ধর্ম ও দর্শন
বিজ্ঞান
সাহিত্য
1 of 2

প্লেটো (৪২৮–৩৪৭ খ্রি. পূ.) – দর্শনশাস্ত্র যাঁর হাতে পেয়েছিল পূর্নাঙ্গরূপ

প্লেটো (৪২৮–৩৪৭ খ্রি. পূ.) – দর্শনশাস্ত্র যাঁর হাতে পেয়েছিল পূর্নাঙ্গরূপ

সক্রেটিস ছিলেন দর্শনশাস্ত্রের আদি জনক। আর তাঁরই সুযোগ্য শিষ্য মহাজ্ঞানী প্লেটো। সক্রেটিস যে দর্শনের সূত্রপাত করে গিয়েছিলেন, প্লেটোতে এসেই তা-ই পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করেছিল।

প্লেটো দর্শনশাস্ত্রের এতখানি বিকাশ সাধন করে গেছেন যে তাঁকে অতিক্রম করে যাওয়া আজও কারও পক্ষে সম্ভব হয়নি।

তাঁর দর্শন সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে আধুনিক দার্শনিক এম. এন. হোয়াইটহেড মন্তব্য করেছেন, প্লেটোর পর দর্শনশাস্ত্র বিন্দুমাত্র অগ্রসর হয়নি। এ যাবৎ প্লেটোর দর্শনের টীকাভাষ্য রচনা হয়েছে মাত্র।

আরেক দার্শনিক ইমারসন বলেছেন, দর্শন বলতে যেমন প্লেটোকেই বুঝতে হবে, তেমনি প্লেটো বলতেও বুঝতে হবে দর্শনকে।

মহাজ্ঞানী এই প্লেটোর জন্ম হয়েছিল ৪২৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিসের এক অভিজাত পরিবারে। কেউ কেউ বলেন, প্লেটো নাকি তাঁর আসল নাম নয়, পিতৃদত্ত একটি নামও তাঁর ছিল। তাঁর আসল নাম হলো অ্যারিস্টিক্লিস। কিন্তু তিনি প্লেটো নামেই পরিচিত হন।

তাঁর পিতার নাম ছিল অ্যারিস্টন এবং মায়ের নাম ছিল পেরিকটিয়োন।

তিনি ছিলেন বিশাল স্কন্ধের অধিকারী। গ্রিক ভাষায় প্লেটো শব্দের অর্থ বিশাল স্কন্ধ। এজন্যই লোকে তাঁকে প্লেটো বলে ডাকত। তিনি ছিলেন অভিজাত ও ধনীর সন্তান। তবে বাল্যকালটা তাঁর ভালো যায়নি। ওই সময়টা তাঁর বখাটেপনা করেই কেটেছে। দিনমান খেয়ালখুশি মতো ঘুরে বেড়ানোই ছিল তাঁর কাজ।

তার পরই হঠাৎ করেই প্লেটোর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। পাল্টে যায় তাঁর সবকিছু সক্রেটিসের সংস্পর্শে এসে। তিনি হয়ে যান সক্রেটিসের একান্ত ভক্ত শিষ্য। মনোনিবেশ করেন জ্ঞানচর্চায়। সক্রেটিসের জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্লেটো তাঁর গুরুর সাথে ছিলেন। সক্রেটিস যখন হেমলকের বিষ পান করে আত্মহত্যা করেন, তখন প্লেটোর বয়স ছিল মাত্র আটাশ বছর। সক্রেটিসের মৃত্যুর পর প্লেটো বেরিয়ে পড়েন দেশভ্রমণে।

সেই সময় তাঁর দেশ ছেড়ে যাবার আরও একটা কারণ ছিল। এথেন্সের অনেক লোকই সে সময় তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট ছিল না। গুরু সক্রেটিসের মৃত্যুর জন্য তিনি এথেন্স- এর জনগণকেই দায়ী করতেন। প্লেটো গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি সক্রেটিসের মৃত্যুর জন্য শাসনব্যবস্থাকে দায়ী করেন। এ ছাড়া সেই সময় এথেন্স একটি যুদ্ধে পরাজয় বরণ করেছিল। পরাজয়ের জন্যও তিনি গণতন্ত্রকে দায়ী করেন। তাঁর এ সমস্ত মতপার্থক্যের জন্যই এথেন্সবাসী তাঁর ওপর খেপে ওঠে।

কেউ কেউ বলেন, এই সময় প্লেটো তাঁর অন্যতম শিষ্য সিরাকুজের শাসনকর্তা ডায়ন-এর মাধ্যমে একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে কল্পিত ভূ-স্বর্গ তৈরি করারও চেষ্টা করেছিলেন। এই ষড়যন্ত্র অবশেষে ফাঁস হয়ে যায় এবং সবাই তাঁর ওপর খেপে ওঠে।

অবশেষে তাঁর বন্ধুরা তাঁকে এথেন্স ছেড়ে যাবার পরামর্শ দেন। কারণ, এথেন্স তখন তাঁর জন্য আর নিরাপদ ছিল না।

এথেন্স থেকে পালিয়ে প্লেটো সিসিলিতে গিয়ে সাক্ষাৎ করেন রাজা ডায়োনাইসিয়াস-এর সাথে। সেখানে রাজার জামাতা এবং সিরাকুজের রাজা ডায়নের সঙ্গেও তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ডায়ন প্লেটোর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর শিষ্য হয়ে যান।

প্লেটো ডায়নকে দিয়ে তাঁর আদর্শের দার্শনিক রাজা তৈরি ও রাজ্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু এর কিছুদিন পরেই সিসিলির রাজা ডায়োনাইসিয়াস মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর রাজা হন রাজার পুত্র দ্বিতীয় ডায়োনাইসিয়াস। কিন্তু তিনি ছিলেন সন্দেহপ্রবণ লোক। তিনি তাঁর ভগ্নীপতি ডায়নকে ভালচোখে দেখতেন না। সেইসাথে তিনি প্লেটোকেও বাঁকাচেখে দেখতে শুরু করেন।

একটা সময় এই সম্পর্ক আরও খারাপ হয়ে যায়। নতুন রাজা তাঁর ভগ্নীপতি ডায়নকে দেশ থেকেই বের করে দিলেন।

এরপর প্লেটোর পক্ষেও আর সিসিলিতে থাকা সম্ভব হলো না। তিনি আবার ফিরে এলেন এথেন্সে। এর কিছুদিন পর তিনি আবার গোপনে সিসিলিতে যান ডায়নের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য। কিন্তু সেখানে গিয়েই তিনি ধরা পড়েন এবং কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। পরে এক বন্ধুর সহায়তায় ছাড়া পেয়ে স্বদেশে ফিরে আসতে সক্ষম হন।

এই ঘটনার বছর দশেক পর বিতাড়িত সিরাকুজরাজ ডায়ন তাঁর শ্যালক দ্বিতীয় ডায়োনাইসিয়াসকে দেশ থেকে বিতাড়িত করে সিসিলি দখল করেন। এই খবর পেয়ে প্লেটোও আবার ৩৮৬ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ফিরে যান সিসিলিতে। কিন্তু এবারও প্লেটোর বেশিদিন থাকা হলো না এখানে। সিসিলির সিংহাসন দখল করার কিছুদিনের মধ্যেই ডায়ন নিজেই নিহত হলেন গুপ্তঘাতকের হাতে।

আবার প্লেটোকে ফিরে আসতে হলো স্বদেশে।

তিনি এথেন্স ছেড়ে আবারও বিশ্বভ্রমণে বের হন ৩৯৯ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। প্রথমে ভ্রমণ করেন মিশর। এ সময় মিশরের শাসনব্যবস্থা ছিল ধর্মভিত্তিক। দেশের শাসনভার ছিল ধর্মগুরুর হাতে। তাঁকে সহায়তা করত সেনাবাহিনী। এ ছাড়া দেশে ছিল আরও একটি শ্রেণী, যারা ছিল সরাসরি উৎপাদনের সাথে জড়িত। এ ধরনের শাসনব্যবস্থাই ভাল লাগত। তিনি এথেন্সে এ রকমই একটা কিছু করতে চেয়েছিলেন। মিশর ছাড়া তিনি ইতালিও গিয়েছিলেন। তিনি সুদূর ভারতবর্ষেও এসেছিলেন বলে শোনা যায়। ভারতের সনাতন ধর্মের অধ্যাত্মবাদ তাঁকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করেছিল।

তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ ‘রিপাবলিক’-এ দেশের শাসনব্যবস্থার যে শ্ৰেণীবিভাগ তুলে ধরেছেন, তার ওপর সনাতন ধর্মের জাতিগত শ্রেণীভেদের (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র) প্রবল প্রভাব রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।

প্লেটো তাঁর রিপাবলিক গ্রন্থেও দেশের জনগণকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন। প্রথম হলো অভিভাবক শ্রেণী, যারা রাষ্ট্র পরিচালনা ও বিচার কাজ করবে। দ্বিতীয় শ্রেণীতে থাকবে সেনাবাহিনী বা যোদ্ধা। তারা দেশকে বহিঃশক্তির আক্রমণ থেকে রক্ষা করবে। এদের হাতে থাকবে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। অভিজাত ও যোদ্ধা—এই দুটি শ্রেণী সম্পর্কে তাঁর আরও কিছু মজার মতবাদ সব ধরনের। তিনি মনে করেন যেহেতু শাসন এবং ক্ষমতা ন্যস্ত করা হবে তাদের হাতে, তাই তাদের থাকতে হবে সব ধরনের লোভ-লালসা ও দুর্নীতির ঊর্ধ্বে। তাদের ব্যক্তিগত কোনো সম্পত্তি থাকতে পারবে না। তারা নিঃস্বার্থভাবে দেশ শাসন করবে। অভিভাবক শ্রেণী হবে দার্শনিক রাজা। তারা বিয়ে পর্যন্ত করতে পারবে না। জাগতিক কোনো কামনা-বাসনাই তাদের থাকতে পারবে না। অনেকটা তিব্বতের দালাই লামাদের মতো। নিচু সম্প্রদায়ের বা দাসশ্রেণীর লোকেরা বিয়ে এবং ঘর-সংসার করতে পারবে। তাদের বিষয়সম্পত্তি থাকবে। সমাজের প্রত্যেকেই নিষ্ঠার সাথে পালন করবে নিজ নিজ দায়িত্ব। এটাকেই প্লেটো ‘সামাজিক ন্যায়’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।

এছাড়া প্লেটো কল্পিত রাজ্য বা সমাজে কবির কোনো স্থান ছিল না। তিনি কবিদের সমাজে ঠাঁই দিতেও নারাজ ছিলেন। তিনি তাদের জন্য বরাদ্দ করেছিলেন নির্বাসনদণ্ড। কবিদের প্রতি তাঁর এই নাখোশ হওয়ার একটা কারণ ছিল। তাঁর মতে, পৃথিবীর সকল বস্তুই হলো এক নির্দিষ্ট আদর্শ বস্তুর অনুকরণমাত্র। পৃথিবীতে আমরা যা কিছু দর্শন করি, তার কোনোটাই সত্যি নয়, এর সমস্ত কিছুই হলো এক মহাসত্যের অনুকরণমাত্র। প্লেটোর মতে, এই মহাসত্যের কোনো পরিবর্তন হয় না। কবিরা এই অনুকরণের অনুকরণ করে কবিতা রচনা করে থাকেন। তাই কবিদের কাব্য সত্যনিষ্ঠ নয়। অনুকরণের মধ্যে কোনো মৌলিক তথ্য থাকে না। সেখানে সত্যের বিকৃত রূপটাই ধরা পড়ে মাত্র। কবিরা যেহেতু অনুকরণ করেন, তাতে সত্যের লেশমাত্র থাকে না, তাই কবির কাব্য সত্য নয়। সুতরাং কাব্যচর্চা নিষিদ্ধ হওয়া দরকার।

তিনি মনে করতেন, জগতের যা কিছু সৃষ্টি, তার সমস্তই মহাস্রষ্টার খণ্ডিত প্ৰকাশ। মানুষের জীবাত্মাও বিশ্বের মহাত্মার খণ্ডিত প্রকাশ মাত্র। এই বিশ্বআত্মাই হল পরমেশ্বর। উল্লেখ্য, এটা সনাতন ধর্মেরও মূল সূত্র।

প্লেটো ছিলেন ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী। তাঁর মতে, ঈশ্বরই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন। তিনিই সকল কারণের কারণ। তিনি দেব-দেবীতেও বিশ্বাস করতেন এবং সনাতন ধর্মের অনুকরণেই বিশ্বাস করতেন যে, এই দেব-দেবীও এক মহাবিশ্বআত্মার বিশেষ বিশেষ গুণের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

মহাকবি হোমার তাঁর মহাকাব্যে স্বর্গের দেব-দেবী নিয়ে কিছু হাসি-তামাশা করায় তাকে তিনি দেখতে পারতেন না। তিনি মহাকবি হোমারকে মহাপাপী বলে আখ্যায়িত করেছেন।

তিরিশ বছর বয়সে দেশভ্রমণে বের হয়েছিলেন প্লেটো। দেশের পর দেশ ঘুরে ঘুরে কাটিয়ে দেন দশ-দশটি বছর। তারপর ৪০ বছর বয়সে আবার ফিরে আসেন নিজের শহর এথেন্সে। ততদিনে তাঁর প্রতি জনগণের বিদ্বেষও অনেকখানি কমে এসেছিল। স্বদেশে ফিরে এসে স্থাপন করেন একটি দর্শনশিক্ষার স্কুল। পাশাপাশি শুরু হলো তাঁর দর্শনচর্চা।

তিনি প্রথমবার সিসিলি থেকে দেশে ফিরে এসেই এথেন্সে স্থাপন করেছিলেন তাঁর দর্শনের স্কুল। তাঁর লক্ষ্য ছিল, শহরের তরুণসমাজকে জনসেবা ও শিক্ষার ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেয়া। তাঁর স্কুল বা অ্যাকাডেমিতে শিক্ষা দেওয়া হতো বিজ্ঞান এবং দর্শন।

প্লেটো দর্শনশাস্ত্রের ওপর বেশ কয়েকটি গ্রন্থও রচনা করে গেছেন। তাঁর বইগুলি ছিল প্রশ্নোত্তরের ভিত্তিতে রচিত। এগুলোকে বলা হয় ডায়ালগ্স্‌ (dialogues)।

শিষ্য প্রশ্ন করছেন, গুরু সেসব জটিল প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। এ ভাবেই তিনি ব্যাখ্যা করে গেছেন তাঁর যাবতীয় দর্শনশাস্ত্র। তাঁর এই ডায়ালগ রচনার পদ্ধতির মধ্যে ও হিন্দুশাস্ত্রের শ্রেষ্ঠ ধর্মগ্রন্থ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার প্রভাব বিদ্যমান। গীতাও কথোপকথনের ভঙ্গিতে রচিত। শিষ্য অর্জুন প্রশ্ন করছেন আর তাঁর গুরু শ্রীকৃষ্ণ তার উত্তর দিচ্ছেন।

প্লেটোর রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে আছে ‘লাসেস’ (Laches), ‘ক্রিটিয়াস’ (Critias), ‘প্রোটাগোরাস’ (Protagoras), ‘জরজিয়াস’ (Jorgias), ‘মেনো’ (Meno)।

তাঁর উল্লেখযোগ্য ডায়ালগগুলোর মধ্যে বিখ্যাত হচ্ছে ‘সিম্পেজিয়াম’ (Symposium), ‘ফেডো’ (Phaedo), ‘রিপাবলিক’ (Republic), ‘ফেওড্রাস’ (Pheodrus), ‘পারমেনিডেস’ (Parmenides), ‘সোফিস্ট’ (Sophist), ‘পলিটিকাস’ (Politicus), “তিমাই-উস’ (Tima-eus), ‘ফিলেবাস’ (Philebus) এবং ‘লজ’ (Laws)। লজ-ই তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ।

এই মহান দার্শনিকের মৃত্যু হয় ৩৪৭ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে। সক্রেটিসের যেমন সুযোগ্য শিষ্য ছিলেন প্লেটো, তেমনি প্লেটোরও সেরা শিষ্য ছিলেন অ্যারিস্টটল। অ্যারিস্টটল তাঁর মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে ছিলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *