০৬৫. সত্য-প্রতিজ্ঞা

৬৫.

ভীষ্ম তার পূর্বকৃত সত্য-প্রতিজ্ঞা ছেড়ে মায়ের কথা শুনতে রাজি হলেন না। মায়ের কথা শোনাও নিশ্চয়ই ধর্ম, আপদ্ধর্মও ধর্ম, আবার সত্যরাও ধর্ম। মহাকাব্যের সমাজে এই সমস্ত ধর্মেরই মূল্য আছে, আবার এই ধর্ম সাধনের মধ্যে তরতমও আছে। মায়ের কথা, আপদ্ধর্ম–এই দুয়ের থেকেও ভীষ্মের কাছে প্রতিজ্ঞা-রক্ষার ধর্মই বড় হয়ে উঠল, কারণ প্রথমত বর্ণাশ্রমের আচারে ক্ষত্রিয়ের কাছে সত্য বা প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার মতো বড় ধর্ম আর নেই। আর দ্বিতীয়ত মা যা চান, অথবা এখন যা আপদ্ধর্ম বলে বলা হচ্ছে, তার সমাধান ভীষ্ম ছাড়াও অন্য লোকও করতে পারেন। অর্থাৎ বিকল্প ব্যবস্থা এখানে হতে পারে। ভীষ্ম মাকে বলেছেন–আপনি গুণবান কোনও ব্রাহ্মণকে নিযুক্ত করুন। তিনিই প্রসিদ্ধ ভরত বংশের ধারা রক্ষা করবেন।

যে বংশে পুরু, ভরত, কুরুর মতো রাজা জন্মেছেন, সেই বংশ উপযুক্তভাবে রক্ষা করতে গেলে যাকে-তাকে দিয়ে কাজ হবে না–এ কথা ভীষ্মের মতো আর কে জানেন। ভীষ্ম তাই চরম ‘প্রোফেশনালিজম’ দেখিয়ে জননী সত্যবতীকে বলেছেন–দরকার হলে টাকা-পয়সা কবুল করুন, কিন্তু গুণবান কোনও ব্রাহ্মণকে এই ব্যাপারে আমন্ত্রণ করে আনতে হবে– ব্রাহ্মণো গুণবান্ কশ্চিদ্ ধনেনোপনিমতাম্।

 ‘গুণবান ব্রাহ্মণ’–কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সত্যবতীর মাথায় চকিতে বিদ্যুৎ খেলে গেল। যেমন আমাদেরও হয়। কঠিন রোগ সারাতে গেলে আমরা ডাক্তার ডাকি। এখানে বিকল্প থাকে। আমরা কখনও প্রচুর টাকা-পয়সা খরচা করে বড় ডাক্তার ডাকি, এবং অর্থমূল্যের বিশ্বাসে তার ওপর ভরসাও করি। অন্যদিকে আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে যদি কেউ ডাক্তার থাকেন, তবে তার ওপরে আমরা কিন্তু কখনও কখনও বেশি নির্ভর করি। তিনি হয়তো বড় চিকিৎসকের তুলনায় কিছু কম উজ্জ্বল হতে পারেন, কিন্তু স্বজন বলেই তার মায়া-মমতা এবং ব্যক্তিগত স্পর্শগুলি আমাদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এখানে সত্যবতীর। ক্ষেত্রেও তাই হল।

তিনি অর্থমূল্যের বিনিময়ে বিধিসম্মতভাবেই একজন শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণকে দিয়ে তার দুই পুত্রবধূর গর্ভাধান করাতে পারেন। কিন্তু আপন রক্তের সম্বন্ধের মধ্যেই যদি সেই মমত্বময় বিপত্তারণ মানুষটি সত্যবতী পেয়ে যান, তবে এই রকম একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে অন্য ব্রাহ্মণকে ডেকে আনার প্রয়োজন কী? এর মধ্যেই সেই কাছের মানুষটির সন্ধান তিনি পেয়ে গেছেন, তাকে তিনি স্বচ্ছন্দে স্মরণ করতে পারছেন। কিন্তু সেই ব্যক্তিটি তার অত্যন্ত কাছের মানুষ হলেও হস্তিনার রাজবাড়ি তাকে চেনে না। হস্তিনার রাজবধূর গর্ভে যেখানে সন্তান উৎপাদন করাতে হবে, সেখানে নিজের একক ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত রাজবাড়ির ভাগ্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না। তিনি যা ভাবছেন, তা মহারাজ শান্তনুর প্রথম পুত্র ভীষ্মের কাছে জানাতে হবে। পিতার জীবিত অবস্থা থেকেই যিনি প্রায় হস্তিনার রাজবাড়ির অভিভাবকের মতো, তাকে অতিক্রম করে সত্যবতী একা সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। যে সিদ্ধান্ত প্রসিদ্ধ ভরত-বংশের সামগ্রিক ধারাকে প্রভাবিত করবে, সেটা ভীষ্মের সঙ্গে আলোচনা করতেই হবে।

 সত্যবতী তার এই সখাসম পুত্রের কাছে সবই খুলে বলবেন ঠিক করলেন। কিন্তু এই মুহূর্তে তার বড় লজ্জা করছে। সেই কুমারী অবস্থায় মহামুনি পরাশরের সঙ্গে তার মিলন হয়েছিল–আজ এতদিন পরে সেই ক্ষণিক মিলনের কথা পুত্ৰকল্প ভীষ্মের কাছে বিবৃত করবেন। তিনি। তার বড় লজ্জা করল। লজ্জা পেলে মানুষ বোকার হাসি হেসে লজ্জাকে চাপা দিতে চায়। সত্যবতীও তাই করলেন। হাসি-হাসি মুখ করে দু-একবার ইচ্ছাকৃতভাবে থতমত খেয়ে-বাচা সংসজ্জমানয়া–সত্যবতীর তাঁর পূর্ব জীবনের এক চরম ঘটনা ভীষ্মকে বলতে উদ্যত হলেন–বিহসন্তীব সত্ৰীড় ইদং বচনমব্রবীৎ।

নিজের জীবনের এই লুক্কায়িত ঘটনা, যা হয়তো মহারাজ শান্তনুও জানতেন না, সেই ঘটনা তিনি ভীষ্মের কাছে কেন বলছেন, তার কারণ সত্যবতী নিজেই বলেছেন। সত্যবতী বলেছেন–একমাত্র তোমার কাছেই আমি আমার মনের কথা বলতে পারি, ভীষ্ম! কারণ তোমাকে আমি সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি–বিশ্বাসাত্তে প্রবক্ষ্যামি। টীকাকার নীলকণ্ঠ এই বিশ্বাসের মর্ম বোঝেন বলেই বলেছেন–এই বিশ্বাসের মানে হল ভীষ্মের সঙ্গে সত্যবতীর অন্তরঙ্গতা বিশ্বাস অন্তরঙ্গত্ববুদ্ধেঃ। আমরা আগেই জানিয়েছি–সত্যবতী তার এই সমবয়স্ক বা কিঞ্চিৎ অধিকবয়স্ক পুত্রটিকে বন্ধুর মতো দেখতেন। হয়তো এই অন্তরঙ্গতা ছিল বলেই সত্যবতী ভীষ্মকেই শুধু এই কাহিনী বলতে পারেন, আর কাউকে নয়।

 সত্যবতী বললেন–আমাদের এই ভরত বংশের কুল রক্ষার জন্য আমার এই জীবনকাহিনী তোমাকেই শুধু বিশ্বাস করে বলতে পারি–বিশ্বাসাত্তে প্রবক্ষ্যামি সন্তানায় কুলস্য নঃ

 সত্যবতী আরও বললেন-বংশবিলুপ্তির মতো এই বিপন্ন সময়ে আমাদের কী করা উচিত, সে কথা তোমাকে না বলেই বা থাকি কী করেন তে শক্যমনাখ্যাতুম্ আপদ্ধর্মং তথা বিধ। না বলে পারছি না এই কারণে যে, তুমিই এখন এই বংশের ধর্মরক্ষক, তুমিই সত্যরক্ষক, আর সবচেয়ে বড় কথা–তুমি আমাদের একমাত্র অবলম্বন–ত্বমেব নঃ কুলে ধৰ্মঃ ত্বং সত্যং ত্বং পরা গতিঃ।

আগেই বলেছি–মনস্বিনী সত্যবতী একা কোনও সিদ্ধান্ত নেবেন না। তিনি তার জীবনকাহিনী বিবৃত করে ভরত বংশের প্রবাহ রক্ষায় সাহায্য করতে চাইছেন, কিন্তু তিনি যা বলছেন, তা করণীয় কিনা সে সিদ্ধান্তের ভার দিলেন ভীষ্মের হাতে, কারণ হস্তিনাপুরের পূর্ব-যুবরাজ তিনি। তার পুত্রের নামে রাজা হলেও হস্তিনাপুরের রাজতন্ত্র ভীষ্মের হাতেই ছিল এবং এখন তার পুত্রদের মৃত্যুর পরেও ভীষ্মই প্রখ্যাত ভরত বংশের সম্পূর্ণ দায়ভার বহন করছেন। সত্যবতী তাই বললেন–আমার এই কাহিনী শুনে যা করবার তুমি করো–তস্মানিশম্য সত্যং মে কুরুত্ব যদনন্তরম্।

 সত্যবতী বলতে আরম্ভ করলেন–আমার বাবার একখানা নৌকা ছিল, জান। আমার তখন। কাঁচা বয়স–গতা প্ৰথমযৌবনে–তো আমি সেই নৌকায় বসে ছিলাম যমুনা নদীর ওপর। এমন সময় মহামুনি পরাশর যমুনা পার হবার জন্য আমারই নৌকায় এসে উঠলেন।

সত্যবতী তার এই মিলন-কাহিনী খুব সংক্ষেপে বলছেন ভীষ্মের কাছে। কারণ তিনি পুত্রকল্প, আবার প্রধান প্রধান ঘটনাগুলি তিনি বাদও দিচ্ছেন না, কারণ সত্যস্বরূপ ভীষ্মের কাছে তিনি কিছুই লুকোবেন না। নৌকা বেয়ে নিয়ে যাবার সময় পরাশর কীভাবে তাকে দেখে মোহমুগ্ধ হয়ে পড়লেন, মুনির মুখে ধীর-মধুর প্রেমের কথা শুনে আস্তে আস্তে সত্যবতী নিজেও কীভাবে তার বশীভূত হয়ে পড়লেন–সব ঘটনা আনুপূর্বিক ভীষ্মকে শোনালেন সত্যবতী। কন্যা অবস্থায় তার এই মিলন-কাহিনী শুনে ভীষ্ম যদি ভাবেন–তার পিতা শান্তনু শুধুই বঞ্চিত হয়েছেন, কেননা যে রমণীর কুমারীত্ব হৃত হয়েছে, তাকে বিবাহ করে তার পিতা কী পেলেন জীবনে–ভীষ্ম যদি এই কথা ভেবে দুঃখিত হন, সত্যবতী তাই বলেছেন–আমার কোনও উপায় ছিল না, বাবা। এদিকে মহর্ষি শাপ দেবেন এই ভয়, ওদিকে পিতার ভয়। আমি কী করব ভেবে পাচ্ছি না। এই অবস্থায় মুনি আমাকে এমন একটি দুর্লভ বর দিলেন যে, আর তাকে প্রত্যাখ্যান করার উপায় রইল না আমার–বরৈরসুলভৈরুক্তা ন প্রত্যাখ্যাতুমুৎসহে।

 সত্যবর্তী বলে চললেন–আমাদের মিলন হয়েছিল সেই নৌকার ওপরেই। মুনি আপন তেজে চারদিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে আমাকে যুগপৎ অভিভূত এবং বশীভূত করে ফেললেন –অভিভূয়স মাং বালাং তেজসা বশমানয়ৎ। আমাদের মিলন সম্পূর্ণ হলে মুনি বললেন–এই নদী মধ্যগত দ্বীপের মধ্যে আমার দ্বারা উৎপন্ন গর্ভ প্রসব করে তুমি আবারও কন্যা হয়ে যাবে–কন্যৈব ত্বং ভবিষ্যসি।

সত্যবতীর ভাবটা এই–আমি তোমার পিতাকে বঞ্চিত করিনি পুত্র। নিজের গুঢ় মিলন বর্ণনা করে সত্যবতী বললেন–আমার সেই কুমারী অবস্থার পুত্রটি এখন দ্বৈপায়ন নামে প্রসিদ্ধ হয়েছে। শুধু তাই নয়, সে এক মহাযোগী, মহা-ঋষি হয়ে গেছে–পারাশৰ্যো মহাযোগী সবভূব মহানৃষিঃ। চারটে বেদ ভাগ করেছে বলে লোকে তাকে ব্যাস বলেও ডাকে আবার গায়ের রঙ আমারই মতো কালো বলে লোকে তাকে কৃষ্ণ বলেও ডাকে-লোকে ব্যাসত্ব আপেদে কাষ্ণাৎ কৃষ্ণত্বমেব চ।

এই কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন ব্যাসকে ভীষ্ম খুব ভাল করেই চেনন, কিন্তু তার সঙ্গে ভীষ্মের যে এইরকম এক ভ্রাতৃ-সম্বন্ধ আছে তা বোধহয় তিনি জানতেন না। সত্যবতী ভীষ্মের কাছে তার কন্যাবস্থার পুত্রটির গুণখ্যাপন করতে লাগলেন, যেন ভীষ্ম তার গুণ জানেন না। এই কিছুদিন আগে অম্বার তপস্যার ঘটনা এবং পরশুরামের সঙ্গে তার যোগাযোগের কথা তো তিনি এই দ্বৈপায়ন ব্যাস এবং নারদের সঙ্গেই আলোচনা করেছিলেন। অতএব ভীষ্ম তার পরম-ঋত্বিক সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন। সত্যবতী সেই ভীষ্মের কাছেই পুত্রের গুণপনা ব্যাখ্যা করছেন। সত্যবতী বললেন–ছেলে আমার যেমন সত্যবাদী, তেমনি জিতেন্দ্রিয়। অহোরাত্র এমন তপস্যা করেছে যে, পাপ বলে কোনও জিনিস নেই তার মধ্যে–সত্যবাদী শমপরস্তপসা দন্ধকিন্বিষঃ। জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই সে পিতা পরাশরের পদবি অনুসরণ করেছে।

সত্যবতী আপন পুত্রের এত গুণ-ব্যাখ্যান করছেন, তার কারণ আছে। বস্তুত নিয়োগ প্রথায় পুত্র উৎপাদন করতে গেলে এমনই একজন পুরুষকে আহ্বান জানানো দরকার, যিনি জ্ঞানী, গুণী, পণ্ডিত। এতে পরম্পরাক্রমে জ্ঞান এবং বিদ্যাবত্তা নিয়োগজাত পুত্রের মধ্যে সঞ্চারিত হতে পারে। দ্বিতীয় কারণ, যাঁকে পরক্ষেত্রে পুত্রোৎপাদনের জন্য আহ্বান করা হবে তিনি যেন কামুকতার বশবর্তী হয়ে না আসেন। নিযুক্ত হবার মুহূর্তে বাস্তব পরিস্থিতিই কামুকতার সঞ্চার করবে, কিন্তু নিযুক্ত পুরুষ যদি পূর্বাহ্নেই কামে বশীভূত হয়ে থাকেন, তবে তাকে দিয়ে পরের স্ত্রীর গর্ভে পুত্রোৎপাদন করানোটা খুব বড় একটা মানসিক বিপর্যয় তৈরি করে। সত্যবতী তাই তার পুত্রের সত্যবাদিতার সঙ্গে অন্তরিন্দ্রিয়ের নিরুদ্ধির কথা জোর দিয়ে বলেছেন–শমপরঃ অন্তরিন্দ্রিয়-নিগ্রহ-ব্যাপৃত। শুধু অন্তরিন্দ্রিয় এইজন্য যে, এর সঙ্গে বহিরিন্দ্রিয়েরও নিরুদ্ধি ঘটলে পুত্রোৎপাদনের ঘটনাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।

শমদমাদির পরম সাধনা যাঁর করায়ত্ত, ঐহিক-পারত্রিক কোনও কামনা বা ফলে যার কোনও স্পৃহা নেই সেই রকম একজন মানুষই যে,এক রমণীর গর্তে নিরাসক্তভাবে পুত্র উৎপাদন করার সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি সে বিষয়ে সন্দেহ নেই কারও। সত্যবতী ভীষ্মকে বললেন–আমি এবং তুমি, দুজনেই যদি এই তেজস্বী মুনিকে তোমার ভ্রাতৃ বধূদের গর্ভে পুত্র। উৎপাদন করার জন্য নিযুক্ত করিস নিযুক্তো, ময়া ব্যক্তং ত্বয়া চাপ্রতিমদ্যুতিঃ–তবে সে কিছুতেই না বলতে পারবে না। আমার এই পুত্রটি আমাকে ছেড়ে যখন পিতার সঙ্গে তপস্যা করতে গেল, তখন আমাকে বলেছিল–কোনও প্রয়োজন হলে আমাকে ডেকো, আমি ঠিক চলে আসব। আজ সেই প্রয়োজন উপস্থিত। ভীষ্ম! এখন তুমি এ বিষয়ে অনুমতি করো তাহলে আমি তাকে স্মরণ করতে পারি–ত্বং স্মরিয্যে মহাবাহো যদি ভীষ্ম ত্বমিচ্ছসি।

এই প্রস্তাব যে ভীষ্মের কাছে অত্যন্ত আদরণীয় হয়েছে, তা তার পরবর্তী মন্তব্য থেকেই বোঝা যাবে। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসকে তিনি এতটাই সম্মান করেন যে, তার নাম শোনামাত্রই তিনি হাত জোড় করে দাঁড়ালেন–মহর্ষেঃ কীর্তনে তস্য ভীষ্মঃ প্রাঞ্জলিরব্রবীৎ। বললেন–মা! যিনি কাজ করার আগেই ধর্ম, অর্থ, কাম এবং এগুলির ফলাফল–দুইই চিন্তা করতে পারেন, তিনিই প্রকৃত বুদ্ধিমান। বিচিত্রবীর্যের স্ত্রীদের গর্ভে পুত্রোৎপত্তির জন্য যা আপনি বলেছেন, তা শুধু ধর্মসম্মতই নয়, তা আমাদের বংশের পক্ষেও হিতকর হবে, আমাদের তাতে মঙ্গল হবে। আপনার এই প্রস্তাব আমার অত্যন্ত ভাল লাগছে–উক্তং ভবতা যয়ে স্তন্মহং রোচতে ভূশম্।

লক্ষণীয় বিষয় হল, মহামতি ভীষ্ম একজন বীর ক্ষত্রিয় পুরুষ। তিনি কুরুবাড়ির সংসার সীমার মধ্যে আবদ্ধ। কিন্তু তিনি বিবাহ করেননি। তিনি আমৃত্যু ব্রহ্মচর্যের ব্রত নিয়েছেন এবং তিনি রাজ-সিংহাসনও ভোগ করবেন না বলে ঠিক করেছেন। এক কথায় তিনি গৃহস্থ হওয়া সত্ত্বেও সন্ন্যাসী। অন্যদিকে কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন ব্যাস একজন ব্রাহ্মণ মহর্ষি। কোনও সামাজিক বিবাহ-বন্ধনের মধ্যে তার জন্ম হয়নি। জন্মমাত্রেই তিনি পিতার সঙ্গে তপস্যায় নিযুক্ত হয়েছেন। তিনি এখনও পর্যন্ত অবিবাহিত। কিন্তু তিনি সুদুর আশ্রম থেকে কুরুবাড়ির সংসার-সীমার মধ্যে ফিরে আসছেন কুরুবাড়ির বংশধারা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য।

ব্যাস এবং ভীষ্ম দুজনেই কুরুবাড়ির মূল বংশধর বিচিত্রবীর্যের ভাই–একজন মাতার সম্বন্ধে, অন্যজন পিতার সম্বন্ধে। পিতৃ-সম্বন্ধ অনুযায়ী ক্ষত্রিয় ভীষ্মই তার বংশরক্ষায় সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি ছিলেন। কিন্তু তিনি ব্রহ্মচর্যের প্রতিজ্ঞা নিয়েছেন বলে তার মাতৃসম্বন্ধের ভাই ব্রাহ্মণ মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস তার ভাইয়ের স্ত্রী দুই ক্ষত্রিয়াণীর ক্ষেত্রে বা গর্ভে ব্রাহ্মণ্যের বীজ বপন করার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছেন। ব্রাহ্মণ মহর্ষি তার বীজ বপন করেই চলে যাবেন, আর ক্ষত্রিয় ভীষ্ম কুরুবাড়ির সংসার-সীমান্তে দাঁড়িয়ে এই বীজ অঙ্কুরিত হতে দেখবেন, সেই অঙ্কুরকে তিনি লালন করবেন, সেই অঙ্কুরকে বিস্তারিত শাখা-প্রশাখায় মহীরুহে পরিণত হতে দেখবেন এবং সেই মহীরুহের মহতী বিনষ্টি থেকে নতুন সৃষ্টি পর্যন্ত দেখে যাবেন। এই বিশাল। এক বিবর্তন প্রক্রিয়ার দ্রষ্টা হয়ে থাকবেন ভীষ্ম, আর তার পরিপূরক ব্যক্তিত্ব হিসেবে স্রষ্টার ভূমিকায় থাকবেন ব্যাস–যিনি ভারত-বংশের ধারা অক্ষুণ্ণ রাখবেন এবং ভবিষ্যতে মহাভারতের কবি হবেন। আপাতত ভারত বংশের মূল ক্ষেত্রে সৃষ্টির জন্য তার ডাক এসেছে–এই সৃষ্টির বিষমৃতই তাকে পরে মহাভারতের কবি করে তুলবে।

আপাতত ভীষ্ম সত্যবতীকে সমর্থন করার সঙ্গে সঙ্গে সত্যবতী কাল বিলম্ব না করে তার প্রথম পুত্র দ্বৈপায়ন ব্যাসকে মনে মনে স্মরণ করলেন। মহর্ষি সেই মুহূর্তে বেদ-পাঠে নিরত ছিলেন। সেই অবস্থাতেই জননী তাকে কোনও প্রয়োজনীয় কাজে স্মরণ করছেন মনে করে | তিনি সকলের অলক্ষিত অবস্থায় মায়ের সামনে আবির্ভূত হলেন।

কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস এতটাই উচ্চ স্তরের যোগী এবং মুনি যে, তার সম্বন্ধে যেন এমন অলৌকিকভাবে বললেই ভাল মানায়। কিন্তু মহাভারতের সর্বত্রই এই দেবোপম ঋষিরা এবং এমনকি স্বয়ং দেবতা বলে প্রথিত পুরুষেরাও এমন মনুষ্যোচিতভাবে লীলায়িত হয়েছেন যে, ব্যাসের মায়ের সামনে আসাটুকুও লৌকিকভাবেই উপস্থাপিত করা যায়। বাস্তব জগতে আমরাও শ্রদ্ধেয় মানুষকে দেখা হলে বলে থাকি–আপনাকে স্মরণ করছিলাম। একইভাবে সত্যবতী ব্যাসকে স্মরণ করে বিশ্বস্ত কাউকে পাঠিয়েছিলেন তাঁর কাছে। হয়তো সেই সময় তিনি বেদ পড়ছিলেন–স বেদান্ ব্রিব্রূবন্ ধীমান্। কিন্তু সেই সময় মা তাকে স্মরণ করছেন শুনে কাউকে কিচ্ছুটি না বলে সবার অজ্ঞাতে তিনি মায়ের কাছে চলে এসেছেন– প্রাদুর্ভুবাবিদিতঃ ক্ষণেন কুরুনন্দন।

এই যে কাউকে কিছু না বলে মায়ের ডাক শোনা মাত্রই বেদপাঠ ছেড়ে চলে আসা–এই সমস্ত প্রক্রিয়াটার মধ্যে এমন ত্বরিত গতি এবং আবেগ ছিল যে, মহাভারতের কবি সেটাকে অলৌকিকভাবে বর্ণনা করে তার নিজের কাছে মায়ের আদেশের মূল্য কতখানি, সেটাই বোঝাতে চেয়েছেন। এতকাল পরে তাঁর কুমারী অবস্থার প্রথমজ পুত্রটিকে দেখে সত্যবতীর অন্তর্গঢ় স্নেহধারা উদ্বেলিত হয়ে উঠল। ছেলে এখন মহাযোগী হয়েছে, মহা-ঋষি হয়েছে, তাই প্রথমে সাধারণের সম্মান-বিধি অনুসারে একটু কুশল প্রশ্ন বা স্বাগত-ভাষণ করেই সুচিরকালের ব্যবধানে দৃষ্ট পুত্রটিকে জননী সত্যবতী দুই হাতে জড়িয়ে ধরলেন। এতকাল পরেও যেন তার মাতৃস্তন্যের উষ্ণ ধারা ক্ষরিত হল প্রায়-পরিজ্য চ বাহুভ্যাং প্রস্রবৈরভিষিচ্য চ। সত্যবতীর চোখ দুটি বাষ্পচ্ছন্ন হল আনন্দে, এতকাল পর পুত্র দর্শনের সন্তুষ্টিতে–মুমোচ বাষ্পং দাসেয়ী পুত্রং দৃষ্টা চিরস্য তম্।

আজন্ম সংসার-বিরাগী ব্যাসও উদ্বেল মাতৃস্নেহে আকুল বোধ করলেন। কীই বা দেবার আছে! সমস্ত পুণ্যতীর্থের জল তার কমণ্ডলুতে ভরা ছিল। সেই জল মায়ের মাথায় ছড়িয়ে দিলেন দেবতার আশীর্বাদের মতো–তামদ্ভিঃ পরিষিচ্যার্তাং মহর্ষিরভিবাদ্য চ। বুঝিয়ে দিলেন–এতকাল এত তীর্থে ঘুরে ঘুরে তপস্যার ফল লাভ করেছি, মা! আজ সেই সর্বতীর্থোদ্ভব জল তোমার গায়ে ছড়িয়ে দিয়ে আমার জন্মাবধি সম্পূর্ণ জীবৎকালের সঙ্গে স্পর্শ ঘটালাম তোমার। মায়ের মাথায় তীর্থজল ছড়িয়ে দিয়ে তাকে যথাবিধি অভিবাদন করলেন ব্যাস। বললেন–তোমার মনের যা ইচ্ছে তাই করব আমি। তুমি যেমন আদেশ করবে এবং যেমনটি তোমার ভাল লাগে, তেমনটিই আমি করব–শাধি মাং ধর্মতত্তম্ভেজ্ঞ করবাণি প্রিয়ং তব।

 মহামুনি ব্যাস এসেছেন হস্তিনায়। ব্যাস তো শুধু মায়ের নন, তিনি যে সবার। খবর পেয়ে হস্তিনাপুরের রাজপুরোহিত এসে মঙ্গল-মন্ত্র উচ্চারণ করলেন মহর্ষির শুভাগমনের জন্য। মহর্ষি ব্যাসও রাজপুরোহিতের দেওয়া পাদ্য-অর্ঘ্য সাদরে স্বীকার করলেন। তিনি আসনে উপবেশন করতেই সত্যবতী আবার তার প্রথমজন্মা পুত্রটির কাছে এসে বসলেন। কথাগুলো রাজপুরোহিতের সামনেই হওয়া ভাল, কারণ রাজপুরোহিত তৎকালীন রাজযন্ত্রের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব। রাজবাড়িতে যা ঘটছে, সমস্ত প্রজাদের স্বার্থে তা তার জানার অধিকার আছে।

সত্যবতী পুত্রকে আবারও কুশল প্রশ্ন করলেন। এতকাল পরে তার মাতৃত্বের দাবি কতটা টিকবে, সেটাও যেন একটু বুঝে নিতে চাইলেন তিনি। পুত্রকে বললেন–কবি!

সম্বোধনটা ভারি চমৎকার। পৃথিবীর প্রথম কবিতাবলীর মর্মকথা বুঝে নিয়ে সেগুলির শ্রেণী বিভাগ করেছেন ব্যাস। কোনটা মন্ত্র, কোনটা গান সব বুঝে নিয়ে তিনি চতুর্বেদের পৃথক সংকলন করেছেন–ঋক্, সাম, যজুঃ, অথর্ব-যো বাস্য বদাংশ্চতুর-স্তপসা ভগবানৃষিঃ। তা। এমন মানুষকে তার জননী কবি বলবেন না তো কি? তাছাড়া সংস্কৃতে কবি শব্দের অর্থ বড় গভীর। ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান–সব তিনি দেখতে পান বলে ক্রান্তদশী কবির সঙ্গে ঋষির কোনও পার্থক্য নেই। সত্যবতী সেই ক্রান্তদর্শী পুত্রের কাছে আপন মাতৃত্বের দাবি জানাচ্ছেন। বলছেন-কবি! সংসারে একটি ছেলে যেমন পিতার সবচেয়ে বড় সহায়, তেমনি সে তার মায়েরও সবচেয়ে বড় সহায়। পিতা যেমন তার পুত্রকে স্বচ্ছন্দে শাসন করতে পারেন, তেমনি মাও তাকে শাসন করতে পারেন–তেষাং যথা পিতা স্বামী তথা মাতা ন সংশয়ঃ।

সত্যবতী গৌরচন্দ্রিকা করছেন। এতকাল পিতার সংস্পর্শে ছিলেন, অতএব পিতার কথাই মান্য, আর এতকাল মায়ের সঙ্গে তার থাকা হয়নি বলে মায়ের কথার কোনও মূল্য নেই–এই লঘুতা যাতে না ঘটে তার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন সত্যবতী। তিনি বললেন–আমার কুমারী অবস্থায় তুমি যেমন আমার সমাজ-সম্মত প্রথম পুত্র–বিধানবিহিতঃ স ত্বং যথা মে প্রথমঃ সুতঃ–তেমনি বিচিত্রবীর্যও আমার কনিষ্ঠ পুত্র। আবার দেখ–পিতার দিক দিয়ে মহামতি ভীষ্ম যেমন বিচিত্রবীর্যের ভাই, তেমনি মায়ের দিক দিয়ে তুমিও তার ভাই–যথা বৈ পিতৃতো ভীষ্ম-স্তথা ত্বমপি মাতৃতঃ। আমার মুশকিল হয়েছে–শান্তনব ভীষ্ম। বিবাহ করবেন না এবং রাজ্যও পালন করবেন না বলে কঠিন প্রতিজ্ঞা করেছেন। এই অবস্থায় তোমার ছোট ভাই বিচিত্রবীর্যের মঙ্গলের জন্য এবং মহান কুলের বংশধারা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য আমি যা বলব, তা তোমায় একটু মন দিয়ে শুনতে হবে, বাবা!

এক বিচিত্রবীর্য এবং তাঁর বংশরক্ষা–এর মধ্যে যদি ব্যক্তিগত স্বার্থেরই শুধু চরিতার্থতা থাকে, তাই সত্যবতী বলছেন–হস্তিনাপুরবাসী সমস্ত প্রজাদের প্রতি যদি কোনও দয়া থাকে তোমার–(ভাবটা এই, সে দয়া আমার অন্তত আছে), সকলের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যদি তোমার কোনও ভাবনা থাকে, আর ওই স্বামী পুত্রহীনা বেচারা ওই বউ-দুটির ওপর যদি কোনও মায়া থাকে তোমার, তবে আমি যা বলব, তা শুনে তোমায় একটি কাজ করতে হবে, বাবা–আনৃশংস্যাচ্চ যক্ৰয়াং তদ্ভুত্ব কতুমহসি।

 সত্যবতী আর ভণিতা করছেন না। কারণ, তখনকার দিনের সামাজিক রীতিনীতি এবং বিপন্নতায় সত্যবতী এখন কী প্রস্তাব করবেন, সে আন্দাজ ব্যাসের হয়ে গেছে বলেই সত্যবতী এবার ঝটিতি তার বক্তব্য জানালেন। বললেন-তোমার ছোট ভাইয়ের দুটি স্ত্রীই দেবরমণীদের মতো সুন্দরী। তাদের রূপ-যৌবন যথেষ্ট এবং তারা ধর্মানুসারে পুত্রকামনা করে-রূপযৌবন সম্পন্নে পুত্ৰকামে চ ধমতঃ। ব্যাসের সামনে পুত্রবধূদের রূপযৌবনের কথা উচ্চারণ করে সত্যবতী বোঝাতে চাইলেন–বিচিত্রবীর্য মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গে এই দুই যুবতী বধূর সমস্ত কিছু ব্যর্থ হয়ে গেছে, এমনকি কোল-আলো করা দুটি সন্তানও নেই, যাদের দিকে তাকিয়ে এরা জীবন কাটাবে।

অতএব সত্যবতীর প্রস্তাব–আমার এই দুই পুত্রবধূর গর্ভে তুমি পুত্ৰ উৎপাদন করো। একমাত্র তুমিই এই কাজ করতে পার, বাছা–তয়োরুৎপাদয়াপত্যং সমর্থো হাসি পুত্ৰক।’পুত্র’ সম্বোধনটির মধ্যেও ভারি সুন্দর ব্যঞ্জনা আছে। অক্সার্থে ‘ক’ প্রত্যয় হয়। ক’ প্রত্যয়ের প্রয়োগে বড়কে ছোট করে দেখানো যায়, যেমন বাল, বালক, মানব, মানবক (শিশু)।’পুত্র’ শব্দের ব্যঞ্জনা–তুমি যত বড় ঋষিই হও না কেন, বেদ-বিভাগ করে তুমি যত বড় কবিই হও না কেন, মায়ের কাছে এখনও তুমি সেই আদরের শিশুটিই আছ। অতএব আমার কথা শুনতে হবে বাছা! ব্যাস যদি ভাবেন–এই কর্মে শুধু স্নেহময়ী মায়েরই অনুমোদন আছে, হস্তিনার পূর্বজাত দায়ভাক্‌ ভীষ্মের অনুমোদন নেই, তাই সে কথা সত্যবতী আগেই বলে নিয়েছেন ভীষ্ম এই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় অনুরোধ করেছেন, আর আমারও এই আদেশ–ভীষ্মস্য চাস্য বচনান্নিয়োগাচ্চ মোনঘ। তুমি বিচিত্রবীর্যের পত্নীদের গর্ভে পুত্রের জন্ম দাও। তাতে আমার কনিষ্ঠ পুত্রের বংশধারাও অক্ষুণ্ণ থাকবে এবং তোমারও সন্তান জন্মাবে-অনুরূপং কুলসাস্য সত্যাঃ প্রসবস্য চ।

জননীর এই আদেশ দ্বৈপায়ন ব্যাসের মনে কোনও আকস্মিকতা সৃষ্টি করেনি। এক পুত্রবধূর গর্ভে পুত্রোৎপাদনের জন্য অন্য পুত্রের নিয়োগ যেহেতু তদানীন্তন সমাজ-সচল প্রথা, কাজেই সত্যবতীর অনুরোধে ব্যাস কিছুই আশ্চর্য হননি। তিনি এমন ঘটনা অনেক দেখেওছেন-দৃষ্টং হ্যেতৎ সনাতন। অতএব জননীর উদ্দেশে তিনি সাধারণভাবেই বললেন–মা! তুমি ঐহিক এবং পারত্রিক সব ধর্মই জান। তোমার বুদ্ধিও ধর্মবোধে পরিশীলিত। কাজেই তোমার আদেশ মেনে শুধু ধর্মের খাতিরেই তোমার ইচ্ছাপূরণ করব–তস্মাদহং ত্বন্নিয়োগাদ্ধৰ্মমুদ্দিশ্য কারণম্। আমি নিশ্চয়ই আমার ভাই বিচিত্রবীর্যের জন্য দেবোপম পুত্র উৎপাদন করব। কিন্তু তার জন্য তোমার রাণীদের কিছু কষ্ট করতে হবে। আমি যেমন বলব, ঠিক সেইভাবে তোমার দুই রাজবধু এক বৎসর কাল ব্রত পালন করুন–ব্রতং চরেতাং তে দেব্যৌ নির্দিষ্টমিহ যন্ময়া। এতে তাদের শুদ্ধি ঘটবে এবং সেই ব্রতক্লিষ্ট শুদ্ধ অবস্থাতেই আমার সঙ্গে মিলন হবে তাদের। নীতি নিয়ম-ব্ৰতহীন অবস্থায় আমার সঙ্গে কোনও রমণীর সঙ্গতি হতে পারে না–ন হি মাম অব্রতোপেতা উপেয়াৎ কাচিদঙ্গনা।

ব্যাসের ভাবটা বোঝা যায়। উপযুক্ত পুত্রের জন্য পিতা-মাতাকে তপস্যা করতে হয়। শুধুই কামজাত পুত্রের দ্বারা জগতের কোনও হিত সাধন হয় না বলেই ব্যাস মনে করেন। তাছাড়া বিচিত্রবীর্যের সাহচর্যে দুই রানীর এতদিন যে কাম সাধন চলেছে, সেই একই বৃত্তিতে তাপোধন দ্বৈপায়ন ব্যাসের সাহচর্য লাভ করা যায় না। তপঃক্লিষ্ট মুনির কাছে পুত্র কামনা করলে তার জন্য তাদেরও চিত্ত শুদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। সেইজন্যই ব্যাস এক বৎসরের ব্রত-নিয়মের কাঠিন্য আরোপ করতে চাইছেন রানীদের ওপর–সংবসরং যথান্যায়ং ততঃ শুদ্ধে ভবিষ্যতঃ।

সত্যবতী দেখলেন–এক বছর সময় বড় কম নয়। তার ওপর যোগী-মুনি বলে কথা। কখন কী মতিগতি হয় কে জানে? হয়তো এক বৎসর পর এসে ছেলে বলল-না, এখনও কাল পরিপক্ক হয়নি, চিত্ত শুদ্ধ হয়নি। তখন আবার কোন বিপদ হবে কে জানে? সত্যবতী ভাবলেন –একবার যখন তার পুত্রটিকে হাতের কাছে পাওয়া গেছে, তখন যেভাবেই হোক তাকে দিয়ে ঈঙ্গিত কাজটি করিয়ে নিতে হবে। সত্যবতী তার প্রিয় পুত্রকে কাতর হয়ে অনুরোধ জানালেন বাবা! এখনই যাতে রানীরা গর্ভ ধারণ করতে পারে, সেই ব্যবস্থাই করো, বাবা! –সদ্যো যথা প্রপদ্যেতে দেব্যৌ গর্ভং তথা কুরু। এ দেশে এখন রাজা নেই। অরাজক রাজ্যে বৃষ্টি হয় না, অরাজক রাজ্যের ওপর দেবতার প্রসন্ন দৃষ্টি থাকে না। আর আমরাই বা কী করে এই অরাজক রাজ্য রক্ষণাবেক্ষণ করব। তাই বলছিলাম-তুমি বাবা আর বিলম্ব করো না। রানীরা যাতে এখনই গর্ভ ধারণ করতে পারেন, তুমি সেই ব্যবস্থা করো। সন্তান জন্মালে তাদের বড় করে তুলবেন মহামতি ভীষ্ম, তুমি কোনও চিন্তা করো না–তস্মাদ্ গর্ভং সমাধৎস ভীষ্মঃ সম্বৰ্ষয়িষ্যতি।

সত্যবতীর প্রস্তাব শুনেই বোঝা যায়–আজকের মহাকবি যে সাবেগে বলেছিলেন কৌরব-পাণ্ডবের এক পিতামহ-সে কথাটা ততটা আক্ষরিক সত্য নয়। আসলে দুই পিতামহ–একজন মহামুনি ব্যাস, অন্যজন ক্ষত্রিয় ভীষ্ম। কাশীরাজের দুই কন্যাকে এনে তিনি বিবাহ দিয়েছিলেন বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে। আজ বিচিত্রবীর্যের মৃত্যুর পর তিনিই রয়ে গেলেন তার সন্তানদের বড় করে তোলার জন্য। প্রকৃতির প্রতিশোধ বোধহয় এমনটাই হয়। যিনি বিবাহ করবেন না, রাজ্য গ্রহণ করবেন না বলে কঠিন প্রতিজ্ঞা করে বসে রইলেন, তাকেই সংসারের সবচেয়ে মায়াবদ্ধ জীবটির মতো ভাইয়ের বিবাহ দেওয়ার জন্য, তার ছেলেপিলে মানুষ করার জন্য সংসার আঁকড়ে বসে থাকতে হচ্ছে। সন্ন্যাসী মুনি মুহূর্তের গর্ভাধান-সম্পন্ন করে আবারও তপস্যায় ফিরে যাবেন, আর ক্ষত্রিয়ের তপস্যা এমনই যে, প্রতিজ্ঞাত সত্য রক্ষা করার জন্য, রাজ্য রক্ষার জন্য ভীষ্মকে সারা জীবন আরও এক সাধনা করে যেতে হবে। নিজে সন্তানহীন, অথচ সারা জীবন তাকে অন্যের সন্তানের মায়ায় মুগ্ধ হতে হবে–ভীষ্মঃ সম্বর্ধয়িষ্যতি।

.

৬৬.

দ্বৈপায়ন বলেছিলেন–তোমার পুত্রবধূদের সম্বচ্ছর ধরে ব্রত-নিয়ম পালন করতে হবে, তবেই তাঁদের শুদ্ধ সত্তার মধ্যে সন্তানের জন্ম দেব আমি। সত্যবতীর উপরোধে ব্যাসের এই প্রস্তাব টিকল না। সত্যবতী দেরি করতে রাজি হলেন না। ব্যাস তখন বললেন-আমাকে যদি আকালিকভাবে এখনই পুত্র উৎপাদনে ব্রতী হতে হয়, তবে তোমার পুত্রবধুদের অনেক সহ্য-শক্তির পরীক্ষা দিতে হবে। তাদের সহ্য করতে হবে আমার বিকৃত রূপ এবং সেইটাই তাদের ব্রতের কাজ করবে–বিরূপতাং মে সহতাং তয়োরেতং পরং ব্রত। ব্যাস আরও বললেন-আমার শরীরে থাকবে দুর্গন্ধ, আমার রূপ হবে জঘন্য, আমার পরিধানেও থাকবে বিকারের ছোঁয়া। তোমার পুত্রবধুরা যদি এই সমস্ত বিকার মেনে নিয়েও আমার সঙ্গে সঙ্গত হতে পারেন, তবে আজই তাদের গর্ভে উৎকৃষ্ট সন্তান জন্মাবে-যদি মে সহতে গন্ধং রূপং বেশং তথা বপুঃ।

 আমাদের জিজ্ঞাসা হয়, ব্যাস এইরকম একটা শর্ত দিলেন কেন? কেনই বা তার চেহারায়, পরিধানে এই স্বেচ্ছাকৃত বিকার ঘনিয়ে আনছেন তিনি? আমাদের ধারণা, কারণ এখানে একটাই। সেকালের দিনের নিয়োগ-প্রথার সুফল হিসেবে একজন স্বামী-পুত্রহীনা নারীও সন্তানের মুখ দেখতে পারতেন। কিন্তু এই সন্তান-লাভের জন্য স্ত্রী-পুরুষের মধ্যে কামনার আগুন জ্বলে ওঠাটা কোনও গৃহস্থ বাড়ির অভিভাবকেরই কাম্য হত না। আর এটাই তো স্বাভাবিক। ধরুন, কারও পুত্ৰ স্বৰ্গত হয়েছে। ছেলের বউ সুস্থ, স্বাভাবিক এবং বয়স কম। তার। কোনও সন্তানও নেই। গৃহস্থ চান, তাঁর পুত্রবধূর কোলে একটি সন্তান আসুক। এই অবস্থায়। সেকালের প্রথায় গৃহস্থ মানুষ অন্যের দ্বারা গর্ভাধান করাতে রাজি হলেও তিনি কি চাইবেন যে তার পুত্রের প্রেমাস্পদা বধূ অন্যের লালায়িত লালসার বিষয়ীভূত হোন।

আমরা জানি, এমনটি কেউ চাইবেন না। সেকালের দিনের নিয়োগ প্রথাতেও তাই কিছু বিধি-নিয়ম ছিল। নিয়োগ প্রথায় নিযুক্ত পুরুষ মানুষটির গায়ে ঘি, দই, লবণ ইত্যাদি মাখিয়ে তাকে একেবারে জ্যাবজ্যাব করে ফেলা হত, যাতে সেই পুরুষের দেহ-স্পর্শ কোনওমতেই এক রমণীর হৃদয়ে প্রফুল্লতা না আনে। গর্ভাধান সম্পন্ন হত অন্ধকারে, যাতে সেই পুরুষের রূপ রমণীর মনে কোনও সুখচ্ছায়া না ফেলে। পরিষ্কার বোঝা যায়–গর্ভাধানের মতো কর্তব্য কর্মটির মধ্যে শুধু কর্তব্য ছাড়া আর কিছুই থাকুক- এটা তখনকার সামাজিকেরা চাইতেন না।

 আজকের সামাজিক বিচারে এই প্রথা কতটা নৃশংস অথবা নিযুক্ত রমণীর মতামতের অপেক্ষা না করে শুধু বৃদ্ধদের অনুমতিতে এই প্রথা সম্পন্ন হওয়ার মধ্যে কতটা সুবিচার ছিল, সে কথা আজকের পরিশীলিত সমাজিক মননে বিচার করে কোনও লাভ নেই। কেননা আজকের সামাজিক নীতি-নিয়মগুলিও হয়ত সেকালের মাপকাঠিতে অতীব নৃশংস। কাজেই সেই তারতম্যের আলোচনায় না যাওয়াই ভাল। আমাদের বক্তব্য–ব্যাস যে এই বিকৃত রূপ, পরিধানের বিকার তথা নিজ দেহকে দুর্গন্ধময় করে তুলে বিচিত্রবীর্যের বধুদের সামনে এক অসহ্য বিকার প্রকট করে তুলতে চাইলেন, তার পিছনে কারণ একটাই। কোনওভাবেই যেন এখানে কামনার অবকাশ না থাকে। তাকে যেন কোনওভাবেই রানীদের ভাল না লাগে। সাধারণ নিয়োগ-প্রথায় যেমন ঘৃত-দধি মাখানোর ব্যবস্থাও থাকে, ব্যাস সেই রাস্তায় গেলেন না। এমনকি নিশীথের অন্ধকারে তিনি আলোর ব্যবস্থাও রাখতে বলেছেন। অন্ধকারে থাকলে কল্পনায় একজনকে সুপুরুষ ভাবা যেতে পারে। ব্যাস সে ফাঁকটুকুও রাখেননি। তার চেহারায় তিনি এমনই এক ঘৃণ্য-বিকার ঘনিয়ে তুলবেন, যেন তা দেখেই আর কোনও সুখ-কল্পনার অবকাশ থাকবে না। যাঁরা ভাবেন-দ্বৈপায়ন ব্যাস রানীদের শয্যায় অলৌকিকভাবে আবির্ভূত হবেন, তাদের এই অলৌকিকতার মধ্যে প্রবেশ করতে নিষেধ করি। অথবা ব্যাস যে বিকার। নিয়ে রানীদের সামনে উপস্থিত হবেন, তা এতটাই অস্বাভাবিক যে, একভাবে সেটাকে আবির্ভাবই বলা যেতে পারে। এই আবির্ভাবে সমস্ত কামনা জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। আর সেই ছাই থেকেই জন্মাবে কর্তব্যের অঙ্কুর; দাবাগ্নিদগ্ধ কদলীকান্ড থেকেও যেমন অঙ্কুরোৎপত্তি হয় সেইরকম।

ব্যাসের দিক থেকে গর্ভাধানের সংকেত লাভ করে সত্যবতী বড় রানী অম্বিকার কাছে উপস্থিত হলেন, নির্জনে-মানসিকভাবে তাকে প্রস্তুত করানোর জন্য। বিচিত্রবীর্যের অন্যতম প্রিয়তমা মহিষী অম্বিকা। তিনি এতকালের রাজরানী। সত্যবতীর মতো না হলেও তারও কিছু ব্যক্তিত্ব আছে। হঠাৎ করে তার কাছে গিয়ে বলা যায় না–তুমি প্রস্তুত হও, তোমার ভাশুর আসছেন তোমার সঙ্গে মিলিত হতে। সত্যবতী জানেন–প্রলোভনের বস্তু এমন কিছু তার সামনে উপস্থিত করতে হবে, যাতে তার পুত্রবধূ স্বয়ংই আকর্ষণ বোধ করেন। তার সঙ্গে থাকতে হবে সামাজিক আচার এবং ধর্মের প্রলেপ। সত্যবতী ভূয়োদর্শিনী, মনস্বিনী। রাজরানীর ব্যক্তিত্ব স্মরণ করেই সত্যবতী যুক্তি সাজালেন অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে। বললেন–কৌশল্যা!

 আমরা আগে বলেছি–কোশল দেশটি কাশীর সঙ্গে এক সময় রাজনৈতিকভাবে যুক্ত হয়েছিল এবং অম্বিকার পিতা কাশীরাজ মূলত কোশল দেশের জাতক না হলেও অম্বিকার সঙ্গে কোশলদোশের যোগাযোগ ছিল জন্মগত। কিন্তু এই মুহূর্তে তাকে ‘কৌশল্যা’ বলে ডেকে সত্যবতী যেমন তার নিজের মুখে পুত্রবধূর বাপের বাড়ির স্নেহমমতা ফুটিয়ে তুলেছেন তেমনি একাধারে তিনি তার পুত্রবধুর মধ্যে একটি দেশের ভাবনা ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। ভাবটা এই-কোশল দেশের মায়ায় তোমাকে যেমন কৌশল্যা বলে ডাকছি, তেমনি আজকে তোমার ডাক পড়েছে হস্তিনার জনসাধারণের কাছ থেকে। তাদের কথাও তোমাকে ভাবতে হবে।

সত্যবতী বললেন–কৌশল্যা! তোমার কাছে ধর্ম-সম্মত কথাই একটা বলব। কিন্তু কথাটা আগেই না বলে সত্যবতী নিজেকে দায়ী করলেন প্রাথমিকভাবে। কথার মধ্যে পুত্রবধুর নিরুপায়তা এবং নির্দোষত্ব বজায় রেখে নিজের ওপর দোষ চাপানোটাই সত্যবতীর মনস্বিতা। সত্যবতী বললেন– সবই আমার কপালের দোষ, অম্বিকা! আমার কপাল-দোষেই আজ এই প্রসিদ্ধ ভরত বংশ উচ্ছন্নে যেতে বসেছে–ভরতানাং সমুচ্ছেদে ব্যক্তং মদ্ভাগ্যসংক্ষয়াৎ। আমি তো এই বংশলোপের ভয়ে খুবই ভেঙে পড়েছিলাম। আমার-তমার পিতৃবংশীয় লোকেরা অর্থাৎ আমাদের শ্বশুরকুলের সবাই তো সব আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন। এই অবস্থায় বুদ্ধিমান ভীষ্ম এই বংশের বৃদ্ধির জন্য আমাকে একটা বুদ্ধি দিয়েছেন–ভীষ্মে বুদ্ধিমদাম্মহাং কুলস্যাস্য বিবৃদ্ধয়ে।

আমরা জানি বুদ্ধিটা সত্যবতীরই, ভীষ্ম সেটাকে সাদর সমর্থন করেছেন। পুত্রবধুদের কাছে মহামতি ভীষ্মের কথাটা বেশি মর্যাদাকর এবং ওজনদার হবে ভেবেই সত্যবতী ভীষ্মের নাম করে অম্বিকাকে বললেন–ভীষ্ম আমাকে একটা বুদ্ধি দিয়েছেন ঠিকই, তবে সে বুদ্ধির সফলতা নির্ভর করছে সম্পূর্ণই তোমার ওপর–সা চ বুদ্ধি-স্তয্যধীনা। আমার ইচ্ছা তুমি বুদ্ধি সফল করে লুপ্তপ্রায় ভরত বংশকে পুনরুদ্ধার করো– নষ্টঞ্চ ভারতং বংশং পুনরেব সমুদ্ধর। ভীষ্মের বুদ্ধিটা আসলে কী–সত্যবতী তো স্পষ্ট করে কিছু বললেন না, কেননা তিনি আন্দাজ করতে পারেন-রাজবধুরা আকারে ইঙ্গিতে ঠিকই কিছু বুঝেছেন। নিয়োগ-প্রথা সেকালের সমাজ-সচল প্রথা হলেও রাজবধুদের দিক থেকে সংকোচ কিছু থাকবেই। সেই সংকোচ এবং লজ্জার শব্দমাত্রও উচ্চারণ না করে যে বিষয়ে তার পুত্রবধূটি প্রলুব্ধ হয়ে রয়েছেন, সত্যবতী সেই কথা উচ্চারণ করলেন। সত্যবতী বললেন-সুশ্রাণী! (এই শব্দের ব্যঞ্জনা–এখনও তোমার রূপ-যৌবন-বয়স যে কোনও পুরুষের কাম্য) দেবরাজ ইন্দ্রের মতো একটি ছেলে হতে পারে তোমার। তুমিই সেই অসামান্য পুত্রের জন্ম দিতে পার–পুত্রং জনয় সুশ্রাণি দেবরাজসমপ্রভ। তোমার সেই গর্ভজাত পুত্রই এই বিখ্যাত বংশের ধারা রক্ষা করবে, আর সেই পুত্রই হবে ভবিষ্যতের রাজা–স হি রাজ্যধুরং গুৰীমুক্ষ্যতি কুলস্য নঃ।

 পুত্রহীনা রমণীর কাছে পুত্রের আশ্বাস যতটুকু মধুর লাগে, অম্বিকার কাছে ততটাই নিশ্চয় মধুর লাগল সত্যবতীর আশ্বাস। কিন্তু যে উপায়ে সেই বহু প্রতীক্ষিত পুত্রলাভ ঘটবে, সেই উপায়টি অস্বিকার কাছে কতখানি অবাঞ্ছিত–তা কি সত্যবতী জানেন? জানেন নিশ্চয়ই, কিন্তু তিনিও নিরুপায় অথবা ‘ডেসপারেট’। এক অতি সুখী পুত্রবতী জননী অন্য এক পুত্রহীনা দুঃখিনীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করে আমাকে বলেছিলেন–আমি যদি হতাম, আমি যে কোনও উপায়ে পুত্রলাভ করতাম। তাতে যদি অপরিচিত কারও সঙ্গে মুহূর্তের জন্য যান্ত্রিকভাবে সঙ্গতও হতে হত, তাও আমি লজ্জিত হতাম না। আমি জানি- পুত্রহীনার চোখের জল দেখেই, তিনি এত বড় কথাটা বলেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে স্বামী বেঁচে থাকতে বা স্বামী স্বর্গত হলে ভারতবর্ষের সামাজিক, পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত রুচিতেও অনীতি পুরুষের সাহচর্যে গর্ভধারণ যে কতটা বেদনার, তা বুঝতে পারবেন তিনিই, যিনি এমন অস্বাভাবিকভাবে গর্ভধারণ করেছেন।

পুত্রহীনা অম্বিকা পুত্রের আশ্বাস পেয়ে যতটা আনন্দ লাভ করলেন, দুঃখও পেলেন ঠিক ততটাই। মহাভারতের কবি এই দুঃখটা বর্ণনা করেছেন অদ্ভুত একটা শব্দ প্রয়োগ করে। তিনি বলেছেন–সত্যবতী ধর্মের দোহাই দিয়ে, এই কাজের ধর্মসঙ্গতি যথাসম্ভব ব্যাখা করে অনেক বোঝালেন অম্বিকাকে এবং বহু কষ্টে তাকে রাজি করালেন–সা ধর্মতো’নুনী য়ৈনাং কথঞ্চি ধর্মচারিণীম। কী রকম অম্বিকা? বিশেষণ দিচ্ছেন–ধর্মচারিণীম। এর সোজা অর্থ হল, যিনি স্বামীর মৃত্যুর পর থেকেই বৈধব্যের কারণে ইন্দ্রিয়-সংযম এবং ব্রত-নিয়মের কাঠিন্যে ব্রহ্মচারিণীর মতো জীবনযাপন করছেন, সত্যবতী তাকে অনেক বুঝিয়ে-সুজিয়ে রাজি করালেন। কিন্তু অর্থটা যে এত সোজা নয় তা বলে দিয়েছেন টীকাকার নীলকণ্ঠ। তিনি বলেছেন–কথঞ্চিৎ, মানে কোনও প্রকারে বহু কষ্টেসৃষ্টে। যিনি অন্য পুরুষের স্পর্শ কোনওভাবেই সহ্য করতে পারছেন না, এই রকম অম্বিকাকে বহু কষ্টে রাজি করালেন–এনাং পুরুষান্তরস্পর্শ অনিচ্ছুন্তী ইতি সূচয়তি কথঞ্চিদিতি।

অম্বিকা শাশুড়ির মুখে বংশের প্রয়োজন এবং তাঁর ধর্ম-সম্মত ব্যাখ্যা শুনে কোনওমতে তার প্রস্তাবে নিমরাজি হতেই রাজবাড়িতে উৎসব লেগে গেল। সত্যবতী ব্রাহ্মণদের ডেকে, মহর্ষি-দেবর্ষিদের ডেকে খুব করে ভোজ দিলেন। ক্রমে দিন শেষে রাত্রি হল। সত্যবতী ঋতুস্নাতা পুত্রবধু অম্বিকাকে শয়ন-গৃহে নিয়ে গেলেন ধীরে, সযত্নে। তাঁর গলার স্বর মৃদু হল, সত্যবতী বললেন–অম্বিকা! তোমার এক ভাশুর আছেন, তিনি আজ তোমার সঙ্গে মিলিত হতে আসবেন। তুমি সাবধানে তাঁর জন্য অপেক্ষা করো। রাত্রির অর্ধকাল অতীত হলে তিনি আসবেন। তার লক্ষ্য কিন্তু তুমিই অপ্রমত্তা প্রতীক্ষৈনং নিশীথে হ্যাঁগমিষ্যতি। সত্যবতী অম্বিকার মানসিক প্রস্তুতি খানিকটা বাড়িয়ে দিয়ে শয়ন-গৃহ ছেড়ে চলে গেলেন।

একা মহার্ঘ শয্যায় শুয়ে রইলেন অম্বিকা। কাশীরাজনন্দিনী, বিচিত্রবীর্যের প্রথম প্রেয়সী। ঘরের মধ্যে প্রদীপ জ্বলছিল অনেক–দীপ্যমানেষু দীপেষু। অম্বিকা রাজবাড়ির এক বিদহ্মা রমণী। ভরত বংশের ধারা রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে কোনওদিন তাকে এমন অস্বস্তিতে পড়তে হবে, এমন কথা তিনি ভাবেননি। সত্যবতী তাকে বলে গেলেন– তোমার ভাশুর আসবেন নিশীথিনীর অন্ধকারে। কিন্তু কে এই ভাশুর? ভীষ্ম কি? অন্য কেউ যিনি ভাশুর-স্থানীয়?

অম্বিকা এক এক করে ভাবতে লাগলেন। তাদের চেহারা, হাব-ভাব বয়স, মিলিত হবার সময় তাদের একেকজনের বিকার–এই সব-সাচিন্তয়ত্তদা ভীষ্মমন্যাংশ্চ কুরুপুঙ্গবা। বহুতর দীপালোকিত শয়নকক্ষে কত শত কথা তার মনে আসছে–ভীষ্ম তাদের তিন বোনকে হরণ করে নিয়ে এলেন, মহারাজ বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে তার বিবাহ, তার প্রাণাধিক ভালবাসা, তার মৃত্যু এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আজ এই রম্য অভিযান-এত সব ভাবতে ভাবতেই রাত্রির দ্বিতীয় প্রহর উপস্থিত হল।

মহর্ষি বেদব্যাস উপস্থিত হলেন অম্বিকার শয়ন কক্ষে–শয়নং প্রবিবেশ হ। মহাভারতের কথক-ঠাকুর তার কথাগুরু বেদব্যাসের চেহারার বর্ণনা দিয়ে বলেছেন–তাঁর মাথায় ছিল পিঙ্গল জটাভার, এক গাল দাড়ি, কালো গায়ের রঙ, আর চোখ দুটো যেন জ্বলছিল–তস্য কৃষ্ণস্য কপিলাং জটাং দীপ্তে চ লোচনে। দ্বৈপায়ন তার মাকে বলেছিলেন-আজই যদি তোমার বধূর সঙ্গে মিলন চাও, তবে আমার বিকৃত রূপ, বিকৃত বেশ আর গায়ের দুর্গন্ধ সহ্য করতে হবে তোমার বন্ধুকে। আমাদের ধারণা–তিনি আর নতুন কী বিকার ঘনিয়ে আনবেন নিজের চেহারায়। তার চেহারাটাই তো ওইরকম। আমরা ছোটবেলায় বৈষ্ণব-সজ্জনদের মুখে মহামতি ব্যাসের একটা ধ্যানমন্ত্র শুনতাম। সেই শ্লোক মন্ত্রে ব্যাসের প্রথম উপাধি হল-বেদ-শাস্ত্রের অধ্যয়ন-অধ্যাপনে যার বুদ্ধি পরিশীলিত হয়েছে এই তার আন্তর রূপ। দ্বিতীয় রূপ হল বাহ্যরূপ–চামড়ার কাপড় পরিধানে, কালো গায়ের রঙ, মাথায় কপিল-তুঙ্গ জটাভার কৃষ্ণত্বিষং কনকতুঙ্গ-জটাকলাপ। আর মধ্যে আছে দুটি আগুনের ভাটার মতো চোখ–

রাজবাড়ির সার্বত্রিক পরিচ্ছন্নতার মধ্যে যে রাজবধূ জীবন কাটিয়েছেন, যিনি ভীষ্ম কিংবা রাজপরিবারের ভাশুর স্থানীয় অন্য কারও কথা ভেবে নিজের মনকে তবু একটু প্রস্তুত করছিলেন, সেই রাজবধু রাজবালা মহর্ষি বেদব্যাসের এই অকল্পনীয় রূপ দেখে ভয়ে চোখ বুজলেন- দৃষ্টা দেবী ন্যমীলয়ৎ। ঘরে দীপ জ্বালা রয়েছে ব্যাস উপস্থিত হয়ে রমণীর হৃদয়হারী কোনও চাটুবাক্য বললেন না, কোনও শৃঙ্গার-নর্মে মন দিলেন না। শুধু মায়ের ইচ্ছাপূরণ করে ইতিকর্তব্য পালন করলেন। ওদিকে অদ্ভুত আশঙ্কায়, ভয়ে রাজবধূ অম্বিকা চক্ষু মুদে আপন রুচি-বিরোধী এক পুরুষ-সংসর্গ সহ্য করে গেলেন। একবারের জন্যও তিনি চোখ খুলে ব্যাসের দিকে আর তাকালেন না– ভয়াৎ কাশীসূতা তন্তু নাশক্লোদভিবীতুম্।

রানীর শয়নকক্ষ থেকে ব্যাস বেরিয়ে চলে যাবার পথেই তাকে ধরলেন সত্যবতী। জিজ্ঞাসা করলেন–খুব ভাল ছেলে হবে তো, বাবা। রাজার ছেলে রাজপুত্রের মতোই হবে তো সে অপ্যস্যাং গুণবান্ পুত্র রাজপুত্রো ভবিষ্যতি? সত্যবতীও বোধহয় পুত্রের চেহারা দেখে তত ভরসা পাননি। অবশ্য প্রশ্নটাও ঠিক পুত্রের কাছে মায়ের মতো নয়। এ যেন ভবিষ্যদ-দ্রষ্টা এক ঋষির কাছে সাধারণ রমণীর আকুতি-ভাল ছেলে হবে তো, বাবা! ব্যাস জননীর কথা শুনে দৈবপ্রেরিত ব্যক্তির দূরদৃষ্টিতে বললেন–মা! এই রানীর গর্ভে যে ছেলেটি হবে, তার গায়ে থাকবে হাতির মতো শক্তি। তিনি বিদ্বান, ভাগ্যবান এবং বুদ্ধিমান হবেন যথেষ্টই। কিন্তু সেই ভাবী ছেলের মা এমনই একটা ব্যবহার করল, যে ছেলেটি তার অন্ধ হয়েই জন্মাবে–কিন্তু মাতুঃ স বৈগুণাদ অন্ধ এব ভবিষ্যতি।

সত্যবতী বললেন–কী সৰ্বনেশে কথা, বাবা! একজন অন্ধ মানুষ কি কুরুবংশের উপযুক্ত রাজা হতে পারে নান্ধঃ কুরূণাং নৃপতিরনুরূপস্তপোধন? তুমি বাপু কুরুবংশের উপযুক্ত, রাজা হওয়ার মতো একটি পুত্র-জন্মের ভাবনা করো। সেও তার পিতার বংশের ধারা বজায় রাখবে। ব্যাস আর কী করেন। মায়ের কথায় রাজি হলেন আবার।

কাশীরাজনন্দিনী অম্বিকা যথা সময়ে একটি অন্ধ পুত্র প্রসব করলেন। এখনকার দিনে হলে বলা যেত, অনীতি এক ধর্ষণের ফলেই অম্বিকার পুত্রের এই অঙ্গহানির বিকার ঘটেছে। অথবা ব্যাসের ভবিষ্যৎ-দৃষ্টির ওপর ভরসা না থাকলে বলা যায়-অম্বিকার পুত্র অন্ধ হয়ে জন্মানোর পরেই সত্যবতী তাঁর দ্বিতীয় অনুরোধটি করেছেন ব্যাসের কাছে। এই অনুরোধের মধ্যে আশ্চর্যের কিছু নেই। কারণ অম্বিকা অলৌকিকভাবে ব্যাসের মিলন-মুহূর্তেই তার সদ্যগর্ভ প্রসব করেননি। তিনি সন্তান ধারণ করেছেন এবং যথাকালেই প্রসব করেছেন–সাপি কালে চ কৌশল্যা সুষুবে’ন্ধং তমাত্মজ।

 অন্ধ পুত্রের মুখ দেখে ভূয়োদর্শিনী সত্যবতী আবারও আহ্বান জানালেন ব্যাসকে। এবারে এবার বিচিত্রবীর্যের দ্বিতীয়া মহিষী অম্বালিকার পালা। সত্যবতী তাকেও ধীরে-মধুরে বুঝিয়ে-সুজিয়ে শয়নকক্ষে পাঠালেন-পুনরেব তু সা দেবী পরিভাষ্য সুষাং ততঃ।

অম্বালিকা অপেক্ষা করতে লাগলেন নিযুক্ত পুরুষ ব্যাসের আগমনের জন্য। ব্যাস একইভাবে জটা-দাড়ি আর দীপ্ত চক্ষুর বিকর্ষণ নিয়ে উপস্থিত হলেন অম্বালিকার শয়ন-প্রকোষ্ঠে–ততস্তেনৈব বিধিনা মহর্ষিস্তামপদ্যত। অগ্রজা অম্বিকার অভিজ্ঞতায় অম্বালিকা মনের জোর করেই চোখ বন্ধ করলেন না বটে, কিন্তু ভয়ে সিঁটিয়ে গেলেন একেবারে। সেই ভয়েই তিনি বুঝি একেবারে বিবর্ণ ফ্যাকাশে হয়ে গেলেন- বিবর্ণা পান্ডুসঙ্কাশা সমপদ্যত ভারত। মিলন সম্পূর্ণ হল এইভাবেই–ভয়ে, বিবর্ণতায়।

আগের বারে যাঁর সঙ্গে তার মিলন হয়েছিল, সেই ভীতা নিমীলিতচক্ষু অম্বিকার সঙ্গে কথা বলার কোনও সুযোগই পাননি ব্যাস। এক অন্তহীন বিকর্ষণের মধ্যেই তাকে বিদায় নিতে হয়েছিল। এবারে শত শত প্রজ্বলিত দীপামালার মধ্যে তারই দিকে তাকিয়ে থাকা এক বিবর্ণ মলিন সন্ত্রস্ত মুখ ব্যাস দেখতে পেলেন। সে মুখের মধ্যে তৃপ্তির আভাস ফুটে না উঠলেও, তার মধ্যে অনভিনন্দন বা সম্পূর্ণ নির্বিকার ভাব ছিল না। ভয়ে সিটিয়ে থাকা রমণীর মুখপানে তাকিয়ে ব্যাস দুটো কথা বলার সুযোগ পেলেন। বললেন–আমার এই বিরূপ বিষম আকৃতি দেখে তুমি যখন এমন বিবর্ণ পার হয়ে গেলে, তাই তোমার পুত্রটির চেহারাও হবে এইরকম নিষ্প্রভ বিবর্ণ গোছের। আমি বলি—তার নাম রেখো পাণ্ডু–তস্মাদেষ সুতস্তে বৈ পারেব ভবিষ্যতি। মাথা নত করলেন অম্বালিকা।

 শয়নকক্ষ থেকে নির্গত হতেই দ্বৈপায়নকে ধরলেন সত্যবতী। বললেন–এবারে একটি সুক্ষণ পুত্রের জন্ম হবে তো? ব্যাস বললেন-এই পুত্রটি যথাকালে প্রবল পরাক্রান্ত এবং জগদ্বিখ্যাত হবে। কিন্তু মা! অম্বালিকার পূর্ব আচরণ আচরণনুযায়ী এই ছেলেটির গায়ের রঙ হবে বিবর্ণ পান্ডু।

গায়ের রঙ দিয়ে আর কী হবে! সত্যবতী খুব একটা হতাশ হলেন না। কিন্তু তবুও আবার কী মনে করে দ্বৈপায়ন পুত্রকে তিনি তৃতীয়বার অনুরোধ করে বসলেন। হয়ত এই অনুরোধও পাণ্ডু জন্মাবার পরেই তিনি করেছিলেন। হয়ত বা পাণ্ডুর বিবর্ণতা দেখে তার বড় কোনও আশঙ্কা হয়নি। কিন্তু একবারের তরেও হয়ত বড় রানী অম্বিকার দশা দেখে তার মায়া হয়েছিল। হয়তো ভেবেছিলেন–স্বামী বেঁচে নেই এবং একটি জন্মান্ধ পুত্রের মুখ দেখে সারাজীবন কাটাতে হবে তাকে। মনে মনে হয়ত সে দুষবে তার শাশুড়িকে। সত্যবতীর জন্যই তো তার এই দুর্দশা। সত্যবতী মাতৃসুলভ বায়না করে ব্যাসকে তৃতীয়বার অনুরোধ জানালেন–আরও একবার অম্বিকার সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য।

জন্মেই যে বিরাগী পিতার সঙ্গে তপস্যায় চলে গিয়েছিল, সে পুত্রের মনে মাতৃকৃত্যের দায় ছিল। ব্যাস মায়ের কথায় রাজি হলেন। ওদিকে পাণ্ডু জন্মালেন। চেহারাটি বিবর্ণ হলেও রাজা হওয়ার মতো সমস্ত লক্ষণই তাঁর মধ্যে ছিল অতি প্রকট–পাণ্ডুলক্ষণসম্পন্নং দীপ্যমানবি শিয়া। সত্যবতী আবারও ব্যাসকে আহ্বান জানালেন এবং আবারও বড় রানী অম্বিকাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে রাজি করানোর চেষ্টা করলেন। অম্বিকা সামনাসামনি সত্যবতীর কথা অমান্য করলেন না। কিন্তু মহর্ষির তপঃক্লিষ্ট দেহের সেই দুঃসহ গন্ধ, ওই জটা-দাড়ির ঘন সন্নিবেশ তিনি মনে মনে মোটেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তিনি ভাবলেন-শাশুড়ির কথা মাথায় থাক। তার পক্ষে দ্বিতীয়বার ওই বিষমরূপী মহর্ষির সঙ্গ করা সম্ভব নয়– নাকরোদ্ বচনং দেব্যা ভয়াৎ সুরসুলতাপমা।

শাশুড়ির কাছে তিনি স্বীকার করে এসেছিলেন বলেই নির্দিষ্ট শয়নকক্ষে তার উপস্থিতির ব্যাপারে সত্যবতী কোনও সন্দেহও করেননি। কিন্তু অম্বিকার বুদ্ধি ছিল অন্যরকম। নির্দিষ্ট দিনে তিনি ঠিক করলেন–নিজে নয়, তার সুন্দরী দাসীটিকে তিনি পাঠিয়ে দেবেন সেই শয়নকক্ষে–সেখানে ব্যাস আসবেন জননীর অনুরোধ মেনে নতুন করে গর্ভাধান করার জন্য। নিশীথিনীর মায়া-শয়নে মুনির চিত্ত যাতে বিগলিত হয়, তার জন্য অম্বিকা নিজে তার দাসীটিকে খুব করে সাজালেন। রাজ-আভরণে, বসনে-ভূষণে দাসীটিকে অপ্সরার মতো সুন্দর দেখাচ্ছিল–ততঃ স্বৈভূষণে দাসীং ভুষয়িত্বারোপমা।

আধুনিক দৃষ্টিতে দেখতে গেলে এই যে দাসীর কথা বললাম, এঁদের সামাজিক স্থিতি মোটেই ভাল ছিল না। কোনও রাজার বাড়িতে এঁরা থাকতেন, অথবা রাজারা এঁদের কিনে নিতেন। তারপর রাজকন্যার বিয়ের সময় যৌতুক হিসেবে এই অসহায়া রমণীদের পাঠিয়ে দেওয়া হত রাজকন্যার সঙ্গে। প্রথমত নতুন রাজবাড়িতে রাজকন্যার যাতে কোনও অসুবিধে না হয়, নতুন বাড়িতে লজ্জানা, রাজবধু যাতে সহজ হয়ে উঠতে পারেন নতুন আস্তানায়, সে ব্যাপারে এঁরা সাহায্য করতেন। দ্বিতীয়ত রাজবধুরা যখন ঋতুর কারণে স্বামী-সহবাসে অক্ষম হতেন, তখন রাজাদের সঙ্গ দিতেন এই রমণীরাই।

জাতিগতভাবে এঁরা সমাজের তিন উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বা বৈশ্যের ঘরের মেয়ে হতেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এঁরা ছিলেন শূদ্র বর্ণের। কিন্তু সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে এরা অনেকেই। ছিলেন যথেষ্ট সুন্দরী এবং সৌন্দর্যের কারণেই এক রাজা তাদের যৌতুক দিতেন, অন্য রাজা তাদের ভোগ করতেন। মহাকাব্যের সমাজে এই দাসীরা অনেক বড় বড় রাজা-মহারাজা বা মুনি-ঋষির জননী হয়েছেন।

আমরা পূর্বে দীর্ঘতমা নামে এক অন্ধ মুনির কাহিনী কীর্তন করেছি। হস্তিনার রাজবাড়িতে পুত্রোৎপাদনের জন্য ব্যাসের নিয়োগের পূর্বে ভীষ্ম এই দীর্ঘতমারই উদাহরণ দিয়েছিলেন সত্যবতীর কাছে। অঙ্গ-দেশের রাজা বলি তার স্ত্রী সুদেষ্ণার গর্ভে পুত্র-উৎপাদনের জন্য অন্ধ দীর্ঘতমাকে নিয়োগ করেন। অন্ধতার সঙ্গে দীর্ঘতমার বার্ধক্যও ছিল আর ছিল কিছু যৌন বিকারও। রাজরানী সুদেষ্ণা অপুত্রক হলেও রাজকীয় রুচিতে বাধে বলে এই অন্ধ-বৃদ্ধ মুনির সঙ্গে–অন্ধং বৃদ্ধঞ্চ তং জ্ঞাত্বা-সহবাস করতে রাজি হননি প্রথমে। অতএব তিনিও প্রথমে তার দাসীটিকেই সাজিয়ে-গুজিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন দীর্ঘতমার কাছে। সে শুদ্রা রমণীর গর্ভে যে সব পুত্র জন্মে তারা অনেকেই ছিলেন মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি-মুনি। তাদের মধ্যে কাক্ষীবান তো রীতিমতো বিখ্যাত।

আমাদের ধারণা, হস্তিনার রাজবধূ দীর্ঘতমার উদাহরণেই নিজের দাসীটিকে নিজের বসন-ভূষণে অলঙ্কৃত করে পাঠিয়ে দিলেন মহর্ষি বেদব্যাসের কাছে–প্ৰেষয়ামাস কৃষ্ণায় ততঃ কাশীপতেঃ সুতা। রাজবাড়ির দাসীর কাছে এ ছিল অপরিমিত সৌভাগ্য। সে চিরকাল রাজার প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়েছে। রতি-রঙ্গের যাতনাটুকুই তার কাছে সাধারণ, রাজার সন্তান ধারণের সুযোগ তার সবসময় হয় না। আজ সে পুত্রলাভের জন্য সাদরে নিযুক্তা। তাছাড়া পরমর্ষি বেদব্যাসের সম্মান-মর্যাদা সেও কি জানে না? সে হস্তিনার রাজবাড়িতে থাকে; রাজকীয় পরিশীলনে তার বোধ অনেক উন্নত হয়ে গেছে এবং ইতোমধ্যে দুই রাজবধুর গর্ভে দুটি পুত্রসন্তান দেখে আজ সে আপ্লুত বোধ করছে। মহামুনি ব্যাস তার গর্ভে পুত্র জন্মাবেন এই মর্যাদায় আজ সে অভিভূত।

এতকাল কী হয়েছে, বিচিত্রবীর্যের রানীরা বিষণ্ণ মুখে বিষণ্ণ ভাবনায় ঘরে শুয়ে থেকেছেন। কোনও আমন্ত্রণ নেই, অভিবাদন নেই অভিনন্দন তো দূরের কথা। রাজরানীর পরিশীলিত রুচিতে তথা আধুনিক দৃষ্টিতেও ব্যাসের প্রতি এই আচরণ হয়ত অসম্মত নয়। কিন্তু ব্যাসের দিক থেকে ব্যাপারটা কী রকম? তিনি পুত্র-সন্তানের জন্ম দিতে এসেছেন তৎকালীন সামাজিক প্রথা মেনে এবং রীতিমতো আমন্ত্রিত হয়ে। তার কাছে রাজবধূদের এই বিষবৎ পরিহারের আচরণ কেমন লেগেছে?

আজ কিন্তু সেরকম ঘটল না। আজ তিনি দেখলেন– এক সুন্দরী রমণী সর্বাভরণ ভূষিতা হয়ে তার আগমনের প্রতীক্ষা করছে। শয়নকক্ষে নয়, রাজগৃহের দ্বারে। তিনি আসতেই সে রমণী তাকে সাদরে পথ দেখিয়ে নিয়ে এল শয়নকক্ষ পর্যন্ত–সা তমৃমি অনুপ্রাপ্তং প্রত্যুদগম্যাভিবাদ্য চ। ঋষির অনুমতি নিয়েই সে তাকে আসন দিল বসতে, আহার দিল ফল-মূল। ভারি খুশি হলেন বেদব্যাস। তাঁর শুষ্ক-রুক্ষ মুনি-জীবনে কোনও সুন্দরী রমণী এমন মধুর ব্যবহার করেনি তার সঙ্গে। ব্যাস বড় খুশি হয়ে তার সঙ্গে বসে বসে বেশ খানিকক্ষণ গল্প করলেন। গল্পে-সন্সে, কথারঙ্গে কখনও তার হাত দুটি ধরলেন মুনি, কখনও হাত রাখলেন কাঁধে, পিঠে; কানে কানে কহিবার ছলে দাসীর লজ্জারুণ কুসুম-কপোল চুম্বন করলেন হয়ত-বাগবোপপ্রদানেন গাত্র-সংস্পর্শনেন চ। লগ্ন অনুকূল হল, আলিঙ্গন ঘনতর হল। ব্যাস দাসীর সঙ্গসুখে পরম তৃপ্তি লাভ করলেন-কামোপভাগেন রহস্তস্যাং তুষ্টিমগাদৃষিঃ।

হয়ত এই তৃপ্তির কারণও ছিল। এখানে নিয়োগ প্রথার নিয়ম মেনে কামনার গন্ধহীন কোনও যান্ত্রিকতা নেই। মহর্ষির দিক থেকেও নেই, শূদ্রা দাসীর দিক থেকেও নেই। অন্যদিকে সত্যবতী পুর্বে ব্যাসকে ডেকে এনে বলেছিলেন–তুমি তোমার ভ্রাতৃজায়াদের গর্ভে বিচিত্রবীর্যের এবং তোমার নিজেরও পূত্র উৎপাদন করো–অনুরূপং কুলস্যাস্য সত্যাঃ প্রসবস্য চ। আমাদের ধারণা বিচিত্রবীর্যের দুই রানীর গর্ভে দুটি পুত্র উৎপাদন করার পর এই যে তৃতীয় দাসী–এই দাসীগর্ভজাত পুত্রটিকেই তার একান্ত আপন পুত্র মনে করেই ব্যাস পরম আনন্দ লাভ করলেন। মহর্ষির বিবাহ হয়নি। সমাজের বিধান অনুযায়ী না হলেও এই শূদ্রা দাসীর অভিবাদন অভিনন্দনে তিনি প্রথম বিবাহের আনন্দ পেলেন যেন।

সহবাসের অন্তে পরম প্রীত ব্যাস–মহর্ষিঃ প্রিয়মানয়া-দাসীর কপালে হস্তস্পর্শ করে বললেন–আমার অনুগ্রহে আজ থেকে আর তুমি দাসী থাকবে না–অভুজিষ্যা ভবিষ্যতি। ব্যাস আরও বললেন–আমি মনে করি কোনও মহাপুরুষ আসছেন তোমার গর্ভে–অয়ঞ্চ তে শুভে গর্ভঃ শ্রেয়ানুরমাগতঃ। যিনি তোমার পুত্র হয়ে জন্মাবেন তিনি হবেন পরম ধার্মিক এবং বুদ্ধিমান মানুষের মধ্যে তিনি হবেন শ্রেষ্ঠ। দাসীকে আশীর্বাদ করে দ্বৈপায়ন ব্যাস বাইরে এলেন। জননীর কাছে বিদায় নেবার সময় বড় রানী অম্বিকার ছলিক আচরণের কথাও যেমন জানালেন, তেমনি জানালেন, শূদ্রা দাসীর সঙ্গে তার আনন্দ-মিলনের কথা–প্রলম্ভম আত্মনশ্চৈব শূদ্রায়াং পুত্রজন্ম চ।

মায়ের ঋণ তো কখনও পূরণ করা যায় না। কিন্তু জন্ম থেকেই যিনি তপস্বীর ব্রত গ্রহণ করেছেন, তিনি অন্তত তিন-তিনবার মায়ের আদেশ শিরোধার্য করে সন্তানের ঋণ শোধর চেষ্টা করে গেলেন। কারণ সেকালের ধারণা ছিল–সন্তানের জন্ম হলে তাদের ভাল মন্দ নিয়ে যখন মানুষ ব্যাপৃত থাকে, সন্তানের মূত্রপুরীষ পরিষ্কার করে তাদের বড় করে তোলার জন্য মানুষ যে কষ্ট এবং ভাবনা করে সে ভাবনার মাধ্যমেই একভাবে পিতৃ-মাতৃ-ঋণ খানিকটা শোধ হয়। ব্যাস তপস্বী, তাই মায়ের অনুজ্ঞা পালন করে সন্তানের জন্ম দিয়ে গেলেন, কিন্তু তাদের দায়িত্ব দিয়ে গেলেন তারই গৃহস্থাংশ ভীষ্মের ওপর। কিন্তু ভাবনার সময় যখন আসবে, তখন তাকে বারবার ঠিক ফিরে আসতে হবে হস্তিনার দ্বন্দ্ব-দীর্ণ সংসারের প্রাঙ্গণে। বারবার তাকে সত্যের পথ বলে দেবার জন্য আশ্রম ছেড়ে আসতে হবে। আসতে হবে মমতার টানে, নাড়ির টানে। আসতে হবে মহাভারতের কবি হয়ে ওঠার উপকরণ সংগ্রহের জন্য–স্রষ্টার মতো, সাক্ষী-চৈতন্যের মতো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *