অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ – উপসংহার
দুর্গ হইতে প্রায় দুই ক্রোশ উত্তরে গিয়া অশ্বারোহী অশ্ব থামাইল। উপত্যকা এখানে সঙ্কীর্ণ হইয়াছে, চারিদিকে উচ্চ নীচ প্রস্তরখণ্ড বিকীর্ণ; সাবধানে অশ্ব চালাইতে হয়। পথ এত বিঘ্নসঙ্কুল বলিয়াই অশ্বারোহীকে চন্দ্রোদয়ের পর যাত্রা করিতে হইয়াছে; উপরন্তু চন্দ্রালোক সত্ত্বেও বেগে অশ্বচালনা করা সম্ভব হয় নাই। শব্দ নিবারণের জন্য ঘোড়ার পায়ে কর্পট বাঁধা; এরূপ অবস্থায় ঘোড়া অধিক বেগে দৌড়িতে পারে না।
অশ্বারোহী পশ্চাদ্দিকে ফিরিয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দূর পর্যন্ত নিরীক্ষণ করিল। প্রস্তরখণ্ডগুলা চারিদিকে কালো ছায়া ফেলিয়াছে, সচলতার আভাস নাই; সব স্থির নিথর। অশ্বারোহী অশ্ব হইতে অবরোহণ করিল। ঘোড়ার ক্ষুরের কর্পট খুলিয়া এবার বেগে ঘোড়া ছুটানো যাইতে পারে; শব্দ হইলেও শুনিবার কেহ নাই।
তিনটি ক্ষুরের বস্ত্র খুলিয়া অশ্বারোহী চতুর্থ ক্ষুরে হাত দিয়াছে এমন সময় ঘোড়াটা ভয় পাইয়া দূরে সরিয়া গেল। অশ্বারোহী চকিতে উঠিয়া পিছু ফিরিল, অমনি তরবারির অগ্রভাগ তাহার বুকে ঠেকিল। চিত্রক বলিল—মরুসিংহ, অশুভক্ষণে যাত্রা করিয়াছিলে। আমার সঙ্গে ফিরিতে হইবে।
মরুসিংহের বুকে লৌহজালিক ছিল, সে এক লাফে পিছু হটিয়া সঙ্গে সঙ্গে তরবারি বাহির করিল। চিত্রকের অসি তাহার বুকে বিঁধিল না, তাহাকে আর একটু দূরে ঠেলিয়া দিল মাত্র।
তখন মলিন চন্দ্রালোকে দুইজনে অসিযুদ্ধ হইল।
যুদ্ধ শেষ হইলে চিত্ৰক মরুসিংহের বুকের উপর বসিয়া তাহার হস্তদ্বয় তাহারই উষ্ণীষ বস্ত্র দিয়া বাঁধিল; তারপর তাহাকে দাঁড় করাইয়া উষ্ণীষ বস্ত্র তাহার কটিতে জড়াইল; উষ্ণীষ-প্রান্ত বাম হস্তে এবং তরবারি দক্ষিণ হস্তে ধরিয়া বলিল—এবার চল। হাঁটিয়া ফিরিতে হইবে। তুমি আগে চল, আমি পিছনে থাকিব। পলায়নের চেষ্টা করিও না—
মরুসিংহ এতক্ষণ একটি কথাও বলে নাই, এখনও বাঙ্নিষ্পত্তি করিল না।
তাহারা যখন তরু বাটিকায় ফিরিল, তখন ঊষার আলোক ফুটিতে আরম্ভ করিয়াছে; কিন্তু তখনও রাত্রির ঘোর কাটে নাই।
চিত্রকের রহস্যময় অন্তর্ধান ইতিমধ্যে লক্ষিত হইয়াছিল। ছাউনিতে চাঞ্চল্য দেখা দিয়াছিল। সকলে জাগিয়া উঠিয়াছিল। চিত্রক বন্দীসহ ফিরিতেই গুলিক ছুটিয়া আসিয়া বলিল—একি, কোথায় গিয়াছিলে? এ কে?
চিত্ৰক বলিল—ইনি চষ্টন দুর্গের দুর্গপাল মরুসিংহ। আগে ইহাকে শক্ত করিয়া গাছের কাণ্ডে বাঁধ। তারপর সব বলিতেছি।
মরুসিংহকে গাছে বাঁধিয়া দুইজন রক্ষী খোলা তলোয়ার হাতে তাহার সম্মুখে দাঁড়াইল। তখন নিশ্চিন্ত হইয়া চিত্ৰক গুলিককে অন্তরালে লইয়া গিয়া রাত্রির সমস্ত ঘটনা বলিল।
শুনিয়া গুলিক বলিল—তোমার অনুমানই সত্য। কিন্তু কেবল অনুমানের উপর নির্ভর করিলে চলিবে না; হূণটার মুখ হইতে প্রকৃত কথা জানিতে হইবে।
চিত্ৰক বলিল—উহার নিকট হইতে কথা বাহির করা শক্ত হইবে।
গুলিক বলিল—যদি সহজে না বলে তখন কথা বাহির করিবার অন্য পথ ধরিব।
তখন সূর্যোদয় হইয়াছে। চিত্ৰক ও গুলিক গিয়া মরুসিংহকে প্রশ্ন করিতে আরম্ভ করিল। মরুসিংহ কিন্তু নীরব; একটি প্রশ্নেরও উত্তর দিল না।
ক্রমে বেলা বাড়িয়া চলিল। নিরামিষ প্রশ্নে ফল হইতেছে না দেখিয়া গুলিক লাঠৌষধের প্রয়োগ করিল। কিন্তু মরুসিংহের মুখ খুলিল না। দৈহিক পীড়ন ক্রমশ বাড়িতে লাগিল। প্রাণে না মারিয়া যতদূর নৃশংসতা প্রয়োগ করা যাইতে পারে তাহা প্রযুক্ত হইল।
দ্বিপ্রহর হইল। তথাপি মরুসিংহের মুখের অর্গল খুলিল না দেখিয়া গুলিক বর্মা সহসা হুঙ্কার ছাড়িল—হতবুদ্ধি হূণ যখন প্রশ্নের উত্তর দিবে না তখন উহাকে বাঁচাইয়া রাখিয়া লাভ নাই। উহাকে ঘোড়া দিয়া চিরিয়া ফেলিব। তবু একটা হূণ কমিবে।
ঘোড়া দিয়া চিরিয়া ফেলার প্রক্রিয়া অতি সহজ। যাহাকে চিরিয়া ফেলা হইবে তাহার দুই পায়ে দুইটি রঞ্জুর প্রান্ত বাঁধিয়া রজু দুটির অন্য প্রান্ত দুইটি ঘোড়ার সহিত বাঁধিয়া দিতে হইবে; তারপর ঘোড়া দুইটিকে একসঙ্গে বিপরীত দিকে ছুটাইয়া দিতে হইবে।
মরুসিংহকে মাটিতে ফেলিয়া তাহার গুফে রঞ্জু বাঁধা হইলে মরুসিংহ প্রথম কথা কহিল। বলিল—প্রশ্নের উত্তর দিব।
দুইজন রক্ষী মরুসিংহকে টানিয়া দাঁড় করাইল।
অতঃপর প্রশ্নোত্তর আরম্ভ হইল।
প্রশ্ন : গত রাত্রে চুপি চুপি কোথায় যাইতেছিলে?
উত্তর : হূণ শিবিরে।
প্রশ্ন : হূণ শিবির কত দূর?
উত্তর : এখান হইতে ত্রিশ ক্রোশ বায়ুকোণে।
প্রশ্ন : পথ আছে?
উত্তর : গুপ্তপথ আছে।
প্রশ্ন : তুমি হূণদের পথ দেখাইয়া আনিতে যাইতেছিলে?
উত্তর : হাঁ।
প্রশ্ন : কে তোমাকে পাঠাইয়াছিল?
উত্তর : দুর্গাধিপ।
প্রশ্ন : তুমি নিজ ইচ্ছায় যাও নাই? প্রমাণ কি?
উত্তর : দুর্গাধিপের পত্র আছে।
প্রশ্ন : কোথায় পত্র?
উত্তর : আমার তরবারির কোষের মধ্যে।
মরুসিংহের কটি হইতে তখনও শূন্য কোষ ঝুলিতেছিল। কোষ ভাঙ্গিয়া তাহার নিম্ন প্রান্ত হইতে লিপি বাহির হইল। অগুরুত্বকের পত্র, তদুপরি ক্ষুদ্র অক্ষরে লিখিত লিপি। লিপি পাঠ করিয়া মরুসিংহকে আর প্রশ্ন করিবার প্রয়োজন হইল না। গুলিক বলিল—বন্দীকে পানাহার দাও। কিন্তু বাঁধিয়া রাখ। উহার ব্যবস্থা পরে হইবে।
তারপর চিত্ৰক ও গুলিক বিরলে গিয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া পরামর্শ করিল। মন্ত্রণার ফলে দুইজন অশ্বারোহী বার্তা লইয়া স্কন্দের স্কন্ধাবারের দিকে যাত্রা করিল। গুরুতর সংবাদ; অবিলম্বে সম্রাটের গোচর করা প্রয়োজন।
তারপর মন্ত্রণানুযায়ী, অপরাহ্নের দিকে চিত্ৰক একাকী দুর্গতোরণের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল। বলিল—দুর্গস্বামীর সাক্ষাৎ চাহি।
আজ আর বিলম্ব হইল না। দুর্গদ্বার খুলিয়া গেল; চিত্রক প্রবেশ করিল। কিরাত নিজ ভবনে ছিল, হাসিয়া চিত্রককে সম্ভাষণ করিল—দৃত মহাশয়, আপনি ফিরিয়া যাইবার জন্য নিশ্চয় বড় চঞ্চল হইয়াছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয় ধর্মাদিত্যের অবস্থা পূর্ববৎ, কোনও উন্নতি হয় নাই। আপনাকে আরও দুই একদিন অপেক্ষা করিতে হইবে।
চিত্ৰক উত্তর দিল না, স্থিরদৃষ্টিতে কিরাতের পানে চাহিয়া রহিল।
কিরাত পুনশ্চ বলিল—অবশ্য আপনারা যদি নিতান্তই থাকিতে না পারেন তাহা হইলে কল্য প্রাতে ফিরিয়া যাওয়াই কর্তব্য। কিন্তু যে কার্য করিতে আসিয়াছেন তাহার শেষ না দেখিয়া ফিরিয়া যাওয়া উচিত হইবে কি? কিরাতের কণ্ঠস্বরে গোপন ব্যঙ্গের আভাস ফুটিয়া উঠিল।
কিরাতের মুখের উপর স্থিরদৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়া চিত্ৰক বলিল—আমরা ফিরিয়া না যাই ইহাই। আপনার ইচ্ছা?
হাঁ—অবশ্য। সম্রাটের আদেশ—
কিন্তু তাহাতে আপনার কোনও লাভ হইবে না।
আমার লাভ—? কিরাত প্রখরচক্ষে চাহিল।
চিত্রক শান্তস্বরে বলিল—আপনি আশা করিতেছেন আপনার নিমন্ত্রণ লিপি পাইয়া হূণ সেনাপতি সসৈন্যে আসিয়া আমাদের হত্যা করিবে। কিন্তু তাহা হইবার নয়। মরুসিংহ ধরা পড়িয়াছে; যে অধম গুপ্তচর হূণদের পথ দেখাইয়া আনিতে পারিত, সে এখন আমাদের হাতে।
কিরাত প্রস্তরমূর্তির ন্যায় দাঁড়াইয়া রহিল।
কিয়ৎকাল স্তব্ধ থাকিয়া চিত্ৰক আবার বলিতে লাগিল—আপনার পত্র হইতে আপনার অভিপ্রায় সমস্তই ব্যক্ত হইয়াছে। আপনি শত্রুকে ঘরে ডাকিয়া আনিয়া প্রথমে নিজ দুর্গ ও ধর্মাদিত্যকে তাহাদের হস্তে সমর্পণ করিতে চান; তারপর হুণেরা যাহাতে সহজে বিটঙ্ক রাজ্য অধিকার করিয়া সম্রাট স্কন্দগুপ্তের কণ্টকস্বরূপ হইতে পারে সেজন্য তাহাদের সাহায্য করিতেও উদ্যত আছেন। আপনি রাজদ্রোহী—দেশদ্রোহী। কিন্তু সম্রাট স্কন্দগুপ্ত ক্ষমাশীল পুরুষ। এখনও যদি আপনি তাঁহার বশ্যতা স্বীকার করিয়া রোট্ট ধর্মাদিত্যকে আমাদের হস্তে অর্পণ করেন তাহা হইলে সম্রাট হয়তো আপনাকে ক্ষমা করিতে পারেন।
এতক্ষণে কিরাত আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের ন্যায় ফাটিয়া পলি। তাহার অগ্নিবর্ণ মুখে শিরা উপশিরা স্ফীত হইয়া উঠিল; সে উন্মত্তবৎ গর্জন করিয়া বলিল—রাজদ্রোহী! দেশদ্রোহী! মূর্খ। দূত, তুমি কী বুঝিবে কেন আমি হূণকে ডাকিয়াছি! এ রাজ্য আমার—অধম ধর্মাদিত্য প্রবঞ্চনা করিয়া আমার পৈতৃক অধিকার অপহরণ করিয়াছে! আমি বিটঙ্ক রাজ্যের ন্যায্য রাজা
চিত্ৰক বলিয়া উঠিল—তুমি ন্যায্য রাজা?
বাধা অগ্রাহ্য করিয়া কিরাত ফেনায়িত মুখে বলিয়া চলিল—তথাপি আমি ধৈর্য ধরিয়া ছিলাম, বিদ্রোহ করিয়া নিজ অধিকার সবলে গ্রহণ করিতে চাহি নাই। আমি শুধু চাহিয়াছিলাম, ধর্মাদিত্যের কন্যাকে বিবাহ করিয়া উত্তরাধিকার সূত্রে সিংহাসন লাভ করিব। তাহাতে কাহারও ক্ষতি হইত না। কিন্তু নষ্টবুদ্ধি ধর্মাদিত্য এবং তাহার নষ্টবুদ্ধি কন্যা
চিত্ৰক বাধা দিয়া প্রশ্ন করিল—বিটঙ্ক রাজ্য ন্যায়ত তোমার, একথার অর্থ কি?
তাহা তুমি বুঝিবে না। হূণ হইলে বুঝিতে। আমার পিতা তুষাণ স্বহস্তে পূর্ববর্তী আর্য রাজার মস্তক স্কন্ধচ্যুত করিয়াছিলেন; সেই অধিকারে বিটঙ্ক রাজ্য আমার পিতার প্রাপ্য। হূণদের মধ্যে এইরূপ প্রথা আছে। কিন্তু চতুর ধর্মাদিত্য–
কি বলিলে? তোমার পিতা পূর্ববর্তী আর্য রাজাকে হত্যা করিয়াছিল? ধর্মাদিত্য হত্যা করে নাই?
না! একথা সকলে জানে। কিন্তু এ পৃথিবীতে সুবিচার নাই—
চিত্রকের তিলক ত্রিলোচনের ললাট বহ্নির ন্যায় জ্বলিতেছিল। সে কিরাতের দিকে একপদ অগ্রসর হইল।
এই সময় বাহিরে উচ্চ গণ্ডগোল শুনা গেল। দুই তিনজন প্রাকাররক্ষী কক্ষের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল। একজন রুদ্ধশ্বাসে বলিল—দুর্গেশ, শত শত রণহস্তী লইয়া একদল সৈন্য দক্ষিণদিক হইতে আসিতেছে। বোধহয় স্বয়ং স্কন্দগুপ্ত। একটি হস্তীর মাথায় শ্বেতছত্র রহিয়াছে।
স্কন্দগুপ্ত বলিলেন—রট্টা যশোধরার নিকট পাশার বাজি হারিয়াছিলাম, তাই পণ রক্ষার জন্য আসিতে হইয়াছে। এখন দেখিতেছি আসিয়া ভালই করিয়াছি।
দুর্গের মধ্যে উন্মুক্ত স্থানে সভা বসিয়াছিল; স্কন্দের রণহস্তীর দল চক্রাকারে সভাস্থল ঘিরিয়া ছিল। দুর্গ এখন স্কন্দের অধিকারে। কিরাত স্কন্দের বিরুদ্ধে দুর্গদ্বার রোধ করিতে সাহসী হয় নাই; প্রাণ বাঁচাইবার ক্ষীণ আশা লইয়া তাঁহার কাছে আত্মসমর্পণ করিয়াছিল।
এদিকে কপোতকূট হইতে চতুরানন ভট্ট অনুমান চারিশত সৈন্য সংগ্রহ করিয়া প্রায় স্কন্দের সমকালেই আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। গর্দভপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া জম্বুকও সঙ্গে আসিয়াছে।
স্কন্দ একটি প্রশস্ত বেদীর উপর বসিয়াছিলেন; পাশে ধাদিত্য। ধর্মাদিত্যের দেহ শুষ্ক শীর্ণ, মুখে ক্লেশের চিহ্ন বিদ্যমান; কিন্তু তাঁহাকে দেখিয়া মরণাপন্ন রোগী বলিয়া মনে হয় না। রট্টা যশোধরা তাঁহার জানু আলিঙ্গন করিয়া পদপ্রান্তে বসিয়াছিল। চিত্ৰক গুলিক ও আরও অনেক সেনামুখ্য সভার সম্মুখভাগে দণ্ডায়মান ছিল। কিরাত কিছু দূরে একাকী বক্ষ বাহুবদ্ধ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিল।
ধর্মাদিত্য ভগ্নস্বরে বলিলেন—আমার আর রাজ্যসুখে স্পৃহা নাই। আমি সংঘের শরণ লইব। রাজাধিরাজ, আপনি আমার এই ক্ষুদ্র রাজ্য গ্রহণ করুন; আততায়ীর সন্ত্রাস হইতে প্রজাকে রক্ষা করুন।
স্কন্দ বলিলেন—তাহা করিতে পারি। কিন্তু আমি তো বিটঙ্ক রাজ্যে থাকিয়া রাজ্য শাসন করিতে পারিব না। একজন স্থানীয় সামন্ত প্রয়োজন যে সিংহাসনে বসিয়া প্রজা শাসন করিবে। এমন কে আছে?
ধর্মাদিত্য বলিলেন—আমার একমাত্র কন্যা আছে—এই রট্টা যশোধরা। বলিয়া রট্টার মস্তকে হস্ত রাখিলেন।
স্কন্দ বলিলেন—রট্টা আপনার কুমারী কন্যা। যদি আপনার জামাতা থাকিত সে আপনার স্থলাভিষিক্ত হইয়া রাজ্য শাসন করিতে পারিত, কাহারও ক্ষোভের কারণ হইত না। কিন্তু অনধিকারী ব্যক্তিকে সিংহাসনে বসাইলে রাজ্যে অশান্তি ঘটিবার সম্ভাবনা, বর্তমান অবস্থায় তাহা। বাঞ্ছনীয় নয়। ধর্মাদিত্য, আপনি আরও কিছুকাল রাজদণ্ড ধারণ করিয়া থাকুন। তারপর…
ধর্মদিত্য সবিনয়ে যুক্তকরে বলিলেন—আমাকে ক্ষমা করুন। সংসারে আমার নির্বেদ উপস্থিত হইয়াছে। আপনার রাজ্য আপনি যাহাকে ইচ্ছা দান করুন; আমার কন্যার জন্যও আর আমি অনুগ্রহ ভিক্ষা করি না। রট্টা আপনার স্নেহ পাইয়াছে, সে আপনারই কন্যা। আপনি প্রজার কল্যাণে যেরূপ ইচ্ছা করুন।
সভা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিল; তারপর রট্টা ধীরে ধীরে উঠিয়া দাঁড়াইল। একবার চিত্রকের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া মৃদু হাসিল; তারপর স্কন্দের দিকে ফিরিল। বলিল—আয়ুষ্মন্, রাজ্যের ন্যায্য অধিকারীর যদি অভাব ঘটিয়া থাকে আমি একজন ন্যায্য অধিকারীর সন্ধান দিতে পারি।
সকলে বিস্ফারিত নেত্রে চাহিল। রট্টা বলিল—যে আর্য রাজাকে জয় করিয়া পিতা বিটঙ্ক রাজ্য অধিকার করিয়াছিলেন সেই আর্য রাজার বংশধর জীবিত আছেন—
স্কন্দ বলিয়া উঠিলেন—কে সে? কোথায় সে?
উত্তর না দিয়া রট্টা ধীরপদে গিয়া চিত্রকের সম্মুখে দাঁড়াইল। চিত্ৰক অভিভূতভাবে স্খলিতস্বরে একবার রট্টা—! বলিয়া নীরব হইল।
রট্টা চিত্রকের হাত ধরিয়া স্কন্দের সম্মুখে লইয়া আসিল, বলিল—ইনিই সিংহাসনের ন্যায্য অধিকারী।
স্কন্দ সবিস্ময়ে বলিলেন—চিত্ৰক বর্মা–!
রট্টা বলিল—ইহার প্রকৃত নাম তিলক বর্মা।
স্কন্দ বলিলেন—তিলক বর্মা, তুমি ভূতপূর্ব আর্য রাজার পুত্র?
চিত্ৰক বলিল—হাঁ, পূর্বে জানিতাম না, সম্প্রতি জানিয়াছি।
স্কন্দ প্রশ্ন করিলেন—প্রমাণ আছে?
চিত্ৰক বলিল—যিনি আমার গোপন পরিচয় প্রকাশ করিয়াছেন তিনিই প্রমাণ দিবেন। আমার কোনও আগ্রহ নাই।
রট্টা বলিল—প্রমাণ আছে; প্রয়োজন হইলে দিব। কিন্তু আর্য, প্রমাণের কি কোনও প্রয়োজন আছে?
স্কন্দ তীক্ষ্ণ চক্ষে একবার রট্টার মুখ ও একবার চিত্রকের মুখ দেখিলেন। তাঁহার অধরে ঈষৎ ক্লিষ্ট হাসি দেখা দিল। তিনি বলিলেন—না, প্রয়োজন নাই। তিলক বর্মা, বিটঙ্কের সিংহাসন তোমাকে দিলাম। রট্টা যশোধরা, বিটঙ্কের রাজমহিষী হইতে বোধকরি তোমার কোনও আপত্তি নাই?
রট্টা অধোমুখী হইয়া আবার পিতার পদতলে বসিয়া পড়িল। সভাস্থ সকলে চিত্রার্পিতবৎ এই দৃশ্য দেখিতেছিল, এখন হর্ষধ্বনি করিয়া উঠিল।
রোট্টা ধর্মাদিত্য আসন ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন; চিত্রককে সম্বোধন করিয়া কম্পিত কণ্ঠে। বলিলেন—বৎস, যৌবনের প্রচণ্ডতায় যে হিংসাবৃত্তি অবলম্বন করিয়াছিলাম তজ্জন্য অনুতাপে আমার হৃদয় দগ্ধ হইতেছে। বিটঙ্কের সিংহাসন তোমার, তুমি তাহা ভোগ কর। আর, আমার রট্টা যশোধরাকে গ্রহণ করিয়া আমাকে ঋণমুক্ত কর।
চিত্ৰক মস্তক অবনত করিয়া বলিল—আপনি স্বেচ্ছায় ঋণ পরিশোধ করিলেন; আপনি মহানুভব। কিন্তু অন্য একটি আদান-প্রদান এখনও বাকি আছে।
চিত্ৰক দ্রুতপদে কিরাতের সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল; বলিল—আমার পরিচয় শুনিয়াছ। পিতৃঋণ শোধ করিতে প্রস্তুত আছ?
রক্তহীন মুখ তুলিয়া কিরাত বলিল—আছি।
চিত্ৰক বলিল—তবে তরবারি লও। আমাকেও পিতৃঋণ পরিশোধ করিতে হইবে।
পরিশিষ্ট
আবার কপোতকূট।
রাজপ্রাসাদ আলোকমালায় ঝলমল করিতেছে। চারিদিকে বাদ্যোদম। ঝল্লরী মুরলী মৃদঙ্গ বাজিতেছে; নগরীর পথে পথে নাগরিক নাগরিকার নৃত্যগীত আর শান্ত হইতেছে না। পুরাতন রাজপুত্র ও নূতন রাজকুমারীর বিবাহ। দুই রাজবংশ মিলিত হইয়াছে। রোট্ট ধর্মাদিত্য জামাতার হস্তে রাজ্যভার অর্পণ করিয়া চিল্লকূট বিহারে আশ্রয় লইবেন। সম্রাট স্কন্দগুপ্ত বর-বধূর জন্য স্কন্ধাবার হইতে পাঁচটি হস্তী উপহার পাঠাইয়াছেন। বিশ্বাসঘাতক কিরাত মরিয়াছে।
সকলেই সুখী; সকলেই আনন্দমত্ত। এমন কি বৃদ্ধ হূণ যোদ্ধা মোঙের অধরে হাসি ফুটিয়াছে। প্রত্যেক মদিরা-ভবনে নাগরিকেরা আনন্দ কোলাহল করিয়া তাহাকে ডাকিতেছে এবং মদ্যপান করাইতেছে। তাহার বহুশ্রুত গল্প শুনিয়া কেহই পলায়ন করিতেছে না, বরং উচ্চকণ্ঠে হাসিতেছে; বলিতেছে—মোঙ্, তারপর কী হইল? তারপর কী হইল? মোঙের সুরাভিষিক্ত মন আনন্দে টলমল করিতেছে। সে ক্রমাগত গল্প বলিয়া চলিয়াছে।
রাজপ্রাসাদে বিবাহ-ক্রিয়া সম্পন্ন হইয়াছে। গভীর রাত্রে একটি পুষ্পসুরভিত কক্ষে চিত্ৰক রট্টা আর সুগোপা ছিল।
চিত্ৰক বলিল—সুগোপা, তুমি আমার সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করিয়াছ।
সুগোপা চটুলকণ্ঠে বলিল—বিশ্বাসঘাতকতা না করিলে সখীকে পাইতেন কি?
পুষ্পভরণভূষিতা রট্টার হাতে একটি রৌপ্যনির্মিত বাণ (আধুনিক কাজললতা) ছিল; কন্যাকে বিবাহকালে ইহা ধারণ করিতে হয়। সেই বাণ দিয়া সুগোপার উরুর উপর মৃদু আঘাত করিয়া রট্টা বলিল—সুগোপা কি আমার কাছে কিছু গোপন করিতে পারে। পর দিনই প্রাতে আসিয়া আমাকে তোমার সকল পরিচয় দিয়াছিল।
চিত্রক রট্টার হাত ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিল—রট্টা, আমার প্রকৃত পরিচয় জানিতে পারিয়া তোমার কী মনে হইয়াছিল?
রট্টার চক্ষু দুটি ক্ষণকাল তন্দ্রাবিষ্ট হইয়া রহিল; তারপর সে বলিল—সেদিন সন্ধ্যার পর চাঁদের আলোয় প্রাকারের উপর তোমার সহিত দেখা হইয়াছিল, মনে আছে? তোমার মনের ভাব বুঝিতে পারিয়াছিলাম। মনে মনে সঙ্কল্প করিয়াছিলাম, তোমাকে প্রতিহিংসা লইবার সুযোগ দিব, নচেৎ তোমার হৃদয় জয় করিব। কিন্তু তুমি প্রতিহিংসা লইলে না। তাই তোমার হৃদয় জয় করিলাম; আর তোমাকে ভালবাসিলাম।
রট্টা চিত্রকের পানে বিদ্যুবিলাস তুল্য কটাক্ষ হানিল, তারপর সুগোপার কানে কানে বলিল—সুগোপা, তুই এখন গৃহে যা রাত্রি শেষ হইতে চলিল। আজিকার রাত্রে মালাকরকে আর বঞ্চিত করিস না।
সুগোপাও চুপি চুপি বলিল—বল না, নিজের মালাকর পাইয়াছ তাই আমাকে বিদায় করিতে চাও। আর বুঝি ত্বর সহিতেছে না? সুগোপা ফুৎকারে প্রদীপ নিভাইয়া দিয়া হাসিতে হাসিতে ছুটিয়া পলাইল।
তারপর সুখস্বপ্নের ন্যায় ছয় মাস কাটিয়া গিয়াছে।
ওদিকে হণের সহিত স্কন্দগুপ্তের যুদ্ধ চলিতেছে। হূণ কখনও হটিয়া যাইতেছে, কখনও অতর্কিত পথে অগ্রসর হইয়া আসিতেছে। বিটঙ্ক রাজ্যে এখনও হূণ প্রবেশ করিতে পারে নাই। চষ্টন দুর্গে অধিষ্ঠিত হইয়া গুলিক বর্মা সহস্র চক্ষু হইয়া সঙ্কটপথ পাহারা দিতেছে।
চিত্রক নিজ রাজ্যে এক সৈন্যদল গঠিত করিয়াছে। তিন সহস্র সৈন্য কপোতকূট রক্ষার জন্য সর্বদা প্রস্তুত হইয়া আছে।
একদিন সূর্যাস্তের সময় প্রাসাদশীর্ষে উঠিয়া রট্টা দেখিল, চিত্ৰক স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া পশ্চিম দিগন্তের পানে তাকাইয়া আছে।
রট্টা কাছে গিয়া তাহার বাহু জড়াইয়া দাঁড়াইল। কি দেখিতেছ?
চমক ভাঙ্গিয়া চিত্ৰক বলিল—কিছু না। সূর্যাস্তের বর্ণগৌরব কী অপূর্ব; মেঘ পাহাড় ও আকাশ একাকার হইয়া গিয়াছে—যেন রক্তবর্ণ রণক্ষেত্র।
রট্টা কিছুক্ষণ চিত্রকের মুখের উপর চক্ষু পাতিয়া রহিল, তারপর বলিল—যুদ্ধে যাইবার জন্য তোমার মন বড় চঞ্চল হইয়াছে?
ধরা পড়িয়া গিয়া চিত্ৰক একটু করুণ হাসিল। রট্টা তাহার স্কন্ধে হস্ত রাখিয়া বলিল—যদি মন অধীর হইয়া থাকে, যুদ্ধে যাও না কেন?
চিত্ৰক চকিতে একবার তাহার পানে চাহিল, কিন্তু নীরব রহিল। রট্টা তখন ঈষৎ হাসিয়া বলিল—তোমার মনের কথা বুঝিয়াছি। তুমি ভাবিতেছ, হূণ আমার স্বজাতি, তাহাদের বিরুদ্ধে তুমি যুদ্ধযাত্রা করিলে আমি দুঃখ পাইব। তোমার বোধহয় বিশ্বাস স্বজাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে হইবে বলিয়া পিতা রাজ্য ত্যাগ করিয়াছেন। সত্য কি না?
চিত্ৰক বলিল—না, ধর্মাদিত্য অন্তর হইতে বুদ্ধ তথাগতের শরণ লইয়াছেন। কিন্তু তুমি রট্টা? তোমার দেহে হূণ রক্ত আছে। আমি হূণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করিলে সত্যই কি তুমি দুঃখ পাইবে না?
রট্টা দৃঢ়স্বরে বলিল—। হূণ যেমন তোমার শত্ৰু, তেমনই আমার শত্রু। আমার দেশ যে আক্রমণ করে, পরমাত্মীয় হইলেও সে আমার শত্রু। তোমার মন টানিয়াছে, তুমি যুদ্ধে যাও, স্কন্দগুপ্তের সহিত যোগদান কর।
চিত্ৰক রট্টাকে বাহুবদ্ধ করিয়া বলিল—রট্টা, ভাবিয়াছিলাম আমার রাজ্য যতদিন আক্রান্ত না হইবে ততদিন নিরপেক্ষ থাকিব। কিন্তু তবু হৃদয় অধীর হইয়াছিল। তুমি আমার মনের কথা কি করিয়া জানিলে?
আমি অন্তর্যামিনী তাহা এখনও বুঝিতে পার নাই? রট্টা হাসিল।
উৎসাহভরে চিত্ৰক বলিল—তবে যাই? আমি এক সহস্র সৈন্য লইয়া যাইব; বাকি দুই সহস্র পুরী রক্ষার জন্য থাকিবে।
রট্টা বলিল—তুমি রাজা, তোমার যাহা ইচ্ছা কর। কিন্তু তোমার অনুপস্থিতিতে রাজ্য দেখিবে কে?
চিত্ৰক বলিল—তুমি দেখিবে। চতুর ভট্ট দেখিবেন।
রট্টা অনেকক্ষণ স্বামীর মুখের পানে চাহিয়া রহিল। চোখ দুটি ছলছল করিতে লাগিল। শেষে বাষ্পরুদ্ধস্বরে বলিল—তুমি যখন যুদ্ধ জয় করিয়া ফিরিয়া আসিবে, একটি নূতন মানুষ। পুরদ্বারে তোমাকে অভ্যর্থনা জানাইবে। বলিয়া স্বামীর বক্ষে মুখ লুকাইল।
।।ঐতিহাসিক গল্পে শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায় এক অসামান্য ব্যক্তিত্ব ।। সুন্দর বর্নন এতই প্রানবন্ত যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে