ত জোড়াদিঘির ওপারে মরিচের জমি, ছাইরঙের পাতলা অন্ধকারে পাকা মরিচের টকটকে লাল রঙ, হঠাৎ করে তাকালে, ছাইয়ের ভেতরকার আগুনের মতো ঝাণ্টা মারে। এদিকে ছেলের কথাবার্তা শুনে নাদু মাথায় হাত দেয়। অনেকক্ষণ পর স্বগতোক্তি করে, উগল্যান কথা কওয়া হয় না বাপ, মুখখান তোর বড়ো দুষমন ছেলেকে বাচাবার উদ্দেশ্যে সে চেষ্টা করে গাজীদের দোষক্ষালণের, গাজীগোরে বাথান কি আজকার? কতো ছোটো থাকতে হামরাই দেখছি, যমুনার এই চর, ঐ চর ব্যামাকই গাজীগোরে দখলে। কতো বাথান, কতো গোরু, কতো মোষ দেখছি মাটির ঠিলা ভরা দুধ আসছে। হামরাই তো দেখছি।
তার সমর্থনে আরেকজন কিষান বলে, গাজীগোরে বাথান ভরা গোরু মোষ কি গুনা শ্যাষ করা গেছে?
কিন্তু চেন্টু বলে, উগল্যান কথা থোও গো! আগে কার কি আছিলো হামরা কবার পারি না। এখন ডাকাত-মারা চরত যায়া দ্যাখো, ব্যামাক এই অঞ্চলের গোরু। গেরস্থের গোরুবাছুর সব আটকা রাখছে। চালান হয় পুবে, যমুনার ঐ পার। মাদারগঞ্জের হাটোত বেচা হয়। ডাকাত-মারা চর দখল করছে কেডা, তোমরা জানো না?
কথা বলতে বলতে চেংটু কখন যেন উঠে পড়েছে দালানের ভাঙা গুপে। আনোয়ার এবার ভালো করে তার দিকে দেখলো। আনোয়ারের দাদাজী মারা যাওয়ার ৩ বছর আগে এই বৈঠকখানা দালানে চিড় ধরে, নতুন করে তৈরি করার জন্য গোটা দালান ভেঙে ফেলা হয়। সেই বছর তার মৃত্যু হলো। এরপর আর কিছু করা হয়নি। চেন্টু সেই স্তুপের উঁচু চূড়ায় দিব্যি পা ঝুলিয়ে বসেছে। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে তার মুখ অস্পষ্ট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *