2 of 8

সুপরামর্শ

সুপরামর্শ

এই পৃথিবীতে পরামর্শ দেওয়ার লোকের কোনও অভাব নেই, কখনও ছিল না। আপনি যদি একটু কাশেন, বলেন, “গলাটা কেমন ব্যথা-ব্যথা করছে’, সাতজন লোক আপনাকে সতেরো রকম উপদেশ বা পরামর্শ দেবে। সেই পরামর্শের মধ্যে নাক দিয়ে উষ্ণ নুন জল টেনে গলা দিয়ে বার করা থেকে হলুদ পাতা পুড়িয়ে সেই পোড়াপাতার গন্ধ শোঁকা পর্যন্ত বিচিত্র ও অসম্ভব যত নির্দেশ নিহিত। কে কী করে কাকে বোঝাবে যে নাক দিয়ে গরম জল টেনে গলা দিয়ে বার করা সহজ কর্ম নয়, কিংবা হলুদ গাছের পাতা জীবনে চোখে দেখিনি, কোথায় পাওয়া যায় তাও জানি না।

সব সময় সব পরামর্শ অবশ্য সংগত কারণেই গ্রহণযোগ্য নয়।

পাড়াগাঁয়ের এক কৃষকের বলদের পিঠে একটা ঘা হয়েছিল; বিশাল, দগদগে ঘা। বলদটা ক্রমশই কাহিল হয়ে পড়ছিল। এই সময়ে সেই কৃষকের দেখা হল পাশের গাঁয়ের এক কলুর সঙ্গে। কলু ওই কৃষকের জমির পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। কৃষক ভাবল কলুর বলদ সারাদিন ঘানি ঘোরায়, তারও পিঠে নিশ্চয় ঘা আছে। কৃষক কলুকে তার বলদটা দেখিয়ে বলল, ‘ভাই তোমার বলদের পিঠেও কি এই রকম ঘা আছে?’ কলু বলদের পিঠের ঘা ভাল করে দেখে তারপর বলল, ‘হ্যাঁ আমার বলদের পিঠেও এইরকম ঘা হয়েছিল।’ তারপর একটু থেমে বলল, ‘এখন আর নেই।’ কৃষক উৎসাহী হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ঘায়ে ওষুধ কিছু দিয়েছিলে? কলু বলল, ‘টোটকা ওষুধ দিয়েছিলাম। কলকে ফুলের রসের সঙ্গে ধুতরো ফলের শুকনো বীজ গুঁড়ো করে মলম বানিয়ে লাগিয়েছিলাম।’

কলুর এই পরামর্শ শুনে কৃষকও তার বলদকে ওই টোটকা মলম লাগাল এবং ওই বিষাক্ত মলমে কয়েকদিনের মধ্যেই বলদটি মারা পড়ল। পরের হাটবারে কলুর সঙ্গে আবার কৃষকের দেখা। কলুকে কৃষক বলল, ‘তোমার পরামর্শ মতো ওষুধ লাগিয়ে আমার বলদটা যে মারা গেল।’ কলু করুণ হেসে বলল, ‘ওই ওষুধ লাগিয়ে আমার বলদটাও মারা গিয়েছিল।’

এর পরের গল্পটি ঠিক এ রকম করুণ রসের নয় কিন্তু দৃষ্টান্তযোগ্য।

এক তস্কর কঠোর পরিশ্রম করে এবং গলদঘর্ম হয়ে গভীর নিশীথে এক গৃহে প্রবেশ করতে সমর্থ হল। গৃহস্থ বাড়িতে নেই, তার মূল্যবান দ্রব্যাদি রয়েছে একটি শক্ত লোহার আলমারিতে। তস্কর যখন লোহার আলমারিটা ভেঙে খুলতে যাচ্ছে, দেখল আলমারির গায়ে পরিষ্কার ছাপার অক্ষরে লেখা আছে, ‘অনুগ্রহ করে এই মূল্যবান আলমারি ভাঙবেন না। জোর করে খোলার দরকার নেই। এই পাশে একটা লাল রঙের সুইচ আছে, ওটা টিপলে আলমারি একা একাই খুলে যাবে।’

এই পরামর্শ পাঠ করে এবং কোনো রকম চিন্তা ভাবনা না করে তস্করটি লাল সুইচটা টিপল। সঙ্গে সঙ্গে সেই অন্ধকার বাড়ি আলোতে ভরে গেল, তীব্রস্বরে সাইরেন বাজতে লাগল, সিঁড়ি দিয়ে, বারান্দা দিয়ে দলে দলে সান্ত্রীরা ছুটে ওই ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল এবং তস্করকে গ্রেফতার করল।

পরামর্শ দান ও গ্রহণের আবার অন্য একটি দিকও আছে। এক মনস্তত্ত্ববিদ রোগিণীকে বলেছিলেন, ‘যদি কাউকে দেখে মনে বিরক্তি হয় তা হলে পারতপক্ষে তাঁকে এড়িয়ে চলবেন। মন ঠান্ডা থাকবে।’

মাস তিনেক পরে সেই রোগিণীর সঙ্গে রাস্তায় মনস্তত্ত্ববিদের দেখা। মনস্তত্ত্ববিদ বললেন, ‘কী হল আপনি তো আর আসেন না।’ রোগিণী বললেন, ‘সেই যে আপনি বলেছিলেন কোথাও বিরক্ত হলে যাবেন না। আপনার ওখানে আমার এত বিরক্ত লাগে, তাই আর যাই না।’

পরামর্শ বা উপদেশ দেবার অধিকারও থাকা চাই। হজরত মোহাম্মদকে নিয়ে সেই বিখ্যাত গল্পটি এই প্রসঙ্গে অবশ্যই স্মরণীয়।

হজরতের কাছে এক ব্যক্তি এসেছেন একটা পরামর্শ নিতে। ব্যাপারটা আর কিছুই নয়, লোকটি গরিব, তার মিছরি কেনার পয়সা নেই। কিন্তু তার ছেলে খুব মিছরি খেতে চায়। সে কী করবে? কী করে ছেলের মিছরি খাওয়া বন্ধ করবে।

হজরত লোকটিকে বললেন, ‘কয়েকদিন পরে এসো।’ কয়েকদিন পরে লোকটি এল, হজরত মোহাম্মদ তাকে বাস্তব পরামর্শ দিলেন কীভাবে ছেলের মিছরি খাওয়া আস্তে আস্তে কমিয়ে ছাড়িয়ে দেওয়া যাবে।

মোহাম্মদ পরামর্শ দেওয়ার পর একজন সঙ্গী তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি তো এই একই পরামর্শ কয়েকদিন আগেও দিতে পারতেন লোকটিকে, যখন ও প্রথমদিন আসে।’

হজরত মোহাম্মদ হেসে বললেন, ‘তখন যে আমি নিজেই মিছরি খেতে খুব ভালবাসতাম, খুব মিছরি খেতাম। আমি কী করে অন্যকে মিছরি খাওয়া ছেড়ে দিতে উপদেশ দিতাম?’

অবশ্য আপামর সাধারণ উপদেশদানের ব্যাপারে মোটেই সতর্ক নয়।

একটি কাল্পনিক শোকসংবাদ পড়েছিলাম, বিলিতি হাসির ম্যাগাজিনে।

মিস্টার গুড ওয়াকার

‘পথচারীদের জন্যে নির্দেশাবলি’ এবং ‘সাবধানে পথ চলুন’ পুস্তিকাদ্বয়ের লেখক মিস্টার ওয়াকার গতকাল দুপুরে ফ্লিট স্ট্রিটে গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেছেন।

অন্যকে পরামর্শ দিতে গিয়ে ওয়াকার সাহেব নিজেই মারা পড়েছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *