রাষ্ট্রীয় সত্তার স্বাতন্ত্র্য
প্রাচীন বাঙলার রাজবৃত্ত ও রাষ্ট্র জীবনের ধারার কথা এই গ্রন্থের দুটি অধ্যায়ে বিশ্লেষণ করিতে চেষ্টা করিয়াছি। সেই সুবিস্তৃত বিশ্লেষণ হইতে কয়েকটি ইঙ্গিত সুস্পষ্ট ধরা পড়ে।
সমাজ, ধর্ম ও সাংস্কৃতিক জীবনে যেমন, পূর্ব প্রত্যন্ত দেশ হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রীয় জীবনেও তেমনই সমগ্র ভারতবর্ষের সঙ্গে বাঙলাদেশের একটা যোগাযোগ সর্বদা ছিল এবং ভারতীয় রাষ্ট্ৰীয় জীবনে তাহার বড় একটা অংশও ছিল। মৌর্য সম্রাটদের কাল হইতে আরম্ভ করিয়া একেবারে আদিপর্বের শেষ পর্যন্ত সে-সম্বন্ধ কখনও ক্ষুন্ন হয় নাই; বস্তুত, প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস শুধু অবাঙালীর ইতিহাস নয়। পঞ্চম-ষষ্ঠ শতক পর্যন্ত বাঙলার রাষ্ট্ৰীয় ইতিহাস মধ্য-ভারতের বাম বাহু প্রসারণের ইতিহাস এবং তাহার ফল বাঙলার কৌম রাষ্ট্রীয় জীবনে কি পরিবর্তন-বিবর্তন হইতেছে তাহারই ইতিহাস। এই পরিবর্তন-বিবর্তনের কোনও বিবরণ আমাদের সম্মুখে উপস্থিত নাই, তবে প্রান্তের বাহির হইতে কোনও ক্ষমতাবান রাজশক্তি যখন অপরিণত কৌমকেন্দ্ৰিক খণ্ড খণ্ড সংস্থার দিকে হাত বাড়াইয়া বৃহত্তর পরিধির ভিতর সেগুলিকে টানিয়া লইতে চায় তখন স্বাভাবিক কারণেই কী পরিবর্তন-বিবর্তন ঘটিতে পারে তাহা অনুমান করা কঠিন নয়। যাহাই হউক, ষষ্ঠ শতকের শেষ ও সপ্তম শতকের গোড়া হইতেই বাঙলাদেশ দুই বাহু বাড়াইয়া উত্তর-ভারতের বৃহত্তর রাষ্ট্ৰীয় জীবনের উন্মুখর স্রোতে ঝাপাইয়া পড়ে এবং ক্ৰমে ক্ৰমে উত্তর ও দক্ষিণ-ভারতের সাধারণ রাজনৈতিক জীবনে নিজের একটি বিশিষ্ট স্থান করিয়া লয়। অষ্টম ও নবম শতকের বহুলাংশ জুড়িয়া যে তিনটি প্রধান রাষ্ট্রশক্তি সর্বভারতীয় প্ৰভুত্ব ও প্রাধান্যের জন্য লড়িয়াছিল। তাহার মধ্যে একটির কেন্দ্র ছিল বাঙলাদেশে ও আশ্রয় ছিল পাল-রাজবংশ। খুব সম্ভব, এই সময় কিংবা ইহার কিছু আগে, মাৎস্যন্যায়ের কালে বাঙলাদেশ নিজের সস্তানদের ক্রোড়বিচুর্থাৎ করিয়া পঠাইয়াছিল পঞ্জাবের পার্বত্য অঞ্চলে নূতন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য। দশম শতকে বরেন্দ্ৰভূমির গদাধর রাষ্ট্রকূটরাজ তৃতীয়-কৃষ্ণের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করিয়া দক্ষিণ-ভারতে বেলারি জেলায় একটি ক্ষুদ্র সমস্তরাজ্য প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। এই শতকে প্রথম-মহীপালের রাজ্য ও রাষ্ট্ৰশক্তি উত্তর-ভারতের অন্যতম শক্তি বলিয়া পরিগণিত হইত। একাদশ শতক হইতে দক্ষিণ-ভারতের সঙ্গে বাঙলার রাজনৈতিক সম্বন্ধ বাড়িয়া যায় এবং ক্রমশ বাঙলাদেশ দক্ষিণী রাষ্ট্ৰীয় প্রভাবের কবলে জড়াইয়া পড়ে। তাহারই ফলে সেনা-বংশের প্রতিষ্ঠা। যাহাই হউক, একদিকে বাঙলার সীমা ডিঙ্গাইয়া সাম্রাজ্য বিস্তার করা এবং তাঁহাকে সৃষ্টি ও শক্তি সম্ভাবনায় পূর্ণ করিয়া তোলা যেমন বার বার বাঙালীর পক্ষে সম্ভব হইয়াছিল, তেমনই জয়-পরাজয়ের ভিতর দিয়া বাঙলাদেশ ভারতের অন্যান্য অংশের সঙ্গে যোগরক্ষা করিতেও পশ্চাদপদ হয় নাই। শুধু রাষ্ট্রীয় সম্বন্ধ আশ্রয় করিয়াই নয়, ব্যাবসা-বাণিজ্য এবং ধর্ম ও সংস্কৃতিগত সম্বন্ধ আশ্রয় করিয়াও বাঙলাদেশ নিখিল ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করিয়া চলিত, কাশ্মীর হইতে সিংহল এবং গুজরাট হইতে কামরূপ পর্যন্ত। ভারতবর্ষের বাহিরে— তিব্বতে, ব্ৰহ্মদেশে, সুবর্ণদ্বীপে, পূর্ব-দক্ষিণ সমুদ্রশায়ী অন্যান্য দেশ ও দ্বীপগুলিতেও— তাহার যোগাযোগ নানা সূত্রে বিস্তার লাভ করিয়াছিল। কাজেই, প্রান্তীয় দেশ বলিয়া প্রাচীন বাঙলাদেশ শুধু তাহার পুকুর পাড়ে, বটের ছায়ে ঘরের দাওয়ায় বসিয়া নিজের ক্ষুদ্র সুখ-দুঃখ লইয়া একান্ত আত্মকেন্দ্ৰিক জীবন যাপন করিত, এমন মনে করিবার কোনও কারণ নাই।
রাষ্ট্রীয় সত্তার স্বাতন্ত্র্য
খ্রীষ্টোত্তর তৃতীয়-চতুর্থ শতক হইতে আরম্ভ করিয়া বাঙলার রাষ্ট্ৰীয় ইতিহাসে ওঠা-পড়া ভাঙা-গড়ার শেষ নাই। কিন্তু ভাঙাগড়ার ভিতর দিয়া বাঙলাদেশ একটি রাষ্ট্রীয় আদর্শ সম্বন্ধে সর্বদা সজাগ ছিল— সে তাহার রাষ্ট্রীয় সত্তার স্বীকৃতি। গুপ্ত-পর্বে যখন এই দেশ উত্তরভারতীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত তখনও এই আদর্শ একেবারে বিস্মৃত নয়। কিন্তু শশাঙ্কের সময় হইতেই এ-সম্বন্ধে সচেতনতা বাড়িয়া যায়। আর্যমঞ্জুশ্ৰীমূলকল্প-গ্রন্থে যখন গৌড়তন্ত্রের কথা পড়িতেছি তখন তাহার মধ্যেও এই সচেতনতার সুপরিস্ফুট। পরবর্তীকালে তো স্বাধীন স্বতন্ত্র সত্তার আদর্শ ক্রমশ আরও পরিষ্কার হইয়া উঠিয়াছে, বিশেষত পাল-আমলে। এই স্বাধীন স্বতন্ত্র সন্তার চেতনাই বাঙলার রাষ্ট্রীয় চেতনা। নানা অন্তৰ্দ্ধন্দ্ব, নানা রাষ্ট্ৰীয় কলকোলাহল এই চেতনাকে বার বার বিপর্যস্ত করিয়াছে, কিন্তু বার বারই বাঙলাদেশ সেই আদর্শকে ফিরিয়া পাইতে চেষ্টাও করিয়াছে। প্রাচীন বাঙালীর এই আদর্শের তথা রাষ্ট্ৰীয় সচেতনতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ মাৎস্যন্যায়োৎপীড়িত বাঙালীর গোপালদেবকে রাজপদে নির্বাচন। এই ধরনের সচেতনতা এবং রাষ্ট্রীয় শুভবুদ্ধির দৃষ্টান্ত ভারতবর্ষের ইতিহাসে বিরল।
অথচ এই আদর্শ খণ্ডিতও হইয়াছে বার বার নানা আঞ্চলিক চেতনাসঞ্জাত অনৈক্য ও অন্তৰ্দ্ধান্দ্বের ফলে এবং তাহার ফলে বার বার জাতীয় জীবন বিপন্নও হইয়াছে। এই অনৈক্য ও অন্তৰ্দ্ধান্দ্বের মূলে যে শক্তি ছিল সক্রিয়, তাহা সামন্তন্ত্রের; বস্তুত আঞ্চলিক সামন্তরাই নেতৃত্ব ও সংঘশক্তিতে স্থায়ীভাবে কখনও সবল ও সমৃদ্ধ হইতে দেন নাই, দীর্ঘস্থায়ী অখণ্ড রাজ্য এবং রাষ্ট্রও গড়িতে দেন নাই।
যাহাঁই হউক, প্রাচীন বাঙালীর স্বতন্ত্র রাষ্ট্ৰীয় সত্তার চেতনা যত প্ৰবলই হউক না কেন, সে চেতনা তাহার সর্বভারতীয় চেতনাকে নিরস্তু করিয়া রাখে নাই; অন্তত শশাঙ্ক হইতে আরম্ভ করিয়া ধর্মপাল-দেবপাল পর্যন্ত ভারতবৃদ্ধি অক্ষুন্ন। প্রান্তীয় স্বাতন্ত্রা সত্ত্বেও রাজনৈতিক দৃষ্টিটি ভারতব্যাপী। কিন্তু, পাল-পর্বের দ্বিতীয় পর্যায় হইতেই যেন রাষ্ট্ৰীয় দৃষ্টি সংকীর্ণ হইয়া আসিতেছে, নিজের প্রান্তীয় স্বতন্ত্র সত্তা এবং প্রান্তীয় লাভক্ষতিটাই যেন বড় হইয়া দেখা দিতেছে। বৈদেশিক মুসলিম অভিযাত্রীরা যখন সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও পঞ্জাব অধিকার করিয়া ফেলিয়াছে, উত্তর-ভারতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন হিন্দুরাজশক্তি যখন মুসলিম অভিযাত্রীদের ঠেকাইয়া রাখিবার প্রাণান্তকর সংগ্রামে রত তখন মহীপালের আচরণ, অথবা পরে গাহিড়বাল রাজশক্তিকে দুর্বল করিবার মধ্যে লক্ষ্মণসেনের যে-আচরণ তাহাতে তো মনে হয়। ভারতবুদ্ধি অপেক্ষা প্রান্তীয় সচেতনতাটাই ছিল প্রবলতর, অন্তত এই পর্বে।
ধর্ম ও রাষ্ট্র
প্রাক-আর্য নানা কৌম ধর্মবিশ্বাস ও অনুষ্ঠান ব্রাহ্মণ্য ধর্মের নানা মত, পথ ও অনুষ্ঠান, বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম প্রভৃতির নানা আদর্শ ও আচার উচ্চকোটি ও লোকায়াত স্তরের বাঙালী জীবনে প্রচলিত ছিল। ধর্মমত ও পথ লইয়া বাদ-বিসংবাদ কলহ-কোলাহল ছিল না। এমন বলা যায় না; ধর্মমত বা বিশ্বাস বা বিশেষ কোনও সম্প্রদায়গত আচারানুষ্ঠানের জন্য কেহ কখনো হয়তো রাজার বা রাষ্ট্রের রোষাকর্ষণও করিয়া থাকিবেন, যদিও প্রাচীনতর কালে তেমন প্রমাণ কিছু জানা নাই। রাজা এবং রাজবংশের লোকেরা যে যাহার ইচ্ছা ও বিশ্বাসানুযায়ী এক এক ধর্মের অনুসরণ করিতেন, পোষকতাও করিতেন; হয়তো কখনো কখনো অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বিষ্ট হইয়া অনিষ্ট সাধনের চেষ্টা ও কপিয়া থাকিবেন। সব সময়ই যে পরধর্মবিদ্বেষ হেতুই তাহা হইত, এমনও বলা যায় না; কখনো কখনো তাহার পশ্চাতে অনুক্ত রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক কারণও সক্রিয় থাকিত, সন্দেহ নাই। তৎসত্ত্বেও সাধারণভাবে এ-কথা বলা চলে যে, রাজা বা রাজবংশের ব্যক্তিগত ধর্ম যাহাই হউক না কেন, তাহাতে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের নীতি, আদর্শ ও সংস্থার কোনও পরিবর্তন ঘটে নাই; জনসাধারণের দৈনন্দিন জীবনযাত্ৰাও রাজার বা রাজবংশের ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয় নাই। অন্তত পাল-পর্ব পর্যন্ত এই আদর্শ অক্ষুঃ। সেনা-বর্মণ পর্বে খুব সম্ভব এই আদর্শের ব্যত্যয় কিছু ঘটিয়াছিল; এই পর্বের একাধিক রাষ্ট্রনায়ক পরধর্ম সম্বন্ধে যে-ভাষা ব্যবহার ও যে মনোবৃত্তি প্রকাশ করিয়াছেন তাহাতে এই সন্দেহ জাগা কিছু বিচিত্র নয় এবং হয়তো তাহার ফলে রাষ্ট্রে ও রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মে ধৰ্মগত সংকীর্ণতার কিছুটা স্পর্শ লাগিয়া থাকিবে। তাহার প্রমাণ যে একেবারে নাই, এমন নয়!
পতন ও অবসানের হেতু
বাঙলাদেশে, তথা সমগ্র উত্তর-ভারতে হিন্দুরাষ্ট্র ও রাজত্বের পতন ও অবসানের প্রধান কারণ ব্যক্তিগত সাহস বা শৌর্যবীর্যের অভাব নয়; সে-কারণ রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব এবং সঙ্ঘশক্তির অভাব, এবং তাহার হেতু একাধিক। কৌমচেতনা, আঞ্চলিক চেতনা, সামন্ততন্ত্র, বর্ণবিন্যাসের অসংখ্য স্তরভেদ, সংকীর্ণ স্থানীয় রাষ্ট্রবুদ্ধি প্রভৃতি সমািপ্তই তাহার মূলে; এ সব কথা বিস্তুত র্যাখ্যার কোনও অপেক্ষা রাখে না। দ্বিতীয়ত, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া প্রাচীন বঙ্গদেশে, তথা ভারতবর্ষে চিরাচরিত চতুরঙ্গব্বল-রণপদ্ধতির কোনও পরিবর্তন ঘটে নাই। খ্ৰীষ্টপর্ব চতুর্থ শতকে আলেকজান্দারের অভিযান ও রণপদ্ধতি হইতে যে উন্নত ওর শিক্ষা গ্ৰহণ করা উচিত ছিল, ভারতবর্ষ তাহা করে নাই। প্ৰায় দেড় হাজার বৎসর ধরিয়া সৈন্যচালনা এবং চতুরঙ্গবলসজ্জা ও ব্যবহারের পদ্ধতি মোটামুটি একই থাকিয়া গিয়াছে। তাহার ফলে দুর্ধর্ষ মুসলিম অভিযাত্রীরা যখন বিদ্যুৎগামী অশ্বপষ্ঠে চড়িয়া বর্শা ও তরবারি হতে শ্লথগতি হস্তাশ্বরথাপদাতিক বাহিনীর বৃহের উপর ঝাপাইয়া পড়িত তখন সৈন্যাধ্যক্ষ বা সেনাবাহিনীর ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত শৌর্যবীর্য বিশেষ কোনও কাজে লাগিতা না, বিপর্যয় ঘটিত অতি সহজেই; তৃতীয়ত, বহুদিন একটি সুপ্রাচীন সমৃদ্ধ সভ্যতা ও সংস্কৃতির এবং সুপ্রতিষ্ঠিত, সুবিন্যস্ত সমাজ ও রাষ্ট্রবিন্যাসের মধ্যে জীবনযাপনের ফলে ভারতবাসীর দহমানে এক ধরনের সনাতনী নিশ্চিস্ততা ও ভাগনির্ভরতার ধূসর আকাশ বিস্তুতি লাভ করিয়ছিল। অন্যদিকে, যে সব মুসলিম অভিযাত্রীর দল তরঙ্গের পর তরঙ্গে ভারতবর্ষের বুকের উপর ঝাপাইয়া পড়িতেছিল। তাহারা বয়সে নবীন; মারু ও পাহাড়ের প্রাকৃত্তিক ও সামাজিক আবেষ্টনে তাহাদের দেহমান দৃঢ় ও কঠোর; খাদ্য ও ধনলুণ্ঠন তাঁহাদের অন্যতম জীবনোপায়; নূতন জীবনভূমি আবিষ্কারে তাহারা বদ্ধপরিকর।; পরধর্মের প্রতি তাহাদের অপরিমেয় বিদ্বেষ এবং সর্বোপরি তাহারা সংগ্রামোন্মত্ত। দশম হইতে দ্বাদশ শতকে উত্তর-ভারতে যে নিরবসর সংগ্রাম তাহা দুই ভিন্নমুখী, বিপরীত চরিত্রের জীবনপ্রবাহের সংগ্রাম। ভারতবর্ষের জীবনপ্রবাহ অন্যতর প্রবাহকে ঠেকাইতে পারিত যদি তাহার নেতৃত্ব থাকিত, সংঘশক্তি থাকিত, রণপদ্ধতি উন্নততর হইত, রাষ্ট্ৰীয় দৃষ্টি দূরপ্রসারী হইত, জাতীয় চরিত্র আত্মশক্তিনির্ভর হইত, সমাজবিন্যাসে ভেদবুদ্ধি না থাকিত এবং দেহগত বিলাসব্যসনে সমাজ নিরক্ত, নিবীৰ্য না হইত। এ-সব কথার সবিস্তারে আলোচনা রাজবৃত্ত, ও অন্যান্য প্রসঙ্গে করিয়াছি; এখানে আর পুনরুক্তি করিয়া লাভ নাই। দ্বাদশ শতকের বাঙলাদেশে কোনও প্রকার প্রতিরোধের মনোবৃত্তি যে ছিল না। তাহা সুস্পষ্ট + বিজয়ী যবনবীরের প্রশস্তি গাহিয়া উমাপতিধর যে শ্লোক রচনা করিয়াছিলেন, তাহাঁই তাহার একমাত্র প্রমাণ নয়। রামাই পণ্ডিতের শূন্যপুরাণ এখন যে-রূপে পাইতেছি। তাহা খুব প্রাচীন না হইলেও তাহাতে, তুর্কী-বিজয়ের অব্যবহিত পরে বাঙালী হিন্দুর মনোভাবের একটু পরিচয় পাওয়া যায়।
ধর্ম হৈলা যাবনরূপী শিরে পরে কাল টুপী
হাতে ধরে ত্রিকচ কামান
ব্ৰহ্ম হৈলা মহম্মদ বিষ্ণু হৈলা পেগম্বর
মহেশ হইল বাবা আদিম
দেখিয়া চণ্ডিকা দেবী তেঁত তুইল হায়া বিবি।
স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে, জাতির মানসক্ষেত্ৰ নানাভাবে আগে হইতেই এই বিপর্যয়ের জন্য প্রস্তুত হইতেছিল। মুসলিম অভিযাত্রীরাই তো কল্কি-অবতার এবং অশ্বারূঢ় এই অবতারের আগমনের জন্য দূরদৃষ্টিহীন সংকীর্ণবুদ্ধি ভাগ্যনির্ভর ধর্মোপদেষ্টারা আগে হইতেই দেশের লোকের চিত্তভূমি তৈরি করিতেছিলেন। মুসলমানেরা যখন আসিয়া পড়িলেন তখন বিহ্বল বিক্ষিপ্ত জনচিত্তকে বুঝাইতে কষ্ট হইল না যে, ইহাই বিধাতার অমোঘ বিধান, কল্কি-অবতার তো আসিবেনই! দেশের ভিতরে এই অবস্থা; আর, বাহির হইতে অভিযানের পর অভিযানে যাঁহারা আসিতেছিলেন তাহদের কাছেও যে এই অবস্থা একেবারে অজ্ঞাত ছিল, এমন মনে হয় না। সোমনাথ-মন্দির হইতে আরম্ভ করিয়া প্রাচ্য-ভারতের বিহার ধ্বংস ও লুণ্ঠন যে শুধু রক্তের নেশায় এবং ধনরত্নের লোভেই, হয়তো তাহা নয়; অন্য উদ্দেশ্যও হয়তো ছিল এবং সে-উদ্দেশ্য জাতির নিগূঢ় চেতলার গভীর স্থানটিতে আঘাত হানিয়া তাহাকে নিরাশ, বিহ্বল ও বিপর্যস্ত করিয়া দেওয়া। সজ্ঞান সচেতন উদ্দেশ্য যে তাহাঁই ছিল এমন কোনও প্রমাণ নাই; কিন্তু ফলত যে তাহাই হইয়াছিল। তাহাতে আর সন্দেহ কী?
সমাজদূষ্টির সংকীর্ণতা
শেষ পর্যায়ের সামাজিক দৃষ্টি যে সংকীর্ণ হইয়া আসিতেছিল তাহার প্রমাণ তো ইতস্তত বিক্ষিপ্ত; নানাপ্রসঙ্গে তাহা উল্লেখও করিয়াছি। পাল-পর্বের মাঝামাঝি পর্যন্তও দেখিতেছি, বাঙলাদেশ আন্তর্দেশিক বৌদ্ধধর্মকে আশ্রয় করিয়া এবং কিছুটা ব্যাবসা-বাণিজ্যকে আশ্রয় করিয়া দেশবিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করিয়াছিল। তাহার ফলে রাষ্ট্রের দৃষ্টি কখনো একান্তভাবে প্রান্তীয় স্থানীয় সীমার মধ্যে আবদ্ধ হইয়া পড়িতে পারে নাই, গ্রামের ও নগরের সমাজও একান্তভাবে কুপমণ্ডুকতাকে এবং ঐকান্তিক ভাগ্যনির্ভরতাকে প্রশ্রয় দিতে পারে নাই। তাহা ছাড়া, বর্ণ-বিন্যাস ও ধর্মকর্ম-অধ্যায়ে সবিস্তারে দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি, পাল-পর্বের শেষ পর্যায়ে, বিশেষভাবে সেন-বৰ্মণ পর্যয়ে মধ্যভারতীয় স্মৃতিশাসন এবং দক্ষিণী-রক্ষণশীল মনোবৃত্তি ক্রমশ বাঙলাদেশে বিস্তার লাভ করিয়া বাঙালীর সমাজকে স্তরে উপস্তরে ভাগ করিয়া এবং সমাজে পুরোহিত-প্রাধান্যের প্রতিষ্ঠা করিয়া সমাজের ও রাষ্ট্রের সামগ্রিক দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করিয়া দিয়াছিল। তাহার ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রজীবন উত্তরোত্তর প্রান্তীয় সীমার মধ্যেই নিজের সার্থকতা লাভের চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করিল। নানাদিক হইতে ব্যাহত হইয়া জীবনযুদ্ধে পর্যুদস্ত হইয়া ভাগ্যনির্ভরতা অর্থাৎ জ্যোতিষ এবং নানাপ্রকারের বিধিনিষেধই তাহার প্রধান আশ্রয় হইয়া দাঁড়াইল! দিগ্নিদিকে বিছুরিত হইবার, নানা কর্মে লিপ্ত হইবার সুযোগ যেখানে নাই সেখানে জীবন আত্মকেন্দ্ৰিক হইবে, ভাগ্যনির্ভর হইবে, রক্ষণশীল হইবে, ইহা কিছু বিচিত্র নয়! বিচিত্র সংগ্রাম, বিচিত্র প্রচেষ্টা, ব্যাবসা-বাণিজ্য, দুঃসাহসিক আবিষ্কার-অভিযান, ধান-মনন, অপরিমেয় শক্তি, উদ্যম, বিশ্বাস প্রভৃতি যেখানে নিরস্ত ও নিঃসুযোগ, জীবন যেখানে বিধিবদ্ধ ও গতানুগতিক সেখানে ভাগ্য এবং পরাজয়ী মনোবৃত্তি রাষ্ট্র এবং সমাজের দৃষ্টিকে গ্রাস করিবে, ইহাই তো স্বভাবের নিয়ম। এই ভাগ্যনির্ভরতা এবং জীবনের স্তিমিত গতি প্রধানতম সমর্থন পাইয়াছিল সমসাময়িক সমাজের ঐকান্তিক ভূমি ও কৃষিনির্ভরতা হইতে। দিনের পর দিন রৌদ্র-বৃষ্টি-কড়ি, প্রকৃতির নানা ভুকুটি প্রভৃতির সঙ্গে লড়িয়া যে-কৃষক মাঠে সোনার শস্য ফলায় এবং হঠাৎ যখন একদিন দুই দণ্ডের শিলাবৃষ্টির ফলে সেই সোনার ধান ঝরিয়া যায় মাটিতে মিশিয়া, অথবা অনাবৃষ্টি বা অতিবৃষ্টিতে যায় ধ্বংস হইয়া এবং তখন যাহার আশ্রয় করিবার মতো অন্য জীবনোপায় কিছু নাই, প্ৰতিকারের শক্তিও যাহার নাই সে তো ভাগ্যনির্ভর হইবেই, আত্মশক্তিতে বিশ্বাস হারাইবেই। তাহা ছাড়া, কৃষিনির্ভর জীবন তো স্বাভাবিক কারণেই আঞ্চলিক ও রক্ষণশীল এবং পরিবার-গোষ্ঠী-গ্রাম-প্ৰান্ত লইয়াই সে-জীবন স্বয়ংসম্পূৰ্ণ; বৃহত্তর, পরিব্যাপ্ত এবং বৈচিত্ৰ্যময় উন্মুখর জীবনের প্রয়োজনও তাহার কাছে স্বল্প। এই ধরনের জীবনের শান্ত, স্নিগ্ধ, স্তিমিত সৌন্দৰ্য-মাধুর্য নিশ্চয়ই আছে এবং বাহির হইতে শক্তিমান, প্রখর ও প্রবল জীবনস্রোতের আঘাত কিছু না লাগিলে এই জীবনের আয়ু অর্থাৎ স্থায়িত্ব এবং শক্তিও কিছু কম নয়, কিন্তু তেমন আঘাত যখন লাগে তখন বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী; এবং বিপর্যয়ের ফলে রাষ্ট্রশক্তি ও সমাজশক্তি দুয়েরই ভিতর ফাটলও অনিবার্য। এয়োদশ শতকে বাঙালী-জীবনের বিপর্যয় এই কারণেই। কিন্তু বিপর্যয় যাহারা ঘটাইল সেই মুসলিম অভিযাত্রীরা সামরিক শক্তিতেই শুধু দুর্ধর্ষ ছিলেন; তাহারা যখন শাসক অর্থাৎ রাষ্ট্রের কর্ণধার হইয়া বসিলেন তখন কিন্তু গ্রামকেন্দ্ৰিক কৃষিনির্ভর জীবনে কোনও পরিবর্তন দেখা দিল না, জীবনের নূতন কোনও বিস্তারও ঘটিল না, না। শিল্প-ব্যাবসা-বাণিজ্যে, না দুঃসাহসী কোনও আবিষ্কার-অভিযানে, না ধ্যানে, না মননে। কাজেই মধ্য-পর্বের সুদীর্ঘ শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়িয়া বাঙালীর ভাগ্য বা দৈবনির্ভরতাও ঘুচিল না, আত্মশক্তিতে বিশ্বাসও ফিরিয়া আসিল না।