গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

১২. শীলভদ্র

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – শীলভদ্র

রক্তমৃত্তিকার মহাবিহার এক পাটক* ভূমির উপর অবস্থিত। তিন দিকে প্রাচীর, পিছনে গঙ্গা। বিহার ভূমির মধ্যস্থলে উচ্চ ত্রিভূমক হর্ম্য। নিম্নতল প্রশস্ত, দ্বিতল তদপেক্ষা ক্ষুদ্র, ত্রিতল আরও ক্ষুদ্র; স্তূপের আকৃতি। এই স্তূপসদৃশ ভবনের মধ্য-তলে শাক্যমুনির দিব্য দেহাবশেষ রক্ষিত আছে।

এই গন্ধকুটিকে কেন্দ্র করিয়া চারিপাশে সারি সারি ভিক্ষুগণের প্রকোষ্ঠ। অগণিত প্রকোষ্ঠ, প্রত্যেকটিতে একজন ভিক্ষু বাস করেন। প্রকোষ্ঠগুলি নিরাভরণ, শয়নের জন্য একটি কাঠের পাটাতন ও একটি জলের কুম্ভ; অন্য কোনও তৈজস নাই।

বজ্র এদিক-ওদিক দৃক্‌পাত করিতে করিতে চলিল। অধিকাংশ পরিবেণই শূন্য, ভিক্ষুরা পরিক্রমণের জন্য গঙ্গার তীরে গিয়াছেন; শরীর রক্ষার জন্য ইহা তাঁহাদের নিত্য কর্ম। কদাচিৎ একটি দুইটি ভিক্ষু পরিবেণের কবাটহীন দ্বারের কাছে বসিয়া পুঁথি পড়িতেছেন। সন্ধ্যার মন্দালোকে নত হইয়া তাঁহারা পাঠে নিমগ্ন; বজ্রকে চক্ষু তুলিয়া দেখিলেন না।

ঘুরিতে ঘুরিতে অবশেষে বজ্র বিহারের পশ্চাদ্দিকে এক চত্বরের নিকট উপস্থিত হইল। বৃহৎ গোলাকৃতি চত্বর, তাহার মধ্যস্থলে বসিয়া দুইটি বৃদ্ধ লঘু স্বরে আলাপ করিতেছেন। একটি বৃদ্ধ স্থূল ও খর্বকায়, মুখে মেদমণ্ডিত প্রসন্নতার সহিত পদাভিমানের গাম্ভীর্য। অন্য বৃদ্ধটি সম্পূর্ণ বিপরীত; দীর্ঘ দেহ ক্ষীণ ও তপঃকৃশ, স্কন্ধ হইতে মস্তক সম্মুখদিকে একটু অবনত হইয়া পড়িয়াছে; মুখে মাংসলতার অভাববশত চিবুক ও হনুর অস্থি তীক্ষ্ণভাবে প্রকট হইয়া আছে। ইঁহার মুখভাব হইতে পদবী অনুমান করা যায় না, নিম্নতম শ্রেণীর শ্রমণও হইতে পারেন। কিন্তু অন্য বৃদ্ধটি যেরূপ সম্ভ্রমের সহিত তাঁহাকে সম্ভাষণ করিতেছেন তাহাতে মনে হয় ইনি সামান্য ব্যক্তি নয়।

বজ্র চত্বরের প্রান্তে গিয়া দাঁড়াইলে দুইজনে চক্ষু তুলিয়া তাহার পানে চাহিলেন, তাঁহাদের বাক্যালাপ স্থগিত হইল। বজ্র সসম্ভ্রমে তাঁহাদের সম্বোধন করিল— ‘মহাশয়, আমি দূরের পান্থ, কর্ণসুবর্ণে যাব। আজ রাত্রির জন্য সংঘে আশ্রয় পাব কি?’

স্থূলকায় বৃদ্ধটি বলিলেন— ‘অবশ্য।’

তিনি এক হস্ত উত্তোলন করিতেই একটি অল্পবয়স্ক শ্রমণ আসিয়া তাঁহার পাশে দাঁড়াইল। তিনি বলিলেন— ‘মণিপদ্ম, অতিথির পরিচর্যা কর।’

অন্য বৃদ্ধটি এতক্ষণ অপলক নেত্রে বজের পানে চাহিয়া ছিলেন, তাঁহার শান্ত মুখে ক্রমশ বিস্ময়ের ভাব ফুটিয়া উঠিতেছিল। শ্রমণ মণিপদ্ম যখন অন্য বৃদ্ধের আদেশ পালনের জন্য বজ্রের দিকে পা বাড়াইল তখন তিনি তাহাকে ডাকিয়া নিম্নস্বরে কিছু বলিলেন। মণিপদ্ম গভীর শ্রদ্ধায় নত হইয়া তাঁহার কথা শুনিল, তারপর বজ্রের কাছে আসিয়া বলিল— ‘ভদ্র, আসুন আমার সঙ্গে।’

মণিপদ্ম প্রথমে বজ্রকে গঙ্গার তীরে লইয়া গেল। বিস্তীর্ণ ঘাটে রাত্রির ছায়া নামিয়াছে, জলের উপর ধূসর আলোর ম্লান প্রতিফলন। ঘাটের পৈঠাগুলির উপর পরিক্রমণরত ভিক্ষু শ্রমণের নিঃশব্দ ছায়ামূর্তি। কেহ কাহারও সহিত কথা বলিতেছে না, ক্ষণেকের জন্য গতি বিলম্বিত করিতেছে না, যন্ত্রচালিত পুত্তলিকার ন্যায় ঘাটের এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত পাদচারণা করিতেছে। দৃষ্টি ভূমিনিবদ্ধ, বক্ষ বাহুবদ্ধ। এমন প্রায় তিন চারিশত শ্রমণ। বজ্র দেখিল, সংঘ নিতান্ত জনহীন নয়।

ঘাটে হস্ত মুখ প্রক্ষালনের পর বজ্রকে লইয়া মণিপদ্ম এক প্রকোষ্ঠে উপনীত হইল। ইতিমধ্যে প্রকোষ্ঠগুলিতে দীপ জ্বলিতে আরম্ভ করিয়াছে, কয়েকজন শ্রমণ বর্তিকাহস্তে দ্বারে দ্বারে দীপ জ্বালাইয়া ফিরিতেছে। মণিপদ্ম প্রকোষ্ঠে দীপ জ্বালিয়া একপাশে রাখিল, বলিল— ‘আপনি বিশ্রাম করুন, আমি আপনার আহার্য নিয়ে আসি।’

মণিপদ্ম চলিয়া গেল, বজ্র প্রকোষ্ঠে বসিয়া রহিল। ক্রমে আশেপাশের পরিবেণগুলিতেও জনসমাগম হইতে লাগিল। ভিক্ষুরা সান্ধ্যকৃত্য সমাপন করিয়া আসিয়াছেন। কিন্তু কোথাও চঞ্চলতার আভাস নাই। অল্প আলোকে ছায়ার ন্যায় সঞ্চরমাণ মানুষগুলি; কদাচিৎ নিম্নস্বর বাক্যালাপের গুঞ্জন; যেন ভৌতিক লোকের অবাস্তব পরিমণ্ডল।

তারপর গন্ধকুটি হইতে মধুর-স্বনে ঘণ্টিকা বাজিতে লাগিল। ভিক্ষুগণ স্ব স্ব কক্ষ ছাড়িয়া সেইদিকে যাত্রা করিলেন। সেখানে ভগবান তথাগতের পূজার্চনা হইবে, তারপর ভিক্ষুদের নৈশ ভোজন।

পূজার্চনার ঘণ্টিকা নীরব হইবার কিয়ৎকাল পরে মণিপদ্ম বজ্রের আহার্য লইয়া উপস্থিত হইল। আহার্যের মধ্যে ঘৃতপক্ক তণ্ডুল ও গোধূমের একটা পিণ্ড এবং ফলমূল; কিন্তু পরিমাণে প্রচুর। বজ্র আহারে বসিল; মণিপদ্ম সম্মুখে নতজানু হইয়া পরিবেশন করিল।

শ্রমণ মণিপদ্ম বজ্রেরই সমবয়স্ক। সুশ্রী ক্ষীণাঙ্গ প্রফুল্ল-মুখ যুবক; মুণ্ডিত মস্তক ও পীত বস্ত্র তাহার মনের সরসতা মুছিয়া ফেলিতে পারে নাই। তাহার বৈরাগ্য সহজ আনন্দেরই রূপান্তর। বজ্র আহার করিতে করিতে তাহার সহিত দুই চারিটি বাক্যালাপ করিল; দেখিল মণিপদ্মের বুদ্ধিদীপ্ত মনে কোনও কৌতূহল নাই, উচ্চাকাঙ্ক্ষাও নাই; সকলের আজ্ঞাধীন হইয়া অন্যের সেবা করাই তাহার আনন্দময় স্বধর্ম।

আহার সমাধা হইলে মণিপদ্ম বলিল— ‘ভদ্র, একটি অনুরোধ আছে। যদি ক্লেশ না হয়, আর্য শীলভদ্র আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।’

বজ্র বলিল— ‘ক্লেশ কিসের? কিন্তু আর্য শীলভদ্র কে?’

মণিপদু বলিল— ‘সদ্ধর্মভাণ্ডার আর্য শীলভদ্রের নাম শোনেন নি?’

বজ্র মাথা নাড়িল— ‘না। কে তিনি?’

মণিপদ্ম বিস্ময়াহতভাবে চাহিয়া রহিল। শীলভদ্রের নাম জানে না এমন মানুষ আছে? যাঁহার শিষ্যত্ব গ্রহণ করিবার আশায় সুদূর চীনদেশ হইতে গুণগ্রাহীরা ছুটিয়া আসে, দেশের লোক সেই শীলভদ্রের নাম জানে না! শেষে মণিপদ্ম বলিল— ‘আমার ধারণা ছিল শীলভদ্রের নাম সকলেই জানে। তিনি নালন্দা বিহারের মহাধ্যক্ষ; তাঁহার মত জ্ঞানী পৃথিবীতে নেই।’

বজ্র দীনকণ্ঠে বলিল— ‘ভাই, আমি গ্রামের ছেলে, পৃথিবীর কিছুই জানি না। আর্য শীলভদ্র আমার সঙ্গে দেখা করতে চান কেন?’

‘তা জানি না। তিনি আদেশ করেছেন, যদি আপনার ক্লেশ না হয়, আহারের পর আপনাকে তাঁর কাছে নিয়ে যেতে।’

‘আমি প্রস্তুত। আজ সন্ধ্যাবেলা যে দুটি বৃদ্ধকে দেখলাম, ইনি কি তাঁদেরই একজন?’

‘হাঁ। যিনি শীর্ণকায় অশীতিপর বৃদ্ধ তিনি।’

‘আর অন্যটি?’

‘তিনি এই রক্তমৃত্তিকা বিহারের মহাস্থবির।’

অতঃপর মণিপদ্ম বজ্রকে লইয়া কক্ষ হইতে বাহির হইল। গন্ধকুটির নিম্নতলে এক কোণে একটি প্রকোষ্ঠে শীলভদ্র বসিয়া আছেন। কক্ষটি সাধারণ পরিবেণের মতই ক্ষুদ্র ও নিরাভরণ। শীলভদ্র দীপের সম্মুখে বসিয়া একটি তালপত্রের পুঁথি দেখিতেছিলেন; অশীতি বৎসর বয়সেও তাঁহার চোখের জ্যোতি ম্লান হয় নাই। বজ্র ও মণিপদ্ম তাঁহার দ্বারপ্রান্তে আসিয়া দাঁড়াইলে তিনি মণিপদ্মকে বলিলেন— ‘মণিপদ্ম, তুমি এবার আহার কর গিয়ে। আজ রাত্রে তোমার সেবার আর প্রয়োজন নেই বৎস।’

মণিপদ্ম হাসিমুখে প্রণাম করিয়া চলিয়া গেল। শীলভদ্র বজ্রকে বলিলেন— ‘এস, উপবেশন কর।’

বজ্র আসিয়া শীলভদ্রের সম্মুখে এক পীঠিকায় বসিল। শীলভদ্র পুঁথি বন্ধ করিয়া সূত্র দিয়া বাঁধিতে বাঁধিতে বজ্রকে নিরীক্ষণ করিলেন, তাহার বাহুতে অঙ্গদ দেখিলেন, তারপর বলিলেন— ‘তোমার নাম কি বৎস?’

বজ্র বলিল— ‘আমার নাম বজ্রদেব।’

শীলভদ্র তখন ধীরস্বরে বলিলেন— ‘আমি তোমাকে দু’ একটি প্রশ্ন করব, ইচ্ছ না হয় উত্তর দিও না। আজ সন্ধ্যায় তোমাকে দেখে অনেক দিনের পুরানো কথা মনে পড়ে গেল, তাই তোমাকে ডেকেছি। আমার পরিচয় বোধহয় শুনেছ। আমি শীলভদ্র, নালন্দা বিহারের অধ্যক্ষ, প্রাচীমণ্ডলের বিহারগুলি পরিদর্শনের জন্য বেরিয়েছি; এখান থেকে সমতট যাব। সমতট আমার জন্মস্থান। * মৃত্যুর পূর্বে একবার জন্মভূমি দেখবার ইচ্ছা হয়েছে। তারপর, যদি বুদ্ধের ইচ্ছা হয়, আবার এই পথে নালন্দায় ফিরে যাব।’

শীলভদ্র একটু হাসিয়া নীরব হইলেন; যেন নিজের পরিচয় দিয়া বজ্রকেও পরিচয় দিবার জন্য আহ্বান করিলেন। বজ্র তাঁহার শান্ত মুখের পানে চাহিয়া অনুভব করিল ইনি সাধারণ কৌতূহলী মানুষ নয়, অন্য স্তরের মানুষ। চাতক ঠাকুরের সহিত ইঁহার আকৃতির কোনই সাদৃশ্য নাই, কিন্তু তবু যেন কোথায় মিল আছে। বজ্র স্থির করিল ইঁহার কাছে কোনও কথা গোপন করিবে না। সে বলিল— ‘আপনি প্রশ্ন করুন, আমি উত্তর দেব।’

শীলভদ্র তাহার মুখভাব লক্ষ্য করিতেছিলেন, বলিলেন— ‘তুমি বুদ্ধিমান। তোমার পিতার নাম কি?’

‘আমার পিতার নাম শ্রীমানবদেব।’

স্মিতহাস্যে শীলভদ্রের চক্ষুপ্রান্ত কুঞ্চিত হইল; তিনি বলিলেন— ‘আমার অনুমান মিথ্যা নয়। তুমি মানবদেবের পুত্র, শশাঙ্কদেবের পৌত্র। ত্রিশ বছর আগে তোমার পিতাকে আমি দেখেছিলাম। তখন তাঁর বয়স ছিল তোমারই মত।’

বজ্র ব্যগ্রস্বরে জিজ্ঞাসা করিল— ‘আমার পিতা কোথায়? তিনি কি এখন গৌড়ের রাজা নয়?’

শীলভদ্র করুণনেত্রে চাহিয়া বলিলেন— ‘না। কিন্তু আগে তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও, তোমার প্রশ্নের উত্তর আমি পরে দেব।’

শীলভদ্রের প্রশ্নের উত্তরে বজ্র নিজ জন্ম ও জীবন-কথা, মাতার মুখে যেমন শুনিয়াছিল সমস্ত অকপটে বলিল; কর্ণসুবর্ণে আসার উদ্দেশ্যও প্রকাশ করিল। শুনিয়া শীলভদ্র দীর্ঘকাল নীরব রহিলেন। শেষে কোমলস্বরে বলিলেন— ‘বৎস, তোমার পিতা জীবিত নেই। তুমি কর্ণসুবর্ণে যেও না; সেখানে এমন লোক এখনও জীবিত আছে যারা তোমার পিতাকে চিন্‌ত, তোমাকে দেখলে মানবদেবের পুত্র বলে চিন্‌তে পারবে। সেটা তোমার পক্ষে শুভ হবে না। তুমি তোমার গ্রামে ফিরে যাও, আর তুমি যে মানবদেবের পুত্র এ কথাটা গোপন রাখার চেষ্টা কোরো।’

বজ্র বলিল— ‘কিন্তু আপনি কি স্থির জানেন আমার পিতা জীবিত নেই?’

শীলভদ্র বলিলেন— ‘তোমার পিতার সম্বন্ধে যা জানি বলছি। ত্রিশ বছর আগে শশাঙ্কদেব গৌড়ের রাজা ছিলেন; মানবদেব ছিলেন যুবরাজ। তখন হর্ষবর্ধনের সঙ্গে শশাঙ্কদেবের যুদ্ধ চলছে। হর্ষবর্ধন ছিলেন বৌদ্ধ; তাই যুদ্ধের উত্তেজনায় শৈবধর্মী শশাঙ্ক গৌড়ের বৌদ্ধদের ওপর কিছু উৎপীড়ন আরম্ভ করেছিলেন। এই সংবাদ পেয়ে আমি নালন্দা থেকে গৌড়ের রাজসভায় শশাঙ্কদেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসি। তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলোচনা হয়। যুবরাজ মানবদেবও আলোচনায় যোগ দিয়েছিলেন, তিনি আমার পক্ষ সমর্থন করেছিলেন। ফলে আমি সিদ্ধমনোরথ হয়ে নালন্দায় ফিরে যাই, শশাঙ্ক তারপর আর কারও ধর্মের ওপর হস্তক্ষেপ করেন নি। তোমার পিতার সঙ্গে সেই একবার মাত্র আমার সাক্ষাৎ। তারপর ত্রিশ বছর কেটে গেছে, কিন্তু আজ তোমাকে দেখেই তাঁর মুখ স্মরণ হয়েছিল।

‘যা হোক, এই ঘটনার দশ বছর পরে শশাঙ্কদেব দেহরক্ষা করলেন, মানব রাজা হলেন। মানব সিংহাসন লাভের কয়েক মাস পরে ভাস্করবর্মা উত্তর থেকে গৌড় আক্রমণ করলেন! কজঙ্গলে মানবের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ হল। মানব পরাজিত হয়ে কর্ণসুবর্ণে ফিরে এলেন।

‘কিন্তু ভাস্করবর্মা তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করেছিলেন; কর্ণসুবর্ণে দ্বিতীয়বার যুদ্ধ হল। এবারও মানব পরাজিত হলেন; রাজপুরী রক্ষার জন্য অমিতবিক্রমে যুদ্ধ করতে করতে তিনি ভাস্করবর্মার হাতে বন্দী হলেন। জনশ্রুতি আছে, মানব যুদ্ধে গুরুতর আহত হয়েছিলেন, সেই রাত্রেই তাঁর মৃত্যু হয়; তারপর তাঁর মৃতদেহ রাজপুরীর প্রাকার থেকে গঙ্গার জলে ফেলে দেওয়া হয়।’

শীলভদ্র নীরব হইলে বজ্রও বহুক্ষণ কথা বলিল না। এইভাবে তাহার পিতার জীবনান্ত হয়, তাই তিনি মাতার কাছে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করিতে পারেন নাই। কিন্তু—

বজ্র জিজ্ঞাসা করিল— ‘এখন রাজা কে? ভাস্করবর্মা?’

শীলভদ্র বলিলেন— ‘না। কয়েক বছর হল ভাস্করবর্মার মৃত্যু হয়েছে। এখন তাঁর পুত্র অগ্নিবর্মা রাজা।’ ক্ষণেক নীরব থাকিয়া বলিলেন— ‘ভাস্করবর্মাও ধর্মে শৈব ছিলেন এবং বিদ্যানুরাগী সজ্জন ছিলেন। অগ্নিবর্মা শুনেছি ঘোর নরাধম। কিন্তু তার আর বেশি দিন নয়।’

‘বেশি দিন নয় কেন?’

‘অগ্নিবর্মা ইন্দ্রিয়াসক্ত, কুকর্মনিরত; রাজকার্য দেখে না। এই সুযোগ নিয়ে দক্ষিণের এক রাজা গৌড়দেশ গ্রাস করার ষড়যন্ত্র করছে; ইতিমধ্যে দণ্ডভুক্তি গৌড়ের অধিকার থেকে কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু অগ্নিবর্মার কোনও দিকেই লক্ষ্য নেই। দেশের যখন সর্বনাশ উপস্থিত হয় তখন রাজারা বুদ্ধিভ্রষ্ট হন। আজ গৌড় পুণ্ড্র সমতট সর্বত্র এই দেখছি, শাসনশক্তিহীন রাজারা রমণীর মত পরস্পর কোন্দল করছেন, নয় বিলাসব্যাসনে গা ঢেলে দিয়েছেন। রাষ্ট্রের অবস্থা ঘুণ-চর্বিত কাষ্ঠের ন্যায়। অন্তর্বাণিজ্য বহির্বাণিজ্য দুই-ই উৎসন্নে গিয়েছে। প্রজার মনে সুখ নেই, ধর্মজ্ঞানও লুপ্তপ্রায়। শশাঙ্কদেবের মৃত্যুর পর থেকে দেশের এই দুর্দিন আরম্ভ হয়েছে। কতদিন চলবে জানি না। যতদিন না দেশে নূতন কোনও শক্তিমান রাজার আবির্ভাব হবে ততদিন দেশের মঙ্গল নেই।’

নিশ্বাস ফেলিয়া শীলভদ্র নীরব হইলেন।

বজ্র প্রশ্ন করিল— ‘আপনি আমাকে গ্রামে ফিরে যেতে বলছেন কেন?’

শীলভদ্র বলিলেন— ‘তুমি নিঃসঙ্গ নিঃসহায় অবস্থায় কর্ণসুবর্ণে যাচ্ছ। বর্তমান রাজার লোকেরা যদি জানতে পারে তুমি মানবদেবের পুত্র, তোমার জীবন-সংশয় হবে, যারা তোমার পিতাকে হত্যা করেছিল তারা তোমাকে নিষ্কৃতি দেবে না। তোমার পিতা যদি জীবিত থাকতেন তাহলে তাঁর সন্ধান করা তোমার অবশ্য কর্তব্য ছিল। কিন্তু তিনি দীর্ঘকাল মৃত; ব্যর্থ অন্বেষণে নিজের জীবন বিপন্ন করে লাভ কি?’

বজ্র বলিল— ‘আমার পিতা বেঁচে আছেন এ সম্ভাবনা কি একেবারেই নেই?’

শীলভদ্র বলিলেন— ‘তোমার পিতা বেঁচে থাকলে রাজ্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করতেন। গত বিশ বছরের মধ্যে সেরূপ কোনও চেষ্টা হয়নি।’

সুদীর্ঘ নীরবতার পর বজ্র ধীরে ধীরে বলিল— ‘পিতার মৃত্যু-সংবাদ নিয়ে মা’র কাছে ফিরে যেতে আমার মন সরছে না। আমি কর্ণসুবর্ণে যাব, তারপর যা হয় হবে।’

শীলভদ্র বলিলেন— ‘আর একটা কথা আছে। কর্ণসুবর্ণে রাষ্ট্রবিপ্লব আসন্ন। জয়নাগের জাল গুটিয়ে আসছে, হঠাৎ একদিন সমরানল জ্বলে উঠবে, কর্ণসুবর্ণ অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হবে। তুমি বাহিরে আছ, ইচ্ছা করে অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়বে কেন? জয়নাগ যে-কোনও মুহূর্তে মাথা তুলতে পারে।’

আবার জয়নাগ! বজ্র চকিত হইয়া বলিল— ‘জয়নাগ কে?’

‘যে-রাজা গৌড়দেশ অধিকার করবার চক্রান্ত করছে তার নাম জয়নাগ।’

বজ্র নাগদের সম্বন্ধে যে সন্দেহ করিয়াছিল তাহা আরও দৃঢ় হইল, কিন্তু এ বিষয়ে শীলভদ্রের সহিত আলোচনা করিবার স্পৃহা তাহার হইল না। সে করজোড়ে বলিল— ‘আপনার সহৃদয়তা ভুলব না। আজ আজ্ঞা করুন।’

শীলভদ্র জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘কর্ণসুবর্ণে যাবে?’

বজ্র বলিল— ‘পিতৃ-পিতামহের রাজধানীর এত কাছে এসে আমি ফিরে যাব না। আমাকে কর্ণসুবর্ণে যেতেই হবে।’

শীলভদ্র নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলিলেন— ‘সকলই তথাগতের ইচ্ছা। যাও। কিন্তু এক কাজ করো, তোমার ঐ অঙ্গদ ঢাকা দিয়ে রাখো।’

‘কেন?’

‘দেশের সোনার বড় অভাব হয়েছে। তোমার হাতে সোনার অঙ্গদ সকলের দৃষ্টি আকর্ষন করবে। কর্ণসুবর্ণে দস্যু-তস্করের অভাব নেই।’

শীলভদ্র কর্পটের ন্যায় একটি বস্ত্রখণ্ড লইয়া নিজ হস্তে বজ্রের অঙ্গদের উপর তাগা বাঁধিয়া দিলেন, বলিলেন— ‘যদি নগরে অর্থাভাব হয় কোনও স্বর্ণকারের কাছে গিয়ে অঙ্গদ থেকে সোনা কেটে বিক্রয় কোরো। অন্যথা অঙ্গদ কাউকে দেখিও না। অরাজকতার দেশে সাধুও তস্কর হয়।’

শীলভদ্রের পদধূলি লইয়া বজ্র বলিল— ‘আপনাকে শতকোটি ধন্যবাদ। কর্ণসুবর্ণে আপনার পরিচিত কেউ আছে কি?’

শীলভদ্র চকিত চক্ষে তাহার পানে চাহিয়া ক্ষণেক চিন্তা করিলেন, তারপর বলিলেন— ‘পরিচিত অনেক আছে, কিন্তু তাদের দিয়ে কাজ হবে না। তুমি একটি দরিদ্র ব্রাহ্মণের সঙ্গে দেখা কোরো। তাঁর নাম কোদণ্ড মিশ্র, নগরের দক্ষিণে গঙ্গাতীরে তাঁর কুটির।’

‘তিনি কে?’

‘তিনি এক সময় তোমার পিতামহের সচিব ছিলেন।’

পিতামহের সচিব! বজ্র আগ্রহভরে শীলভদ্রের পানে চাহিয়া রহিল। কিন্তু তিনি আর কিছু বলিলেন না।

অতঃপর বজ্র বিদায় লইল। শীলভদ্র দীপ নিভাইয়া অন্ধকারে নিস্তব্ধ বসিয়া রহিলেন। মনে মনে বলিতে লাগিলেন— সুগত, তোমার মনে কি আছে জানি না। এই বালকের হৃদয়ে নিষ্ঠা আছে, ধৈর্য আছে, দৃঢ়তা আছে। যদি প্রাক্তন পুণ্যবলে ও পিতৃরাজ্য ফিরে পায়, হয়তো দেশের ভাগ্যও ফিরবে। তাই ওকে কোদণ্ড মিশ্রের কাছে পাঠালাম। এখন তোমার ইচ্ছা।