• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

০৬. বন্দিনী

লাইব্রেরি » শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় » ঐতিহাসিক কাহিনী সমগ্র - শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় » কালের মন্দিরা (উপন্যাস) - শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় » ০৬. বন্দিনী

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – বন্দিনী

তোরণ-প্রতীহারের নাসিকায় বিলক্ষণ আঘাত লাগিয়াছিল। সুগোপার প্রতি রসে-ভরা প্রীতির ভাব আর তাহার ছিল না। তদুপরি দুইটা বিকশিতদন্ত যামিক-রক্ষী যখন একটা চোরকে তাহার স্কন্ধে চাপাইয়া দিয়া চলিয়া গেল তখন শুধু সুগোপা নয়, সমস্ত নারী-জাতির উপর তাহার মন বিরক্ত হইয়া উঠিল। দেবদুহিতার সখী না হইয়া অন্য কোনও লোক হইলে কখনই সে চোরকে সারা রাত্রি আগুলিয়া থাকিবার ভার লইত না। শান্তির সময়, দেশে কোনও প্রকার উপদ্রব নাই। এ সময়ে রাজপুরীর তোরণ পাহারা দিতে হইলে সমস্ত রাত্রি জাগিয়া থাকিবার প্রয়োজন হয় না; দ্বারে ঠেস দিয়া চক্ষু মুদিত করিলেই প্রভাত হইয়া যায়। কিন্তু এখন এই অশ্বচোরটাকে লইয়া সে চক্ষু মুদিবে কি প্রকারে? চোর যদি পালায় তবে আর রক্ষা নাই। এখন চতুঃপ্রহর রাত্রি জাগিয়া এই বন্ধ্যাপুত্র চোরকে পাহারা দিতে হইবে। অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হইয়া প্রতীহার বলিল—বাপু অশ্বচোর, তোমার সাজসজ্জা দেখিয়া তোমাকে শিষ্ট ব্যক্তি বলিয়া মনে হইতেছে। তুমি এমন কুকর্ম করিতে গেলে কেন? রাজকুমারীর ঘোড়া চুরি করিলে কি জন্য?

চোর উত্তর না দিয়া নির্বিকার মুখে আকাশের পানে চাহিয়া রহিল। প্রতীহার পুনরায় বলিল—আর যদি করিলেই, ধরা পড়িলে কেন? ধরা যদি পড়িলে, কল্য প্রাতে পড়িলে কি দোষ হইত?

চোর এবারও কোনও উত্তর করিল না।

তুমি তো কল্য প্রাতে নির্ঘাত শূলে চড়িবে। তবে আজ রাত্রে আমাকে কষ্ট দিয়া কী লাভ হইল?

প্রতীহারের বিরক্তি ক্রমশ হতাশায় পর্যবসিত হইতেছিল, এমন সময় তাহার পাশে একটি কৃষ্ণ ছায়া পড়িল। চমকিয়া প্রতীহার দেখিল, পুরভূমির জীবন্ত প্রেত গুহ নিঃশব্দে তাহার পাশে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।

এ আখ্যায়িকায় গুহের স্থান অতি অল্পই; তবু তাহার একটু পরিচয় আবশ্যক। সে হূণ, হূণ অভিযানের সময় আসিয়াছিল। রাজপুরীর যুদ্ধে তাহার মস্তকে গুরুতর আঘাত লাগে, কপালের বাম ভাগে একটা গভীর ক্ষতচিহ্ন এখনও তাহার সাক্ষ্য দিতেছে। ফলে, গুহের স্মৃতি ও বাশক্তি চিরতরে লুপ্ত হইয়া যায়। তদবধি সে রাজপুরীর প্রাকারবেষ্টনীর মধ্যে আছে, কেহ তাহাকে কিছু বলে না। দিবা ভাগে সে কোথায় থাকে কেহ দেখিতে পায় না; রাত্রে পুরভূমির উপর শীর্ণ খর্ব ছায়ার মত ঘুরিয়া বেড়ায়। রাত্রির প্রহরীরা কদাচিৎ তাহাকে দেখিতে পায়, সে তোরণ-স্তম্ভের পাশে বসিয়া আপন মনে হাসিতেছে, অথবা অতৃপ্ত প্রেতযোনির মত অন্ধকার প্রাকারের উপর সঞ্চরণ করিয়া বেড়াইতেছে। প্রহরীরা সাগ্রহে তাহার সহিত কথা বলিবার চেষ্টা করে কিন্তু গুহ নীরব থাকে; তাহার লুপ্ত স্মৃতির মধ্যে কোন্ বিচিত্র রহস্য লুক্কায়িত আছে কেহ অনুমান করিতে পারে না।

গুহ আসিয়া কয়েকবার সন্তর্পণে চিত্রককে প্রদক্ষিণ করিল; মুখের কাছে মুখ লইয়া গিয়া যেন আঘ্রাণ গ্রহণ করিল; পশ্চাতে গিয়া কি যেন দেখিল—তারপরে নিঃশব্দে হাসিতে হাসিতে প্রতীহারকে অঙ্গুলি সঙ্কেতে ডাকিল।

চিত্রকের হস্তদ্বয় পশ্চাতে রঞ্জু দ্বারা বদ্ধ ছিল; প্রতীহার গিয়া দেখিল কোন্ অজ্ঞাত উপায়ে রজ্জবন্ধন ঢিলা হইয়া গিয়াছে, টানিলেই হাত বাহির হইয়া আসিবে। প্রতীহার ক্রুদ্ধ হইয়া বলিল—আরে শৃগালপুত্র চোর, তুই আমাকে ফাঁকি দিয়া পালাইতে চাস? সে দৃঢ়ভাবে রঞ্জু বাঁধিতে প্রবৃত্ত হইল।

গুহের গলার মধ্যে অব্যক্ত হাসির মত একটা শব্দ হইল। প্রতীহার তাহার দিকে ফিরিয়া বলিল—গুহ, বড় রক্ষা করিয়াছ। এ চোর পালাইলে আমাকেই শূলে যাইতে হইত। এখন এই গর্ভ-কুষ্মণ্ডটাকে বাঁধিয়া সারারাত্রি বসিয়া থাকি। আর বিশ্বাস নাই। একটা কূটকক্ষও যদি থাকিত, এই নষ্টবুদ্ধি তস্করটাকে তাহার মধ্যে বন্ধ করিয়া নিশ্চিন্ত হইতে পারিতাম।

গুহের চোখে যেন একটা ছায়া পড়িল; সে দাঁড়াইয়া নিজ অঙ্গুষ্ঠ দংশন করিতে লাগিল।

প্রতীহারের মনে বহু অশান্তি সঞ্চিত হইয়া উঠিয়াছিল, সে গুহকে লক্ষ্য করিয়া বলিতে আরম্ভ করিল—গুহ, তোমাকে বলিতেছি, স্ত্রীজাতিকে কদাপি বিশ্বাস করিতে নাই। তাহাদের মত অবিশ্বাসিনী ক্লেশদায়িনী দৃষ্টপ্রকৃতি— উপর্যুক্ত বেগবান বিশেষণের অভাবে প্রতীহার থামিয়া গেল।

হয়তো নারীজাতির সম্বন্ধে প্রতীহারের উক্তিতে কিছু সত্য ছিল, গুহের চক্ষুদ্ৰায় সহসা অর্থপূর্ণ উত্তেজনায় বিস্ফারিত হইয়া উঠিল। সে সবেগে মস্তক আন্দোলন করিয়া প্রতীহারকে তাহার অনুসরণ করিবার সঙ্কেত করিয়া অগ্রসর হইয়া চলিল।

দুই তোরণ-স্তম্ভে দুইটি প্রতিহার-কক্ষ আছে পূর্বে বলা হইয়াছে। এইরূপ প্রাকারের সর্বত্র সম-ব্যবধানে স্তম্ভগৃহ ছিল। এগুলির প্রবেশদ্বারে কবাট নাই, তাই প্রাকাররক্ষীদের বিশ্রামের উপযোগী হইলেও বন্দীকে বন্ধ করিয়া রাখিবার সুবিধা নাই। ইহাদের মধ্যে তোরণের দুই পাশের কক্ষ দুইটি সর্বদা ব্যবহৃত হইত, অন্যগুলি প্রয়োজনের অভাবে শূন্য পড়িয়া থাকিত। বহুকাল পড়িয়া থাকার ফলে সেগুলি আবর্জনায় পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল, প্রবেশপথে কণ্টকগুল্ম জন্মিয়াছিল। গুহ এইরূপ একটি অব্যবহৃত কক্ষের মুখ পর্যন্ত গিয়া আবার হাতছানি দিয়া প্রতীহারকে ডাকিল।

প্রতীহারের কৌতূহল হইল। কিন্তু চোরকে একাকী ফেলিয়া যাইতে পারে না। সে ক্ষণেক চিন্তা করিয়া চিত্রকের হস্তরঞ্জু ধরিয়া টানিতে টানিতে লইয়া চলিল।

স্তম্ভগৃহের মুখে উপস্থিত হইয়া প্রতীহার দেখিল, গুহ চৰ্মকি ঠুকিয়া একটি ক্ষুদ্র প্রদীপ জ্বালিয়াছে। চমকি প্রদীপ কোথা হইতে পাইল সেই জানে, হয়তো পূর্ব হইতে সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিল। প্রতীহার বুঝিল এই পরিত্যক্ত কক্ষটিতে গুহের যাতায়াত আছে।

দীর্ঘ অব্যবহারে ঘরটি অপরিচ্ছন্ন, কোণে ঊর্ণনাভের জাল। একটা চর্মচটিকা আলোকের আবির্ভাবে ত্রস্ত হইয়া মাথার উপর চক্রাকারে উড়িতে লাগিল।

প্রদীপ ধরিয়া গুহ কক্ষপ্রাচীরের কাছে গেল। অমসৃণ পাথরের দেয়াল, পাথরের উপর পাথরে যেখানে জোড় লাগিয়াছে সেখানে কমঠপৃষ্ঠের ন্যায় চিহ্ন। গুহ প্রদীপ তুলিয়া ধরিয়া দেখিতে লাগিল, তারপর একটি স্থান অঙ্গুলি দ্বারা টিপিয়া ধরিল। ধীরে ধীরে দেয়াল হইতে চতুষ্কোণ একটা অংশ সরিয়া গেল।

মহাবিস্ময়ে প্রতীহার দেখিল, একটি সুড়ঙ্গ পথ। ক্ষীণালোকে সুড়ঙ্গের বেশি দূর দেখা গেল; কিন্তু সুড়ঙ্গ যে প্রাকারের ভিতর দিয়া বল্মীক-বিবরের ন্যায় বহুদূর পর্যন্ত চলিয়া গিয়াছে তাহাতে সন্দেহ নাই। হুণেরা পুরী দখল করিয়াছিল বটে কিন্তু এই গুপ্ত সুড়ঙ্গের কথা জানিতে পারে নাই।

মিটিমিটি হাসিতে হাসিতে গুহ রন্ধ্রমধ্যে প্রবেশ করিয়া প্রতীহারকে অনুসরণ করিতে ইঙ্গিত করিল। সুড়ঙ্গ অপরিসর নয়, দুইজন লোক পাশাপাশি চলিতে পারে। প্রতীহার চিত্রককে লইয়া ভিতরে প্রবেশ করিল।

প্রায় ত্রিশ হস্ত যাইবার পর সম্মুখে গহ্বরের ন্যায় অন্ধকার একটা স্থান দেখা গেল; কয়েক ধাপ সোপান এই অন্ধকূপের মধ্যে নামিয়া গিয়াছে, আর কিছু দেখা যায় না।

উত্তেজিত প্রতীহার বলিল—এ তো দেখিতেছি একটা কূটকক্ষ! আশ্চর্য! কেহ ইহার সন্ধান জানিত না। গুহ, তুমি কি প্রকারে জানিলে?

গুহ ললাটের ক্ষত চিহ্নটার উপর হাত বুলাইয়া যেন স্মরণ করিবার চেষ্টা করিল; কিন্তু স্মৃতির দ্বার খুলিল না।

প্রতীহার বলিল—ভালই হইল। আজ রাত্রে চোরটা এইখানেই থাক, কাল প্রাতে আবার বাহির করিয়া লইয়া যাইব। —কে ভাবিয়াছিল প্রাকারের ভিতরটা ফাঁপা! তাহার ভিতর সুড়ঙ্গ আছে, কূটকক্ষ আছে! যা হোক, গুহ, একথা তুমি জান আর আমি জানিলাম—আর কেহ জানিতে না পারে—

প্রতীহারের মস্তকে নানাপ্রকার কল্পনা খেলা করিতেছিল; কে বলিতে পারে, ভূগর্ভস্থ গুপ্তকক্ষে হয়তো পূর্ববর্তী রাজাদের কত রত্ন-ঐশ্বর্য লুক্কায়িত আছে। চোরটা জানিতে পারিল বটে কিন্তু কাল ও শূলে যাইবে, সুতরাং একপ্রকার নিশ্চিন্ত মনে মনে এই কথা ভাবিয়া প্রতীহার চিত্রককে সেই অন্ধকার গহ্বরের মধ্যে ঠেলিয়া দিল, তারপর কবাটে অর্গল লাগাইয়া গুহের সহিত বাহিরে ফিরিয়া আসিল। মুক্ত আকাশের তলে আসিয়া সুদীর্ঘ নিশ্বাস গ্রহণপূর্বক প্রতীহার গুহের দিকে ফিরিয়া দেখিল, অশরীরী ছায়ার ন্যায় গুহ কখন নিঃশব্দে অন্তর্হিত হইয়া গিয়াছে।

কূটকক্ষের দ্বার বাহির হইতে বন্ধ হইয়া গেলে চিত্রক দেখিল রন্ধ্রহীন অন্ধকারের মধ্যে সে দাঁড়াইয়া আছে। কিন্তু কূটকক্ষের বায়ু সম্পূর্ণ নিশ্চল ও বদ্ধ নহে, কোনও অদৃশ্য পথে বায়ু চলাচল হইতেছে শ্বাস রোধ হইয়া মরিবার ভয় নাই।

চিত্রকের হস্তদ্বয় রদ্বারা পশ্চাতে আবদ্ধ ছিল, প্রতীহার খুব দৃঢ় করিয়া বাঁধিয়াছিল। কিছুক্ষণ চেষ্টা করিবার পর সে বন্ধনের ভিতর হইতে হাত বাহির করিয়া লইল। সৈনিকের বিচিত্র জীবনে এই কৌশলটি সে আয়ত্ত করিয়াছিল।

তারপর অন্ধকারে অতি ধীরে সে সোপান অবতরণ করিতে লাগিল। পাঁচ ছয়টি ধাপ নামিবার পর পদদ্বারা অনুভব করিয়া বুঝিল সোপান শেষ হইয়া চত্বর আরম্ভ হইয়াছে।

এই চত্বর কতখানি বিস্তৃত তাহা জানিবার কৌতূহল চিত্রকের ছিল না, কূটকক্ষ হইতে পলায়নের পথ থাকা সম্ভব নয়, থাকিলেও এই অন্ধকারে তাহা আবিষ্কার করা অসাধ্য। চিত্রক শেষ সোপানের উপর বসিয়া ভাবিতে আরম্ভ করিল। তাহার মনে হইল সে জীবনের শেষ সোপানে আসিয়া উপনীত হইয়াছে। তাহার হাসি আসিল। নিয়তির জালে সে ধরা পড়িয়াছে। কিন্তু আশ্চর্য! তাহার অকিঞ্চিৎকর জীবনকে সমাপ্তির উপকূলে পৌঁছাইয়া দিবার জন্য নিয়তির এত উদ্যোগ আয়োজন, এত ষড়যন্ত্র? সে যোদ্ধা, মৃত্যুর সহিত তাহার পরিচয় ঘনিষ্ঠ। তবে আজ মৃত্যু সিধা পথে তীরের মুখে বা অসির ফলায় না আসিয়া এমন কুটিল পথে আসিল কেন? জ্ঞানের উন্মেষ হইতে নিজের জীবনের কাহিনী তাহার মনে পড়িল। মৃত্যু বহুবার তাহার সম্মুখে আসিয়াছে, আবার হাসিয়া অবজ্ঞাভরে ফিরিয়া গিয়াছে; কিন্তু এত আড়ম্বর করিয়া তো কখনও আসে নাই!

শৈশবের কথা তাহার ভাল করিয়া মনে পড়ে না। যখন তাহার অনুমান পাঁচ বৎসর বয়স তখন কোন্ এক নগরে একটা বিকলাঙ্গ লোকের সহিত সে বাস করিত। লোকটা বোধহয় অর্ধ-উন্মাদ ছিল, কখনও তাহাকে প্রহার করিত, কখনও বা আদর করিত। তাহার একটা শাণিত ছুরি ছিল, সেই ছুরি দিয়া সে চিত্রকের দেহ কাটিয়া ক্ষতবিক্ষত করিয়া দিত, আবার জঙ্গল হইতে লতাপাতা আনিয়া সযত্নে বাঁধিয়া সেই ক্ষত আরোগ্য করিত। একদিন হঠাৎ পাগলটা কোথায় চলিয়া গেল, আর ফিরিয়া আসিল না।

অতঃপর কিছুদিনের ঘটনা চিত্রকের মনে নাই, কি করিয়া কোথায় কাহার আশ্রয়ে কৈশোরের সীমান্তে উপনীত হইল তাহা তাহার স্মৃতি হইতে মুছিয়া গিয়াছে।

যৌবনের প্রারম্ভে সে এক যাযাবর বণিক সম্প্রদায়ের সহিত ঘুরিয়া বেড়াইত, তাহাদের সংসর্গে কিছু কিছু লিখিতে ও পড়িতে শিখিয়াছিল। সার্থবাহ বণিকেরা উষ্ট্রপৃষ্ঠে পণ্য লইয়া দেশ দেশান্তরে বিচরণ করিয়া বেড়াইত, এক নগর হইতে অন্য নগরে যাইত। চিত্ৰক তাহাদের সঙ্গে থাকিয়া বহু সমৃদ্ধ নগর দেখিয়াছিল। পুরুষপুর মথুরা বারাণসী পাটলিপুত্র তাম্রলিপ্ত উজ্জয়িনী কাঞ্চী—উত্তরাপথ ও দক্ষিণাপথের বিচিত্র শোভাশালিনী নানা নগরীর সহিত চিত্রকের সাক্ষাৎ পরিচয় ঘটিয়াছিল।

বণিক সম্প্রদায় ধর্মে জৈন ছিল, তাহারা আমিষ আহার করিত না। অথচ মৎস্য মাংসের প্রতি চিত্রকের একটা প্রকৃতিগত আকর্ষণ ছিল, সে সুযোগ পাইলেই লুকাইয়া পশুমাংস আহার করিত। একদিন সে ধরা পড়িয়া গেল।

বণিক সম্প্রদায় তাহাকে বিদায় করিয়া দিল। চিত্রকের দেশ নাই, আত্মীয় নাই—জগতে সে সম্পূর্ণ একাকী। এই সময় হইতে তাহার যোদ্ধৃজীবনের আরম্ভ। তাহার দেহ স্বভাবতই বলিষ্ঠ, সে সহজে অস্ত্রচালনা করিতে শিখিল। জগতে যাহার কেহ নাই সে আত্মনির্ভর হইতে শেখে, চিত্ৰক বুদ্ধি ও বাহুবল সম্বল করিয়া জীবনযুদ্ধে ঝাঁপাইয়া পড়িল।

আর্যাবর্তে তখন সর্বত্রই যুদ্ধবিগ্রহ চলিতেছে। চিত্ৰক যখন যে পক্ষে পাইল যুদ্ধ করিল; কোনও রাষ্ট্রের প্রতি তাহার মমত্ব নাই, যেখানে অর্থলাভের সম্ভাবনা দেখিল সেইখানে গিয়া উপস্থিত হইল। এক পক্ষের পরাজয়ে যুদ্ধ থামিয়া গেলে আবার নূতন যুদ্ধের অন্বেষণে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল।

এইভাবে তাহার জীবনের শেষ দশ বর্ষ কাটিয়াছে। সৌবীর দেশে একটা অন্তঃকলহজাত ক্ষুদ্র যুদ্ধ মিটিয়া গেলে সে আবার ভাগ্য অন্বেষণে বাহির হইয়াছিল। সৌবীর যুদ্ধে সে বিশেষ লাভবান হইতে পারে নাই, উপরন্তু তাহার অশ্বটি মরিয়াছিল। সেখান হইতে লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরিতে ঘুরিতে সে গান্ধার অঞ্চলে সমরসম্ভাবনার জনশ্রুতি শুনিয়া সেই পথে যাত্রা করিয়াছিল। গান্ধারের পথ কিন্তু সরল নয়; গিরি-সঙ্কটকুটিল অজ্ঞাত দেশের পাকচক্রে পথ হারাইয়া অবশেষে নিঃস্ব অবস্থায় সে বিটঙ্ক রাজ্যে উপস্থিত হইয়াছিল। তারপর সুগোপার জলসত্র হইতে আজিকার এই ঘটনাবহুল দিবসটি বিসর্পিল গতিতে অগ্রসর হইয়া শেষে এই অন্ধকার কূটকক্ষে পরিসমাপ্তি লাভ করিয়াছে।

মুদিত চক্ষে চিত্ৰক নিজ জীবনকথা চিন্তা করিতেছিল; চিন্তার সূত্র মাঝে মাঝে ছিন্ন হইয়া যাইতেছিল, আবার যুক্ত হইয়া আপন পথে চলিতেছিল। ক্লান্ত দেহ যতই নিদ্রার অতলে ড়ুবিয়া যাইতে চাহিতেছিল, আজিকার বহু ঘটনাবিদ্ধ মন ততই সচেতন থাকিবার চেষ্টা করিতেছিল।

নিদ্রা ও জাগরণের মধ্যে এইরূপ দ্বন্দ্ব চলিতেছিল, এমন সময় চিত্রকের চেতনা সম্পূর্ণ জাগ্রত হইয়া উঠিল। তাহার মনে হইল কে যেন অতি লঘু করস্পর্শে তাহার মুখে হাত বুলাইয়া দিল। নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে সে কাহাকেও দেখিতে পাইল না; প্রথমে মনে হইল হয়তো চর্মচটিকার পাখার স্পর্শ; ইহারা সূচীভেদ্য অন্ধকারে নিঃশব্দে উড়িয়া বেড়ায়, স্পর্শেন্দ্রিয়ের দ্বারা বাধাবন্ধ অনুভব করিয়া গতি পরিবর্তন করিতে পারে। হয়তো চর্মচটিকাই হইবে।

কিন্তু যদি চর্মচটিকা না হয়? যদি জীবন্ত কোনও প্রাণীই না হয়? চিত্রকের মেরুযষ্টির ভিতর দিয়া একটা শিহরণ বহিয়া গেল। সে অন্ধকারে চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া সতর্কভাবে বসিয়া রহিল।

আবার তাহার মুখের উপর লঘু করাঙ্গুলির স্পর্শ হইল, যেন কেহ অঙ্গুলির দ্বারা তাহার মুখাবয়ব অনুধাবন করিবার চেষ্টা করিতেছে; তাহার গণ্ডে তীক্ষ্ণ নখের আঁচড় লাগিল। চিত্রক প্রস্তুত ছিল, সে ক্ষিপ্র হস্ত সঞ্চালনে অদৃশ্য স্পর্শকারীকে ধরিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু কিছুই ধরিতে পারিল না। যে স্পর্শ করিয়াছিল সে সরিয়া গিয়াছে। চিত্ৰক তখন উচ্চকণ্ঠে বলিয়া উঠিল—কে? কে তুমি?

কয়েক মুহূর্ত পরে তাহার সম্মুখের অন্ধকারে গভীর নিশ্বাস পতনের শব্দ হইল। চিত্রকের সর্বাঙ্গের রোম কণ্টকিত হইয়া উঠিল। সে কম্পিতস্বরে বলিল—কে তুমি? যদি মানুষ হও উত্তর দাও। কিছুক্ষণ নীরব। তারপর অদূরে অস্ফুট শব্দ হইতে লাগিল। চিত্রক উৎকর্ণ হইয়া শুনিল। মানুষের কণ্ঠস্বরই বটে, কিন্তু শব্দগুলির কোনও অর্থ হয় না। যেন স্বপ্নের ঘোরে কেহ অস্পষ্ট অর্থহীন আকুতি প্রকাশ করিবার চেষ্টা করিতেছে। মনুষ্য বুঝিয়া চিত্রক আবার স্বস্থ হইল। সে বলিল—শব্দ শুনিয়া মনে হইতেছে তুমি মানুষ। স্পষ্ট করিয়া বল, কে তুমি?

দীর্ঘকাল আর কোনও শব্দ নাই। চিত্রকের মনে হইল, সে বুঝি কল্পনায় শব্দ শুনিয়াছিল, সমস্তই এই কুহকময় অন্ধকারের ছলনা। তাহার স্নায়ুপেশী আবার শক্ত হইতে লাগিল। এ কিরূপ মায়া? অলৌকিক মায়া?

আমি বন্দিনী…বন্দিনী….

না, মানুষের কণ্ঠস্বর—ছলনা নয়। কথাগুলি অতি দ্বিধাভরে কথিত হইলেও স্পষ্ট। বক্তা যেন আরও নিকটে আসিয়াছে।

চিত্ৰক বলিল—বন্দিনী? তুমি নারী?

হাঁ।

নিশ্চিন্ত হইলাম। ভাবিয়াছিলাম তুমি প্রেতযোনি।

তুমি কে?

চিত্ৰক হাসিল—আমিও বন্দী। তুমি কত দিন বন্দী আছ?

কতদিন—জানি না। এখানে দিন রাত্রি নাই, মাস বর্ষ নাই— কণ্ঠস্বর মিলাইয়া গেল।

চিত্ৰক বলিল—তুমি আমার কাছে এস। ভয় নাই, আমি তোমার অনিষ্ট করিব না।

কিছুক্ষণ পরে প্রশ্ন হইল—তুমি কি হূণ?

না, আমি আর্য।

তখন অদৃশ্য রমণী কাছে আসিয়া চিত্রকের জানুর উপর হাত রাখিল, চিত্ৰক তাহার হস্ত স্পর্শ করিয়া দেখিল, কঙ্কালসার হস্ত, শীর্ণ অঙ্গুলির প্রান্তে দীর্ঘ নখ। তাহার জানুর উপর হস্তটি থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। চিত্ৰক বলিল—উপবিষ্ট হও। আমাকে ভয় করিও না, আমিও তোমারই মত অসহায়। মনে হয় দীর্ঘকাল বন্দিনী আছ। তুমি অন্ধকারে দেখিতে পাও?

অল্প।

তোমার বয়স কত?

এতক্ষণে রমণী যেন অনেকটা সাহস পাইয়াছে, সে সোপানের উপর উপবেশন করিল। যখন কথা কহিল তখন তাহার কথা আরও স্পষ্ট ও সুসংলগ্ন শুনাইল। যেন সে দীর্ঘকাল কথা না বলিয়া কথা বলিতে ভুলিয়া গিয়াছিল, আবার ক্রমশ সুসঙ্গত বাশক্তি ফিরিয়া পাইতেছে।

রমণী বলিল—আমার বয়স কত জানি না। যখন বন্দিনী হই তখন কুড়ি বছর বয়স ছিল। কে তোমাকে বন্দিনী করিয়াছিল?

হূণ।

হূণ? কোন হূণ?

রমণী থামিয়া থামিয়া বলিতে লাগিল—একটা কদাকার খর্বকায় হূণ। রাজপুরী হুণেরা আক্রমণ করিয়াছিল। আমি ছিলাম রাজপুত্রের ধাত্রী…আমি রাজপুত্রকে স্তন্যদান করিতেছিলাম এমন সময় হুণেরা রাজ-অবরোধে প্রবেশ করিল…তাহারা রাজপুত্রকে আমার কোল হইতে কাড়িয়া লইয়া তলোয়ারের উপর লোফালুফি করিতে লাগিল, একটা কদাকার হূণ আমাকে হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া আসিল–

সর্বনাশ। এ যে পঁচিশ বছর আগের কথা! তুমি পঁচিশ বছর বন্দিনী আছ?

পঁচিশ বছর?…তা জানি না। …কদাকার হূণটা আমাকে টানিতে টানিতে স্তম্ভগৃহে লইয়া আসিল…নির্জন স্তম্ভগৃহে আমি তাহার হাত ছাড়াইবার অনেক চেষ্টা করিলাম, কিন্তু…স্তম্ভগৃহের দেয়ালে একটা গুপ্তদ্বার ছিল, কেমন করিয়া খুলিয়া গিয়াছিল..হূণটা আমাকে এই অন্ধকারে ঠেলিয়া দিয়া গুপ্তদ্বার বন্ধ করিয়া দিল—

তারপর?

তারপর আর জানি না…সেই অবধি এই রন্ধ্রের মধ্যে আছি। রন্ধ্র বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত, কিন্তু বাহির হইবার পথ নাই…সেই হূণটা মাঝে মাঝে খাদ্য ফেলিয়া দিয়া যায়, তাহাই খাই…হূণটা আমাকে অন্ধকারে দেখিতে পায় না তাই ধরিবার চেষ্টা করে না–

চিত্ৰক পূর্বে মোঙের কাহিনীর কিছু অংশ শুনিয়াছিল, এখন রমণীর বৃত্তান্ত শুনিতে শুনিতে পঁচিশ বৎসর পূর্বের হূণ উৎপাতের চিত্র যেন অস্পষ্টভাবে দেখিতে পাইল। রমণীর জন্য তাহার অন্তরে সমবেদনার উদয় হইল, সে অন্ধকারে তাহার হস্তে হস্ত রাখিয়া বলিল—হতভাগিনি! তোমার স্বজন কি কেহ ছিল?

রমণী সুদীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিল।

স্বামী ছিল—একটি কন্যা ছিল—

হয়তো তাহারা বাঁচিয়া আছে। কাল প্রাতে আমি বাহির হইব। যদি প্রাণে বাঁচি তোমার উদ্ধারের চেষ্টা করিব। তোমার নাম কি?

পৃথা।

ভাল, পৃথা, আমি এবার একটু নিদ্রা দিব, রাত্রি বোধহয় প্রভাত হইতে চলিল। কাল প্রাতে সম্ভবত শূলেই চড়িতে হইবে। কিন্তু একটা উপায় চিন্তা করিয়াছি, হয়তো রক্ষা পাইতেও পারি।

তুমি কে, তাহা তো বলিলে না।

আমি চোর। তুমি কি রাত্রে ঘুমাও না?

কখন ঘুমাই কখন জাগিয়া থাকি বুঝিতে পারি না। তুমি ঘুমাও, আমি জাগিয়া থাকিব।

Category: কালের মন্দিরা (উপন্যাস) - শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
পূর্ববর্তী:
« ০৫. মদিরা ভবন
পরবর্তী:
০৭. মুক্তি »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑