অনেকে নিশ্চয়ই জানেন, বাঙলার পাড়াগাঁয়ে সর্বত্রই গ্রামের বাহিরে জনপদসীমার বাহিরে ‘থান’ বা ‘স্থান’ বলিয়া একটা জায়গা নির্দিষ্ট থাকে; কোথাও কোথাও এই ‘থান’ উন্মুক্ত আকাশের নীচে বা গাছের ছায়ায়; কোথাও কোথাও গ্রামবাসীরা তাহার উপর একটা আচ্ছাদনও দেয়। এই ‘থান’ বা স্থানে— সংস্কৃতরূপে দেবস্থান বা দেওথান— মূর্তিরূপী কোনও দেবতা অধিষ্ঠিত কোথাও থাকেন, কোথাও থাকেন না, কিন্তু থাকুন বা না-ই থাকুন, সর্বত্রই তিনি পশু ও পক্ষী বলি গ্রহণ করিয়া থাকেন। গ্রামবাসীরা তাহার নামে ‘মানৎ’ করিয়া থাকেন, তাঁহাকে ভয়ভক্তি করেন এবং যথারীতি তাঁহাকে তুষ্ট রাখার চেষ্টাও করেন সকলেই, কিন্তু লক্ষণীয় এই যে, গ্রামের ভিতর বা লোকালয়ে তাঁহার কোনও স্থান নাই।
‘গ্রাম-দেবতা’ সর্বত্র একই নামে বা একই রূপে পরিচিত নহেন; সাম্প্রতিক বাঙলায় কোথাও তিনি কালী, কোথাও ভৈরব বা ভৈরবী, কোথাও বনদুর্গা বা চণ্ডী, কোথা বা অন্য কোনও স্থানীয় নামে পরিচিত। কিন্তু যে নামেই পরিচিত তিনি হউন, পুরুষ বা প্রকৃতি-তন্ত্রেরই হউন, সংশয় নাই যে, সর্বত্রই তিনি প্রাক্-আর্য আদিম গ্রামগোষ্ঠীর ভয়-ভক্তির দেবতা। আদিবাসীদের এই সব গ্রাম্য দেবতাদের প্রতি আর্য-ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি খুব শ্রদ্ধিতচিত্ত ছিল না।
ব্রাহ্মণ্য বিধানে গ্রাম্য দেবতার পূজা নিষিদ্ধ; মনু তো বারবার এই সব দেবতার পূজারীদের পতিতই বলিয়াছেন। কিন্তু কোনও বিধান, কোনও বিধিনিষেধই ইঁহাদের পূজা ঠেকাইয়া রাখিতে আজও পারে না, আগেও পারে নাই। ইঁহাদের কেহ কেহ ক্রমশ ধীরে ধীরে ব্রাহ্মণ্য সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত হইয়া ব্রাহ্মণ্য ধর্মকর্মে ঢুকিয়া পড়িয়াছেন, এমনও বিচিত্র নয়। শীতলা, মনসা, বনদুর্গা, ষষ্ঠী, নানাপ্রকারের চণ্ডী, নরমুণ্ডমালিনী শ্মশানচারী কালী, শ্মশানচারী শিব, পর্ণশবরী, জাঙ্গুলী প্রভৃতি অনার্য গ্রাম্য দেবদেবীরা এইভাবেই ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধ ধর্মকর্মে স্বীকৃতি লাভ করিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয়; দুই চারি ক্ষেত্রে তাহার কিছু কিছু প্রমাণও পাওয়া যায়। পরে তাহা বলিতেছি।