2 of 8

শেষের সেদিন

শেষের সেদিন

কোথায়, কোন দেশে নাকি তাঁর ল্যাবরেটরিতে এক খামখেয়ালি জীববিজ্ঞানী একটি হাস্যবান হায়েনার সঙ্গে এক সদাবাত্ময়ী কাকাতুয়ার পরিণয় দিয়েছিলেন।

জীববিজ্ঞানীর উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল, এই পরিণয়জাত সংকর সন্তানটি পশু না পাখি বোঝা যায়নি, কিন্তু সে বাবার কাছ থেকে হা হা হাসি এবং মায়ের কাছ থেকে চমকপ্রদ কথা বলা এই দুটি জন্মসূত্রে অর্জন করে।

ফলে এই বিচিত্র জীবটি শুধু হা হা করে হেসেই ক্ষান্ত হত না, সঙ্গে সঙ্গে কাজের মাধ্যমে হাসির কারণ সর্বদাই ব্যাখ্যা করত।

এ অবশ্য নিতান্তই গল্প, মানে কল্পকথা। আজ এই শেষ বিদ্যাবুদ্ধিতে এ গল্পের খেই ধরতে যাব না। বিদ্যাবুদ্ধিতে বোকা হাসি এবং মোটা গল্প অনেক হয়েছে, এবার এই শেষ কিস্তিতে আমার জবাবদিহির পালা।

উত্তর কলকাতার প্রাচীন পাঠক থেকে আলিপুর আদালতের মাননীয় ব্যবহারজীবী পর্যন্ত কেউ কেউ কখনও কখনও বিদ্যাবুদ্ধির কোনও না কোনও স্খলন উল্লেখ করে পত্রাঘাত করেছেন। তাঁদের কাছে আমি যথার্থই কৃতজ্ঞ, তাঁদের চিঠি না পেলে জীবনে জানতে পারতাম না যে এমন প্রাজ্ঞ লোকেরা কষ্ট করে বিদ্যাবুদ্ধির মতো জোচ্চুরি করে লেখা পাঠ করেছেন, পাঠ করে বিরক্ত বোধ করেছেন। পয়সা খরচ করে চিঠি দিতেও তাঁদের কষ্ট কম হয়নি। তাঁদের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। তবে যাঁরা লিখেছেন বিদ্যাবুদ্ধির কিছু কিছু রসিকতা বিলিতি জোকবুকে তাঁরা খুজে পেয়েছেন, তাঁরা স্বভাবদোষে বিনয় প্রকাশ করেছেন, একটি রসিকতাও আমার নিজের নয়, সবই কোনও না-কোনও বই থেকে টোকা। আমার অক্ষম ভঙ্গিতে এবং নির্বোধ ভাষায় আমি শুধু সে গল্পগুলোকে সাজিয়েছি।

বিনীতভাবে জানাই, মহামহিম মার্ক টোয়েনসাহেব কিংবা চিরকিশোর শিবরাম চক্রবর্তী এবং গোপালভাঁড়, নাসিরুদ্দিন কিংবা প্রাতঃস্মরণীয় পরশুরাম অথবা সৈয়দ মুজতবা আলি, আমার এ মহাবিদ্যা তাঁদের কাছেই অধীত। রসিকতার ধারাই তাই।

মধ্যযুগে আরবদেশে একটা গল্প ছিল। যমজ ভাই দু’জন, আগাগোড়া একরকম দেখতে, তাঁদের মধ্যে একজন মারা গেছেন। এক বিদেশি বণিক এসে দ্বিতীয় জীবিত ভ্রাতাকে জিজ্ঞাসা করছে, ‘গতবার আপনার কিংবা আপনার ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। শুনলাম আপনি মারা গেছেন, নাকি আপনার ভাই ? আমি কি আপনার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছি নাকি আপনার সঙ্গে কথা বলছি ? আপনারা দু’জনে এত একরকম দেখতে, কিছুতেই ধরতে পারছি না।’

এ প্রশ্নের জবাব নেই। মার্ক টোয়েনসাহেব নিজের মতো করে চমৎকার লিখেছিলেন এই গল্প, পরে শিবরাম আরও চমৎকার। আর এই অধম ? সে এ গল্প লেখেনি, লেখার সাহস হয়নি তার, সে শুধু মুখে বলেছিল। বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ার মতো, একবার সে গিয়েছিল মার্কিন দেশে। সে দেশে সবই রহস্যময়। সেই রহস্যময়তা শুরু হয়েছে জন্মবৃত্তান্ত থেকে।

সবাই আমাকে জিজ্ঞাসা করত, আমি কে, আমি কোথা থেকে এসেছি ইত্যাদি উপনিষদীয় জটিল প্রশ্ন। সব প্রশ্নের জবাবে আমার ছিল একটিমাত্র উত্তর, একটিমাত্র গল্প, সে ওই যমজের গল্প।

গল্পটা বলি। গল্পটা আমার জন্মরহস্য নিয়ে।

আমার ঠাকুমা ছিলেন যমজ বোনের একজন। এক খরস্রোতা নদীর তীরে ছিল আমার বাবার মাতুলালয়। মানে আমার পূজনীয়া পিতামহীর পিত্রালয়। যখন আমার ঠাকুমা এবং তাঁর বোনের নয়-দশ বছর বয়স, একবার বাড়ির নদীর ঘাটে স্নান করতে গিয়ে, তাঁদের দু’জনের একজন জলে ভেসে যান, কে যে সঠিক ভেসে গিয়েছিলেন, আমার পিতামহী নাকি পিতামহীর বোন, তাঁর দেহ আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।

দু’জনেই ছিলেন হুবহু একরকম দেখতে, নাক চোখ একরকম, গায়ের রং, উচ্চতা সবই একরকম, কে যে কে বোঝা অসম্ভব। ফলে হল কী, যিনি জলে ভেসে গেলেন, তিনিই আমার পিতামহী নাকি তিনি ছিলেন পিতামহীর বোন তা কোনওদিন জানা যায়নি। আজ পর্যন্ত আমি জানি না, আমি আমার পিতামহীর পৌত্র নাকি আমার পিতামহীর বোনের পৌত্র। এই অসম্ভব জটিলতা, রহস্যময়তা আমার এই ক্ষুদ্র জীবনকে ঘিরে আছে।

বিশ্বাস করুন বা না করুন, বিদেশিরা তাজ্জব বনে যেত এই গল্প শুনে।

এবার একটি তথ্যের মধ্যে যাচ্ছি। গত ১৪ সেপ্টেম্বরের ‘দেশ’ পত্রিকায় শ্রীযুক্ত অরবিন্দ সামন্ত লিখেছেন কবিকঙ্কণে আলুর উল্লেখ আছে, সুতরাং আমি যে ‘গোপাল ভাঁড়’ নিবন্ধে লিখেছিলাম আলু অষ্টাদশ শতকের পরের ব্যাপার, সেটা ভুল।

সত্যিই কি ভুল ? আলু হল একপ্রকার মূল বা কন্দ। শব্দটি সংস্কৃত না ফরাসি সে বিষয়ে পণ্ডিতদের সন্দেহ আছে। সম্ভবত, আমার মনে হয় আলের মধ্যে যা জন্মায় তাই আলু এবং গোল আলু আমাদের দেশে খুব বেশিদিন আসেনি। এই সেদিন পর্যন্ত পুজোপার্বণে আলুর ব্যবহার নিষিদ্ধ ছিল, এখনও সে জলচল হয়নি।

এ সম্পর্কে উল্লেখ করা যেতে পারে ১৯০২ সালে নব্যভারত পত্রিকায় প্রাচীন আচার ব্যবহার নিবন্ধে প্রাণকৃষ্ণ দত্ত মহোদয় লিখেছিলেন, ‘এখন গোল আলু লোকের প্রধান তরকারি হইয়াছে। পিতামহেরা উহার নামগন্ধ জানিতেন না। এমনকী, ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দে স্টাভোরিনাস নামক ভ্রমণকারী কলিকাতার বাজারের যে সকল তরকারির তালিকা দিয়াছেন, তাহাতে বাঁধাকপি ও কড়াইশুঁটির উল্লেখ আছে, কিন্তু আলুর নাম নেই।’ (দ্রষ্টব্য, প্রাণকৃষ্ণ দত্ত প্রণীত কলিকাতার ইতিবৃত্ত, ১৯৮১ সংস্করণ, পৃ. ১০৭।)

অকারণে শেষমেষ কচকচির মধ্যে চলে যাচ্ছি। বরং তরল বিষয়ে চলে আসি।

সন্ন্যাসীরা যেমন স্বপ্নে মাদুলি পান তেমনি আমি ডাকে দু’-একটা চমৎকার গল্প পেয়েছি। সেগুলির সদ্ব্যবহার করি।

কাঁকুলিয়া রোড থেকে শ্রীমতী সুদেষ্ণা সরকার একাধিক ভাল গল্প পাঠিয়েছেন। একটা গল্প বিশুদ্ধ জলপান নিয়ে।

যখন আন্ত্রিক রোগের হিড়িক দেখা দিয়েছিল, তখন মিলিটারি সব ব্যারাকে যে কতরকমের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তা আর কহতব্য নয়।

ব্যারাক অধিকর্তা ক্যাম্প পরিদর্শনে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পানীয় জল জীবাণুমুক্ত রাখতে তোমরা কী কী ব্যবস্থা নিয়েছ ?’

‘আজ্ঞে, আমরা জলটা ভাল করে ফুটিয়ে নিই।’

‘বাঃ, বাঃ, এই তো চাই।’

‘তারপর আমরা জলের মধ্যে জীবাণুনাশক ওষুধ দিই।’

‘চমৎকার।’

‘এরপর আমরা সেই জল ফিলটার করি।’

‘চমৎকার। অতি চমৎকার।’

‘এবং তারপর আমরা নিরাপত্তার খাতিরে শুধু বিয়ার খাই। আজ তিন সপ্তাহ আমরা কেউ জল খাচ্ছি না।’

মদের প্রসঙ্গ অনিবার্যভাবে যখন এসেই পড়ল তা হলে বহরমপুরের লোকেন রায়কেও স্মরণ করতে হয়। তিনি আমাকে জানিয়েছেন, সেখানে এক ভাঁটিখানায় প্রতি সন্ধ্যায় কবির লড়াই হয়, সেখানে তিনি দেখেছেন এবং শুনেছেন, খালি বোতল বাজিয়ে গান হচ্ছে,

হুইস্কি ব্র্যান্ডি যাই বল না

বাংলা মদের নেই তুলনা।

মদমত্ত পাঠ করে উত্তেজিত হয়ে ইন্দ্র বিশ্বাস রোড থেকে আবদুস সালাম বিশ্বাস লিখেছিলেন, ‘মদ্যপায়ীদের নিয়ে অহেতুক যথেচ্ছাচার বিবেকবুদ্ধিকে প্রশংসিত না করে ধিক্কৃতই করে।’ ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারিনি তবে অনুমান করি বিশ্বাস সাহেব খুব ক্ষুব্ধ।

প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন ক্ষুদিরাম বসু রোডের বুদ্ধদেব কর। একটি কালো পতাকা পাঠিয়ে করমশায় আমাকে জানিয়েছেন, ‘কলকাতার বিভিন্ন সরাবখানায় আপনাকে আমরা ধিক্কার জানিয়েছি। ব্যক্তিগত প্রাতবাদ জানানোর জন্য একটি ক্ষুদ্র কালো পতাকা আপনাকে প্রদর্শন করলাম।’

শেষ করবার আগে একটি সুখবর দিই। দুর্গাপুর থেকে শ্রীআশীষ মজুমদার আমাকে একটি লটারির টিকিট উপহার পাঠিয়েছেন, তাঁর প্রথম পুরস্কার একটি বড় খাসি, দ্বিতীয় পুরস্কার তিনটি বড় মুরগি।

প্রতিযোগিতার ফলাফল এখনও জানি না। আমার যা ভাগ্য একটা পুরস্কার হয়তো পেয়েও যেতে পারি।

ইতি ১৩৯২ বঙ্গাব্দ, আশ্বিন মাস।

হাস্যোপাখ্যান বিদ্যাবুদ্ধি কাণ্ড সমাপ্ত।

পুনশ্চ: একটু দাঁড়ান। এবার যে যমজকাহিনী লিখেছি তাতে একটু বাদ আছে। সেদিন এক যমজ ভাইবোনকে দেখলাম। তারাও দু’জনে আগাগোড়া একরকম, শুধু বয়সের ব্যাপারটা ছাড়া। ভাইয়ের বয়স একচল্লিশ আর বোনের এখনও চৌত্রিশ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *