2 of 8

ভোজনালয়

ভোজনালয়

প্রথমেই অনেকদিন আগেকার একটা রদ্দি গল্প বলে নিচ্ছি। ঘটনাটা প্রায় পঁচিশ-তিরিশ বছর আগেকার, কিন্তু এখনও ভুলিনি, বোধহয় কখনওই ভুলব না।

ক্ষুধার্ত অবস্থায় শেয়ালদার কাছে একটা মাঝারি রেস্তোরাঁয় ঢুকে একটা মাংসের কাটলেটের অর্ডার দিয়েছিলাম। কিন্তু বেয়ারা কাটলেটটি পরিবেশন করবার পর খাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখি সেটা ভয়ংকর শক্ত। ছুরি-কাঁটা দিয়ে নানাভাবে নানা কায়দায় বিপুল প্রয়াস চালানোর পর ঘামতে ঘামতে বুঝতে পারলাম কাটলেটটি দুর্ভেদ্য; ঢাল বা বর্ম বানানোর জন্যে এ জিনিস চমৎকার কিন্তু গলাধঃকরণ করা অসম্ভব।

অবশেষে ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়ে বেয়ারাকে ডাকলাম, কাটলেটটির প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়ে বললাম, ‘এ জিনিস খাওয়া যাবে না। এটা ফেরত নিয়ে যাও।’

বেয়ারাটি অনেকক্ষণ আমার কাটলেটটি ভালভাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিরীক্ষণ করল। তারপর আপত্তি জানাল, ‘না স্যার, এটা ফেরত নেয়া যাবে না।’ আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেন ফেরত নেয়া যাবে না?’ বেয়ারাটি অম্লানবদনে বলল, ‘স্যার এটাকে আপনি একদম বেঁকিয়ে ফেলেছেন, এটা তো আর ফেরত হবে না।’

এই ঘটনার পর বহুকাল কোনও রেস্তোরাঁয় মাংসের কাটলেট অর্ডার দিতে সাহস করিনি। তবুও আরেকবার আরেকটা গণ্ডগোল হয়েছিল। ওই শেয়ালদা এলাকারই একটা রেস্তোরাঁয় গিয়ে বলি, ‘ফিশ ফ্রাই দাও’। বেয়ারা বলে, ‘মাছ ভাল হবে না, তার চেয়ে মাংসের কাটলেট দিই’। আমি বললাম, ‘না মাংসের কাটলেট নয়। ফিশ ফ্রাই দেবে।’ লোকটি কিছুতেই রাজি হচ্ছে না দেখে, হেড বেয়ারাকে ডেকে বললাম, ‘আমাকে একটা ফিশ ফ্রাই দিতে বলো’। হেড বেয়ারা বলল, ‘তার চেয়ে মাংসের কাটলেট নিন।’

বেশ কিছুক্ষণ আলাপ আলোচনা করেও হেড বেয়ারাকে ফিশ ফ্রাই দিতে রাজি করাতে পারলাম তখন উঠে রেস্তোরাঁর ম্যানেজার সাহেবের কাউন্টারে গিয়ে বললাম, ‘দেখুন আমি বারবার ফিশ ফ্রাই চাচ্ছি আর আপনার বেয়ারারা আমাকে মাংসের কাটলেট দিতে চাচ্ছে। ব্যাপারটা কী বলুন তো?’

ম্যানেজার সাহেব চোখ থেকে চশমা নামিয়ে আমাকে ভাল করে পর্যবেক্ষণ করে বললেন, ‘মাংসের কাটলেট খারাপ কী? ফিশ ফ্রাই জোর করছেন কেন?’ এরপরেও আমি আরেকবার কী ভরসায় ফিশ ফ্রাইয়ের আবেদন জানিয়েছিলাম তা বলতে পারব না, কিন্তু এর পরিণতি যা ঘটল তা রীতিমতো ভয়াবহ।

ম্যানেজার সাহেব, হেড ওয়েটার এবং প্রথম ওয়েটারটি পরস্পর চোখ চাওয়া-চাওয়ি করে নিজেদের মধ্যে কী এক নিঃশব্দ অথচ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিল, তারপর ম্যানেজার সাহেব আমাকে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘আমাদের সঙ্গে চালাকি করবেন না। আমরা বুঝতে পেরেছি, আপনি কার কাছ থেকে এসেছেন আর আপনি কার লোক।’

ম্যানেজার সাহেবের কথার আমি মাথামুণ্ডু কিছুই অনুধাবন করতে পারলাম না। আমি হতবাক হয়ে গেলাম। হেড ওয়েটার আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে ম্যানেজার সাহেবকে অনুচ্চ কণ্ঠে বলল, ‘স্যার আমি প্রথমেই বুঝতে পেরেছিলাম গঙ্গাবাবু একে পাঠিয়েছে, এ নিশ্চয় গঙ্গাবাবুর লোক।’

কে গঙ্গাবাবু? কেন তিনি আমাকে এখানে পাঠাবেন? এসব প্রশ্ন আমার মনে উদয় হওয়ার আগেই রেস্তোরাঁর ওয়েটাররা আমাকে ঠেলতে ঠেলতে রাস্তায় নামিয়ে দিল। পেছন থেকে ম্যানেজার সাহেব উচ্চকণ্ঠে বললেন, ‘খেতে এসেছ না গোলমাল পাকাতে এসেছ? গঙ্গারামকে বলে দিয়ো চালাকি করে বিশেষ সুবিধে হবে না।’

গঙ্গারামকে কোনওদিন এসব কথা আমার বলা হয়নি। কারণ, তার সঙ্গে আমার কখনও দেখা হয়নি, তাকে আমি চিনিই না।

আমার এক পরিচিত ভদ্রলোক রেস্তোরাঁর বেয়ারাকে খুব ভাল বখশিস দেন। তাঁকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আপনি যে বেয়ারাকে এত বখশিস দেন, তাতে আপনার কী লাভ হয়? আপনার কাটলেটটা কি আমাদের চেয়ে কম শক্ত হয়?’

ভদ্রলোক অতিশয় বিজ্ঞ হাসি হেসে বলেছিলেন, ‘তা নিশ্চয় হয় না। কিন্তু বেয়ারা কাটলেট কাটার জন্যে আমাকে যে ছুরিটা দেয় সেটাই রেস্তোরাঁর একমাত্র ধারালো ছুরি। বাকিগুলো সব ভোঁতা, তাই আপনারা কাটতে পারেন না।’

খারাপ খাবার নয়, রেস্তোরাঁর সবচেয়ে বিরক্তিকর জিনিস হল দেরি করা। বহু জায়গায় অর্ডার নিতেই ঘণ্টাখানেক লেগে যায়। আর একবার অর্ডার দিলে খাবার না আসা পর্যন্ত বন্দি, উঠে চলে যাওয়ার উপায় নেই।

ধৈর্য না হারানোর একটা কাহিনী বলি। এক ভদ্রলোক রেস্তোরাঁয় খেতে গিয়েছেন। ঘণ্টাখানেক বসে থাকার পরে এক বেয়ারা এক গেলাস জল এনে তাঁর সামনে রেখে উধাও হল। অনেকক্ষণ চেষ্টার পর ভদ্রলোক তাকে ধরে একটা মেনু চাইলেন। ঘণ্টাখানেক পরে তেল-হলুদ-মশলা মাখা একটা মেনু টেবিলের উপর ফেলে দিয়ে বেয়ারা আবার নিরুদ্দেশ। আরও ঘণ্টাখানেক বাদে ভদ্রলোক তাকে কবজা করে একটা স্যুপের অর্ডার দিলেন। স্যুপের অর্ডার নিয়ে যখন বেয়ারাটি আবার দ্রুত বিদায় নিচ্ছে, ভদ্রলোক তাকে ডাকলেন, ডেকে পকেট থেকে দুটো পোস্টকার্ড বার করে বললেন, ‘তোমার দিতে যদি খুব দেরি হয় চিঠি দিয়ে জানাবে, না হলে খুব চিন্তায় থাকব।’

ভদ্রলোক চিন্তায় থাকুন ইতিমধ্যে মেনুর প্রসঙ্গে একটা ঘটনা বলে নিই। এটি একটি দাম্পত্য আলাপ।

স্বামী বেচারি মেনু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলেন, হঠাৎ স্ত্রী বললেন, ‘ওগো মেনুটা কি উর্দুতে ছাপা নাকি?’ স্বামী বললেন, ‘কেন?’ স্ত্রী বললেন, ‘তাহলে তুমি যে ডানদিক থেকে বাঁদিকে পড়ছ।’ স্বামী বেচারার দোষ নেই, মহামূল্য সব খাবার, ডানদিকে তার দাম দেখে তারপর বাঁয়ে দেখছেন কী জিনিস।

অবশেষে একটা মধুর গল্প দিয়ে ভোজনালয় থেকে বেরোচ্ছি।

বহুদিন আগে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ কফি হাউসে একটা ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলাম। তখন চিনির এবং দুধের পটে আলাদা করে চিনি এবং দুধ দিত, এখনও হয়তো দেয় তবে অনেককাল ওদিকে যাইনি তাই বলতে পারব না। সে যা হোক আমার টেবিলের সামনের চেয়ারে এক অচেনা ভদ্রলোক বসেছিলেন। তিনি চিনির পট থেকে কম-সে-কম দশ থেকে বারো চামচ চিনি নিয়ে নিজের কফির পেয়ালায় ঢাললেন। তারপর চামচে দিয়ে চিনিটুকু না গুলে কফিটা খেতে লাগলেন। আমি অবাক হয়ে ব্যাপারটা দেখছিলাম এতক্ষণ, শেষে আর থাকতে না পেরে ভদ্রতার সাধারণ সীমা লঙ্ঘন করে ভদ্রমহোদয়কে বললাম, ‘চিনিটা গুলে নিলেন না?’ ভদ্রমহোদয় মুখটা বিকৃত করে বললেন, ‘বেশি মিষ্টি একদম খেতে পারি না।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *