০২. আহার-বিহার

একাদশ অধ্যায় – দৈনন্দিন জীবন
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – আহার বিহার

মধ্যযুগীয় সুবিস্তৃত বাঙলা সাহিত্যে বাঙালীর আহার্য ও পানীয় সম্বন্ধে যে বিস্তৃত বিবরণ জানা যায় এবং তাহার মধ্যে রুচি ও রসনার যে সূক্ষ্ম বোধ সুস্পষ্ট, রন্ধনকলার যে সূক্ষ্ম ও জটিল পরিচয় বিদ্যমান, আদিপর্বের সংক্ষিপ্ত উপাদানের মধ্যে কোথাও সে-পরিচয় ধরা পড়ে নাই। এ-পর্বের জীবনের এই দিকটায় বাঙালীর বুদ্ধি ও কল্পনা প্রসারিত হয় নাই, প্রমাণের অভাবে সে-কথা জোর করিয়া বলা যায় না, তবে সাক্ষাপ্রমাণ অনুপস্থিত, তাহা স্বীকার করিতেই হয়। সমস্ত সংবাদই পরোক্ষ এবং অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত।

আহার বিহার

ইতিহাসের ঊষাকাল হইতেই ধান্য যে-দেশের প্রথম ও প্রধান উৎপন্ন বস্তু, সে-দেশে প্রধান খাদ্যই হইবে ভাত তাহাতে আশ্চর্য হইবার কিছু নাই। ভাত-ভক্ষণের এই অভ্যাস ও সংস্কার অস্ট্রিক ভাষাভাষী আদি-অস্ট্রেলীয় জনগোষ্ঠীর সভ্যতা ও সংস্কৃতির দান। উচ্চকোটির লোক হইতে আরম্ভ করিয়া নিম্নতম কোটির লোক পর্যন্ত সকলেরই প্রধান ভোজ্যবস্তু ভাত, এবং ‘হাঁড়িত ভাত নাহি, নিতি আবেশী’, ইহাই বাঙালী জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখ! ভাত রাঁধার প্রক্রিয়ায় তারতম্য তো ছিলই, কিন্তু তাহার সাক্ষ্য প্রমাণ নাই বলিলেই চলে। উচ্চকোটির বিবাহভোজে যে-অন্ন পরিবেশন করা হইত স-অন্নের কিছু বিবরণ নৈষধচরিতে দয়মন্তীর বিবাহভোজের বর্ণনায় পাওয়া যায়। গরম ধূমায়িত ভাত ঘৃত সহযোগে ভক্ষণ করাটাই ছিল বোধ হয় সাধারণ রীতি। প্রাকৃত পৈঙ্গল-গ্রন্থেও (চতুর্দশ শতকের শেষাশেষি?) প্রাকৃত বাঙালীর আহার্য দেখিতেছি কলাপাতায়, ‘ওগ্‌গরা ভত্তা গাইক ঘিত্তা’, গো-ঘৃত সহকারে সফেন গরম ভাত। নৈষধচরিতের বর্ণনা বিস্তৃততর : পরিবেশিত অন্ন হইতে ধূম উঠিতেছে, তাহার প্রত্যেকটি কণা অভগ্ন, একটি হইতে আর একটি বিচ্ছিন্ন (ঝরঝরে ভাত), সে-অন্ন সুসিদ্ধ, সুস্বাদু ও শুভ্রবর্ণ, সরু এবং সৌরভময় (১৬/৬৮)। দুগ্ধ ও অন্নপক্ক পায়েসও উচ্চকোটির লোকেদের এবং সামাজিক ভোজে অন্যতম প্রিয় ভক্ষ্য ছিল (১৬/৭০)।

 

প্রাকৃত বাঙালীর খাদ্য

ভাত সাধারণত খাওয়া হইত শাক ও অন্যান্য ব্যঞ্জন সহযোগে। দরিদ্র এবং গ্রাম্য লোকদের প্রধান উপাদানই ছিল বোধ হয় শাক ও অন্যান্য সবজি তরকারী। ডাল খাওয়ার কোনও উল্লেখই কিন্তু কোথাও দেখিতেছি না। উৎপন্ন দ্রব্যাদির সুদীর্ঘ তালিকায়ও ডালের বা কোনও কলাইর উল্লেখ কোথাও যেন নাই। নানা শাকের মধ্যে নালিতা (পাট) শাকের উল্লেখ প্রাকৃত পৈঙ্গলে দেখিতেছি। বস্তুত, এই গ্রন্থের প্রাকৃত বাঙালীর খাদ্য-তালিকাটি উল্লেখযোগ্য :

ওগ্‌গরা ভত্তা রম্ভঅ পত্তা গাইক ঘিত্তা দুগ্ধ সজুক্তা
মোইলি মচ্ছা নালিত গচ্ছা দিজ্জই কান্তা খা (ই) পুনবস্তা।

 

 বিবাহভোজ

কলাপাতায় গরম ভাত, গাওয়া ঘি, মৌরলা মাছের ঝোল এবং নালিতা শাক যে-স্ত্রী নিত্য পরিবেশন করিতে পারেন তাঁহার স্বামী পূণ্যবান, এ-সম্বন্ধে আর সন্দেহ কী! কিন্তু সামাজিক ভোজে, বিশেষত বিবাহভোজে বরযাত্রীরা শাকসবজীর তরকারী পছন্দ করিতেন না। দয়মন্তীর বিবাহভোজে সবুজবর্ণ পাত্রে ভাত-তরকারী পরিবেশন করা হইয়াছিল; বরযাত্রীরা মনে করিলেন বুঝি-বা শাকান্ত পরিবেশন করা হইয়াছে; একটু বিরক্তির ভাবই প্রকাশ করিলেন দেখিয়া কন্যাপক্ষীয়েরা বলিলেন, আপনাদের শাক পরিবেশন করা হয় নাই, পাত্রটির বর্ণ সবুজ বলিয়াই অন্নব্যঞ্জন সবুজ দেখাইতেছে। এই বিবাহভোজে যে-সব ব্যঞ্জন পরিবেশন করা হইয়াছিল তাহাতে দেখা যাইতেছে, ব্যঞ্জন তরকারী প্রভৃতির বাহুল্য সেই যুগেও উচ্চকোটির বাঙালী সমাজে যথেষ্টই ছিল এবং এর বেশি আয়োজন হইত যে, লোকেরা সব খাইয়া, এমন কি গণনাও করিয়া উঠিতে পারিত না। এই ধরনের বৃহৎ ভোজে সামাজিক অপচয়ের কথা ই-ৎসিঙ্‌ও বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন। কবি শ্রীহর্ষের কালে বং আজও দেখিতেছি, বাঙলা দেশে তাহা অব্যাহত গতিতে চলিতেছে। যে-সব ব্যঞ্জনাদি এই বিবাহভোজে পরিবেশিত হইয়াছিল তাহা তালিকাগত করা যাইতেও পারে : দই ও রাই সরিষার প্রস্তুত শ্বেতবর্ণ কিন্তু বেশ ঝালযুক্ত কোনও ব্যঞ্জন (খাইতে খাইতে লোকদের মাথা ঝাঁকিতে এবং তালু চাপড়াইতে হইয়াছিল); হরিণ, ছাগ এবং পক্ষী মাংসের নানা রকমের ব্যঞ্জন; মাংসের নয় কিন্তু দৃশ্যত মাংসোপম, বিবিধ উপাদানযুক্ত কোনও ব্যঞ্জন; মাছের ব্যঞ্জন এবং অন্যান্য আরো নানা প্রকারের সুগন্ধি ও প্রচুর মসলাযুক্ত ব্যঞ্জনাদি, নানা প্রকারের সুমিষ্ট পিষ্টক এবং দই ইত্যাদি। পানীয় পরিবেশিত হইয়াছিল কর্পূরমিশ্রিত সুগন্ধি জল। ভোজের পর দেওয়া হইয়াছিল নানা মসলামিশ্রিত পানের খিলি। অবান্তর হইলেও একটি অনুমানগত তথ্যের উল্লেখ এখানে করা যাইতে পারে। সমস্ত প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলিতে এবং পূর্ব ও দক্ষিণ-ভারতে পান পরিবেশনের রীতি হইয়াছে পান, সুপারী এবং অন্যান্য মসলা পৃথক পৃথক ভাবে সাজাইয়া দেওয়া। পূজা-পার্বণেও তাহাই প্রচলিত রীতি; আদিবাসী কৌমসমাজের রীতিও তাহাই। পান খিলি করিয়া পরিবেশন করা বোধ হয় পরবর্তী আর্য-ভারতীয় রীতি এবং উচ্চকোটি লোকস্তরে ক্রমশ সেই রীতিই প্রবর্তিত হয়। বৌদ্ধ গান ও দোহায় দেখিতেছি পানের সঙ্গে মসলা হিসাবে কর্পূর ব্যবহার করা হইত।

দই, পায়স, ক্ষীর প্রভৃতি দুগ্ধজাত নানাপ্রকারের খাদ্যের উল্লেখ একাধিক ক্ষেত্রে পাইতেছি। এগুলি চিরকালই বাঙালীর প্রিয় খাদ্য। ভবদেব-ভট্টের প্রায়শ্চিত্ত-প্রকরণ-গ্রন্থে নানাপ্রকারের দুগ্ধপান সম্বন্ধে কিছু কিছু বিধিনিষেধ আছে, কিন্তু তাহা সমস্তই স্বাস্থ্যগত কারণে।

 

মৎস্য ও মাংস আহার

মাংসের মধ্যে হরিণের মাংস খুবই প্রিয় ছিল, বিশেষ ভাবে শবর পুলিন্দ প্রভৃতি শিকারজীবী লোকেদের মধ্যে এবং সমাজের অভিজাত স্তরে। ছাগ মাংসও বহুল প্রচলিত ছিল সমাজের সকল স্তরেই। কোনও কোনও প্রান্তে ও লোকান্তরে, বিশেষভাবে আদিবাসী কোমে বোধ হয় শুকনো মাংস খাওয়াও প্রচলিত ছিল, কিন্তু ভবদেব-ভট্ট কোনও কারণেই এবং কোনও অবস্থাতেই শুকনো মাংস খাওয়া অনুমোদন করেন নাই, বরং নিষিদ্ধই বলিয়াছেন। কিন্তু মাছই হোক আর মাংসই হোক, অথবা নিরামিষই হোক, বাঙালীর রান্নার প্রক্রিয়া যে ছিল জটিল এবং নানা উপাদানবহুল তাহা নৈষধচরিতের ভোজের বিবরণেই সুস্পষ্ট।

বারিবহুল, নদনদী-খালবিল বহুল, প্রশান্ত-সভ্যতাপ্রভাবিত এবং আদি-আস্ট্রেলীয়মূল বাঙলায় মৎস্য অন্যতম প্রধান খাদ্যবস্তু রূপে পরিগণিত হইবে, ইহা কিছু আশ্চর্য নয়। চীন, জাপান, ব্রহ্মদেশ, পূর্ব-দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ও দীপপুঞ্জ ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের আহার্য তালিকার দিকে তাকাইলে বুঝা যায়, বাঙলাদেশ এই হিসাবে কোন সভ্যতা ও সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। সর্বত্রই এই তালিকায় ভাত ও মাছই প্রধান খাদ্যবস্তু। বাংলাদেশের এই মৎস্যপ্রীতি আর্যদসভ্যতা ও সংস্কৃতি কোনোদিনই প্রীতির চক্ষে দেখিত না, আজও দেখে না; অবজ্ঞতার দৃষ্টিটাই বরং সুস্পষ্ট। মাংসের প্রতিও বাঙালীর বিরাগ কোনোদিনই ছিল না, কিন্তু আর্য-ব্রাহ্মণ্য ভারতে ছিল; বিশেষভাবে খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ-পঞ্চম শতক হইতেই খাদ্যের জন্য প্রাণীহত্যার প্রতি ব্রাহ্মণ্যধর্মে (বৌদ্ধ ও জৈনধর্মে তো বটেই) একটা নৈতিক আপত্তি ক্রমশ দানা বাঁধিতেছিল এবং আর্য-ব্রাহ্মণ্য ভারতবর্ষ ক্রমশ নিরামিষ আহার্যের প্রতিই পক্ষপাতী হইয়া উঠিতেছিল। বাঙলাদেশেও এই আপত্তি বিস্তৃত হইয়াছিল, সন্দেহ নাই; কিন্তু চিরাচরিত এবং বহু অভ্যস্ত প্রথার বিরুদ্ধে তাহা যথেষ্ট কার্যকরী হইতে পারে নাই। বাঙলার অন্যতম প্রথম ও প্রধান স্মৃতিকার ভট্ট ভবদেব সুদীর্ঘ যুক্তিতর্ক উপস্থিত করিয়া বাঙালীর এই অভ্যাস সমর্থন করিয়াছেন। মনু-যাজ্ঞবল্ক্য-ব্যাস, ছাগলেয় প্রভৃতি প্রাচীন স্মৃতিকারদের মতামত উদ্ধার করিয়া ভবদেব বলিতেছেন, ইঁহাদের নিষেধবাক্য তো শুধু চতুর্দশী, তিথি বা এই ধরনের বিশেষ বিশেষ বার বা তিথি উপলক্ষে প্রযোজ্য, কাজেই মাছ বা মাংস খাওয়ায় কোনও দোষ স্পর্শে না। বস্তুত, মাংস ও মৎস্য আহার বাঙলাদেশে এত সুপ্রচলিত ও গভীরাভ্যস্ত যে, এই সমর্থন ছাড়া ভবদেবের আর কোনও উপায় ছিল না। বাঙলার অন্যতম স্মৃতিকার শ্রীনাথাচার্যও তাহাই করিয়াছেন; বিষ্ণুপুরাণ হইতে দুইটি শ্লোক উদ্ধা করিয়া তিনি দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছেন যে, কয়েকটি পর্বদিবস ছাড়া আর কোনও দিনেই মৎস্য বা মাংস আহার গর্হিত কাজ কিছু নয়। বৃহর্দ্বমপুরাণের মতে রোহিত, শফর (পুঁটি বা শফরী মাছ), সকুল (সোল) এবং শ্বতবর্ণ ও আঁশযুক্ত অন্যান্য মৎস্য ব্রাহ্মণদের ভক্ষ্য। প্রাণীজ ও উদ্ভিজ্জ তৈল বা চর্বির তালিকা দিতে গিয়া জীমূতবাহন ইল্লিস (ইলিশ বা ইল্‌সা) মাছের তৈলের উল্লেখ ও বহুল ব্যবহারের কথা বলিয়াছেন। মনে হয়, আজিকার দিনের মতো প্রাচীনকালেও ইলিশ মাছ বাঙালীর অন্যতম প্রিয় খাদ্য ছিল এবং ইলিশের তৈল নানা প্রয়োজনে ব্যবহৃত হইত। সব মাছ কিন্তু ব্রাহ্মণদের ভক্ষ ছিল না; যে সব মাছ গর্তে বা কাঁদায় বাস করে, যাহাদের মুখ ও মাথা সাপের মত (যেমন, বাণ মাছ), পচা ও শুকনা মাছ খাওয়াও নিষিদ্ধ ছিল, কিন্তু টীকাসর্বস্ব-গ্রন্থের লেখক সর্বানন্দ বলিতেছেন, বঙ্গালদেশের লোকেরা সিহুলী বা শুকনো মাছ খাইতে ভালোবাসিত (যত্র বঙ্গালবচ্চারণাং প্রীতিঃ) এখনও তো তাহাই। শামুক, কাঁকড়া, মোরগ, সারস, বক, হাঁস, দাত্যূহ পক্ষী, উট, গরু, শূকর প্রভৃতির মাংস একেবারেই ছিল অভ্যক্ষ, অন্তত ব্রাহ্মণ্য স্মৃতিশাসিত সমাজে। তবে, সন্দেহ নাই, নিম্নতর সমাজস্তরে এবং আদিবাসী কোমের লোকদের মধ্যে আজিকার মতই শামুক, কাঁকড়া, মোরগ প্রভৃতির মাংস, নানাপ্রকারের আঁশ ছাড়া মাছ, সর্পাকৃতি বাণ মাছ, গর্তকাদাবাসী নানাপ্রকারের অকুলীন মৎস্য, নানাপ্রকারের পক্ষীমাংস সমস্তই ভক্ষ্য ছিল। পঞ্চনখ প্রাণীদের মধ্যে গোধা, শশক, সজারু এবং কচ্ছপ খাওয়ার খুব বাধানিষেধ কাহারো পক্ষে কিছু ছিল না, এ কথা ভবদেব নিজেই বলিতেছেন তাঁহার প্রায়শ্চিত্তপ্রকরণ গ্রন্থে। বাঙালীর মৎস্যপ্রীতির পরিচয় পাহাড়পুর এবং ময়নামতীর পোড়ামাটির ফলকগুলিতে কিছু কিছু পাওয়া যায়। মাছ কোটা এবং ঝুড়িতে ভরিয়া মাছ হাটে লইয়া যাওয়ার দু’টি অতি বাস্তবচিত্র কয়েকটি ফলকেই উৎকীর্ণ। (শবর) পুরুষ হরিণ শিকার কইয়া কাঁধে ফেলিয়া বাড়ি লইয়া যাইতেছে, সে চিত্রও বিদ্যমান। শবর, পুলিন্দ, নিষাদ জাতীয় ব্যাধদের প্রধান বৃত্তিই তো ছিল হরিণ ও অন্যান্য পশুপক্ষী শিকার। হরিণ-শিকারের খুব সুন্দর বর্ণনা আছে একাধিক চর্যাগীতে। একটি গীতে চতুর্দিক হইতে আক্রান্ত ভীত সন্ত্রস্ত হরিণের যে বর্ণনা আছে অবান্তর হইলেও তাহা উদ্ধারের লোভ সংবরণ করা কঠিন :

তেন ন চ্ছুপই হরিণা পিবই না পাণী।
হরিণা হরিণীর নিলয় ন জাণী।।
হরিণী বোলও সুন হরিণা তো।
এ বন চ্ছাড়ী হোহু ভান্তো।।
তরংগতে হরিণার খুর ন দাসই।
ভুসুকু ভণই মূঢ় হিঅহি ন পইসই।।

(ভয়ে) হরিণ তৃণ ছোয় না, জল খায় না; হরিণ জানে না হরিণীর ঠিকানা। হরিণী (আসিয়া) বলে, শোন হরিণ, এ-বন ছাড়িয়া ভ্রান্ত হইয়া (চলিয়া) যাও। তীরগতিতে ধাবমান হরিণের খুর দেখা যায় না। ভুসুক বলেন; মূঢ়ের হৃদয়ে একথা প্রবেশ করে না।

 

জালের সাহায্যেও হরিণ ধরা হইত, এই ধরণের ইঙ্গিত আছে ভুসুকুরই আর একটি গীতিতে। তরঙ্গসংকুল মাঝনদীতে জাল ফেলিয়া মাছ ধরিবার ইঙ্গিতও আছে একটি চর্যাগীতে। কাহ্নপাদ বলিতেছেন,

তরিত্তা ভবজলধি জিম করি মাঅ সুইনা।
মাঝ বেণী তরঙ্গম মুনিআ।।
পঞ্চ তথাগত কিঅ কেড়ুআল।
বাহঅ কাঅ কাহ্নিল মাআজাল।।

 

তরকারী

যে-সব উদ্ভিদ্‌ তরকারী আজও আমরা ব্যবহার করি, তাহার অধিকাংশই, যেমন, বেগুন, লাউ, কুমড়া, ঝিঙ্গে, কাঁকরুল, কচু (কন্দ) প্রভৃতি আদি-অস্ট্রেলীয় অস্ট্রিক ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর দান। এ-সব তরকারী বাঙালী খুব সুপ্রাচীন কাল হইতেই ব্যবহার করিয়া আসিতেছে, ভাষাতত্ত্বের দিক হইতে এই অনুমান অনৈতিহাসিক নয়। পরবর্তী কালে, বিশেষভাবে মধ্যযুগে, পর্তুগীজদের চেষ্টায় এবং নানাসূত্রে নানা তরকারী, যেমন, আলু, আমাদের খাদ্যের মধ্যে আসিয়া ঢুকিয়া পড়িয়াছে। কিন্তু আদিপর্বে তাহাদের অস্তিত্ব ছিল না। নানাপ্রকারের শাক খাওয়ার অভ্যাসও বাঙালীর সুপ্রাচীন।

 

ফল

ফলের মধ্যে কলা, তাল, আম, কাঁঠাল, নারিকেল ও ইক্ষুর উল্লেখই পাইতেছি বারবার। আম ও কাঁঠালের উল্লেখ তো লিপিমালায় সুপ্রচুর। কলা আদি-অস্ট্রেলীয় অস্ট্রিক ভাষাভাষী লোকদের দান; প্রাচীন বাঙলার চিত্রে ও ভাস্কর্যে ফলভারাবনত গলাগাছের বাস্তব চিত্র সুপ্রচুর। পূজা, বিবাহ, মঙ্গলযাত্রা, প্রভৃতি অনুষ্ঠানে কলাগাছের ব্যবহার সমসাময়িক সাহিত্যেও দেখিতে পাওয়া যায়। ইক্ষুর রস আজিকার মতো তখনও পানীয় হিসাবে সমাদৃত ছিল; ইক্ষুর রস জ্বাল দিয়া একপ্রকার গুড় (এবং বোধ হয় শর্করাখণ্ড জাতীয় একপ্রকার ‘খণ্ড’ চিনিও) প্রস্তত হইত। হেমন্তে নূতন গুড়ের গন্ধে আমোদিত বাঙালার গ্রামের বর্ণনা সদুক্তিকর্ণামৃত-গ্রন্থের একটি শ্লোকে দীপ্যমান। অন্যত্র এই শ্লোকটি উদ্ধার করিয়াছি। তেঁতুলের উল্লেখ আছে চর্যাগীতিতে।

কালবিবেক ও কৃত্যতত্ত্বার্ণব গ্রন্থে আশ্বিন মাসে কোজাগর পূর্ণিমা রাত্রে আত্মীয় বান্ধবদের চিপিটক বা চিড়া এবং নারিকেলের প্রস্তুত নানাপ্রকারের সন্দেশে পরিতৃপ্ত করিতে হইত, এবং সমস্ত রাত বিনিদ্র কাটিত পাশা খেলায়। খৈ-মুড়ি (লাজ) খাওয়ার রীতিও বোধ হয় তখন হইতেই প্রচলিত ছিল; খৈ বা লাজ যে অজ্ঞাত ছিলনা তাহার প্রমাণ বিবাহোৎসবে সুপ্রচুর খৈ-বর্ষণের বর্ণনায় লাজহোমের অনুষ্ঠানে।

 

পানীয় ।। মদ্যপান

দুধ, নারিকেলের জল, ইক্ষুরস, তালরস ছাড়া মদ্য জাতীয় নানাপ্রকারের পানীয় প্রাচীন বাঙলায় সুপ্রচলিত ছিল। গুড় হইতে প্রস্তুত সর্বপ্রকার গৌড়িয় মদ্যের খ্যাতি ছিল সর্বভারতব্যাপী। ভাত, গম, গুড়, মধু, ইক্ষু ও তালরস প্রভৃতি গাঁজাইয়া নানাপ্রকারের মদ্য প্রস্তুত হইত। ভবদেব ভট্ট তাঁহার প্রায়শ্চিত্তপ্রকরণ-গ্রন্থে নানাপ্রকার মদ্য-পানীয়ের উল্লেখ করিয়াছেন, এবং সঙ্গে সঙ্গে দ্বিজ ও দ্বিজেতর সকলের পক্ষেই মদ্যপান নিষিদ্ধ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। কিন্তু লোকে তাঁহার এই স্মৃতি-নির্দেশ কতটা মানিয়া চলিত, বলা কঠিন। বৃহদ্বর্মপুরাণে দেখিতেছি, শাস্ত্রনিষিদ্ধ কালে স্বর্ণ, মদ্য, রক্ত, মৎস্য ও মাংস উপাচারে এবং নরবলি সহকারে ব্রাহ্মণের পক্ষে শিবপূজা নিষিদ্ধ। ইহার অর্থ বোধ হয় এই যে, শিবপূজা পক্ষে এই নিষেধ প্রযোজ্য হইলেও শক্তিপূজায় এই সব উপাচার ও নরবলি নিষিদ্ধ ছিল না, আর শাস্ত্রনিষিদ্ধ-কাল ছাড়া অন্য সময়ে কোনও পূজায়ই তেমন নিষেধ ছিল না। চর্যাগীতির একাধিক গীতিতে যে-ভাবে শৌণ্ডিকালয় বা শুঁড়িখানার উল্লেখ পাইতেছি, মনে হয়, বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের ভিতর মদ্যপান খুব গর্হিত বলিয়া বিবেচিত হইত না। শৌণ্ডিকালয়ে বসিয়া শৌণ্ডিক বা শুঁড়ির স্ত্রী মদ্য বিক্রয় করিতেন, এবং ক্রেতারা সেইখানে বসিয়াই তাহা পান করিতেন। শুঁড়িখানার দরজায় বোধ হয় একটা কিছু চিহ্ন আঁকা থাকিত, এবং মদ্যাভিলাষীরা সেই চিহ্ন দেখিয়াই গন্তব্য স্থানটি চিনিয়া লইতেন।! এক জাতীয় গাছের সরু বাকল (অন্যমতে, শিকড়) শুকাইয়া গুড়া করিয়া তাহা দ্বারা মদ চোলাই করা হইত। বেলের খোলা করিয়া মদ্য পানের উল্লেখ আছে সুদুক্তিকর্ণামৃত-গ্রন্থের একটি শ্লোকে; চর্যাগীতিতে দেখিতেছি, মদ্য ঢালা হইত ঘড়ায় ঘড়ায়। বিরুবাপাদ বলিতেছেন :

এক সে শুণ্ডিনি দুই ঘরে সান্ধঅ।
চীঅণ বাকলঅ বারুণী বান্ধঅ।
*       *         *
দশমি দুআরত চিহ্ন দেখিয়া।
আইল গরাহক অপণে বহিয়া।।
চউশটি ঘড়িয়ে দেল পসারা।
পইঠেল গরাহক নাহি নিসারা।।
এক সে ঘড়লী সরুই নাল।
ভণন্তি বিরুআ থির করি চাল।।

এক শুঁড়িনী দুই ঘরে সান্ধে (ঢোকে), সে চিকণ বাকল দ্বারা বারুণী (মন) বাঁধে। শুঁড়ির ঘরের চিহ্ন (আছে) দুয়ারেই; সেই চিহ্ন দেখিয়া গ্রাহক নিজেই চলিয়া আসে। চৌষট্টি ঘড়ায় মদ ঢালা হইয়াছে; গ্রাহক যে ঘরে ঢুকিল তাহার আর সাড়াশব্দ কিছু নাই (মদের নেশায় এমনই বিভোর)! সরু নালে একটি ঘড়ায় মদ ঢালা হইতেছে—বিরুপা সাবধান করিতেছেন, সরু নল দিয়া ঢাল স্থির করিয়া বারুণী ঢাল।

 

প্রাচীন বাঙালী কি ডাল খাইত না?

আগেই বলিয়াছি, প্রাচীন বাঙালীর খাদ্য তালিকায় ডালের উল্লেখ কোথাও দেখিতেছি না। ইহাতে আশ্চর্য হইবার কিছু নাই। বাঙলা, আসাম ও ওড়িষ্যায় যত ডাল আজও ব্যবহৃত হয়—এ ব্যবহার ক্রমশ বাড়িতেছে সমাজের সকল স্তরেই—তার খুব স্বল্পাংশই এই তিন প্রদেশে জন্মায়। পূর্বেও তাহাই ছিল; বোধ হয় উৎপাদন আরও কম ছিল। পূর্ব-দক্ষিণ এশিয়ায়, প্রশান্ত মহাসাগরের দেশ ও দ্বীপগুলিতে আজও ডালের ব্যবহার অত্যন্ত কম, নাই বলিলেই চলে। সেই জন্য ডালের চাষও নাই। বাঙলা দেশের কোনও কোনও জেলায়, যেমন বরিশালে ও ফরিদপুরের, উচ্চকোটি লোকস্তরে বহুক্ষেত্রে উদ্ভিজ ও আমিষ ব্যঞ্জনাদি খাওয়ার পর সর্বশেষে ডাল খাওয়ার রীতি প্রচলিত। আর, নিম্নকোটি স্তরে বাঙলার সর্বত্রই আজও অনেকে ডাল ব্যবহারই করেন না; প্রাচীন কালে বোধ হয় একেবারেই করিতেন না। আর, সুলভ মৎস্যভোজীর পক্ষে তাহার প্রয়োজনও ছিল কম। বস্তুত, ডালের চাষ ও ডাল খাওয়ার রীতিটা বোধ হয় আর্য-ভারতের চান, এবং তাহা মধ্যযুগে।

এ-তথ্য অনস্বীকার্য যে, সুপ্রাচীন কাল হইতেই মৎস্যভোজী বাঙালীর আহার্য অবাঙালীদের রুচি ও রসনায় খুব শ্রদ্ধেয় ও প্রীতিকর ছিল না; আজও নয়। তীর্থংকর মহাবীর যখন ধর্মপ্রচারোদ্দেশে শিষ্যদল লইয়া পথহীন রাঢ় ও বজ্রভূমিতে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলেন তখন তাঁহাদের অখাদ্য কুখাদ্য খাইয়া দিন কাটাইতে হইয়াছিল। সন্দেহ নাই যে, সেই আদিবাসী কৌম-সমাজের মৎস্য খাইয়া দিন কাটাইতে হইয়াছিল। সন্দেহ নাই যে, সেই আদিবাসী কৌম-সমাজের মৎস্য ও শিকার মাংস ভক্ষণ, সমসাময়িক সাধারণ বাঙালীর উদ্ভিজ্জ ব্যঞ্জনাদি, এবং তাহাদের আদিম রন্ধন প্রণালী ভিন্‌ প্রদেশী জৈন আচার্যদের নিরামিষ রুচি ও রসনায় অশ্রদ্ধার উদ্রেক করিয়াছিল। সেই অশ্রদ্ধা আজও বিদ্যমান!

 

শিকার ও অন্যান্য শারীর-ক্রিয়া গৃহক্রীড়া

রাজা-মহারাজ-সামন্ত-মহাসামন্ত প্রভৃতিদের প্রধান বিহারই ছিল শিকার বা মৃগয়া। আর, অন্ত্যজ ও ম্লেচ্ছ শবর, পুলিন্দ, চণ্ডাল, ব্যাধ প্রভৃতি অরণ্যচারী কোমদের শিকারই ছিল প্রধান উপজীব্য ও বিহার দুইও। ইঁহাদের কিছু কচিহু শিকার-চিত্র পাহাড়পুর ও ময়নামতীর ফলকগুলিতে দেখা যায়। এই ফলকগুলিতেই দেখিতেছি, কুস্তী বা মল্লযুদ্ধ এবং নানাপ্রকারের দুঃসাধ্য শারীর ক্রিয়া ছিল নিম্নকোটির লোকদের অন্যতম বিহার। পবনদূতে নারীদের জলক্রীড়া এবং উদ্যানরচনার উল্লেখ আছে; এই দুইটিই বোধ হয় ছিল তাঁহাদের প্রধান শারীর-ক্রিয়া। দ্যুত বা পাশাখেলা এবং দাবা খেলার প্রচলন ছিল খুব বেশি। পাশা খেলাটা তো বিবাহোৎসবের একটি প্রধান অঙ্গ বলিয়াই বিবেচিত হইত। দাবা খেলার প্রচলন যে বাঙলাদেশে কবে হইয়াছিল, বলা কঠিন; তবে চর্যাগীতিতে ‘ঠাকুর’ (অর্থাৎ ‘রাজা’), ‘মন্ত্রী’, ‘গজবর’ এবং ‘বড়ে’, এই চারিটি গুটি, খেলার ‘দান’ এবং ছকের চৌষট্টি কোঠার বা ঘরের উল্লেখ এমন সহজভাবে পাইতেছি যে মনে হয়, দশম-একাদশ শতকের আগেই এই খেলা বাঙলাদেশে সুপ্রচলিত হইয়া গিয়াছিল। কাহ্নপাদ বলিতেছেন :

করুণা পিহাড়ি খেলহু নঅবল ।
সদ্‌গুরু-বোহেঁ জিতেল ভববল ॥
ফীটউ দুআ মাদেসী রে ঠাকুর ।
উআরি উএসেঁ কাহ্ন নিঅড় জিনউর ॥
পহিলেঁ তেড়িয়া বড়িআ মারিউ ।
গঅবরেঁ তোড়িয়া পাঞ্চজনা ঘালিউ ॥
মতিএঁ ঠাকুরক পরিনিবিতা ।
অবশ করিয়া ভববল জিতা ॥
ভণই কাহ্ন অম্‌হে ভাল দান দেহুঁ ।
চউষট্‌ঠি কোয়া গুনিয়া লেহু ॥

করুণার পিড়িতে নবদল (দাবা) খেলি, সদগুরুবোধে ভববল জিতিলাম। দুই নষ্ট হইল, ঠাকুরকে (রাজাকে) দিওনা; উপকারীর উপদেশে কাহ্নর নিকটে জিনপুর। প্রথমে বড়িয়া তুড়িয়া মারিলাম (অর্থাৎ, প্রথমেই হইল বড়ের চাল); তারপর গজবর (হাতি) তুলিয়া পাঁচজনকে ঘায়েল করিলাম। মন্ত্রীকে দিয়া ঠাকুরকে (রাজাকে) প্রতিনিবৃত্ত করিলাম (ঠেকাইলাম); অবশ করিয়া ভববল জিতিলাম। কাহ্নু বলে, দান আমি ভালই দিই, চৌষট্টি কোঠা গুলিয়া লই।

 

নিম্নকোটি স্তরে এবং নারীদের মধ্যে কড়ির সাহায্যে নানাপ্রকার খেলা, যথা গুঁটি বা ঘুণ্টিখেলা, বাঘবন্দী, ষোলঘর, দশপঁচিশ, আড়াইঘর, প্রভৃতি তখন হইতেই সুপ্রচলিত ছিল, এমন অনুমানে কিছু মাত্র বাধা নেই! সাংস্কৃতিক জনতত্ত্বের অনুসন্ধানে বহুদিন ধরা পড়িয়াছে যে, এই সমস্ত খেলা সমগ্র পূর্ব-দক্ষিণ এশিয়া ও প্রশান্তমহাগরবন্ধ দেশ ও দ্বীপগুলির সুপ্রাচীন কৌমসমাজের একেবারে মৌলিক গৃহক্রীড়া।

সর্বানন্দের টিকাসর্বস্ব গ্রন্থ হইতে জানা যায়, ‘অড্‌ঢ’ বা ‘আঢ’, অর্থাৎ বাজি রাখিয়া তখনকার দিনের লোকেরা জুয়া খেলিতেও অভ্যস্ত ছিল। লোকেরা বাজি রাখিয়া ভেড়া ও মুরগীর লড়াই খেলিত ও খেলাইত।

সমতটেশ্বর শ্রীরাধণ-রাতের কৈলান-লিপিতে বলা হইয়াছে, সতত হস্তী ও অশ্বক্রীড়ায় নিযুক্ত থাকার ফলে শ্রীধারণের দেহ ছিল পেশীসমৃদ্ধ এবং সুদর্শন (গজতুরগ-সতত-পীড়ন-ক্রমোচিতশ্রম বলিততনুবিভাগ- রম্যদর্শন)। রাজ-পরিবারে এবং অভিজাতবর্গের পুরুষদের মধ্যে হস্তী ও অশ্বক্রীড়া সুপ্রচলিত ছিল, সন্দেহ নাই।

 

নৃত্যগীতবাদ্য ও অভিনয়

নৃত্যগীতবাদ্যের প্রচলন ও প্রসার সম্বন্ধে প্রমাণ সুপ্রচুর। রামচরিত, পবনদূত প্রভৃতি কাব্যে, নানা লিপিতে, সদুক্তিকর্ণামৃতের প্রকীর্ণ শ্লোকে, চর্যাগীতি ও দোঁহাকোষের নানা জায়গায় নানাসূত্রে নৃত্যগীতবাদ্যের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। মনে হয়, উচ্চ ও নিম্নকোটি উভয় স্তরেই এই দুই বিদ্যা ও ব্যসনের সমাদর ছিল যথেষ্ট। বাররামা ও দেবদাসীদের সকলেই নৃত্যগীতবাদ্যপটীয়সী হইতে হইত। তাঁহারা যে নানা কলানিপুণা ছিলেন, এ-কথার ইঙ্গিত সেন-লিপিতে এবং পবনদূতেও আছে। রাজতরঙ্গিণী-গ্রন্থে দেখিতেছি, পুণ্ড্রবর্ধনের কার্তিকেয় মন্দিরে যে নৃত্যগীত হইত তাহা ভরতের নাট্যশাস্ত্রানুযায়ী, এবং নৃত্যগীতমুগ্ধ জয়ন্ত স্বয়ং ভরতানুমোদিত নৃত্যগীত শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। পাহাড়পুর ও ময়নামতীর পোড়ামাটির ফলকগুলিতে এবং অসংখ্য ধাতব ও প্রস্তরমূর্তিতে নানা ভঙ্গিতে নৃত্যপর পুরুষ ও নারীর প্রতিকৃতি সুপ্রচুর। বৃহদ্ধর্ম ও ব্রহ্মবৈবর্ত উভয় পুরাণেই নট পৃথক বর্ণহিসাবেই উল্লিখিত হইয়াছেন, সমাজের নিম্নতর স্তরে। এখনও বাঙালী সমাজের নিম্নতর স্তরে। এখনও বাঙালী সমাজের নিম্নস্তরে এক ধরনের গায়কগায়িকা দেখিতে পাওয়া যায়, গান গাহিয়া এবং নাচিয়াই যাঁহারা জীবিকা নির্বাহ করেন; ইঁহারাই বোধ হয় উপরোক্ত পুরাণ দুইটির নটবর্ণ। কিন্তু উচ্চকোটির কেহ কেহও বোধ হয় নটনটীর বৃত্তি গ্রহণ করিতেন। জয়দেব-গৃহিনী পদ্মাবতী প্রাকবিবাহ-জীবনে কুশলী নটী ছিলেন এবং সংগীতে তাঁহার খুব প্রসিদ্ধি ছিল। পাহাড়পুর ও ময়নামতীর ফলকগুলিতে, কোনও কোনও প্রস্তরচিত্রে, নানা প্রকারের বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটে, যেমন কাঁশর, করতাল, ঢাক, বীণা, বাঁশি, মৃদঙ্গ, মৃৎভাণ্ড প্রভৃতি। রামচরিতে দেখিতেছি, বরেন্দ্রীতে বিশেষ এক ধরনের মুরজ (মৃদঙ্গ) বাদ্য প্রচলিত ছিল; বাঙলার অন্যত্র বোধ হয় অন্য প্রকারের মুরজের প্রচলন ছিল। সদুক্তিকর্ণামৃতের একটি শ্লোকে আছে তুম্বীবীণার উল্লেখ। কিন্তু সর্বাপেক্ষা বিস্তৃত ও ঘনিষ্ঠ বিবরণ পাইতেছি চর্যাগীতিতে—কণ্ঠ ও যন্ত্রসংগীত উভয়েরই, নানাপ্রকার বাদ্যযন্ত্রের এবং বোধ হয় গীতাভিনয়েরও। নিম্নশ্রেণীর নটনটীদের কথা আগেই বলিয়াছি। চর্যাগীতিতে দেখিতেছি, ডোম্বীরা সাধারণত খুব নৃত্যগীতপরায়ণা হইতেন।

এক সো পদ্ম চৌষঠী পাখুড়ী।
তঁহি চড়ি নাচঅ ডোম্বী বাপুড়ী।

একটি পদ্ম, তাহার চৌষট্টি পাপড়ি; তাহাতে চড়িয়ে নাচে ডোম্বী।

লাউ-এর খোলা আর বাঁশের ডাঁট বা দণ্ডে তন্ত্রী (তার) লাগাইয়া বীণা জাতীয় একপ্রকার যন্ত্র ইঁহারা প্রস্তুত করিতেন, আর গান গাহিয়া গাহিয়া গ্রামে গ্রামান্তরে ঘুরিয়া বেড়াইতেন।

সুজ লাউ সসি লাগেলি তান্তী।
অণহা দাণ্ডী চাকি কিঅত অবধূতী।।
বাজই অলো সহি হেরুঅ বীণা।।
সুন তান্তিধ্বনি বিলসই রুণা।।
*             *             *
নাচন্তি বাজিল গাঅন্তি দেবী।
বুদ্ধনাটক বিসমা হোই।।

সূর্য লাউ-এ শশী লাগিল তন্ত্রী, অনাহত দণ্ড—সব এক করিয়া অবধূতী। ওলো সখি, হেরুক-বীণা বাজিতেছে; শোন্‌, তন্ত্রীধ্বনি কি সকরুন বাজিতেছে! * * * বজ্রাচার্য নাচিতেছে, দেবী গাহিতেছে—এইভাবে বুদ্ধনাটক সুসম্পন্ন হয়।

বুদ্ধ-নাটকের উল্লেখ লক্ষ করিবার মতন। নৃত্য এবং গীতের সাহায্যে এক ধরনের নাট্যাভিনয় বোধ হয় প্রাচীন বাঙলায় সুপ্রচলিত ছিল, এবং এই নাচ-গানের ভিতর দিয়াই বোধ হয় কোনও বিশেষ ঘটনাকে (এই ক্ষেত্রে বুদ্ধদেবের জীবন কাহিনীকে?) রূপদান করা হইত।

অবান্তর হইলেও এই প্রসঙ্গে বলিয়া রাখা চলে, নৃত্যগীতপরায়ণা ছিলেন বলিয়াই বোধ হয় ডোম্বী ও অন্যান্য তথাকথিত নীচ জাতীয়া রমণীদের সামাজিক নীতিবন্ধন কিছুটা চঞ্চল ও শিথিল হইত, এবং সেই হেতু তাঁহারা অনেক ক্ষেত্রে উচ্চকোটির পুরুষদেরও মনোহরণে সমর্থ হইতেন। তাহা ছাড়া জাতি ও শ্রেণীসংস্কারমুক্ত সহজযানী ও কাপালিকদের যোগের সঙ্গিনী হইতেও কোনও বাধা তাঁহাদের বা যোগীদের কাহারও হইত না।

কইসণি হালো ডোম্বী তোহোরি ভাভরী আলী।
অন্তে কুলিণজণ মাঝেঁ কাবালী॥
*         *         *
কেহো কেহো তোহোরে বিরুআ বোলই।
বিদুজণ লোঅ তোরেঁ কণ্ঠ ন মেলই॥
কাহ্নে গাই তু কামচণ্ডালী।
ডোম্বীত আগলি নাহি চ্ছিণালী॥

হাঁলো ডোম্বী, কিরূপ (আশ্চর্য) তোর চাতুরী! তোর (এক) অন্তে কুলীন জন, (আর) মধ্যে কাপালী! কেহ কেহ তোকে বলে বিরূপ (তাহাদের প্রতি), (কিন্তু) বিদ্বজ্জন তোকে কণ্ঠ হইতে ছাড়ে না। কাহ্নু (কাহ্ন) গায়, তুই কামচণ্ডালী, ডোম্বীর চেয়ে বেশি ছিলানী (আর) কেহ নাই।

 

লোকায়ত সমাজে এবং সামাজিত ও ধর্মগত উৎসবানুষ্ঠান উপলক্ষে, নানা ক্রিয়াকর্মে নৃত্যগীতের প্রমাণ সমসাময়িক শিল্প-সাহিত্যে সুস্পষ্ট। চর্যাগীতির একটি গীতে সমসাময়িক বিবাহযাত্রার একটি সংক্ষিপ্ত অথচ সুন্দর বর্ণনা আছে এবং সেই প্রসঙ্গে কয়েকটি বাদ্যযন্ত্রেরও উল্লেখ আছে। কাহ্নপাদ বলিতেছেন :

ভবনির্বাণে পড়হ মাদলা।
মনপবন বেণি করণ্ডকশালা॥
জঅ জঅ দুন্দুহি সাদ উছলিআঁ।
কাহ্ণ ডোম্বী বিবাহে চলিঅ॥
ডোম্বী বিবাহিআ অহারিউ জাম।
জউতুকে কিঅ আণতু ধাম॥

ভব ও নির্বাণ হইল পটহ মাদল; মনপবন দুই করণ্ডক শালা। জয় জয় দুন্দুভি শব্দ উচ্ছলিত করিয়া কাহ্ন চলিল ডোম্বীকে বিবাহ করিতে। ডোম্বীকে বিবাহ করিয়া জন্ম খাইলাম, কিন্তু যৌতুকে (লাভ) করিলাম অনুত্তরধাম (অর্থাৎ, নীচু জাতের ডোম্বীকে বিবাহ করিয়া জাত কুল গেল বটে, কিন্তু ভালো যৌতুক পাওয়া গিয়াছে, তাহাতেই ক্ষতি যেন সব পূরণ হইয়া গিয়াছে, এই ভাবে)।

তখনকার দিনেও বাঙলাদেশে বিবাহ ব্যাপারে বরপক্ষ যৌতুক লাভ করিত, এবং যৌতুকের লোভে নীচকুল হইতে কন্যাগ্রহণেও খুব আপত্তি ছিল না। অন্যান্য সংবাদের সঙ্গে এই প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতটিও এই গীতে বিদ্যমান।

 

যানবাহন ।। নৌযান

সাধারণ লোকেরা স্থলপথে পদব্রজে এবং জলপথে ভেলা বা ডিঙ্গা এবং নৌকাযোগেই যাতায়াত করিত। ভেলা, ডিঙ্গা-ডিঙ্গী-ডোঙ্গা, প্রত্যেকটি শব্দই অস্ট্রিক ভাষার দান, এবং মনে হয়, আদিমতম কাল হইতেই ইহাদের সঙ্গে বাঙ্গালীর পরিচয় ছিল ঘনিষ্ঠ। নৌকার ব্যবহার, নৌ-বন্দর, নৌ-ঘাটি, নৌবাণিজ্য, নৌদণ্ডক প্রভৃতির কথা ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসঙ্গে আগেই বলিয়াছি; কিন্তু নৌকার সঙ্গে বাঙালী জীবনের ঘনিষ্ঠ আত্মিক যোগের কথা ধরা পড়িয়াছে চর্যাগীতিতে। রূপকছলে নৌকা, নৌকার হাল, গুণ, কেড়ুঁয়াল, পুলিন্দা, খোল, চক্র বা চাকা, খুঁটি, কাছি, সেঁউতি, পাল প্রভৃতি এমন সহজভাবে ব্যবহার করা হইয়াছে যে, মনে হয়, এই যানটির সঙ্গে বাঙালীর হৃদয়ের একটি গভীর যোগ ছিল। নৌকায় খেয়া-পারাপারের ইঙ্গিতও আছে। পারের মাশুল আদায় হইত কড়িতে (কবড়ী) বা বোড়িতে। খেয়া-পারাপারের কাজ অনেক সময় নিম্নশ্রেণীর নারীরাও করিতেন। চর্যাগীতির একটি গীতিতে দেখিতেছি পাটনীর কাজটি করিতেছেন জনৈকা ডোম্বী।

গঙ্গা জউনা মাঝেঁরে বহই নাই।
তহিঁ বুড়িলী মাতঙ্গী পোইআ লীলে পার করেই॥
বাহতু ডোম্বী বাহ লো ডোম্বী বাটত ভইল উছারা।
সদ্‌গুরু পঅইপত্র জাইব পুণু জিণ উরা॥
পাঞ্চ কেড় আল পড়ন্তে মাঙ্গে পিঠত কচ্ছী বান্ধী।
গঅণ খোলে সিঞ্চহু পাণী ন পইসই সান্ধী।।
*           *            *
কবড়ী ন লেই বাড়ী ন লেই সুচ্ছড়ে পার করই।
জো রথে চড়িলা বাহবা ন জাই কুলে কুল বুলই॥

গঙ্গা আর যমুনার মাঝে বহিতেছে নৌকা; মাতঙ্গ কন্যা ডোম্বী তাহাতে জলে ডুবিয়া ডুবিয়া লীলায় পার করিতেছে। বাহ গো ডোম্বী, বাহিয়া চল, পথেই দেরি হইয়া যাইতেছে; সদগুরু পাদপদ্মে যাইব জিনপুর। পাঁচটি দাঁড় পড়িতেছে পথে, পিঠে কাছি বাঁধ, সেঁউতিতে জল সেচ, জল যেন সন্ধিতে প্রবেশ না করিতে পারে।… কড়িও লয় না, বুড়িও লয় না, স্বেচ্ছায় করে পার; যাহারা রথে চড়িল, নৌকা বাওয়া জানিল না, তাহারা শুধু কুলে কুলে ঘুরিয়া ফিরিল।

সহরপাদের একটা গীতে আছে :

কাঅ ণাবড়ি খাণ্টি মণ কেডুআল ।
সদ্‌গুরু-বঅণে ধর পতিবাল ॥
চীঅ থির করি ধরহুরে নাই ।
আন উপায়ে পার ন জাই ॥
নৌবাহী নৌকা টানঅ গুণে ।
মেলি মেল সহজে জাউ ণ আণেঁ ॥
বাটত ভঅ খাণ্ট বি বলআ ।
ভব উলোলেঁ সর বি বোলিআ ॥
কুল লৈ খর সে উজাঅঁ ।
সরহ ভণৈ গঅণেঁ সমাঅ ॥

কায় (হইতেছে) নৌকা, খাঁটি মন (হইল তাহার) দাঁড়; সদগুরু বচনে হাল ধর। চিত্ত স্থির করিয়া নৌকা ধর; অন্য উপায়ে পারে যাওয়া যায় না। নৌবাহী নৌকা টানে গুনে; সহজে গিয়া মিলিত হও, অন্য (পথে) যাইও না। পথে (আছে) ভয়, বলবান দস্যু; ভব উল্লোলে (তরঙ্গে) সবই টলমল। কূল ধরিয়া খরস্রোতে উজাইয়া যায়; সরহ বলে, গগনে গিয়া প্রবেশ করে।

অন্যত্র কম্বলপাদ বলিতেছেন :

খুঁটি উপাড়ী মেলিলি কাচ্ছি ।
বাহতু কামলি সদ্‌গুরু পুচ্ছি ॥
মাঙ্গত চড্‌হিলে চৌদিস চাহঅ ।
কেডুআল নাহি কেঁকি বহবকে পারঅ ॥

খুঁটি (গাঁজ) উপড়াইয়া কাছি খুলিয়া দাও; হে কামলি (পূর্ব-বাঙলায় মাঝি প্রভৃতি দিন-মজুরদের আজও কাম্‌লা বা কামুলা) সদ্‌গুরুকে জিজ্ঞাসা করিয়া নৌকা বাহিয়া চল। পথ চড়িয়া (মাঝনদীতে আসিয়া) চারদিকে দেখিয়া দেখ, দাঁড় না থাকিলে কে বাহিতে পারে।

নদ-নদী-খাল-বিলের বাঙলাদেশে নৌকা ও নদীকে কেন্দ্র করিয়া আধ্যাত্ম-জীবনের রূপ-রূপক গড়িয়া উঠিবে, ইহা কিছু বিচিত্র নয়।

ভবনই গহণ গম্ভীর বেগেঁ বাহী।
দুআন্তে চিখিল মাঝেঁ ন থাহী।।

ভবনদী গভীর, গম্ভীর বেগে বহিয়া চলে। দুই তীরে কাদা, মাঝে ঠাঁই নাই।

এ-ছবি তো একান্তই বাঙলার নদনদীগুলির : দুই তীর পলিমাটি কাদায় ভরা। আর, নদীর গভীর গম্ভীর বেগ, সেও তো গঙ্গা-পদ্মা-মেঘনা-লৌহিত্যেরই। সরহপাদের একটি গীতে আছে,

বাম দহিন জো খাল-বিখলা।
সরহ ভণই বাপা উজুবাট ভইলা।।

(পথে) বামে দক্ষিণে অনেক খাল-বিখাল; সরহ বলেন, সোজা পথ ধরিয়া চল (অর্থাৎ, খাল-বিখালের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িও না, সোজা চলিয়া যাও)।

এই ছবিও তো একান্তই বাঙলাদেশের। এত খাল-বিখালই বা আর কোথায়! শান্তিপাদের একটি গীতে আছে :

কূলে কূলে মা হোইরে মূঢ়া উজুবাট সংসারা ।
বাল ভিণ একুবাকু ণ ভুলহ রাজপথ কন্ধারা ॥
মাআ মোহ সমুদারে অন্ত ন বুঝসি থাহা ।
আগে নাব ন ভেলা দীসৈ ভন্তি ন পুচ্ছসি নাহা ॥
সুনাপান্তর উহ ন দীসই ভান্তি ন বাসসি জান্তে ।
এস আট মহাসিদ্ধি সিঝৈ উজুবাট জাঅন্তে ॥
বামদাহিণ দো বাটা চ্ছাড়ী শান্তি বুলথেউ সংকেলিউ ।
ঘাট ণ গুমা খড়তড়ি ণ হোই আখি বুঝিব বাট জাইউ ॥

হে মূঢ় কূলে কূলে ঘুরিয়া ফিরিও না; সংসারের (মাঝখানে রহিয়াছে) সহজ পথ। সম্মুখে পড়িয়া আছে যে সমুদ্র, তাহার অন্ত যদি না বুঝা যায়, থই যদি না পাওয়া যায়, সম্মুখে যদি কোনও নৌকা বা ভেলা দেখা না যায়, তবে অভিজ্ঞ পথিক যাঁহারা তাঁহাদের নিকট হইতে পথের দিশা জানিয়া লও। শূন্যে প্রান্তরে যদি পথের ঠিকানা না মেলে, তবু ভ্রান্তির পথে আগাইয়া যাওয়া উচিত নয়। সোজা সহজ পথ ধরিয়া গেলেই মিলিবে অষ্টমহাসিদ্ধি। খেলা করিতে করিতে বাম ও দক্ষিণ পথ ছাড়িয়া (মাঝপথে) চলিতে হইবে। এই সহজপথে ঘাট ঝোপ কিছু নাই, বাধাবিঘ্ন কিছু নাই; চোখ বুঝিয়া এই পথে চলা যায়।

 

গো-যান । হস্তী ও অশ্বযান

স্থলপথে গ্রাম হইতে দূরে গ্রামান্তরে বা নগরে যাইবার লোকায়ত যান ছিল গো-রথ বা গরুর গাড়ি। মহিষের গাড়ির উল্লেখ দেখিতেছি না; কিন্তু নৈষধচরিতের সাক্ষ্য যদি প্রামাণিক হয় তাহা হইলে স্বীকার করিতে হয়, বাঙালী প্রাচীন কালে মহিষের দধি ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিল। গ্রীক ঐতিহাসিকদের বিবরণীতে দেখিতেছি, প্রাচ্য ও গঙ্গারাষ্ট্রের রাজাদের চতুরশ্ববাহিত রথ ছিল। অশ্ববাহিত যান উচ্চকোটির লোকেরা ব্যবহার করিতেন, সন্দেহ করিবার কারণ নাই। গ্রীক ঐতিহাসিকেরা বলিতেছেন, যুদ্ধে গঙ্গারাষ্ট্রের সৈন্যবলের মধ্যে প্রধান বলই ছিল হস্তীবল। অসংখ্য লিপিতেও হস্তীসৈন্যর উল্লেখ সুপ্রচুর। সুপ্রাচীন কাল হইতেই পূর্বভারতের হস্তী অন্যতম প্রধান বাহন বলিয়াও গণ্য হইত। এই পূর্ব-ভারতেই, বিশেষভাবে বাঙলাদেশে ও কামরূপে, হাতি ধরা ও হাতির চিকিৎসা ইত্যাদি সম্বন্ধে একটি বিশেষ শাস্ত্রই গড়িয়া উঠিয়াছিল। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় তো বলেন, হস্তী-আয়ুর্বেদ বাঙলার অন্যতম প্রধান গৌরব। রাজ-রাজড়া, সামন্ত-মহাসামন্তরা, বড় বড় ভূম্যধিকারীরা হাতিতে চড়িয়াও যাতায়াত করিতে সন্দেহ নাই। চর্যাগীতি ও দোহাকোষে হাতির রূপক আশ্রয়ে অনেকগুলি গীত স্থান পাইয়াছে, এবং রূপকগুলি এমন, মনে হয়, এই প্রাণীটির সঙ্গে বাঙালীর প্রাণের গভীর পরিচয় ছিল। খেদা পাতিয়া আজিকার দিনে যেমন করিয়া হাতি ধরা হয় তখনও তেমন করিয়াই হাতি এবং হাতিশিশু (করভ) ধরা হইত। বন্য হাতী সুদৃঢ় করিয়া বাঁধিয়া রাখা হইত। চর্যাগীতিতে কাহ্নপাদের একটি গীত আছে :

এবং কার দৃঢ় বাখোড় মোড়িউ ।
বিবিহ বিআপক বাহ্মণ তোড়িউ ॥
কাহ্নু বিলসঅ আসব মাতা ।
সহজ নলিনীবন পৈসি নিবিতা ॥

কিন্তু বন্যহাতি কোনো বাধা বন্ধনই মানিত না, সমস্ত শিকল ছিঁড়িয়া খুঁটি ভাঙিয়া পদ্মবনে গিয়া প্রবেশ করিত।

পাগলা হাতির বর্ণনা মহীধরপাদের একটি গানেও আছে।

মাতেল চীঅ গএন্দা ধারই ।
নিরনতর গঅণন্ত তুসেঁ ঘোলই ॥
পাপ পুণ্ণ বেণি তোড়িঅ সিকল মোড়িঅ খম্ভাঠানা ।
গঅন টকলি লাগিয়ে চিত্ত পৈতি নিবানা ॥

আমার মত্ত চিত্তগজেন্দ্র ধাবিত হইতেছে; নিরন্তর গগনে সকল কিছু ঘোলাইয়া যাইতেছে। পাপ ও পুণ্য উভয়ই শিকল ছিঁড়িয়া এবং সকল খাম্ভা মাড়াইয়া গগন-শিখরে গিয়া পৌঁছিয়া একেবারে শান্ত হইয়াছে।

উত্তর ও পূর্ব বাঙলার পার্বত্য নদীর তীরে হাতিরা ঘুরিয়া বেড়াইত যথেচ্ছভাবে। সরহপাদ বলিতেছেন :

মুক্কই চিত্তগজেন্দ করু এত্থ বিঅপ্প ণু পুচ্ছ ।
গঅন গিরী ণৈজল পিএউ তিহুঁ তড় বসউ সইচ্ছ ॥

চিত্ত গজেন্দ্রকে মুক্ত কর; এ বিষয়ে আর কোনও বিকল্প জিজ্ঞাসা করিও না। গগন গিরির নদী জল সে পান করুক, তাহার তটে স্বেচ্ছায় সে বাস করুক।

হাতি ধরিবার আগে সারিগান গাহিয়া হাতির মনকে বশ করিতে হইত। বীণাপাদের একটি গান আছে :

আলি কালি বেণি সারি মুণিয়া।
গঅরব সমরস সান্ধি গুণি আ।।

 

গরুর গাড়ির চেহারা এখনও যেরূপ প্রাচীনকালেও তাহাই ছিল; বাঙলা ও ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন প্রস্তর ও মৃৎফলকই তাহার প্রমাণ। বরযাত্রায়ও গরুর গাড়ি ব্যবহার করা হইত, চর্যাগীতির একটি গীতে এইরূপ ইঙ্গিত আছে। পাহাড়পুরের একট মৃৎফলকে সুসজ্জিত অশ্বের একটি চিত্র আছে; এই ধরনের সজ্জিত অশ্বে চড়িয়াই সঙ্গতিসম্পন্ন লোকেরা যাতায়াত করিতেন।

পাল্কীর ব্যবহারও ছিল বলিয়াই মনে হয়। কেশবসেনের ইদিলপুর-লিপিতে দেখিতেছি, একটু প্রচ্ছন্নভাবে হস্তীদন্তনির্মিত বাহদণ্ডযুক্ত পাল্কীর উল্লেখ। বল্লালসেন নাকি তাঁহার শত্রুদের রাজলক্ষ্মীদিগকে বন্দী করিয়া লইয়া আসিয়াছিলেন, এই ধরনের পাল্কী চড়াইয়া।

রামচরিত ও পবনদূতে রামাবতী ও বিজয়পুরের বর্ণনা এবং বাণগড়, রামপাল, মহাস্থান, দেওপাড়া প্রভৃতি স্থানের ধ্বংসাবশেষ হইতে মনে হয়, সমৃদ্ধ নগরবাসীরা ইটকাঠের তৈরী খুদ্র বৃহৎ হর্মে বাস করিতেন; রাজপ্রাসাদও তৈরী হইত ইটকাঠেই। কিন্তু এই সব ভবনের আকৃতি প্রকৃতি কিরূপ ছিল তাহা জানিবার উপায় নাই। গ্রামের ইটকাঠের বাড়ি বড় একটা ছিল বলিয়া মনে হয় না; কোনো গ্রামবর্ণনাতেই সেরূপ কোনো উল্লেখ দেখিতেছি না। দরিদ্র নিম্নকোটির লোকেরা ত বটেই, এমন কি সম্পন্ন মহত্তর-কুটুম্ব-গৃহস্থরাও সাধারণত মাটি, খড়, বাঁশ, কাঠ ইত্যাদির তৈরী বাড়িতে বাস করিতেন; মৃৎফলকের সাক্ষ্যে মনে হয়, চাল হইত খড়ের, বাঁশের চাঁচারী বুনিয়া তৈরী হইত বেড়া, আর খুঁটি হইত বাঁশের বা কাঠের। চর্যাগীতিতে বাঁশের চাঁচারী দিয়া বেড়া বাঁধিবার কথা আছে (চারিপাশে ছাইলারে দিয়া চঞ্চালী)। মাটির দেয়ালও ছিল; রাঢ়াঞ্চলে ও উত্তরবঙ্গে মাটির দেয়াল, পূর্বাঞ্চলে চাঁচারীর বেড়া। প্রস্তর ও মৃৎফলকের চিত্র এবং পাণ্ডুলিপি-চিত্র হইতে মনে হয়, আজিকার মতন তখনও বাঁশের বা কাঠের খুঁটির উপর ধনুকাকৃতি বা দুই তিন স্তরে পিরামিডাকৃতির চাল বা ছাউনি তৈরি হইত। একান্ত গরীব গৃহস্থ ও সমাজ-শ্রমিকেরা কুঁড়েঘরে বাস করিতেন। সদুক্তিকর্ণামৃত-গ্রন্থের একটি শ্লোকে এই ধরনের কুঁড়েঘরের একটি বাস্তব বর্ণনা আছে। ‘প্রচুর পয়সি’ প্রাচ্য দেশে এবং বৃষ্টিবহুল বাঙলাদেশে দরিদ্র গৃহস্থের জীর্ণগৃহের দুর্দশার এমন বস্তুনির্ভর অথচ কাব্যময় বর্ণনা বিরল। কবি বার ছবি আঁকিয়াছেন:

চলৎ কাষ্ঠং গলৎকুড্যমুত্তানতৃণ সঞ্চয়ম।
গণ্ডুপদার্থিমণ্ডুকাকীর্ণং জীর্ণং গৃহং মম।।

কাঠের খুঁটি নড়িতেছে, মাটির দেয়াল গলিয়া পড়িতেছে, চালের খড় উড়িয়া যাইতেছে; কেঁচোর সন্ধানে ব্যাঙের দ্বারা আমার জীর্ণ গৃহ আকীর্ণ।

 

নদ-নদী-খাল-বিখালের বাঙলাদেশে এ-পাড় হইতে ও-পাড় যাইতে আজিকার মতো তখনও সাঁকোর প্রয়োজন ছিলই; এই কারণেই বাঁশ কিংবা কাঠের সাঁকোর সঙ্গে বাঙালীর পরিচয়ও ছিল প্রাচীন কাল হইতেই। চর্যাগীতির একটি গীতে বলা হইয়াছে, পারগামী লোক যাহাতে নির্ভয়ে পারাপার করিতে পারে সেজন্য চাটিলপাদ বেশ একটি দৃঢ় সাঁকো প্রস্তুত করিয়া দিয়াছিলেন। বড় গাছ চিরিয়া সাঁকোর পাট জোড়া দেওয়া হইত এবং টাঙ্গিদ্বারা ইহা শক্ত করা হইত।

ধামার্থে চাটিল সাঙ্কম গঢ়ই।
পারগামী লোঅ নীভর তরই।।
ফাড়িঅ মোহতরু পাটী জোড়িঅ।
অদঅদিঢ়ি টাঙ্গি নিবাণে কোডিঅ।।

 

তৈজসপত্র 

গৃহের আসবাবপত্রের মধ্যে নানা জিনিসের উল্লেখ চর্যাগীতি, রামচরিত, পবনদূত প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে, এবং তাহাদের প্রতিকৃতি প্রস্তর ও মৃতফলকে দেখিতেছি। সমৃদ্ধ, বিত্তবান লোকেরা সোনা ও রূপার তৈরী থালা-বাসন ব্যবহার করিতেন। কিন্তু গ্রামবাসী সাধারণ গৃহস্থেরা কাঁসার এবং দরিদ্র লোকেরা সাধারণত মাটির ভোজন ও পানপাত্র ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিলেন। বাঙলার নানা প্রত্নস্থানের ধ্বংসাবশেষ হইতে অসংখ্য মৃৎপাত্রের ভাঙা টুকরা প্রচুর পাওয়া গিয়াছে। পাহাড়পুর ও ময়নামতীর মৃতফলক এবং নানা প্রস্তরফলকে মাটির খেলনা, ফুলদানী, খাট, নানা আকৃতির কলস, বাটি, পান ও ভোজনপাত্র, মাটির জালা, লোটা, দোয়াত, দীপাধার, ঘড়া, জলচৌকী, পুস্তকাধার প্রভৃতির প্রতিকৃতি দেখিতে পাওয়া যায়। এ-সব তৈজসপত্রের বহুল প্রচলন ছিল, সন্দেহ নাই। নানা সুদৃশ্য মণ্ডনালংকারযুক্ত এবং স্বর্ণনির্মিত বিচিত্র আসবাবপত্রের কথা রামচরিতে উল্লেখিত আছে। এ-সব তৈজসপত্র সমৃদ্ধ লোকেদের আয়ত্ত ছিল, সন্দেহ নাই! তবকাত্‌-ই-নাসীরী-গ্রন্থে আছে, লক্ষণসেনের রাজপ্রাসাদে সোনা ও রূপার ভোজনপাত্র ব্যবহৃত হইত। কেশবসেনের ইদিলপুর লিপিতে লোহার জলপাত্রের উল্লেখ আছে।