০২৫. পুরূরবা-উর্বশীর পুত্র আয়ু

২৫.

কথায় বলে–নিজের নামে যে মানুষ জন-সমাজে পরিচিত, তিনিই সত্যিকারের কৃতী এবং উত্তম পুরুষ। যিনি পিতার নামে বিখ্যাত হন, তাকে মধ্যম আখ্যায় অভিহিত করা হয়েছে–স্বনামা পুরুষো ধন্যঃ পিতৃনামা তু মধ্যমঃ। মায়ের নামে যার পরিচিতি, তাকে অধম বলেছেন নীতিশাস্ত্রকারেরা। চতুর্থ কোনও আখ্যা তাদের অভিধানে নেই, তবে ভাবে বুঝি–পুত্রের নামে যদি কেউ বিখ্যাত হন, তবে নীতিকারদের হাতে তার বিশেষণ জুটত ‘অধমাধম’।

 নীতিকথার প্রসঙ্গ এল পুরূরবা-উর্বশীর পুত্র আয়ুর কথায়। আয়ু নিজে তেমন কোনও বিখ্যাত রাজা নন। পুরূরবার পুত্র হিসেবে তাকে বড় জোর মধ্যম মাপের পুরুষ বলা যেতে পারে। আর যদি তার পুত্রের নাম করি তাহলে আয়ুকে একেবারে ‘অধমাধম’ বলতে হবে। আয়ুর পুত্র নহুষ। মহাভারতের বিরাট পরিসরে নহুষ এতটাই বিখ্যাত রাজা যে তার পরিচয়েই আয়ু খানিকটা বিখ্যাত হয়েছেন। আয়ুর পুত্র নহুষ বললে নহুষের মর্যাদা কিছু বাড়ে না। কিন্তু নহুষের পিতা আয়ু বললে নহুষের মর্যাদা নাই বাড়ুক, আয়ুর মর্যাদা তাতে বাড়ে। আয়ু রাজ্যে অভিষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার চরিত্র এবং বল-বর্ণনা অন্য রাজার তুলনায় কিছুই হয়নি, উপরন্তু পৌরাণিকেরা আরম্ভেই বলেছেন- মুনিরা উর্বশীর সন্তান আয়ুকে সিংহাসনে অভিষিক্ত করলেন এবং লোকে এই রাজাকে নহুষের বাবা বলে জানে নহুষস্য মহাত্মানং পিতরং যং প্রক্ষিতে।

পৌরাণিক যেভাবে কথাটা বললেন তাতে আয়ুর মর্যাদা কিছু বাড়ল না, অর্থাৎ তার অবস্থাটা প্রায় ‘অধমাধম’ গোছের হয়ে দাঁড়াল। এবারে উপরিউক্ত নীতিবাক্য এবং পৌরাণিকের কথার বিরুদ্ধে আমাদের প্রতি-বক্তব্য পেশ করি। প্রথমেই বলি–সব মানুষই বিখ্যাত হন না, হাতে পারেন না। কিন্তু কীর্তিমান পুত্রের পিতা হওয়ার জন্য পিতার যে তপস্যা থাকে, যে প্রাণ থাকে সেই তপস্বী প্রাণটুকুকে অস্বীকার করি কী করে? শাস্ত্রে বলে উপযুক্ত এবং কৃতী সন্তানের জন্য পিতা-মাতাকে তপস্যা করতে হয়, ভাবনা করতে হয়। এই তপস্যা। এবং ভাবনা শুরু হয় পুত্রজন্মের বহু পূর্ব থেকে এবং তা চলে সারা জীবন ধরে।

আমি যখন একেকটি বাবা-মাকে পরম আগ্রহে তার সন্তানকে স্কুলে নিয়ে যেতে দেখি, পুত্র-কন্যার জন্য সারাদিন স্কুলবাড়ির আশে-পাশে বসে থাকতে দেখি, তাদের জন্য ভাবনা করতে দেখি, তখনই বুঝি সেই প্রাচীন তপস্যা চলছে। একশো জনের মধ্যে একটি সন্তান হয়তো ভবিষ্যতে কৃতী হবে, কিন্তু তার জন্য কল্যাণকামী পিতা-মাতার সম্ভাবনার পরম এবং চরম কষ্টকর তপস্যাকে অস্বীকার করি কী করে? কী করেই বা সেই অনামা পিতা-মাতাকে অধমাধম’ বলি? মহামতি বিদ্যাসাগরের জন্য ঠাকুরদাস বা ভগবতী দেবী বিখ্যাত হয়েছেন হয়তো, কিন্তু বিদ্যাসাগরের বীজ ছিল ওই জনক-জননীর তপস্যা, ভাবনা বা ইচ্ছার মধ্যে ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে। এই জনক-জননীকে কোন যুক্তিতে আমরা ‘অধমাধম’ বলব?

 আয়ুর মতো অনামা পিতার জন্য, আরও পরিষ্কার করে বলি- যে পিতা তার অসাধারণ পুত্রের জন্যই শুধু বিখ্যাত, তার জন্য কিছু সমব্যথা আছে আমার। নীতিশাস্ত্রকার একটি পুরুষকে কৃতী হওয়ার উদ্দীপনা জোগান দিতেই অমন নীতিবাক্য রচনা করেছেন, তা বেশ বুঝি, নইলে হাজারো অনামা জনক-জননীর তপস্যা থেকেই একটি বিবেকানন্দ, কি একটি বিদ্যাসাগরের জন্ম হয়। পুরূরবার পুত্র আয়ু এই রকমই অসহায় তপস্বী পিতার উদাহরণ। বস্তুত যে পৌরাণিক তাচ্ছিল্যভরে বলেছিলেন– ওই যাঁকে নহুষের পিতা বলে লোকে বলে–এই উক্তির প্রতিবাদেই যেন অন্য এক পৌরাণিক আয়ুর কথা কিছু লিখেছেন। মহাভারত এবং অন্যান্য মহাপুরাণের উপেক্ষার জবাব দিতেই যেন আয়ুর এই কাহিনী। মুশকিল হল- ভাগ্যের এমনই চক্রান্ত যে,আয়ুর কথা সামান্য বলতে গেলেও আমাদের নহুষকে একবার ছুঁয়ে যেতে হবে।

তাবে তারও আগে মনে রাখতে হবে–যে পুরাণ থেকে এই কাহিনী আমরা সংগ্রহ করেছি, তা অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন পুরাণ। দেখা যাচ্ছে–ত্রিলোকসুন্দরী পার্বতী একবার মহাদেবকে সপ্রেমে বলেছিলেন–আমাকে একবার নন্দন-কাননে নিয়ে যাবে? কাছে গিয়ে একবার দেখতে ইচ্ছে করে কেমন সেবন? মহাদেব তার প্রমথগণ আর ভূতপ্রেতের বাহিনী সঙ্গে নিয়ে প্রেমানন্দে পার্বতাঁকে নন্দনকাননে নিয়ে গেলেন। স্বৰ্গশোভার সার সেই অপূর্ব বনভূমি দেখে শিবপ্রিয়া পার্বতী একেবারে মোহিত হয়ে গেলেন। নন্দনকাননের সব চেয়ে বড় আকর্ষণ হল মধ্যিখানে থাকা কল্পবৃক্ষটি। সে বৃক্ষের কাছে যা চাওয়া যায় তাই পাওয়া যায়। শিব বললেন-তোমার মনের যা অভিলাষ আছে, জানাও এই কল্পতরুর কাছে, তোমার বাসনা পূরণ হবে।

পার্বতী শিবের অনুমতি নিয়ে তরুরাজ কল্পদ্রুমের কাছে চেয়ে নেবেন বলে অসামান্য রূপবতী গুণবতী রমণীর ভাবনা করলেন মনে মনে। কল্পনামাত্রেই রূপে চারদিক আলো করে বেরিয়ে এল এক কন্যা। পার্বতীর ভাবনা আর কল্পতরুর ঋদ্ধি আত্মসাৎ করে সেই কন্যা এসে প্রণাম করল পার্বতীর পদদ্বন্দ্বে। পার্বতী বললেন-কল্পতরুর কাছে সত্যিই চেয়ে পাওয়া যায় কিনা– সে কৌতূহল আমার তৃপ্ত হল তোমাকে দেখে। তোমার নাম হবে অশোকসুন্দরী। জগতে তুমি আমার কন্যা বলে পরিচিত হবে–সর্বসৌভাগ্যসম্পন্না মম পুত্রী ন সংশয়ঃ।

পার্বতী কন্যাকে আর্শীবাদ করে বললেন- চন্দ্রবংশে ইতুল্য এক রাজা জন্মাবেন। তিনিই তোমার স্বামী হবেন–নহুষশ্চৈব রাজেন্দ্র স্তব নাথো ভবিষ্যতি।

রাম না জন্মাতেই রামায়ণ হয়ে গেল। নহুষের জন্মের কোনও লক্ষণই দেখিনি এতক্ষণ, কিন্তু জগজ্জননী তাঁর কল্পকন্যার স্বামী নির্ধারিত করে রাখলেন আগে থেকে। অশোকসুন্দরী’ নামটার মধ্যে আধুনিকতা আছে বলেই বড় বেশি কাব্যগন্ধী। বস্তুত এই রকম একটা আধুনিক নাম মহাভারত কিংবা প্রাচীন পুরাণগুলিতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। পদ্ম পুরাণ যেহেতু তুলনায় কিছু অর্বাচীন তাই নহুষের স্ত্রী হিসেবে অশোকসুন্দরীর নাম আমরা উপাখ্যানের তাড়নায় মেনে নিলাম। আরও একটা নাম গল্পের খাতিরেই আমাদের মেনে নিতে হবে। সেটি একটি পুরুষ-নাম। তার নাম দৈত্যপতি হুণ্ড পদ্ম পুরাণ এবং আরও দু-একটি পুরাণে হুণ্ড দৈত্যের মরণের কাহিণী বর্ণিত আছে। পণ্ডিতদের মতে হুণ্ড একটি ছোট উপজাতির নাম এবং হণদের সঙ্গেও একে এক করে দেখা যেতে পারে। অনেকে আবার হুণ্ড’ শব্দটাকে ‘পৌন্ড্র’ শব্দের অপভ্রংশ বলে মনে করেন। পৌন্ড্র অর্থ প্রাচীন পুন্ড্রবর্ধনের লোক, আর পুণ্ড্রবর্ধন মানে এখনকার বাংলাদেশের পাবনা-রাজশাহীর খানিকটা নিয়ে উত্তরবঙ্গ এলাকা। এই সব জায়গার লোককে সেকালের আর্য পুরুষেরা অসুর, রাক্ষস, বর্বরই বলতেন, যদিও তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি কিছু কম ছিল না। অতএব হুণ্ড কোনও বিজাতীয় লোক নন, অনার্য-জাতীয় কোনও প্রভাবশালী পুরুষ।

পদ্মপুরাণ বলেছে– হুণ্ড ছিলেন বিচিত্তির ছেলে। শিব-পার্বতীর কল্পকন্যা অশোকসুন্দরী যখন রূপের আলোয় নন্দন-কানন ভরিয়ে রেখেছেন, সেই সময় স্বেচ্ছাচারী হুন্ড এসে প্রবেশ করলে সেই বনভূমিতে। অপরূপা রমণীরত্ব দেখে হুণ্ডের মাথাটাই ঘুরে গেল। অশোকসুন্দরীর কাছে আপন অন্তর্ভেদী কামনা প্রকাশের আগে সে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল–আমি বিচিত্তির ছেলে। শৌর্যে-বীর্যে এবংণে আমার মতো দ্বিতীয় কোনও সুলক্ষণ রাক্ষস নেই এই তিন ভুবনে। তোমাকে দেখেই আমার সর্বাঙ্গ শিহরিত কামনায়। তোমাকে আমি বিয়ে করতে চাই এবং এ ব্যাপারে তোমার প্রসন্নতা চাই আমি–প্রসাদসুমুখী ভব। ভবস্ব বল্লভ ভার‍্যা মম প্রাণসমা প্রিয়া।

অশোকসুন্দরী শান্ত মনে হণ্ড-দৈত্যকে নিজের অপার্থিব জন্মকথা শোনালেন। জানালেন শিব-পার্বতীর সঙ্গে তার সম্পর্ক। শেষ পর্যন্ত পার্বতীর নির্দেশ জানিয়ে অশোকসুন্দরী বললেন–আমার জন্মলগ্নেই জগজ্জননী পার্বতী আমার স্বামী নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। চন্দ্রবংশে সর্বগুণসম্পন্ন রাজা নহুষ জন্মাবেন। তার সঙ্গেই আমার বিয়ে হবে। এবারে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, দৈত্যরাজ, তুমি যার সঙ্গে কথা বলছ, সে আসলে পরস্ত্রী। তুমি আর ভুল কোরো না, যাও এখান থেকে–অতঃ ত্বং সর্বথা হুণ্ড ত্যজ ভ্রান্তিমিতো ব্রজ।

দৈত্য বলল–যত সব গাঁজাখুরি কথা। যেমন তুমি, তেমনই তোমার দেবদেবীর কথা। চন্দ্রবংশে কবে নহুষ জন্মাবেন? আর কবে তুমি তার বউ হবে? বরের থেকে বউ বয়সে বড়–এ কি খুব ভাল কথা? মেয়েদের যতদিন যৌবন থাকবে, তারুণ্য থাকবে, ততদিনই তারা রূপবতী। তোমার এই রূপ-যৌবন একেবারে বৃথা যাবে। কবে মহারাজ আয়ুর পুত্র জন্মাবেন? কবে সে ছোট থেকে বড় হবে? আর কবে সে তোমাকে বিয়ে করার বয়সে পৌঁছবে-কদাসৌ যৌবনোপেস্তব যোগ্যা ভবিষ্যতি। তার চেয়ে ওসব কল্পকথা, স্বপ্ন দেখা থাক। আমার সঙ্গে রসে-রমণে তোমার দিন কাটবে আরও ভাল ময়া সহ বিশালাক্ষি রমস্ব ত্বং সুখেন বৈ। চলো তুমি।

একটা কথা এখনই বলে নেওয়া ভাল, কারণ পরেও এসব কথা আসবে। আমাদের বিশ্বাস-সেকালে যখন বয়সে বড় কোনও মেয়ের সঙ্গে বয়ঃকনিষ্ঠ পুরুষের বিয়ে হত, তখনই এই ধরনের উপাখ্যান কিছু তৈরি হত। কৃষ্ণজ্যেষ্ঠ বলরামের বিয়ে হয়েছিল রেবতীর সঙ্গে এবং রেবতী বয়সে বড় ছিলেন। তাকে নিয়েও পুরাণ-ইতিহাসে অনুরূপ উত্তম উপাখ্যান রচিত হয়েছে, যার হাস্যরসাত্মক রূপ পরশুরামের লেখা “রেবতীর পতিলাভ”। যাই হোক, অশোকসুন্দরী নিজের পাতিব্ৰত্য প্রতিষ্ঠা করে কড়া ভাষায় প্রত্যাখ্যান করলেন হুণ্ডকে এবং অভিশাপের ভয়ও দেখালেন নাচার হয়ে। হুও আপাতত প্রস্থান করল বটে–কিন্তু ছলে, কৌশলে এবং মায়ায় সে অশোকসুন্দরীকে শেষ পর্যন্ত নিজের বাড়িতে এনে তুলল। অশোকসুন্দরী যখন বুঝলেন যে, তিনি অপহৃত হয়েছেন, তখন ক্রোধভরে অভিশাপ দিলেন–আমার স্বামীই তোকে মারবে। আরও বললেন–তোর মরার জন্য আমি তপস্যা করব। কথাটা বলেই অশোকসুন্দরী গঙ্গাস্নান করে গঙ্গার তীরে তপস্যায় বসে গেলেন আর অভিশপ্ত হয়ে হুণ্ড এসে মন্ত্রণায় বসল তার প্রধান মন্ত্রী কম্পনের সঙ্গে। সব কথা মন্ত্রীর কাছে খুলে বলতেই মন্ত্রী কম্পন বললেন-আয়ুর পুত্র নহুষকে আর জন্মাতে হবে না। হয় গর্ভিণী অবস্থায় আয়ুর স্ত্রীকে আমরা হরণ করব এবং ভয় দেখিয়ে তার গর্ভপাত ঘটাব, নয়তো নহুষ জন্মালে তাকে তুলে এনে মেরে ফেলব। মন্ত্রী দৈত্যরাজকে অভয় দিয়ে নিজের কাজে নেমে পড়ল।

অশোকসুন্দরীর জন্মকথা থেকে আরম্ভ করে হণ্ড-দৈত্যের কুমন্ত্রণা পর্যন্ত ঘটনা আমরা না বললেই পারতাম। কারণ, এ কাহিনী অর্বাচীন এবং হয়তো এসব ঘটনা ঘটেনি। অপি চ নহুষের জন্মও হয়নি এখনও, কিন্তু কাহিনীটি এই জন্যই শুধু বলতে হচ্ছে যে, পুরূরবার পুত্র আয়ু তার পুত্রজন্মের জন্য কী করেছিলেন? এ ঘটনাও মহাভারতে নেই; কিন্তু নহুষের কীর্তি-কাহিনী যেহেতু মহাভারতে বারবার বলা হয়েছে, তাই নহুষের জন্মের মধ্যে তার পিতার তপস্যাটুকু আমরা শুনে নিতে চাই। আর শুনে নিতে চাই এইজন্য যে, পিতা-মাতার হাজারো সম্ভাবনা থাকলেও পুত্রের জীবন-চর্চা কত ভিন্নতর হয়, সেটা এই কাহিনী থেকে বোঝা যাবে।

আগেই বলেছি–পুরূরবার পুত্র আয়ু ছিলেন ধর্মাত্মা। দান-যজ্ঞ, ব্রত-হোমেই তার দিন কেটে যেত। কিন্তু ধর্ম-কর্ম, রাজকার্যে অনেক ধ্যান দিয়েও তার মন ভাল থাকে না। তিনি পুত্রহীন। যাকে তিনি বিবাহ করেছেন তিনি যথেষ্টই সুলক্ষণা রমণী এবং স্বামীর উপযুক্তা সহধর্মিণী। মহাভারতে তার নাম স্বর্ভাবী। এটা ঠিক নাম নয়, এর মানে তিনি স্বর্ভানু রাজার কন্যা। পৌরাণিকেরা তাকে কেউ ইন্দুমতী বলে ডেকেছেন, কেউ বা ডেকেছেন প্রভা বলে। নাম যাই হোক, আয়ুপত্নী স্বর্ভানবীর কোলে ছেলে নেই–রাজা-রানির তাই বড় দুঃখে দিন কাটে। পুত্রলাভের জন্য নানা প্রযত্ন করেও যখন আয়ুর ছেলে হল না, সেই সময়ে একদিন তিনি দত্তাত্রেয় মুনির আশ্রমে এসে উপস্থিত হলেন।

মহর্ষি দত্তাত্রেয় অত্রির পুত্র এবং অনেক পুরাণেই তাকে ভগবানের অংশ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। সেকালের মহর্ষি-দেবর্ষিদের মধ্যে অনেক সময়েই লোকাতীত মহিমা এবং ঐশ্বর্যের সঙ্গে ইন্দ্রিয়-পরায়ণতা এবং তথাকথিত অসংযমের সংমিশ্রণ দেখা যেত। লোক-সংস্রব ত্যাগ করার জন্যই হোক অথবা স্বেচ্ছাকৃতই হোক, এই অশোভন অসংযম তাদের অন্তর বিচলিত করত না। ভারতবর্ষে সাধু-মহাত্মাদের এই লোক-জুগুঙ্গিত আচরণ অনেকভাবে দেখা যায়। যাঁর যেরকম দৃষ্টি। মহারাজ আয়ু ঘুরতে ঘুরতে মহর্ষি দত্তাত্রেয়র আশ্রমে এসে দেখলেন–তিনি স্ত্রী-পরিবৃত হয়ে বসে আছেন। তার চক্ষু দুটি মদিরারুণ। তিনি হাসছেন, গাইছেন মোদো-মাতাল লম্পটের মতো–গায়তে নৃত্যতে বিপ্রঃ সুরাঞ্চ পিবতে শম্। কাঁধে-ঝোলা যজ্ঞোপবীত খুলে পড়ে গেছে কখন, বেশ-ভূষাও মোটেই মুনিজনোচিত নয়। মহর্ষি দত্তাত্রেয়র এ কী রূপ?

 রাজা আয়ু শ্রদ্ধা হারালেন না। তিনি সমাহিতচিত্তে মুনিকে প্রণাম করলেন। মুনি রাজার সঙ্গে একটাও কথা বললেন না। সদাচার আতিথ্য সব যেন তিনি ভুলে গেছেন। দেশের রাজা এসেছেন তার কাছে–এসব কথা গ্রাহ্য না করে, তাকে অনাদর করেই যেন তিনি মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত বিলাস ছেড়ে ধ্যানমগ্ন হলেন। রাজা কোনও কথা বলারই সুযোগ পেলেন না। রাজা বহুদিন সেই আশ্রমে বসে থাকলেন- কবে মুনির ধ্যান ভাঙবে সেই আশায়। বসেই রইলেন, বসেই রইলেন, মুনি তবু নির্বিকারচিত্ত, ধ্যানমগ্ন। বহুদিন পর দত্তাত্রেয় মুনির বাহ্যজ্ঞান ফিরে এল। তখনও রাজা তার আশ্রমে বসে আছেন দেখে মুনি বললেন–মহারাজ! আপনি কেন এত কষ্ট করছেন? ব্রাহ্মণের আচার আমি কিছুই পালন করি না। নারী-সঙ্গ, সুরাপান এবং মাংস-ভক্ষণ আমার অন্তরঙ্গ বিলাস। আপনাকে কোনও বর দেওয়ার শক্তিও আমার নেই। আপনি বরং উপযুক্ত অন্য কোনও মহৎ ব্রাহ্মণের শুশ্রূষা করুন–বরদানে ন মে শক্তিরন্যং শুশ্রূষ ব্রাহ্মণ।

 আয়ু বললেন–মুনিবর! আপনার থেকে শ্রেষ্ঠতর কোনও ব্রাহ্মণ আমার জানা নেই। আপনাকে সাক্ষাৎ ভগবান বলে আমি মনে করি। দত্তাত্রেয় রাজার কথায় একটুও বিচলিত না হয়ে বললেন–তাহলে আমার কথা শোন–যে আমার এই নর-কপালের পাত্রে মদ এনে দাও, আর রান্না-করা মাংস নিয়ে এসো আমার জন্য–কপালে মে সুরাং দেহি পাচিতং মাংসভোজন। রাজা অসীম শ্রদ্ধায় কালবিলম্ব না করে মুনিকে সুরা-মাংস এনে দিলেন। দত্তাত্রেয় ভেবেছিলেন–অনাচার-কু-আচার করতে দেখলেই রাজার ভক্তি নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু স্থিরচিত্ত আয়ু সব কাজ সমাধা করলেন দ্বিধাহীনভাবে, সশ্রদ্ধে।

দত্তাত্রেয় খুশি হলেন এবার। বললেন–বর চাও, রাজা! তোমার যা মনে চায়, বলো। রাজা বললেন–আমার একটি পুত্র চাই, মুনিবর! সর্বজ্ঞ সর্বগুণান্বিত দেব-দানবের অজেয় একটি পুত্র চাই-পুত্রং দেহি গুণেপেতং সর্বজ্ঞং গুণসংযুত। মুনি রাজরানি ইন্দুমতাঁকে দেবার জন্য রাজার হাতে একটি ফল দিলেন আর বললেন–যেমন চেয়েছ, সেইরকম অমিত শক্তিধর পুত্র লাভ করবে তুমি। সে হবে ইন্দ্রের তুল্য সার্বভৌম রাজা।

মহারাজ আয়ু রাজপ্রাসাদে এসে মুনিদত্ত ফল খেতে দিলেন ইন্দুমতাঁকে। সময়ে তিনি গর্ভ ধারণ করলেন। পদ্মপুরাণের উপাখ্যানে এরপর রীতিমতো হিন্দি সিনেমার ‘প্লট’আছে। নহুষের জন্ম হল ইন্দুমতীর গর্ভে। হুণ্ড-দৈত্যের নিজের মেয়ে ইন্দুমতীর বাড়ির চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে মহর্ষি দত্তাত্রেয়র আর্শীবাদ এবং ইন্দুমতীর গর্ভধারণের খবর শুনতে পেল। হুণ্ড নিজপুত্রীর মুখে ইন্দুমতীর গর্ভসঞ্চারের খবর শুনে বিশ্বস্ত লোক পাঠালেন গর্ভ নষ্ট করার জন্য। কিন্তু বহুঙ্কাল। পুত্রহীন অবস্থায় থেকে পরিণত বয়সে পুত্রের সম্ভাবনা হলে পিতা-মাতা গর্ভ রক্ষায় যে যত্ন নেন, আয়ুও রাজবাড়িতে ইন্দুমতীর গর্ভরক্ষার কারণে তেমনই নিবিড় সুরক্ষা-ব্যবস্থা চালু করলেন। হুণ্ডের চক্রান্ত ব্যর্থ হল–বিফলো দানবো জাত উদ্যমশ্চ নিরর্থক।

ইন্দুমতী রাত্রিকালে পুত্র প্রসব করলেন। শুভলক্ষণ পুত্র জন্মাল বটে, কিন্তু ছিদ্রান্বেষী দৈত্য তালে তালেই ছিল। কিছুদিনের মধ্যেই মঙ্গল-উচ্চারণকারিণী এক দুষ্ট দাসীর মাধ্যমে হও-দৈত্য আয়ু-ইন্দুমতীর শিশুপুত্রটিকে হরণ করে নিয়ে এল। রাজবাড়িতে এনে হুণ্ড তার স্ত্রী বিপুলাকে বলল–এই শিশুটি আমার শত্রু। রাধুনে ঠাকুরকে বলো–এই বাচ্চাটিকে কেটে রান্না করে আমাকে পরিবেশন করতে। সুন্দর ছোট্ট শিশুটিকে দেখে দৈত্যরানি বিপুলার প্রথমে বেশ মায়াই হল। স্বামীকে সে একবার বললও- সে কী মহারাজ? এই দুধের বাছাকে চিবিয়ে খাবার ইচ্ছে হল কেন তোমার–পুনঃ পপ্ৰচ্ছ ভর্তারং কস্মাত্ ভক্ষসি বালক? পরে যখন সে। শুনল যে, এই শিশুপুত্রের মৃত্যু না হলে তার স্বামীর মৃত্যু অনিবার্য, তখন সে গিয়ে তার চুল-বাঁধার দাসী মেলাকে বলল-যা গিয়ে এই বাচ্চাটিকে দিয়ে আয় রাঁধুনে ঠাকুরের হাতে। একে কেটে সে যেন রান্না করে নিয়ে আসে, মহারাজ খাবেন–হুণ্ডভোজনহেতবে।

 সৈরিন্ধ্রী মেকলা পাঁচকের হাতে শিশুপুত্র দিয়ে রাজাদেশ জানাল। পাঁচক কঠিন নিষ্ঠুর মানুষ, রাজার ভোজনের জন্য সে বহু প্রাণী জবাই করেছে নিজের হাতে। আয়ুপুত্র ছোট্ট শিশুটিকে কাটার জন্যও সে খঙ্গ উঠিয়েছিল। কিন্তু খঙ্গ উঁচু করতেই নিরীহ অবোধ শিশুর মুখে ভেসে উঠল মধুর এক ঝলক হাসি। শিশুর মুখে মিষ্টি হাসি দেখে পাঁচক-ঠাকুরের মন একেবারে গলে গেল। পাশে দাঁড়িয়ে ছিল সৈরিন্ধ্রী মেলা। সুন্দর, অসাধারণ সুন্দর আয়ুপুত্রের শিশু-মুখখানিতে ফুটফুটে অবোধ হাসিরভেচ্ছতা দেখে মেকলা-সৈরিষ্ক্রীর মন বিচলিত হল। সে পাঁচককে সাবেগে অনুরোধ জানাবাচ্চাটাকে মেরো না, ঠাকুর। না জানি এমন দিব্যলক্ষণসম্পন্ন ছেলে কার ঘরে জন্মেছে

পাঁচক সৈরিন্ধ্রী মেলার কথা শুনল এবং দুজনেই মায়াপরবশ হয়ে আয়ুর শিশুপুত্রটিকে রক্ষা করল সযত্নে। রাত্রি আঁধার হয়ে এল। হুণ্ড-দৈত্য রাতের খাবার খাবে। পাঁচক-ঠাকুর নিজে হাতে একটি হরিণ মেরে নিয়ে এল। সেই হরিণের মাংস রান্না করে হৃত শিশুর মাংস বলে হু-দৈত্যকে খেতে দিল। এদিকে রাজ-অন্তঃপুরের সৈরিন্ধ্রী মেকলা শিশুটিকে কোলে। নিয়ে রাতের অন্ধকারে পথ চলতে চলতে বশিষ্ঠ মুনির আশ্রমে পৌঁছল। সমস্ত আশ্রম তখন শান্ত সুপ্ত। মেলা বশিষ্ঠ-মুনির কুটীর-দ্বারে শিশুটিকে শুইয়ে দিয়ে চলে এল নিজের বাড়িতে।

হরিণের মাংস খেয়ে হুণ্ড ভাবল নহুষকে সে খেয়ে ফেলেছে। অন্যদিকে বশিষ্ঠ মুনি কুটীর-দ্বারে পরিত্যক্ত নহুষকে পরম আদরে তুলে নিলেন মানুষ করার জন্য। তিনি ধ্যানযোগে জানতে পারলেন মহাত্মা আয়ুর পুত্র তাঁর আশ্রমে পরিত্যক্ত হয়েছেন। তিনিই আয়ুর শিশু-পুত্রের নাম রাখলেন নহুষ। তিনি বলেছিলেন–বালক অবস্থাতেও তোমাকে, হুষিত করা যায়নি অর্থাৎ পরাভূত করা যায়নি বলেই তোমার নাম হল নহুষ হুষিতে নৈব কেনাপি বালভাবৈ নরাধিপ। বশিষ্ঠ মুনির আশ্রমে মানুষ হতে থাকলেন আয়ুপুত্ৰ নহুষ। শুধু বেদবিদ্যাই নয়, অন্য সমস্ত শাস্ত্র এবং অস্ত্র-শস্ত্রের সমস্ত কৌশল শিখে নহুষ অদ্বিতীয় ধনুর্ধর হয়ে উঠলেন।

যেদিন আয়ুর বাড়ি থেকে নহুষ হারিয়ে গেলেন, সেদিন থেকেই নহুষের মা ইন্দুমতীর দিন আর কাটে না। এতদিন তিনি পুত্রহীনা ছিলেন, সেও এক রকম ছিল। কিন্তু পুত্ৰমুখ দেখার পর সে পুত্র হারিয়ে গেলে কোন জননী সইতে পারেন? রানি চোখের জল রাখতে পারেন না। দিন-রাত তিনি শুধু কাঁদেন আর ভাবেন কবে তাঁর ছেলে ফিরে আসবে। ওদিকে নহুষ মানুষ হচ্ছেন বশিষ্ঠের বাড়িতে। বঙ্কাল পরে ইন্দুমতীর ঘরে এসে উপস্থিত হলেন দেবর্ষি নারদ। সেকালের দিনে সংবাদ পাওয়ার সবচেয়ে বড় উৎস ছিলেন মুনি-ঋষিরাই। তারা যজ্ঞ-দান উপলক্ষে অন্য মুনি-ঋষিদের আশ্রমে যেতেন, আর যেতেন ভারতবর্ষের নানা তীর্থক্ষেত্রে। সংবাদ জোগাড় হয়ে যেত স্বাভাবিক ভাবেই। নারদ এসে ইন্দুমতাঁকে বললেন–তার ছেলে বশিষ্ঠের বাড়িতে মানুষ হচ্ছে। তার জন্য কোনও চিন্তা নেই। নারদ আস্তে আস্তে অশোকসুন্দরীর প্রাণান্তক তপস্যার কথা, হুণ্ড-দৈত্যের চক্রান্ত এবং নহুষের শক্তিধর হয়ে ওঠার সমস্ত বিবরণ দিলেন ইন্দুমতাঁকে। তিনি আশ্বস্ত হলেন এই ভেবে যে, তার প্রিয় পূত্রটি আবার ফিরে আসবে–আগমিষ্যমাজ্ঞায় নহুষং তনয়ং পুনঃ।

নহুষ বশিষ্ঠের আশ্রমে অস্ত্রশিক্ষা এবং বিদ্যাশিক্ষায় দিন কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না যে, তিনি চন্দ্রবংশীয় মহারাজ আয়ুর পুত্র এবং ইন্দুমতী তার জননী। একদিন বশিষ্ঠ নহুষকে আদেশ দিলেন-বাছা। বনে যাও তো একবার। ফলমূল যা পাও নিয়ে এসো। নহুষ গেলেন বনে। সেখানে গিয়ে তিনি শুনতে পেলেন–কারা যেন বলছে–এই নহুষ হলেন আয়ুর ছেলে। এই ছেলের জন্য কেঁদে কেঁদে মরছেন এর জননী ইন্দুমতী। শিবসুতা অশোকসুন্দরী তপস্যা করছেন এই নহুষের জন্যই। সব শুনে নহুষ ফলমূল নিয়ে উপস্থিত হলেন বশিষ্ঠের আশ্রমে এবং সত্য যাচাই করে নিলেন মুনির কাছে। মুনি প্রথম থেকে সমস্ত বৃত্তান্ত জানালেন নহষকে এবং তাকে প্ররোচিত করলেন- হুণ্ড-দৈত্যকে বধ করে তপস্বিনী অশোকসুন্দরীকে উদ্ধার করার জন্য।

নহুষ ইন্দ্রদত্ত রথে চড়ে রওনা দিলেন কার্যসিদ্ধির জন্য। অশোকসুন্দরীর সঙ্গেই তার প্রথম দেখা হল। তারপর হুশু-দৈত্যকে হত্যা করে নহুষ অশোকসুন্দরীকে সঙ্গে নিয়ে বশিষ্ঠের আশ্রমে এলেন। সেই আশ্রমেই বিধিমতো তাদের বিয়ে-থা হয়ে গেল। নহুষ এবার নব বিবাহিতা বধুকে নিয়ে পৌঁছলেন বাবা-মায়ের কাছে। মহারাজ আয়ু এবং ইন্দুমতীর আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ পেল স্নেহে, মানে, দানে। বীর পুত্রের সাহায্যে আয়ু তার পিতৃদত্ত রাজ্য আরও সুদৃঢ় করে নিলেন। বয়স পরিপক্ক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দান-যজ্ঞ, ব্ৰত-নিয়মেই আয়ুর দিন কাটতে লাগল। তারপর যখন মৃত্যু ঘনিয়ে এল আয়ু-ইন্দুমতীর জীবনে, তখন চন্দ্রবংশের অধস্তন নহুষই রাজা হলেন।

 আরও একবার জানাই, নহুষের জন্মলগ্নেই লৌকিক-অলৌকিক নানা ঘটনার এই বিচিত্র উপন্যাস মহাভারতে নেই। বরং মহাভারতে চন্দ্রবংশের অধস্তন হিসেবে নহুষই বোধহয় প্রথম ব্যক্তিত্ব, যার মধ্যে চন্দ্র কিংবা বুধের দেব-ধর্ম নেই, অতিলৌকিক জগতের সঙ্গে পুরূরবার যে মিলন-সাংকর্য, তাও নেই। ঐল পুরূরবার পুত্র আয়ু ধর্মাত্মা পুরুষ নির্বিরোধী ব্যক্তিত্ব। রাজা হিসেবে তিনি বিরাট কিছু ছিলেনও না। কিন্তু নহুষ পরম বিক্রান্ত রাজা। এমন একজন রাজার জন্ম-বৃত্তান্ত একেবারে সামান্য এবং লঘু-জনোচিত হবে– এ কথা পুরাণকারেরা ভাল করে মানতে পারেননি। নহুষের খ্যাতি এবং প্রতিপত্তির নিরিখে আমরাও পৌরাণিকদের বৃত্তান্ত এখানে লিপিবদ্ধ করলাম এবং তা করলাম এইজন্যে যে, এরমধ্যে নহুষের জন্মের মাহাত্মের থেকেও ঐল পুরূরবার পুত্র আয়ুর সন্তানের তপস্যাটাই মূল্যবান। কৃতী সন্তানের জনক হিসেবে আয়ু যে মোটেই কোনও অধমাধম ব্যক্তিত্ব নন, সেটা বোঝনোর জন্যই এই নহষ-কাহিনীর অবতারণা।

.

২৬.

 ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির তখন ভাইদের সঙ্গে বিশাখ-যুপ নামে একটি বনে বাস করছেন। এই কিছুদিন আগে অর্জুন মহাদেবকে তুষ্ট করে পাশুপত অস্ত্র নিয়ে, ইন্দ্র-ভবন ঘুরে বাড়ি ফিরেছেন। সবার মনে তাই ভারি খুশি খুশি ভাব। মধ্যম পাণ্ডব ভীম তো আনন্দে শিকার করতেহবেরিয়ে পড়েছেন। সুস্থ এবং স্বাস্থ্য-সমুজ্জ্বল উদ্দাম বালকের মধ্যে যে অফুরন্ত প্রাণশক্তি থাকে, সেই প্রাণশক্তিই দুষ্টুমির আকার নেয়। সেই দুষ্টুমি যেমন কোনওভাবেই বালক চেপে রাখতে পারে। না, ভীমের অতিলৌকিক শক্তিও তেমনই তাকে কিছুতেই চুপ করে বসে থাকতে দেয় না। তিনি এ বনে-সে বনে হরিণ-বরাহ মেরে, গাছ উপড়ে, ডাল ভেঙে সমস্ত বনভূমি যেন তোলপাড় করে তুললেন। হিমালয় সন্নিহিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যুধিষ্ঠিরকে যেখানে আরও নিবিষ্ট করে রেখেছে, সেখানে ওই একই সৌন্দর্য ভীমকে আরও পাগল করে তুলেছে। বৃক্ষভঙ্গ, পশুমারণের সঙ্গে সঙ্গে তার কখনও দৌড়ানো, কখনও দাঁড়ানো, কখনও হাততালি কখনও বা বিনা কারণে গর্জনও চলছে-চিৎ প্ৰধাবংস্তিষ্ঠংশ্চ কুচিচোপবিশংস্তথা।

বনের পথে চলতে চলতে ভীম মহাবনে এসে পৌঁছলেন। সেখানে গুহার মধ্যে দেখলেন এক বিশাল অজগর সাপ। বিশাল তার শরীর, বিচিত্রবর্ণ, মুখখানা বড় এবং তামাটে। ক্ষণিকের মধ্যে সেই অজগর ভীমকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। ভীমের নড়বার শক্তিও রইল না। ভীম নিজের অসহায়তায় নিজেই অবাক হলেন। মহাসর্পকে বললেন–আপনি কোনও দেবতার বরলাভ করেছেন, নাকি কোনও বিদ্যা জানা আছে আপনার কিছু বিদ্যাবলং কিছু বরদানমথো তব? নইলে রাক্ষস, পিশাচ, নাগ–কেউই আমার শক্তি সহ্য করতে পারে না। সেখানে আমি চেষ্টা করেও আপনাকে কিছুই করতে পারছি না।

সর্প বলল– ভাগ্যবশে আজ তুমি আমার আহার নির্দিষ্ট হয়েছ। তবে সত্যিই আমি আসলে কোনও সাপ নই। ব্রাহ্মণের অভিশাপে আজ আমার এই অবস্থা। এবারে ভীমকে সম্পূর্ণ অবাক করে দিয়ে অজগর মনুষ্যকণ্ঠে বলল- আমি তোমারই পূর্বপুরুষ। রাজর্ষি নহুষের নাম তোমার কানে এসে থাকবে। আমি তোমার বহু পূর্বপুরুষ আয়ুর পুত্র নহুষ–তবৈব পূর্বঃ সর্বেষামায়োর্বংশধরঃ সুতঃ।

ভীম এই মহাসর্পের হাত থেকে মুক্তি পাননি এবং জীবন সম্বন্ধে এই সময়ে তার মুখ দিয়ে রীতিমতো দার্শনিক কথাবার্তা বেরিয়েছে। ভীম ফিরছেন না দেখে যুধিষ্ঠিরকে ওই সর্পগুহায় উপস্থিত হতে হয়েছিল। রক্ষার উপায়-চেষ্টাহীন ভীমকে সর্পবেষ্টিত অবস্থায় দেখে যুধিষ্ঠিরের মনেও ওই একই প্রশ্ন উদয় হল–আপনি কি দেবতা, দৈত্য, নাকি সত্যিই এক মহাসর্প? অজগরের দিক থেকে আবারও সেই একই উত্তর–আমি ষ। তোমারই পূর্বপুরুষ। ভগবান চন্দ্র থেকে পঞ্চম পুরুষ আমি নহুষ, আয়ুর পুত্র–প্রথিতঃ পঞ্চমঃ সোমাদার্টেঃ পুত্রো নরাধিপ। যজ্ঞ, দান, তপস্যা এবং আপন বিক্রমে এই তিন ভুবনের অধিকার লাভ করেছিলাম। তারপর ব্রাহ্মণের অভিশাপে আমার এই অবস্থা। তবে সাপই হই, আর যাই হই, আমার মাথাটা কিন্তু ঠিক আছে। পূর্বের স্মৃতি আমার কিছু নষ্ট হয়নি।

যুধিষ্ঠির বেশি বিস্তারের মধ্যে যাননি। কবে, কোথায়, কেন–এ সব প্রশ্নে তার অভীষ্টসিদ্ধিতে বড় দেরি হয়ে যাবে। সর্প তার সর্পত্বের কারণ বলেছে সংক্ষেপে। যুধিষ্ঠির আর কিছু শুনতে চান না। প্রিয় ভাইটিকে তার বাঁচাতে হবে এবং বাঁচানোর উপায় একটিই। সর্প বলেছে– যদি আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পার তবেই তোমার ভাই মুক্তি পাবে আমার হাত থেকে। যুধিষ্ঠির কালবিলম্ব না করে বলেছেন– রূহি সর্প–আপনি বলুন। চেষ্টা করে দেখি, যদি আপনার প্রীতি হয় তাতে অপি চেয়াং প্রতিমাহর্তুং তে ভুজঙ্গম।

কিন্তু এই মহাসর্পের প্রশ্ন বড় অদ্ভুত। তার জিজ্ঞাসা- ব্রাহ্মণ কাকে বলে? যুধিষ্ঠির যখন পূর্বে ইন্দ্রপ্রস্থে রাজত্ব করেছেন অথবা এখন যে বনবাসে আছেন অথবা তার জন্ম থেকে এই বনবাসের বয়স পর্যন্ত তিনি কম ব্রাহ্মণ দেখেননি। ব্রাহ্মণের চরিত্র, গুণ এবং হৃদয় কেমন হবে, সে সম্বন্ধে তার শাস্ত্রীয় এবং ব্যবহারিক জ্ঞানও কিছু কম নেই। এখানে লক্ষণীয় বিষয় আছে আরও দুটি। যিনি প্রশ্ন করেছেন ব্রাহ্মণ কাকে বলে–ব্রাহ্মণঃ কো ভাবে রাজন্–তিনি পূর্বসংস্কারে চন্দ্রবংশীয় রাজা হলেও এখন নাগ-জনজাতির একতম পুরুষ প্রায় শূদ্রসংজ্ঞক। যাকে তিনি প্রশ্ন করছেন তিনি আগে রাজা ছিলেন এবং এখন তিনি বনবাসের যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট। উপরন্তু এখন তার নাচার অবস্থা। তার ভাইকে এই মহাস আটকে রেখেছে। ভাইয়ের মুক্তিপণ এই প্রশ্ন–ব্রাহ্মণ কাকে বলে আগে বলুন।

একজন রাজা হিসেবে যুধিষ্ঠিরের সবচেয়ে বেশি সংস্রব ঘটেছে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে। জাতি হিসেবে ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয় একে অন্যতরের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ জাতি। ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়ের চেয়ে উচ্চবর্ণ বটে, কিন্তু মহাভারতের সময়ের রাজনীতি এবং সমাজের রীতিতে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের সব সময় ওঠা-বসা, বিবাহ, একে অপরের বৃত্তি গ্রহণ–সবই চলে। অতএব অন্য সময়ে যদি যুধিষ্ঠিরের কাছে এই প্রশ্ন আসত তবে ব্রাহ্মণমাত্রেরই প্রশংসা বেরুত তার মুখ দিয়ে। কিন্তু এখন তাঁর সময় ভাল নয়। তার ভাই অসীম বলশালী বৃকোদর এই মহাসর্পের আক্রমণে নিষ্ক্রিয়। তাঁকে বাঁচাতে হবে–অতএব তার অভিজ্ঞতায় এবং মননে সবচেয়ে নিরপেক্ষ উত্তরটি এই সময়েই বেরিয়ে আসবে।

আজকের দিনে সাধারণ সময়ে একজন মন্ত্রীর সচিবের মুখে মন্ত্রীর সম্বন্ধে কোনও নিন্দাবাক্য শুনবেন না। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তিনি যদি বিপদে পড়েন, তার যদি আত্মরক্ষা বা পরিবার-রক্ষার তাগিদ বড় হয়ে ওঠে, তখন তার মুখে তারই বিভাগীয় মন্ত্রী সম্বন্ধে নিরপেক্ষ মন্তব্য শুনতে পাবেন। এখানেও সেই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। চন্দ্রবংশের মহান রাজা নহুষ সর্প হবার অভিশাপ লাভ করেছেন নিজের দোষে ব্রাহ্মণদের চটিয়ে। সে দোষ তিনি স্বীকারও করেন। কিন্তু কী এমন ঘটল, যাতে চিরকাল এই লোক-জুগুতি অবনমন বয়ে বেড়াতে হবে। তাকে? যিনি প্রশ্ন করছেন, তিনি সোমবংশের পঞ্চম পুরুষ লুপ্তস্মৃতি পূর্বের নহুষই কিনা, সেকথা পরে। কিন্তু তিনি নিজে রাজা থাকার সময়ে ব্রাহ্মণদের কম লক্ষ্য করেননি এবং এখন অভিশপ্ত নাগ হয়েও তার সততা এবং চরিত্রগুণ হয়তো ব্রাহ্মণের চেয়ে কিছু কম নয়। অতএব তিনি যুধিষ্ঠিরের কাছে ব্রাহ্মণত্বের সংজ্ঞা জানতে চাইছেন। অবশ্য তার আগে আয়ুপুত্র নহুষ কী ছিলেন এবং কেনই বা এই অবস্থায় পতিত–সেটা আমাদের জেনে নিতে হবে।

মহাভারতের বিবরণ অনুযায়ী আয়ু এবং স্বৰ্তানবীর প্রথম পুত্ৰ নহুষই বটে, কিন্তু তিনিই একমাত্র পুত্র নন। নহুষের পরে আয়ুর আরও চারটি পুত্রের নাম আমরা মহাভারতে পাই। তাঁরা হলেন-বৃদ্ধশর্মা, রজি, গয় এবং অনেনা- স্বর্ভানবীসুতানেতা আয়োঃ পুত্ৰা প্ৰচক্ষতে। পুরাণগুলিতে নহুষ, রজি এবং অনেনার নাম নিয়ে কোনও গন্ডগোল নেই, কিন্তু বৃদ্ধশর্মা কোথাও ক্ষত্ৰবৃদ্ধ হয়েছেন, এবং গয় হয়েছেন রম্ভ। রম্ভের কোনও পুত্র-সন্তান ছিল না। অনেনা এবং ক্ষত্রবৃদ্ধের বংশে বহু বিখ্যাত রাজা আছে মহা-মহা ঋষিও আছেন। আপাতত সেই বংশপরম্পরায় আমরা যাচ্ছি না। নহুষের কনিষ্ঠ রজিও পরম বিখ্যাত রাজা ছিলেন। দেবতা-অসুরদের যুদ্ধে তিনি কোন পক্ষে থাকবেন– এই নিয়ে এক সময়ে দুপক্ষেরই চরম দুর্ভাবনা গেছে। আমরা সেই উপাখ্যানের মধেও যাচ্ছি না। আমরা নহুষের জন্ম-বৃত্তান্ত পুরাণ থেকে সংগ্রহ করে পূর্বেই উপস্থাপিত করেছি। এখন দেখতে হবে তার রাজত্ব বিপন্ন হল কী করে?

পূর্বোক্ত পুরাণের ঘটনা যদি সঠিক হয়, তবে নহুষের রাজপদ লাভ করতে কিছু দেরি হয়ে থাকতে পারে। নহুষের অন্য ভাইদের মধ্যে অতি বিখ্যাত রজি এবং তার পুত্রেরা (যারা রাজেয় বলে খ্যাত) হয়তো অন্য কোথাও রাজত্ব করতেন। কিন্তু নহুষ পিতার রাজ্যেই অভিষিক্ত হয়েছিলেন। তবে নহুষের জীবনে তার পিতৃদত্ত রাজ্যের অধিকার খুব বড় কথা নয়। বড় কথা হল-তাকে স্বর্গ রাজ্যের রাজা করা হয়েছিল। তিনি ইন্দ্রপদ লাভ করেছিলেন এবং তা করেছিলেন কোনও যুদ্ধ-বিগ্রহ, রক্তপাত না ঘটিয়ে। তাকে ইন্দ্ৰত্বে বরণ করা হয়েছিল। মহাভারতের কবি যেখানে প্রথম নহুষের প্রসঙ্গ অবতারণা করেছেন, সেখানে বলেছেন আয়ুর পুত্র নহুষ ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং তার প্রধান পরাক্রম ছিল তার সত্যনিষ্ঠা। নহুষ তার রাজকীয় বীরত্ব, ধর্মবুদ্ধি এবং সত্যনিষ্ঠার পরাক্রমেই এক বিশাল ভূমিখভ শাসন করতেন রাজ্যং শোস সুমহন্দু ধর্মেণ পৃথিবীতে। পরবর্তী সময়ে নহুষ নিজেও যুধিষ্ঠিরকে জানিয়েছেন–যজ্ঞ, তপস্যা এবং দৈনন্দিন ব্রাহ্ম সংস্কার বেদপাঠ আমার জীবনের অঙ্গ ছিল। আদর্শ রাজার পক্ষে ইন্দ্রিয় নিগ্রহের যতখানি প্রয়োজনীয়তার কথা পন্ডিতেরা বলেন, সেই ইন্দ্রিয়-নিগ্রহের বৃত্তি আমার স্বাভাবিক ছিল–তুভিস্তপসা চৈব স্বাধ্যায়েন দমেন চ।

এই সমস্ত সদগুণ এবং জিতেন্দ্রিয়তার কারণেই হয়তো নহুষের ডাক পড়েছিল স্বর্গরাজ্যে ইন্দ্ৰত্ব করার জন্য। স্বর্গের দেবতাদের ওপর রাজত্ব করার আহ্বান মত্যভূমির রাজার কাছে সাধারণত আসে না, কিন্তু নহুষের অতিলৌকিক চরিত্রগুণেই হয়তো সেই আহ্বান নেমে এসেছিল নহুষের কাছে। স্বর্গরাজ্যে তখন এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে, স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র পর্যন্ত তাঁর প্রিয় দেবভূমি শাসনের যোগ্যতা হারিয়েছিলেন; কিন্তু নহুষের মধ্যে সেই যোগ্যতা দেখতে পাওয়া গিয়েছিল, যার জন্য তাকে বরণ করা হয়েছিল স্বর্গের রাজতে।

ইন্দ্রের চিরশত্রু বৃত্রাসুর তখন সবে মারা গেছেন। কিন্তু বৃহত্যার মধ্যে এমন কিছু অন্যায় ছিল, যাতে ইন্দ্রের মনে মিথ্যাচারের অনুতাপ ছিল– অনৃতেনাভিভূতো’ভুচ্ছঃ পরমদুর্মনাঃ। শুধু এই মিথ্যাচারই নয়, পূর্বকৃত অন্যায় আরও কিছু ছিল, যা দিন দিন ইন্দ্রের মনঃপীড়া বাড়িয়ে তুলল। তিনি স্বর্গ ছেড়ে পালিয়ে গেলেন জগতের সীমার প্রান্তে, বাস করতে থাকলেন। জলের মধ্যে সাপের মতো–প্রতিচ্ছমো’ বসচ্চাঙ্গু চেষ্টমান ইবোরগঃ।

উপমাটা খেয়াল করলেন নিশ্চয়–দেবলোক থেকে পতিত হয়ে ইন্দ্র বাস করছেন জলে, সাপের মতো। উপমাটা পরে আমাদের কাজে লাগবে স্বয়ং নহুষের পরিচয় বোঝানোনার জন্য। ইন্দ্রের পলায়নে দেবরাজ্যে অরাজকতা দেখা দিল। অন্যান্য দেবতারা, মহর্ষিরা রীতিমতো ভয়ে ভয়ে দিন কাটাতে লাগলেন–দেবাশ্চাপি ভূশং এস্তাস্তথা সর্বে মহর্ষয়ঃ। বেশিদিন তো এইভাবে চলতে পারে না। নেতা না থাকার ফলে সবই বিশৃঙ্খল হয়ে গেছে। স্বর্গভূমি বিধ্বস্ত, বনভূমি শুষ্ক, নদীর স্রোত রুদ্ধ। রাজা না থাকলে প্রকৃতির রাজ্যে এই বিপর্যয় বিশ্বাস্য নয়, কিন্তু সেকালের দিনে অরাজক অবস্থা হলেই কবিরা এইরকম বর্ণনা দিতেন। ভূমিবিধ্বস্তসঙ্কাশা। নিবৃক্ষা শুষ্ককানো। এই বর্ণনার কারণ একটাই। রাজা থাকলে রাজকার্য এমনভাবেই স্তব্ধ হয়ে যায় যেন মনে হয় পৃথিবীর সমস্ত প্রয়োজনীয় স্ফূরণই যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। কবিরা আসলে প্রকৃতির স্তব্ধতা বর্ণনা করে জীবনের স্বাভাবিক স্ফুরণগুলির স্তব্ধতা নির্দেশ করেন।

 স্বর্গরাজ্যে রাজার অভাবে সর্বত্র যে বিপর্যয় দেখা দিল, সেই বিপর্যয়, মাথায় নিয়েই এক জরুরি সভায় আলোচনায় বসলেন ঋষিরা, অন্য দেবতারা, স্বর্গপতি দেবোপম ব্যক্তিরা। প্রথম শ্রেণীর দেবতাদের মধ্যে যম, বরুণ, সূর্য-কেউই স্বর্গের রাজা হওয়ার ইচ্ছা বা চেষ্টা কোনওটাই করলেন না– ন স্ম কশ্চন দেবানাং রাজ্যে বৈ কুরুতে মতি। দেবতারা, ঋষিরা সবাই মিলে ঠিক করলেন–স্বর্গের আধিপত্যে বরণ করা হোক মর্ত্যভূমির রাজা নহুষকে। তাঁর গৃহে রাজলক্ষ্মীর চিরাবাস। তিনি নিজে পরম ধার্মিকই শুধু নন, তিনি যেমন তেজস্বী, তেমনই যশস্বী। অতএব নহুষকেই বলা হোক স্বর্গরাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করার জন্য–অয়ং বৈ নহুষঃ শ্রীমান্ স্বর্গরাজ্যেভিষিচ্যতাম্।

দেবতারা, ঋষিরা সবাই মিলে নহুষের কাছে এলেন। বললেন– স্বর্গরাজ্য ছারখার হয়ে গেল। আপনি আমাদের রাজা হোন-রাজা নো ভব পার্থিব। নহুষ বিনীতভাবে বললেন–তাই কি হয়? আমি এই মত্যভূমির রাজা। আমার মধ্যে সেই শক্তি নেই যাতে স্বর্গের দেবতা এবং দেবর্ষিদের প্রতিপালন করতে পারি– দুর্বলোহং ন মে শক্তি ভবতাং পরিপালনে।ইন্দ্রের সেই শক্তি ছিল, তিনি পেরেছেন। কিন্তু তিনি যা পারেন, আমি কি তাই পারি? উপযাচক ঋষি-দেবতারা বললেন–আমাদের তপস্যার শক্তি আপনাকে দেব, রাজা! দেবতারা তাদের দৈবশক্তি দিয়ে উদ্বুদ্ধ করবেন আপনাকে। সবার তেজে তেজীয়ান হয়ে আপনি স্বর্গরাজ্যের রাজা হয়ে বসুন। আপনার কোনও ভয় নেই–পাহি রাজ্যং ত্রিপিষ্টপে।

আসলে এও এক ধরনের নির্বাচন-প্রক্রিয়া। গণতন্ত্রে একজন সংসদ সদস্য যেমন একটি নির্দিষ্ট এলাকার জনগণের শক্তিতে নির্বাচন হন, আবার নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শক্তি হাতে নিয়ে যেমন একজন মুখ্য নেতার নির্বাচন হয়, নহুষের ক্ষেত্রেও তাই হল। সবাই বললেন–দেবতা, দানব, গন্ধর্ব, যক্ষ, রাক্ষস, ঋষি, সিদ্ধ, সাধ্য এবং সমস্ত প্রাণীর তেজ আপনার মধ্যে সঞ্চারিত হবে। আপনি সেই তেজে তেজীয়ান হয়ে ধর্ম-সম্মতভাবে এই জগৎকে রক্ষা করুন। রক্ষা করুন দেবতাদের। রক্ষা করুন ঋষিদের–ধর্মং পুরস্কৃত্য সদা সর্বলোকাধিপো ভব।

সকলের মিলিত প্রার্থনায় নহুষ স্বর্গরাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করতে স্বীকৃত হলেন। মর্ত্য ভূমির অধিকার তো তার থাকলই। এবার তিনি দেবতা, রাক্ষস-সবার তেজে বলীয়ান হয়ে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল-তিন ভুবনের প্রতিপালক হলেন। ভালই চলছিল। যজ্ঞ-দান, তপো হোম, স্বাধ্যায় এবং সর্বোপরি তার নিজের পরাক্রমে সমস্ত লোক তার বশীভূত হল। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, দেবতা, রাক্ষস, গন্ধর্ব–সবাই তার প্রজা

পিতৃন্ দেবাষীন্ বিন্ গন্ধর্বোরগরাক্ষন্।
নহুষঃ পালয়ামাস ব্ৰহ্মক্ষমথো বিশঃ।

তিন ভূবনের অধিপতি নহুষের শত্রুও কিছু কম ছিল না। অবশ্য তাদের জয় করতে কোনও বেগ পেতে হয়নি নহুষকে। সমস্ত রাজ্য যখন নিরুপদ্রব, নিষ্কন্টক–তখনই সেই দুর্ঘটনাটা ঘটল। গণতন্ত্রের নির্বাচিত সংসদ-সদস্য মন্ত্রীদের যেমন ঘটে, তেমনটাই ঘটল নহুষের বেলায়। অধিকাংশ জনগণের নির্বাচনে শক্তি বৃদ্ধি ঘটার পর সংসদ সদস্য অথবা মন্ত্রীদের যেমন আর। মানুষের সঙ্গে যোগ থাকে না, অথবা জনগণের প্রতি তাদের নিজস্ব কর্তব্যের কথাও মনে থাকে না, এখানেও তাই ঘটল।

৩) নহুষের জীবনে বিলাসিতা আসল। ধর্ম-কর্ম, স্বাধ্যয় মাথায় উঠল। দিন রাত তিনি শুধু বিলাস-ব্যসনে দিন কাটান। স্বর্গসুন্দরী অপ্সরাদের চারপাশে নিয়ে অরোভিঃ পরিবৃতঃ দেবকন্যা-সমাবৃতঃ- তিনি কখনও দেবতাদের বাগানবাড়িতে, কখনও নন্দন-বনে, কখনও সমুদ্রের ধারে, কখনও বা নদীর কিনারায় বসে থাকেন। দেবর্ষিদের সামগান আর তার ভাল লাগে না। নৃত্য-গীত আর ভাল বাজনা না হলে তার মেহফিল জমে না–বাদিত্রাণি চ দিব্যানি গীতঞ্চ মধুরশ্বর। ছয় ঋতুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে গন্ধর্ব-অপ্সরাদের নৃত্য-গীত ব্যসনে নহুষ ধর্মকার্য, রাজকার্য, সব ভুলে গেলেন। ধর্মাত্মা রাজা কামাত্মা হয়ে পড়লেন দিনে দিনে।

এইসময়ে নহুষ একদিন তার অপ্সরা-সঙ্গিনীদের নিয়ে পথ চলেছেন। হঠাৎ তার চোখ পড়ে গেল ইন্দ্রের প্রিয়তমা পত্নী শচীদেবীর দিকে–সম্প্রপ্তা দর্শনং দেবী শস্য মহিষী প্রিয়া। ইন্দ্র তার স্বর্গের ভদ্রাসন ত্যাগ করে কবেই চলে গেছেন কোথায়। আর রানির আসন থেকে নেমে শূচী এখন অনাথা রমণীর মতো এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ান। কিন্তু রাজ্যভ্রষ্টা হলেও শচী এখনও পরমা রূপসী। রাজলক্ষ্মী ত্যাগ করে গেলেও রূপলক্ষ্মী তাকে ত্যাগ করেননি। শচীকে দেখেই নহুষ মুগ্ধ হলেন। কিন্তু যিনি এককালে ইন্দ্রের মতো স্বামীর সৌভাগ্য ভোগ করেছেন, তিনি অন্য পুরুষ দেখে মুগ্ধ হবেন কেন? তাছাড়া ইন্দ্রাণী শচীর মধ্যে ইন্দ্রের প্রতি সেই একনিষ্ঠতা ছিল, যাতে নহুষের অপাঙ্গ-লেহনে তিনি বিরক্ত হলেন।

কিন্তু নহুষ এসব বুঝবার পাত্র নন। প্রতিনিয়তই যেহেতু স্বর্গের কলাবতী রমণীরা নহুষের সঙ্গভিক্ষা করেন, অতএব নহুষকে দেখেও ইন্দ্ৰপত্নীর উদাসীন নিশ্চেষ্ট আচরণ নহুষকে একটু পীড়া দিল। পাত্র মিত্র-মোসাহেবদের ডেকে তিনি বললেন- ইন্দ্রাণী শচীর হলটা কী? আমাকে দেখেও তিনি একটু সেবা-টেবা না করেই চলে যাবেন-ইন্দ্রস্য মহিষী দেবী কস্মান্মাং নোপতিষ্ঠতি? নহুষের মনের অবস্থা এমনই যে সাধারণ ঢাক্-ঢাক্ গুড়-গুড়ের লজ্জাটুকুও তার চলে গেছে। সবাইকে বললেন আমি এখন এই জগতের অধীশ্বর এবং দেবতাদেরও আমি রাজা। ইন্দ্র তো এখন আমিই। তা শচীর আর কষ্ট করার দরকার কী? বরং শচীকে বলুন–দেরি না করে একেবারে আমার ঘরে চলে আসতে, নির্জনে কথা কওয়া যাবে–আগচ্ছতু শচী মহ্যং ক্ষিপ্রমেব নিবেশন।

সবাইকে বলার সময় নহুষ শচীকে শুনিয়েই কথাটা বলেছিলেন। শচী আর রাস্তায় দাঁড়াননি। স্ত্রীলোকের স্বাভাবিক বিপদ অনুভব করে শচী সটান উপস্থিত হলেন দেবগুরু বৃহস্পতির বাড়িতে। হাজার হলেও তিনি ব্রাহ্মণ মানুষ। আপদে বিপদে সব সময় তিনি দেবতাদের সৎপরামর্শ দিয়ে থাকেন। শচী তার কাছেই গিয়ে দাঁড়ালেন। বললেন আমাকে বাঁচান ঠাকুর! নহুষের হাত থেকে আমায় বাঁচান–রক্ষ মাং নহুষা ব্ৰহ্মণ ত্বমস্মি শরণংগতা। শচী নহুষের বাক্যে, চোখের চাউনিতে স্ত্রীলোকের অশ্লীল মরণ দেখেছেন। বৃহস্পতির পায়ে পড়ে তিনি বললেন- আপনিই একদিন বলেছিলেন ঠাকুর–আমি নাকি স্বাধ্বী, সুলক্ষণা, ভাগ্যবতী। তা, আজ আমার এ কী হল? বৃহস্পতি বললেন– আমি যা বলেছি, ঠিকই বলেছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গে আবার আপনার দেখা হবে। আমি আপনাকে অভয় দিয়ে বলছি-নহুষের থেকে আপনাঃ কোনও ভয় নেই–ন ভেতব্যঞ্চ ন্যাৎ সত্যমেব্রবীমি তে।

ইন্দ্রানী বিপন্ন হয়ে দেবগুরু বৃহস্পতির আশ্রয় নিয়েছেন–এ কথা নহুষের কানে গেল। তিনি যার-পর-নাই ক্রুদ্ধ হলেন–চুকোপ স নুপোস্তদা। রাজা-মহারাজাদের রাগ হলে যা হয়। চারদিক থেকে সবাই এসে স্ততি-মানে তাঁকে বোঝাবার চেষ্টা করে। এখানেও দেবতারা, ঋষিরা সবাই এসে নহুষকে বললেন-আপনি ক্রুদ্ধ হবেন না, মহারাজ! আপনি রাগ করেছেন, তাই কারও মনে আজ শান্তি নেই। দেবতা, অসুর, নাগ-সকলেই শুধু ভয় পাচ্ছে। আপনার মতো একজন মহান রাজার কি এত রাগ করলে চলেন লুধ্যস্তি ভবদবিধাঃ।

সবাই ভয় পাচ্ছে–এ কথা বললে রাগী লোকের ক্রোধ কিছু শান্ত হয়। নাকি আরও বাড়ে? যাইহোক দেবতারা-ঋষিরা ভাবলেন-স্তুতিমানে রাজার বুঝি বা কিছু ক্রোধশাস্তি হয়েছে। সময় বুঝে তারা বললেন–মহারাজ! শচীদেবী যে পরের স্ত্রী। পরের স্ত্রীকে জোর করে ভোগ করার মধ্যে মহত্ত্ব নেই কোনও, বরং পাপ আছে শত শত। শচী দেবীর ওপর থেকে মন তুলে নিন আপনি-নিবর্তয় মনঃ পাপাৎ পরদারাভিমৰ্ষণাৎ। ঋষিরা বললেন–এতেই আপনার মঙ্গল। দেবতাদের রাজা হয়েছেন আপনি, ধর্ম অনুসারে রাজ্য পালন করুন। পরস্ত্রীব্যসনে লিপ্ত হবেন না।

 কামুক ব্যক্তিকে বেশি সদুপদেশ দিলে তার ক্রোধ হয়। তার কারণও আছে। মহামতি শঙ্করাচার্য এই মনস্তত্ত্বটা বুঝেছিলেন বলেই ভগবদ্গীতার টীকা করবার সময় লিখেছেন–কামনা যদি কোনওভাবে প্রতিহত হয়, তবে সেই প্রতিহত কামনাই ক্রোধের জন্ম দেয়–কাম এব প্রতিহতঃ ক্রোধরূপেণ পরিণমতে। নহুষের ক্ষেত্রেও এই নিয়মের ব্যতিক্রম হল না। তিনি দেবতা-ঋষিদের কথা একেবারে উড়িয়ে দিলেন-এবমুক্তো ন জগ্রাহ তদবচঃ কামমোহিতঃ। বুদ্ধিমান মানুষ যদি চারিত্রিক বিপাকে পড়েন, তবে তিনি অধম ব্যক্তির উপমা ব্যবহার করেন। একটি ভাল ছাত্র যদি পরীক্ষায় খারাপ করে, তবে সে অন্য কোনও ভাল ছেলের খারাপ হওয়ার উপমা খোঁজে। নহুষ দেবতাদের দিকে চোখ রাঙিয়ে বললেন-বেশি জ্ঞান দেবেন না। আপনাদের আগের ইন্দ্র যখন গৌতম ঋষির জীবিত অবস্থাতেই লুকিয়ে লুকিয়ে তার পত্নীকে ধর্ষণ করেছিলেন–অহল্যা ধর্ষিত পূর্বং ঋষিপত্নী যশস্বিনী–তখন কোথায় ছিলেন আপনারা? একটুও তো বারণ করেননি তাঁকে–স চ কিং ন নিবারিতঃ? আর সেই ইন্দ্র কি একটা দুটো পাপ করেছেন? ছল, অন্যায়, নৃশংসতা কিছুই তো বাদ যায়নি! কই আপনারা তখন তো বারণ করেননি তাকে স বঃ কস্মান্ন বারিতঃ?

নহুষ একটু দম নিলেন। উলটো চাপা দেওয়া শেষ হলে মাথা ঠান্ডা করে তিনি বললেন সে যাকগে। ইন্দ্রাণীকে বলুন, সে আমাকে একটু খুশি করে দিক, একটু সেবা করুক আমার। ব্যস আর ভাবতে হবে না। এতে তারও ভাল হবে, আপনাদেরও ভাল হবে-উপতিষ্ঠতু দেবী মাম্ এতদস্যা হিতং পরম্। দেবতারা নহুষের কথা শুনে মাথা নিচু করলেন এবং নহুষের কাছে প্রার্থনা করলেন–তবু আপনি ক্রোধ ত্যাগ করুন, মহারাজ। আমরা কথা দিচ্ছি–ইন্দ্রাণীকে নিয়ে আসব আপনার কাছে–ইন্দ্রাণী আনয়িষ্যামো যথেচ্ছসি দিবতে–আপনার যেমন ইচ্ছে, তেমনই করব আমরা।

নহুষের দুর্নিবার সম্ভোগেচ্ছা পূরণ করার জন্য দেবতা এবং ঋষিরা সবাই মিলে এসে উপস্থিত হলেন বৃহস্পতির বাড়িতে–যেখানে শচী রয়েছেন। শচীকে নহুষের কাছে যেতে হবে– এই অমঙ্গলের সংবাদ দেওয়ার সময়েও তাদের মনের মধ্যে নহুষের ভয় কাজ করছিল। ফলত নহুষের কাছে যাওয়াটা ইন্দ্রাণীর পক্ষে কোনও অন্যায়ই নয়–এইরকম একটা তর্কযুক্তি সাজাতে আপাতত দেবতা এবং ঋষিদের সময় লাগল না। তারা ভাবলেন-ভূতপূর্ব ইন্দ্রপত্নীকে নহুষের হাতে তুলে দিলে দেব-সমাজ এবং ঋষি-সমাজ নহুষের কোপ থেকে আপাতত বেঁচে যাবেন। অতএব বৃহস্পতির কাছে গিয়ে তারা বললেন– আমরা জানি, ইন্দ্রপত্নী শচীকে আপনি আশ্রয় দিয়েছেন– জানীমঃ শরণং প্রাপ্তামিন্দ্রাণীং তব বেশ্মনি। কিন্তু দেবতা, গন্ধর্ব এবং ঋষিদের সবারই মত হল–শচীদেবীকে নহুষের হাতেই দিয়ে দিন–নহুষায় প্রদীয়তা।

দেবতারা যুক্তি দিয়ে বললেন-দেখুন, নহুষ এখন দেবরাজ এবং ভূতপূর্ব ইন্দ্রের থেকে তিনি অনেকাংশেই শ্রেষ্ঠতর–ইন্দ্রা বিশিষ্টো নহুষঃ। তা এইরকম একজন বড় মানুষকে ইন্দ্রাণী যদি স্বামিত্বে বরণ করেন, তাতে খারাপ কী আছে– বৃণোমিং বরায়োহা ভর্তৃত্বে বরবণিনী। বৃহস্পতির গৃহের অন্তর্ধারে দাঁড়িয়ে দেবতা-ঋষিদের কাতর প্রার্থনা শচী দেবীর কানে যেতে কোনও অসুবিধে হল না। নিজের সতীত্ব এবং শালীনতা বিপন্ন বুঝে শচী ইন্দ্রাণী করুণভাবে কেঁদে উঠলেন। বৃহস্পতিকে সানুনয়ে বললেন–নহুষ যত বড় মানুষই হোন, এমনকি হোন না তিনি আমার স্বামী ইন্দ্রের থেকেও অনেক বড়, কিন্তু তবুও আমি নহুষকে আমার স্বামী ভাবতে পাচ্ছি নানাহমিচ্ছামি নহুষং পতিং দেবর্ষিসত্তমঃ। আপনি আমাকে বাঁচান ঠাকুর, আমাকে বাঁচান-ত্রায় মহতো ভয়াৎ। বৃহস্পতি ইন্দ্রাণীকে অভয় দিয়ে বললেন–তুমি নির্ভয়ে নিশ্চিন্তে থাক, ইন্দ্রাণী। তুমি তোমার ধর্ম ত্যাগ করনি, আমিও আমার ধর্ম ত্যাগ করব না। তুমি আমার ওপর নির্ভর করেছ। এই বিপদের সময় আমারই শরণপ্রার্থিণী এক রমণীকে আমিও ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারি না– শরণাগতং ন ত্যজেয়মিন্দ্রাণি মম নিশ্চয়ঃ।

.

২৭.

ইন্দ্রাণী শচীদেবীকে নিশ্চিন্তে থাকতে বললেন বৃহস্পতি। বললেন–এই দুঃসময়ে তোমাকে নহুষের হাতে ছেড়ে দেব না অন্তত-ন ত্যজে ত্বমনিন্দিতে। বৃহস্পতি দেবতা এবং ঋষিদের আর্জি নাকচ করে দিয়ে বললেন-কোন অবস্থায় কী ধর্ম পালন করা উচিত, আমি তা জানি। ইন্দ্রাণী আমার শরণাগত। লোকপিতামহ ব্রহ্মা শরণাগত ব্যক্তিকে ত্যাগ করার দোষ কীর্তন করেছেন বারে বারে। তাছাড়া আমি একজন সত্যনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ হয়ে এমন অধর্ম করি কী করে-নাকার্যং কর্তুমিচ্ছামি ব্রাহ্মণঃ সন্ বিশেষতঃ। তোমরা যাও এখান থেকে। আমি ইন্দ্রের প্রিয়তমা পত্নীকে অন্তত নহুষের হাতে ছেড়ে দেব না–ন দাস্যামি শচীমিমা। তবে হ্যাঁ, নহুষ যেভাবে তোমাদের বলেছেন, যেভাবে ভয় দেখিয়েছেন, তাতে উপায় একটা বার করতেই হবে যাতে এরও ভাল হয়, আমারও ভাল হয়। তা সেই ভালর পরামর্শটাই আপনারা দিন, অবশ্য আপনাদের তরফ থেকে পরামর্শ যাই আসুক শচীকে কিন্তু আমি ফেরত দিচ্ছি না–ক্রিয়তাং তৎ সুরশ্রেষ্ঠা ন হি দাস্যাম্যহং শচীম্।

 দেবতারা বৃহস্পতির দৃঢ় সিদ্ধান্ত শুনে তাকেই বললেন–তাহলে আপনিই বিচার করে বলুন কিসে সবারই ভাল হয়। বস্তুত সকলেই তারা বুঝতে পারছিলেন যে, নহুষের হাতে শচীকে ছেড়ে দেওয়া কিছুতেই ঠিক হবে না, কিন্তু নহুষের ভয়েই তারা বৃহস্পতির কাছে ওই প্রস্তাব করেছিলেন। এখন যখন দেবতারা বুঝলেন দেবগুরু স্বয়ং উপায় চিন্তা করছেন, তখন স্বয়ং তার পরামর্শই তাদের কাছে গ্রহণীয় মনে হল। বৃহস্পতি অনেক ভাবনা করে দেবতাদের বললেন–ইন্দ্রাণীকে দিয়েই নহুষকে বলতে হবে যে, তিনি আপনার ইচ্ছার কথা শুনেছেন। তবে বুঝতেই তো পারছেন, এই সেদিন তার স্বামী চলে গেছেন–মন তত দ্বিধাগ্রস্ত হয় বটেই। তিনি আপনার কাছে একটু সময় ভিক্ষা করছেন-নহুষঃ যাচতাং দেবী কিঞ্চিৎ কালান্তরং শুভা।

সময়। মানুষের সৌভাগ্য এবং দুর্ভাগ্য–দুইই গড়ে দিতে পারে সময়। বৃহস্পতি যে বুদ্ধি দিলেন, সেটা আধুনিক মতে ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’। রামায়ণের রাবণের নীতি অনুযায়ী এটা ‘অশুভস্য কালহরণ’ অর্থাৎ ঘটনা শুভ হলে সময় নষ্ট করা উচিত নয়, আর অশুভ হলে সময় নাও, শুধুই সময় নাও। আর দেবগুরু বৃহস্পতি এই সুযোগে দেবতাদের একটু জ্ঞানই দিয়ে দিলেন। বললেন–কাল বড় সাংঘাতিক জিনিস। যত সময় নেবে, ততই দেখবে নানা বাধা, ঝুট-ঝামেলা এসে কাজ পণ্ড করছে–বহুবিধুঃ সুরাঃ কালঃ কালঃ কালং নয়িষ্যতি। সবার আশীর্বাদ আর তেজ লাভ করে নহুষ যতই অহংকারী হোন না কেন, এই কালই তাঁর কাল হয়ে দাঁড়াবে।

দেব-শিষ্য আর তাদের শুরুতে মিলে সিদ্ধান্ত হল ঠিকই। তবে ইন্দ্রাণীকেই তো নিজে মুখে। কথাটা বলতে হবে। দেবতারা যদি নহুষের কাছে গিয়ে ইন্দ্রাণীর মত ব্যক্ত করে বলেন–একটু দেরি হবে তার। তাহলে আর রক্ষে থাকবে না। ভাববেন, ষড়যন্ত্র চলছে। অতএব দেবতারা ইন্দ্রাণীকে ধরে বললেন–আপনার সতীত্ব এবং সত্যনিষ্ঠা সম্বন্ধে আমাদের কোনও সন্দেহই নেই, তবে এই সময় চাইতে হবে আপনাকেই, নইলে সে মানবে কেন? ইন্দ্রাণী রাজি হলেন দেবতাদের প্রার্থনায়।

কাজ গোছাতে হবে। অতএব মন শক্ত করে একেবারে অভিসারিকার সাজে ইন্দ্রাণী চললেন নহুষের বাড়ি–ইন্দ্রাণী কার্যসিদ্ধয়ে। মুখে বেশ একটু লজ্জা-লজ্জা ভাব ফুটিয়ে ইন্দ্রাণী নহুষের বাড়ি চললেন সাভিনয়ে। কিন্তু অভিনয় যতই করুন, যার কাছে তিনি এসেছেন তিনি তো আর অভিনয় করছেন না। ইন্দ্রাণী তার চোখের মধ্যে, তার মুখমণ্ডলের মধ্যে কামুক পুরুষের নির্লজ্জ অভিব্যক্তি দেখতে পেলেন, সুস্থ শালীন রমণীর কাছে সে অভিব্যক্তি ভয়ঙ্কর, ভীষণ–কবির ভাষায়-নহুষং ঘোরদর্শনম। অন্যদিকে প্রার্থিতা রমণীকে স্বয়ং উপস্থিত হতে দেখে নহুষের কাম-ব্যাকুল চিত্ত নৃত্য করে উঠল। তার চোখ বলল–এই তো রমণীর বয়স এবং রূপ–দুইই ঠিক আছে–দৃষ্টা তাং নশ্যাপি বয়োরূপ-সমম্বিতাম্। দুষ্ট মন বলল–যা চেয়েছিলাম পেয়েছি–সমহৃষ্যত দুষ্টাত্মা কামোপহতচেতনঃ।

 দৃষ্টির দ্বারা ইন্দ্রাণী শচীর দেহ লেহন করতে করতেই নহুষ বললেন-তুমি তো জান, এখন আমিই তিন ভুবনের ইন্দ্র। অতএব আমাকেই এখন থেকে তুমি স্বামী মনে করবে–ভজস্ব মাং বরারোহে স্বামিতে বরবৰ্ণিনি। শচীর হৃদয় একেবারে কম্পিত হয়ে উঠল। অভিনয় করতে এসে যদি এখনই বিপাকে পড়েন? ঠাকুর-দেবতা স্মরণ করে কোনও মতে শচী বললেন–আমাকে একটু সময় দিন, দেবরাজ! আমার স্বামী কোথায় গেছেন, কী করছেন, কিছুই তো জানি না। আমি তার একটু খবর নিয়ে নিই। আর যদি তার সংবাদ কিছু না পাই, তবে তো চিরকাল আপনারই সেবা করব আমি, তত’হং ত্বমুপস্থাস্যে সত্যমেত ব্রবীমি তে।

নহুষ খুশি হলেন। ভাবলেন–ইন্দ্ৰণী জালে জড়িয়ে গেছেন, এখন শুধু সামান্য সময়ের অপেক্ষা। দুর্দম পৌরুষের সঙ্গে কামুকতার সুর মেশালে যে শব্দরাশি তৈরি হয়, সেই নূর-মধুর শব্দে নহুষ বললেন-সুনিতম্বে! তবে তাই হোক। তুমি ইন্দ্রের খবর নিয়ে তবেই এখানে এস। মনে রেখ, তুমি কিন্তু কথা দিয়েছ, সেই কথাটা রেখ কিন্তু। নহুষের হাত থেকে ছাড়া পেয়েই শচীদেবী বৃহস্পতির বাড়িতে এসে ঢুকলেন আবারও। দেবতারা এবার সবাই মিলে বিষ্ণুর সঙ্গে দেখা করলেন। পরামর্শ এবং অভয়–দুইই জুটল। ইন্দ্রের পাপমুক্তির জন্য হোম-যজ্ঞ, শান্তি-স্বস্ত্যয়নও চলল কিছুদিন। এমনকি ইন্দ্র এসে একবার দেখেও গেলেন নহুষের অবস্থা। দেখলেন–দেবতা-ঋষিদের বরের প্রভাবে তিনি এখনও দুর্ধর্ষ, তাকে কিছুই করা যাবে না–অকম্প্যং নহুষং স্থানান্ দৃষট্টা বলনিশূদনঃ। ইন্দ্র আবারও চলে গেলেন সেই জলস্থানে, অপেক্ষা করতে লাগলেন, অনুকুল সময়ের জন্য।

ক্ষণিকের জন্য স্বর্গরাজ্যে ইন্দ্র যে একবার এসেছিলেন, ইন্দ্রাণী তা দেখেছিলেন। কিন্তু তাঁকে যে ধরে রাখা গেল না, সেই দুঃখ তার কাছে মর্মান্তিক হয়ে দাঁড়াল। মহাভারত বলেছে–ইন্দ্রাণী তখন উপশ্রুতি’ নামে এক রাত্রিদেবীর উপাসনা করে, তারই সহায়তায় ইন্দ্রের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন তার গোপন আস্তানায়। আমাদের ব্যক্তিগত ধারণায় উপশ্রুতি’ হয়তো তিনিই, যিনি সাধারণ খবর ছাড়াও আরো কিছু খবর রাখেন। সংস্কৃতে ত’ বা শব্দ-খবর রাখা বা জানা থাকার অর্থ বোঝায়। বহুশ্রুত’, ‘অল্পক্রত’ এই শব্দগুলির অর্থ লক্ষণীয়। আরও লক্ষণীয় উপশ্রুতি’ দেবী রাত্রির সমার্থক। অর্থাৎ আমাদের ধারণা–গোপন খবর জানেন এমন একজন রমণীর সঙ্গে রাতের আঁধারে ইন্দ্রাণী গিয়েছিলেন ইন্দ্রের আস্তানায়। ইন্দ্রের সঙ্গে তাদের দেখাও করতে হচ্ছে অতি সূক্ষ্ম-রূপে–সূক্ষ্মরূপধরা দেবী বভূবোপক্ৰতিশ্চ সা। এই সূক্ষ্মরূপ গোপনতা ছাড়া আর কিছুই নয়। ইন্দ্রও সূক্ষ্মরূপে আছেন, এরাও দেখা করছেন সূক্ষ্মরূপে অর্থাৎ অন্যে যাতে বুঝতে না পারে সেইরকম গূঢ়ভাবে শচী আর উপশ্রুতি দেখা করলেন লুকিয়ে থাকা ইন্দ্রের সঙ্গে।

 ইন্দ্ৰ আপন পত্নীকে এই অবস্থায় তার কাছে আসতে দেখে খুশি হলেন না মোটেই। বললেন–তুমি কী জন্য এখানে এসেছ, আমি যে এখানে আছি তাই বা জানলে কী করে–কিমর্থমসি সম্প্রপ্তা বিজ্ঞাত কথং তৃহম? শচী আর উপশ্রুতির কথা বিশদে না বলে তার আসন্ন বিপদের কথা জানালেন। জানালেন–দুরাত্মা নহুষ লজ্জা-ধর্ম ত্যাগ করে আমাকে বলেছেন তাকে স্বামিত্বে বরণ করতে। আমার সঙ্গে মিলিত হওয়ার শেষ একটা সময়-সীমাও তিনি দিয়ে দিয়েছেন–কালঞ্চ কৃতান মম। এই অবস্থায় তুমি যদি এখন আমাকে তার হাত থেকে রক্ষা না কর, তাহলে জোর করে সে আমাকে আত্মসাৎ করবে-যদি ন ত্ৰাস্যসি বিভো করিষ্যতি স মাং বশে। তুমি আক্রমণ করো নহুষকে।

ইন্দ্র শচীর সব কথা ভাল করে শুনলেন। তারপর প্রকৃত সত্য স্বীকার করে মন্তব্য করলেন–এখনও নহুষকে আক্রমণ করার সময় হয়নি। আর আমার বীরত্ব দেখানোর সময়ও এটা নয়। কারণ নহষ আমার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিমান–বিক্রমস্য ন কালো’য়ং নহুষো বলবত্তরঃ। ঋষিরা নহষকে দেবতার সমাদর দেখিয়ে বাড়িয়ে তুলেছেন, এখন আর আমার কিছু করার নেই। ইন্দ্র আপন পত্নীকে নিজের অসহায় অবস্থার কথা জানিয়ে শেষে বললেন–আমি একটা কৌশল করব। তুমি সেটা কাউকে বলবে না।

বিপদ থেকে ত্রাণ পাবার আশায় শচী উৎকর্ণ হলেন। ইন্দ্র শচীকে বললেন-কেউ যখন নহুষের কাছে থাকবে না, সেই নির্জন মুহূর্তে তুমি নহুষের কাছে যাবে। তারপর বলবে…। তারপর যা বলতে হবে ইন্দ্র তা কানে কানে বলে দিলেন শচীদেবীকে। অলোকমান্যা রূপসী শচী শৃঙ্গার-মধুর বেশভূষা করে ইন্দ্রের কথামতো নির্জনে দেখা করলেন নহুষের সঙ্গে। নহুয তো শচীকে দেখে বিগলিত হয়ে বললেন–আরে ইন্দ্রাণী যে! রাস্তায় কোনও কষ্ট হয়নি তো? তা এই সময়ে তোমার চিরভক্তের কাছে তুমি এসেছ। বল কী চাও? যা চাও তাই দেব-ভক্তং মাং ভজ কল্যাণি কিমিচ্ছসি মনস্বিনি।

মধুর হেসে ইন্দ্রাণী বললেন–আপনি আমাকে যে মিলনের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন, তা আমি মেনে নিয়েছি। এর পরে আপনিই হবেন আমার স্বামী, আমার সব–ততস্তমেব মে ভর্তা ভবিষ্যসি সুরাধিপ। তবে কী, মনে মনে আমার একটা অভিলাষ আছে। সেই। অভিলাষ-বাক্যের মধ্যেই আছে আমার ভালবাসা–বাক্যং প্রণয়সংযুক্ত।

আপনি যদি সত্যিই আমার কথা রাখেন, তবেই আমি আপনার চরণের দাসী হব।

নহুষ ভাবলেন–তিন ভুবনের অধিকার তারই হাতে। কী এমন চাইবেন ইন্দ্রাণী যা তার অদেয় হতে পারে? শচী নহুষের মনের ভাব বুঝে সাভিনয়ে নিজের স্বামীকে পর্যন্ত তুচ্ছ করে বললেন–আমার আগের স্বামী ইন্দ্রের অনেক বাহন ছিল। হাতি, ঘোড়া, রথে আমি অনেক চড়েছি। কিন্তু হস্তিশ্রেষ্ঠ ঐরাবতও হাতি, অশ্বশ্রেষ্ঠ উচ্চৈবাও ঘোড়াই বটে। এসব বাহন আমার কাছে পুরনো হয়ে গেছে। আমি আমার ভবিষ্যৎ স্বামীকে এমন বাহনে সমাসীন দেখতে চাই, যে বাহন শিব, বিষ্ণু দেবতা-অসুর কারও নেই।

বিষ্ণুর বাহন গরুড়, কি শিবের বাহন ষাঁড়-এও যখন ভাবী-প্রিয়তমার পছন্দ নয়, অথবা দেবতাদের বাহনগুলি হংস-ঘোটক, মূষিক-ময়ূর–কিছুই যখন পছন্দ নয়, তবে হয়তো সিংহ-টিংহ পছন্দ হবে শচীর। নহুষ মনে মনে চিন্তা করলেন–শচী তাকে কতটা বড় ভাবেন। এতটাই বড় যে বিষ্ণু-শিবের সমাসনে পর্যন্ত তাকে বসাতে চান না। নহুষের আপন হৃদয়ের স্ফীত ভাবনাকে আরও প্রশ্রয় দিয়ে শচী বললেন–আমি চাই আমার প্রিয়তম আমাকে বরণ করে নেওয়ার জন্য এমন একটি পাল্কি করে আসুন, যে পাল্কি বয়ে আনবেন দেবাসুরের পূজ্যতম মহর্ষিরা, দেবর্ষিরা-বহন্তু ত্বং মহাভাগা সঙ্গতা বিভো।

বলদর্পিত, কামুক নহুষ যাতে পিছিয়ে না আসেন, তার জন্য যাকে ইংরেজিতে বলি ‘ফেমিনিটি এক্সপ্লয়েট’ করা, ঠিক সেই ভাবেই শচী তার রমণীয়তা তীব্রতর করে বললেন আপনাকে এই রকম করেই দেখতে চাই মহারাজ–এতদ্ধি মম রোচতে। আপনাকে লোকে দেবতা-অসুরদের সমান বলে ভাববে–এ আমার সইবে না, রাজা! দেবতা-অসুর যার দিকে আপনি দৃষ্টিপাত করেন তারই শক্তি আপনার মধ্যে সংক্রামিত হয়। আপনি তাদের অনেক ওপরে। ওঁরা কেউ আপনার সামনে দাঁড়িয়ে পর্যন্ত থাকতে পারবে না। কিন্তু সেই মানুষটা অন্য দেবতাদের মতো চিরাচরিত পশুবাহনে সমাসীন হয়ে, বড় জোর রথে চড়ে আমার গলায় বরমাল্য দিতে আসবেন–এ আমি সইতে পারব না মহারাজ। আমার মাথা খাও, ওঁদের সঙ্গে তোমাকে আমি এক করে দেখতে পারব না–নাসুরেসু ন দেবেষু তুল্যো ভবিতুমহসি।

শচীর ভাবে, মাধুর্যে, কথায় নহুষ নিজেকে হারিয়ে ফেললেন একেবারে। বিগলিত হয়ে বললেন-বাঃ! তুমি নইলে এমন অপূর্ব এক বাহনের কথা কার মাথায় আসত–অপূর্বং বাহনমিদং ত্বয়োক্তং বরবৰ্ণিনি। তুমি যা বলেছ, আমার ভীষণ ভীষণ পছন্দ হয়েছে। বৃহৎ কোনও পশু নয়, রথ নয়, এমনকি সাধারণ মানুষও নয়। আমি হব ঋষি-বাহন। সাধারণ অল্পশক্তি কোনও রাজা কি আর ঋষিদের নিয়ে পাল্কি বওয়াতে পারে–নাল্পবীর্যো ভবতি যো বাহান্ কুরুতে মুনী?

নহুষ আত্মখ্যাপনে ব্যস্ত হলেন। শচীকে বললেন–আর সত্যিই তো, তুমি যেমন বলেছ আমি তপস্বী এবং বলবান। আমার রাগ হলে তিন ভুবনে থরহরি কম্প লাগে। ঋষিরা এখন আমারই উদ্দেশে আহুতি দিচ্ছেন। তুমি ভেব না, ইন্দ্রাণী! যেমনটি তুমি বলেছ, তেমনটিই আমি করব। আমি যে তোমারই–তদ্বশোস্মি বরাননে। যেদিন মিলন-মুহূর্ত নির্ধারিত হবে, সেদিন সপ্তর্ষির সাত বেহারা সামনে এসে আমায় কাঁধে তুলে নেবে শিবিকার ভিতরে। পিছনে আসবেন ব্রহ্মর্ষিরা পায়ের তালে হুনহুনার ঝঙ্কার তুলে–সপ্তর্ষয়ো মাং বক্ষ্যন্তি সর্বে ব্রহ্মর্ষয় স্তথা। তুমি শুধু দাঁড়িয়ে দেখবে আমার ক্ষমতা, আমার ঋদ্ধি-পশ্য মাহাত্ম্যম্ অস্মাকমৃদ্ধি বরবৰ্ণিনি।

 শচীদেবী এতক্ষণ নহুষকে যেভাবে বললেন–তার মধ্যেই দেবরাজ ইন্দ্রের কৌশল নিহিত ছিল। নহুষের অহঙ্কার স্ফীতভাব অনুমোদন করে শচীদেবী বৃহস্পতির বাড়িতে ফিরে এলেন। সময় আর বেশি নেই। সন্ধ্যাবেলায় নহুষ আসবেন ঋষি-বেহারার পাল্কি চড়ে। শচী বৃহস্পতিকে বললেন–আপনি ইন্দ্রের খোঁজ করুন। আর যে সময় নেই-সময়ো’ল্পাবশেষো মে নহুষেণেহ যঃ কৃতঃ। বৃহস্পতি অগ্নিদেবের মাধ্যমে ইন্দ্রকে খবর পাঠালেন। ইন্দ্রও যম, বরুণ, চন্দ্রের মতো উচ্চকোটির দেবতাদের সঙ্গে শলাপরামর্শ আরম্ভ করলেন নহুষের সঙ্গে শেষ লড়াই করবার জন্য। ইন্দ্র যে নহুষের মুখোমুখি হতে খুব সাহস পাচ্ছেন, তা মোটেই নয়। বারবার তিনি তার যোদ্ধা দেবতা-বন্ধুদের বলছেন–বর্তমান দেবরাজ নহুষ একেবারে সাংঘাতিক লোক, আপনারা যুদ্ধের সময়ে আমাকে সাহায্য করবেন কিন্তু রাজা দেবানাং নহুযো ঘোররূপ। স্ত সাহং দীয়তাং মে ভবদ্ভিঃ।

সৌভাগ্যের বিষয় ইন্দ্রকে শেষ পর্যন্ত লড়াই করতে হয়নি। সেই সন্ধ্যায় নহুষ যখন রায়বেশে পাকিতে উঠেছেন, তখন তার পাক্কি কাঁধে করে বয়ে নিয়ে চললেন সাত-বেহারা সপ্তর্ষি। আগে-পিছে চললেন মহর্ষিরা, ব্রহ্মর্ষিরা। ব্রহ্মর্ষি ঋষিদের সর্বত্র সমভাব, তারা স্থিতধী। সুখ-দুঃখ, লাভ-অলাভ-সর্বত্র সমভাব–দুঃখে অনুদ্বিগ্নচিত্ত, সুখে বিগতস্পৃহ। তাঁরা যে। অযোগ্য নহুষের শিবিকা কাঁধে করে বয়ে নিয়ে চলেছেন, এতে তারা কিছু মনেও করেননি, দুঃখও পাননি। দেশের রাজা চাইছেন তিনি ঋষিদের কাঁধে চড়ে প্রিয়মিলনে যাবেন, তাঁরাও সেটাকে রাজার নবতর বিলাস মনে করে তাঁকে সানন্দে কাঁধে তুলে নিয়েছেন।

মজা হল, ঋষি-মুনিরা অন্যসময় দিনরাত স্বাধ্যায়-অধ্যয়ন আর হোম-যজ্ঞ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন বলে সাধারণ অবসরেও তারা সাধারণ কথা বলতে পারেন না। রাজা নহুষকে কাঁধে করে নিয়ে যেতে যেতে তারা একটু ক্লান্তও হয়ে গিয়েছিলেন। একে অনভ্যাস তার ওপরে বৃথা সময় নষ্ট। হয়তো সেই কারণেই পথে সামান্য সময়ের জন্য শিবিকা নামিয়েছিলেন। সামান্য অবসর মানেই বৈদিক ক্রিয়া-কলাপ নিয়ে ঋষিদের মীমাংসাশাস্ত্রের আলোচনা। আলোচনার বিষয় যজ্ঞকালে গো-প্রোক্ষণ। যজ্ঞের সময় গোবধের কতগুলি মন্ত্র আছে। সেই মন্ত্রগুলির প্রয়োগ নিয়ে যাজ্ঞিকদের মধ্যে কিছু মতভেদও আছে। ঋষিরা সামনে নহুষকে পেয়েছেন। নহুষ জ্ঞানী ব্যক্তি। এককালে তিনি বহু যজ্ঞ করেছেন। ঋষিরা ঠিক করলেন গো-প্রেক্ষণের প্রশ্ন মীমাংসার জন্য তারা নহুষকেই সাক্ষী মানবেন।

ঋষিরা বললেন–মহারাজ! গো-প্রাণে ব্রহ্মা যে মন্ত্রগুলি উচ্চারণ করার কথা বলেছেন, আপনি কি সেগুলিকে প্রমাণ বলে গ্রাহ্য করেন? নহুষ বললেন–না, মোটেই না। আমি সেগুলিকে প্রমাণ বলে মানি না। ঋষিরা বললেন–আপনি না মানলেও ব্রহ্মার কথাকেই আমরা প্রমাণ বলে মনে করি এবং প্রাচীন মহর্ষিরাও তাই মনে করেন। নহুষ মানলেন না। লোক-পিতামহ ব্রহ্মার বিধানও আজ নহুষের কাছে হেয়।

ঋষিদের প্রশ্ন এবং সিদ্ধান্ত নহুষের ক্রোধ উদ্রেক করল। প্রশ্নকারী ঋষিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ঋষি অগস্ত্য। মুনিদের সঙ্গে তর্ক করতে করতে নহ্য অগস্ত্যের মাথায় কষে একটি লাথি মারলেন। ঋষিদের শিবিকা-বহন স্তব্ধ হল। অগস্ত্য ঘুরে দাঁড়ালেন। মন্ত্রপূত জল হাতে নিয়ে অভিশাপ উচ্চারণ করলেন–তুমি সর্বজনপূজ্য ব্রহ্মার কথা মানছ না। ঋষিরা গোপোক্ষণে যে মন্ত্র ব্যবহার করেন, সেই মন্ত্রানুষ্ঠান তুমি উড়িয়ে দিচ্ছ। আজকে তোমার এমন অবস্থা যে, পূজ্যতম মহর্ষিদের দিয়ে তুমি পাল্কি বওয়াচ্ছ, আর তোমার দুঃসাহস কতদূর বেড়েছে যে, তুমি আমার মাথায় লাথি মারলে! এর ফলে আজই তুমি স্বর্গ থেকে পতিত হবে–ধবংস পাপ পরিভ্রষ্ট ক্ষীণপূণ্যো মহীতলে–আর বিশাল সর্পদেহ ধারণ করে তোমাকে বিচরণ করতে হবে পৃথিবীতে। সময় আসবে যখন তোমারই বংশোদ্ভূত যুধিষ্ঠির তোমাকে পাপ-মুক্ত করবেন।

ঋষিদের সঙ্গে নহুষের তর্কের বিষয় নিয়ে মতভেদ আছে। মহাভারত বৈদিক যুগের অব্যবহিত পরের রচনা। ফলত তর্কের বিষয়ের মধ্যে বৈদিক কর্মকাণ্ডই প্রাধান্য লাভ করেছে। পৌরাণিকেরা মনুষ্য-কল্পনার অনেক কাছাকাছি এসেছেন, তাই তাদের উপাখ্যানে কাহিনীর সরসতা বেশি। তারা বলেন–ইন্দ্রাণী শচীর সঙ্গে মিলিত হবেন বলে নহুষের উৎকণ্ঠা এবং ব্যগ্রতা ছিল তুঙ্গে। শিবিকাবহনে অনভ্যস্ত ঋষিরা ঠিক তাল রেখে বহন করতে পারছিলেন না। তাদের সমবেত পদক্ষেপে কোনও ঐক্য ছিল না। শিবিকারোহী নহুষের তাতে কষ্ট বাড়ছিল এবং তার যেতে দেরিও হচ্ছিল। বাহনের অসুবিধে যখন চরমে উঠল, তখন নহুষ অগস্ত্যের মাথায় লাথি মেরে বলেন—’সর্প, সৰ্প’। সংস্কৃতে এই নিষ্পন্ন ক্রিয়াপদের অর্থ ‘চল চল’। আমাদের তাড়াতাড়ি থাকলে ট্যাক্সিওয়ালা বা রিক্সাওয়ালাকে আমরা যেমন বলি–একটু তাড়াতাড়ি চল, জদি চল, ঠিক সেইরমই নহুষের বক্তব্য। তবে নহুষ দর্পোদ্ধত রাজা হওয়ার ফলে তার ভাষায় কটুতা তো ছিলই, উপরন্তু অগস্ত্যের মাথায় পদাঘাত। ফল যা হবার হল। অন্তত অভিশাপের বৃত্তান্ত সর্বত্র একই রকম। নহুষের মুখে সর্প সর্প যতই শীঘ্রতা বোঝাক, সর্প শব্দটাই অভিশাপের ভাষায় ক্রিয়াপদ থেকে রূপান্তরিত হল বিশেষ্যপদে-যার অর্থ, তুমি সর্পগতি প্রাপ্ত হবে–দশবর্ষ-সহষা সর্পরূপধরো মহান্।

 নহুষরূপী সর্পের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের মিলন কীভাবে হল, সে কথা পুর্বে আমরা জানিয়েছি। এখানে কৌতূহলের বিষয় একটাই–চন্দ্রবংশের পঞ্চম পুরুষ হাজার হাজার বছর ধরে শাপগ্রস্ত হয়ে পড়ে আছেন কত বছর পরে তার অধস্তন যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দেখা হবে বলে। সর্প হবার অভিশাপ কি সত্যই সর্পের রূপ, নাকি সর্পগতি। মহাভারতে এবং পুরাণগুলির মধ্যে দেখা যাবে-ব্রাহ্মণেরা যখন আপন স্বধর্ম স্বাধ্যায়-অধ্যয়ন ত্যাগ করতেন, তারা তখন শূদ্রসংজ্ঞা লাভ করতেন। একইভাবে ক্ষত্রিয়েরাও যখন তাদের রাজধর্ম, প্রজারণ ধর্ম ঠিক-ঠিক পালন করতেন না, তখন তারাও শূদ্র বলে পরিগণিত হতেন। সোজাসুজিভাবে এসব কথার অর্থ হল–ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়রা নিজের ধর্ম থেকে পতিত হল, আর তারা আপন সমাজের মানুষজনের সঙ্গে ওঠাবসা করতে পারতেন না। সমাজের অধম স্তরে তাদের গতি হত। অন্যদিকে লক্ষণীয়–সমাজের নিম্নস্তরেও এক ধরনের গভীর স্বাজাত্যবোধ থাকে। আজ যে ব্যক্তি ব্রাহ্মণ্য বা ক্ষাত্রধর্ম থেকে পতিত হয়ে শূদ্রসংজ্ঞা প্রাপ্ত হলেন, শূদ্রেরা যে তাকে আত্মীয়বৎ নিজের করে নেবে তা মোর্টেই নয়। দলে জায়গা না পাওয়া বাঘকে বেড়ালও আত্মীয় মনে করে না। ময়ূরপুচ্ছধারী হলে কাকও অন্য কাককে জায়গা দেয় না। লক্ষ্য করে দেখবেন, নহুষ অগস্ত্যের শাপে সর্পগতি প্রাপ্ত হয়ে সর্পজগতের মধ্যে বসতি স্থাপন করেননি। তিনি এক মহাবনে একাকী রয়েছেন গুহার মধ্যে।

সোজা কথা সোজা ভাষায় বলি। নহুষ স্বর্গরাজ্য থেকে চ্যুত হয়ে অধম গতি প্রাপ্ত হয়েছেন। ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের উচ্চ শাসনাধিকার থেকে তাকে নেমে যেতে হয়েছে। অত্যাচার এবং অসভ্যতার চরম দণ্ড হিসেবে শুধু রাজ্যচ্যুতিই নয়, ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের সমাজেই তার স্থান হয়নি, তিনি সর্পসংজ্ঞা লাভ করেছেন। সর্পকে যেমন গর্তে লুকিয়ে থাকতে হয়, নহুষেরও তেমনই আপন সমাজে মুখ দেখানোর উপায় নেই; তিনি গুহার মধ্যে লুকিয়ে আছেন। ঠিক এই মুহূর্তে আমরা সেই ভূতপূর্ব ইন্দ্রের কথাও স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, যিনি আপন পাপ এবং অন্যায়ের জন্য সর্পের মতো লুকিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন জলা জায়গায়।

নহুষেরও তাই হয়েছে। মহাবনে থাকতে থাকতে হাজার বছর ধরে তার নামেও এক নাগগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, যে গোষ্ঠীর কোনও পরবর্তী বংশধর-পুরুষের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের দেখা হয়েছে। তিনি পূর্বতন পুরুষের গৌরব অনুভব করেন, পাতিত্য ঘটা সত্তেও চন্দ্রবংশের সঙ্গে একাত্মতায় তিনি পূর্ব গৌরব অতিক্রম করতে পারেন না এবং শেষ পর্যন্ত চন্দ্রবংশের উপযুক্ত বংশধরের সাহায্যেই তিনি মুক্তির উপায় খুঁজে পান। মনে রাখতে হবে–জনমেজয়ের। সর্পষজ্ঞের পূর্বে যে সমস্ত বিখ্যাত নাগের নাম উগ্রশ্রবা সৌতির মুখে কীর্তিত হয়েছে, তাদের মধ্যে নহুষ একজন নিষ্ঠানকো হেমগুহে নহুষঃ পিঙ্গলস্তথা। বিখ্যাত নাগদের যে এক-একটা সম্পূর্ণ গোষ্ঠী ছিল, তার প্রমাণ পাবেন জনমেজয়ের সঙ্গে একেকটি নাগগোষ্ঠীর ধ্বংস থেকে। সেখানে বাসুকির বংশ, তক্ষকের বংশ অথবা ঐরাবত নাগের বংশে যত সর্প ছিল, সকলেই আগুনে প্রবেশ করেছেন।

আমাদের বক্তব্য নহুষেরও একটা বংশ তৈরি গয়ে গিয়েছিল এবং সে বংশ যথেষ্ট পুরনো। পণ্ডিতেরা বলেন–’নহুষ’ নামটির সমশব্দ পাওয়া যাবে প্রাচীন হিব্রু শব্দ ‘নঘুস বা নঘস’ শব্দের মধ্যে এবং সে শব্দের অর্থই হল মাগ। অনেকে মনে করেন নঘস’ শব্দটা থেকেই দ্রাবিড় ভাষায় নাগ শব্দটা এসেছে। বিশেষত দ্রাবিড় জাতি ভারতবর্ষে আর্যদের পূর্ববর্তী এবং প্যালেস্টাইনেও তারা সেমেটিক সভ্যতার পূর্বসূরি। কাঠিন্যের মধ্যে না গিয়ে, মহামতি কোশাম্বীর কথা উল্লেখ কলে ব্যাপারটা এইরকম দাঁড়ায়–মহাভারতের সময়ে অরণ্যবাসী অনার্য জনজাতির সঙ্গে নাগরা প্রায় সমীকৃত হয়ে গেছেন। এরা সর্পাকৃতি কোনও টোটেম ব্যবহার করতেন কিনা অথবা এরা সর্পের পূজা করতেন কিনা, সেটাও এখানে প্রায় অবান্তর। গাঙ্গেয় উপত্যকার বনভূমিতে নাগরা খাদ্য সংগ্রহ করে বেড়াতেন, যেহেতু পাঞ্জাবের মরুপার্বত্য অঞ্চলে খাদ্য সংগ্রহের চেয়ে গাঙ্গেয় সমভূমিতে খাদ্য-সংগ্রহ করা অনেক সহজ ছিল। খাদ্য-সংগ্রহের এই উদাসীন বৃত্তির সঙ্গে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কোনও বিরোধও ছিল না। বেদের মধ্যেই এমন ব্রাহ্মণের পরিচয় আছে, যারা এইভাবেই খাদ্য সংগ্রহ করতেন। গুরুকুলে পাঠরত ব্রহ্মচারীকেও অনেক সময় খাদ্য-সংগ্রহ করতে হত এইভাবে। নাগেরা তাই কখনও শূদ্র বা দাস-পর্যায়ভুক্ত হননি। কেন না শুদ্র বা দাসদের সঙ্গে চাষবাসের যোগ আছে। নাগমাতার পুত্র আস্তীক এবং সোমবার মুনির সম্মান দেখে একথা আরও পরিষ্কার বলা যায় যে–If the Brahmins who edited the overinflated epic could proclaim ancestry so far beyond the Aryan pale, without shame, the Nagas were in some way a very respectable people, not demons nor a low caste.

কোশাম্বী নাগ জনজাতিকে ভারতবর্ষে আর্যপূর্ব জনজাতিদের একতম মনে করেন, যাঁরা গাঙ্গেয় উপত্যকার গভীর অরণ্যভূমিতে ঘুরে ঘুরে খাদ্য সংগ্রহের বৃত্তি ত্যাগ করতে পারেননি। আমরাও আমাদের নহুষকে এক মহাবনের মধ্যে অবস্থিত দেখেছি। কাহিনীর অনুরোধে তার খাদ্যসংগ্রহের বৃত্তির মধ্যে ভীমের মতো এক খাদ্যের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আমাদের ধারণা যুধিষ্ঠির-ভীমের সঙ্গে যে নহুষের দেখা হয়েছে, তিনি পূর্বতন চন্দ্রবংশের পঞ্চম পুরুষ যে নহুষ, তার বংশধর কেউ হবেন। ঋগবেদে নহুষ তো একেবারে মনুর মতোই এক জনগোষ্ঠীর প্রতিভূর নাম। এই নহুষের সঙ্গে হয়তো বৈদিক নহুষের কোনও সম্পর্ক নেই; কিন্তু চন্দ্রবংশের পঞ্চম পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও কোনও এক নহুষের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের দেখা হওয়াটা কোনওভাবেই ব্যাখ্যা করা যায় না, যদি না তিনি ব্রাহ্মণের অভিশাপে পতিত নহুষের নাগ-বংশধর কেউ না হন।

মনুসংহিতাতেও নহুষের যে বিবরণ পাই তাতেও নহুষের সর্পত্ব স্পষ্ট নয়। সেখানে নহুষের রাজ্যচ্যুতি এবং সমাজচ্যুতিই বড় কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে–বেনো বিনষ্টো বিনয়াৎ নহুষশ্চৈব পার্থিবঃ। মনু বলেছেন–কাম এবং ক্রোধ থেকে যে সব ভ্রষ্টাচার মানুষের মধ্যে জন্মায়, রাজাদের তা পতিত করে। কামজ এবং ক্রোধজ ব্যসনের ফলে রাজারা তাদের রাজ্য হারান-বহবোবিনয়ামষ্টাঃ। মনু আবার বলেছেন–উপযুক্ত শিক্ষা এবং বিনয় যদি থাকে তবে রাজারা হারানো রাজ্যও ফিরে পান-বনস্থা অপি রাজ্যানি বিনয়াৎ প্রতিপদিরে। রাজ্য ফিরে পাওয়া এবং রাজ্য হারানো–এই দুটিই যেহেতু মনুর মতে বিনয়-শিক্ষা এবং অবিনয়ের ফলাফল, মনু তাই নাম জানিয়ে উদাহরণও দিয়েছেন সেই রাজাদের–যাঁরা অবিনয়ের ফলে রাজ্য হারিয়েছেন এবং যারা বিনয়ের ফলে রাজ্য ফিরে পেয়েছেন। আমাদের এই নহুষও কাম এবং ক্রোধের ব্যসনে মত্ত হয়ে রাজ্যচ্যুত হয়েছিলেন ঋষিদের দ্বারা। তার সর্পগতি। ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-সমাজচ্যুতির প্রতিরূপমাত্র। যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে যে নহুষের দেখা হয়েছে, সে নহুষ রাজ্যচ্যুত, সমাজচ্যুত নহুষের বংশ-পরম্পরায় নেমে আসা নাগ-জনজাতির অন্যতম প্রধান। পুরুষ। ব্রাহ্মণের অভিশাপে তার প্রাচীন পূর্বপুরুষ রাজ্যচ্যুত হয়েছিলেন বলেই যুধিষ্ঠিরের কাছে তার প্রশ্ন-মহারাজ ব্রাহ্মণ কাকে বলে–ব্রাহ্মণগা কো ভবে রাজন।

.

২৮.

চন্দ্র থেকে আরম্ভ করে পঞ্চম পুরুষ নহুষ পর্যন্ত যা দেখা গেল, তাতে পুরূরবার পুত্র আয়ু এবং চন্দ্রপুত্র বুধ ছাড়া আর তিনজন রাজার সঙ্গেই তদানীন্তন ব্রাহ্মণদের কিছু বিবাদ ঘটেছে। এই তালিকায় আছেন চন্দ্র স্বয়ং। দ্বিতীয় জন পুরূরবা এবং তৃতীয় নহুষ। ব্রাহ্মণ-সমাজের সঙ্গে ক্ষত্রিয় রাজাদের এই বিবাদ-বিসংবাদের একটা সামাজিক তাৎপর্যও আছে। পরিষ্কার বোঝা যায়–একটা কনফিউশন, একটা সংশয় তখনও চলছিল। ব্রাহ্মণ-সমাজের অনুমোদন ছাড়া রাজা সিংহাসনে বসতে পারছেন না বটে, কিন্তু রাজাদের ওপর ব্রাহ্মণরা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণও খুঁজে পাচ্ছেন না। পুরূরবা রাজ্যচ্যুত হয়েছেন ব্রাহ্মণদের দ্বারা। নহুষও রাজ্যচ্যুত হয়েছেন ব্রাহ্মণদের দ্বারা।

সন্দেহ নেই, যোদ্ধা রাজার ওপরে বেদ-যজ্ঞ নিয়ে থাকা দার্শনিক ব্রাহ্মণদের নিয়ন্ত্রণ যথেষ্টই জরুরি ছিল। দণ্ডধারী রাজার কাছে ক্ষমতা, ঐশ্বর্য এবং স্বেচ্ছাচারিতা এমনই লোভনীয় বস্তু, যা তাদের প্রমত্ত করে। এই প্রমত্ততা যখনই বেড়েছে, তখনই ব্রাহ্মণদের অভিশাপ নেমে এসেছে নিয়তির মতো। যুধিষ্ঠিরের কাছে নহুষ দুঃখ করে বলেছেন–আমার ক্ষমতা তো কিছু কম ছিল না, রাজা! অভিষেকের সময় ঋষিরা আমাকে বর দিয়েছিলেন–যার দিকে আমি দৃষ্টিপাত করব, তারই তেজ আমার মধ্যে সংক্রমিত হবে–তস্য তেজো হরাম্যা তদ্ধি দৃষ্টেবলং মম। এককালে আমি স্বর্গীয় বিমানে চড়ে সমস্ত স্বর্গভূমিতেই ঘুরে বেড়িয়েছি। ব্রহ্মর্ষিদের হাজার বেহারা আমার পাল্কি বয়ে নিয়ে গেছেন-ব্রহ্মষীণাং সহস্রং হি উবাহ শিবিকাং মম।

 নহুষ জানেন–তার পক্ষে ব্ৰহ্মর্ষিদের দিয়ে পাল্কি বওয়ানোতেও কোনও অসুবিধে ছিল না। কিন্তু স্বাধিকার-প্রমত্ততায় তার মাথায় খুন চাপল। তিনি অগস্ত্যের মাথায় লাথি মেরে বসলেন। একজন চরম শিক্ষিত লোকের এই চরম অবমাননায় হাজার জন ব্রহ্মর্ষি নিশ্চয় মুখ ফিরিয়ে ঘাড় শক্ত করে দাঁড়িয়ে ছিলেন অগস্ত্যের পিছনে। শিক্ষিত জনতার রোষ নেমে এল অগস্ত্যের অভিশাপের রূপ ধরে। নহুষ রাজ্যচ্যুত হলেন। তিনি স্বীকার করেছেন–আমার আশ্চর্য লেগেছিল, যুধিষ্ঠির! আশ্চর্য লেগেছিল। সত্য, জিতেন্দ্রিয়তা, তপস্যা, অহিংসার এ কী শক্তি, যা এক দণ্ডধারী সর্বক্ষম রাজাকেও বিপর্যস্ত করে দেয়। তাকে স্থানচ্যুত করে। তপস্যার এই শক্তি দেখে সত্যিই আমার বড় আশ্চর্য লেগেছিল–ততে মে বিস্ময়ো জাতস্ত দৃষা তপসো ফলম।

 চন্দ্রবংশের সর্বাধিক ঐশ্বর্যশালী সব চেয়ে বড় রাজার এই ইন্দ্রপতন আজ শত শত বচ্ছর পরেও চিন্তার ব্যাপার রয়ে গেছে। যে গহন বনের মধ্যে নহুষের নাগবংশীয় অধস্তনেরা যুধিষ্ঠিরের সাক্ষাৎ পেয়েছেন তাদের কাছে এখনও সেই প্রশ্নটাই বড় হয়ে রয়েছে–মহারাজ! ব্রাহ্মণ কাকে বলে? ভাবটা এই–জাতিটা তো বড় কথা নয়। আমরা নহুষ, আমরা রাজা ছিলাম। স্বর্গের দেবতাদের ওপর পর্যন্ত আমাদের পূর্বাধিকার বিস্তৃত ছিল। তবে কী এমন শক্তি এই ব্রাহ্মণ-নামক শব্দটির যা সব কিছুর ওপরে।

যুধিষ্ঠির বড় সুন্দর জবাব দিয়েছিলেন। যুধিষ্ঠির বলেছিলেন–সত্যনিষ্ঠা, ক্ষমা, চারিত্রিক বল, অনৃশংসতা, তপস্যা এবং দয়া–এই গুণগুলি যে ব্যক্তির মধ্যেই দেখা যাবে, তিনিই আসলে ব্রাহ্মণ। নহুষরূপী নাগবংশীয় বললেন–সে কী কথা যুধিষ্ঠির। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র–এই সামাজিক সংস্থানটা কি তুমি ভুলে মেরে দিলে! তুমি যেমন বলছ, তাতে তো একজন শূদ্রকেও ব্রাহ্মণ বলে সম্মান করতে হবে। কেননা ওই যে এত সব গুণের কথা বললে–সত্যনিষ্ঠা, ক্ষমা, দয়া–তা এসব গুণ তো একজন শুদ্রের মধ্যেও থাকতে পারে। তাহলে তো সেই শূদ্র ব্যাটাকেও গড় করতে হবে এখন থেকে–শূদ্রেঘপি চ সত্যঞ্চ দানমক্রোধ এব চ। তুমি হাসালে যুধিষ্ঠির।

যুধিষ্ঠির গম্ভীর হলেন। উত্তর দিলেন নিরপেক্ষ ধর্মাধ্যক্ষের মতো। বললেন–আমি যেসব সগুণের কথা বললাম, তা একজন শূদ্রের মধ্যে থাকতেই পারে। আবার বামুনের ঘরে জন্ম নিয়ে গলায় পৈতে ঝুলিয়েও একজন ব্রাহ্মণের মধ্যেও এসব গুণ না থাকতেই পারে–শদ্রে তু য ভবেল্লক্ষ্ম দ্বিজে তচ্চ ন বিদ্যতে। যুধিষ্ঠির হেঁয়ালি করে বললেন–তাহলে সে শুদ্রও শূদ্র নয়, আবার সেই ব্রাহ্মণও ব্রাহ্মণ নয়ন বৈ শূদ্রো ভবেচ্ছুদ্ৰো ব্রাহ্মণো ন চ ব্রাহ্মণঃ। কথাটা কেমন হল? সে শুদ্র, শূদ্র নয়। সে ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণ নয়। নহুষরূপী নাগবংশীয়র মাথাটা একেবারেই যেন ঘুরে গেল। চিরকাল তিনি শুনে আসছেন বামুনের ছেলেই বামুন, শূদ্রের ছেলেই শূদ্র। আর আজ এই ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের মুখে এ সব কী নতুন কথা শোনা যাচ্ছে?

নতুন কথাই বটে। এমনকি আজকের সমাজেও এটা নতুন কথা। আজকাল কতগুলি মহাপণ্ডিত দেখতে পাচ্ছি, যাঁরা দেশীয় ধর্মবাদ, দর্শন কিছুই বোঝন না, কিন্তু আরও নানারকম বাদ-প্রতিবাদ ভাল বোঝেন। স্বীকার করে নেওয়া ভাল–মহাভারতে জাতি-ব্রাহ্মণ্যবাদ বা জাতিব্রাহ্মণ্যের সপক্ষে অনেক কথা আছে। কিন্তু প্রতিবাদী পণ্ডিতেরা শুধু সেই ব্রাহ্মণ্য গোঁড়ামির জায়গাগুলি উদ্ধার করে–আমাদের ধর্ম কত সংকীর্ণ, কত জঘন্য, কত গোঁড়া–এটা বারবার প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। তাদের মাথায় যুধিষ্ঠির-নহুষের এই কথোপকথনটুকু মোটেই কাজ করে না। কাজ করে না এই কারণে যে, তাদের বক্তব্যে তাহলে আর নতুন কিছু থাকে না। তারা যে নতুন কথাটা শোনাবেন–সে নতুন কথাটা যুধিষ্ঠির আগেই বলে ফেলায় তাদের বড় অসুবিধে হয়। তাদের উদারপন্থী কথাবার্তা, নৃতত্ত্বের বড় বড় বুলির সঙ্গে মনুষ্যত্বের মশলা-মেশানো অত্যাধুনিক বচন যুধিষ্ঠিরের মুখে আগেই পরিবেশিত হওয়ায় এই অহংমানী পণ্ডিতদের বৈপ্লবিক উদারতা মূল্য হারিয়ে ফেলে। অতএব মহাভারতের অন্য কোথায় জাতি-ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতিষ্ঠা, কোথায় অনুশাসন পর্বে ব্রাহ্মণ্যের জয়-জয়কার–খোঁজ সে সব জায়গা। জনসাধারণকে দেখাও। কত সঙ্কীর্ণমনা এই লোকগুলি, ভারতবর্ষের কী ক্ষুদ্রতা! যেন অন্য কোথাও কোনও ক্ষুদ্রতা নেই। সব এই ভারতবর্ষে।

বস্তুত যুধিষ্ঠির যে কথা বলেছেন–তা যেমন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সার কথা, তেমনই তা ভারতবর্ষের অন্য ধর্মেরও পরম্পরাগত বিশ্বাস। এ বিষয়ে আমাদের ব্যক্তিগত একটা ধারণা আছে এবং সে ধারণার মধ্যে নতুনত্ব কিছু নাই থাক, তুলনামূলক বৈচিত্র্য কিছু আছে। মনে রাখতে হবে, বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ এবং দর্শনেও ব্রাহ্মণ’ শব্দটি বহুল প্রযুক্ত। একটি ব্যক্তি-মানুষের মধ্যে কোন কোন সদ্গুণ থাকলে ব্রাহ্মণ’ হওয়া যায়-এই তর্ক সেখানে নানা জায়গায় উপস্থিত। এটা কোনও আশ্চর্যের বিষয় নয়, কারণ বুদ্ধ এই কথাই বলবেন যে, জন্মের দ্বারা মানুষ ব্রাহ্মণ হয় না, গোত্র-বরের দ্বারাও ব্রাহ্মণ হয় না, মাথায় তপস্বিসুলভ জটাজুট থাকলেও ব্রাহ্মণ হয় না–ন জাটাহি ন গোনে। আশ্চর্যের বিষয় হল–মহাভারতে ব্রাহ্মণ্য-ধর্মের প্রবক্তা হিসেবে সুপরিচিত যুধিষ্ঠিরের মতো রাজ-বর্ণের মুখে ওই একই রকম কথা এল কী করে?

অতি পণ্ডিতেরা বলবেন–ওসব কথা বৌদ্ধদের কাছ থেকে ধার করা। ঠিক যেমন তারা রামায়ণের উপাখ্যানের সঙ্গে মিল দেখে দশরথ জাতকের পূর্বগামিতা প্রমাণ করেন, ঠিক সেইভাবেই এখানেও তাদের প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব কাজ করে। যুক্তি-তর্ক তাদের বড়ই সরল, কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি পক্ষপাত প্রদর্শন করলে আজকাল যেহেতু প্রগতিশীলতা বেশি প্রকাশ পায়, তাই এক্ষেত্রে বৌদ্ধধর্মের কাছে ব্রাহ্মণ্য-ধর্মের অধমর্ণতা দেখানোর আশঙ্কা থাকে খুব বেশি। আমার নিজের ব্যক্তিগত মতে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম এবং দর্শন তথা বৌদ্ধধর্ম এবং দর্শন–দুটিই পরস্পরের বিকাশে পরম পরিপূরক। যদি বৌদ্ধ দার্শনিকতা থেকেও যুধিষ্ঠিরের এবংবিধ উদারতা ঘটে থাকে, আমাদের তাতে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু আমাদের ধারণা ব্রাহ্মণ্য-ধর্মের মধ্যেও এই উদার আকাশটুকু মাঝে মাঝে দেখতে পাব, যা একেবারেই আকস্মিক নয় এবং তারও একটা পরম্পরা আছে। যুধিষ্ঠিরের কথাও তাই নতুন কিছু নয় এবং নতুন নয় বলেই সেটা আমাদের পরম্পরাগত পুরাতন দর্শন, যার চরম অভিব্যক্তি ভগবদ্গীতার মধ্যে–আমি গুণ এবং কর্মের নিরিখেই চতুর্বর্ণের বিভাগ রচনা করেছি, জন্ম-কুল দেখে নয়–চাতুর্বর্ণং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।

যুধিষ্ঠির বুঝিয়ে দিলেন–কথাটা বোঝ ভাল করে। মানুষের সগুণটাই আসল। যদি দেখ এ সব সদগুণ একজন শূদ্রের মধ্যে আছে, তবে তাকে ব্রাহ্মণ বলেই মানবে। আর যদি দেখ-কুলজাত ব্রাহ্মণের মধ্যেও ক্ষমা নেই, দয়া নেই, অহিংসা নেই, তপস্যা নেই, তবে তাকে শূদ্র বলেই চিহ্নিত করবে-যত্রৈতন্ন ভবেৎ সর্প তং শূদ্ৰমিতি নির্দিশেৎ। নহুষ বললেন–কী কথা শুনালে দাদা! চরিত্র, ক্ষমা, অনৃশংসতা–এসব দিয়ে যদি বামুন চিনতে হয়, তবে তো জাতিবর্ণের কথাটাই বৃথা হয়ে গেল। সগুণের কৃতিত্ব দিয়ে যদি শূদ্রকে বামুনের আসনে চড়াতে হয়, তাহলে চাতুর্বর্ণের ভিত্তিটাই যে নড়বড়ে হয়ে গেল-বৃথা জাতিস্তদাযুম্মন্ কৃতির্যাবন্ন বিদ্যতে।

যুধিষ্ঠির অসাধারণ একটি কথা বললেন। কথাটা তার গভীর বিশ্বাস এবং অতিসংবেদনশীল দীর্ঘনিঃশ্বাসের সঙ্গেও জড়িয়ে নিয়ে বলা যায়। যুধিষ্ঠির বললেন–জাতি! মানুষের কথা বল, বুঝি। কিন্তু মনুষ্য-সমাজে জাতির ব্যাপারটা বড়ই বিচিত্র হে। সমগ্র মানবজাতির মধ্যে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের জাতি-জম্মের বিচার যে বড়ই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। যুধিষ্ঠির হাজার হাজার বছরের পুরনো সংস্কৃতির ঘেরাটোপের মধ্যে বসে পাকা নৃতাত্ত্বিকের মতো জবাব দিলেন। বললেন–মানুষ বলে কথা। আমি যে কথা বলি, যে শব্দ ব্যবহার করি, একজন ব্রাহ্মণও সেই শব্দ ব্যবহার করে। একজন শূদ্রও সেই শব্দ ব্যবহার করে। সেই অশেষ বাক্যরাশির মধ্যে কোনও শব্দের শুদ্ধতা বজায় রাখা কি সম্ভব? বলা কি যায়–এটা ব্রাহ্মণের অভিধান, আর এটা শূদ্রের? আরও সরস উদাহরণ দিয়ে বলি–ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্র- সবার মধ্যে যে প্রথায় মৈথুন চলে, সেই প্রথার মধ্যে থেকে কখনও কি এমন পৃথকীকরণ সম্ভব যে-এটাকে বলব ব্রাহ্মণের মৈথুন আর ওটা ক্ষত্রিয়ের অথবা ওটা শূদ্রের? সম্ভব নয়। কারণ বাক্য, মৈথুন, জন্ম, মরণ-সমস্ত বর্ণে একই রকম–বামৈথুনমঘো জন্ম মরণঞ্চ সমং নৃণা।

যুধিষ্ঠির সমতার উদাহরণ দিয়ে তার আসল মত প্রতিষ্ঠা করেছেন। বলেছেন–মানুষ বলে কথা। ইন্দ্রিয় দুর্বার। এখনও পর্যন্ত এমন একটা শুদ্ধ-রক্তের সমাজ দেখাতে পারবে না, যেখানে তথাকথিত একটি জাতি অন্য জাতির রমণীতে সন্তান উৎপাদন করেনি। সবার ঘরে সবার ছেলে আছে। শূদ্ৰানীর গর্ভে ব্রাহ্মণের, ব্রাহ্মণীর গর্ভে শূদ্রর-সর্বে সর্বাস্বপত্যানি জনয়ন্তি সদা নরাঃ। কখনও রুচি-বৈচিত্র্য, কখনও বা সময় বুঝে মানুষ দেখে, তুচ্ছ জাতি শিকেয় তুলে নির্জন মিলন–টীকাকারের ভাষায়-রুচিবৈচিত্র্য প্রায়েণ রহোলাভাচ্চেতি। যুধিষ্ঠির সিদ্ধান্ত দিলেন–একমাত্র মৈথুনের মাধ্যমেই ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্রের রক্ত এমনভাবে মিশে গেছে যে তার মধ্যে থেকে একটা শুদ্ধ ব্রাহ্মণ-জাতি অথবা একটা শুদ্ধ শূদ্র-জাতি খুঁজে বার করাটা ভীষণ কঠিন হবে–সঙ্করাৎ সর্ববর্ণানা দুষ্পরীক্ষ্যেতি মে মতিঃ।

যুধিষ্ঠির এবার নৃতাত্ত্বিকের ভূমিকা ছেড়ে তত্ত্বজ্ঞের ভূমিকায় উত্তরণ করছেন। তিনি শাস্ত্রজ্ঞ, বেদ-বেদান্তের নিগুঢ় তত্ত্ব তিনি জানেন। উপরন্তু নিজের অনুভবের কথা বলেই তো আর ব্রাহ্মণ্যের বিচার চলে না। সেই জন্য তিনি পরম্পরাগত শ্রুতিবাক্য উচ্চারণ করছেন নহুষরূপী নাগবংশীয়র কাছে। বলছেনজম্মের নিয়মেই শুধু একটা মানুষ ব্রাহ্মণ হতে পারেন কি না, এ সন্দেহ আজকের নয় সর্প! এ সন্দেহ বৈদিক কাল থেকে আরম্ভ করে ঋষিদের কাল পর্যন্ত একইভাবে চলেছে। বৈদিক ব্রাহ্মণ বলেছেন–আমরা সঠিক জানি না, আমরা ব্রাহ্মণ, না অব্রাহ্মণন চৈতদবিম্মা ব্রাহ্মণাঃ স্ম বয়মব্রাহ্মণ বা। বেদের কালের যাজ্ঞিক যাঁরা, তারাও নিজেদের জন্মে বিশ্বাস করেন না। যার জন্য যজ্ঞ করার সময় সাধারণভাবে তারা একবারও বলেন না–আমরা ব্রাহ্মণেরা এই যজন-কর্ম করছি। তারা বলেন–’আমরা যারা যজন-কর্ম করছি’–অর্থাৎ নিজেদের জন্ম-ব্রাহ্মণ্যে তাদের আস্থা নেই। কিন্তু যজ্ঞ যখন করছেন, তখন তাদের শম-দমাদি গুণের প্রশ্নটা স্বতঃসিদ্ধই বটে–ত্যা যাগসামান্যে ‘যে যজামহে’ ইত্যাদি মন্ত্রপাঠো বিহিতঃ, তত্র চ ব্রাহ্মণ বয়ং যজামহে ইত্যাদ্যনুকত্বা যৎ ‘যে যজামহে’ ইত্যুক্তং তদ যাজ্ঞিকানামাত্মজন্ম-সন্দেহাদেব।

যুধিষ্ঠির শেষ পর্যন্ত ব্রাহ্মণ্যের চরম উৎকর্ষ স্থাপন করলেন ব্রাহ্মণের সবৃত্তি এবং চরিত্রে–তস্মাচ্ছীলং প্রধানেষ্টং বিদুর্যে তত্ত্বদর্শিনঃ। যুধিষ্ঠির সারা জীবন ব্রাহ্মণদের মুখে তত্ত্বকথা শুনেছেন। তার নিজের মধ্যেও ক্ষত্রিয়দের সংস্কারের চেয়ে ব্রাহ্মণের সংস্কার বেশি। ফলত তার কথা আস্তে আস্তে বড়ই তত্ত্ব-কর্কশ শুষ্ক হয়ে উঠছিল। কিন্তু একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে নহুষও তো কিছু কম যান না। যিনি জ্ঞান এবং তপস্যার বলে দেবতা এবং ঋষিদের দ্বারা স্বর্গরাজ্যে ইন্দ্রপদে অভিষিক্ত হয়েছিলেন, তার জ্ঞানও তো কিছু কম নয়। সেই জ্ঞান পরম্পরাক্রমে নেমে এসেছে তার অধস্তনের মধ্যে। নাগবংশীয় নহুষও যুধিষ্ঠিরকে কিছু উপদেশ করেছেন। সেই উপদেশ এমনই যে, তার মধ্যেও ব্রাহ্মণ্যের সংজ্ঞা হয়ে দাঁড়িয়েছে সত্যনিষ্ঠা, ইন্দ্রিয়দমন, তপস্যা, দান এবং ধর্মপরায়ণতা।

বস্তুত ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের সমাজ থেকে পতিত হয়ে অনুতপ্ত নহুষ হয়তো শম-দমের সাধনেই নিজেকেই শোধন করেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন–মানুষ জ্ঞানী বা বীর হলেও ঐশ্বর্য এবং সম্পদ তার মধ্যে মত্ততা সৃষ্টি করে, যে মত্ততা তাকে এক সময় গ্রাস করেছিল। মানুষের জীবনে যখন চরম সুখ, সুখের কুল-কিনারা পাওয়া যায় না, সেই সুখের মধ্যেই বাসা বাঁধে অভিমান আর মূঢ়তা-বর্তমানঃ সুখে সর্বো মুহ্যতীতি মতির্মম। নহুষ একসময় এই চরম সুখ পেয়েছিলেন। কিন্তু তারও মত্ততা এসেছিল এবং সে মত্ততার শাস্তিও তিনি পেয়েছেন। হয়তো মহাবনে নাগ-জন-জাতির সঙ্গে থাকতে থাকতে দিবারাত্র সেই বিস্ময়বোধ কাজ করেছে। ঋষি অগস্ত্যের কথা তার মনে পড়ে। অর্থ নয়, দণ্ডধারণ নয়, রাজত্ব নয়; শুধু সত্য, অহিংসা, তপস্যার জোর একটা মানুষকে কত শক্তিমান করে দিতে পারে। দিনের পর দিন এই ব্রাহ্মণ্য-গুণের অনুশীলনে তার পাপ-শোধন হয়েছে, বংশ বংশ ধরে সেই শোধন মুক্ত করেছে। ব্যক্তি নহুষকে এবং নহুষের পরিমণ্ডলে বাস করা নহুষ নামের নাগ-জন-জাতিকে। নহুষেরা বুঝেছেন–সত্যনিষ্ঠা, শম-দম–এইসব গুণই মানুষকে মানুষ করে তোলে। জাতিগৌরবও নয়, জন্মলব্ধ কুল-গৌরবও নয়—সাধকানি সদা পুংসাং ন জাতি ন কুলং নৃপ। নাগদের মধ্যে বাস করেও নহুষেরা আজ তাই নিজের জাতি-কুল নিয়ে বিব্রত নয়। আজকে নহুষ দলের প্রধান পুরুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে এমন একজনের, যিনি রাজ্যভ্রষ্ট বটে, তবে তার মধ্যে রয়েছে সেইসব গুণ যা শুদ্ধ ব্রাহ্মণোচিত। ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়ের সমাজচ্যুত নহুষেরা আজকে ব্রাহ্মণ্যের শুদ্ধ-সংজ্ঞায় মিলিত হয়েছেন এমন একজনের সঙ্গে যিনি তপস্যা, সত্যনিষ্ঠা এবং ধর্মের আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত। নহুষ মুক্ত হয়ে স্বর্গে গেছেন, আর যুধিষ্ঠির সত্যনিষ্ঠ হয়ে বনান্তরালে বসে আছেন হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারের সঙ্কল্প নিয়ে।

আমরা চন্দ্রবংশের পরম্পরা দেখানোর সময় যুধিষ্ঠিরের প্রসঙ্গ না টেনেও নহুষের কীর্তিকাহিনী বর্ণনা করতে পারতাম। কিন্তু এখানে নহুষের প্রতিষ্ঠা, তার রাজ্যচ্যুতি এবং পরিশেষে ব্রাহ্মণ্যের সংজ্ঞা নিয়ে যে যুধিষ্ঠিরকেও জড়িয়ে নিলাম, তার পিছনে কারণ একটা আছে। কারণটা হল–যুধিষ্ঠির যে বললেন-ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় ইত্যাদি সমস্ত বর্ণের মধ্যেই। মিলন-বিবাহ এমনভাবে সম্পন্ন হয়েছে, তাতে কোনও একটি বর্ণকে রক্তের শুদ্ধতায় চিহ্নিত করা যায় না–এই সাস্কর্য বা মিশ্রণ সুপ্রসিদ্ধ চন্দ্রবংশের সম্বন্ধেও প্রযোজ্য। আমরা দেখেছি–ক্ষত্রিয়-সংজ্ঞক চন্দ্রের সঙ্গে ব্রাহ্মণ বৃহস্পতির স্ত্রীর মিলনে বুধ জন্মালেন। বুধের সঙ্গে মিলন হল ইলার–তিনি মানবী। পুরূরবার সঙ্গে মিলন হল স্বৰ্গবেশ্যা উর্বশীর। অদ্ভুত সাস্কর্য।

যুধিষ্ঠিরের সিদ্ধান্তে আমরা রীতিমতো আধুনিকভাবে খুশি হতে পারি, কারণ মিলনের মধ্যে ভালবাসার বেদনা থাকে বলেই সন্তানের জন্মে কোনও কালিমা নেই। দেখার বিষয়, সেই সন্তানকে তার পিতা কিংবা মাতা কোন সংস্কারে সংস্কৃত করছেন। এখনও পর্যন্ত চন্দ্রবংশের প্রত্যেক পুরুষের মধ্যে শম-দম-তপস্যার গুণ দেখেছি, ভালবাসার রম্যতা দেখেছি, ভ্রষ্টাচারও দেখেছি, আবার ভ্রষ্টাচারের শাস্তি এবং অনুশোচনাও দেখেছি। শুদ্ধির বিচারে এইগুলিই বড় কথা এবং এই বড় কথাটা মনে রেখেই আমাদের নহুষের মূল বংশপরম্পরায় ফিরে যাব। কেন না চন্দ্রবংশ এবার ছড়িয়ে যাবে। শুধু প্রতিষ্ঠানপুরের চৌহদ্দির মধ্যে আর চন্দ্রবংশকে আবদ্ধ করে রাখা যাবে না।

ধরে নিতে পারি, নহুষ যখন পিতৃরাজ্যে অভিষিক্ত হলেন তার আগেই তার সঙ্গে অশোকসুন্দরীর বিবাহ হয়েছিল। আমরা আগে বলেছি–অশোকসুন্দরী নামটার মধ্যে কিছু অর্বাচীনতা আছে। কিন্তু তাই বলে তার স্ত্রীর আসল নাম কী, তা মহাভারত থেকে জানা খুব কঠিন। তবে কতগুলি মহাপুরাণে এবং হরিবংশে নহুষের স্ত্রীর নাম বিরজা এবং এই নাম সেকালের নামের সঙ্গে মেলে। পুরাণ এবং হরিবংশে বিরজার কোনও বংশ বর্ণনা নেই। শুধু বলা আছে বিরজা হলেন পিতৃন্যা’ এবং সেই পিতৃন্যার গর্ভে নহষ পাঁচ অথবা ছয়টি পুত্রের জন্ম দেন। পিতৃকন্যা’ শব্দটা শুনেই সাহেব-পণ্ডিতদের মধ্যে গুন-গুন রব উঠেছে। বিখ্যাত Pargiter সাহেব তো এক কলমের খোঁচায় বলে দিলেন-Nahusa had six or seven sons by pitri-kanya Viraja, which no doubt means his sister’.

সাহেবের সন্দেহ থাকবে কেন? তারা আমাদের ইতিহাস-পুরাণ পড়ে ফেলেছেন, বেদ পড়ে ফেলেছেন, আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নব-নবোম্মেষশালিনী প্রতিভা। ব্যস, আর আটকায় কে? বলে দিলেন-নহুষ পিতৃকন্যা বিবাহ করেছেন–মানে, নিজের বাপের মেয়েকে বিয়ে করেছেন–মানে, বোনকে বিয়ে করেছে। সাহেবের ধারণা–নিজের বোনকে বিয়ে করেছেন–এসব কথা কি জনসমক্ষে বলা যায়? তাই একটা গাল-ভরা নাম দেওয়া হল-পিতৃকন্যা’। আসলে এসব পৌরাণিকদের ‘mythologizing’. আমরা বলি-সাহেব। আমরা যা করি, আমরা তা স্পষ্টভাষায় বলি। আমাদের পিতামহ ব্রহ্মা নিজকন্যা শতরূপা–সাবিত্রীর প্রতি আসক্ত হয়েছিলেন, সে প্রবৃত্তি তিনিও লুকোননি, আমরাও লুকোইনি। এমনকি ব্ৰহ্ম পিতার কাণ্ড দেখে তার ছেলেদের পর্যন্ত মাথা নিচু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে অবস্থাতেও তিনি অহো রূপং অহো রূপং’ করতে করতে তার সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। এ ঘটনার মধ্যে যত রূপই থাক, আমরা লুকোইনি। লুকোনো আমাদের স্বভাব নয়। নমস্য মুনি-ঋষি, দেবতা থেকে আরম্ভ করে বাপ-ঠাকুরদা কারও অপকর্ম আমরা লুকোইনি। খামোখা এটাই বা লুকোতে যাব কেন?

আসলে সাহেব আমাদের বেদ-পুরাণ সব পড়েছেন, কিন্তু আসল সংস্কারটাই ধরতে পারেননি, ট্রাডিশনটাও নয়। তুলনা দিতে সাহেবের জুড়ি নেই। তিনি হরিবংশের প্রমাণ দিয়ে বলেছেন–শুকদেবের মেয়ে কৃত্বীও একজন পিতৃকন্যা। কিন্তু হরিবংশ বলেছে স্বয়ং শুকদেবের ওইরকম একটি কন্যা ছিল। তার নাম কৃত্বী। শুকদেব সেই মেয়েকে বিয়ে। দিয়েছিলেন আজমীঢ় বংশের ‘অণুহ’র সঙ্গে।

বঙ্কিমি ভাষায় বলতে হয়–ইহার দ্বারা কিসের উপপত্তি হইল? কিছু প্রমাণ হল কি? পারজিটারের ধারণায় এবং ভাষায় কৃত্বী যে শেষ পর্যন্ত শুকদেবের কন্যা রইলেন তা মনে হয় না। তার বক্তব্য-–The genealogies say that Nahusa’s sons were born of pitri kanya Viraja, connect a pitri-kanya with Visvamahal and call kritvi a pitri kanya. There can be no doubt that the word meant ‘father’s daughter’ that is ‘sister’ for union between brother and sister was not unknown, as Rigveda x. 10 about Yama and Yami shows.

বেদে কি যম-যমীর মিলন আছে নাকি? আমরা জানতাম না। ঋগবেদের বর্ণনায় যমী এই রকম একটা কুপ্রস্তাব দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু যম সেটা মানেননি। অপিচ ভ্রাতা-ভগিনীর মধ্যে এইরকম অস্বস্তিকর আচরণ যে বিহিত নয়, তা বারবার যমের মুখেই শোনা যাচ্ছে। যা নিবারিত হল, তা যে কী করে বিধি হয়ে ফিরে এল, তা জানি না। ভ্রাতা-ভগিনীর ইনসেসচুয়াস রিলেশন’ নিষিদ্ধ করার জন্য যে মন্ত্রবর্ণ রচিত হল, তা যে কী করে সিদ্ধরূপ লাভ করল (was not unknown) তা আমরা বুঝলাম না। আর শুকদেবের উদাহরণটা তো মিললই না। হরিবংশ বলেছে-শুকদেব তার কৃত্বী নামের কন্যাকে বিবাহার্থে অণুহের হাতে দিয়েছেন। এরপর কথক ঋষি-ঠাকুর বলছেন–আমরা সনৎকুমারের কাছে শুনেছি যে ইনি একজন পিতৃকন্যা ছিলেন–সা ঘদ্দিষ্টা পুরা ভীষ্ম পিতৃকন্যা মনীষিণী। এর থেকে Pargiter এর সিদ্ধান্ত–Nahusa and Visvamahat married their sisters and half-sisters and the same may be presumed of…Suka.

ডট-ডটের মধ্যে আরও কতগুলি নাম আছে। সাহেব যে কোথা থেকে এসব বানালেন তা সাহেবরাই জানেন। Pargiter এর ওপর শত শ্রদ্ধা রেখে জানাই, হরিবংশ কিংবা পুরাণ তার ইষ্টসিদ্ধির জন্য সেইভাবে পড়া থাকলেও পিতৃতত্ত্ব তিনি তত যুৎসই করে বোঝেননি। সাহেব যদি যত্ন করে হরিবংশের পূর্ব পূর্ব অধ্যায়গুলি মন দিয়ে পড়তেন, অথবা পড়তেন অন্য পুরাণগুলি তাহলে আর তাকে হঠাৎ করে পিতৃকন্যার এই আজগুবি তত্ত্ব ফেঁদে বসতে হত না। মনে রাখতে হবে, প্রত্যেক পুরাণে, হরিবংশে এবং মহাভারতে পিতৃগণ’ এবং পিতৃবংশ’ বলে একটা ভাবনা-চিন্তা আছে, সাহেব সেটা কিছুই বোঝেননি।

Pargiter হরিবংশে নহুষ এবং শুকদেবের ভগিনী-বিবাহ কল্পনা করেছেন। আমরা সেই হরিবংশ থেকেই জানাচ্ছি যে, আমাদের ভাবনায় সাতজন ঋষিস্বরূপ ব্যক্তি পিতৃপুরুষ নামে খ্যাত। এঁদের চারজনকে দেখা যায়, তিনজনকে দেখা যায় না। এঁরা যোগাচারী পুরুষ, কখনও বা যোগষ্টও হয়েছেন এবং তারপর আবার ব্রহ্মবাদী ঋষি হয়ে জন্মেছেন। পুরাণের ঋষিকল্পে আপনারা পুলহ, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য প্রমুখ প্রজাপতির নাম পাবেন। এরাই প্রথম লোকসৃষ্টি করেন। এই পুলস্ত্যের মানসী কন্যার নাম পীবরী। মানসী শব্দটার মধ্যে যদি আপনারা ধোঁকাবাজির গন্ধ পান, তাহলে ধরে নিন, কোনও অনামা স্ত্রীর গর্ভে পীবরী জন্মেছিলেন। এই পীবরী নিজে যোগিনী, যোগীর পত্নী এবং যোগীর মাতা। লক্ষ করে দেখবেন পীবরী শুধু পুলস্ত্যেরই কন্যা নন, তিনি অন্যান্য পিতৃগণেরও কন্যা। আমাদের স্বগত ধারণা–পুরাকালে যে সমস্ত কন্যা-সন্তান পিতামাতার অবহেলা লাভ করতেন, অথবা বাপ-মা-ভাইরা যে সমস্ত মেয়ের ভরণ-পোষণ করতেন না, তারাই এসে জুটতেন ঋষিদের আশ্রমে।

ঋষির ঘরে খাবার-দাবারের অভাব হত না। এঁরা মমতায় ভালবাসায় ঋষির আশ্রম আলোকিত করতেন, কাজকর্মও করে দিতেন। আমাদের ধারণা, এই নামগোত্রাহীনা রমণীরাই পিতৃকন্যা বলে পরিচিত হন। ঋষির আশ্রমে যেহেতু কাম-ক্রোধের প্রশ্রয় নেই অতএব এঁদের ধর্মসাধন, যোগসাধন করতে হত। হরিবংশ বলেছে–সর্বাচ্চ ব্রহ্মবাদিন্যঃ সর্বাশ্চৈবোর্ধরেতসঃ আপনারা কালিদাসের লেখায় মহর্ষি কণ্বের আশ্রমে–অনসূয়া-প্রিয়ংবদার কথা শুনেছেন। তাদের অন্য কোন পিতৃ-মাতৃ পরিচয় নেই। তারা ক-মুনির ঔরসজাত কন্যাও নন। আমাদের ধারণা, এঁদের মতো সাধনপুরা রমণীরাই পিতৃকন্যা। কশ্বশ্রমের আর‍্যা গৌতমীও তাই। সুপাত্র পেলে মুনিরা এঁদের বিয়েও দিয়ে দিতেন, নইলে তারা আশ্রমেই থেকে যেতেন যোগচারিণী হয়ে।

পুলস্ত্যের যোগচারিণী কন্যা পীবরীর সঙ্গে শুকদেবের বিয়ে হয় এবং পীবরীর গর্ভে শুকদেবের চার পুত্র এবং কন্যা কৃত্বীর জন্ম হয়। এই কৃত্বীর সঙ্গেই অণুহের বিয়ে হয় এবং কৃত্বীর পুত্র পুরাণে সুবিখ্যাত ব্ৰহ্মদত্ত

স (শুকদেবঃ) তস্যাং পিতৃকন্যায়াং পীবৰ্যাং জনয়িষ্যতি।
কৃষ্ণং গৌরং প্রভুং শম্ভং কৃত্বীং কন্যাং তথৈবচ।
ব্ৰহ্মদস্য জননীং মহিষীং তৃহস্য চ।

 এখানে যে কোথায় শুকদেবের সঙ্গে তার নিজের বোনের বিয়ে হল, তা সাহেবের ঈশ্বরই জানেন। সাহেব হরিবংশ থেকে শুকদেবের উদাহরণ দিয়েছেন আমরাও শুকদেবের ঘটনার নিরিখেই নহুষের কথা বলি। লক্ষ্য করলে দেখবেন–হরিবংশে ‘বৈরাজ’ পিতৃগণের নাম আছে, বিরাজ-প্রজাপতির পুত্রেরা বৈরাজ’ নামে বিখ্যাত বিরাজস্য দ্বিজশ্রেষ্ঠ বৈরাজা ইতি বিশ্রুতা। নহুষের সঙ্গে যে পিতৃকন্যা বিরজার বিবাহ হয়েছিল, এই বিরজাও সম্ভবত ‘বৈরাজ’ পিতৃগণের যোগচারিণী কন্যা হবেন। মৎস্য পুরাণে পরিষ্কার বলা আছে–পুলহ-প্রজাপতির বংশে যে পিতৃগণ ছিলেন, তাদেরই মানসী কন্যার নাম বিরজা, যিনি নহুষের পত্নী, যযাতির জননী।

পুলহাঙ্গজদায়াদা বৈশ্যাস্তান্ ভাবয়স্তি চ।
এতেষাং মানসী কন্যা বিরজা নাম বিতা।
যা পত্নী নহুষস্যাসী যযার্তেজননী তথা

এখানে কি কোথাও পেলেন যে, বিরজা নহুষের নিজের বোন। এক সাহেব ইন্দ্রিয়গ্রাম’ অর্থ করেছেন village of senses. Pargite-এর পিতৃকন্যাও সেই রকম–father’s daughter. হাসব না কাঁদব। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে প্রজাপতিদের বংশ বর্ণনায় বৈরাজ পিতৃগণের কথা আছে–ভৃণ্ডশ্চ বিরজাশৈক কাশী চোশ্চ ধর্মবিৎ। নহুষপত্নী বিরজার নাম তাই কোনও অভাবনীয় ব্যাপার নয়। তার ‘পিতৃকন্যা’ হওয়াটাও কোনও অবৈধ ব্যাপার নয়।

মহামতি Pargiter-এর ভ্ৰম উপস্থিত হয়েছে কেন, আমরা জানি। আধুনিক প্রগতিশীল অনেক গবেষকের উর্বর প্রতিভার সঙ্গে Pargiter-এর প্রতিভাও তুলনীয়। প্রাচীনেরা রমণীকে সবসময়েই ভোগ্যবস্তু হিসেবে ভেবেছেন–এই চরম ধারণা থেকেই এই মতের সৃষ্টি। পিতৃকন্যার মতো শব্দগুলি এই পূর্বকল্পিত ধারণা বা অবসেশন’ থেকেই অপব্যাখ্যাত হয়েছে। প্রাচীনদের মতো অনসূয়া-প্রিয়ংবদার সমগোত্রীয় রমণীর প্রতি যদি আজও সেই সমব্যথা থাকত, তাহলে গবেষকরা বুঝতেন, প্রাচীন ঋষি-মুনিদের আশ্রমবাড়িতে নাম-গোত্রহীন কত পিতৃকন্যা’ সসম্মানে জীবন কাটিয়ে গেছেন। তাদের কারও বিবাহ হয়েছে, কারও বা হয়নি। যাঁর বিবাহ হয়ে যেত, সে পুরাতনী সখীর গলা ধরে পিয়সহি’ বলে কাঁদত, আর ঋষি-পিতা সান্ত্বনা দিয়ে বলতেন–ওদের জন্য অমন করে কেঁদো না, বৎসে! ওদেরও তো বিয়ে দিতে হবে-বৎসে, ইমে অপি প্রদেয়ে। এরাই আমাদের ধারণায় পিতৃকন্যা, পৌরাণিক ব্যাখ্যায় নাই বা গেলাম।

না, অনসূয়া-প্রিয়ংবদার বিয়ে হয়নি। হলেও আমরা জানি না। তারা কাব্যে উপেক্ষিতা। কিন্তু নহুষের বেলায় বেশ বুঝতে পারি, তার জীবনের প্রথম কল্পে ঋষি-মুনিদের সঙ্গে যখন তার দহরম-মহরম চলছে, তখনই কোনও আশ্রমবাসিনী ‘পিতৃকন্যা’ বিরজার সঙ্গে তার বিবাহ হয়েছিল। পরবর্তী পৌরাণিক সেই পিতৃকন্যার প্রতি অনুকম্পায় তার নতুন নামকরণ করবেন–অশোকসুন্দরী। কিন্তু যত সুন্দরীই তিনি হোন, তাকে যোগচারিণী তপস্বিনী করে রাখতে পৌরাণিক কিন্তু ভুলবেন না। গল্পের গরু যেমন করে লাফিয়েই গাছে উঠুক, বিরজা নামের সেই পিতৃকন্যার স্মৃতিটি অর্বাচীন পুরাণের কথক ঠাকুর ভুলতে পারেননি বলেই অশোকসুন্দরীকে নির্জন বনে নহুষের জন্য তপস্বিনী করে রেখেছেন–তস্য হেতোস্তপস্তেপে নিরালম্বা তপোবন–অথবা সেই কারণেই অশোকসুন্দরীও শিব-শিবানীর মানসকন্যা। আমরা ‘পিতৃকন্যা’ শব্দের যে অর্থকল্পনা করেছি, তাতে মানসকন্যাকে পিতৃকন্যা বলতে অসুবিধে নেই কোনও। যে অর্থে অশোকসুন্দরী মানসকন্যা সেই অর্থে বিরজাও পিতৃকন্যা। মানুষটি একই, নামভেদমাত্র।

পিতৃকন্যা বিরজার গর্ভে নহুষের ছ’টি ছেলে। পুরাণগুলিতে ছেলের সংখ্যা কোথাও পাঁচ, কোথায় ছয়, কোথাও বা সাতটি। মহাভারতে ছয় ছেলের নাম-যতি, যযাতি, সংযাতি, আয়াতি, অয়তি এবং ধ্রুব। পুত্রসংখ্যা ছয় কি সাত, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল–প্রথম দু’জন ছাড়া আর কারও না জন্মালেও চলত। কালিদাস এক স্বয়ংবর সভার চিত্রে নায়ক পদবির এক পুরুষের কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন–দুনিয়ায় অনেক ছোটখাট রাজা থাকলেও যে ব্যক্তির দিকে আঙুল দেখিয়ে বলা যায়–এই রাজার জন্য পৃথিবী নিজেকে সনাথা রাজস্বতী মনে করেন, ইনি তাই। নহুষের ছয় পুত্র থাকা সত্ত্বেও ইন্দ্রত্ব-পাওয়া পিতার পিতৃত্ব যে পুত্রের দ্বারা সার্থক হয়েছে, তিনি হলেন যযাতি।

নহুষের প্রথম এবং জ্যেষ্ঠ পুত্র হলেন যতি। যতি শব্দের সাধারণ অর্থ যোগী, মুনি। নহষ-পুত্র যতির ক্রিয়া-কলাপও তার নামের অর্থের মতোই। তিনি মুনিবৃত্তি অবলম্বন করে বনবাসী হলেন ব্রহ্মোপলব্ধির পরম আনন্দ উপলব্ধি করার জন্য। ধারণা হয়–পিতা নহুষকে তিনি চরম ঐশ্বর্যের মধ্যে দেখেছেন এবং একই সঙ্গে ঐশ্বর্যের মোহে তার বিকারগুলিও তিনি লক্ষ্য করে থাকবেন। পরিশেষে নিরাসক্ত মুনিদের দ্বারা তাকে স্বর্গভ্রষ্ট হতেও দেখেছেন। পিতার সমস্ত ঘটনা হয়তো নহুষের প্রথম পুত্রের মনে নির্বেদ এনে দিয়েছে। তিনি মুনি হয়ে গেলেন–যতিন্তু যোগমস্থায় ব্রহ্মীভূতোভবন মুনিঃ।

নহুষের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের সেই কথোপকথন স্মরণ করুন। যুধিষ্ঠির যে জাতি-বর্ণ মাথায় তুলে দিয়ে শুধু গুণ এবং সদাচারের নিরিখে ব্রাহ্মণত্ব নির্ধারণ করেছিলেন, নহুষের প্রথম পুত্রই তার উদাহরণ। তৎকালীন সময়ে পিতা স্বর্গভ্রষ্ট তথা ক্ষত্রিয় সমাজ থেকে পতিত হওয়া সত্ত্বেও, তার প্রথম পুত্রের ব্রাহ্মণতে বাধা হয়নি। সমাজ তাকে ব্রহ্মভূত প্রসন্না মুনির সম্মান দিয়েছে।

যতি বনবাসী হলে নহুষের দ্বিতীয় পুত্র রাজা হলেন। শুধু রাজা নন, সম্রাট। অকৃত্রিম রাজগুণের সঙ্গে বিনয়শিক্ষা মিশ্রিত হওয়ায় তার দিন আরম্ভ হত দেবতার পূজা এবং পিতৃপুরুষের তর্পণের মধ্য দিয়ে। অনুপমাচী ব্রাহ্মণদের যাতে কথঞ্চিৎ বৃত্তির ব্যবস্থা হয় তার জন্য মাঝে মাঝে দান-যজ্ঞের ব্যবস্থা করতেন যযাতি–ঈজে চ বহুর্ভি মুখৈঃ। আর সবার ওপরে ছিল প্রজাপালনের হিতৈষণা। একদিকে সুপ্রযুক্ত পররাষ্ট্রনীতি, অন্যদিকে প্রজারঞ্জন–এই দুয়ে মিলে যযাতির সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দৃঢ়ভিত্তির ওপর। যযাতির বংশ থেকেই যেহেতু মহাভারতের কথা এবং ভারতীয় রাজনীতিতে নতুন ধরনের জটিলতা এবং নবতর মাহাত্ম সূচিত হয়েছে, তাই যযাতিকে আমাদের দেখতে হবে অসীম গুরুত্ব দিয়ে নতুন ভাবনায়, নতুন আলোয়, নতুন পর্ববিভাগে।

.

২৯.

 স্বর্গরাজ্যের অবস্থা মোটেই ভাল যাচ্ছিল না। দৈত্য-দানবের আক্রমণ তো ছিলই। তার মধ্যে দেবরাজ ইন্ত্রের ক্রিয়াকলাপ এবং রাজ্য-শাসনও নিশ্চয় ভাল ছিল না। ভাল হলে, তাকে স্বর্গ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হত না, মর্তের মানুষ নহুষকেও বরণ করে নিয়ে যেতে হত না স্বর্গের রাজত্ব করার জন্য। তবে যত অন্যায়ই করুন, ইন্দ্র নিজের ভুল বুঝতে পারতেন খুব তাড়াতাড়ি। তাই নিজেকে সংশোধন করার সঙ্গে সঙ্গে ব্রহ্মা-বিষ্ণুর মতো মহত্তর দেবতাদের সাহায্য পেতেও তার দেরি হত না।

আগে যে ইলাবৃত-বর্ষের কথা বলেছিলাম, স্বর্গ এখন আর সে জায়গায় নেই। সেটা বোঝাও যায়। বেদের মধ্যে সিন্ধু নদীর গুরুত্ব অনেক বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, অপিচ বেদোত্তর যুগে হিমালয় এবং মানস সরোবরের কাছাকাছি অঞ্চলগুলির প্রাধান্যের নিরিখে বোঝা যায়–স্বর্গরাজ্যের ঠিকানা বদলে গেছে। মহাভারতের বনপর্বে অর্জুন যখন তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করে স্বর্গে ঘুরে এলেন, তখন স্বর্গের রথ যেখানে তাকে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল সেটা গন্ধমাদন পর্বতের কাছে একটা জায়গা। স্বর্গ যে সেখান থেকে খুব দূরে তো মনে হয় না। বরঞ্চ বলা যায়–স্বর্গ এখন অনেকটাই মানুষের নাগালের মধ্যে। মানুষ সেই স্বর্গে যায়। দেবতাদের সঙ্গে তার দেখা হয়, দরকারে সাহায্যও করে।

স্বর্গরাজ্যের সব চেয়ে বড় সমস্যা হল দৈত্য-দানবদের আক্রমণ। দৈত্য এবং দানবদের মধ্যে পার্থক্য বেশি কিছু নেই। এঁরা সবাই দেবতাদের বৈমাত্রেয় ভাই। একই পিতার সন্তান মহর্ষি কশ্যপের পুত্র। পার্থক্য শুধু, দেবতারা কশ্যপের প্রথমা পত্নী অদিতির পুত্র, দৈত্যেরা দ্বিতীয়া পত্নী দিতির পুত্র, আর তৃতীয়া পত্নী দনুর পুত্র হলেন দানবেরা।

নহুষের পিতা আয়ু যাকে বিয়ে করেছিলেন, পুরাণে তার নাম কোথাও প্রভা, কোথাও বা বাহুপুত্রী।-পুরূরবসো জ্যেষ্ঠ পুত্রো বস্তু আয়ুর্নাম স বাহোর্দুহিতরমুপযেমে। কিন্তু মহাভারতে এবং অধিকাংশ পুরাণে আয়ুর স্ত্রীর কোনও নাম নেই, তিনি শুধুই স্বর্ভানবী অর্থাৎ স্বর্ভানু রাজার কন্যা। আমাদের ধারণা স্বর্ভানু একজন দানব রাজা। মহাভারতে দনুপুত্র দানবদের লিস্টিতে তার নাম আছে–স্বর্ভানুরশ্বেশ্বপতিঃ। সেকালে এটা কিছু অপূর্ব নয়। দৈত্য-দানবদের অনেক মেয়েই মানুষের গৃহবধূ হয়ে এসেছেন। তাদের চাল-চলনও যথেষ্ট মানুষোচিত এবং যথেষ্টই ভদ্র।

আগেই বলেছি–নহুষের রাজা হতে হয়তো কিছু দেরি হয়েছিল। কিন্তু তার এক ভাই রজিও ছিলেন বিখ্যাত রাজা। রজি যখন রাজা হলেন মর্ত্যভূমিতে, তখন স্বর্গরাজ্যে দেবাসুর সংগ্রাম চলছে পুরোদমে। দৈত্যদের রাজা তখন বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদ। প্রহ্লাদ পরম বৈষ্ণব হলে কী হবে, তার দাপট কিন্তু সাংঘাতিক। দৈত্য-বাহিনী নিয়ে প্রহ্লাদ স্বর্গরাজ্য আক্রমণ করেছেন। দেবতাদের মধ্যে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠছে। দেবতাদের উদ্যোগের বিরাম নেই। সমস্ত দেব-বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছে আত্মরক্ষায়। দুপক্ষের তুমুল সংগ্রাম চলছে, কেউ জিতছেও না, হারছেও না। দেবতারা দৈত্যদের মেরে সাফ করে দিতে চান। অসুর-দৈত্যরাও স্বর্গধাম থেকে দেবতাদের নাম চিরতরে মুছে দিতে চান। কিন্তু যুদ্ধে দু-পক্ষই সমান হওয়ার দরুন একসময় তারা যুক্তি-বুদ্ধি করার জন্য লোক-পিতামহ ব্রহ্মার কাছে এসে পৌঁছলেন–পরস্পরবধেন্সবো দেবাশ্চ অসুরা ব্রহ্মাণং পছু।

দেবতারা ব্রহ্মাকে বললেন–ঠাকুর! আমরা কি এই যুদ্ধে জিতব? একই সময়ে অসুর-দৈত্যরাও জিজ্ঞাসা করলেন–আমাদের অবস্থাটা কী বুঝছেন? আমরাই কি জিতব? প্রজাপতি ব্রহ্মা দুই পক্ষেরই ঠাকুরদাদা। তিনি আর কী বলবেন? অনেক ভেবে-চিন্তে দু-পক্ষেরই মন রেখে তিনি জবাব দিলেন– তোমাদের দু-পক্ষের মধ্যে মর্ত্যভূমির রাজা রজি যাঁদের হয়ে অস্ত্র হাতে তুলবেন, তাঁরাই এই ভয়ংকর যুদ্ধে জয় লাভ করবেন-যোমর্থে রজিরাত্তায়ুবধা যোৎস্যতীতি। ব্রহ্মা রজির অনেক প্রশংসা করলেন। বললেন-রজির যেমন ধৈর্য, তেমনটি কারও নেই। যেখানে ধৈর্য, সেইখানেই বিজয়-লক্ষ্মীর চিরাবাস। তোমরা রজির কাছে যাও। তিনি যে পক্ষে যুদ্ধ করবেন, সেখানেই জয়।

ব্রহ্মার কথা শুনে সুরাসুর দুই পক্ষই রজির সঙ্গে সমঝোতা করতে গেলেন। দৈত্যরা বললেন–মহারাজ! আমরা আপনার সাহায্যপ্রার্থী। আপনি আমাদের জয়ের জন্য ধনুর্ধারণ করুন–উঁচু রম্মজ্জয়ায় ত্বং গৃহাণ বরকামুক। মর্ত্যভূমির রাজা রজি দেখলেন–এই সুযোগ! একজন উন্নতিকামী রাজা নিজের স্বার্থ দেখবেন আগে। তারপর অন্যকে সাহায্য করার প্রশ্ন আসবে। রজি বললেন–যুদ্ধ করব নিশ্চয়, তবে যাদের হয়ে আমি যুদ্ধ করব, তারা জিতলে স্বর্গের ইন্দ্রপদ আমাকে দিতে হবে–ইন্দ্রো ভবামি ধর্মেণ ততো যোৎস্যামি সংযুগে। দৈত্য-দানবেরা সরল মানুষ। রজির প্রস্তাব শুনেই তারা বললেন-দেখুন, আমাদের মনে-মুখে এক। বলব একরকম, আর করব একম-এ আমাদের চরিত্র নয়–ন বয়মন্যথা বদিষ্যামোন্যথা করিষ্যামঃ। দৈত্যরা তাদের মনের কথা পরিষ্কার করে বললেন–আমাদের ইন্দ্র হলেন প্রহ্লাদ। আমাদের যত চেষ্টা, যত উদ্যম–সবই তার জন্য। আমরা যে যুদ্ধে জয়। চাই, সেও তারই জন্য–অস্মাকমিন্দ্র প্রহ্লাদো যস্যার্থে বিজয়ামহে। অতএব মহারাজ! আমরা এরকম কোনও আগাম কথা দিতে পারব না যে, যুদ্ধে জিতলে আপনাকেই আমরা ইন্দ্র বানাব। দুঃখিত মহারাজ। আমাদের কিছু করার নেই।

অসুরেরা চলে গেলে এবার দেবতারা এলেন রজির কাছে। নিজের স্বার্থ এবং ইন্দ্ৰত্বের যশঃপ্রার্থী রজি দেবতাদের কাছেও সেই একই প্রস্তাব দিলেন–যুদ্ধ জিতলে আমাকে কিন্তু ইন্দ্রের পদটি দিতে হবে। দেবতারা সময় বুঝে বললেন-সে আর বলতে! আপনি যা বলছেন, তাই হবে। যুদ্ধে যদি অসুরদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করি, তো, আপনিই ইন্দ্র হবেন– ভবিষ্যসীন্দ্রো জিত্বৈবং দেবৈরুক্তস্তু পার্থিবঃ।

 আয়ুপুত্র রজি দেবতার কথা বিশ্বাস করে দেবতাদের জন্য অসুরদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করলেন এবং যুদ্ধে জয় লাভ করলেন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইন্দ্র রজির কাছে এসে রজির পা দুটি নিজের মাথায় রাখলেন–রজি-চরণ-যুগল আত্মাশিরসা নিপীড্যাহ। বললেন-মহারাজ! আপনি আমার মা-বাপ। অসুরদের ভয় থেকে আপনি আমাদের রক্ষা করেছেন বলে, আজ থেকে আপনি আমার পিতা হলেন–ভয়ত্রাণদানাদস্মৃৎপিতা ভবান্।

নীতিশাস্ত্রে পাঁচ রকমের ব্যক্তিত্ব পিতার সংজ্ঞায় ভূষিত। যিনি অন্ন দান করেন, যিনি ভয় থেকে বাঁচান, যিনি কন্যা দান করেন, যিনি জন্মদাতা এবং যিনি উপনয়ন দেন–এই পাঁচ রকমের পিতার সংজ্ঞা বলা আছে স্মৃতিশাস্ত্রে। সম্ভবত পিতৃত্বের এই অভিধান মাথায় রেখেই ইন্দ্র বললেন–আপনি অসুরবিজয় সম্পন্ন করে আমাদের ভয় অপনোদন করেছেন; অতএব দেবতাদের মধ্যে আপনি ইন্দ্র বলে পরিচিত হলেন সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি ইন্দ্র আজ থেকে আপনার ছেলে বলেই পরিচিত হব–যস্যাহমিন্দ্রঃ পূত্রস্তে খ্যাতিং যাস্যামি কর্মভিঃ।

ইন্দ্রের কথার মধ্যে মায়া ছিল। কৌশল ছিল। ধরুন, কোনও পিতা তার সন্তানকে কোনও একটি অঙ্গরাজ্যের রাজা করে দিয়েছেন। হঠাৎ সন্তান সেই রাজ্য নিয়ে বিপাকে পড়ল। পিতা এলেন সন্তানের জন্য যুদ্ধ করতে। যুদ্ধে যদি জয় লাভ করা যায়, তবে পিতা কী করেন? তিনি পুনরায় তার সন্তানকে আপন রাজ্যে সুস্থিত করে ফিরে আসেন। দেবরাজ ইন্দ্র যে রজির পায়ে মাথা খুঁড়ে তার পুত্রত্ব স্বীকার করে নিলেন তার একটাই মানে। অর্থাৎ পিতা হয়ে কি কেউ পুত্রের রাজ্য দখল করে সেই রাজ্যের রাজা হয়ে বসেন? রজি ইন্দ্রের চালাকি সব বুঝলেন। কিন্তু সব বুঝলেও তিনি চন্দ্রবংশের গরিমা বহন করেন। শত্রুপক্ষে থেকেও যদি কোনও প্রধান-পুরুষ এইভাবে পায়ে মাথা ঠেকিয়ে নিজের দৈন্য প্রকাশ করে, তবে তাকে তার অভীষ্ট বস্তু ফিরিয়ে দিতেই হয়–অনতিক্ৰমণীয়া হি বৈরিপক্ষাদপ্যনেকবিধ-চাটু-বাক্যগর্ভা প্রণতিঃ।

রজি ইন্দ্রের রাজ্য ফিরিয়ে দিয়ে নিজের রাজ্যে ফিরে গেলেন। স্বর্গে ইন্দ্র রাজত্ব করতে লাগলেন–শতক্রতুরপীত্বং চকার। অসুর-বিজয়ের পরিবর্তে স্বর্গে ইন্দ্র হওয়ার যে ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন রজি, স্বয়ং ইন্দ্রের মায়া-চাটুবাদে তা বিফল হয়ে গেল। রজি মর্ত্যভূমিতে নিজের রাজত্ব চালিয়েই শেষ পর্যন্ত মারা গেলেন। এইবারে আসল লড়াই আরম্ভ হল। পিতার সম্পত্তির দায়ভাগ নিতে আধুনিক যুগে যে মামলা চলে, এবার সেই মামলার শুনানি আরম্ভ হল রজির মৃত্যুর পর।

ইন্দ্র রজির পুত্রত্ব স্বীকার করে নিয়ে স্বর্গের অধিকার ফিরে পেয়েছিলেন। এদিকে মর্ত্যভূমিতে রজির পুত্র ছিলেন পাঁচশোজন। পৌরাণিকতার অতিবাদে রজির পুত্রসংখ্যা পাঁচশো নাই হোক, অন্তত অনেকগুলি পুত্র তার ছিল। তারা অত্যন্ত বলশালী এবং যুদ্ধবীর বলে খ্যাত ছিলেন। সবাই তাঁদের রাজেয়’ ক্ষত্রিয় উপাধি দিয়েছিল। রজির মৃত্যুর পর তারা সিদ্ধান্ত নিলেন–পিতা নিজে ইন্দ্র হতে না পেরে পুত্রত্ব-স্বীকার করা দেবরাজকে ইন্দ্রত্ব দিয়েছেন। কিন্তু রজির পুত্রত্বই যদি ইন্দ্রত্ব লাভের প্রধান মাপকাঠি হয়, তবে তারাই তো এখন। স্বর্গরাজ্যের আসল দাবিদার। আইনের সব দিক ভেবে রাজেয় ক্ষত্রিয়রা ইন্দ্রের কাছে গেলেন। পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারে সমস্ত আইন দেখিয়ে তারা বললেন-ইন্দ্ৰত্বের অধিকার এখন আমাদের। তার নিজের ছেলেরা যেখানে বেঁচে আছে, সেখানে আপনার কোনও অধিকার টেকে না। বলা বাহুল্য রজির ছেলেদের পক্ষে প্রধান উকিল ছিলেন দেবর্ষি নারদ নারদর্ষিচোদিতা রজিসুতাঃ শতক্রতু আত্মপিতৃপুত্রসমাচারা রাজ্যং যাচিতবন্তঃ।

ভাল কথায় ইন্দ্র রাজ্য দিলেন না। রজির পুত্রের সঙ্গে সঙ্গে স্বর্গরাজ্য আক্রমণ করলেন। তারা অসীম শক্তিধর। অতি সহজেই ইন্দ্রকে তারা পরাস্ত করলেন এবং স্বর্গ অধিকার করে নিলেন–অবজিত্য ইম্ অতিবলিনঃ স্বয়ংমিত্বং চঃ। অনেক কাল চলে গেল। ইন্দ্র কিছুই করতে পারলেন না। পৃথিবীর মানুষেরা ইন্দ্রকে প্রায় ভুলতে বসেছিল। তারা কেউই আর ইন্দ্রের সন্তুষ্টির জন্য যাগ-যজ্ঞের আয়োজন করে না। অগ্নিতে এক ফোঁটাও ঘৃতাহুতি দেয় না ইন্দ্রের উদ্দেশে। ইন্দ্র শেষে মনের দুঃখে দেব-পুরোহিত বৃহস্পতির কাছে গিয়ে বললেন আপনি আমার জন্য একটু ঘি আর এক টুকরো পুরোডাশের ব্যবস্থাও কি করতে পারেন না?

পুরোডাশ এক ধরনের পিঠের মতো জিনিস। পূর্বকালে বৈদিক-যজ্ঞে ঘি আর পুরোডাশ দেবতার উদ্দেশে আহুতি দেওয়া হত। ইন্দ্রের করুণ কথা শুনে বৃহস্পতি নানা যাগ-যজ্ঞ করে ইন্দ্রের তেজোবৃদ্ধি করলেন। নিজে গিয়ে রজির ছেলেদের নানা কথা বলে বিভ্রান্ত করলেন। তাদের বোঝালেন–বেদ-ব্রাহ্মণ কিছু নয়। তোমরাই সব। বৃহস্পতির কথা শুনে রজির ছেলেরাও অকর্ম-কুকর্ম আরম্ভ করল। সেকালের দিনে বেদ-ব্রাহ্মণের ওপর আস্থা নষ্ট হয়ে যাওয়া মানেই তার রাজ্যচ্যুতি হতে দেরি লাগত না। রজিপুত্রেরা রাজ্য হারালেন। ইন্দ্র আবার স্বর্গরাজ্যে আপন অধিকার প্রতিষ্ঠা করলেন।

রজির কাহিনী আপনারা শুনলেন। নহুষের কাহিনী আমরা পূর্বে বলেছি। রজি এবং নহুষ দুজনেই আয়ুপুত্র। দুজনের আমলেই ইন্দ্র নিজের রাজ্য হারিয়েছেন। মর্ত্যভূমির রাজাদের। হাতেই তার যখন এই নাকাল অবস্থা, সেখানে দেবতাদের চিরশত্রু দৈত্য-দানবদের আক্রমণ হলে ইন্দ্রের অবস্থা যে কতটা করুণ হয়ে উঠতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। আমরা তাই প্রথমেই বলেছি–স্বর্গভূমির অবস্থা ভাল যাচ্ছিল না মোটেই। নহুষ যখন ইন্দ্রপত্নী শচীকে আত্মসাৎ করার চেষ্টা করেছিলেন, তখন আমরা দেবগুরু বৃহস্পতিকে যথেষ্ট উদ্যোগ নিতে দেখেছি ইন্দ্রের অনুকূলে। রজির পুত্র রাজেয় ক্ষত্রিয়রা যখন স্বর্গের ওপর ইন্দ্রের স্বত্ব-বিলোপ ঘটালেন তখনও আমরা সেই বৃহস্পতিকেই দেখেছি ইন্দ্রের সাহায্যে এগিয়ে আসতে। ইন্দ্রের বিপদে এই বৃহস্পতির বুদ্ধিই তাকে বারবার বাঁচিয়েছে।

রজির পুত্রেরা যখন ইন্দ্রকে মেরে-ধরে তাড়িয়ে দিলেন, তখন বৃহস্পতির কাছে সামান্য এক টুকরো পুরোডাশের জন্য ইন্দ্র দীন ভিখারীর মতো উপস্থিত হয়েছিলেন। ইন্দ্র বলেছিলেন–ঠাকুর! আমার খাবার-দাবার সব শেষ। দিন দিন রোগা হয়ে যাচ্ছি, শরীরটা বড় দুর্বল, মনেও আমার কোনও সুখ নেই–ব্রহ্মন্ কৃশোহং বিমনা হৃতরাজ্যো হুতাশনঃ। হতৌজা দুর্বলো মূঢ়ঃ। বৃহস্পতি বলেছিলেন–তোমার এই অবস্থা হয়েছে, অথচ আগে একবারও একটু জানাওনি আমাকে। আগে জানলে এত খারাপ অবস্থা তোমার কখনও হত না। তোমার জন্য আমি করিনি বা পরে করব না, এমন কাজ তো কিছু নেই–নাভবিষ্যত্ তৎপ্রিয়ার্থৰ্মকৰ্তব্যং মমানঘ।

সত্যি কথা, স্বর্গরাজ্যে ইন্দ্রের সুস্থিতির জন্য দেবগুরু বৃহস্পতি করেননি হেন কাজ নেই। নিজে বেদবাদী ব্রাহ্মণ হয়েও রজির পুত্রদের নাস্তিকের ধর্ম শিক্ষা দিয়েছেন। একবার দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য তপস্যায় গেলে বৃহস্পতি শুক্রাচার্যের বেশ ধরে দৈত্যশিবিরে গিয়েছিলেন এবং দৈত্যদের এমন কুশিক্ষা দিয়েছিলেন যে, তাদের সে শিক্ষা ভুলতেই সময় লেগেছিল কয়েক বছর। এসব তো সামান্য কথা। ইন্দ্র এবং অপরাপর দেবতাদের জন্য অনেক গভীর অন্যায়। এবং ছলের আশ্রয় নিয়েছেন বৃহস্পতি। কিন্তু তবু কখনও এমন হয়নি যে, দৈত্য-দানবেরা তার বুদ্ধিতে চিরতরে বিনষ্ট হয়ে গেল আর দেবতারা চিরতরে স্বর্গলক্ষ্মীর ঐশ্বর্য ভোগ করলেন।

না, এমন হয়নি। হয়নি, তার কারণ বলেছিলাম প্রথমে। অমৃত, লক্ষ্মী এবং স্বর্গরাজ্যের অধিকার নিয়ে দেবতাদের সঙ্গে অসুরদের চিরকালের লড়াই লেগেই ছিল। এই লড়াইতে দেবগুরু বৃহস্পতি যেমন দেবতাদের স্বার্থরক্ষায় সদা-সর্বদা নিযুক্ত ছিলেন, তেমনই শুক্রাচার্য নিয়েছিলেন অসুরদের পক্ষ। শুক্রাচার্য মহা তেজস্বী ব্রাহ্মণ। আমরা পূর্বে ভৃগু এবং পুলোমার কাহিনী বলেছি। শুক্রাচার্য ভণ্ড-পুলোমার সাত ছেলের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী। মহাভারতের একটি শ্লোক দেখে অবশ্য মনে হয়, শুক্রাচার্য ভৃগুর ছেলে না হয়ে নাতিও হতে পারেন। ভৃগুর পুত্র কবি, কবির পুত্র শুক্রাচার্য-ভূগোঃ পুত্রঃ কবি বিদ্বান্ শুক্রঃ কবিসুতো গ্রহঃ। আবার কোনও মতে ভৃগুমুনির অন্য নামই হল কবি। অতএব শুক্রাচার্য ভৃগুরই পুত্র। দেব-দানবদের প্রথম সংঘাতের সময় থেকেই বৃহস্পতি দেবতাদের পক্ষে আর শুক্রাচার্য দৈত্য-দানবদের পক্ষে যোগ দেন। শুক্র দেব-দানবদের পরামর্শদাতা, গুরু–অসুররামুপাধ্যায়ঃ শুক্ৰস্তু ঋষিসুতো হৃৎ।

মহাভারতে শুক্রাচার্যের বাসস্থানটিও বড় চমৎকার। তিনি নাকি মেরু-পর্বতের চূড়ায় থাকেন আর সমস্ত দৈত্য-দানবেরা দিনরাত তার পরিচর্যা করছে–তস্যৈ মূর্ধশনাঃ কাব্যে। দৈত্যৈ মহামতে। তার ভাণ্ডারে ধন-রত্নের শেষ নেই। সে ধন-রত্নের পরিমাণ এতটাই যে, ধনপতি কুবেরকে তিনি তার সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ ভাগ দেন–তস্মাৎ কুবেরো ভগবান্। চতুর্থং ভাগমতে।

শুক্রাচার্যের চার ছেলে এবং তারাও অসুর-রাক্ষসদের যাজন করেন। শুক্রাচার্য যখন থেকে অসুরদের শুরু হয়েছেন, তখন থেকে আরম্ভ করে এ পর্যন্ত দেবতা এবং অসুরদের বিরাট বিরাট যুদ্ধ হয়ে গেছে এবং সে যুদ্ধের সংখ্যা বারো। অসুরদের মধ্যে হিরণ্যকশিপু, প্রহাদ এবং বলি–এঁরা তিনজনই ইন্দ্রপদ লাভ করেন–ইন্দ্রায়স্তে বিখ্যাতা অসুরাণাং মহৌজসঃ–এবং প্রায় দশ যুগ ঐরা তিন ভুবনের সর্বময় অধিকর্তা ছিলেন। কিন্তু বলি বামনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে রাজ্য হারালে স্বয়ং ইন্দ্র আবার স্বর্গ দখল করেন। অসুরদের অবস্থা তখন খুবই খারাপ হয়ে পড়ল। মাঝে মাঝেই দেবতাদের অতর্কিত আক্রমণে অসুরেরা প্রাণ হারাতে লাগলেন। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য তার অসুর-শিষ্যদের ডেকে বললেন–বারোটা যুদ্ধ হয়ে গেছে। প্রধান। প্রধান অসুরেরা সকলেই প্রায় নিহত হয়েছেন। এখন আর মাত্র ক’জন তোমরা বেঁচে আছ–কিঞ্চিচ্ছিষ্টাস্তু বৈ যুয়ং যুদ্ধেবত্যেষু বৈ স্বয়ম্। এই অবস্থায় তোমরা আর যুদ্ধের কোনও চেষ্টাই করো না। আমি অতি শীঘ্রই মহাদেবের তপস্যা করতে যাব। আমি জানি–ওদিকে বৃহস্পতি দেবতাদের জন্য কী মন্ত্র সাধনা করছেন। মহাদেবের উপাসনা করে আমাকে সেই মন্ত্র জেনে আসতে হবে, যা বৃহস্পতি কিংবা দেবপক্ষের অন্য কেউ জানেন না। তোমরা যুদ্ধ-বাসনা ত্যাগ করে আপাতত দেবতাদের সঙ্গে সন্ধি করো।

গুরুর কথা শুনে দৈত্যকুলের তদানীন্তন মুখপাত্র বুড়ো প্রহ্লাদ দেবতাদের ডেকে বললেন–আজ থেকে তোমাদের সঙ্গে আর আমাদের কোনও বিবাদ-বিসম্বাদ রইল না। তোমরা এই তিন ভুবনের অধিকার নাও-ন্যস্তবাদা বয়ং সর্বে লোকান্ যুয়ং ক্রমন্তু বৈ। আমাদের যা অবস্থা তাতে আমাদের গাছের বাকল পরে বনবাসী তপস্বী হওয়া ছাড়া কোনও উপায় আর নেই। তোমরা সুখে রাজত্ব করো।

অসুরেরা যা বলেন, তাই করেন। শুক্রাচার্যও অসুরদের পরিকল্পনা অনুমোদন করে বললেন–আমি যতদিনে মহাদেবের তপশ্চর‍্যা সেরে ফিরে না আসি, ততদিন তোমরাও সংযত হয়ে তপস্যায় মন দাও-যুয়ং তপশ্চরধ্বং বৈ সংবৃতা বন্ধলৈবনে। তারপর আমি ফিরে এলে দেবতাদের সঙ্গে যুদ্ধ হবে আবার। সেখানে তোমাদের জয় হবে সুনিশ্চিত। শুক্রাচার্য চলে গেলেন। অসুররাও মন দিলেন তপস্যায়। দেবতারা একে একে অসুরদের সমস্ত ভূ-সম্পত্তি অধিকার করে নিলেন নিশ্চিন্তমনে।

শুক্রাচার্য মহাদেবের কাছে গিয়ে বললেন-প্রভু! আমি এমন বিদ্যা চাই, যা দেবগুরু বৃহস্পতিও জানেন না-মানিচ্ছাম্যহং দেব যে ন সন্তি বৃহস্পতৌ। মহাদেব দেখলেন শুক্রাচার্য যে উদ্যম নিয়েছেন–তাতে দেবতাদের বিপদ অবশ্যম্ভাবী। তিনি ইচ্ছে করেই এমন এক কঠিন তপশ্চরণের নির্দেশ দিলেন শুক্রাচার্যকে, যা মনুষ্যদেহে প্রায় অসম্ভব। তিনি বললেন–তুমি যদি হাজার বছর ধরে অবামুখ অবস্থায় শুধু কুণ্ডধুম পান করে তপস্যা করতে পার তবেই বৃহস্পতির অগম্য সেই মন্ত্র লাভ করবে তুমি। শুক্রাচার্য মহাদেবের নির্দেশ মেনে তারই নির্দিষ্ট একটি ধূমোদগারী কুণ্ডাধারের পাশে তপস্যায় বসে গেলেন–তত নিযুক্তো দেবেন কুণ্ডাধারোস্য ধুমকৃৎ।

ধূমোগারী কুণ্ডাধার আমাদের ধারণায় কোন হট স্প্রিং হবে বোধহয়, আর হাজার হাজার বছরের তপস্যা মানে বহু বছরের তপস্যা। সে যাই হোক শুক্রাচার্য একদিকে তপস্যায় বসলেন, অন্যদিকে অসুরেরাও নিয়ম-ব্রতে মন দিলেন। দেবতারা অবশ্য এই সুযোগ ছাড়লেন না। এই অবস্থাতেও তারা অসুরদের ওপর আক্রমণ চালাতে লাগলেন। অসহায় অসুরেরা তখন শুক্রের। মায়ের কাছে আশ্রয় নিলেন। শুক্রমাতা কোনওক্রমে অসুরদের বাঁচিয়ে রাখলেও তিনি নিজে দেবতাদের হাত থেকে নিস্তার পাননি। কিন্তু সুবিধা ছিল–সেটা ভৃগুমুনির আশ্রম। ভৃগুমুনি খুব সহজ লোক নন। একালের কবি তাঁকে বিদ্রোহী বলে চিহ্নিত করেছেন, কাজেও তিনি তাই ছিলেন। ভগবানের বুকে পদচিহ্ন এঁকে দিতে যাঁর বাঁধেনি, তাঁর পক্ষে ইন্দ্র-বিষ্ণুর সাহস প্রতিহত করা মোটেই অসম্ভব হয়নি। অসুরেরা শুক্ৰমাতার নিরাপদ আশ্রয়ে কোনওরকমে বেঁচে রইলেন।

দেবতারা প্রমাদ গুনলেন। সব কিছু পেয়েও ইন্দ্রের রাতের ঘুম কেড়ে নিলেন শুধু শুক্রাচার্য। তিনি নিশ্চল তপস্যায় মগ্ন। ঠিক এই সময়ে ইন্দ্র দুটি কাজ করলেন। কাজ দুটি ক্রমান্বয়ে বলতে হবে। প্রথম কাজ-ইন্দ্র তার নিজের মেয়ে জয়ন্তীকে ডেকে বললেন–বৎসে! একটা কাজ করে দিতে হবে তোমায়। অসুরগুরু শুক্রাচার্য ধূম্ৰত গ্রহণ করে দুশ্চর তপস্যা করছেন মহাদেবকে তুষ্ট করার জন্য। এই কারণে আমি বড় ব্যাকুল হয়ে পড়েছি। হয়তো আমার ইন্দ্ৰত্বই চলে যাবে। এই সময়ে আমার আদেশে তুমি শুক্রাচার্যের কাছে যাও। তার যেমন ভাল লাগে, তেমন ব্যবহারে, নানা উপচারে তুমি তাকে সেবা করে বশ করো–সমারাধয় তন্বঙ্গি মৎকৃতে তং বশং কুরু। শুধু আমার জন্য এই কাজটা তোমায় করে দিতে হবে।

ইন্দ্র জানতেন—মনোমোহিনী অপ্সরাদের শুক্রাচার্যের কাছে পাঠালে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাতে তপস্বী মুনির অভিশাপ জোটা মোটেই অসম্ভব নয়। তার চেয়ে নিজের মেয়ে যদি বাপের করুণ অবস্থা বুঝে তোষামোদ আর ভালবাসায় কার্যোদ্ধার করতে পারে, সেটাই হবে সবচেয়ে ভাল। শব্দটাও তিনি ব্যবহার করেছেন মোক্ষম–বশং কুরু–বশ করতে হবে, যেভাবে হোক। নিজের মেয়েকে এর চেয়ে বেশি কীই বা আর বলা যায়। পিতার চিন্তাকুল অনুরোধ শুনে শুভচারিণী জয়ন্তী সোকণ্ঠে উপস্থিত হলেন শুক্রাচার্যের তপোভূমিতে যেখানে শুধু কুণ্ড-ধূমপান করে শিবের তপস্যায় মগ্ন আছেন অসুর-গুরু।

 শুক্রাচার্যকে দেখার পর থেকে জয়ন্তী তার সঙ্গে সেই ব্যবহারই করতে লাগলেন, যেরকমটি ইন্দ্র তাকে বলে দিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যবহারের মাত্রায় বুঝি কিছু তফাৎ ছিল। স্বার্থের কথা মাথায় রেখে নিজেকে বিকিয়ে দিয়ে শতেক প্রলোভন সৃষ্টি করতে পারতেন জয়ন্তী। কিন্তু ইন্দ্রের নিজের মেয়ে হওয়ার জন্যই হোক, অথবা জয়ন্তীর মধ্যে সেই গভীরতা আগে থেকেই ছিল, যার জন্য তিনি শুক্রাচার্যের সঙ্গে কোনও অসংযত আচরণ করতে পারলেন না। অন্যদিকে সমস্ত দেবতার বিরুদ্ধ-পক্ষে দাঁড়িয়ে একা একটি মানুষ কীভাবে তার হতশ্রী শিষ্যদের জন্য কষ্ট করে যাচ্ছেন–এই উদ্যম, এই প্রয়াস জয়ন্তীকে মুগ্ধ করল। জয়ন্তী শুক্রাচার্যের মায়ায় পড়ে গেলেন।

 ধূমোদগারী জলাধারের পাশে বসে শুক্রাচার্য তপস্যা করেন, আর জয়ন্তী তার শরীরের উষ্ণতা হ্রাস করার জন্য কলার পাতা কেটে এনে তাকে হাওয়া করেন–কদলীদলমাদায় বীজয়ামাস তং মুনি। তৃষ্ণারুক্ষ মুনির সামনে এনে রাখেন সুবাসিত নির্মল জল। গ্রীষ্মের মধ্যাহ্নে শুক্রাচার্য যখন শিবের তপস্যায় প্রচণ্ড দাব দাহ সহ্য করছেন, তখন জয়ন্তী তার আঁচল বিছিয়ে ছায়া করেন মুনির মাথার ওপর—ছায়াং পত্রেণ ভাস্করে মধ্যগে সতি। দিনান্তে মুনির ভোজনের জন্য বন্য ফল আহরণ, সকাল বেলায় মুনির নিত্যকর্ম অগ্নিষ্টোমের জন্য কুশ-কুসুমের ব্যবস্থা রাত্রে পল্লব-শয্যা রচনা করে আচার্যকে একটু পাখার হাওয়া করার জন্য বসে থাকেন জয়ন্তী। মুনি কোনও কথা বলেন না। জয়ন্তীও কোনও কথা বলেন না, এমন কোনও ব্যবহারও করেন না, যাতে মুনির মনে বিকার আসে, অথবা ক্রোধের আবেশ হয়–হাবাভাবাদিকং কিঞ্চি বিকারজননঞ্চ যৎ ন চকার জয়ন্তী সা শাপভীতা মুনেস্তদা। এক অর্থে শুক্রাচার্য যদি মহাদেবের তুষ্টির জন্য তপস্বী হয়ে থাকেন, তবে ইন্দ্রকন্যা জয়ন্তী শুক্রাচার্যের তুষ্টির জন্য তপস্বিনী। আসলে জয়ন্তী অসুরগুরু শুক্রাচার্যকে ভালবেসে ফেলেছেন।

পৌরাণিক সংখ্যার গৌরবে হাজার বছর পর শুক্রাচার্যের তপস্যা নির্বিঘ্নে শেষ হল। সন্তুষ্ট মহাদেব বর দিলেন–যে তপস্যা তুমি করেছ, তা অন্য কেউ পারে না। আমি আশীর্বাদ করছি–আমি যে নিগুঢ় মন্ত্র জানি তার সমস্ত রহস্য তুমি ছাড়া আর অন্য কারও কাছে প্রতিভাত হবে না–প্রতিভাস্যতি তে সর্বং তস্যাদ্যন্তং ন কস্যচিৎ। এই মন্ত্রের শক্তিতে এবং তোমার প্রতিভার তেজে তুমি সমস্ত সুর-সমাজকে পরাভূত করতে পারবে–তেজসা চাপি বিবুধান্ সর্বানভিভবিষ্যসি।

মহাদেব শুক্রাচার্যকে যে মন্ত্র দান করলেন, সেটারই নাম সঞ্জীবনী মন্ত্র-যে মন্ত্রে মৃত অসুরদের বাঁচিয়ে তুলতে পারবেন শুক্রাচার্য, যে মন্ত্র জানবার জন্য দেবসভা থেকে স্বয়ং বৃহস্পতির পুত্র কচ আসবেন শুক্রাচার্যের কাছে। কিন্তু তার আগে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে সেই মৌন-মূক রমণীটির দিকে যিনি শুক্রাচার্যকে বশ করতে এসে নিজেই বশীভূত হয়ে বসে আছেন।

1 Comment
Collapse Comments
কালিপদ August 15, 2022 at 6:45 am

যজ্ঞ কালে গোবধের মন্ত্র? গাঁজা খেয়ে এইসব লেখেন, নাকি মসজিদে বসে লেখেন?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *