2 of 2

৭৬. নীতিকথার কাহিনী লেখা সহজ

১. এদেশের এক জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক সম্প্রতি পুত্রসন্তানের জনক হয়েছেন। তাঁর তিন কন্যা বর্তমান। তিন কন্যার কেউ অন্ধ নয়, খোঁড়া নয়, মস্তিষ্কের কোনও বিকৃতিও কারও নেই। সকলেই সুস্থ, সুন্দর, সকলেই স্বাস্থ্যবান, সকলেই প্রখর মেধায় দীপ্যমান। তবু প্রয়োজন হয় কেন আরও এক সন্তানের? আসলে এ কোনও সন্তানের প্রয়োজন নয়, এই প্রয়োজন পুত্রের। প্রথিতযশা সাহিত্যিক, যাঁকে মানুষ আদর্শ মানে, যাঁর জীবনাচারণ মানুষ অনুসরণ করে, তাঁর এমন পুত্রপিপাসু, চরিত্র মানুষকে আর যা-ই দিক সততা বা মহত্ত্বের তিলমাত্র দেবে না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।

শুনেছি পুত্রের লালসা তাঁকে শাহজালালের মাজার অবধি নিয়েছে। মাথায় টুপি পরে আমাদের বিজ্ঞানমনস্ক সাহিত্যিক মাজারে দাঁড়িয়ে হযরত শাহজালালের কাছে পুত্রের প্রার্থনা করেছেন। অবশেষে নানা তাবিজ, কবজ, দোয়া কালাম, মাজার জিয়ারত-এর পর একটি পুত্র-জন্ম তাঁর পিতৃত্বকে মজবুত করেছে এবং একই সঙ্গে তাঁর পুরুষ-জন্ম সার্থক করেছে।

কী শেখেছে তাঁর অগুণতি পাঠক এবং তাঁর অসংখ্য গুণমুগ্ধ অনুসারী? শিখেছে এই যে, তিন কন্যা যথেষ্ট নয়, একটি পুত্রই সন্তান হিসেবে সম্পূর্ণ এবং একটি পুত্র জন্মানোর আগে উৎপাদন বন্ধ করা অনুচিত। শিখেছে শরীরে ও মনে পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠলেও নারীর পঙ্গুত্ব কাটে না। তাই লিখতে গেলে বড় বড় নীতিকথার কাহিনী লেখা সহজ, কিন্তু স্বভাবে চরিত্রে এই নীতির চর্চা সম্ভব নয়।

এ কথা নারী সবচেয়ে বেশি জানে যে তার জন্ম অনাকাঙ্খিত। একটি দু’টি পুত্রের পর যদি কন্যা জন্মে তবে সেই কন্যা-জন্মে কেউ হয়ত রুষ্ট হয় না। কিন্তু কন্যা কখনও একক ও সম্পূর্ণ রূপে কোনও দম্পতির প্রার্থিত নয়। আমাদের খ্যাতিমান সাহিত্যিকও আর দশজন মানুষের মত পুত্র প্রত্যাশী। তার মন ও মেঘার স্তর কুসংস্কারাচ্ছন্ন মূর্খ মানুষের স্তর ডিঙিয়ে সামাণ্যও উর্ধ্বে ওঠেনি।

২. নারীর প্রতি ঘৃণা যাঁর প্রবচনের প্রধান উপাদেয় বিষয়, নারীকে অশ্রদ্ধা এবং অকথ্য অপমান করা যাঁর স্বভাবের হাড়মজ্জার অন্তর্গত সেই নারীবিদ্বেষী পুরুষই ‘নারীবাদী গ্রন্থ’ লিখবার কৃতিত্ব অর্জন করতে আগ্রহী। কৃতিত্ব সবসময় খুব সুস্বাদু জিনিস। নারীকে হেয় করে প্রবচন রচনা করবার কৃতিত্ব যে পুরুষ একবার অর্জন করেছেন, সে পুরুষই নারীবাদী গ্রন্থ রচনার কৃতিত্ব অর্জন করেন–এই চূড়ান্ত স্ববিরোধী আচরণে ‘কৃতিত্ব’ই একমাত্র উপার্জন। নারীকে একবার গালে চড় দিয়ে আনন্দে তাঁরা হাততালি দেন, আরেকবার চুমু দিয়ে উল্লাসে নৃত্য করেন। মূলত নারী নিয়ে তাঁরা খেলা করেন। তাঁরা নারীকে যখন খুশি ভাঙেন, যেমন ইচ্ছে গড়েন। নারী নিয়ে এই মজাদার খেলা খেলবার কৃতিত্ব পুরুষের জন্য বীরত্বের সম্মন বয়ে আনে নিশ্চয়ই।

তাছাড়া বাণিজ্যও হচ্ছে। এদেশে নারী নিয়ে বাণিজ্য করতে গেলে কোনও মেধা বা পুঁজির দরকার হয় না, কিন্তু ফলাফল লাভজনক। নারী নিয়ে বাণিজ্য করে আজ অবধি কারও ক্ষতি হয়নি, বরঙ অর্থ-যশ-খ্যাতি প্রতিপত্তি সকল কিছুই বেড়েছে।

এই নারী বিদ্বেষী ভাষাবিদেরও সম্ভবত ইহকাল সমৃদ্ধ হবে।

৩. এদেশের এক স্বনামধন্য কবির কথা জানি–কবি তখন দ্বিতীয় বিয়ে করবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, প্রথম স্ত্রীকে তিনি তালাকনামা লিখে দেবার জন্য চাপ দিচ্ছেন প্রতিদিন–কবি তাঁর স্ত্রী কর্তৃক তালাকপ্রাপ্ত হতে চাচ্ছেন, এতে দেন মোহরের টাকার ঝামেলা থেকে নিস্তার পাওয়া যায়, স্ত্রী এই প্রস্তাবে রাজী না হলে প্রখ্যাত কবিটি স্ত্রীকে বলেন–‘আমি তোমার চরিত্রের দোষ ছড়িয়ে দেব চারদিকে। তুমি এখনও রাজি হও তা না হলে বলে বেড়াব তুমি একটা আস্ত বেশ্যা।’

নারীর চরিত্র এমনই এক অদ্ভুত জিনিস যে, ‘শারীরিক’ সম্পর্কই তাঁর চরিত্র ভাল-খারাপের মাপকাঠি। বিতরণের জন্য নারীর চারিত্রিক দোষ যতটা উপযোগী, তত আর অন্য কিছু নয়।

সেই কবি শেষ অব্দি দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। প্রথম স্ত্রীকে তিনি চরিত্র দোষের ভয় দেখিয়েছিলেন, যেন এই ভয়ে স্ত্রী তাঁর সকল প্রস্তাব মেনে নেন। চরিত্র তো আগলে রাখবার জিনিস, বিশেষ করে নারীর জন্য। এই মূল্যবান জিনিসটিকে আগলে না রাখলে নারীর আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। নারীর এই একটিমাত্র সম্পদ–এই সম্পদটিকে হাতছাড়া করলে তার আর সমাজে বেঁচে থাকা মানায় না। ‘সতীত্ব’ই নারীর চরিত্র বাঁচিয়ে রাখে। আগে ‘সতীদাহ’ করে নারীর সতীত্ব রক্ষা হত, আজকাল সতীদাহর নিয়ম নেই, ঘরের পুরুষ-প্রহরীরা নারীর সতীত্ব রক্ষা করে। তারাই নিজেদের প্রয়োজনে নারীকে কখনও ‘সতী’ এবং কখনও ‘অসতী’ বানায়। এই বানানোটা এত সহজ যে আমাদের খ্যাতিমান কবিও নিজের দ্বিতীয় বিয়ের প্রয়োজনে প্রথম স্ত্রীকে ‘অসতী’ বানিয়েছিলেন। এতে কারও লজ্জা হয় না, দ্বিধা হয় না, সঙ্কোচ হয় না। সে যত বড় কবি বা চিত্রকরই হোন না কেন, সে যত বড় শিল্পী বা শিল্পপতিই হোন না কেন।

৪. আমাদের বুদ্ধিজীবিরা তাঁদের বুদ্ধির চর্চার সঙ্গে কিছুটা মাজার চর্চা, কিছুটা নারীচর্চা বজায় রেখে জীবনযাপনে স্বাভাবিকতা আনেন। এতে করে দেশের নির্বোধ জনগণের কাতারে দাঁড়ানোও হয় এবং সকলের একজন বলে দাবী করবার মধ্যেও এক ধরনের গৌরব হয়। আমাদের বুদ্ধিজীবিরা এই গৌরব থেকে নিজেদের বঞ্চিত করতে কিছুতেই রাজি নন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *