2 of 8

সময়

সময়

সেই জ্ঞান হওয়া অবধি শুনে আসছি যে সময়টা ভাল নয়। হয়তো আমার এবং আমার বয়সিদের ভাগ্যটাই খারাপ, আমরা জন্মেছিলাম দুর্দিনে। মহাযুদ্ধের ঠিক আগে আগে আর জ্ঞান হয়েছিল দুর্ভিক্ষ আর মন্বন্তরের মুখোমুখি। তারপরের দাঙ্গা, পার্টিশান হিংসা আর প্রতিহিংসার রক্ত আর কালিমালিপ্ত সেই ছিন্নমূল ইতিহাস তার প্রতিটি পৃষ্ঠায়, প্রতিটি অধ্যায়ে লেখা রয়েছে, বড় বড় গোটা গোটা অক্ষরে ‘খারাপ সময়, আরও খারাপ, আরও খারাপ সময়।’

এই দুঃসময় যাকে বলে খারাপ সময় আসল মহাভারতের পাতায় পাতায় তার কথা লেখা আছে। এক অস্থির সময়ের সেই মহাকাব্যে জীবনের সব দুর্গতি, সব দুর্ঘটনা আদ্যন্ত বিবৃত হয়েছে। দুঃসময় নয়, আমরা এখানে শুধু সময়ের মধ্যে আবদ্ধ থাকছি।

প্রথমে একটা রূপকথা বলি।

কলকাতা জি পি ও-র গম্বুজের মাথায় বড় গোলঘড়িটাকে খুব হিংসে করত এক হাতঘড়ি। সেই হাতঘড়ি যাঁর কবজিতে, তিনি কাজ করতেন ওই জি পি ও-র পাশেই একটা অফিসে। প্রতিদিন জি পি ও-র পাশে বাস বা মিনিবাস থেকে নেমে তিনি অভ্যাসবশত অন্তত একবার ঘাড় উঁচু করে জি পি ও-র ঘড়িটার সময় দেখে নিতেন। একবার হাতঘড়িটায় চোখ বুলিয়ে দুটোর সময়ের তারতম্যও হিসেব করতেন।

হাতঘড়িটা এসব পছন্দ করত না। প্রতিদিন সে দেখত যে শুধু তার মালিকই নয়, রাস্তায় অন্য লোকেরাও মাথা তলে জি পি ও-র ঘড়িটা দেখে নিচ্ছে। খুবই হিংসে হত হাতঘড়িটার।

এর মধ্যে একদিন হল কী এক সন্ধ্যাবেলা খুব ভিড়ের বাসে ধাক্কাধাক্কি করে উঠতে গিয়ে হাতঘড়ির মালিকের কবজি থেকে স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে ঘড়িটা ফুটপাথের একপাশে পড়ে গেল, কারও নজরে পড়ল না।

সেদিন অনেক রাতে যখন কেউ কোথাও নেই, অফিসপাড়ার লালদিঘির চারদিক নিঝুম তখন সেই হাতঘড়িটা জি পি ও-র গোল থাম বেয়ে বড় গোল ঘড়িটার চেয়েও অনেক উঁচুতে একদম মিনার চূড়ায় উঠে গেল।

আজকাল সেই হাতঘড়িটা সেখানেই থাকে। অত উঁচুতে একটা বিন্দুতে পরিণত হয়েছে, কেউ তাকে দেখতে পায় না। কিন্তু যখনই রাস্তার লোকরা মাথা উঁচু করে বড় গোলঘড়িটায় সময় দেখে, সে ভাবে সবাই তাকে দেখছে। সে জানে না তাকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না।

এরপর একটা সাদামাটা গল্প মনে পড়ছে। যেমন হয়, একটি মেয়ে একটি ছেলের প্রেমে পড়েছিল, অনুরাগ অনেক দূর গড়ায় এবং শেষ পর্যন্ত মেয়েটি তার বাবাকে বলে যে সে অমুক ছেলেকে ভালবাসে এবং তাকে বিয়ে করতে চায়।

এখন হয়েছে কী, মেয়েটির বাবা হলেন রীতিমতো অবস্থাপন্ন, যাকে বলে বড়লোক তাই। তাঁর নিজের ব্যবসা, বাড়ি-গাড়ি ইত্যাদি। তাঁর ছেলেমেয়ের সংখ্যাও যৎসামান্য তিন-চারটি।

আর এদিকে ভাবী পাত্রটি মাত্র দেড় হাজার টাকা মাইনের একটি চাকরি করে, তাও নিতান্ত এক বাংলা খবরের কাগজে।

মেয়ের কথা শুনে বাবা চিন্তান্বিত হলেন, মেয়েকে বললেন, ‘এটা তুমি ঠিক করছ না। ওই ছেলেটি, কী যেন নাম বললে, কী যেন মাইনে পায়! ওতে তো তোমাদের মাসের মধ্যে তিনদিনও যাবে না। বাকি সাতাশদিন কী করবে? উপোস করবে?’

মেয়েটি অনেকক্ষণ নিথর দৃষ্টিতে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর চোখ নামিয়ে নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, তুমি কি মাকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলে?’

পিতৃদেব খুব শঙ্কিতভাবে যেন খুব অন্যায় করেছিলেন এইরকম মুখভঙ্গিমা করে বললেন, ‘না তো।’

মেয়ে এবার হাতে ট্রাম্প কার্ড পেয়ে গেছে, সে বলল, ‘তা হলে?’ বাবা অবাক হয়ে বললেন, ‘তা হলে?’ মেয়ে বলল, ‘শোনো। ভালবাসার ব্যাপার অন্যরকম। তখন সময় কাটে ঝড়ের বেগে। ওর সঙ্গে আমার বিয়ে হলে একেকটা মাস যাবে একটা দিনের মতো। একটা দিনের জন্যে দেড় হাজার টাকা এ বাজারেও কম নয়।’

সময় কিংবা টাকার এ ধরনের হিসেব হয়তো অনেকেই পছন্দ করবেন না। এর চেয়ে কঠিন হিসেব একটা জানি। কেউ হয়তো বিশ্বাস করবে না, কিন্তু ঘটনাটা সত্যি। কারণ ঘটনাটা আমাদের বাড়িতেই ঘটেছিল।

সামান্য বিশদ করে বলছি। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত আমাদের একটি প্রাচীন দেয়ালঘড়ি আছে। সেটাকে প্রত্যেক রবিবার সকালে দম দেওয়া হয়। ঘড়িটা দেয়ালে প্রায় সাড়ে ছয় ফিট উপরে লাগানো। আমি পায়ে বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে কায়ক্লেশে নাগাল পাই কিন্তু কয়েক বছর আগে একটা মিনিবাসে ডাইনোসর যুগের এক অতিকায় মহিলা চপ্পল পরিহিত আমার বাঁ এবং ডান দু’পায়ের উন্মুক্ত বুড়ো আঙুলকে একসঙ্গে দলিত এবং মথিত করলেন। তারপর থেকে পায়ের পাতায় ভর করে আর দাঁড়াতে পারি না। আমার স্ত্রী তিনি শত চেষ্টা করেও ঘড়ির কাছে পৌঁছতে পারেন না। আমার ভাই, বিজন, সেই এতদিন চাবি দিত। এখন এখানে নেই। আমার ছেলে এসব কাজ খুবই পছন্দ করে, কিন্তু যতবার সে ঘড়িতে দম দিয়েছে ততবার স্প্রিং কেটে গেছে। সাতবার চাবি ঘোরাতে হয় দম দেয়ার সময়, কিন্তু তাতে তার মন সন্তুষ্ট হয় না। আরও কষে দম দেয়, আর চাবি কেটে যায়। ইতিমধ্যে একটি ছোট ছেলে আমাদের বাড়িতে কাজে লেগেছিল। বয়েসের তুলনায় বেশ লম্বা, চমৎকার হাতে পায় ঘড়িটা। তাকে শিখিয়ে দিয়েছিলাম। প্রত্যেক রবিবার সকালে, লম্বা রোগা হাত তুলে সে গুণে গুণে পর পর সাতবার খুব নরম আর আলগা করে চাবি দিত। তাতেই বুড়ো ঘড়িটা সারা সপ্তাহ ঠিক চলত।

এই ছেলেটা, নাম ভৃগুলাল, বছর খানেক কাজ করবার পর একদিন দেশে যাবে। যেদিন সে দেশে যাবে আগের দিন ছিল রবিবার, ঘড়িটায় সাপ্তাহিক দম দেবার দিন।

ভৃগুলাল যথারীতি কাজকর্ম করছে। আমি বাইরের ঘরে বসে খবরের কাগজ পড়ছি। দেখলাম ঘড়িটায় দম দিচ্ছে। কিন্তু মাত্র একপাক দম দিয়েই সে থেমে গেল। আমি ভাবলাম ঘড়িটা খারাপ হয়ে গেল নাকি? স্প্রিংটা কি আটকিয়ে গেছে? আমি বলাম, ‘কীরে ভৃগুলাল, চাবিটা কি আটকে গেল? একবার মাত্র দম দিলি কেন?’ ভৃগুলাল নির্বিকার গম্ভীরমুখে বলল, ‘আমি তো আর কাল থেকে থাকছি না। তাই শুধু আজকের দিনের জন্য দমটুকু দিলাম।’

সবাই অবশ্য আমাদের ভৃগুলালের মতো সময়-সচেতন নয়। সময় বিষয়ে একেকজন একেক রকমভাবে ভাবনা করে। অনেকদিন আগে এক আধুনিক বাঙালি কবি লিখেছিলেন, ‘ঘড়িটা হঠাৎ কেন থেমে যায়?’

‘তোমরা কোথায়?’

ঘড়ি হল সময়ের প্রতীক। সে কারও কথায় থামে না বা চলে না। সে চলে তার নিজস্ব, নির্দিষ্ট গতিতে। নদীর স্রোতের জোয়ার-ভাঁটা, উঠতি-পড়তি, কম-বেশি গতি আছে। কিন্তু সময় চিরকাল সমগতি। সে কারও জন্যে কোথাও ছুটে যায় না, কারও জন্যে কোথাও অপেক্ষাও করে না।

পুনশ্চ: কয়েকদিন আগে চিড়িয়াখানায় গিয়েছিলাম। সেখানে দেখলাম হরিণদের নানারকম কাঁচা তরকারি কুটে খেতে দেওয়া হয়েছে। যে লোকটা খাবার দিচ্ছিল তাকে বললাম, ‘তরকারিগুলো সেদ্ধ করে দিলে হরিণদের তাড়াতাড়ি হজম হত।’ সে লোকটা ঠান্ডা গলায় বলল, ‘এসব জন্তু জানোয়ারের সময়ের কোনও অভাব নেই। একটু দেরি করে হজম হলে এদের কোনও অসুবিধা হবে না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *