গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

০৭. অবন্তীর রাজসভা

অবন্তীর রাজসভা। কুন্তল রাজসভার সহিত সাদৃশ্য থাকিলেও এ আরও বৃহৎ ব্যাপার। উপরন্তু অবরোধের মহিলাগণের জন্য প্রাচীরগাত্রে উচ্চ প্রেক্ষামঞ্চের ব্যবস্থা আছে।

অপরাহ্ণকালে সভার প্রধান বেদিকার উপর মহারাজ বিক্রমাদিত্য আসীন। পঁয়ত্রিশ বৎসর বয়সের দৃপ্তকায় পুরুষ; দণ্ড মুকুটাদির আড়ম্বর নাই, তিনি বেদীর আস্তরণের উপর কেবলমাত্র একটি স্থূল উপাধান আশ্রয় করিয়া অর্ধশয়ান আছেন।

চারিপাশে কয়েকজন অন্তরঙ্গ সভাসদ নিকটে-দূরে অবস্থান করিতেছেন। বরাহমিহির ও অমরসিংহ একত্র বসিয়া নিম্নস্বরে বাক্যালাপ করিতেছেন এবং মাঝে মাঝে তুড়ি দিয়া হাই তুলিতেছেন। এক শীর্ণকায় মুণ্ডিতচিকুর কবি দন্তহীন মুখ রোমন্থনের ভঙ্গিতে নাড়িতে নাড়িতে একাগ্র মনে শ্লোক রচনা করিতেছেন। প্রবীণ মহামন্ত্রী এক পাশে বসিয়া পারাবতপুচ্ছের সাহায্যে কর্ণকুহর কণ্ডূয়ন করিতেছেন। তাঁহার অনতিদূর পশ্চাতে স্থূলকায় বিদূষক চিৎ হইয়া উদর উদ্‌ঘাটনপূর্বক নিদ্রাসুখ উপভোগ করিতেছে।

মহারাজের শিয়রের কাছে এক তাম্বূলকরঙ্কবাহিনী যুবতী বসিয়া একমনে তাম্বূল রচনা করিয়া সোনার থালে রাখিতেছে। অন্য একটি যবনী সুন্দরী শীতল ফলাম্লরসের ভৃঙ্গার হস্তে নতজানু হইয়া চিত্রার্পিতার ন্যায় একপাশে অবস্থান করিতেছে।

কর্মহীন অপরাহ্ণের আলস্য সকলকে চাপিয়া ধরিয়াছে। মহারাজ উত্ত্যক্ত হইয়া উঠিয়াছেন, কিন্তু কেহ একটা রসের কথা পর্যন্ত বলিতেছে না। সভাটা যেন নিতান্ত ব্যাজার হইয়া শেষ পর্যন্ত ঝিমাইয়া পড়িয়াছে। তাহার মধ্যে বরাহমিহির ও অমরসিংহের মৃদু জল্পনা ঝিল্লিগুঞ্জনের ন্যায় শুনাইতেছে।

বরাহমিহির প্রকাণ্ড একটি হাই তুলিয়া হস্তদ্বারা উহা চাপা দিলেন, তারপর ঈষৎ উচ্চকণ্ঠে বলিলেন— ‘রবি এবার মকর রাশিতে প্রবেশ করবেন।’

বিক্রমাদিত্য একটু উৎসুকভাবে সেইদিকে তাকাইলেন— ‘কি বললেন মিহিরভট্ট?’

বরাহমিহির বলিলেন— ‘আমি বলছিলাম মহারাজ, যে রবি এবার মকর রাশিতে গিয়ে ঢুকবেন।’

মহারাজ আবার উপাধানে হেলান দিয়া বসিলেন, ব্যঙ্গ-বঙ্কিম মুখভঙ্গি করিয়া বলিলেন— ‘হুঁ, ঢুকবেন তো এত দেরি করছেন কেন? তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়লেই পারেন। আমার তো এই আলস্য আর নৈষ্কর্ম্য অসহ্য হয়ে উঠেছে। এ রাজ্যে কেউ যেন কিছু করছে না, কেবল বসে বসে ঝিমচ্ছে। ইচ্ছে করে সৈন্য সামন্ত নিয়ে আবার যুদ্ধযাত্রা করি। তবু তো একটু কিছু করা হবে।’

মহামন্ত্রী কর্ণকণ্ডূয়নে ক্ষণকাল বিরতি দিয়া মিটমিটি হাসিলেন, গূঢ় পরিহাসের কণ্ঠে বলিলেন— ‘কার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করবেন মহারাজ? শত্রু তো একটিও অবশিষ্ট নেই।’

বিরক্তি সত্ত্বেও মহারাজের মুখে হাসি ফুটিল— ‘তাও বটে। বড় ভুল হয়ে গেছে মন্ত্রী। সবগুলো শত্রুকে একেবারে নিপাত করে ফেলা উচিত হয়নি। অন্তত দু’একটা শক্রকে এই রকম দুর্দিনের জন্য রাখা উচিত ছিল।’

এই সময় রচনা-রত কবি গলার মধ্যে ঘড়্‌ ঘড়্‌ শব্দ করিলেন, তাঁহার রচনা শেষ হইয়াছে। রাজা তাঁহার প্রতি কটাক্ষপাত করিয়া বলিলেন— ‘কী হয়েছে কবি, আপনি অমন করছেন কেন? হাতে ওটা কি?’

গলা পরিষ্কার করিয়া কবি বলিলেন— ‘শ্লোক লিখেছি মহারাজ। আপনার প্রশস্তি রচনা করেছি।’

বিক্রমাদিত্য নিরুপায়ভাবে একবার চারিদিকে চাহিলেন, শেষে গভীর নিশ্বাস মোচন করিয়া বলিলেন— ‘হুঁ। বেশ পড়ুন— শুনি।’

মহারাজের প্রশস্তি পাঠ হইবে, সুতরাং অন্য সকলেও সেদিকে মন দিলেন। কবি শ্লোকটি পাঠ করলেন—

‘শত্রুণাং অস্থিমুণ্ডানাং শুভ্রতাং উপহাস্যতি।

হে রাজন্‌ তে যশোভাতি শরচ্চন্দ্র মরীচিবৎ ॥’

সকলে অবিচলিত মুখচ্ছবি লইয়া বসিয়া রহিলেন; কেবল অমরসিংহ ভ্রূকুটি করিয়া কবির দিকে তাকাইলেন। বোধহয় শব্দ প্রয়োগে কিছু ভুল হইয়া থাকিবে।

এই জাতীয় শুষ্ক কবিত্বহীন প্রশস্তি শুনিয়া রাজার কর্ণজ্বর উপস্থিত হইয়াছিল, কিন্তু তবু কবির প্রাণে আঘাত দিতে তাঁহার মন সরিল না। অথচ সাধুবাদ করাও চলে না। তিনি বিপন্নভাবে চারিদিকে দৃষ্টি ফিরাইলেন।

তাম্বূলকরঙ্কবাহিনী এই সময় তাম্বূলপূর্ণ থালি রাজার সম্মুখে ধরিল। রাজা চকিত হইয়া তাহার পানে চাহিলেন, তারপর মৃদুস্বরে বলিলেন— ‘মদনমঞ্জরি, তুমিই এই কবিতার বিচারক হও। একে কি কবিতা বলা চলে? মোট কথা, কবিকে পান দেওয়া যেতে পারে কিনা?’

মদনমঞ্জরী অতি অল্প হাস্য করিল, তাহার অধর একটু নড়িল— ‘পারে মহারাজ। কারণ কবিতা যেমনই হোক, তাতে আপনার গুণগান করা হয়েছে।’

মহারাজ একটি নিশ্বাস ত্যাগ করিলেন, পান লইয়া মুখে পুরিতে পুরিতে স্বাভাবিক স্বরে বলিলেন— ‘তাম্বূলকরঙ্কবাহিনী, কবিকে তাম্বূল উপহার দাও, তাঁর কবিতা শুনে আমরা প্রীত হয়েছি।’

মদনমঞ্জরী উঠিয়া গিয়া তাম্বূলের থালি কবির সম্মুখে ধরিল, কবি লুব্ধহস্তে একটি পান লইয়া মুখে পুরিলেন। রাজা সদয় কণ্ঠে বলিলেন— ‘কবি, আজ আপনার যথেষ্ট পরিশ্রম হয়েছে, আপনি গৃহে গিয়ে বিশ্রাম করুন।’

‘জয়োস্তু মহারাজ’ বলিয়া কবি রাজসভা হইতে প্রস্থান করিলেন।

রাজা আর একবার উপাধানের উপর এলাইয়া পড়িয়া সনিশ্বাসে বলিলেন— ‘আমার বয়স্যটি কোথায় কেউ বলতে পারেন?’

মন্ত্রী পশ্চাদ্দিকে একটি বক্র কটাক্ষপাত করিয়া বলিলেন— ‘এই যে এখানে মহারাজ; অকাতরে ঘুমোচ্ছে।’

মহারাজ আবার উঠিয়া বসিলেন— ‘ঘুমোচ্ছে! আমরা সকলে জেগে আছি— অন্তত জেগে থাকবার চেষ্টা করছি— আর পাষণ্ড ঘুমোচ্ছে। তুলে দাও মন্ত্রী।’

আদেশ পাইবামাত্র মন্ত্রী পারাবতপুচ্ছটি বিদূষকের নাসারন্ধে প্রবিষ্ট করাইয়া পাক দিলেন। বিদূষক ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিল— ‘আরে রে মন্ত্রি-শাবক!— মহারাজ, আপনার এই অস্থিচর্মসার মন্ত্রীটা আমার নাকে বিষপ্রয়োগ করেছে।’

মন্ত্রীর ভ্রূক্ষেপ নাই, তিনি নির্বিকার চিত্তে কানে পালক দিতেছেন; রাজা গভীর ভর্ৎসনার কণ্ঠে বিদূষককে বলিলেন— ‘বয়স্য, রাজসভায় তুমি ঘুমোচ্ছিলে?’

বিদূষক কট্‌মট্‌ করিয়া মন্ত্রীর পানে তাকাইল, বলিল— ‘কে বলে ঘুমোচ্ছিলাম? কোন্‌ উচ্চিটিঙ্গ বলে?— মহারাজ, আমি মনে মনে আপনার প্রশস্তি রচনা করছিলাম।’

মহারাজের অধর কোণে একটু হাসি দেখা দিল; তিনি পুনশ্চ গম্ভীর হইয়া বলিলেন— ‘প্রশস্তি রচনা করছিলে? বটে। ভাল, শোনাও তোমার প্রশস্তি। কিন্তু মনে থাকে যেন, যে-প্রশস্তি আমরা এখনি শুনেছি তার চেয়ে যদি ভাল না হয় তাহলে তোমাকে শূলে যেতে হবে।’

‘তথাস্তু।’ বিদূষক আসিয়া রাজার সম্মুখে পদ্মাসনে বসিল, বলিল— ‘শ্রুয়তাং মহারাজ—

তাম্বূলং যৎ চর্বয়ামি সর্ব তে রিপুমুণ্ডবঃ।

পিক্‌ ত্যজামি পুচুৎ কৃত্বা তদেব শত্রু শোণিতম্‌।

প্রাকৃত ভাষায় অস্যার্থ হচ্ছে— আমরা যে পান খাই তা সর্বৈব মহারাজের শত্রুদের মুণ্ডু, আর পুচ্‌ করে যে পিক্‌ ফেলি তা নিছক শত্রুশোণিত।’

মহারাজের আদেশের অপেক্ষা না করিয়াই বিদূষক সুবর্ণথালি হইতে এক খাম্‌চা পান তুলিয়া মুখে পুরিল এবং সাড়ম্বরে চিবাইতে লাগিল। মহারাজ হাসিলেন; অন্য সকলেও মুচ্‌কি মুচ্‌কি হাসিতে লাগিলেন।

কালিদাসের কুটির প্রাঙ্গণের বেষ্টনীতে লতা উঠিয়াছে, লতায় ফুল ধরিয়াছে।

পূর্বাহ্ণে কালিদাস গৃহে নাই। মালিনী পরম স্নেহভরে আঁচল দিয়া কবির বেদিকাটি মুছিয়া দিতেছে। মার্জন শেষ হইলে সে কুটির হইতে কবির লেখনী মসীপাত্র ও পুঁথি লইয়া আসিল, সযত্নে সেগুলি বেদীর উপর সাজাইয়া রাখিল। তারপর ফুল দিয়া বেদীর চারিপাশ সাজাইল। অবশেষে একটি তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলিয়া উৎসুক নেত্রে প্রাঙ্গণদ্বারের পানে তাকাইল।

মালিনীর মুখ দেখিয়া বুঝিতে বাকি থাকে না যে সে মরিয়াছে। প্রাঙ্গণদ্বার দিয়া কালিদাস সিক্ত বস্ত্র নিঙড়াইতে নিঙড়াইতে প্রবেশ করিলেন; তিনি পূজা ও স্নানের জন্য শিপ্রার তীরে গিয়াছিলেন।

মালিনী বলিল— ‘আসা হল? বাবাঃ, পুজো আর স্নান যেন শেষই হয় না। — নাও বোসো। কী হচ্ছিল এতক্ষণ?’

কালিদাস ভাল মানুষটির মত বেদীর উপর বসিলেন, মৃদু হাসিয়া বলিলেন— ‘পুজো আর স্নান।’

মালিনী সিক্ত বস্ত্র লইয়া নিজের কাঁধের উপর ফেলিল, তারপর এক রেকাবি ফল কবির কোলের কাছে ধরিয়া দিয়া বলিল— ‘আচ্ছা, এবার এগুলো মুখে দেওয়া হোক।’

কালিদাস ফলগুলি দেখিয়া বলিলেন— ‘এ কোথা থেকে এল?’

মালিনী বলিল— ‘এল কোথাও থেকে। সে খোঁজে তোমার দরকার?’

কালিদাস মৃদুহাস্যে বলিলেন— ‘আমার ভাণ্ডারে তো যতদূর মনে পড়ছে—’

মালিনী বলিল— ‘চারটি আতপ চাল আর দু’টি ঝিঙে ছাড়া কিছু নেই। — আচ্ছা, খাবার সামিগ্রি ঘরে এনে রাখতে মনে না থাকে, আমাকে বল না কেন? দুপুরবেলা না হয় দু’টি ভাত ফুটিয়ে নিলেই চলে যাবে— বামুন মান্‌ষের কথাই আলাদা— কিন্তু সকালে স্নান আহ্নিক করে কিছু মুখে দিতে হয় না? দুটো বাতাসা কি একছড়া কলাও ঘরে রাখতে নেই?’

কালিদাস করুণ কণ্ঠে বলিলেন— ‘ভুল হয়ে যায় মালিনী।’

‘ভুল— সব তাতেই ভুল। এমন মানুষও দেখিনি কখনো— খাবার কথা ভুল হয়ে যায়!’

‘ঐ তো মালিনী, কবি জাতটাই ঐ রকম। পৃথিবীতে যে-কাজ সবচেয়ে দরকারী, তাতেই তাদের ভুল হয়ে যায়। আমার এক তুমিই ভরসা।’

অনির্বচনীয় প্রীতিতে মালিনীর মুখ ভরিয়া উঠিল। তবু সে তিরস্কারের ভঙ্গিতেই বলিল— ‘আচ্ছা হয়েছে, এবার খাওয়া হোক। মনে থাকে যেন গল্প যে-পর্যন্ত শুনেছি তারপর থেকে পড়ে শোনাতে হবে।’ সে সিক্ত বস্ত্র বেড়ার উপর শুকাইতে দিতে গেল, কালিদাস প্রসন্নমুখে আহারে মন দিলেন।

আহার শেষ হইলে আচমন করিয়া কালিদাস সম্মুখে রক্ষিত পুঁথি তুলিয়া লইলেন। ইত্যবসরে মালিনী বেদীর নীচে আসিয়া বসিয়াছিল এবং বেদীর উপর একটি বাহু রাখিয়া কালিদাসের মুখের পানে চাহিয়া পরম তৃপ্তিভরে প্রতীক্ষা করিতেছিল। কালিদাস পুঁথির পাতাগুলি সাজাইতে সাজাইতে বলিতে আরম্ভ করিলেন— ‘আচ্ছা শোনো এবার। ইন্দ্রসভা থেকে বিদায় নিয়ে মদন আর বসন্ত হিমালয়ে মহাদেবের তপোবনে উপস্থিত হলেন। অমনি হিমালয়ের বনে উপত্যকায় অকালবসন্তের আবির্ভাব হল। শুকনো অশোকের ডালে ফুল ফুটে উঠল, আমের মঞ্জরীতে ভোমরা এসে জুটলো। শোনো—

অসূত সদ্যঃ কুসুমান্যশোকঃ স্কন্ধাৎপ্রভৃত্যেব সপল্লবানি

পাদেন নাপৈক্ষত সুন্দরীনাং সম্পর্কমাশিঞ্জিত নূপুরেণ ॥’

কালিদাস একটু সুর করিয়া শ্লোকের পর শ্লোক পড়িয়া চলিলেন, মালিনী মুগ্ধ তন্ময় হইয়া শুনিতে লাগিল। শুনিতে শুনিতে তাহার চোখ দু’টি কখনো আবেশভরে মুকুলিত হইয়া আসিল, কখনো বা বিস্ফারিত হইয়া উঠিল; নিশ্বাস কখনো দ্রুত বহিল, কখনো স্তব্ধ হইয়া রহিল। মন্ত্রমুগ্ধ সর্পীর মত তাহার দেহ ছন্দের তালে তালে দুলিতে লাগিল। এ কি অনির্বচনীয় অনুভূতি! প্রতি শব্দ যেন মূর্তিমান হইয়া চোখের সামনে আসিয়া দাঁড়াইতেছে। কল্পনার অলৌকিক লীলাবিলাসে, ভাবের অগাধ গভীরতায়, ছন্দের অনাহত মন্দ্র মহিমায় মালিনী আপনাকে হারাইয়া ফেলিল। এমন গান সে আর কখনো শোনে নাই। মালিনী জানিত না যে এমন গান মানুষ পূর্বে আর কখনো শোনে নাই, সে-ই প্রথম শুনিল।

তৃতীয় সর্গ সমাপ্ত করিয়া কালিদাস ধীরে ধীরে পুঁথি বন্ধ করিলেন। কিছুক্ষণ উভয়ে নীরব। তারপর মালিনী গভীর একটি নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বাষ্পাকুল নেত্র কালিদাসের মুখের পানে তুলিল, ভাঙা ভাঙা স্বরে বলিল— ‘কবি, স্বর্গ বুঝি এমনিই হয়? কোন্‌ পুণ্যে আমি স্বর্গ চোখে দেখলুম!— না না, আমি এর যোগ্য নই, এ গান আমাকে শোনাবার জন্যে নয়— এ গান রাজাদের জন্যে। দেবতাদের জন্যে—’সহসা মালিনী কবির হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিল— ‘কবি, আমার একটা কথা শুনবে? রানিমাকে তোমার গান শোনাবো?’

কালিদাসের মুখে বেদনার ছায়া পড়িল— ‘মালিনী, রাজারানীদের আমার গান শুনিয়ে কী লাভ! তোমার ভাল লেগেছে, এই যথেষ্ট।’

মালিনী ব্যাকুলভাবে বলিল— ‘না না কবি, আমার ভাল-লাগা কিছু নয়, আমার ভাল-লাগা তুচ্ছ। আমি কতটুকু? আমার বুকে আমি এত ভাল-লাগা ধরে রাখতে পারি না। কবি, বলো আমার কথা শুনবে? রাজাকে শোনাতে না চাও শুনিও না, কিন্তু রানিমা’কে তোমার গান শোনাতেই হবে। বলো শোনাবে! আমার রানী ভানুমতী— ওগো কবি, তুমি জানো না— তাঁর মত মানুষ আর হয় না। তিনিই তোমার মরম বুঝবেন, তিনি তোমার গানে ডুবে যাবেন—’

কালিদাসের বিমুখতা ক্রমে দূর হইতেছিল, তবু তিনি আপত্তি তুলিয়া বলিলেন— ‘কিন্তু কাব্য যে এখনো শেষ হয়নি।’

মালিনী বলিল— ‘না হোক। যা হয়েছে তাই শোনাবে।’

কালিদাস তখন দ্বিধাগ্রস্তভাবে বলিলেন— ‘তা— ভাল। রানী যদি শুনতে চান—’

কালিদাসের কথা শেষ হইবার পূর্বেই মালিনী সোল্লাসে উঠিয়া দাঁড়াইল।