৮. ব্রাহ্মণ্য সাম্প্রদায়িক ধর্ম ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পারস্পর সম্বন্ধ

৮. ব্রাহ্মণ্য সাম্প্রদায়িক ধর্ম ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পারস্পর সম্বন্ধ

সেন-বর্মণ পর্বের বাঙলায় বৌদ্ধ দেবদেবী প্রতিমাও যে দুই চারিটি পাওয়া যায় নাই, এমন নয়, তবে ইহাদের সম্বন্ধে নূতন করিয়া কিছু বলিবার নাই। এ তথ্য অনস্বীকার্য যে, ইতিহাসের পর্বে বৌদ্ধধর্ম ও দেবদেবীর প্রভাব-প্রতিপত্তি কমিয়া আসিতেছিল। দুই চারিটি বিহার ছিল, অভয়াকরগুপ্তের মতো দুই চারিজন ধর্মাচার্যও ছিলেন; কিন্তু এই সব বিহার ও আচার্যদের সেই প্রভাব-প্রতিপত্তি আর ছিল না। পশ্চিমবঙ্গের কথা ছাড়িয়া দিলেও উত্তর ও পূর্ববঙ্গে যেখানে সাড়ে তিন শত বৎসর ধরিয়া সর্বত্র নব বৌদ্ধধর্মের নিঃসংশয় প্রভাব সক্রিয় ছিল সেখানেও দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকীয় বৌদ্ধ দেবদেবীর প্রতিমা বিরল। বস্তুত, রামপালের পর বৌদ্ধধর্মে উৎসাহী কোনো নামও বিশেষ শোনা যাইতেছে না। দুই চারিখানা পুঁথি এখানে-ওখানে লেখা হইতেছিল, সন্দেহ নাই, যেমন, হরিবর্মার রাজত্বকালে লিখিত দুইখানা পুঁথি কিছুদিন আগে পাওয়া গিয়াছে। কিন্তু সাধারণভাবে সেন ও বর্মণ রাজবংশ বৌদ্ধধর্ম ও সংঘের উপর খুব শুদ্ধিত ও সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন না এবং প্রত্যক্ষ অত্যাচারে না হউক পরোক্ষ নিন্দায় এবং অশ্রদ্ধায় বৌদ্ধদের উৎপীড়িত করিবার চেষ্টার ত্রুটি হয় নাই। ভোজবর্মার বেলাব-লিপিতে বলা হইয়াছে, ত্রয়ী বা তিন বেদবিদ্যাই হইতেছে পুরুষের আবরণ এবং তাহার অভাবে পুরুষেরা নগ্ন। এই উক্তিতে বেদবাহ্য বা বেদবিরোধী বৌদ্ধ, নাথ, জৈন প্রভৃতি ধর্মের প্রতি যে প্রচ্ছন্ন শ্লেষ তাহা আরও প্রকট হইয়া উঠিয়াছে হরিবর্মার মন্ত্রী ভট্ট-ভবদেবকে যখন বলা হইয়াছে “বৌদ্ধাস্তোনিধি-কুম্ভ-সম্ভব-মুনীঃ” এবং “পাষণ্ডি-বৈতণ্ডিক- প্রজ্ঞা-খণ্ডন-পণ্ডিতঃ”। বেদবাহ্য বৌদ্ধদের পাষণ্ড বলিয়া অভিহিত করা যেন এই পর্ব হইতেই ক্রমশ রীতি হইয়া দাঁড়াইল। বল্লালসেন তাঁহার দানসাগর-গ্রন্থের উপক্রমণিকায় বলিতেছেন, পাষণ্ড (অর্থাৎ বৌদ্ধ) কর্তৃক প্রক্ষিপ্তদোষে দুষ্ট বলিয়া বিষ্ণু ও শিবপুরাণ দানসাগর-গ্রন্থে উপেক্ষিত হইয়াছে। অন্য আর একটি শ্লোকে তিনি বলিতেছেন, এই একই কারণে দেবীপুরাণও ঐ-গ্রন্থে নিবদ্ধ হয় নাই। এই গ্রন্থেরই উপসংহারে একটি শ্লোকে বলা হইয়াছে, কলিযুগে বল্লালসেন-নামা, শ্রী ও সরস্বতী পরিবৃত প্রত্যক্ষ নারায়ণের আবির্ভাবই হইয়াছিল ধর্মের অভ্যুদয়ের জন্য এবং নাস্তিকদের (বৌদ্ধদের, নাথপন্থী প্রভৃতিদের) পদোচ্ছেদের জন্য। লক্ষ্মণসেন হয়তো বৌদ্ধধর্মের প্রতি বিদ্বিষ্ট এতটা ছিলেন না। তাঁহার তর্পণদীঘি-শাসনে এক বৌদ্ধ-বিহারের খবর পাওয়া যাইতেছে এবং তাহারই আদেশে বৌদ্ধ পুরুষোত্তমদের পাণিনি-ব্যাকরণ আশ্রয় করিয়া লঘুবৃত্তি রচনা করিয়াছিলেন। কিন্তু তৎসত্ত্বেও সাধারণভাবে সেন-বর্মণ রাষ্ট্র বৌদ্ধধর্ম ও সংঘের প্রতি শ্রদ্ধিত ছিলেন না, এমন অনুমান কঠিন নয়। বৌদ্ধ দেবদেবীর বিরলতাই তার অন্যতম যুক্তি।

জীবজগতের বিবর্তনের নিয়ম মানব-সমাজের ইতিহাসেও সক্রিয়। বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মে একটা সংঘর্ষ যেমন বহু যুগ হইতে চলিতেছিল তেমনই সঙ্গে সঙ্গে নানান্তরে নানা ক্ষেত্রে নানা উপায়ে একটা সমন্বয়ও সঙ্গে সঙ্গে চলিতেছিল। ইহাই বস্তুর স্বভাব। বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ইতিহাসেও তাহার ব্যত্যয় হয় নাই। কিন্তু প্রাচীনতর কালের কিংবা সর্বভারতের কথা এখানে বলিয়া লাভ নাই; বাঙলাদেশের অষ্টম-নবম হইতে দ্বাদশ ত্রয়োদশ এই চার পাঁচশত বৎসরের কথাই বলি। পাল চন্দ্র পর্বে রাষ্ট্রের আনুকুল্যের ফলে এবং নানা সাময়িক ও রাষ্ট্রীয় কারণে মহাযানী-বজ্রযানী -সহজযানী কালচক্রযানী বৌদ্ধধর্মের যথেষ্ট প্রসার ও প্রতিপত্তি দেখা গিয়াছিল, সন্দেহ নাই। কিন্তু ব্রাহ্মণ্যধর্মাশ্রয়ী লোকের সংখ্যা ছিল অনেক বেশী এবং সেই ধর্মের দেবদেবীর প্রভাব প্রতিপত্তিও কিছু কম ছিল না। দুই ধর্মের লোকদের সাধারণ লোকায়ত স্তরে ধর্ম লইয়া দ্বন্দ্ব কোলাহল খুব যে ছিল মনে হয় না, কিন্তু উপরের স্তরে ধর্ম ও সংস্কৃতির নায়কদের মধ্যে একদিকে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ যেমন ছিল তেমনই অন্য দিকে একটা সমন্বয়ের সচেতন চেষ্টাও ছিল। নিম্নস্তরে ক্রিয়াকর্মের অবিরাম সাযুজ্য ও সারূপ্য এই সমন্বয়ের কাজটা সহজও করিয়া দিয়াছিল। সদ্যোক্ত দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ, ধ্যান ও রূপ-কল্পনা উভয় ক্ষেত্রেই ছিল সক্রিয়।

এই দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের প্রচুর প্রমাণ বিদ্যমান। চীনা শ্রমণ-পরিব্রাজকদের বিবরণীতে, শীলভদ্রের জীবনকাহিনীতে তিব্বতী ঐতিহ্যে, ভারতীয় ন্যায়শাস্ত্রের ইতিহাসে এই সব প্রমাণ ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। ব্রাহ্মণ্য, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের নায়কদের তর্কবিতর্কের ইতিহাসই তো প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ন্যায়শাস্ত্রের ইতিহাস, এক কথায় ভারতীয় ধ্যান-ধারণার ইতিহাস। প্রত্যেকেই চেষ্টা করিতেন বিপরীত ধর্মকে আঘাত করিয়া নিজের ধর্মমতটি প্রতিষ্ঠা করিতে এবং সর্বত্র যে তাহা খুব মার্জিত ভাষায় করা হইত তাহাও নয়। তর্কে পরাজয়ের অর্থই তো ছিল লজ্জা ও অপমান এবং প্রতিপক্ষের মতে ও ধর্মে দীক্ষা। এ-সব তথ্য এত সুবিদিত যে, বিস্তৃত ব্যাখ্যার প্রয়োজন রাখে না। আলোচ্য পর্বের বাঙলাদেশের দু’টি মাত্র প্রমাণ উদ্ধার করিলেই যথেষ্ট হইবে। সহজযানী সরহপাদ সহজযান মতবাদকে সমর্থন করিতে গিয়া অন্য সকল ধর্মমতকেই কঠোর ভাষায় আক্রমণ করিয়াছেন; বর্ণাশ্রমকে অস্বীকার করিয়াছেন, বেদের কর্তৃত্ব অগ্রাহ্য করিয়াছেন, যাগ-যজ্ঞের নিন্দা করিয়াছেন, কৃচ্ছ্রসাধনকেন্দ্রিক সন্ন্যাসধর্মকে আঘাত করিয়াছেন। তাঁহার যুক্তিতে মহাযানীরা সূত্রের অর্থ না বুঝিয়া তাহার অপব্যাখ্যা করেন, শ্রমণেরা ভক্তশিষ্যদের ঠকাইয়া জীবিকানির্বাহ করেন, আর তর্ক তোলেন যে জৈনদের মতো উলঙ্গ থাকিলেই যদি সিদ্ধিলাভ ঘটে তাহা হইলে শৃগাল-কুকুরও সিদ্ধির অধিকারী। ভট্ট-ভবদেবের কথা তো আগেই বলিয়াছি; তিনি তো সমগ্র বৌদ্ধজ্ঞান-সমুদ্র অগস্ত্যের মতো নিঃশেষে পান করিয়া ছিলেন এবং পাষণ্ড-বৈতণ্ডিকদের মত ও যুক্তি খণ্ডনে সিদ্ধ ছিলেন। আর, বল্লালসেনের জন্মই তো হইয়াছিল বৌদ্ধ-জৈনদের মতো নাস্তিকদের পদোচ্ছেদের জন্য অন্য দিকে মহাযানী-বজ্রযানী সকল বৌদ্ধরা, নাথপন্থীরা, জৈনেরা সকলেই বেদের নিন্দা করিতেন। সহজযানীরা তো ব্রাহ্মণ্য এবং বজ্রযানী দেবদেবী পূজার কোনো প্রয়োজন আছে বলিয়াই মনে করিতেন না, নিন্দা-বিদ্রুপও করিতেন। পাল এবং চন্দ্র রাজাদের ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতি প্রীতি ও শ্রদ্ধা সুবিদিত, কিন্তু বৌদ্ধ এমন রাজা বা জননায়ক ছিলেন যাঁহারা ব্রাহ্মণ্য দেবতাদের সম্বন্ধে অশ্রদ্ধা প্রকাশ করিতে দ্বিধাবোধ করেন নাই। সমসাময়িক কালের বাতাসে এই ধরনের পারস্পরিক অশ্রদ্ধার বিষ ছড়ানো না থাকিলে কিছুতেই তাহা সম্ভব হইত না। আচার্য করুণাশ্রীমিত্রের শিষ্যানুশিষ্য বিপুলশ্রীমিত্রের নালন্দা-লিপিতে আছে, বিপুলশ্রীমিত্রের যে-কীর্তির দ্বারা বসুমতী অলংকৃতা হইয়াছিলেন সেই কীর্তি সর্বত্র ছড়াইয়া পড়িল, (যেন) হরির (উচ্চ) পদ হইতে তাঁহাকে অপসারিত করিবার জন্যই! আর রণবঙ্কমগ্ন-হরিকালদেবের ময়নামতী লিপিতে আছে, হরিকালদেবের শুভ্র যশদ্বারা ত্রিজগত ইতস্তত আক্রান্ত হওয়ায় সহস্রলোচন ইন্দ্র নিজের প্রাসাদ হইতে অবনীতে অবনমিত হইয়াছিলেন।

এই দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের কিছু প্রমাণ এক ধরনের বজ্রযানী দেবদেবী কল্পনার মধ্যেও আছে। বজ্রযানী প্রসন্নতারা, বজ্রজ্বালানলার্ক বজ্রজ্বালাকরালী প্রভৃতি দেবতার সাধনমন্ত্রে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, ইন্দ্র প্রভৃতিকে বলা হইয়াছে মার। শিব দশভূজামারীচীর পদতলে পিষ্ট : তাঁহাকে এবং গৌরীকে একত্র পদদলিত করিতেছেন ত্রৈলোক্যবিজয়। ইন্দ্র অপরাজিতার ছত্রধর : ইন্দ্রাণী পরমাদ্বারা অপদস্থ। ইন্দ্র আবার উভয়বরাহাননা-মারীটীর কৃপাপ্রার্থী : তিনি আবার অষ্টভুজা মারীচী, পরমশ্ব ও প্রসন্নতারার পদতলে পিষ্ট। সিদ্ধিদাতা গণেশ অপরাজিতা, পর্ণশবরী এবং মহাপ্রতিসরার পদদলিত। অবলোকিক্তশ্বরের অন্যতম রূপ হরিহরিহরিবাহনোদ্ভব- অবলোকিতেশ্বর গরুড়োপরি আসীন বিষ্ণুর স্কন্ধে আরোহণ করিয়া ব্রাহ্মণ্যধর্মের উপর জয়ঘোষণা করিয়াছেন। সন্দেহ নাই, ব্রাহ্মণ্যধর্মের দেবদেবীদের কিছুটা লাঞ্ছিত ও অপমানিত করিবার জনাই এরূপ করা হইয়াছিল, তবে লক্ষ্যণীয় এই যে, সাধনে যাহাই থাকুক এবং অন্যত্র এই ধরনের রূপ-কল্পনার প্রতিমা-প্রমাণ যাহাই থাকুক, বাঙলায় প্রাপ্ত মূর্তিগুলিতে সে প্রমাণ নাই বলিলেই চলে। এখানে বজ্রযানী বৌদ্ধরা এতটা সম্মুখ সমরে বোধ হয় সাহসী হয় নাই। বাঙলার পর্ণশবরীর পদতলে গণেশ দলিত হইতেছেন না; বাঙলার সম্বরও ব্রহ্মাকে পদতলে পিষ্ট না করিয়া তাঁহাকে হস্তে ধারণ করিয়াছেন। রমাই পণ্ডিতের শূন্যপুরাণ অর্বাচীন গ্রন্থ, ঐতিহাসিক উপাদান হিসাবে নির্ভরযোগ্যও নয় : কিন্তু ইহার মূল প্রেরণা যে বৌদ্ধধর্মের এ সম্বন্ধে সন্দেহ নাই। এই গ্রন্থে গণেশ হইতেছেন কাজী, ব্ৰহ্মা মহম্মদ, বিষ্ণু পয়গম্বর, শিব আদম, নারদ শেখ, এবং ইন্দ্র মওলানা। উদ্দেশ্য ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিদ্রুপ, সন্দেহ কী!

কিন্তু দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের কথা যদি বলিলাম- মিলন-সমন্বয়ের কথাটাও বলি। আগে, গুপ্ত ও পাল-পর্বে, একাধিক প্রসঙ্গে দেখিয়াছে, উচ্চকোটির স্তরে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ যাহাই থাকুক লোকায়ত দৈনন্দিন জীবনের স্তরে কিন্তু একটা মিলন-সমন্বয় ধীরে ধীরে চলিতেই ছিল। খড়া, পাল ও চন্দ্র-বংশের রাজারা তো সজ্ঞানে ও সচেতন ভাবেই এই মিলন-সমন্বয়ের সহায়তা করিয়াছিলেন এবং বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীদের রূপ-কল্পনায়ও তাহা প্রতিফলিত হইতেছিল। বৌদ্ধ দেবায়তনে ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীরা যেমন স্থান পাইতেছিলেন তেমনই ব্রাহ্মণ্য আয়তনে বৌদ্ধ দেবদেবীরাও ঢুকিয়া পড়িতেছিলেন। বৌদ্ধ আয়তনের সরস্বতী, বিঘ্ননাটক প্রভৃতি তো স্পষ্টতই ব্রাহ্মণ্য আয়তন হইতে গৃহীত; চটিকা ও মহাকাল দুই আয়তনেই বিদ্যমান। যোগাসন এবং লোকেশ্বর-বিষ্ণু ও ধ্যানী-শিব তো ধ্যানীবুদ্ধের আদর্শেই পরিকল্পিত। ব্রাহ্মণ্য বিষ্ণু ও শিবের প্রভামণ্ডলের উপরিভাগে উৎকীর্ণ ক্ষুদ্রাকৃতি দেবমূর্তির পরিকল্পনা একান্তই বৌদ্ধ-প্রতিমা ধ্যানীবুদ্ধের রূপ-কল্পনানুযায়ী। বৌদ্ধ তারাদেবী তো ব্রাহ্মণ্য আয়তনে কালী এবং দুর্গারই অন্য নাম। রুদ্রযামল ও ব্রহ্মযামল -গ্রন্থের একটি কাহিনীতে বশিষ্ঠকে আদেশ করা হইয়াছে, চীনদেশে গিয়া তারা ও তারাদেবীর সাধনার গুহা রহস্য শিখিয়া আসিবার জন্য। নিম্নে সাধনা-মালা হইতে বৌদ্ধ তারাদেবীর যে স্তোত্রটি উদ্ধার করিতেছি, তাহাতে দেখা যাইবে, তারাদেবী, উমা, পদ্মাবতী এবং বেদমাতা সকলে একই দেবীরূপে কল্পিতা হইয়াছেন। বস্তুত, লোকায়ত স্তরে ইহাদের মধ্যে পার্থক্য কিছু আর ছিল না।

দেবী ত্বমেব গিরিজা কুশলা ত্বমেব
পদ্মাবতী ত্বমসি [ত্বং হি চ] বেদমাতা।
ব্যাপ্তং ত্বয়া ত্রিভুবনে জগতৈকরূপা
তুভ্যং নমোহস্ত মনসা বপুষা গিরা নঃ।।
যানাত্রয়েষু দশপারমিতেতি গীতা
বিস্তীর্ণ যানিকজনা কক্ষশূন্যতেতি।
প্রজ্ঞাপ্রসঙ্গ চট্টলামৃত পূর্ণধাত্রী
তুভ্যং নমোহস্তু মনসা বপুয়া গিরা নঃ ॥
আনন্দনন্দ বিরসা সহজ স্বভাবা
চক্রক্রয়াদ পরিবর্তিত বিশ্বমাতা।
বিদ্যুৎপ্রভা হৃদয়বর্জিত জ্ঞানগম্যা
তুভ্যং নমোহস্ত মনসা বপুষা গিরা নঃ।।

কিন্তু এই মিলন-সমন্বয় সত্ত্বেও ধীরে ধীরে বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের দেবায়তন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কুক্ষিগত হইয়া পড়িতেছিল। নালন্দার বৌদ্ধ বিহারে মন্দিরে দেখিতেছি, শিব, বিষ্ণু, পার্বতী, গণেশ, মনসা প্রভৃতিরা বৌদ্ধ দেবদেবীদের সঙ্গে সঙ্গেই পূজা পাইতেছেন। বাঙলার সোমপুর ও অন্যান্য বিহারের অবস্থাও এইরূপই ছিল,, এ-অনুমানে কিছু বাধা নাই। ইহার পশ্চাতে সমসাময়িক বৌদ্ধধর্মের ঔদার্য এবং বৌদ্ধ-ব্রাহ্মণ্যধর্মের সমন্বয় ভাবনা বেশ কিছুটা সক্রিয় ছিল সন্দেহ নাই। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ-কথাও স্বীকার করিতে হয়, ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর ক্রমশ বৌদ্ধ দেবায়তন গ্রাস করিতেছিলেন এবং বৌদ্ধ গৃহী সম্প্রদায়ের শ্রদ্ধা ও সম্মান আকর্ষণ করিতেছিলেন। সংখ্যা গণনায় ব্রাহ্মণ্য ধর্মের লোকায়তন চিরকালই অনেক বেশি সমৃদ্ধতর। তাহা ছাড়া, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের স্বাঙ্গীকরণ শক্তিও বৌদ্ধধর্মের চেয়ে বরাবরই ছিল বেশি। অন্যদিকে পাল আমলের শেষের দিক হইতেই, নালন্দা মহাবিহারের অবস্থা ক্রমশ দুর্বল হইয়া পড়িতেছিল; জনসাধারণের ভিতর, বিশেষভাবে উচ্চ ও মধ্যস্তরে, বৌদ্ধধর্মের প্রভাব ক্রমশ হ্রাস পাইতেছিল। বিহার ও বাঙলাদেশের অন্যান্য বিহারে সংঘারামেও বোধ হয় তাহার ব্যতিক্রম হয় নাই। বিশেষভাবে সেন-বর্মণ আমলে বৌদ্ধধর্মের প্রতি রাজকীয় বিরাগ ও উচ্চ ও মধ্যকোটির লোকদের অনুদার দৃষ্টি এবং অন্যদিকে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সক্রিয় পোষকতা, এই দু’য়ের ফলে বৌদ্ধধর্মের ক্রমসংকুচীয়মান অবস্থাটা সহজেই অনুমেয়। সংঘে-বিহারে সিদ্ধাচার্য ও তাঁহাদের ভক্ত-শিষ্য প্রভৃতি যাঁহারা বাস করিতেন তাঁহাদের সাধন আরাধনা ক্রমশ গুহ্য হইতে গুহ্যতর পথে বিবর্তিত হইতে লাগিল। গৃহী-শিষ্যরা তাহার গূঢ়গুহ্য রহস্য যে খুব বুঝিতেন, এমন মনে হয় না; তাহাদের মধ্যে স্বল্পসংখ্যক লোক যাঁহারা এই পথ আঁকড়াইয়া রহিলেন তাঁহারা ইহার দেহযাগী কায়সাধনাকে ক্রমশ পঙ্কের মধ্যে টানিয়া নামাইলেন। তাহা ছাড়া, পূজা, প্রতিমা ও অনুষ্ঠানের দিকটায়, অন্তত দৃশ্যত, বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের মধ্যে ব্যবধান ক্রমশ ঘুচিয়া যাইতেছিল। লৌকিক মনের প্রতিমা-তৃষ্ণা মিটাইবার পক্ষে ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীদের কোনো বাধা ছিল না; বস্তুত লোকায়ত মনে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য প্রতিমায় রূপ ও অর্থের পার্থক্য তো ক্রমশই ক্ষীণ হইয়া আসিতেছিল। তত্ত্বের দিক হইতেও তান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা ও আদর্শ বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য সাধনা উভয়কেই একই পর্যায়ে আনিয়া দাঁড় করাইতেছিল। কাজেই লোকায়ত সমাজে বৌদ্ধধর্ম ও সাধনার প্রভাব ক্রমশ কমিয়া আসিবে, ইহা কিছু বিচিত্র নয়! একটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করিতেছি। আজও বাঙলাদেশে মেয়েরা মাটির তৈরি যে-শিবলিঙ্গের পূজা করিয়া থাকেন তাহার মাথায় একটি মাটির গুলি দেওয়া হয়; তাহার নাম বজ্ৰ। বেলপাতা দিয়া তাহা সরাইয়া দিলে তবে তিনি শিবে পরিণত হইয়া পূজার যোগ্য হন।

অন্য দিকে, সমসাময়িক বৌদ্ধধর্ম ও দেবায়তনের প্রতি ব্রাহ্মণ্য জন-সমাজের বিরাগানুরাগ যাহাই থাকুক, বুদ্ধদেবের প্রতি কিন্তু প্রাগ্রসর ব্রাহ্মণ্যচিন্তার প্রীতি ও অনুরাগ ক্রমশ সুস্পষ্ট হইয়া উঠিতেছিল; শুধু বাঙলাদেশেই নয়, সমগ্র উত্তর ভারতেই। বুদ্ধদেব বিষ্ণুর অন্যতম অবতার বলিয়া স্বীকৃতি লাভ বহুদিন আগেই করিয়াছিলেন; ব্রাহ্মণ্যধর্মের স্বাঙ্গীকরণ ক্রিয়ার প্রকৃতিই এইরূপ। এই স্বীকৃতি ক্রমশ অনুরক্তিতে পরিণত হইতে খুব দেরি হয় নাই। অষ্টম শতকে ব্রাহ্মণ কবি মাঘ তাঁহার শিশুপালবধ কাব্যে বুদ্ধের প্রতি তাঁহার সপ্রশংস শ্রদ্ধা গোপন করিতে পারেন নাই। মারের সকল ভীতি ও প্রলোভনের মধ্যেও বুদ্ধের অবিকৃত চিত্তই তাঁহার প্রশংসা আকর্ষণ করিয়াছিল। একাদশ শতকে কাশ্মীরী কবি ক্ষেমেন্দ্র তাঁহার অবদান-কল্পলতায় বলিতেছেন ইন্দ্র, প্রভৃতি দেবগণ ও অন্যান্য মুনিশ্রেষ্ঠগণ যে কামসুখের জন্য বিকৃতচিত্ত হন সেই কামসুখকে যিনি তৃণের ন্যায় তুচ্ছ করিতে পারেন তিনি কাহার বিস্ময়ের পাত্র নহেন? এক সময় মৎস্য, বিষ্ণু, অগ্নি প্রভৃতি পুরাণে বুদ্ধদেব সম্বন্ধে বলা হইয়াছে, তাহার জন্মই হইয়াছিল অসুরগণকে মোহাবিষ্ট করিয়া দেবমার্গ হইতে তাহাদিগকে ভ্রষ্ট করিবার জন্য। কিন্তু সেদিন বহুদিন বিগত আজ কিন্তু পদ্মপুরাণের ক্রিয়াযোগসারে দশাবতার স্তুতিতে বুদ্ধাবতার বেদবিরোধী বলিয়াই তাঁহাকে নমস্কার জানান হইতেছে! ‘তুমি পশুহত্যা অবলোকন করিয়া কৃপাযুক্ত হইয়া বুদ্ধশরীর গ্রহণপূর্বক বেদ সকলের নিন্দা করিয়াছ, তোমাকে নমস্কার। তুমি যজ্ঞনিন্দা করিয়াছ, তোমাকে নমস্কার।’ বাঙলাদেশের কবি জয়দেবের কণ্ঠেও তাহার প্রতিধ্বনিই যেন শুনিতেছি : গীতগোবিন্দের দশাবতার স্তোত্রে পাইতেছি :

নিন্দসি যজ্ঞবিধেরহহ শ্রুতিজাতম্
সদয়হৃদয়দর্শিত পশুঘাতম্‌
কেশবধৃত বুদ্ধ শরীরে জয় জগদীশ হরে।

আর, নৈষধ-রচয়িতা শ্রীহর্ষ যদি বাঙালী হইয়া থাকেন, তাহা হইলে তিনিও সমসাময়িক বাঙালীর মনকেই ব্যক্ত করিতেছেন, যখন তিনি নানা প্রসঙ্গে উল্লেখ করিতেছেন মারজয়ী জিতেন্দ্রিয় বুদ্ধের কথা, তাঁহার ক্ষমাশীলতা ও সৌন্দর্যের কথা। এইভাবে ধীরে ধীরে বেদবিরোধী, যজ্ঞবিরোধী বুদ্ধদেব ব্রাহ্মণ্য ধ্যানের স্বাঙ্গীকৃত হইয়া গেলেন। বৌদ্ধধর্মের তন্ত্রমার্গী সাধনা ও ব্রাহ্মণ্য তন্ত্রমার্গী সাধনার সঙ্গে মিলিয়া মিশিয়া প্রায় এক হইয়া গেল। বৌদ্ধ দেবায়তন আর ব্রাহ্মণ্য দেবায়তনে প্রতিমার রূপ-কল্পনার পার্থক্য প্রায় আর রহিল না। ইহার পর লোকায়ত সমাজে ধীরে ধীরে বৌদ্ধধর্ম সক্রিয় সচেতন ব্রাহ্মণ্যধর্মের কুক্ষিগত হইয়া পড়িতে আর দেরি হইল না।

তবু, বিহারে সংঘারামে একটা বৃহৎ যতিগোষ্ঠী তো ছিলেনই; তাঁহাদের মধ্যে তখনও স্বধর্মচেতনা সক্রিয়ও ছিল, যদিও সেন-বর্মণ আমলে তাহার পরিধি অত্যন্ত সংকীর্ণ। কিন্তু, ইতিহাসের চক্রাবর্তে পড়িয়া সে-চেতনাও যেন দেখিতে দেখিতে ধুলায় পড়িল লুটাইয়া। দেখিতে দেখিতে নালন্দা-বিক্রমশীল ওদন্তপুরীর মহাবিহার তুর্ক সেনার তরবারী ও অশ্বক্ষুরে চূর্ণবিচূর্ণ হইল, হাজার হাজার পুঁথি বিনষ্ট হইল, শত শত শ্ৰমণ অসিমুখে বিগতপ্রাণ হইলেন। তাহার পর সর্বভুক্ অগ্নি শেষকৃত্য সম্পন্ন করিল। যাঁহারা কোনোমতে প্রাণ বাঁচাইতে পারিলেন তাঁহারা অতিকষ্টে যাহা পারিলেন, যে ক’টি পুঁথি ক্ষুদ্র মূর্তি ও প্রতিমা ও সূত্রোৎকীর্ণ মাটির ফলক সংগ্রহ করিতে পারিলেন তাহা ঝুলিতে ভরিয়া পলাইয়া গেলেন তিব্বতে-নেপালে, কামরূপে-ওড়িষ্যায়, আরাকা পেগু পাগানে এবং আরও দূরদেশে। আজ সেই সব গ্রন্থেরই ইতস্তত বিক্ষিপ্ত খণ্ডগুলি শতাব্দীর পর শতাব্দী অতিক্রম করিয়া আমাদের কালে আসিয়া পৌঁছিয়াছে। এ সব তথ্য সুবিদিত, কাজেই সবিস্তারে বলিয়া লাভ নাই। মিনহাজ, তারনাথ, বুদ্ধগুপ্ত, পাগ সাম জোন-জাং গ্রন্থের সংকলিয়তা সকলেই ইতিহাসের এই আবর্তের অল্পবিস্তর বর্ণনা রাখিয়া গিয়াছেন। নালন্দা বিক্রমশীল-ওদন্তপুরীর শ্রমণেরা যাহা করিয়াছিলেন, বিশেষত মগধের বিহারগুলির ধ্বংসলীলার কথা শুনিয়া, বাঙলার সোমপুর, জগদ্দল প্রভৃতি বিহারের শ্রমণেরাও তাহাই করিলেন, এ সম্বন্ধে সন্দেহের কারণ নাই। সমসাময়িক বাঙলার ভাবাকাশ তো এমনিতেই তাঁহাদের প্রতি খুব অনুকূল ছিল না!

ব্রাহ্মণ্য সাম্প্রদায়িক ধর্ম ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পারস্পর সম্বন্ধ।

সেন-বর্মণ পর্বে বৌদ্ধধর্মের প্রতি ব্রাহ্মণ্যধর্মের যত বিরাগই থাকুক না কেন, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পর কোনো বিরোধ ছিল বলিয়া একেবারেই মনে হয় না। বরং এক সাম্প্রদায়িক ধর্মের সঙ্গে আর এক ধর্মের একটা নিরুক্ত অথচ গভীর সহৃদয় চেতনা বোধ হয় এই পর্বে বেশ সক্রিয় ছিল। বস্তুত, ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধের দৃষ্টান্ত প্রাচীন বাঙলার ইতিহাসে নাই বলিলেই চলে। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও হরিহরের যুগলমূর্তি এই সহৃদয় চেতনার প্রকাশ বলিয়াই মনে হইতেছে; পাল-চন্দ্র ও সেন-বর্মণ পর্বে এই ধরনের বহু যুগলমূর্তি বিদ্যমান। এই দুই পর্বেই বিষ্ণুমূর্তির প্রাচুর্য অন্য যে কোনও সাম্প্রদায়িক প্রতিমার চেয়ে বেশি এবং বিষ্ণুভক্তরাই যে সংখ্যায় বেশি ছিলেন, সন্দেহ নাই। কিন্তু বিষ্ণুভক্তের পক্ষেও শিব বা সূর্যপূজার কোনো বাধা ছিল না, অথবা শৈব বা সৌর হইলেই যে কেহ বিষ্ণু আরাধনা করিতেন না, এমনও নয়। ঊনকোটি এবং দেওপাড়া দুইই পরম শৈবতীর্থ, কিন্তু সেখানেও বিষ্ণু বিদ্যমান, এবং তিনিও শিবের সঙ্গে সঙ্গেই পূজা লাভ করিতেন। কমৌলি-লিপির বৈদ্যদেবের সম্প্রদায়গত পরিচয় পরম মাহেশ্বর ও পরম-বৈষ্ণব উভয় রূপেই ডোম্মনপাল পরম মাহেশ্বর কিন্তু ভগবান নারায়ণকে শ্রদ্ধা জানাইতে তাহার কিছুমাত্র দ্বিধা জাগে নাই : লক্ষ্মণসেন পরম-বৈষ্ণব, তিনি, কেশবসেন ও বিশ্বরূপসেন তিনজনই তাঁহাদের লিপি আরম্ভ করিয়াছেন নারায়ণকে প্রণতি জানাইয়া, কিন্তু ইঁহাদের প্রত্যেকেরই রাজকীয় শীলমোহর যাঁহার প্রতিমা উৎকীর্ণ তিনি সদাশিব। ইহাদের পূর্বপুরুষেরা সকলেই কিন্তু আবার পরম শৈব। কেশবসেন ও বিশ্বরূপসেন আবার সূর্যভক্তও এবং সূর্যদেবকেও প্রণতি জানাইতে তাঁহারা ভুলেন নাই; বস্তুত, দুই জনই আত্মপরিচয় দিতেছেন পরমসৌর বলিয়া। গীতগোবিন্দের কবি জয়দেব সর্বসাধারণ্যে পরিচিত পরম-বৈষ্ণব বলিয়া, কিন্তু যথার্থত তিনি ছিলেন পঞ্চদেবতার উপাসক স্মার্ত ব্রাহ্মণ্য। বস্তুত, জয়দেব যে যোগমার্গী পদও রচনা করিয়াছিলেন আচার্য সুনীতিকুমার সম্প্রতি তাহা প্রমাণ করিয়াছেন। আচার্য হরপ্রসাদ দেখাইয়াছিলেন যে, কবি বিদ্যাপতি বৈষ্ণব মহাজন বলিতে আমরা যে সাম্প্রদায়িক সাধক বুঝি, তাহা মোটেই ছিলেন না, সহজিয়া সাধকও ছিলেন না, তিনি পঞ্চদেবতার উপাসক স্মার্ত ব্রাহ্মণ ছিলেন এবং শিবের, গঙ্গার ও উমার উপাসক ছিলেন। গীতগোবিন্দকার জয়দেব সম্বন্ধেও এই কথাই বলা চলে। বস্তুত সাম্প্রদায়িক ধর্মের এই পারস্পর সম্বন্ধই বাঙলার ব্রাহ্মণ্য সমাজের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিভিন্ন পরিবার বৈষ্ণব বা শাক্ত বলিয়া পরিচিত, কিন্তু শাক্ত বা বৈষ্ণব বলিয়াই পরস্পরের প্রতি বিদ্বিষ্ট কেহ নহেন। একই পরিবারে কেহ শাক্ত, কেহ বা বৈষ্ণব, কেহ বা তারার আরাধনায় রত, কেহ বা শিবের, কিন্তু তাহাতে অন্য দেবতার পূজারাধনায় কোনো বাধা নাই। ব্রাহ্মণ্য বাঙালী আজও একই সঙ্গে সমান উৎসাহে ও উদ্দীপনায় বিষ্ণু ও শিব, লক্ষ্মী ও সরস্বতী, সূর্য ও কার্তিক এবং অন্যান্য দেবদেবীর পূজা করিয়া থাকে, অসঙ্গতি কোথাও কিছু আছে বলিয়া মনে করে না। সেন-বর্মণ আমলেও অবস্থাটা প্রায় আজিকার দিনের মতোই ছিল। এই সব স্মার্ত, পৌরাণিক দেবদেবীর সঙ্গে সঙ্গেই আবার সমান প্রচলিত ছিল নানা লৌকিক ব্রত, নানা লৌকিক, অ-স্মার্ত, অ-পৌরাণিক গ্রাম্য দেবদেবীর পূজা।