০১. প্রাক-আৰ্য ভাষার কথা

প্রাক-আৰ্য ভাষার কথা

প্রাচীন বাঙলার, তথা প্রাচীন ভারতবর্ষের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-দীক্ষার ইতিহাস সাধারণত আমরা আরম্ভ করিয়া থাকি বেদ-ব্ৰাহ্মণ-উপনিষদ লইয়া। উপাদানের অভাবে প্রাক-বৈদিক কাল সম্বন্ধে আজও কিছু বলিবার উপায় নাই। কিন্তু বেদ-ব্ৰাহ্মণ-উপনিষদে, এমন কি ধর্মশাস্ত্ৰ-ধৰ্মসূত্রে এবং অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থে যে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-দীক্ষা প্রতিফলিত, বাঙলাদেশ বহুদিন তাহার স্পর্শও পায় নাই। ব্ৰহ্মাবর্ত ও আর্যাবর্তের হৃদয়দেশ হইতে বহুদূরে, আর্যাবর্তের প্রাচ্য প্রত্যন্তে অবস্থিত এই দেশে আর্য জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা-দীক্ষার প্রসার ঘটিয়াছিল বহু বিলম্বে। কিন্তু তাহারও আগে এ-দেশে গৃহবদ্ধ, পরিবারবদ্ধ, সমাজবদ্ধ জনমানুষ বাস করিত; এবং তাঁহাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের এবং শিক্ষা-দীক্ষার একটা সংস্কারও ছিল, শিল্পসাহিত্য-সংগীতের একটা সংস্কৃতিও ছিল। এই সংস্কার ও সংস্কৃতিকে অনাগত কালের জন্য ধারণ করিয়া রাখে প্রত্যেক জন ও গোষ্ঠীর বিশিষ্ট লিপিবদ্ধ ভাষা। বস্তুত, লিপিবদ্ধ ভাষাই সেই বাহন যাহা এক যুগের জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষা, সংস্কার-সংস্কৃতিকে বহন করিয়া লইয়া যায়। ভবিষ্যৎ যুগের দুয়ারে। কিন্তু সেই প্রাক-আর্য নরনারীদের ভাষার লিপি কিছু ছিল না; থাকিলেও এ-পর্যন্ত আমাদের জানা নাই। কাজেই তাঁহাদের শিক্ষা-দীক্ষা জ্ঞান-বিজ্ঞানের সুস্পষ্ট সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্য আজ আমাদের দুয়ারে আসিয়া পৌঁছে নাই। তবে, তাহাদের শিল্প-সাহিত্য-নৃত্যগীতের, অর্থাৎ চলমান সংস্কৃতির কিছুটা ধরিতে পারা সম্ভব আদিম কৌমসমাজের যে-সব নরগোষ্ঠী আজও আমাদের মধ্যে বিচরমান তাহাদের শিল্প-সাহিত্য-নৃত্যগীতে, এক কথায় তাহাদের সামগ্রিক জীবনচর্যায়।

প্রাক-আৰ্য ভাষার কথা

প্রাক-আর্য প্রাচ্য ভারতীয় নরনারীর ভাষা লইয়া আলোচনা-গবেষণা হইয়াছে প্রচুর, আজও হইতেছে। ভাষাতাত্ত্বিকদের সুদীর্ঘ ও সুবিস্তৃত গবেষণার ফলে আজ আমরা জানি, প্রাচ্য ভারতের, তথা বাঙলার সর্বপ্রাচীন ভাষা ছিল (যতটুকু নির্ণয় করা যায়) অস্ট্রিক্‌গোষ্ঠীর ভাষা এবং সেই ভাষার ঘনিষ্ঠতর আত্মীয়তা ছিল মন-খমের ভাষা-পরিবারের সঙ্গে; কিছুটা আত্মীয়তা কোল-মুণ্ডা ভাষা-পরিবারের সঙ্গেও ছিল। এই মুণ্ডা-মন-খমের ভাষা-ভিত্তির উপর নূতন পলি রচনা করিয়াছিল দ্রাবিড় ভাষা-পরিবারের স্রোত, বিশেষভাবে বাঙলার পশ্চিমাঞ্চলে এবং কিছুটা মধ্য-বাঙলায়ও। পূর্ব ও উত্তর-বাঙলায় দ্রাবিড় ভাষার পলি বিশেষ বিস্তৃতি লাভ করে নাই, মোটামুটি এ-কথা বলা চলে। পশ্চিম ও মধ্য-বাঙলায়ও দ্রাবিড় ভাষার প্রভাবের বিস্তৃতি ও গভীরতা কতটা ছিল তাহা নিশ্চয় করিয়া বলিবার উপায় আজও নাই। পূর্ব ও উওর-বাঙলার প্রাচীনতর মুণ্ডা-মন-খমের মূল ভাষার উপর তৃতীয় একটি ভাষাস্রোত আপন প্রবাহ মিশাইয়াছিল; সে-ভাষা ভোটগ্ৰহ্ম নরগোষ্ঠীর ভাষা, প্রাচীন কিরাতজনদের ভাষা। নানা নরগোষ্ঠীকে আশ্রয় করিয়া নানা ভাষার এই জটিল সংমিশ্রণের সূচনা বাঙলাদেশে, তথা প্ৰাচ্য-ভারতে আরম্ভ হইয়াছিল খ্ৰীষ্ট জন্মের বহু শতাব্দী আগে হইতেই।

বেদ-ব্ৰাহ্মণের আর্য ঋষিরা প্রাচ্য ভারতকে খুব সুনজরে দেখিতেন না, এ-কথা তো আগেই একাধিক-প্রসঙ্গে বলিয়াছি। তাহার অন্যতম প্রধান কারণ, প্রাচ্য নরনারীর ভাষা ছিল তাহদের নিকট দুর্বোধ্য, অর্থহীন। অথর্ববেদের ঋষিদের কাছে প্রাচ্যদেশ বহু দূরদেশ; শতপথ-ব্রাহ্মণে এ-দেশের লোকেরা ‘আসূর্য অর্থাৎ অসুরপ্রকৃতি বিশিষ্ট; ঐতরেয় ব্রাহ্মণে এ-দেশ দসু্যদের দেশ; বৌধায়ন-ধর্মসূত্র রচনাকালেও এ-দেশ অস্পৃশ্যদের দেশ। কিন্তু ক্ৰমে ক্ৰমে ধীরে ধীরে প্রাচ্য ভারতে আর্যভাষার প্রসার ঘটিতে আরম্ভ করিল এবং বোধ হয় কিছু কিছু আর্য-সংস্কৃতিরও; তবে, যতটুকু জানা যায়, এই আর্যভাষা ও সংস্কৃতি, দীর্ঘমুণ্ড ঋগ্বেদীয় আর্যভাষা ও সংস্কৃতি নয়, হ্রস্বমুণ্ড অ্যালপীয় আর্যদের ভাষা ও সংস্কৃতি শ্ৰীয়ার্সন যাঁহাদের বলিয়াছেন ‘বহিরার্য। এই অ্যালপীয় (বা অ্যালপো-দীনারায়) আর্যরা ছিলেন অবৈদিক এবং সেই- হেতু ‘আযজ্ঞা অর্থাৎ যজ্ঞধর্মবিরোধী। অর্থবাবেদের এবং পাণিনি-ব্যাকরণের সাক্ষ্য হইতে মনে হয়, প্রাচ্য-ভারতীয় ব্রাতাদের ভাষা আর্যপরিবারের হইলেও সে-ভাষা ঋগ্বেদীয় আর্যভাষা হইতে পৃথক এবং তাহার ‘প্রাকৃত’-লক্ষণ সুস্পষ্ট। এ-তথ্য লক্ষণীয় যে, রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনী এবং অন্যান্য বীরগাথা যাঁহারা গাহিয়া বেড়াইতেন তাঁহাদের বলা হয় ‘সূত এবং ‘মাগধী এবং বাজসনেয়ী-সংহিতায় মগধের লোকদের বলা হইয়াছে ‘স্ট্রীষ্ম’ বা উচ্চস্বর বিশিষ্ট’ (অতিক্রুষ্টিায় মাগধম)। যাহাই হউক, এ-পর্যন্ত যে সাক্ষ্য প্রমাণ আমাদের গোচর তাহাতে অনুমান করা চলে, ভারতের পূর্বাঞ্চলের আর্যভাষা উত্তর-ভারতীয় আর্যভাষা হইতে ছিল পৃথক এবং তাহার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যও কিছু কিছু ছিল। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অধিবাসী পাণিনি সেই জন্যই তাহার ব্যাকরণে বিশেষভাবে প্রাচ্য ‘সংস্কৃত ভাষা ও বাকভঙ্গির বিশৈষ উল্লেখ ও আলোচনা করিয়াছেন, এবং প্রাচ্য বৈয়াকরণিকদের বিশিষ্ট মতামত উল্লেখ করিতেও ভুলেন। নাই! প্রসঙ্গত এ-কথা বলা উচিত, পাণিনির অষ্টাধ্যায়ীতে গৌড় এবং গণপাঠে বঙ্গের উল্লেখ আছে। এ-তথ্য সুস্পষ্ট যে, পাণিনি উদীচ্য উত্তরাখণ্ডের ভাষাকেই আর্যভাষার মাপকাঠি বলিয়া মনে করিতেন এবং প্রাচ্য ভাষার বিচারও সেই ভাবেই করিয়াছেন। কৌষীতকি-ব্রাহ্মণেও সুস্পষ্ট বলা হইয়াছে, ‘’উদীচ্যখণ্ডের ভাষাই শুদ্ধ ও মার্জিতন্তর; লোকেরা সেইজনাই ভাষা শিখিবার জন্য উত্তরে গিয়া থাকে, এবং সেখান হইতে যিনি আসেন তাহার ভাষা শুনিতে ভালোবাসে ‘। উত্তর ও মধ্য-ভারতীয় আর্যভাষার সঙ্গে প্রাচ্য-ভারতের ভাষার পার্থক্য পতঞ্জলিরও দৃষ্টি এড়ায় নাই। তিনি স্পষ্টই বলিয়াছেন, পূর্বাঞ্চলের লোকেরা বিশেষ অর্থে কতকগুলি অদ্ভুত ক্রিয়াপদ ব্যবহার করে, এবং ‘র’ স্থানে ‘’ল” ব্যবহার করা তাহদের ভাষার একটি প্রধান বৈশিষ্টা; সঙ্গে সঙ্গে তিনি এ-কথাও বলিয়াছেন যে, এই উচ্চারণ বৈশিষ্ট্য ‘আসুর বা অসুর নরগোষ্ঠীর; আমরা জানি, ‘র’ স্থানে ‘ল ব্যবহার পরবর্তী মাগধী প্রাকৃতের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য; এবং আচার্য লেভি প্রমাণ করিয়াছেন, এই বৈশিষ্ট্য মুণ্ডা-মনুখমের ভাষা-পরিবারের। আর্যমঞ্জুশ্ৰীমূলকল্প-গ্রন্থে স্পষ্টতই বলা হইয়াছে (আৰ্যদের দৃষ্টিভঙ্গি হইতে), অসুরদের ভাষা ছিল ‘র’ ও ‘ল’-কার বহুল, অব্যক্ত, অস্পষ্ট, নিষ্ঠুর (রূঢ়) ইত্যাদি। আগেই দেখিয়াছি। শতপথ ব্রাহ্মণে প্রাচ্য-ভারতের লোকদের বলা হইয়াছে ‘আসূর্য এবং পতঞ্জলি যখন ‘র’ স্থানে “লা-বৈশিষ্ট্য বলিতেছেন ‘আসুর’ তখন বুঝিতে দেরি হয় না যে, বাঙলা ও প্রাচ্যখণ্ডের প্রাক-আর্য আদিভাষা ছিল মুণ্ডা-মনখমের পরিবারের ভাষা এবং তাঁহারই প্রভাব পড়িয়া অবৈদিক আর্যভাষার যে-সব বিশিষ্ট লক্ষণ গড়িয়া উঠিয়াছিল তন্মধ্যে ‘র’–“ল রূপান্তর একটি। হয়তো আরও ছিল, কিন্তু পতঞ্জলি তাহাদের উল্লেখ করেন নাই। তিনি যে বিশেষ বিশেষ অর্থে কতকগুলি অদ্ভুত ক্রিয়াপদের ব্যবহারের কথা বলিয়াছিলেন, তাহাও যে “অসুর ভাষার প্রভাবে নয়, তাহাও জোর করিয়া বলা যায় না।

পাণিনি প্রাচ্যখণ্ডের বৈয়াকরণিকদের বিশিষ্ট মতামতের কথা বলিয়াছেন। এ-তথ্য সুস্পষ্ট যে, এই সব বৈয়াকরণিকদের মতামত যথেষ্ট শক্তি ও বৈশিষ্ট্য অর্জন করিয়াছিল; তাহা না হইলে পাণিনি তাহা উল্লেখ করিবার ক্লেশ স্বীকায় করিতেন না। কিন্তু সাহিত্য রচিত ও গ্রথিত না। হইলে ব্যাকরণ রচিত হয় না, রচনার প্রয়োজনও হয় না; বৈয়াকরণিকদের বিশিষ্ট মতামতও গড়িয়া উঠে না। সুতরাং অনুমান করা চলে, প্রাচ্য অ-বৈদিক আর্যভাষায় কিছু কিছু সাহিত্য রচিত ও গ্রথিত হইয়াছিল, ভাষার রীতি-পদ্ধতি লইয়া আলোচনা-গবেষণাও হইয়াছিল; কিন্তু কী ছিল সেই সব জ্ঞান-বিজ্ঞানের রূপ ও প্রকৃতি তাহা বলিবার মতো কোনো উপাদানই আমাদের হাতে নাই!

অবৈদিক প্রাচ্য আর্যভাষা ও সংস্কৃতির পদানুসরণ করিয়া ক্রমশ উত্তর ও মধ্য-ভারতীয় আর্যভাষা প্রাচ্যদেশে বিস্তার লাভ করিতে আরম্ভ করিল; এবং প্রাচ্য প্রাকৃত এবং উত্তর ও মধ্য ভারতীয় সংস্কৃতির স্রোত বাঙলাদেশে সবেগে প্রবাহিত হইতে লাগিল। খ্ৰীষ্টীয় শতকের কিছু আগে হইতেই, বোধ হয়, মৌর্য-আমল হইতে— গোড়ার দিকে বাঙলার উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে এবং পরে ক্রমশ পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলেও। এই স্রোতের বাহক হইলেন মধ্য-ভারতীয় নানাধর্মী যতি-সন্ন্যাসীরা, বণিক-সার্থবাহরা, সৈনিক-রাজপুরুষেরা। প্রাক-আর্য ও অনার্য নরনারীরা ক্রমশ বৌদ্ধ, জৈন ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আশ্রয়লাভের সঙ্গে সঙ্গে আৰ্য-ভাষা ও সংস্কৃতির নিকট মাথা নোয়াইতে বাধ্য হইলেন। উওর-বাঙলা (এবং সম্ভবত পশ্চিমবাংলায় ) মৌৰ্য-সাম্রাজ্যান্তর্গত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আর্যভাষা ও সংস্কৃতির প্রসার প্রতিপত্তি বিস্তার আরও সহজ হইয়া গেল। মহাস্থানের ব্ৰাহ্মী লিপিখণ্ডই সমসাময়িক বাঙলায় প্রচলিত আর্যভাষার একমাত্র অভিজ্ঞান।

— নেন সবর্গীয় [া] নং [গলদানস] দুমদিন [মহা-] মাতে সুলখিতে পুডনগলতে এ [ত] ং [নি] বহিপয়িসতি। সংবগীয়ানাং [চ দি] নে [তথা] [ধা]] নিয়ং নিবহিসতি। দ। [ং] গ [া] তিয়া [ি]য়া [ি] য় [ে]ক [ে] দ [বা-] [তিয়ায়ি] কসি। সুঅতিয়ায়িক [সি] পি গংডি [কেহি] [ধানিয়ি] কেহি এস কোঠাগালে কোসং [ভর-] [নীয়ে]।

বলা বাহুল্য, এই ভাষা প্রাচীন মাগধী বা প্রাচ্য প্রাকৃতে লক্ষণাক্রান্ত। যাহাই হউক। এই ভাবে প্রাক-আর্য ও অনার্য ভাষাগুলি আর্যভাষার পথ ছাড়িয়া দিতে বাধ্য হইল; এবং বিগত দুই হাজার বৎসর ধরিয়া প্রাচ্য ভূখণ্ডে আর্যভাষা অনার্য ও প্রাক-আর্য ভাষাকে গ্রাস করিয়া করিয়া অগ্রসর হইতেছে। সে-ক্রিয়া আজও চলিতেছে এবং যতদিন মুণ্ডা-কোল। —মনখমের, দ্রাবিড় ও ভোট-ব্রহ্ম ভাষা ও বুলিগুলির সম্পূর্ণ বিলুপ্তি না ঘটিবে ততদিন চলিতেই থাকিবে।