ধর্মপূজা ও চড়কের সঙ্গে একই পর্যায়ভুক্ত আমাদের হোলী বা হোলক উৎসব। এই উৎসবটি উত্তর ভারতের সর্বত্র যেমন বাঙলাদেশেও তেমনই সুপ্রচলিত এবং সুআদৃত। হোলাক বা হোলক উৎসবের কথা জীমূতবাহনের দায়ভাগ-গ্রন্থে আছে; দ্বাদশ শতকের আগেই যে এই উৎসব বাঙলাদেশে প্রচলিত হইয়াছিল ইহার তাহার প্রমাণ।
এই হোলী উৎসবের বিবর্তন লক্ষণীয়। বাঙলাদেশের ফাল্গুনী শুক্লাচতুর্দশী ও পূর্ণিমা তিথিতে হোলীর সঙ্গে যে-সব আচারানুষ্ঠান জড়িত সংস্কৃতিগত জনতত্ত্বের দিক হইতে তাহার কিছু কিছু আলোচনা-গবেষণা হইয়াছে; ভারতের অন্যত্র যে-সব জায়গায় হোলীর প্রচলন তাহাও এই আলোচনায় অন্তর্ভূক্ত হইয়াছে।
এ-তথ্য এখন অনেকটা পরিষ্কার যে, আদিতে হোলী ছিল কৃষিসমাজের পূজা; সুশস্য উৎপাদন-কামনায় নরবলি ও যৌনলীলাময় নৃত্যগীত উৎসব ছিল তাহার প্রধান অঙ্গ। তারপরের স্তরে কোনও সময় নরবলির স্থান হইল পশুবলি এবং হোমযজ্ঞ ইহার অঙ্গীভূত হইল। কিন্তু হোলীর সঙ্গে প্রধানত যে উৎসববানুষ্ঠনের যোগ তাহা বসন্ত বা মদন বা কামোৎসবের, রাধাকৃষ্ণ-ঝুলনের এবং কোথাও কোথাও মূর্খতম এক রাজাকে লইয়া নানাপ্রকারের ছল-চাতুরী ও তামাসার।
তৃতীয়-চতুর্থ শতক হইতে আরম্ভ করিয়া ষোড়শ শতক পর্যন্ত উত্তর-ভারতের সর্বত্রই বসন্ত বা মদন বা কামোৎসব নামে একটি উৎসবের প্রচলন দেখা যায়। বাৎস্যায়নের কামসূত্র (তৃতীয়-চতুর্থ শতক), শ্রীকৃষ্ণের রত্নাবলী (সপ্তম শতক), মানতীমাধব নাটক (অষ্টম শতক), অল্-বেরুণী (একাদশ শতক), জীমূতবাহনের কালবিবেক (দ্বাদশ শতক) এবং রঘুনন্দন (ষোড়শ শতক) সকলেই এই উৎসবের কথা বলিয়াছেন অল্পবিস্তর বর্ণনায়। প্রচুর নৃত্যগীতবাদ্য, জুগুপ্সিত উক্তি, যৌন অঙ্গভঙ্গি এবং ব্যঞ্জনা প্রভৃতি ছিল এই উৎসবের অঙ্গ এবং পূজাটি হইত মদন ও রতির, চৈত্র মাসে অশোক ফুলের সুপ্রচুর বর্ষণের নীচে।
প্রাচীন বাংলাদেশে এই উৎসবের কথা জীমূতবাহনই বলিয়া গিয়াছেন। পরবর্তী সাক্ষ্য দিতেছেন রঘুনন্দন। মনে হয়, ষোড়শ শতকের পর কোনও সময়ে চৈত্রীয় বসন্ত বা মদন বা কামোৎসব ফাল্গুনী হোলী বা হোলক উৎসবের সঙ্গে মিলিয়া মিশিয়া এক হইয়া যায় এবং কামমহোৎসব অপ্রচলিত হইয়া পড়ে। বস্তুত, ষোড়শ শতকের পর কামমহোৎসবের কোনও উল্লেখ বা প্রচলন কোথাও আর দেখা যায় না।
মুসলমান রাজা-ওমরাহ্রা এবং হারামের মহিলারা হোলী উৎসবের খুব বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং বোধ হয় তাঁহাদের পৃষ্ঠপোষকতার ফলে হোলী ক্রমশ মদনোৎসবকে গ্রাস করিয়া ফেলে। কিন্তু হোলীর সঙ্গে রাধাকৃষ্ণের ঝুলন এবং আবীর-কুমকুম খেলার ইতিহাসের যোগ হয় আবার অন্য পথে। রামগড় গুহার এক লিপিতে (খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয়-তৃতীয় শতক) এক ঝুলন উৎসবের কথাই আমরা প্রথম শুনি। কিন্তু সে-ঝুলন কোনও দেবদেবীর নয়, বোধ হয় নেহাৎই মানুষের ঝুলন। ঝুলনায় মানুষেরা, নরনারী উভয়েই দোলা খাইত, বেশি করিয়া দোলা দিত মানবশিশুকে, তাহাকে আনন্দ দিবে জন্য। হয়তো তাহারই প্রকাশ পরবর্তী সাহিত্যে। বালকৃষ্ণ বা বালগোপালকে দোলাইতেন মাতা যশোদা। তারপরের পর্বে আর শুধু বালগোপাল নহেন, ভগবান শ্রীকৃষনের যৌবনলীলার সহচরী রাধারো আসিয়া উঠিলেন সেই ঝুলনায় এবং একাদশ শতকের আগেই কৃষ্ণরাধার ঝুলনলীলা ভারতবর্ষের অন্যতম ধর্মোৎসবে পরিগণিত হইয়া গেল।
অল্-বেরুণীর সাক্ষ্যে মনে হয়, এই উৎসব অনুষ্ঠিত হইত চৈত্রমাসে; গরুড়-পুরাণ এবং পদ্ম-পুরাণের সাক্ষ্যও তাহাই। পরবর্তী কোনও সময়ে এই উৎসব ফাল্গুনী পূর্ণিমাতে আগাইয়া আসে (পদ্ম-পুরাণ, পাতালখণ্ড এবং স্কন্দপুরাণ, উৎকলখণ্ড দ্রষ্টব্য) এবং হোলীর সঙ্গে মিলিয়া মিশিয়া এক হইয়া যায়। ঝুলনায় রাধাকৃষ্ণকে দোলাইয়া তাঁহাদের উপর ফুল, কুমকুম এবং আবীরগোলা জল ছড়ানো হইত এবং তাঁহারাও সহচরীদের উপর ফুল, কুমকুম ইত্যাদি ছুঁড়িয়া মারিতেন। হোলীর সঙ্গে পিচ্কারী খেলার যোগাযোগ এইভাবেই। প্রাক্-বৈদিক আদিম কৃষিসমাজের বলি ও নৃত্যগীতোৎসব এই ভাবেই বর্তমান হোলীতে রূপান্তরিত হইয়াছে। ভারতের নানা জায়গায় এখনও হোলী বা হোলক উৎসবকে বলা হয় শূদ্রোৎসব।; হোলীর আগুন এখনও ভারতের অনেক স্থানে অস্পৃশ্যদের ঘর হইতেই আনিতে হয়।