গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

১৩. কর্ণসুবর্ণ

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – কর্ণসুবর্ণ

প্রত্যূষে নিদ্রাভঙ্গ হইলে বজ্র প্রকোষ্ঠ হইতে বাহিরে আসিল। দেখিল সংঘের সকলেই জাগিয়া উঠিয়া নিজ নিজ কর্মে প্রবৃত্ত হইয়াছেন, মণিপদ্ম হাসিমুখে তাহার দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া আছে।

দুইজনে সংঘের বাহিরে আসিল। বজ্র বলিল— ‘ভাই, এবার তবে যাই। যদি এ-পথে ফিরি আবার দেখা হবে।’

মণিপদ্ম প্রশ্ন করিল— ‘কবে ফিরবেন?’

বজ্র বলিল— ‘তা জানি না। তুমি সংঘেই থাকবে তো?’

মণিপদ্ম একমুখ হাসিয়া বলিল— ‘হয়তো থাকব না। আর্য শীলভদ্র আমার প্রতি প্রসন্ন হয়েছেন, বলেছেন আমাকে নালন্দায় নিয়ে যাবেন।’

‘সে কবে?’

‘আর্য শীলভদ্র সমতট থেকে ফিরে এলে।’

বজ্র দেখিল, মণিপদ্মের মুখে চোখে উচ্ছলিত আনন্দ। সে জিজ্ঞাসা করিল— ‘নালন্দায় গিয়ে কি হবে? সেখানে কি তুমি অন্য কাজ করবে?’

মণিপদ্ম বলিল— ‘না, এখানে যে কাজ করছি সেখানেও তাই করব। কিন্তু সে যে নালন্দা— মহাতীর্থ! ভদন্ত শীলভদ্র ছাড়াও কত জ্ঞানী মহাপুরুষ, কত সিদ্ধ অর্হৎ আছেন। তাঁদের সেবা করে আমি ধন্য হব।’

মণিপদ্মের উদ্ভাসিত মুখের পানে চাহিয়া বজ্রের অন্তর ক্ষণেকের জন্য টলমল করিয়া উঠিল। মণিপদ্ম যে-পথে চলিয়াছে তাহা কেমন পথ, কোন্‌ আনন্দঘন শান্তিনিকেতনে তাহার শেষ? আর বজ্র যে-পথে পা বাড়াইয়াছে তাহারই বা সমাপ্তি কোথায়?

দুইজন বিপরীত পথের যাত্রী সংঘের সম্মুখে পরস্পর আলিঙ্গন করিল। তারপর বজ্র কর্ণসুবর্ণের পথ ধরিল।

কর্ণসুবর্ণ নগর একদিকে ভাগীরথী ও অন্যদিকে ময়ূরাক্ষী-ময়ূরীর সম্মিলিত ধারার দ্বারা পরিখীকৃত, তাই তাহার আকৃতি ত্রিভুজের ন্যায়; উত্তরে প্রশস্ত, দক্ষিণে ক্রমে সঙ্কীর্ণ হইয়া সঙ্গমস্থলে কোণের আকার ধারণ করিয়াছে। নগরের উত্তর প্রান্তে বিস্তীর্ণ প্রাকার স্থলপথে নগরকে সুরক্ষিত করিয়া রাখিয়াছে।

ত্রিকোণ স্থানটি আয়তনে বড় কম নয়, তাহার মধ্যে লক্ষাধিক লোকের বাস। তাহা ছাড়া প্রাকার পরিখার বাহিরেও বহুলোকের বসতি। দক্ষিণে মৌরীর পরপারে যাহারা বাস করে তাহারা অধিকাংশই নিম্নশ্রেণীর লোক, নগরে ফল ফুল শাক-পত্র যোগান দেওয়া তাহাদের জীবিকা।

কর্ণসুবর্ণ নূতন নগর; মথুরা বারাণসীর ন্যায় প্রাচীন নয়। তাহার পথগুলি ঋজু, গলিঘুঁজি বেশি নাই। পথের দুই ধারে নানা বর্ণের চূর্ণলিপ্ত দ্বিতল ত্রিতল গৃহ, গৃহচূড়ায় ধাতুকলস। পথে পথে বহু দেবদেবীর মন্দির, বৌদ্ধ চৈত্য মঠ। নগরের সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ রাজপথ গঙ্গার ধার দিয়া গিয়াছে। পথের পূর্ব ধারে অসংখ্য ছোটবড় ঘাট, স্নান ঘাট, খেয়া ঘাট, বন্দর। পথের অপর পাশে ধনী নাগরিক ও রাজপুরুষদিগের তুঙ্গশীর্ষ প্রাসাদ। এই পথ দক্ষিণদিকে যেখানে শেষ হইয়াছে সেই নদীরচিত কোণের উপর দুর্গাকৃতি রাজ-অট্টালিকা। পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে শশাঙ্কদেব গৌড়ের অধীশ্বর হইয়া এই জলদুর্গ নির্মাণ করিয়াছিলেন; তারপর দুর্গের ছায়াতলে নগর গড়িয়া উঠিয়াছে।

ভাগীরথী-তীরস্থ অগণ্য ঘাটের মধ্যে একটি ঘাট সর্বাপেক্ষা বৃহৎ— নাম হাতিঘাট। একশত রাজহস্তী এই ঘাটে একসঙ্গে স্নান করিতে পারে। শুধু তাই নয়, ইহাই নগরের বন্দর। ঘাটের সম্মুখে গভীর জলে বহু সমুদ্রগামী তরণী বাঁধা, তাহাদের ঊর্ধ্বোত্থিত গুণবৃক্ষ শরবনের ন্যায় জলপ্রান্ত কণ্টকিত করিয়া তুলিয়াছে। বণিক শ্রেষ্ঠীদের পণ্য ক্রয়বিক্রয়ের ইহা একটি প্রধান কেন্দ্র। আবার সাধারণ নগরবাসীর ইহা হট্টও বটে। মৎস্য হইতে আরম্ভ করিয়া কদলী কুষ্মাণ্ড অলাবু; মুড়ি চালভাজা পর্পট তিলখণ্ড; ফুল মালা কর্পূর চন্দন— কোনও বস্তুরই এখানে অপ্রতুল নাই। অপরাহ্ণে বায়ুসেবনেচ্ছু নাগরিকেরা এখানে সমবেত হয়; তখন বহুবিস্তীর্ণ ঘাটে তিল ফেলিবার ঠাঁই থাকে না। গান, পঞ্চালিকার নাচ, অহিতুণ্ডিকের সাপ খেলানো, মায়াবীর ইন্দ্রজাল; সব মিলিয়া ঘাট গম্‌গম্‌ করিতে থাকে।

বজ্র যেদিন প্রাতঃকালে কর্ণসুবর্ণে আসিয়া উপনীত হইল সেদিন নবারুণ কিরণে নগর ঝলমল করিতেছিল। চারিদিকে নবজাগ্রত নগরের কর্ম-চাঞ্চল্য, গো-রথ অশ্বরথ ঢল্লরিকা ঝম্পানের ছুটাছুটি। দেব-দেউলে কাসর-ঘণ্টা বাজিতেছে। স্নানার্থীরা ঘাটের দিকে চলিয়াছে, পূজার্থীরা মন্দিরে যাইতেছে; করণেরা তাম্বূলচর্বণ করিতে করিতে অধিকরণে চলিয়াছে। পথে পদচারীদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই অধিক, দুই চারিটি নারীও দেখা যায়। পুরুষদের মাথায় উষ্ণীষ নাই, তৈলসিক্ত কেশ কাঁধ পর্যন্ত পড়িয়াছে। সেকালে বাঙ্গালীর চুলের আদর বড় বেশি ছিল; পাছে কেশকলাপের শোভা ঢাকা পড়ে, তাই তাহারা মাথায় কোনও প্রকার আবরণ দিত না। কেবল যাহারা রাজপুরুষ বা সৈনিক তাহারা মাথায় পাগ পরিত।

বজ্র চারিদিক দেখিতে দেখিতে রাজপথে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। তাহার মুখ শান্ত, উত্তেজনার কোনও চিহ্ন নাই; মুখ দেখিয়া অনুমান করা যায় না যে তাহার মনের মধ্যে উত্তেজনার ঝড় বহিতেছে। সে পূর্বে কখনও নগর দেখে নাই; গ্রামে থাকিতে কল্পনা করিবার চেষ্টা করিত নগর কিরূপ। কিন্তু যাহা দেখিল তাহাতে তাহার কল্পনা বামন হইয়া গেল। সে ভাবিতে লাগিল— এই কর্ণসুবর্ণ নগর! এই আমার পিতৃ-পিতামহের লীলাভূমি!

জন্মান্তরের প্রীতিসূত্রের ন্যায় কর্ণসুবর্ণ নগর তাহার নাড়িতে টান দিল, দুর্নিবার বেগে আকর্ষণ করিতে লাগিল। কিন্তু সেই সঙ্গে একটি বিপরীত-মুখী মনোবৃত্তি যেন নিভৃতে থাকিয়া তাহাকে সতর্ক করিয়া দিতে লাগিল— বিম্ব দেখিয়া ভুলিও না, জলবিম্বের ভিতরে কিছু নাই, বুদ্বুদ ফাটিলে কিছুই থাকে না— সাবধান! সতর্ক হও!

লক্ষ্যহীন মোহাক্রান্তভাবে ঘুরিতে ঘুরিতে বজ্র এক মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া অনুভব করিল তাহার উদর শূন্য। ভাণ্ডারে থরে থরে মিষ্টান্ন সাজানো রহিয়াছে— দধি, ঘনাবর্ত দুগ্ধ, মোয়া, খাঁড়, পিঠাপুলি। মিষ্টগন্ধে আকৃষ্ট হইয়া বহু রক্ত-পীত বরলা আসিয়া জুটিয়াছে। নগ্নদেহ মোদক বসিয়া বৃহৎ কটাহে রসবড়া ভাজিতেছে।

বজ্র ময়রার দোকানে প্রবেশ করিল। কোমর হইতে কয়েকটি কড়ি ও ক্ষুদ্র ধাতুমুদ্রা বাহির করিয়া বলিল— ‘আমার কাছে এই আছে। এতে যা খাবার হয় আমাকে দাও।’

ময়রা দেখিল বিপুলকায় আগন্তুক কানসোনার লোক নয়, বিদেশী। সে পুত্রকে ডাকিয়া ভিয়ানে বসাইল, নিজে উঠিয়া গিয়া চত্বরের উপর পিঁড়ি পাতিয়া বজ্রকে বসিতে দিল। তারপর তাহার দোকানে যত প্রকার মিষ্টান্ন ছিল একে একে পরিবেশন করিতে লাগিল। সেকালে বাংলা দেশে খাদ্যদ্রব্য দুর্মূল্য ছিল না; বিশেষত সম্প্রতি বহির্বাণিজ্যে মন্দা পড়ায় দেশজাত সকল বস্তুই সুলভ হইয়াছিল। সোনারূপারই অভাব হইয়াছিল, অন্নবস্ত্রের অভাব কখনও হয় নাই।

ময়রা যত দিল বজ্র তত আহার করিল। আহার করিতে করিতে সে দেখিল একটি লোক দোকানের সম্মুখে দাঁড়াইয়া তাহাকে লক্ষ্য করিতেছে। লোকটি তালপত্রের ন্যায় কৃশ কিন্তু সাজসজ্জার পরিপাট্য অতি অদ্ভুত। পরিধানে সূক্ষ্ম মল্লের ধৌতি ও উত্তরীয়, মাথায় ফুলের মালা জড়ানো। হাতের নখ দীর্ঘ ও ত্রিকোণ করিয়া কাটা, তদুপরি আলতার প্রলেপ। অধরও অলক্তরাগে রঞ্জিত, কানে শঙ্খের কর্ণফুল। বৃশ্চিকপুচ্ছের ন্যায় বক্র একজোড়া গোঁফ, চক্ষু দুটি গোল, তাহার উপর ভ্রূযুগল আকৃষ্ট ধনুর ন্যায় চক্রীকৃত।

বজ্র এরূপ বিচিত্র জীব কখনও দেখে নাই। সে জানিত না কর্ণসুবর্ণের রসিক ও বিলাসী নাগরিকেরা এইরূপ বেশভূষা করিয়া নাগরবৃত্তি চরিতার্থ করিয়া থাকেন। সেও কৌতূহলী হইয়া লোকটিকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিল।

কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ চলিবার পর লোকটি উঠিয়া আসিয়া বজ্রের পাশে বসিল এবং আরও কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করিল। তাহার কাঁকড়াবিছার ন্যায় গোঁফ নড়িতে লাগিল। তারপর সে বিস্ময়-কৌতুকভরা মিহি সুরে হাসিয়া উঠিল। বলিল— ‘তুমি তো দেখছি একটি পিণ্ডবীর হে! দোকান প্রায় শেষ করে এনেছ, এবার কি ময়রাকে ধরে কামড় দেবে নাকি?’

বজ্র উত্তর দিল না, আপন মনে আহার করিতে লাগিল। লোকটি তাহা ঊরু ও বাহুর পেশী টিপিয়া দেখিতে দেখিতে বলিল— ‘হুঁ, একেবারে সাক্ষাৎ মধ্যম পাণ্ডব, যাকে বলে নরপুঙ্গব। তুমি তো কানসোনার লোক নয় বাপু। নাম কি? নিবাস কোথায়?’

বজ্র এবারও উত্তর দিল না। লোকটি তখন তাহার পঞ্জরে অঙ্গুলির একটা খোঁচা দিয়া বলিল— ‘আরে কথা কও না যে। তুমি বংগাল নাকি হে? বলি, কোন্‌ সুন্দরীবৃক্ষ থেকে নেমে এলে!’

ভাগীরথীর পূর্বপারে বংগাল দেশ। তথাকার ভাষার বিকৃতি লইয়া গৌড়ীয় নগরবিলাসীদের মধ্যে ব্যঙ্গ-পরিহাস চলিত।

বজ্র দেখিল, লোকটি বাড়াবাড়ি আরম্ভ করিয়াছে, তাহাকে আর প্রশ্রয় দেওয়া উচিত হইবে না। সে ডান হাতে আহার করিতে করিতে বাঁ হাত দিয়া লোকটির মণিবন্ধ চাপিয়া ধরিল। পাটকাঠির মত হাতের হাড় বজ্রের মুঠির মধ্যে মট্‌ মট্‌ করিয়া উঠিল। লোকটি মিহি গলায় চিৎকার করিয়া উঠিল— ‘আরে আরে, কর কি! উহুহু— ছাড় ছাড়, হাত ভেঙ্গে গেলে কাব্য লিখব কি করে?’

বজ্র হাত ছাড়িল না, মুঠি একটু শিথিল করিল মাত্র। নির্লিপ্তস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, ‘নাম কি?’

লোকটি দ্রুতকণ্ঠে বলিল— ‘নাম? আমার নাম বিম্বাধর— কবি বিম্বাধর। এবার ছেড়ে দাও বাবা, বাড়ি যাই।’

বজ্র প্রশ্ন করিল— ‘কবি বিম্বাধর কাকে বলে?’

বিম্বাধর বলিল— ‘কবি বিম্বাধর বুঝলে না? তুমি দেখছি একেবারেই— না না, তুমি ভারি সজ্জন। তা— আমার নাম বিম্বাধর কিনা, তার ওপর আমি কবি, কাব্য লিখি— তাই লোকে আমাকে কবি বিম্বাধর বলে। বুঝলে?’

বজ্রের আহার সমাধা হইয়াছিল, সে ঘটির জল গলায় ঢালিয়া জল পান করিল। বলিল— ‘বুঝলাম না। কাব্য কী?’

বিম্বাধর হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল, তাহার ধনুসাকৃতি ভ্রূযুগল আরও গোল হইয়া গেল। শেষে সে বলিল— ‘কাব্য কাকে বলে জান না! মেঘদূত পড়নি? নৈষধ? বল কি হে, তুমি যে অবাক করলে! কাব্য— কাব্য— রসের কথা— শ্লোক— কশ্চিৎ কান্তা— শৃঙ্গার রস—’

কিন্তু কাব্য কী তাহা অজ্ঞ ব্যক্তিকে বোঝানো সকলের কর্ম নয়, বিম্বাধর কবি হইয়াও তাহা বুঝাইতে পারিল না। বজ্রেরও বুঝিবার দুর্নিবার আগ্রহ ছিল না, সে বিম্বাধরের হাত ধরিয়া দোকানের বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। একটু হাসিয়া বলিল— ‘তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে ভালই হল। আমি নতুন লোক, তুমি আমাকে কানসোনা দেখিয়ে শুনিয়ে দিতে পারবে।’

বিম্বাধর বড় ফাঁপরে পড়িল। সে স্বভাবত লঘুপ্রকৃতি ও রঙ্গপ্রিয়; বজ্রকে মোদকালয়ে আহার করিতে দেখিয়া সে ভাবিয়াছিল ভোজনপটু গ্রামীণটাকে লইয়া দুদণ্ড রগড় করিয়া চলিয়া যাইবে। কিন্তু রগড় করিতে গিয়া অবস্থা দাঁড়াইয়াছে বিপরীত, গ্রামীণটাই তাহাকে বানর-নাচ নাচাইতেছে। তাহার বজ্রমুষ্টি ছাড়াইয়া যে পলায়ন করিবে সে উপায় নাই, যেমন দৈত্যের মত চেহারা, জোরও তেমনি।

বিম্বাধর মনে মনে পলায়নের ফন্দি খুঁজিতেছে, এমন সময় রাস্তার দক্ষিণ দিক হইতে বাঁশি বাজিয়া উঠিল। বজ্র সেইদিকে দৃষ্টি ফিরাইয়া দেখিল, একটি চতুর্দোলা আসিতেছে। চারিজন অসুরাকৃতি বাহক দোলা স্কন্ধে বহন করিয়া আনিতেছে। দোলার সম্মুখে পশ্চাতে কয়েকজন বংশীবাদক মিঠা সুরে বাঁশি বাজাইতে বাজাইতে চলিয়াছে। একটি দাসী সোনার থালায় পুষ্প-অর্ঘ্য লইয়া দোলার পাশে পাশে যাইতেছে।

চতুর্দোলা কাছে আসিতে লাগিল। চতুর্দোলার আসনে দুকূল-বস্ত্রের বেষ্টনীমধ্যে যিনি বসিয়া আছেন তাঁহাকে স্পষ্ট দেখা যায় না, তবু অনেকখানি অনুমান করা যায়; মনে হয় যেন শীত-প্রভাতে হিমাচ্ছন্ন সরোবরের মাঝখানে স্বর্ণকমল ফুটিয়া আছে। যে দাসীটি পাশে পাশে চলিয়াছে সে মাঝে মাঝে মুখ তুলিয়া অন্তরালবর্তিনীর সহিত হাসিয়া কথা কহিতেছে। দাসীটি লোলযৌবনা, দেহের বর্ণ অতসী পুষ্পের ন্যায়, কিন্তু সে রূপসী। তাহার নাম কুহু। কুহু শুধু রূপসী নয়, চটুলা ছলনাময়ী রতি-রস-চতুরা।

কিন্তু কুহুর কথা পরে হইবে।

চতুর্দোলা বজ্রের সম্মুখ দিয়া যাইবার সময় সহসা তাহার আবরণ উন্মোচন হইল। যিনি এতক্ষণ অচ্ছাব তিরস্করিণীর অন্তরালে রহস্যময়ী হইয়া ছিলেন বজ্র তাহাকে মুখোমুখি দেখিতে পাইল। অত্যুগ্র আলোকে মানুষের যেমন চোখ ঝলসিয়া যায়, বজ্রেরও তেমনি চক্ষু ধাঁধিয়া গেল।

দোলার পর্দা দুই হাতে সরাইয়া রমণী তাহার দিকেই চাহিয়া আছেন। ওষ্ঠাধর ঈষন্মুক্ত, চক্ষুতারকা নিশ্চল, স্তনপট্ট অল্প স্খলিত, দেহভঙ্গিতে মদালসতার সহিত প্রগল্‌ভতা মিশিয়াছে। রমণী নবযুবতী নয়, প্রগাঢ়যৌবনা; তন্বী নয়, পরিপূর্ণাঙ্গী; গায়ের রঙ দুধে-আলতা, আলতার ভাগ কিছু বেশি। চক্ষু দুটি হরিণায়ত, কিন্তু দৃষ্টিতে তীব্রতা মাখানো; অধর পক্ক-বিম্বফলের ন্যায় সুপুষ্ট ও গাঢ় রক্তবর্ণ, আবার নবপল্লবের ন্যায় কোমল। সব মিলিয়া মুখখানি অপূর্ব সুন্দর, কিন্তু সৌন্দর্য ছাড়াও মুখে এমন কিছু আছে যাহা পুরুষের স্নায়ু-শোণিতে আগুন ধরাইয়া দেয়, বুকে উন্মাদনার সৃষ্টি করে।

নারী নয়, ললৎ-শিখা লালসার বহ্নি।

বজ্র চাহিয়া রহিল, দোলা তাহার সম্মুখ দিয়া দূরে চলিয়া যাইতে লাগিল। রমণী কিন্তু একদৃষ্টি তাহার পানে চাহিয়া রহিলেন। চাহিয়া দেখিতে দেখিতে তিনি অস্ফুটস্বরে দাসীকে কিছু বলিলেন; অমনি দাসী ঘাড় ফিরাইয়া বজ্রের দিকে চাহিল।

দাসীর চোখে বিজলী খেলিয়া গেল; সে মুখ টিপিয়া একটু হাসিল। তারপর দেখিতে দেখিতে দোলা দৃষ্টিবহির্ভূত হইয়া গেল। বাঁশির রেশও ক্ষীণ হইয়া মিলাইয়া গেল।

কবি বিম্বাধর এতক্ষণ শিকলে বাঁধা পাখির ন্যায় ছট্‌ফট্‌ করিতেছিল এবং বজ্রের মুঠি হইতে হাত ছাড়াইবার চেষ্টা করিতেছিল। এখন বজ্র তাহার দিকে ফিরিতেই সে বলিয়া উঠিল, ‘দেখলে তো? কানসোনায় আর কিছু দেখবার নেই। এবার হাতটি ছেড়ে দাও, বাড়ি গিয়ে শ্লোক লিখি। মাথায় পদ্য এসেছে।’

বজ্র জিজ্ঞাসা করিল— ‘দোলায় যিনি গেলেন— উনি কে?’

বিম্বাধর বলিল— ‘হায় হতভাগ্য, তাও জান না! রানী— রানী, গৌড়ের রাজমহিষী দেবী শিখরিণী।’

রানী! হাঁ, রানীর মত রূপ বটে। সঙ্গে সঙ্গে বজ্রের মনে পড়িল তাহার মায়ের মুখ। না, এ রানী বয়সে তরুণী বটে, কিন্তু তাহার মায়ের মত সুন্দর নয়। রঙ্গনা রাজহংসী, আর শিখরিণী চক্রবাকী; উভয়ের তুলনা হয় না।

উপরন্তু রানীর হাবভাব যেন নির্লজ্জতার সূচক! কিন্তু কিছুই বলা যায় না, রানীদের পক্ষে এইরূপ হাবভাবই হয়তো স্বাভাবিক। বজ্র অনভিজ্ঞ গ্রামবাসী, নগরের রীতিনীতি আচার-আচরণ কী বুঝিবে?

বজ্রের চিন্তায় বাধা দিয়া বিম্বাধর বলিল— ‘ভ্রাতঃ চাতক, তুমি যে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলে। তা আমার হাতটি মোচন করে হতভম্ব হলেই পার। হাতে যে ঝিন্‌ঝিনি ধরে গেল।’

বজ্র জিজ্ঞাসা করিল— ‘রানী কোথায় গেলেন?’

বিম্বাধর বলিল— ‘মন্দিরে পূজা দিতে গেলেন। ঐ যে চতুষ্পথের ওপারে প্রকাণ্ড মন্দির— কামেশ্বর শিবের মন্দির— রানী ওখানে প্রায়ই পূজা দিতে যান। তা তুমিও যাও না, দেবমন্দিরে যেতে কারুর মানা নেই। যাও যাও, রথ দেখাও হবে, কলা বেচাও হবে।’

বিম্বাধরের বক্রোক্তি না বুঝিয়া বজ্র বলিল— ‘না, আমার অন্য কাজ আছে।’

বিম্বাধর আনন্দিত হইয়া বলিল— ‘বেশ বেশ। তাহলে আর দেরি করে কাজ নেই, বিলম্বে কার্যহানি। তুমি নিজের কাজে যাও, আমিও বাড়ি গিয়ে শ্লোকটা লিখে ফেলি। এবার হস্তটি উন্মোচন কর।’

বজ্র বলিল— ‘উন্মোচন করতে পারি, কিন্তু তোমাকে একটি কাজ করতে হবে। আমি এখানে কিছু চিনি না, আমাকে একটি স্বর্ণকারের দোকান দেখিয়ে দিতে হবে।’

বিম্বাধর অমনি উৎকর্ণ হইল। ক্ষিপ্রদৃষ্টিতে একবার বজ্রের আপাদমস্তক দেখিয়া লইয়া বলিল— ‘স্বর্ণকারের দোকান! সোনাদানা কিনবে নাকি?’

বজ্র মৃদু হাসিয়া বলিল— ‘কিনব না। — দেখিয়ে দিতে পারবে?’

বিম্বাধর বজ্রের বাহুতে তাগা-বাঁধা লক্ষ্য করিয়াছিল, সোৎসাহে বলিল— ‘পারব না! সোনা বিক্রি করবে বুঝি? এতক্ষণ বলনি কেন? এস এস, এই যে কাছেই স্যাকরার বাড়ি—’

বজ্র বিম্বাধরের হাত ছাড়িয়া দিল। বিম্বাধরের পলায়ন-স্পৃহা আর ছিল না; যেখানে সোনারূপার গন্ধ আছে সেখান হইতে কবি বিম্বাধরকে মারিয়া তাড়ানো যায় না। এতক্ষণ সে বজ্রকে কপর্দকহীন গ্রামীণ মনে করিয়াছিল বলিয়াই পলায়নের চেষ্টা করিতেছিল, এখন জোঁকের মত তাহার গায়ে জুড়িয়া গেল।