• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

চিলেকোঠার সেপাই – ০৫

লাইব্রেরি » আখতারুজ্জামান ইলিয়াস » চিলেকোঠার সেপাই (উপন্যাস) » চিলেকোঠার সেপাই – ০৫

চিলেকোঠার সেপাই – ০৫

যেখানে জোড়পুল লেনের শুরু তার উল্টোদিকে শাহীন রেস্টুরেন্ট এ্যাঁন্ড সুইটমিটের দরজার টুটাফাটা নোঙরা পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে নওশাদের সুরে আশা ভোঁসলে শোনা গেলো। শোনবার লোক কম, খাবার লোক আরো কম। খয়েরি সর-পড়া চায়ে চুমুক দিয়ে আনোয়ার একটা কিংস্টর্ক ধরায়, ধোঁয়া সম্পূর্ণবের করে দিয়ে জিগ্যেস করে, অবস্থা কেমন মনে হচ্ছে?
অবস্থা জানাবার জন্য ওসমানই তোওকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এখন ওসমানের খুব বমি বমি লাগছে, পেটে সলিড কিছু পড়া দরকার। এখানে এখন গাজরের হালুয়া আর বোদে আর লাড়ডু ছাড়া কিছুই পাওয়া যাবে না। মুখে মিষ্টি দেওয়া এখন অসম্ভব। আনোয়ার নিজেই নিজের প্রশ্নের জবাব দেয়, এদের দিন শেষ হয়ে এসেছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে, পাগলা কুকুরের মতো দশা!
আনোয়ারের কথায় ওসমান একটু আরাম পায়, আরো আরাম পাবার আশায় জিগোস করে, তুমি তো ঘুরে টুরে এলে। বাইরে অবস্থা কি?
বললাম তো দেয়ার ডেজ আর নাম্বারড। এখন ভয় অপোজিশনের রুই-কাতলাদের নিয়ে।’ কেন? দাখো না মানুষ কতো এগিয়ে গেছে। গ্রামে গভমেন্ট ফেল করছে, লোকে ট্যাক্স দেওয়া বন্ধ করবে। যেসব ইনফ্লুয়েন্সিয়াল লোকদের ওপর ভরসা করে গভমেন্ট চলে পিপল তাদের পাত্তা দিচ্ছে না। সেখানে লিডাররা কি চায় বলো? শেখ সাহেব বেরিয়ে এলে এক এ্যাঁডাল্ট ফ্র্যাঞ্চাইজ ছাড়া আওয়ামী লীগের চাইবার কি থাকবে?
শেখ সাহেবকে ছাড়বে? ওসমান একেবারে সোজা হয়ে বসে এবং সাঙ্ঘাতিক এ্যাঁসিডিটি বোধ করা সত্ত্বেও একটা সিগ্রেট ধরায়। পেটের বা দিকটা চিনচিন করছে। গলার কাছে দলাপাকানো বমি। পেট খালি বলে বমিট ওখানে আটকে রয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির সম্ভাবনা শুনে যেটুকু চাঙা হয়ে উঠেছিলো তা মিইয়ে যায়, বলে, কিন্তু আগরতলা কি উইথড্র করতে পারবে? শওকতের ব্যাখ্যা মনে পড়ে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা আইয়ুব খানের পক্ষে অসম্ভব। সত্যি হোক মিথ্যা হোক, একবার মামলা যখন শুরু করেছে, আর্মির সম্মান, এমনকি অস্তিত্ব নির্ভর করে এর উপর। শাসকদল বলো আর বিরোধীদল বলো,-আর্মি ছাড়া গোটা পাকিস্তানে এরকম সুসংগঠিত রাজনৈতিক সংগঠন আর কি আছে? আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করলে কি সেনাবাহিনী হাস্যকররকম তুচ্ছ বলে প্রমাণিত হয় না? –আনোয়ারের সঙ্গে এসব কথা বলে তর্ক করা যায়, কিন্তু ওসমানের কথা বলতে ভালো লাগছে না। এ ছাড়া শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পেলে সে খুব খুশি হয়, আনোয়ার তার মুক্তির সম্ভাবনাই ব্যাখ্যা করছে, ওসমান তাই চুপ করে থাকে। এবার যেখানে গিয়েছিলাম সেখানে আমাদের বেস বেশ ভালো। মানুষ কি রকম কনশাস আর মিলিট্যান্ট হয়ে উঠেছে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। গ্রামের যারা মাথা, কয়েক জেনারেশন ধরে যারা ইনফ্লুয়েন্স খাটিয়ে আসছে, কর্নার্ড হতে হতে তাদের অবস্থা এরকম দাঁড়িয়েছে যে, ঘোরতর মুসলিম লীগাররা পর্যন্ত শেখ মুজিবের রিলিজ চায়। না হলে ওদের সেভ করবে কে?
নিজের মতবাদ সম্বন্ধে যতোই কথা বলুক, তার রাজনৈতিক তৎপরতা নিয়ে আনোয়ার একেবারে চুপচাপ থাকে। এই নিয়ে ওসমানের একটু অভিমান মতোও আছে? এবার এটুকু যখন বললো তখন আনোয়ার আরো বলবে ভেবে ওসমান উদগ্রীব হয়ে থাকে। কিন্তু আনোয়ার প্রসঙ্গ একটু পাল্টায়, এবার আমাকে যেতে বলছে আমাদের গ্রামে। আমাদের ওদিকটায় আমাদের লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে, ‘খানিকটা দূরে চর এলাকায় যা-ও আছে তারাও অন্য গ্রুপের। একটু থেমে আনোয়ার বলে, ‘তুমি যাবে আমার সঙ্গে?
ওসমান প্রথমে একটু ভয় পায়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে যেতেও খুব ইচ্ছা করে। আনোয়ার ফের বলে, চলো না দোস্ত! আমাদের গ্রামের বাড়িতে এক চাচা থাকেন, আমাদের থাকার জায়গা মেলা। যাবে? তুমি তো গ্রাম দ্যাখেইনি চলো। ওসমান একটু একটু হাসে, তুমি গ্রামে কোনোদিন বাস করেনি, আর পাকিস্তানে চলে আসার আগে পর্যন্ত আমি গ্রামেই ছিলাম। ‘আরে রাখো’ আনোয়ার থামিয়ে দেয়, কতো ছোটবেলায় চলে এসেছে, গ্রামের কথা তোমার মনে আছে?
ওসমানের বেশ হাল্কা হাল্কা ঠেকে। চায়ের পেয়ালায় অনেকক্ষণ চুমুক দেওয়া হয়নি। খয়েরি রঙের চায়ের ওপর শীতকালের পশ্চিমপাড়ার পুকুরের ওপরকার পরতের মতো গাঢ় খয়েরি সর ভাঙা ভাঙা ছড়ানো রয়েছে। সন্ধ্যাবেলা পশ্চিমপাড়ার বাঁকাসিধা তালগাছগুলো পুকুরের সর-পড়া পানিতে কায়ায় ছায়ায় তিরতির করে কাপে। —ওসমান নয়ন ভরে চায়ের পেয়ালা দ্যাখে।
যাবে? আনোয়ার প্রায় তাড়া দেয়, কয়েকদিনের ছুটি ম্যানেজ করতে পারবে না!’ ওসমান কাঙালের মতো বলে, যাবো! কবে যাবে? আনোয়ার জবাব দেওয়ার আগেই শোনা যায়, প্লামালেকুম! পাশের টেবিলের সামনে উপুড় হয়ে লুঙির পানি-ভেজানো প্রান্ত দিয়ে চোখ মোছে খিজির, চেয়ারে বসার পরও তার চোখ মোছা ও কথা বলা অব্যাহত থাকে, ত্যাজ কি! মনে লয় পাইপ দিয়া পিয়াজের রস ঢাইলা দিছে!’ এরপর কথা বলে তার সঙ্গী, ভিজে রুমালে চোখ মুছতে মুছতে লোকটি ওসমানের দিকে তাকায়, হেভি টিয়ার গ্যাস মেরেছে। এতো পানি দিলাম, এখনো জ্বলছে! চোখ থেকে রুমাল তুললে তাকে চেনা যায়। ওসমান জিগ্যেস করে, আপনারা কোথায় ছিলেন পারভেজ? প্রসেশন দেখে আমি ভিড়ে গেলাম। কোর্টের ওখানে দেখলাম কি খিজির বহুত চার্জর্ড হয়ে ইটা মারছে! এদিকে গোলি চলে আর ও ইটা মারে!’
‘কেউ মারা গেছে? ‘ডেফিনিটলি!’ পারভেজ জোর গলায় হাকে, ‘চায়ে দো! ফের গলা নামায়, এ্যাঁট লিস্ট থ্রি, হা তিনজন তো হবেই।’
কয়জন কইলেন? হাড্‌ডি খিজির জোরে প্রতিবাদ জানায়, তিনজন? আরে দশজন এগারোজনের কম হইবে না। কয়টা লাশ তো আমরাই টেরাকে উঠাইতে দেখলাম।
ওদের বেশির ভাগই জখম, ইনজুরিডা পারভেজ উত্তেজিত হয়ে ওঠে, আরে ভাই, এরা হয়ওয়ানসে ভি বেরহম! পহলে টিয়ার গ্যাস মারলে পাবলিক ডিসপার্স হয়ে যেতো। না, এই জানোয়ারগুলি পরথমেই গুলি করলো! গুলি করলি আগে আর টিয়ার গ্যাস মারলি পরে! এটা কি হলো?
আনোয়ার শান্তভাবে মন্তব্য করে, ডেডবডি সরাবার জন্য টিয়ার গ্যাস মারলো।’
পরিণতির কথা ভেবে ওসমান ভয় পায়, লাশগুলো কি করলো? আমি নিজের চোখে দেখছি কয়টারে টাইনা তুলতাছে, উত্তেজনা ও রাগে খিজিরের কালো মুখ আরো কালো দ্যাখায়। হাতের প্লায়ার একবার তার ডান হাতে, একবার বাম হাতে, কখনো টেবিলে রাখে, কখনো তার ময়লা শাদা লুঙির কোচড়ে রেখে তার ওপর কালো কালো শক্ত রঙের মতো আঙুল বুলায়, পরথমটা তো এক গুলিতেই খতম। ব্যাটারে টাইন তুললো, দেহি হাত দুইখান ল্যাতপাত ল্যাতপাত করে। আরেকটার জান কবচ হইছে টেরাকে উঠানের বাদে। এবার আনোয়ার তাকে কি জিগ্যেস করে এবং সে-ও লাশ গায়েব করার ব্যাপারে পুলিসের তৎপরতার একটি বিস্তারিত বিবরণ ছাড়ে। কিন্তু ওসমান কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। পেটের চিনচিন ব্যথা তার মাথায় উঠেছে। চোখের সামনে তার গোল গোল হলদে রঙের আলোর বিন্দু। আলোর বিন্দুর বিন্যাস এরকম দাঁড়ায় যে, মনে হয় রক্তাক্ত ১টি মৃতদেহ টেনে ট্রাকে তোলা হচ্ছে। মৃতদেহ ট্রাকের বাইরে রেলিঙে ঠেকে ঝুলছে। ৪/৫ জন প্রমাণ সাইজের পুলিস ১সঙ্গে টেনেও তাকে রেলিঙের ভেতর নিতে পাচ্ছে না। মৃতদেহের চোখ বেরিয়ে এসেছে কেটির থেকে। ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল অফিসের ছাদ থেকে, আজাদ সিনেমার ওপর থেকে, ওদিকে রায়সায়েবের বাজারের উঁচুনিচু টিনের ছাদ থেকে পাবলিক ইটপাটকেল ছুড়ছে। ৩০৩ রাইফেলের বুলেট ও টিয়ার গ্যাসের শেল ধাক্কা দিয়ে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ছুটে আসছে ভাঙাচোরা বোতল। —এইসব গোগ্রাসে দেখছে মৃতদেহের কোটরছেটা চোখজোড়া। তার ২ হাত নেমে গেছে নিচের দিকে, লোহারপাতের মতো একেকটি হাতে ঝোলে একেকজন গুলিবিদ্ধ মানুষ। তাদের জোড়া জোড়া ৪টে চোখ পেটুকের মতো দেখে নিতে চায় ইট-পাটকেল-বোতল-ছোড়া পাবলিককে। ওসমান নিজের চোখে হাত রেখে দৃশ্যটি নিভিয়ে দিতে চাইলে তা ঠাই নেয় তার নয়নের মাঝখানে। তখন কপালে হাত রেখে সে এদিক ওদিকে দ্যাখে।
কি হলো ওসমান? শরীর খারাপ? আনইজি ফিল করছো? আনোয়ারের ডাকে ওসমান ফের ঠিকঠাক হয়ে বসে। নাঃ! আমজাদিয়ায় দুটো এ্যাঁন্টাসিড ট্যাবলেট খেয়ে বেরোনো উচিত ছিলো। মনে হয় রোদে পিঠ দিয়ে বসে উঠানে ছড়ানো ধান খুঁটে-খাওয়া শালিক পাখি দেখতে দেখতে মাগুর মাছের ঝোল দিয়ে দুটো গরম ভাত খেতে পারলে সব ঠিক হয়। মাগুর মাছের ঝোলে মাখা ভাতের অনুপস্থিত স্বাদে মুখ লালায় ভরে ওঠে। কিন্তু এ শালা টকতেতো লালা। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে দরজার নোঙরা পর্দা তুলে সে থুতু ফেলে। গলা হঠাৎ শুকনা ঠেকে এবং বিশ্রীরকম কাশি শুরু হয়। কাশির সঙ্গে গমক দিয়ে বমি আসে। গলা দিয়ে মুখ দিয়ে বেদম আওয়াজ বেরোয়, কিন্তু যতো গর্জায় ততো বর্ষে না। সিগ্রেটের স্বাদে মাখামাখি হয়ে টক তেতো লালাই গড়িয়ে পড়ে ঠোঁট থেকে। ততোক্ষণে পারভেজ পাশে দাঁড়িয়ে তার মাথায় হাতের নরম চাপড় দিচ্ছে। এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিচ্ছে খিজির।
রাস্তায় খিজির তার গা ঘেঁষে চলে, গলা নামিয়ে বলে, আমাগো আলাউদ্দিন সাব আপনার লগে কি কথাবার্তা কইতে চায়। চান্দার টিকেটের দুইটা বই দিবো আপনারে, কইলো নিজে গিয়া দিবো। ওসমান এখন সম্পূর্ণ সামলে উঠেছে, এখন তার চিন্তা হয়, ‘আগরতলা মিথ্যা মামলায় অভিযুক্তদের সহায়ক কমিটি’র চাঁদার রিসিট বই নিয়ে সে করবেটা কি? কার কাছে সে চাঁদা চাইবে?
আনোয়ার ডাকে, ওসমান আমার সঙ্গে চলো। খেয়ে রেস্ট নিয়ে বাসায় যেও।’ ওসমান কিন্তু এখন যেতে চায় তার নিজের ঘরে। মাগুর মাছের ঝোল এখন তার না হলেও চলে। সবচেয়ে দরকার দুটো এ্যাঁন্টাসিড ট্যাবলেট। তারপর কানা আবুলের হোটেল থেকে ভাত রুটি যা হয় খেয়ে ঘরে সন্ধ্যা পর্যন্ত একটানা শুয়ে থাকবে। সন্ধ্যার দিকে রঞ্জ যদি খাতা নিয়ে এসে বলে, ‘অঙ্কটা একটু দ্যাখেন তো! তো ফ্রেশ শরীরে রঞ্জুর মাথার কাছে মাথা নিয়ে রাত পর্যন্ত অঙ্ক করানো যায়। কিন্তু আনোয়ার নাছোড়বান্দা, চলো। এখন রিকশা পাবে না, লক্ষ্মীবাজার পর্যন্ত হেঁটে যেতে কষ্ট হবে। চলো।’
আনোয়ারের ঘরে এখন রোদ নাই, কিন্তু সকালবেলার রোদের তাপ একেবারে মুছে যায়নি। আনোয়ারের টেবিল বড়ো এলোমেলো, একদিকে গাদা করে রাখা লিফলেটের তাড়া, পাশে বই, পত্রিকা, কাগজপত্র, এ্যাঁশট্রে এবং এ্যাঁশট্রে হিসাবে ব্যবহৃত সিগ্রেটের খালি প্যাকেট। এমনকি ১টা নোঙর গেঞ্জি ও আধ খাওয়া ১টি কমলালেবু। আনোয়ারের বিছানা কিন্তু পরিপাটি, –পুরু গদির ওপর তোষক, তার ওপর চাদর ও বালিশ; গুলটেক্সের পুরু বেড-কভার দিয়ে গোটা বিছানা আবৃত। ঘরের মেঝেও পরিষ্কার। মনে হয় টেবিলে আনোয়ার কাউকে হাত দিতে দেয় না।
আনোয়ার জিগ্যেস করে, গোসল করবে?
না। তুমি করে এসো। তুমি তাহলে বরং একটু শুয়ে থাকো। আমার পাঁচ মিনিট লাগবে। কি ভেবে আনোয়ার টেবিলে কাগজপত্র ঘাটতে শুরু করে। আস্তে আস্তে বলে, তোমাকে একটা চিঠি দাখাবো। আমার এক আত্মীয়’, বইপত্র ওলট-পালট করা অব্যাহত রেখে আনোয়ার বলে, ‘গতবছর বাড়ি গেলে উনার সঙ্গে খুব জমেছিলো, আব্বার কি রকম কাজিনের হাজব্যান্ড, আমাদের গ্রামেই বাড়ি, তার একটা চিঠি পেয়েছি, খুব ইন্টারেস্টিং।’ মানে তোমার ফুপা? কি লিখেছেন? কৌতুহল দ্যাখানো খুব দরকার। কিন্তু ওসমান এখন শুতে পারলে বাচে। চিঠি খুঁজতে খুঁজতে আনোয়ারের হঠাৎ মনে পড়ে, ওহো চিঠিটা ভাইয়াকে পড়তে দিয়েছিলাম। ভাইয়ারা তো হারমোনিয়াম পার্টি করে সমাজতন্ত্র করতে চায়, তাই বললাম, দ্যাখো, গ্রামে মানুষ কি রকম মিলিট্যান্ট হয়ে উঠছে, পড়লেই বুঝবে। আনোয়ার বোধ হয় ভাইয়ার ঘরের দিকে চলে গেলো।
এদিকে পায়ে পায়ে ঘষে স্যান্ডেল সু্য খুলে ওসমান যে কখন শুয়ে পড়েছে নিজেও সে ভালো করে খেয়াল করেনি। শোবার পর একটু শীতশীত করে। এতো সাজানো গোছানো বিছানা, বেণ্ড-কভার তুলে গায়ে দিতে তার বাধো বাধো ঠেকে। তার চিলেকোঠার ঘরে শেষ বিকালে শুয়ে থাকলে কখনো কখনো চারদিকের পুরু দেওয়ালের অনেক ভেতরকার ঠাণ্ডা শাঁস থেকে বাতাস বেরিয়ে এসে চোখে, কপালে ও কানের গোড়ায় আস্তে আস্তে ফুঁ দেয়। তখন উঠে বরং বাইরে দাঁড়ালে ভালো হয়। বাইরে দ্যাখা যায় যে, বাড়ির উল্টোদিকে মসজিদের সামনে পুলিসের গাড়িতে ১টি গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ তোলা হচ্ছে। কোনোরকম নড়াচড়া ছাড়া ট্রাক চলে যায় জনসন রোডে। তার নিজের দাঁড়াবার জায়গাটা খুঁজে পাওয়া যায় না। নিচে সাপের খোলস ছাড়াবার মতো করে পুলিসের লরি তার বডি পাল্টায়। লরির জায়গায় এখন বিরাট বাক্সের মতো দেখতে লাল রঙের ১টা গাড়ি। তার গাঢ় কালচে নীল কাচে ১টার পরে ১টা বুলেট লেগে ফিরে যাচ্ছে। ১টি বুলেটও কি কাচ ভেদ করতে পারে না? আরো চেষ্টা করা চাই। তো রাইফেল ছেড়ে কে। আজাদ সিনেমার ছাদে রেলিঙে রাইফেলের নল রেখে এক নাগাড়ে গুলি ছুড়ে চলেছে রঞ্জু রঞ্জু রঞ্জু কি পাগলামি করছে। নিচে থেকে পুলিসের ১টি মাত্র গুলি এসে ওর মাথাটিকে একেবারে চুরমার করে দেবে। রঞ্জুর মাথায় গুলি ঠেকাবার জন্য ওসমান দুই হাত দিয়ে তার কপাল ও মুখ জড়িয়ে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে শোনা যায়, ঘুমিয়ে পড়লে?
নিজের কপাল ও মুখ থেকে দুই হাত সরিয়ে ওসমান আনোয়ারের দিকে তাকায়। এই যে, এই চিঠিটা ভাবী খুঁজতে খুঁজতে দেরি করে ফেললো। পড়ো, এ্যাঁ? আমার গোসল করতে পাঁচ মিনিট।
ঘুমঘুম চোখে পিঁপড়ের সারির মতো ছোটো ছোটো বাঙলা অক্ষর প্রথম প্রথম ঝাপশা হয়ে আসে। তবে দেখতে দেখতে সেগুলো স্পষ্ট হয়, তখন অনায়াসে পড়া চলে।
এতদঞ্চলে গরু চোরের উপদ্ৰব ভয়ানক বৃদ্ধি পাইয়াছে। ইহার কোন প্রতিকার হইতেছে না। পক্ষকাল পূর্বে হাওড়াখালির নাদু পরামাণিক গরু অপহরণের অভিযোগ লইয়া থানায় যায়, কিন্তু দারোগা এজাহার লয় নাই। উপরন্তু পরদিন বুধবার দিবাগত রাত্রে নাদু পদুমশহর হাট হইতে প্রত্যাবর্তনকালে কে বা কাহারা পান্টি (গবাদি পশু শাসন করিবার যষ্টিবিশেষ) দ্বারা উহাকে প্রহার করে। তিনদিন পর অর্থাৎ শনিবার দিন দ্বিপ্রহরে ইউনিয়ন বোর্ডের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট এবং বর্তমানে ২নং ওয়ার্ডের মেম্বর খয়বার গাজীর ভ্রাতুষ্পপুত্র আফসার গাজী একটি কিষানের মাথায় আধ মণ মরিচের বস্তা লইয়া মূলবাড়ি ঘাটে যাইবার কালে ভুলু খন্দকারের খানকার নিকট পহুছিলে নাদুর পুত্র চেংটু তাহাকে কুকুর ধরাইয়া দিতে উদ্যত হয়। আফসার গাজী দৌড়াইয়া ভুলু খন্দকারের গোয়াল-ঘরে আশ্রয় লয়। চেংটু বলিয়া বেড়াইতেছে যে, খয়বার গাজীর ইশারায় দারোগা উহাদের গরু অপহরণের এজাহার লয় নাই। ক্রুদ্ধস্বভাব খয়বার গাজী ইহার প্রতিশোধ না লইয়া ছাড়িবে না। নাদু পরামাণিক বংশপরম্পরায় তোমাদের বাড়িতে বছর-কামলা হিসাবে কাজ করিতেছে। দরিদ্র ও নীচু বংশীয় হইলেও লোকটি অত্যন্ত অনুগত ও সৎ। কিন্তু উহার পুত্রটি বড় বেয়াদব, উহার উদ্ধত স্বভাব উহার পরিবারটির জন্য সর্বনাশ ডাকিয়া আনিবে। চিঠি পড়তে পড়তে ওসমানের ঘুম সম্পূর্ণ কাটে। আমাদের এলাকার মানুষের ধর্মজ্ঞান লুপ্ত হইয়াছে, সম্ৰমবোধ একরূপ নাই বলিলেই চলে। ভদ্রলোকের পক্ষে গ্রামাঞ্চলে বসবাস করা ক্রমেই দুরূহ হইয়া উঠিতেছে। তুমি দীর্ঘকাল বাড়ী আস নাই। সময় করিয়া একবার আসিলে নিজেই সমস্ত দেখিয়া শুনিয়া চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন করিতে পারিবা। এখানে খোদা চাহে সকলের কুশল। তোমার ফুফুর অবস্থা পূর্ববৎ। বাম চক্ষুর ছানি কাটিবার উপযুক্ত হইয়াছে, ঐ চোক্ষে প্রায় কিছুই দেখিতে পারে না। একবার ঢাকায় লওয়া দরকার।’
শেষ বাক্যটি পড়তে পড়তে ওসমানের ঠোঁটজোড়া একটু বাঁকা হয়, স্ত্রীর চিকিৎসার জন্যে লোকটা আনোয়ারের কিছু পয়সা হাতাবে। তবে কোনো মহিলার ছানি-পড়া চোখের সামনে উপচে পড়ে দুপুর বেলার রোদ। কালো ও ঢাঙা ১টি তরুণ চাষী পাটকিলে রঙের একটি কুকুর নিয়ে রাস্তায় হাঁটছে। —এই দৃশ্যটি অস্বস্তিকর। আনোয়ারের সঙ্গে ওসমানও তো ঐ গ্রামে যাচ্ছে, এরকম চলতে থাকলে তাকে আবার কেউ কুকুর লেলিয়ে না দেয়।

Category: চিলেকোঠার সেপাই (উপন্যাস)
পূর্ববর্তী:
« চিলেকোঠার সেপাই – ০৪
পরবর্তী:
চিলেকোঠার সেপাই – ০৬ »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑