পাস্তারনাকের কাব্যগ্রন্থের নিচে


কোনও কোনও কবিতা দূরে দাঁড়িয়ে থাকে; রুখু লালচে চুল, নীল চোখ,
গালে আপেলের রক্তিমাভা; ক্ষুৎ-পিপাসা, বুলেট এবং বোমা থেকে পালিয়ে
বেড়ানো উদ্বাস্তু ইরাকী বালিকা। হাত নেড়ে ডাকি, রুটি, কোকাকোলা আর
লজেন্সের প্রতিশ্রুতি দিই, তবু সে অনড়। যেন আমার চারপাশে অদৃশ্য
কাঁটাতারের বেড়া, টপকিয়ে আসার আগ্রহ নেই ওর। আমাকে উঠে দাঁড়াতে
দেখে এক দৌড়ে বালিকা-কবিতা শূন্যতায়। মেঘ নেমে আসে বুকের ভেতর।
ক’দিন পর রিকশায় যেতে যেতে ওর মতোই কাউকে দেখি আগুনের হল্কা-
ছড়ানো চৈত্রের রাস্তায়, রিকশাচালককে থামতে বলে পেছনে ফিরে তাকাই;
বাসস্ট্যান্ডে ব্যস্ত যাত্রীর ঠেলাঠেলি, ক’জন ভিখারী-সেই ভিড়ে তাকে খুঁজে
পেলাম না। রোদে-পুড়ে-যাওয়া নির্বাক কাক খুঁজছে গাছ, হয়তো কোনও
ডোবায় সেরে নেবে ত্বরিত স্নান। কোন্‌ মজা খালে বইবে আমার ভাবনার
স্রোত? এমনও তো হতে পারে, কোনও রাতে পালিয়ে-বেড়ানো সেই কবিতা
জ্যোৎস্নার ছোঁয়া লাগা আমার জানালায় বসে পা দোলাবে আর আমি ঘুমে
কাদা, অথচ কত রাত আমার নিদ্রাহীনতায় মরুভূমির মতো ধু ধু। আবার
কোনও দুপুরে আমার বিছানার পাশে এসে দাঁড়াবে, পেলব হাত রাখবে
কপালে; তখন ঝাঁ ঝাঁ জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে আমার গা, চোখ খুলে কোনও কিছু
দেখার শক্তি পর্যন্ত গায়েব। হায়, উদ্বাস্তু ইরাকী বালিকা ও তোমার কেমন
ধরন? তুমি কি আমাকে নিয়ে যেতে চাও এই শ্যামলিমা থেকে ইরাকের
পাথুরে জমিনে, যেখানে ব্যাণ্ডেজ-বাঁধা পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটবো, ক্ষুৎ-
পিপাসায় কাতর? আর তুমি ‘কেমন মজা’ বলে ছুটবে আমার আগে আগে এক
নির্দয় কৌতুক।


আজ অব্দি, হ্যাঁ, এতদিন পরেও কিছুতেই তোমাকে বোঝানো গেল না
আমার নিঃসীম ব্যাকুলতা। কতবার চোখে সেই ভাষা এনে তাকিয়েছি তোমার
দিকে যা নিভৃততম উপলব্ধিকেও টেনে তোলে প্রত্যক্ষে, যেমন গহন ডুবুরি
সমুদ্রগর্ভ থেকে বয়ে আনে মূল্যবান, গুপ্ত সামগ্রী। আমার আঙুলগুলো কি
বাঙ্ময় হয়ে ওঠেনি কখনও? আমার ওষ্ঠে অনুরাগের ঢেউ আছড়ে পড়েনি
বারবার, এ আমি স্বীকার করি কীভাবে? আমার দিনরাত্রি নিবেদিত তোমার
উদ্দেশে, আমার সকল কাজে তোমারই ছায়া খেলা করে-এই সত্যের নগ্নতা
তোমার দৃষ্টিতে দেখতে পাওয়ার আশাকে দাফন করেছি। কালেভদ্রে আমাদের
দেখা, মাঝে-মাঝে টেলিফোনে দ্বিধাজড়িত, সংক্ষিপ্ত আলাপ। বাজে,
এলোমেলো কথার ঝোপঝাড়ে কঞ্চির বাড়ি পড়ে, সবচেয়ে জরুরি কথাই
উচ্চারণের পরপারে থেকে যায়। কী করে সেসব কথা পৌঁছে দেব তোমার
কাছে। যদি বারান্দায় এসে দাঁড়াও অন্যমনস্কভাবে, তাকাও ভেসে-বেড়ানো
মেঘের দিকে, দেখবে সেখানে লেখা আছে আমার সেই কথাগুচ্ছ, যা
এতদিনেও বলা হয়নি তোমাকে; তুমি পড়ে নিও যদি ইচ্ছে হয়। যখন তুমি
দরজা খুলে বেরুবে কোথাও বেড়ানোর জন্যে তখন লক্ষ করলে দেখতে পাবে,
কাঠ কিংবা লোহা থেকে ঝুরঝুর ঝরছে আমার আকাঙ্ক্ষার অনূদিত ভাষা।
কখনও তোমাকে বিশ্বাস করাতে পারলাম না সময়ের পায়ে বেলাগাম বুনো
ঘোড়ার ক্ষুর। আমাদের প্রেম একটি অসমাপ্ত কবিতার মতো, তুমি কি জান?


অন্ধকারে এ কার হাত ছুঁল আমাকে? হতেই পারে না, দুপুর রাতে তুমি
এসে ঘুম ভাঙালে আমার। কে আমাকে একবার স্পর্শ করে চলে গেল? আমার
শরীর ছাড়া কোনও আলোড়ন নেই ঘরের কোনওখানে। তোমার নিদ্রার
উদ্যানে যাওয়া হবে না আমার; এই মুহূর্তে তোমার শয্যার পাশে গিয়ে বসব,
তোমার চুল নিয়ে খেলব কিছুক্ষণ, নিদ্রিত স্তনকে জাগিয়ে তুলব চুমোয়, এমন
সাধ্য আমার নেই। আমার হৃৎপিণ্ড এখন তোমার নামের ধ্বনি জড়িয়ে বেজে
চলেছে দ্রুত, তুমি শুনতে পাবে না। তোমাদের রাস্তায় এখন হয়ত জিনস্‌ পরা
কোনও মাতাল যুবক গালি ছুঁড়ছে ল্যাম্পপোস্ট তার পথ আগলে দাঁড়িয়েছে
বলে। হয়ত গত রাতে ওর পিতার মৃত্যু হয়েচেহ প্রবল স্ট্রোকে; মাথায় একটা
গোটা সংসার নিয়ে মাতলামো করা পলায়বৃত্তিকেই এক ধরনের আস্কারা।
তোমার চুলের ঘ্রাণ, স্তনের গোলাপি চাউনি, আঙুলের চঞ্চল শোভা নিয়ে আজ
মধ্যরাতে আমিও বড় মাতাল। আমার নিঝুম ছোট ঘর দুলছে, যেন বুড়িগঙ্গায়
বজরা; লেখার টেবিল, বুক শেলফ, টেলিভিশন সেট জুড়ে দিয়েছে জিপসি-
নাচ। বোদলেয়ারের অমোঘ বিধান মেনে নেয়া ছাড়া আর উপায় কী? আমার
এই মাতলামো কারও কাছে শুদ্ধ শিল্প আখ্যা পাক, চাই না। তোমরা কেউ
কবিকে খুঁজো না তার রঙিন মওতায়, মানুষটিকে তুলে নাও বুকে।


খট্রাশ সমাজের গালে জোরসে কয়েকটা চড় কষিয়ে দিলেই তো পার।
তোমার কি কখনও ইচ্ছে করে না আমার হাত ধরে খোলা রাস্তায় হেঁটে যেতে
ভ্রূক্ষেপহীন? রোজ তোমার ত্রিভুবন-ভোলানো চুম্বনের ঘ্রাণে বুঁদ হয়ে থাকি,
এ-ও কি তোমার ইচ্ছার পরিপন্থী? তোমার বাক্যসমূহে ‘নায়ের আধিক্য
আমাকে পীড়িত করে। হঠাৎ কোনওদিন আমি বৃষ্টিতে ভিজে এলে তুমি আঁচল
দিয়ে মাথা মুছিয়ে দিতে দিতে আমার মাথাটা বুকে চেপে ধরবে, এরকম আশা
নিশ্চয় আকাশছোঁয়া নয়। অনিয়মের চৌখুপি চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে আসার
আগ্রহ আহত চিলের মতো মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে এক কোণে। নির্ভুল
সামাজিকতা তোমার নখদর্পণে, আমি অবাক হয়ে দেখি। তুমি নির্ভর আমার
স্বপ্নগুলো গ্রীষ্মের কুকুরের জিভের মতো লক লক করুক, এই কি তোমার
প্রত্যাশা? তুমি কি চাও আমার শেষ পারানি কড়ি, ভালোবাসা, ভিক্ষুকের
ভঙ্গিতে সর্বদা হাত পেতে থাক? তাহলে সাফ সাফ বলে দাও, আমি আমার
প্রিয় বাসনাসমূহকে ফাঁসিতে লটকিয়ে কিংবা দাউ দাউ চিতায় তুলে দিয়ে
দশদিক কাঁপিয়ে হো-হো হেসে উঠি। অনন্তর এপিটাফ লিখে তোমাকে
শোনাতে আসব না।


অনেকক্ষণ ক্ষেতের আল-পথে হেঁটে আমি কি কখনও কোনও তরুণীকে
শেষরাতে আলুঘাটায় নৌকায় তুলে দিয়েছিলাম? স্তব্ধতা-চেরা বৈঠার শব্দে
চমকে উঠেছিলাম? জানি না কেন এই প্রশ্ন আজ হঠাৎ তোমাকে ভরদুপুরে
রিকশায় তুলে দিতে গিয়ে মনের গহন স্তরে ঝিকিয়ে উঠল! তোমার শাড়ির
আঁচল আটকে গিয়েছিল ত্রিচক্রযানের কোনও অংশে, আমি আলগোছে
ছাড়িয়ে দেয়ার সময় লক্ষ করি, তোমার মুখাবয়বে লজ্জার ঈষৎ রঙধনু।
তোমাকে নিয়ে রিকশা সদর রাস্তায়। ফিরে আসি ঘরে, পল এলুয়ারের
কবিতায় মন বসে না। আমার হৃদয় জুড়ে সারা দুপুর তুমি, বিকেলে তুমি
রাত্রিতেও তুমি। সন্‌জীদা খাতুনের ‘গীতাঞ্জলি’ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে
টেলিভিশন বন্ধ করে দিই। কিন্তু মনের পর্দার আলো কী করে নিভিয়ে দেব,
যেখানে তুমি বসে আছ, নিজস্ব পরিবেশের সম্রাজ্ঞী, চুল খোলা, ঈষৎ ভেজা
ঠোঁটে প্রজাপতির মতো উড়ছে কবিতার পঙ্‌ক্তি? তোমার রিকশা চলেছে
কালপুরুষের পাশ দিয়ে। তোমার মাথায় নক্ষত্রের মুকুট; তোমাকে শুভেচ্ছা
জানায় স্বাতী এবং অরুন্ধতী।


ভৌতিক জ্যোৎস্নায় ঘণ্টাধ্বনি শুনি; আমার যাবার সময় হয়ে এল।
মুগ্ধতাবোধ আছে, অথচ কোকিলের ডাক শুনি না বহুদিন। সুন্দরের মুখে
জলবসন্তের দাগ। কিছু কিছু কাজ অর্ধসমাপ্ত, অনেক কিছুই অসমাপ্ত, তবু চলে
যেতে হবে অনিবার্যভাবে, ঢেউয়ের আঘাতে আঘাতে যাবে একলা, ফাঁকা
নৌকা; অনিশ্চয়তার মুখে ক্রূর হাসি। কবিতার খাতার অনেকগুলো পাতা
শাদা, ডুকরে ডুকরে কাঁদবে নাকি? টেবিলে প্রুফের তাড়া পড়ে আছে
সংশোধনের অপেক্ষায়। তোমার সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলা হয়ে ওঠনি। কী
করছ তুমি এই রাতে ভৌতিক জ্যোৎস্নায়? গভীর রাতে সফল সঙ্গম শেষে তুমি
কি তৃপ্তিকর ঘুমের মসলিনে আবৃতা। না কি বাথরুমে ঢোকার আগে বুক চিরে
বেরুল দীর্ঘশ্বাস অতীতের চৌকাঠে ঠোকর খেয়ে? কামকলার সাময়িক
অবসানে ভাবছ আধুনিক শিল্পকলার অগ্রযাত্রার কথা। আমি আকাশের দিকে
তাকিয়ে আছি; দেখছি নক্ষত্রের অস্পষ্ট উদ্যান; প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো ছায়াপ্রতিম
ট্রেন, আবছা গার্ড বাজাচ্ছেন অস্পষ্টশ্রুত হুইসেল। অকস্মাৎ মনে পড়ে,
পাস্তারনাকের কাব্যগ্রন্থের নিচে ইলেকট্রিক বিল সেই কবে থেকে চাপা পড়ে আছে।