ধর্ম ও দর্শন
বিজ্ঞান
সাহিত্য
1 of 2

বর্ধমান মহাবীর (৫৯৯–৫২৭ খ্রি. পূ.) – জৈন দর্শন ও ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা

বর্ধমান মহাবীর (৫৯৯–৫২৭ খ্রি. পূ.) – জৈন দর্শন ও ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা

বর্ধমান মহাবীরই হলেন জৈন দর্শন ও জৈনধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। মহান জ্ঞানসাধক মহাবীরের এমন এক সময়ে জন্ম, যখন প্রাচীন ভারতের সামাজিক অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। জাতিভেদ প্রথা তখন চরমে।

উচ্চবর্ণ তথা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যরাই ছিল তখন সকল সামাজিক সুবিধা ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের একচ্ছত্র ভাগীদার। ধর্মকর্মের একচেটিয়া অধিকার ছিল ব্রাহ্মণদের। বলা হতো, ব্রাহ্মণ ছাড়া আর কেউ ধর্মগ্রন্থ পাঠ করলে তাকে নরকে যেতে হবে। রাজ্য শাসনের সকল অধিকার ছিল ক্ষত্রিয়দের হাতে। তারাও মত্ত থাকত বিলাস- ব্যসনে। আর ব্যবসা-বাণিজ্যের একচেটিয়া সুবিধাভোগী ছিল বৈশ্যরা।

কিন্তু চতুর্থ অর্থাৎ নিম্নশ্রেণীর শূদ্রদের অবস্থাই ছিল সবচেয়ে করুণ। মূলত তারা ছিল দাসশ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। কোনো সামাজিক অধিকার আর মর্যাদাই তাদের ছিল না। অথচ তারাই ছিল সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী।

এমনি এক অস্বস্তিকর সামাজিক পরিবেশেই বর্ধমান মহাবীরের জন্ম। যদিও তাঁর জন্মকাল নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে কিছুটা মতপার্থক্য আছে, তবু প্রচলিত মত হলো : মহাবীর ৫৯৯ খ্রি. পূর্বাব্দে প্রাচীন পাটনার উত্তরে কুন্দ নামক একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

তিনি ছিলেন গাঁয়ের এক উচ্চবর্ণ ধনাঢ্য ব্যক্তির দ্বিতীয় পুত্র। শৈশবকাল কেটেছে বিপুল ঐশ্বর্য আর সীমাহীন ভোগবিলাসের ভেতর দিয়ে। পাঁচজন সেবিকা সর্বক্ষণ নিয়োজিত থাকত তাঁর পরিচর্যায়। যৌবনে মহাবীর বিয়ে করে ঘরসংসার পেতেছিলেন এবং এক কন্যার জনকও হয়েছিলেন। কিন্তু তার পরই তাঁর মনের জগতে ঘটে যায় এক আমূল পরিবর্তন। তিনি সংসারধর্ম এবং ভোগবিলাসের কালো পর্দা সরিয়ে প্রত্যক্ষ করেন জীবন-সত্যের এক উজ্জ্বল আলোকশিখাকে। তিনি আলোড়িত হন সেই আলোকশিখা ও সত্যের আহ্বানে। সংসারধর্মের মোহ তাই আর তাঁকে আটকে রাখতে পারল না। কথিত আছে, পিতার মৃত্যুর পরপরই তিনি মাত্র তিরিশ বছর বয়সে ত্যাগ করেন সংসারজীবন। স্ত্রী-কন্যাকে চেড়ে চলে যান বনে। বড় ভাইয়ের অনুমোদন নিয়েই তিনি সেখানে যান এবং অরণ্যের নির্জনতায় শুরু করেন কঠোর তপস্যাব্রত।

গভীর বনে একটানা বারো বছর কাটে তাঁর এই গভীর ধ্যানসাধনায়। এ সময় তিনি এমন নিমগ্ন থাকতেন যে, আহার-নিদ্রার কথা পর্যন্ত মনে থাকত না। এভাবেই তিনি সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন। সংসারজীবনের সব ধরনের লোভ, লালসা, হিংসা, দ্বেষ ও ভোগবিলাসের প্রবৃত্তি তাঁর মন থেকে সম্পূর্ণ দূর হয়ে যায়। এমনকি জন্ম, মৃত্যু, জরা সম্পর্কেও তিনি নির্মোহ হয়ে পড়েন।

এর পরই তিনি প্রচার করতে শুরু করেন নিজের ধর্মমত—জৈনধর্ম। যদিও বলা হয়ে থাকে যে, মোট চব্বিশজন তীর্থঙ্কর জৈনধর্মের প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রথম তীর্থঙ্করের নাম ঋষভ। তিনি ছিলেন রাজা। সর্বপ্রথম তিনিই এই মতবাদের প্রচার করেন। কিন্তু তবুও মহাবীরকে বলা হয় সর্বশ্রেষ্ঠ তীর্থঙ্কর এবং জৈনধর্মের সত্যিকার প্রতিষ্ঠাতা।

জৈনধর্মের মূল কথা হলো অহিংসা ও সৎ আচরণ। এ ধর্মমতে সবচেয়ে বড় পাপ জীব হত্যা। জৈনধর্ম বিশ্বাস করে, সবকিছুর মধ্যেই আত্মা বিদ্যমান। তাই আগুন জ্বাললেও যেমন জীবহত্যা করা হয়, তেমনি আগুন নির্বাপিত করলেও জীব হত্যা হয়। এই ধর্মে কৃচ্ছতা সাধনের প্রতি জোর দেওয়া হয়ে থাকে সবচেয়ে বেশি। আর এ কারণেই এই ধর্মের অনুসারীর সংখ্যাও খুব কম। ভারতের কোনো কোনো অংশে এখনও এই সম্প্রদায়ের অনুসারীরা বসবাস করে থাকেন।

জৈনধর্মের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো—সর্বশক্তিমান কোনো ঈশ্বরে তাদের বিশ্বাস নেই। এই ধর্মের মূল ঈশ্বর আরাধনা নয়, মূল হলো এর তিনটি বিধান—সৎ বিশ্বাস, সৎ জ্ঞান ও সৎ আচরণ। জৈন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে দুটো ভাগ আছে। এর মধ্যে শ্বেতাম্বররা সাদা কাপড় পরে থাকেন। আর দিগম্বররা সামান্য গোঁড়াপন্থি। তারা উলঙ্গ থাকেন।

জৈনধর্মের প্রতিষ্ঠাতা বর্ধমান মহাবীর মোট ৭২ বছর জীবিত ছিলেন বলে অনুমান করা হয়। তিনি শেষ জীবনে সর্বক্ষণই বনে বনে ঘুরে বেড়াতেন। পারতপক্ষে কখনও লোকালয়ে আসতেন না। কারও সাথে খুব একটা কথাও বলতেন না। কোথাও তিনি স্থির থাকতেন না। এক রাতের বেশি কাটাতেন না কোনোখানেই

তিনি পথ চলার সময় করতেন এক মজার কাণ্ড। তাঁর মতে, যে-কোনো ধরনের জীব হত্যাই মহাপাপ। পথ চলার সময় পথের ধুলা এবং ঘাসের নিচে তো হাজারো কীটপতঙ্গ থাকতেই পারে। যদি তাঁর পায়ের চাপে ক্ষুদ্রতম কোনো কীটপতঙ্গেরও মৃত্যু হয়! তা হলে তিনি পাপের ভাগী হবেন। তাই তিনি রাখতেন সবসময় সাথে একটি ঝাড়ু। পথ চলার সময় তাই তিনি সবসময় পথ ঝাড় দিতে দিতে যেতেন। এ নিয়ে লোকে তাঁকে নানারকম ঠাট্টা-বিদ্রূপও করত। কিন্তু লোকনিন্দার কোনো ভয় তিনি করতেন না। এ নিয়ে তাঁর মনে প্রতিহিংসা বা ক্রোধের উদ্রেকও হতো না। কারণ তিনি ছিলেন সত্যের সাধক। সকল জাগতিক হিংসা-বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে।

এই মহান পুরুষের মৃত্যু হয় আনুমানিক ৫২৭ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *