৫. পাল ও চন্দ্রপর্ব

৫. পাল ও চন্দ্রপর্ব

সপ্তম শতকের শেষার্ধ ও অষ্টম শতকের একপাদেরও অধিককাল ধরিয়া বাঙলাদেশের রাষ্ট্রক্ষেত্রে জটিল ও গভীর আবর্ত। স্থানে স্থানে ছোট ছোট রাজবংশের ক্ষণস্থায়ী রাজত্ব, ভিন প্রদেশী সমরাভিযান, যুদ্ধ, জয়-পরাজয়, ভোট বা তিব্বত, কাশ্মীর, নেপাল প্রভৃতি হিমালয়ক্রোড়স্থিত দেশগুলির সঙ্গে নূতন যোগাযোগ, মাৎস্যন্যায় প্রভৃতির সম্মিলিত ক্রিয়া সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও জটিল ও গভীর আবর্তের সৃষ্টি করিয়াছিল, সন্দেহ নাই। আজ সেই আবর্তের আকৃতি-প্রকৃতি বুঝিবার উপায়ও নাই। অথচ, পাল ও চন্দ্র-পর্বের বাঙলাদেশে মহাযান বৌদ্ধধর্মের ও শক্তিধর্মের যে তান্ত্রিক বিবর্তন, যে বিভিন্নি গুহ্য রহস্যবাদী, দেহবাদী ধর্মসম্প্রদায়ের সৃষ্টি তাহার বীজ বোধ হয় এই আবর্তের ইতিহাসের মধ্যেই নিহিত।

হর্ষবর্ধনই ভারতেতিহাসের সর্বশেষ “সকলোত্তরপথনাথ”; তাঁহার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর-ভারতে একরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন প্রায় বিলীন হইয়া গেল, সর্বভারতীয় আদর্শ প্ৰায় বিদায় লইল। নানা কারণে এক একটি ভৌগোলিক অঞ্চলকে কেন্দ্র করিয়া বিভিন্ন রাজবংশ গড়িয়া ওঠার সূচনা হইল এবং সেই অঞ্চলের চতুঃসীমার মধ্যে ধীরে ধীরে এক একটি স্বাধীন স্বতন্ত্র রাষ্ট্র, স্থানীয় ভাষা ও লিখনভঙ্গী, স্থানীয় ধর্ম ও সংস্কৃতি গড়িয়া ওঠার সূচনা দেখা দিল। ইহার সুস্পষ্ট প্রকাশ দেখা দিতে আরম্ভ করিল অষ্টম শতক হইতে। সর্বভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির ভিত্তির উপর প্রত্যেক ভৌগোলিক সীমায় এক একটি স্থানীয় ধর্ম, ভাষা, সাহিত্য, শিল্প, এক কথায় স্থানীয় সংস্কৃতি গড়িয়া তোলা, ইহাই যেন হইল অষ্টম-শতক পরবর্তী ভারতীয় ইতিহাসের ইঙ্গিত। সর্বভারতীয় বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ক্ষেত্রে বাঙলার যে বিশিষ্ট চিন্তা ও কল্পনা, যে কর্মকৃতি তাহা যেন এই সময় হইতেই দেখা দিতে আরম্ভ করিল। ভাষা, সাহিত্য ও শিল্পের ক্ষেত্রেও এ কথা সমান প্রযোজ্য।

য়ুয়ান-চোয়াঙের সময়েই ভারতবর্ষ জুড়িয়া বৌদ্ধ ধর্মের অবনতি আরম্ভ হইয়া গিয়াছিল। ফা-হিয়েন বৌদ্ধ ধর্মের যে সমৃদ্ধ অবস্থা দেখিয়া গিয়াছিলেন, য়ুয়ান্-চোয়াঙ্‌ আর তাহা দেখিতে পান নাই। তাঁহার কালে বহু বৌদ্ধ স্তূপ, মন্দির ও সংঘারাম পড়িয়াছিল ভগ্ন দশায়, বহু ছিল পরিত্যক্ত, এমন কি কপিলবাস্তু, কুসিনারা, শ্রাবস্তী, কৌশাম্বী প্রভৃতি বৌদ্ধ তীর্থগুলিরও সেই অতীত সমৃদ্ধি আর ছিল না। বহু সংখ্যক বৌদ্ধ দেবপূজক ও তীর্থিকদের প্রভাব স্বীকার করিয়া লন। হর্ষবর্ধনের সক্রিয় সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা কনৌজে তথা মধ্যদেশে সদ্ধর্মের কিছু সমৃদ্ধির কারণ হইলেও ভারতের অন্যত্র তাহা এই অবনতির স্রোত ঠেকাইয়া রাখিতে পারে নাই। সর্বত্রই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রবল প্রতাপ : বাঙলাদেশেও তাহার ব্যতিক্রম হয় নাই। তারনাথ বলিতেছেন, পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপালদেবের অব্যবহিত আগে এবং তাঁহার কালে বাঙলাদেশে বৌদ্ধ ধর্মের অত্যন্ত দুরবস্থা; অনেক বৌদ্ধ মন্দির ও বিহার ভগ্ন বা ভগ্নপ্রায় অথবা তীর্থিকদের দ্বারা অধ্যুষিত; ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রসার ও প্রতিপত্তি ক্রমবর্ধমান। য়ুয়ান্-চোয়াঙের সময়েই তো বাঙলাদেশে বৌদ্ধদের যেখানে ছিল মাত্র ৭০টি বিহার সংঘারাম, সেখানে ব্রাহ্মণ্য দেবমন্দিরের সংখ্যা ছিল তিন শত। যাহাই হউক, অষ্টম হইতে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত ভারতের অন্যত্র, অর্থাৎ উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের কোথাও কোথাও বৌদ্ধ ধর্ম ও সংঘের অস্তিত্বের সংবাদ ও মূর্তি নির্দশন কিছু কিছু পাওয়া যায়, সন্দেহ নাই, কিন্তু তাহা অতীত ইতিহাসের অর্থলুপ্ত অবশেষ মাত্র তাহার সার্থক মূল্য আর বিশেষ কিছু নাই। বৌদ্ধ ধর্ম ও সংঘ ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রবল প্রতিযোগিতায় টিকিয়া থাকিতে পারে নাই। কিন্তু, সুদীর্ঘ তিন চার শত বৎসর ধরিয়া একাধিক বৌদ্ধ রাজবংশের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতার ফলে পূর্বভারত – বিশেষভাবে বঙ্গ, গৌড়, মগধ—ভারতীয় বৌদ্ধ ধর্মের শেষ আশ্রয়স্থল হইয়া এই ধর্মের পরমায়ু আরও চার পাঁচ শত বৎসর বাড়াইয়া দিল। তাহারই ফলে মহাযান-যোগাচার বজ্রযান বৌদ্ধ ধর্মের নূতন নূতন রূপ ও ধ্যান প্রত্যক্ষ করিবার সুযোগ আমাদের ঘটিল। এই নূতন নূতন রূপ ও ধ্যান একান্তই পূর্ব-ভারতের, বিশেষভাবে বাঙলাদেশের সৃষ্টি।

বৌদ্ধ ধর্মে যেমন ব্রাহ্মণ্য ধর্মেও তেমনই। সর্বভারতীয় ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার বাঙলাদেশ এ-যাবৎ যাহা পাইয়াছিল এবং এই চারিশত বৎসর ধরিয়া যাহা পাইতেছিল সে-মূলধন তো তাহার ছিলই। কিন্তু এই মূলধনের উপর বাঙলাদেশ নূতন কিছু কিছু গড়িয়া তুলিবার চেষ্টাও করিয়াছে, বিশেষ ভাবে বৈষ্ণব ধর্মে এবং শাক্ত ধর্মে। ক্রমে এ-সব কথা বিস্তৃতভাবে বলিবার সুযোগ হইবে।

বৈদিক ধর্ম

আর্য ব্রাহ্মণ্যধর্মের মূল কথা বৈদিক ধর্ম ও শ্রৌত সংস্কার। কাজেই এই ধর্ম ও সংস্কারের কথাই আগে বলি। ইহাদের প্রসার ও প্রতিপত্তির সূচনা গুপ্ত-পরেই দেখিয়াছি। পাল-চন্দ্র পর্বে প্রাচীন প্রতিপত্তি অক্ষুণ্ণ তো ছিলই, বরং পাল-পর্বের শেষের দিকে এবং সেন-বর্মণ পর্বে তাহা আরও প্রসারিত হইয়াছিল।

পাল-পর্বের অনেকগুলি ভূমিদান পট্টোলীতে দেখিতেছি, যে-সব ব্রাহ্মণদের ভূমিদান করা হইতেছে তাহাদের মধ্যে অনেকেই বেদ-বেদাঙ্গ -মীমাংসা-ব্যাকরণে সুপণ্ডিত এবং বৈদিক যাগযজ্ঞ-ক্রিয়াকর্মে পারদর্শী। দৃষ্টান্ত স্বরূপ দেবপালের মুঙ্গের-লিপি, নারায়ণ পালের বাদলস্তম্ভ-লিপি এবং মহীপালের বাণগড-লিপির কথা উল্লেখ করা যাইতে পারে। বৈদিক হোম, যাগযজ্ঞের কথাও অনেক লিপিতেই আছে। বাদলস্তম্ভ-লিপিতে বৌদ্ধ নরপতি প্রথম বিগ্রহপালের মন্ত্রী কেদারমিশ্র সম্বন্ধে বলা হইয়াছে : “তাঁহার [হোম কুত্তোত্থিত] অবক্রভাবে বিরাজিত সুপুষ্ট হোমাগ্নিশিখাকে চুম্বন করিয়া দিকচক্রবাল যেন সন্নিহিত হইয়া পড়িত।” কেদারমিশ্র ‘চতুর্বিদ্যা পয়োনিধি’ পান করিয়াছিলেন, অর্থাৎ চারি বেদবিদ ছিলেন। তাঁহার পিতা দর্ভপাণিও বেদবিদ বলিয়া খ্যাত ছিলেন। কেদারমিশ্রের পুত্র গুরুবমিশ্র নীতি, আগম ও জ্যোতিষে সুপণ্ডিত ছিলেন এবং বেদার্থচিন্তাপরায়ণ ছিলেন। বৈদ্যদেবের কমৌলি-লিপিতে দেখিতেছি, বরেন্দ্রীয় অন্তর্গত ভাবগ্রামের ব্রাহ্মণ ভরতের পুত্র যুধিষ্ঠির সকল পণ্ডিতের অগ্রণী বলিয়া গণ্য হইতেন। তিনি “শাস্ত্রজ্ঞান পরিশুদ্ধবুদ্ধি এবং শ্রোত্রিয়ত্বের সমুজ্জ্বল যশোনিথি” ছিলেন। যুধিষ্ঠিরের পুত্র ছিলেন দ্বিজাধীশ-পূজা শ্রীধর। তীর্থভ্রমণে, বেদাধ্যায়নে, দানাধ্যাপনায়, যজ্ঞানুষ্ঠানে, ব্রতাচরণে সর্বশ্রোত্রীয়শ্রেষ্ঠ শ্রীধর প্রাতঃ, নক্ত, অযাচিত এবং উপবাসন করিয়া মহাদেবকে প্রসন্ন করিয়াছিলেন, এবং কর্মকাণ্ড জ্ঞানকাণ্ডবিৎ পণ্ডিতগণের অগ্রগণ্য সর্বাকারভপোনিধি এবং শ্রৌতস্মার্তশাস্ত্রের গুপ্তার্থবিবাগীশ বলিয়া খ্যাতিলাভ করিয়াছিলেন। মহীপালের বাণগড়-লিপিতে যজুর্বেদীয় বাজসনেয়ী সংহিতা, মীমাংসা, ব্যাকরণ এবং তর্কশাস্ত্র-চর্চার উল্লেখ আছে। বেদ, বেদান্ত, প্রমাণ এবং সামবেদের কোঠমশাখার চর্চার উল্লেখ আছে দেবপালের মুঙ্গের-লিপি, বিগ্রহপালের আমগাছি-লিপি এবং মদনপালের মনহলি লিপিতে।

বৈদিক ধর্মকর্ম যাগযজ্ঞের এই আবহাওয়া চন্দ্র-পর্বেও সমান সক্রিয়। বিভিন্ন বেদের বিভিন্ন শাখাধ্যায়ী ব্রাহ্মণদের কথা, বৈদিক হোম-যাগযজ্ঞের কথা একাধিক চন্দ্ৰ-লিপিতে সুস্পষ্ট। বৌদ্ধ চন্দ্র ও কম্বোজ রাষ্ট্রে ঋত্বিক নামে যে-রাজপুরুষটির দেখা মিলিতেছে তিনি তো একান্তই বৈদিক হোম যাগযজ্ঞ-ক্রিয়াকর্মের কাণ্ডারী বলিয়া মনে হইতেছে। হরিচরিতগ্রন্থের লেখক চতুর্ভুজ বলিতেছেন, তাঁহার পূর্বপুরুষেরা বরেন্দ্রান্তর্গত করঞ্জগ্রাম ধর্মপালের নিকট হইতে দানস্বরূপ পাইয়াছিলেন; সেই গ্রামের ব্রাহ্মণেরা বেদ, স্মৃতি ও অন্যান্য শাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন। এই ধর্মপাল পাল নরপতি হওয়াই সম্ভব।

পাল-চন্দ্র পর্বের কয়েকটি লিপিতেই (খালিমপুর-লিপি; দ্বিতীয় গোপালদেবের জজিলপুর-লিপি; প্রথম মহীপালের বাণগড়-লিপি; তৃতীয় বিগ্রহপালের আমগাছি-লিপি; কম্বোজরাজ নরপালের ইর্দা-লিপি ইত্যাদি) দেখিতেছি, ভারতবর্ষের নানা জায়গা, (যেমন লাটদেশ, মধ্যদেশ, ক্রোড়ঞ্জ, মুক্তাবাস্তু প্রভৃতি) বিশেষভাবে মধ্যদেশ হইতে, বিভিন্ন গোত্র-প্রবরাশ্রয়ী, বিভিন্ন বৈদিক শাখাধ্যায়ী, বিভিন্ন শ্রৌত সংস্কারানুসারী ব্রাহ্মণেরা বাঙলা দেশে আসিয়া বসবাস করিতেছেন। ইহাদের আশ্রয় করিয়া এবং এই ভাবেই পঞ্চম-ষষ্ঠ শতক হইতে বৈদিক ধর্মের স্রোত বাঙলাদেশে প্রবাহিত হইতে আরম্ভ করে : পাল-চন্দ্র-কম্বোজ-পর্বেও এই সব আগন্তুক ব্রাহ্মণদের সমর্থন ও আনুকূল্যের ফলে সেই স্রোত ক্রমশ আরও প্রবল হয়।

পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য জগতের বিস্তার

পাল-চন্দ্ৰ-কম্বোজ-পর্বের লিপিমালা পাঠ করিলে এ তথ্য সুস্পষ্ট হইয়া উঠে যে, এই সব লিপির রচনা- আগাগোড়া ব্রাহ্মণ্য পুরাণ, রামায়ণ ও মহাভারতের গল্প, ভাবকল্পনা এবং উপমালংকার দ্বারা আচ্ছন্ন; ইহাদের রচিত ভাবাকাশ একান্তই পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কারের আকাশ। মদনপালের মনহলি-লিপিতে ব্রাহ্মণ বটেশ্বর স্বামী-শর্মা কর্তৃক বেদব্যাস-প্রোক্ত মহাভারত পাঠের উল্লেখ আছে। রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণপাঠ বোধ হয় অনেক ব্রাহ্মণেরই বৃত্তি ছিল এবং তাহাদেরই বোধ হয় বলা হইত নীতি-পাঠক। যাহাই হউক, যে ভাবেই হউক, এই পর্বের বাঙলাদেশের আকাশে পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মেরই বিস্তার; এই পৌরাণিক মহিমাই বৈদিক ধর্ম ও শ্রৌত সংস্কারের মহিমাকে যেন আড়াল করিয়া রাখিয়াছিল।

সমসাময়িক উচ্চকোটি বাঙালীর এবং তাহাদের রাষ্ট্র নায়কদের কল্পনাকে উদ্দীপ্ত এবং শ্রদ্ধাকে আকর্ষণ করিতেন পৃথু, ধনঞ্জয়, অম্বরীশ, সগর, নল, যযাতি প্রভৃতি পৌরাণিক বীরেরা (ধর্মপালের বুদ্ধগয়া-লিপি, দেবপালের মুঙ্গের-লিপি, কোটালিপাড়া লিপি); সত্যযুগের দৈত্যরাজ বলি, ত্রেতাযুগের ভার্গব এবং দ্বাপর যুগের কর্ণের মতো দাতারা (দেবপালের মুঙ্গের-ি -লিপি); দেবরাজ বৃহস্পতির মতো জ্ঞানীরা (বাদলস্তম্ভ-লিপি, বৈদ্যদেবের কমৌলি লিপি)। অগস্ত্যর এক গণ্ডূষে সমুদ্র পান (বাদলস্তম্ভ-লিপি), পরশুরামের ক্ষত্রিয়াভিযান (বাদলস্তম্ভ-লিপি), রামেশ্বরের রামচন্দ্রের সেতুবন্ধন (দেবপালের মুঙ্গের-লিপি), হুতভুজ ও স্বাহার গল্প, ধনপতি ও ভদ্রার গল্প, বিষ্ণুর নাভিপদ্ম হইতে ব্রহ্মার জন্ম এবং ব্রহ্মাপত্নী সরস্বতীর গল্প (খালিমপুর-লিপি) প্রভৃতি এই পর্বের সুপরিচিত ও সুআদৃত পুরাণ ও কাব্যকাহিনী। এই পর্বের ইন্দ্র হইতেছেন দেবরাজ এবং তাঁহার পত্নী পৌলোমী পাতিব্রত্যের আদর্শ (খালিমপুর-লিপি, নারায়ণপালের ভাগলপুর-লিপি ও বাদলস্তম্ভ-লিপি)। ইন্দ্রের আর এক নাম পুরন্দর এবং তিনি দৈত্যরাজ বলির নিকট পরাজিত (মুঙ্গের ও ভাগলপুর-লিপি)। পৌরাণিক শিব-কাহিনীও অজ্ঞাত নয়। পতির অপমানে দক্ষযজ্ঞে অপুত্রক সতীর অকালে প্রাণত্যাগ (বাদলস্তম্ভ-লিপি) ও শিবপত্নী উমা বা সর্বাণীর পাতিব্রতাও সে কাহিনী হইতে বাদ পড়ে নাই। বৈদ্যদেবের কমৌলি-লিপিতে সপ্তাশ্বরথবাহিত সূর্য-দেবতাকে বলা হইয়াছে হরির দক্ষিণ চঞ্চু। সমুদ্রগর্ভোথিত, শশধর -লাঞ্ছন চন্দ্রের উল্লেখও পাওয়া যাইতেছে; তাঁহাকে কোথাও কোথাও বলা হইয়াছে সীতাংশু এবং কান্তি ও রোহিণী যে তাঁহার দুই পত্নী, তাহাও উল্লেখ করা হইয়াছে। ধর্মপালের খালিমপুর-লিপি এবং বাদলস্তম্ভ-লিপিতে চন্দ্রকে বলা হইয়াছে অত্রির বংশধর।

পুরাণ কথার ঐশ্বর্য সকলের চেয়ে বেশি আশ্রয় করিয়াছে বিষ্ণু-কৃষ্ণ কথাকে। বিষ্ণু এখন আর ভাগবদ্ধর্মের বাসুদেব নহেন, এখন তিনি কৃষ্ণ এবং শ্রীপতি, ক্ষমাপতি, জনার্দন, হরি, মুরারী প্রভৃতি তাঁহার নাম। এই সব নামের প্রত্যেকটির সঙ্গেই কাবা ও পুরাণ-কাহিনী জড়িত। হরি-ক্ষমাপতি সমুদ্রগর্ভজাত এবং লক্ষ্মী তাঁহার সাধ্বী পত্নী; লক্ষ্মীর সপত্নী হইতেছেন বসুধরা বা পৃথিবী এবং স্বামী মুরারীর সঙ্গে লক্ষ্মী গরুড়ারূঢ় (খালিমপুর-লিপি, মুঙ্গের-লিপি, ভাগলপুর-লিপি, বাদলস্তম্ভ-লিপি, জয়পালের গয়া নরসিংহ মন্দির-লিপি এবং কৃষ্ণদ্বারিকা মন্দির-লিপি)। দেবকী গর্ভজাত বালগোপাল কৃষ্ণের যশোদাভবনে গমন এবং কৃষ্ণের বাল্যজীবন-কাহিনীও অজ্ঞাত নয় (বাদলস্তম্ভ-লিপি), তবে এই বালকৃষ্ণ যে লক্ষ্মীর পতি এবং বিষ্ণুর অন্যতম অবতার তাহাও একই লিপিতে উল্লিখিত হইয়াছে। কৃষ্ণের অন্যান্য অবতাররূপের (যেমন, কৃষ্ণ, নরসিংহ, পরশুরাম, বামন) সঙ্গেও এই পর্বের পরিচয় ঘনিষ্ঠ। উপরোক্ত পৌরাণিক এবং তাঁহাদের কাহিনী যে শুধু লিপিমালায় উদ্দিষ্ট ও উল্লিখিত তাহাই নয় : ইহাদের প্রতিমারূপ আশ্রয় করিয়াই নানা ধর্মসম্প্রদায় এবং নানা ধর্মানুষ্ঠান গড়িয়া উঠিয়াছিল। বিচিত্র লক্ষণ ও লাঞ্ছনযুক্ত, বিচিত্র ধ্যান ও কল্পনার, বিচিত্রতর রূপ ও আকৃতির এই সব অগণিত প্রতিমার অবশেষ এখনও বাঙলাদেশের ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অথবা নানা চিত্রশালায় রক্ষিত। সূক্ষ্ম ও বিস্তৃত মূর্তিতত্ত্বের বা বিশেষ বিশেষ প্রতিমার রূপ ও লক্ষ্মণের আলোচনার স্থান এই গ্রন্থ নয়। তবু, সাধারণভাবে প্রতিমাগুলির স্বরূপ জানা প্রয়োজন, কারণ প্রত্যেক ধর্মের বিশিষ্ট ধ্যান ও কল্পনা ইহাদের সঙ্গে জড়িত।

বৈষ্ণব ধর্ম

ধর্মপালের খালিমপুর-লিপিতে নন্ন-নারায়ণের এক দেউলের (দেবকুলের) উল্লেখ আছে। এই নগ্ন নারায়ণ বোধ হয় নন্দ-নারায়ণেরই অপভ্রংশ, অর্থাৎ এই মন্দিরে যে-দেবতাটির অর্চনা হইত তিনি নন্দদুলাল কৃষ্ণরূপী নারায়ণ। নারায়ণপালের রাজত্বকালে একটি গরুড়স্তম্ভ স্থাপিত হইয়াছিল বর্তমান দিনাজপুর জেলার একটি গ্রামে; এই স্তম্ভগাত্রেই বাদল-প্রশস্তিটি উৎকীর্ণ এবং সে-স্তম্ভ এখনও দণ্ডায়মান। খালিমপুর-লিপিতে একটি কাদম্বরী দেবকুলিকা বা সরস্বতী মন্দিরের উল্লেখ আছে। স্থানক, অর্থাৎ সমপদ দণ্ডায়মান বিষ্ণুর দুই পার্শ্বে লক্ষ্মী ও সরস্বতীর (শ্রী ও পুষ্টি) অধিষ্ঠান; সেই ভাবে তাঁহাদের সম্মিলিত পূজা তো হইতই; এই ধরনের প্রতিমা বাঙলার নানা অঞ্চল হইতেই আবিষ্কৃত হইয়াছে; কিন্তু সরস্বতী স্বাধীন স্বতন্ত্র মর্যাদায় পূজিতা হইতেন, খালিমপুর লিপিই তাহার প্রমাণ। সরস্বতীর স্বাধীন স্বতন্ত্র মূর্তিও কয়েকটি পাওয়া গিয়াছে; ইহাদের প্রতিমা-লক্ষণ সরস্বতীর সাধারণ লক্ষণ। সরস্বতীর বাহন অন্যত্র যেমন বাঙলাদেশেও তাহাই, অর্থাৎ হংস; কিন্তু একটি প্রতিমায় তাঁহার বাহন দেখিতেছি ভেড়া। সরস্বতীর সঙ্গে ভেড়ার সম্বন্ধ অত্যন্ত প্রাচীন এবং নলিনীকান্ত ভট্টশালী মহাশয় তাহার সুন্দর ব্যাখ্যাও রাখিয়া গিয়াছেন। বাঙলাদেশের কোথাও কোথাও সরস্বতী পূজার দিনে এখনও ভেড়া বলি এবং ভেড়ার লড়াই সুপরিচিত। বাদল গরুড়-স্তম্ভের কথা একটু আগেই বলিয়াছি। বিষ্ণু মন্দিরের সম্মুখে একটি করিয়া গরুড়-স্তম্ভের প্রতিষ্ঠা করা ছিল সাধারণ রীতি; স্তম্ভের শীর্ষে থাকিত বদ্ধাঞ্জলিমুদ্রা গরুড়ের একটি মূর্তি। এই ধরনের স্তম্ভশীর্ষ গরুড়-প্রতিমা বাঙলাদেশের নানা জায়গায় আবিষ্কৃত হইয়াছে। রাজশাহী-চিত্রশালায় রক্ষিত এই ধরনের একটি গরুড়-মূর্তি দশম শতকীয় বাঙলার ভাস্কর শিল্পের সুন্দর নিদর্শন।

পাল চন্দ্র কম্বোজ পর্বের বাঙলাদেশে যত প্রতিমা পাওয়া গিয়াছে তাহার মধ্যে বৈষ্ণব পরিবারের মূর্তির সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি; এবং পরিবারটিও সুবৃহৎ। পরিবারের প্রধান হইতেছেন বিষ্ণু স্বয়ং; তাঁহার দুই পত্নী, লক্ষ্মী ও সরস্বতী; কোথাও কোথাও দেবী বসুমতী; নিম্নে বাহন গরুড়; বিষ্ণুর বৈকুণ্ঠ লোকের দুই দ্বারী, জয় এবং বিজয়; বিষ্ণু-কৃষ্ণের দ্বাদশ অবতার; এবং ব্রহ্মা স্বয়ং। এই বৃহৎ পরিবারের প্রত্যেকটি দেবদেবীর বিশেষ বিশেষ ভঙ্গ ও ভঙ্গী, লক্ষণ ও লাঞ্ছন ভারতের অন্যত্র যেমন বাঙলাদেশেও মোটামুটি তাহাই। তবু বাঙলাদেশ এই যুগের সর্বভারতীয় পৌরাণিক ধ্যান-কল্পনা সমূহের সব কিছুই সমান আদরে ও মর্যাদায় গ্রহণ করে নাই; তাহাদের মধ্যেই কিছু বর্জন-নির্বাচন-সংযোজনও করিয়াছে।

আসন, শয়ান ও (সমপদ) স্থানক, এই তিন ভঙ্গীর বিষ্ণুমূর্তির মধ্যে বাঙলাদেশের পক্ষপাত যেন, অন্তত এই পর্বে, স্থানকমূর্তির দিকেই বেশি। বস্তুত, এই পর্বের অধিকাংশ বিষ্ণুমূর্তিই স্থানক, অর্থাৎ দণ্ডায়মান মূর্তি; আসন ও শয়ান মূর্তি বাঙলাদেশে কমই পাওয়া গিয়াছে। গরুড়াসীন এবং যোগাসীন, সাধারণত এই দুই প্রকারের আসনমূর্তিই এ-যাবৎ দৃষ্টিগোচর হইয়াছে। বরিশাল জেলার লক্ষ্মণকাটি গ্রামে প্রাপ্ত (ঢাকা চিত্রশালা) বিষ্ণু, সাগরদীঘির হৃষিকেশ-বিষ্ণু (বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ চিত্রশালা) প্রভৃতি গরুড়াসীন এবং সাধারণ আসন-বিষ্ণুর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। দিনাজপুর জেলার ইটাহার গ্রামে প্রাপ্ত বিষ্ণুমূর্তির ভগ্নাবশেষ যোগাসন-বিষ্ণুর প্রতিকৃতি, সন্দেহ নাই। এই সব ক’টি মূর্তিই এই পর্বের যোগাসন-বিষ্ণুর আরও একাধিক প্রমাণ বিদ্যমান এবং তাহারাও এই পর্বের বলিয়াই মনে হয়, অন্তত ভাস্কর্য-শৈলীর ইঙ্গিত তাহাই। দৃষ্টান্ত স্বরূপ ঢাকা-সোনারঙ্গে প্রাপ্ত কাষ্ঠফলকের যোগাসন-বিষ্ণু এবং বোস্টন-চিত্রশালার ধাতব যোগাসন-বিষ্ণুর কথা উল্লেখ করা যায়।

স্থানক-বিষ্ণুমূর্তিগুলি সাধারণত সপরিবার বিষ্ণু। বিষ্ণু মধ্যস্থলে দণ্ডায়মান; তাঁহার দক্ষিণে ও বামে, উপরে ও নীচে পরিবারস্থ অন্যান্য দেবদেবী, বাহন, প্রহরী ইত্যাদি! ইহাদের সকলেরই লক্ষণ ও লাঞ্ছন সর্বভারতীয় প্রতিমাশাস্ত্রই অনুসরণ করে। বাঙলার বিষ্ণুমূর্তি সাধারণত দুই প্রকরণের। ত্রিবিক্রম প্রকরণের মূর্তিই বেশি, বাসুদেব-প্রকরণের প্রতিমাও কিছু কিছু দেখিতে পাওয়া যায়। এই প্রকরণ-পার্থক্য নির্ভর করে বিষ্ণুর চারি হস্তের শঙ্খচক্রগদাপদ্ম এই চারিটি লক্ষণের সন্নিবেশের উপর। এই চারি লক্ষণের বিভিন্ন রীতির সন্নিবেশ বাঙলাদেশের প্রতিমাগুলিতেও দেখা যায়, কিন্তু বাঙালী শিল্পী ও পুরোহিতেরা সর্বত্রই প্রতিমালক্ষণ শাস্ত্রের এবং পঞ্চরাত্রীয় ব্যুহবাদের এই প্রকরণ-নির্দেশ মানিয়া চলিতেন, নিঃসংশয়ে তাহা বলা কঠিন। প্রথম মহীপালের রাজত্বের তৃতীয় বৎসরে ত্রিপুরা জেলার বাঘাউড়া গ্রাম বা নিকটবর্তী কোনও স্থানে একটি বিষ্ণুমূর্তির প্রতিষ্ঠা হইয়াছিল; পাদপীঠে উৎকীর্ণ লিপিতে বলা হইয়াছে, মূর্তিটি “নারায়ণভট্টারস্য”। কিন্তু ইহার চারি হস্তের শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মের সন্নিবেশ ত্রিবিক্রম বিষ্ণুর সন্নিবেশানুযায়ী, নারায়ণের নহে। কোনও কোনও মূর্তিতে দেখা যায়, শঙ্খ, চক্র ও গদা যথাক্রমে শঙ্খ-পুরুষ, চক্র-পুরুষ ও গদা-দেবীতে রূপায়িত। এ-ক্ষেত্রেও সর্বভারতীয় প্রতিমা নির্দেশ সক্রিয়।

বিষ্ণুর অন্যান্য বিচিত্র রূপের মধ্যে অভিচারিক স্থানক বিষ্ণুর একটি নিদর্শন বাঙলাদেশে পাওয়া গিয়াছে। মূর্তিটি কালো পাথরের, পাওয়া গিয়াছিল বর্ধমান জেলার চৈতন্যপুর গ্রামে! লক্ষণ ও লাঞ্ছন মিলাইলে দেখা যায়, প্রতিমাটি দক্ষিণ ভারতীয় প্রতিমা শাস্ত্ৰ বৈখানসাগম-কথিত অভিচারিক স্থানক-বিষ্ণুর প্রতিকৃতি। সাগরদীঘিতে প্রাপ্ত আসন-বিষ্ণু এবং বর্ধমানে প্রাপ্ত (রাজশাহী চিত্রশালা) আর একটি বিষ্ণুমূর্তি উভয়ই শ্রীধর বা হৃষিকেশ-বিষ্ণুর প্রতিমা। রংপুর জেলায় প্রাপ্ত (কলিকাতা-চিত্রশালা) ধাতুনির্মিত স্থানক-বিষ্ণুর একটি প্রতিমায় বিষ্ণুর বামে যেখানে পুষ্টি বা সরস্বতীর স্থান সেখানে দেখিতেছি দেবী বসুমতীকে। কোনও কোনও বিষ্ণু-প্রতিমার পৃষ্ঠফলকে বিষ্ণুর দশাবতারের প্রতিকৃতি দেখিতে পাওয়া যায়; দৃষ্টান্ত স্বরূপ বাঁকুড়া জেলায় প্রাপ্ত (কলিকাতা-চিত্রশালা) একটি প্রতিমা এবং ঢাকা-চিত্রশালায় রক্ষিত আর একটি প্রতিমার উল্লেখ করা যাইতে পারে। রাজশাহী-চিত্রশালায় বিশহস্ত সমপদস্থানক একটি বিষ্ণুমূর্তি আছে; মূর্তিটি বোধ হয় রূপমগুণ-গ্রন্থোক্ত বিশ্বরূপ-বিষ্ণুর। রংপুরের টেপা-সংগ্রহে একটি চতুর্মুর্খ বিষ্ণুর প্রতিমা আছে; ইঁহার সম্মুখের মুখটি মানুষের মুখের অনুরূপ, দক্ষিণে বরাহের, বামে সিংহের এবং পশ্চাতে ভৈরবের। কলিকাতা-চিত্রশালায় ব্রহ্মা-বিষ্ণুর একটি যুগ্ম-মূর্তি আছে; প্রতিমাটিতে উভয় দেবতারই লক্ষণ ও লাঞ্ছন বিদ্যমান। ব্রহ্মার স্বাধীন স্বতন্ত্র-মূর্তিও বাঙলাদেশে পাওয়া গিয়াছে। এই ব্রহ্মা স্ফীতোদর, চতুর্মুখ, চতুর্হস্ত, ললিতাসনোপবিষ্ট; তাঁহার বাহন হংস। দিনাজপুর জেলার ঘাটনগরে প্রাপ্ত (রাজশাহী-চিত্রশালা) প্রতিমাটি এই ধরনের প্রতিমাগুলির প্রতিনিধি বলা যাইতে পারে।

সরস্বতীর কথা আগেই বলিয়াছি। লক্ষ্মীরও স্বাধীন স্বতন্ত্র মূর্তি বিদ্যমান। ইহাদের মধ্যে দেবীর গজলক্ষ্মী রূপই প্রধান। কিন্তু বিশুদ্ধ লক্ষ্মী প্রতিমা নাই, এমন নয়। বগুড়া জেলায় প্রাপ্ত (রাজশাহী-চিত্রশালা) একটি চতুর্হস্ত স্থানক-লক্ষ্মী প্রতিমা একাদশ শতকের তক্ষণ-শিল্পের এবং এই ধরনের প্রতিমার চমৎকার নির্দশন। এই চিত্রশালারই একটি দ্বিহস্ত ধাতব লক্ষ্মীর প্রতিমাও আছে। বগুড়ার চতুস্ত লক্ষ্মীর এক হস্তে বাঙলাদেশে সুপরিচিত লক্ষ্মীর ঝাঁপিটি লোকায়ত ধর্মের ক্ষীণ একটি প্রতিধ্বনি রূপে বিদ্যমান।

অবতাররূপী বিষ্ণুর প্রতিমা এই পর্বের বাঙলাদেশে সুপ্রচুর। প্রস্তর ও ধাতব বিষ্ণুপট্টের পশ্চাদ্ভাগে অথবা ফলকে বিষ্ণুর দশাবতারের প্রতিকৃতি প্রাচীন বাঙলার নানা স্থান হইতেই পাওয়া গিয়াছে। এই পর্বের বাঙলাদেশে বিষ্ণুর দশটি অবতারের মধ্যে প্রধানত বরাহ, নরসিংহ এবং বামন বা ত্রিবিক্রম এই তিনজনই স্বাধীন ও স্বতন্ত্র পূজা লাভ করিতেন। মত্স্য ও পরশুরামাবতারের স্বতন্ত্র মূর্তিও বাঙলাদেশে পাওয়া গিয়াছে, কিন্তু অন্য তিনটির মর্যাদা ও প্রতিপত্তি ইহারা বোধ হয় লাভ করিতে পারেন নাই। অবতারের মধ্যে সিলিমপুর গ্রামে প্রাপ্ত বরাহমূর্তি, বিক্রমপুরে প্রাপ্ত (ঢাকা-চিত্রশালা) বরাহমূর্তি, ঢাকা-চিত্রশালার নরসিংহ মূর্তি, জোডাদেউলে প্রাপ্ত (ঢাকা-চিত্রশালা) বামন মূর্তি এবং ব্রজযোগিনীর মৎস্যাবতার মূর্তি উল্লেখযোগ্য। অষ্টমাবতার হলধর বা বলরামের যে কয়েকটি প্রতিমা পাওয়া গিয়াছে তাহার মধ্যে ঢাকা জেলার বাঘড়া গ্রামে প্রাপ্ত একটি প্রতিমা, পাহাড়পুর-মন্দিরের পীঠ-গাত্রের প্রতিমাটি এবং রাজশাহী-চিত্রশালার একটি প্রতিমাই প্রধান।

মহাযান বৌদ্ধ ধর্ম এবং তাহার দেবায়তন বাঙলাদেশে ইতিমধ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং তাহার প্রতিমালক্ষণ ও সাধন সুঅভ্যস্ত। এই গর্বের কয়েকটি বিষ্ণু প্রতিমায় তাহার প্রভাব অনস্বীকার্য। বরিশাল জেলার লক্ষণকাটির সুপ্রসিদ্ধ বিষ্ণু মূর্তির কথা ইতিপূর্বেই বলিয়াছি; এই প্রতিমার পশ্চাতের দুই হাতের উপর আসীনা শ্রী ও পুষ্টির প্রতিকৃতি এবং মুকুটে চতুর্হস্ত ধ্যানী বুদ্ধপ্রতিম প্রতিমাটি মূর্তিতত্ত্বের দিক হইতে উল্লেখযোগ্য। উভয় লক্ষণেই মহাযানী বৌদ্ধ প্রতিমার রূপ কল্পনা নিঃসন্দেহে সক্রিয়। কালন্দপুরে প্রাপ্ত একটি বিষ্ণুপ্রতিমাতেও শেষোক্ত মহাযানী লক্ষণটি উপস্থিত। পূর্বোক্ত সাগরদীঘির আসন-বিষ্ণু প্রতিমাটিতে শঙ্খ, চক্র ও গদা সনাল পদ্মের উপর স্থিত; এ-ক্ষেত্রেও সমসাময়িক মহাযানী বৌদ্ধ প্রতিমালক্ষণ ও সাধন সক্রিয়, সন্দেহ নাই।

শৈবধর্ম

শৈবধর্মেরও লিপি এবং মূর্তিপ্রমাণ সুপ্রচুর, যদিও বৈষ্ণব ধর্মের সঙ্গে তাহা তুলনীয় নয়। খালিমপুর-লিপিতে এক চতুর্মুখ মহাদেবের চতুর্মুর্খ লিঙ্গের (?) প্রতিমা প্রতিষ্ঠার সংবাদ আছে। নারায়ণপালের ভাগলপুর-লিপিতে রাজা কর্তৃক শিব-ভট্টারক ও তাঁহার পূজক ও সেবক পাশুপতদের উদ্দেশ্যে কিছু ভূমিদানের উল্লেখ দেখা যায়। এই নারায়ণপাল এক সহস্র শিব (?) মন্দির প্রতিষ্ঠার দাবি করিয়াছেন। রামপাল রামাবতীতে শিবের তিনটি মন্দির, একাদশ রুদের একটি মন্দির এবং সূর্য, সন্দ ও গণপতির মন্দির প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন বলিয়া উল্লেখ আছে। এই পর্বের বাঙলার শৈবধর্ম বোধ হয় শিব-শ্রীকণ্ঠ ও তাঁহার শিষ্য লাকুলীশ (খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতক)-প্রবর্তিত পাশুপত ধর্ম এবং এ-তথ্য আজ সুবিদিত যে, উত্তর ভারতে পাশুপত ধর্মই আদি শৈবধর্ম। প্রবোধচন্দ্র বাগচী মহাশয় দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছেন, আগমাত্ত শৈবধর্ম গুপ্ত-পর্বেই পরিপূর্ণ রূপ গ্রহণ করিয়াছিল এবং পাশুপত ধর্মের ধ্যান-কল্পনার মধ্যেই ধর্মের শ্রেষ্ঠ বিকাশ দেখা গিয়াছিল। আঠারোটি আগম এবং তাহাদের কিছু পরবর্তী কালে রচিত ছয়টি যামল ও ছয়টির অন্যতম ব্রহ্মযামলের পরিশিষ্টরূপী পিঙ্গলা-মত-গ্রন্থে এই ধর্মের ধ্যান-কল্পনার বিস্তৃত পরিচয় নিবদ্ধ। এই সব গ্রন্থের মতে আর্যাবর্তই শিব-সাধনার প্রকৃষ্ট ক্ষেত্র; কামরূপ, কলিঙ্গ, কঙ্কন, কাঞ্চী, কাবেরী, কোশল ও কাশ্মীর এই ক্ষেত্রের বাহিরে। গৌড়দেশ এই ক্ষেত্রের অন্তর্গত বলিয়া স্বীকৃত, তবে গৌড়ীয় সাধন-গুরুরা আর্যাবর্তের গুরুদের চেয়ে নিকৃষ্ট এ-কথাও বলা হইয়াছে। সে যাহাই হউক, সন্দেহ নাই যে, গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর কালে আর্যাবর্তের পাশুপতধর্মী ব্রাহ্মণ গুরু ও তাঁহাদের শিষ্যবর্গ ক্রমাগতই বাঙলাদেশে আসিতেছিলেন এবং তাঁহারাই এই দেশে পাশুপতধর্ম প্রচার করিতেছিলেন।

পাল চন্দ্ৰ-কম্বোজ পর্বেও লিঙ্গরূপী শিবের পূজাই সমধিক প্রচলিত এবং এই লিঙ্গ সাধারণত একমুখলিঙ্গ। একমুখলিঙ্গ শিব-প্রতিমা বাঙলার নানা স্থান হইতে আবিষ্কৃত হইয়াছে। মাদারীগঞ্জ গ্রামে প্রাপ্ত (রাজশাহী-চিত্রশালা) প্রতিমাটি এই জাতীয় লিঙ্গের সুন্দর নিদর্শন। চতুর্মুখলিঙ্গও বিরল নয়। মুর্শিদাবাদে প্রাপ্ত (আশুতোষ-চিত্রশালা) ধাতব চতুর্মুখলিঙ্গটি দশম-একাদশ শতকের ভাস্কর-শিল্পের একটি সুউজ্জ্বল নিদর্শন; ইহার চারিদিকের চারিমুখের একটি মুখ শিবের বিরূপাক্ষ বা অঘোর রূপের প্রতিকৃতি। নবম শতকের কয়েকটি চতুর্মুখলিঙ্গ উল্লেখযোগ্য; এই ধরনের লিঙ্গ-প্রতিমার চারিদিকে চারিটি উপবিষ্ট শক্তি-মূর্তি রূপায়িত। লক্ষণীয় যে, এই ধরনের প্রতিমাগুলি সবই উত্তরবঙ্গের নানা স্থান হইতে আবিষ্কৃত হইয়াছে। ত্রিপুরার ঊনকোটি শিবলিঙ্গও এই প্রসঙ্গে উল্লেখের দাবি রাখে।

শিবের অন্যান্য রূপ-কল্পনার প্রতিকৃতি যাহা পাওয়া গিয়াছে তাহার মধ্যে চন্দ্রশেখর, নৃত্যপর, সদাশিব, উমা-মহেশ্বর, অর্ধনারীশ্বর এবং কল্যাণ-সুন্দর বা শিব-বিবাহ এই কয়টি সৌম্যমূর্তির শিব-প্রতিমাই প্রধান। রুদ্র রূপ-কল্পনার প্রতিকৃতির মধ্যে পাওয়া গিয়াছে অঘোররুদ্রের প্রতিমা। পাহাড়পুর-মন্দিরের পীঠ-গাত্রে চন্দ্রশেখর শিবের একাধিক প্রতিকৃতির কথা আগেই বলিয়াছি। শিবের দ্বিহস্ত ও চতুর্হস্ত ঈশান মূর্তির উভয় রূপই বাঙলাদেশে সুপরিচিত ছিল। রাজশাহী জেলার চৌরাকসবা গ্রামে প্রাপ্ত (কলিকাতা-চিত্রশালা) দ্বিহস্ত প্রতিমা এবং ঐ জেলারই গণেশপুর গ্রামে প্রাপ্ত (রাজশাহী-চিত্রশালা) চতুর্হস্ত প্রতিমাটি এই দুই রূপের নিদর্শন। বরিশাল জেলার কাশীপুর গ্রামে একটি চতুর্হস্ত স্থানক-শিব প্রতিমার পূজা এখনও প্রচলিত; স্থানীয় লোকেরা ইহাকে শিবের বিরূপাক্ষ রূপ বলিয়া মনে করেন। কিন্তু শারদাতিলক-গ্রন্থের বর্ণনা অনুসরণ করিয়া নলিনীকান্ত ভট্টশালী মহাশয় বলিয়াছেন, এই রূপটি নীলকণ্ঠ শিবের, বিরূপাক্ষের নয়।

নটরাজ শিবের প্রতিমা বাঙলাদেশে সুপ্রচুর; কিন্তু বাঙলার নটরাজ-রূপকল্পনা দক্ষিণী রূপ-কল্পনাকে দ্বাদশহস্ত এই ধরনের নটরাজ-শিবের প্রতিমা এ-পর্যন্ত বাঙলাদেশের বাহিরে আর কোথাও বড় একটা পাওয়া যায় নাই, অথচ বাঙলাদেশে নৃত্যমূর্তি-শিবের দ্বিতীয় রূপ-কল্পনা আর কিছু দেখাও যায় না। পূর্ব-দক্ষিণ বাঙলায় নৃত্যপর-শিবের যত মূর্তি পাওয়া গিয়াছে সবই দশহস্ত এবং তাঁহার লক্ষণ ও লাঞ্ছন-সন্নিবেশ পুরাপুরি মৎস্য পুরাণের বর্ণনানুযায়ী; দক্ষিণ-ভারতীয় চতুর্হস্ত নটরাজ শিব-প্রতিমায় শিবের পদতলে যে অপস্মার পুরুষটিকে দেখা যায় বাঙলাদেশে তাঁহার চিহ্নও নাই। এই ধরনের দশহস্ত, মৎস্যপুরাণ-অনুসারী নটরাজ শিবের মূর্তিগুলির একটির পাদপীঠে উৎকীর্ণ লিপিতে মূর্তিটিকে বলা হইয়াছে ‘নটেশ্বর’। দ্বাদশহস্ত নটরাজ-শিবের যে ক’টি মূর্তি পাওয়া গিয়াছে তাঁহাদের হস্তধৃত লক্ষণ ও লাঞ্ছন একটু পৃথক এবং সন্নিবেশও ভিন্ন প্রকারের; এই ধরনের মূর্তিগুলিতে এক হাতে বীণা এবং দুই হাতে করতালে নৃত্যের তাল রাখা হইতেছে। শিব যে নৃত্য ও সংগীতরাজ ইহা দেখানও যেন এই প্রতিমাগুলির উদ্দেশ্য।

শিবের সদাশিব-মূর্তিও বাঙলাদেশে সুপ্রচুর। রুদ্র-যামল গ্রন্থের মতে শিবের ছয় রূপের (ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র, ঈশ্বর, সদাশিব, পরাশিব) মধ্যে একরূপ সদাশিব। সদাশিবের রূপ-কল্পনা মহানির্বাণতন্ত্র, উত্তর-কামিকাগম এবং গরুড় পুরাণ গ্রন্থে বিধৃত এবং শেষের দু’টি গ্রন্থ গরুড়-পরাণ বাঙলাদেশে অধিকতর প্রচলিত। বাঙলাদেশে যে ক’টি সদাশিব মূর্তি পাওয়া গিয়াছে প্রতিমা-লক্ষণের দিক হইতে তাঁহারা প্রায় পুরাপুরি এই দুটি গ্রন্থের বর্ণনানুযায়ী। তৃতীয় গোপালের রাজত্বকালে এই ধরনের একটি সদাশিব মূর্তির প্রতিষ্ঠা হইয়াছিল; মূর্তিটি এখন কলিকাতা-চিত্রশালায় রক্ষিত। দক্ষিণ-ভারতের সদাশিব মূর্তির সঙ্গে বাঙলার সদাশিব মূর্তির রূপ-কল্পনার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা কিছুতেই দৃষ্টি এড়াইবার কথা নয়। দক্ষিণাগত সেন বংশীয় রাজারাও ছিলেন সদাশিবের পরমভক্ত। এই সব কারণে কেহ কেহ মনে করেন, কর্ণাটাগত সেনবংশ এবং দক্ষিণাগত সৈন্য সামন্তরাই সদাশিবের এই রূপ-কল্পনা বাঙলাদেশে বহন করিয়া আনিয়াছিলেন। কিন্তু এ-তথ্য অনস্বীকার্য যে, সদাশিব রূপ-কল্পনা একান্তই উত্তর-ভারতীয় আগমান্ত শৈবধর্মের সৃষ্টি। তবে মনে হয়, উত্তর-ভারতীয় সদাশিব দক্ষিণ ভারতে যে-রূপ গ্রহণ করিয়াছিলেন তাহাই কালক্রমে দক্ষিণাগত রাজবংশ ও সৈন্য-সামন্তরা বাঙলাদেশে লইয়া আসিয়াছিলেন।

পাল-পর্বের বাঙলাদেশে উমা-মহেশ্বরের যুগলমূর্তি রূপ বাঙালীর চিত্তহরণ করিয়াছিল বলিয়া মনে হয়। আজ এইসব মূর্তির অবশেষ বাঙলায় ইতস্তত বিক্ষিপ্ত; বস্তুতই ইহাদের সংখ্যার ইয়ত্তা নাই। তন্ত্রপরায়ণ শক্তি বাঙালীর চিত্তের শিব-উমার আলিঙ্গন-মূর্তি আনন্দ ও সৌন্দর্যের পরিপূর্ণ রূপ বলিয়া মনে হইবে, ইহা কিছু আশ্চর্য নয়। শিবক্রোড়োপবিষ্টা, সুখাসীনা, আলিঙ্গনবদ্ধা, হাস্যানন্দময়ী উমাই তো শিবশক্তির তান্ত্রিক সাধকদের ত্রিপুরা-সুন্দরী এবং তাঁহাদের রূপধ্যানই ধ্যানযোগের শ্রেষ্ঠ ধ্যান।

উমা-মহেশ্বর মূর্তিতে উমা এবং মহেশ্বর আলিঙ্গনাবদ্ধ হইলেও উভয়ই পৃথক পৃথক রূপকল্পিত, কিন্তু অর্ধনারীশ্বর কল্পনায় তাঁহারা দুইয়ে মিলিয়া এক হইয়া গিয়াছেন : দক্ষিণার্থে শিব, বামার্ধে উমা। বাঙলাদেশে অর্ধনারীশ্বর প্রতিমা সুপ্রচুর নয়, বরং তাহার নিদর্শন কমই পাওয়া গিয়াছে। পুরপাড়া গ্রামে প্রাপ্ত (রাজশাহী-চিত্রশালা) প্রতিমাটি এই ধরনের প্রতিমার এবং একাদশ শতাব্দীর বাঙলা ভাস্কর্যের একটি শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।

শিবের বৈবাহিক বা কল্যাণ-সুন্দর যুগলমূর্তিও বাঙলাদেশে (ঢাকা ও বগুড়া জেলা, ব-সা-প চিত্রশালা) কয়েকটি পাওয়া গিয়াছে; দক্ষিণ-ভারতের সুপরিচিত বৈবাহিক রূপের সঙ্গে ইহাদের সাদৃশ্য স্বল্প। বাঙলার প্রতিমাগুলিতে বিবাহ ব্যাপারে বাঙালীর রীতি ও আচার পদ্ধতির কয়েকটি সুস্পষ্ট অভিজ্ঞান বিদ্যমান; সপ্তপদী গমন, বরের হাতে কর্তি বহন প্রভৃতি দক্ষিণী প্রতিমাতে দেখা যায় না, কিন্তু বাঙলার প্রতিমাগুলিতে এই সব স্থানীয় আচার ও রীতিগুলি রূপায়িত হইয়াছে।

রুদ্র-শিবের বটুক ভৈরব এবং অঘোর-রুদ্র রূপের সঙ্গে এই পর্বের বাঙালীর পরিচয় ছিল। অঘোর-রুদ্রের মূর্তিপ্রমাণ বাঙলাদেশে খুব বেশি নাই; ঢাকা ও রাজশাহীর চিত্রশালায় দুইটি মূর্তি রক্ষিত আছে মাত্র এবং দুটিই এই পর্বের বলিয়া মনে হয়। শৈবাগম অনুসারে রুদ্র-শিবের পঞ্চরূপের (বামদেব, তৎপুরুষ, সদ্যোজাত, অঘোর ও ঈশান পঞ্চব্রহ্মা) মধ্যে অঘোর-রূপ অন্যতম এবং এই রূপের একটি বিশিষ্ট ভক্ত সম্প্রদায় বোধ হয় পাল-সেন পর্বেই গড়িয়া উঠিয়াছিল; অন্তত কিছু পরবর্তী কালের বাঙলায় অঘোরপন্থী নামে একটি শৈব সম্প্রদায়ের পরিচয় সমসাময়িক সাহিত্যে নিবদ্ধ। বটুক ভৈরবের কয়েকটি মূর্তিও বাঙলাদেশে পাওয়া গিয়াছে। নগ্ন সর্বাঙ্গ, কাষ্ঠ পাদুকা, কুকুর সঙ্গী, অগ্নিপ্রভা, নরমুণ্ড ও নরমুণ্ডমালা, বিকট হাস্যবাদিত মুখ প্রভৃতি দেখিলে ভুল করিবার কারণ নাই যে, এই ধরনের প্রতিমা আগমাস্ত তান্ত্রিক শৈবধর্মের ধ্যান ও কল্পনার সৃষ্টি।

শিবপুত্র গণপতি এবং কার্তিকেয়ের স্বাধীন স্বতন্ত্র প্রতিমাও বাঙলাদেশে কয়েকটি পাওয়া গিয়াছে। তবে গণপতি বা গণেশের তুলনায় কার্তিকেয়ের প্রসার বোধ হয় তত বেশি ছিল না। এই পর্বে গণেশের সব প্রতিমাই মুষিক বাহনোপরি নৃত্যপরায়ণ। তাঁর একটি হাতে একটি ফল; এই ফল সিদ্ধির প্রতীক এবং গণেশ বাঙলাদেশের সকল সম্প্রদায়ে, বিশেষ ভাবে বণিক-ব্যবসায়ী শ্রেণীতে সিদ্ধফলদাতা বলিয়াই পূজিত ও আদৃত। শৈব গাণপত্য সম্প্রদায়ের অন্তত একটি গণেশ-প্রতিমা বাঙলাদেশে পাওয়া গিয়াছে, রামপাল গ্রামের ধ্বংসাবশেষ হইতে। মূর্তিটির লক্ষণ ও লাঞ্ছন একান্তই দক্ষিণ ভারতীয় প্রতিমাশাস্ত্র অনুযায়ী; জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় যথার্থই বলিয়াছেন, দক্ষিণী কোনো প্রবাসী ভক্তের প্রয়োজনে মূর্তিটির নির্মাণ ও প্রতিষ্ঠা। কার্তিকেয়ের স্বতন্ত্র প্রতিমা যে দু’একটি এ-যাবৎ পাওয়া গিয়াছে তাহার মধ্যে উত্তরবঙ্গের কোনও স্থানে প্রাপ্ত (কলিকাতা-চিত্রশালা) ময়ূরবাহনের উপর মহারাজলীলায় উপবিষ্ট কার্তিকেয়ের মূর্তিটি দ্বাদশ শতকীয় ভাস্কর-শিল্পের সুন্দর নির্দশন।

পার্বত্য ত্রিপুরার ঊনকোটি এবং রাজশাহী জেলার দেওপাড়া, পালপর্বের এই শৈব তীর্থ দুইটির কথা না বলিয়া পাল-পর্বের শিবায়ন শেষ করা যায় না। পূর্ব-ভারতে বোধ হয় বারাণসীর কোটি তীর্থের পরেই ছিল উনকোটির স্থান। বস্তুত, এখনও উনকোটি পাহাড়ের হতস্তত যত মূর্তির ধ্বংসাবশেষ ছড়াইয়া আছে তাহাতে উনকোটি নামের সার্থকতা খুঁজিয়া পাওয়া কঠিন নয়। পাহাড়ের গায়ে একাধিক বৃহদাকৃতি শৈব-প্রতিমা ও প্রতিমার শির এখনও উৎকীর্ণ দেখিতে পাওয়া যায়। শিব ও গণেশ ছাড়া পরিবার-দেবতাদের মধ্যে হর, গৌরী, হরিহর, নরসিংহ, হনুমান, একমুখ ও চতুর্মুখলিঙ্গ প্রভৃতিও আছেন।

দক্ষিণ ভারতের চোল রাজাদের দু’টি লিপিপ্রমাণ হইতে বাঙলার বাহিরে বাঙালী শৈবগুরুদের সমসাময়িক মর্যাদা ও প্রতিপত্তির কতকটা ধারণা করা যায়। একটি লিপিতে জানা যায়, রাজেন্দ্রচোল রাজরাজেশ্বরের মন্দির নির্মাণ করিয়া সবশিব পণ্ডিত শিবাচার্যকে সেই মন্দিরের পুরোহিত নিযুক্ত করিয়াছিলেন এবং সর্বকালের জন্য তাঁহার আর্যাদেশ ও গৌড়দেশবাসী শিষ্য ও শিষ্যানুশিষ্যরাই মন্দিরের পুরোহিত নিযুক্ত হইবেন, এই নির্দেশ দিয়া গিয়াছিলেন। ত্রিলোচন শিবাচার্যের সিদ্ধান্তসারবলী -গ্রন্থের একটি টীকায় আরও বলা হইয়াছে যে, রাজেন্দ্রচোল গঙ্গাতীর হইতে শৈব আচার্যদের চোলদেশে লইয়া যাইতেন। পরকেশরীবর্মা রাজাধিরাজ-চোলের একটি লিপিতে জানা যায়, গৌড়দেশান্তর্গত দক্ষিণ-রাঢ়ের শৈবাচার্য উমাপতিদেব বা জ্ঞান-শিবদেবের পূজাপুণ্যের বলেই সিংহলী এক অভিযাত্রী সৈন্যদলকে রাজাধিরাজ যুদ্ধে পরাজিত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। কৃতজ্ঞতার চিহ্নস্বরূপ তিনি শিবদেবকে একটি গ্রাম দান করিয়াছিলেন; শিবদের সেই গ্রামলব্ধ আয় তাঁহার আত্মীয়বর্গের মধ্যে বিলাইয়া দিতেন।

শাক্তধর্ম

শৈব-ধর্ম ও শৈব-দেবতাদের সঙ্গেই শাক্তধর্ম ও শক্তি দেবী-প্রতিমার কথা বলিতে হয়। দেবীপুরাণে (খ্রীষ্টোত্তর সপ্তম-অষ্টম শতক) বলা হইয়াছে, রাঢ়া -বরেন্দ্র-কামরূপ কামাখ্যা-ভোট্টদেশে (তিব্বতের) বামাচারী শাক্তমতে দেবীর পূজা হইত। এই উক্তি সত্য হইলে স্বীকার করিতেই হয়, খ্রীষ্টোত্তর সপ্তম-অষ্টম শতকের পূর্বেই বাঙলাদেশের নানা জায়গায় শক্তিপূজা প্রবর্তিত হইয়া গিয়াছিল। ইহার কিছু পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় গুপ্তোত্তর পর্বে এবং মধ্য ভারতে রচিত জয়ন্থ-নামল গ্রন্থে। এই গ্রন্থে ঈশান-কালী, রক্ষা-কালী, বীর্যকালী, প্রজ্ঞাকালী প্রভৃতি কালীর নানা রূপের সাধনা বর্ণিত আছে। তাহা ছাড়া ঘোরতারা, যোগিনীচক্র, চক্রেশ্বরী প্রভৃতির উল্লেখও এই গ্রন্থে পাওয়া যায়। আর্যাবর্তে শাক্তধর্ম যে গুপ্ত গুপ্তোত্তর পর্বেই বিকাশ লাভ করিয়াছিল আগম ও যামল গ্রন্থগুলিই তাহার প্রমাণ। খুব সম্ভব ব্রাহ্মণ্য অন্যান্য ধর্মের স্রোত প্রবাহের সঙ্গে সঙ্গেই শক্তিধর্মের স্রোতও বাঙলাদেশে প্রবাহিত হইয়াছিল এবং এই দেশ পরবর্তী শক্তিধর্মের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র রূপে গড়িয়া উঠিয়াছিল। এইসব আগম ও যামল গ্রন্থের ধ্যান ও কল্পনাই, অন্তত আংশিকত, পরবর্তী কালে সুবিস্তৃত তন্ত্র সাহিত্যের ও তন্ত্রধর্মের মূলে এবং এই তন্ত্র-সাহিত্যের প্রায় অধিকাংশ গ্রন্থই রচিত হইয়াছিল বাঙলাদেশে। তন্ত্রধর্মের পরিপূর্ণ ও বিস্তৃত বিকাশও এই দেশেই। দ্বাদশ শতকের আগেকার রচিত কোনও তন্ত্র-গ্রন্থ আজও আমরা জানি না এবং পাল চন্দ্র কাম্বোজ লিপিমালা অথবা সেন-বর্মণ লিপিমালায়ও কোথাও এই গুহ্য সাধনার নিঃসংশয় কোনও উল্লেখ পাইতেছি না, এ-কথা সত্য। কিন্তু পাল-পর্বের শাক্ত দেবীদের রূপ-কল্পনায়, এক কথায় শক্তিধর্মের ধ্যানধারণায় তান্ত্রিক বাঞ্জনা নাই, এ কথা জোর করিয়া বলা যায় না। জয়পালের গয়া-লিপিতে মহানীল-সরস্বতী নামে যে দেবীটির উল্লেখ আছে তাঁহাকে তো তান্ত্রিক দেবী বলিয়াই মনে হইতেছে। তবু স্বীকার করিতেই হয় যে, পাল-পর্বের অসংখ্য দেবী মূর্তিতে শাক্তধর্মের যে রূপ-কল্পনার পরিচয় আমরা পাইতেছি তাহা আগম ও যামল গ্রন্থবিধৃত ও ব্যাখ্যাত শৈবধর্ম হইতেই উদ্ভূত এবং শাক্তধর্মের প্রাক- তান্ত্রিক রূপ। এ তথ্য লক্ষণীয় যে, পুরাণকথানুযায়ী সকল দেবীমূর্তিই শিবের সঙ্গে যুক্ত, শিবেরই বিভিন্নরূপিণী শক্তি, কিন্তু তাঁহাদের স্বাধীন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ছিল এবং সেইভাবেই তাঁহারা পূজিতাও হইতেন। শাক্তধর্ম ও সম্প্রদায়ের পৃথক অস্তিত্ব ও মর্যাদা সর্বত্র স্বীকৃত ছিল।

বাঙলাদেশে যত দেবীমূর্তি পাওয়া গিয়াছে তাহার মধ্যে চতুর্ভুজা ও দণ্ডায়মানা মূর্তির সংখ্যাই বেশি। কোনো কোনো প্রতিমায় তিনি একক, কোথাও কোথাও তিনি সপরিবারে ও সমগুলে বিদ্যমানা। শেষোক্ত ক্ষেত্রে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, উপস্থিত; অন্যত্র গণেশ, কার্তিকেয়, লক্ষ্মী এবং সরস্বতী। বিভিন্ন প্রতিমার দেবীর চারি হস্তের লক্ষণ বিভিন্ন; পার্শ্ব-দেবতারাও বিভিন্ন, কিন্তু উল্লেখযোগ্য হইতেছে অধিকাংশ প্রতিমার পাদপীঠে উৎকীর্ণ গোধিকার মূর্তি এবং কোনো কোনো প্রতিমায় দুই পাশে দুইটি কদলীবৃক্ষ। এই দুইটি লক্ষণই লোকায়ত ধর্মের প্রতিধ্বনি হিসাবে বিদ্যমান। গোধিকাটি তো অনিবার্য ভাবে মধ্যযুগীয় বাঙলা সাহিত্যের চণ্ডী ও কালকেতুর উপাখ্যান এবং কদলীবৃক্ষ দুইটি হয়তো পরবর্তী কালের দুর্গা-প্রতিমার কলা-বউ’র কথা স্মরণ করাইয়া দেয়। তবে, কলাগাছ দু’টি আবার বিশুদ্ধ মঙ্গলসূচক লক্ষণ হওয়াও বিচিত্র নয়। যাহা হউক, এই ধরনের চতুর্ভুজা ও পাদপীঠোপরি দণ্ডায়মানা দেবী মূর্তিগুলিকে কেহ বলিয়াছেন চণ্ডী, কেহ বলিয়াছেন গৌরী-পার্বতী। নাম যাহাই হউক, এই জাতীয় দেবী প্রতিমা বাঙলাদেশের নানা জায়গা হইতে সুপ্রচুর আবিষ্কৃত হইয়াছে এবং মূর্তিতত্ত্বের দিক হইতে তাঁহাদের মর্যাদাও কম নয়। দিনাজপুর জেলায় মঙ্গলবাড়ী গ্রামে প্রাপ্ত দেবী প্রতিমা, রাজশাহী-চিত্রশালার দ্বিহস্ত একটি প্রতিমা, রাজশাহীর মান্দৈল গ্রামে প্রাপ্ত নবগ্রহের মূর্তি সংযুক্ত সুবৃহৎ একটি প্রতিমা, খুলনা জেলার মহেশ্বরপাশা গ্রামে প্রাপ্ত একটি প্রতিমা, বাঁকুড়া জেলার দেওলি গ্রামে একটি প্রতিমা প্রভৃতি পাল-পর্বের এই ধরনের প্রতিমার বিশিষ্ট নিদর্শন।

আবার উপবিষ্ট মূর্তি অপেক্ষাকৃত বিরল। আসীনা দেবীর যে ক’টি মূর্তি পাওয়া গিয়াছে

তাঁহাদের মধ্যে কাহারও চার হাত, কাহারও ছয়, কাহারও বিশ; কাহারও পরিচয় সর্বমঙ্গলা, কাহারও অপরাজিতা, কাহারও পার্বতী বা ভুবনেশ্বরী, কাহারও বা মহালক্ষ্মী। হাতের সংখ্যা, হস্তধৃত লক্ষণ ও মুদ্রা, আসন-ভঙ্গি, বাহন, পরিবার-দেবতা প্রভৃতির উপরই এই সব পরিচয়ের নির্ভর। নওগাঁর (রাজশাহী-চিত্রশালা) সর্বমঙ্গলা, নিয়ামতপুরে প্রাপ্ত অপরাজিতা, যশোহর জেলার শাঁখহাটি গ্রামের ভুবনেশ্বরী, রাজশাহী জেলার শিমলা গ্রামের মহালক্ষ্মী প্রভৃতি পাল-পর্বের এই ধরনের মূর্তির এবং তক্ষণ শিল্পের উজ্জ্বল নিদর্শন। বিক্রমপুরের কাগজীপাড়া গ্রামে লিঙ্গোদ্ভবা চতুর্ভুজা (সম্মুখের দুই হাত ধ্যান মুদ্রায়, পশ্চাতের দুই হাতে অক্ষমালা ও পুস্তক) একটি দেবী মূর্তি পাওয়া গিয়াছে; ভট্টশালী মহাশয় বলেন, মূর্তিটি মহামায়া বা ত্রিপুর-ভৈরবীর।

রুদ্র বা উগ্রতন্ত্রের দেবী মূর্তির মধ্যে সুপরিচিতা মহিষমর্দিনী দুর্গাই প্রধান এবং তাঁহার প্রতিমা ভারতের অন্যান্য প্রান্তের মতো বাঙলাদেশেও সুপ্রতুল। বাঙলার প্রাচীনতম মহিষমর্দিনী প্রতিমাগুলি অষ্টভুজা বা দশভুজা। ঢাকা জেলার শাক্তগ্রামে একটি দশভুজা মহিষমর্দিনী মূর্তির পাদপীঠে “শ্রী-মাসিক-চণ্ডী” এই লিপিটি উৎকীর্ণ আছে; এই মূর্তিটির সঙ্গে মানভূম জেলার দুলমি গ্রামে প্রাপ্ত একটি দশভুজা মহিষমর্দিনীর সাদৃশ্য অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ভবিষ্যপুরাণ-কথিত মহিষমর্দিনীর নবদুর্গা-রূপও বাঙলাদেশে অজ্ঞাত ছিল না। দিনাজপুর জেলার পোরষ গ্রামে প্রাপ্ত এই ধরনের একটি নবদুর্গা-প্রতিমার মধ্যস্থলে বৃহদাকৃতি মহিষমর্দিনী এবং বাকি চারদিক ঘিরিয়া আটটি ক্ষুদ্রাকৃতি অনুরূপ মূর্তি। মধ্যস্থলের মূর্তিটির আঠারটি হাত, বাকি আটটির প্রত্যেকটির ষোলটি। ভবিষ্য পুরাণে মধ্য-মূর্তিটির নামকরণ উগ্রচণ্ডী, অন্যগুলির কাহারও নাম চণ্ডা, কাহারও চণ্ডনায়িকা, কাহারও চণ্ডবতী বা চণ্ডরূপা ইত্যাদি। বারোটি এবং ষোলটি হাতযুক্ত দুটি মহিষমর্দিনী মূর্তি পাওয়া গিয়াছে যথাক্রমে দিনাজপুর জেলার কেশবপুর গ্রামে এবং বীরভূম জেলার বক্রেশ্বরে। দিনাজপুর জেলার বেতনা গ্রামে একটি বত্রিশহস্ত চণ্ডিকা মহিষমর্দিনী প্রতিমা পাওয়া গিয়াছে; প্রধান মূর্তিটির উপরে শিব, গণপতি, সূর্য, বিষ্ণু ও ব্রহ্মার মূর্তি উৎকীর্ণ। বরিশাল জেলার শিকারপুর গ্রামের মন্দিরে এখনও একটি দেব মূর্তির পূজা হইয়া থাকে; মূর্তিটি শবোপরি দণ্ডায়মান এবং তাঁহার চার হাতে খেটক, খড়্গ, নীলপদ্ম এবং নরমুণ্ডের কঙ্কাল, মাথার উপর ক্ষুদ্রাকৃতি কার্তিকেয়, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব ও গণপতি। প্রতিমা-শাস্ত্র মতে মূর্তিটি খুব সম্ভব উগ্রতারার। এই উগ্রতারার মূর্তিটিকে এবং মহিষমর্দিনীর একাধিক প্রতিমার মধ্য মূর্তির উপরে ক্ষুদ্রাকৃতি পঞ্চমূর্তির সন্নিবেশ নিঃসংশয়ে মহাযানী প্রতিমার পঞ্চ ধ্যানীবুদ্ধের সন্নিবেশ স্মরণ করাইয়া দেয়। নবদুর্গা-প্রতিমার কেন্দ্রমূর্তির চারপাশে যে বাকি আটটি ক্ষুদ্রাকৃতি পুনরুক্তি তাহাও অরপচন-মঞ্জুশ্রীর প্রতিমা-বিন্যাসের কথা স্মরণ না করাইয়া পারে না। এই সব মূর্তি-কল্পনায় মহাযানী-বজ্রযানী প্রভাব অনস্বীকার্য।

এই পর্বের বাঙলাদেশে অন্তত দুই তিনটি চতুর্ভুজা ষড়ভুজা বাগীশ্বরী মূর্তি পাওয়া গিয়াছে। ইহাদের কাহারও চার হাত, কাহারও বা ছয়। বাগীশ্বরী ছাড়া আরও কয়েকটি মাতৃকা মূর্তির সঙ্গে এই পর্বের বাঙলার পরিচয় ছিল। মাতৃকা মূর্তি সাতটি : ব্রাহ্মণী, মহেশ্বরী কৌমারী, ইন্দ্রাণী, বৈষ্ণবী, বরাহী ও চামুণ্ডী এবং ইহারা প্রত্যেকেই কোনও না কোনও ব্রাহ্মণ্য দেবতার শক্তিরূপে কল্পিতা। ইহাদের মধ্যে চামুণ্ডা বা চামুণ্ডীই ছিলেন বাঙালীর প্রিয়; এবং তাঁহার সিদ্ধ-যোগেশ্বরী, দস্তুরা, রূপবিদ্যা, ক্ষমা, রুদ্রচটিকা, রুদ্রচামুণ্ডা, সিদ্ধচামুণ্ডা প্রভৃতি বিভিন্ন ধ্যান-কল্পনার প্রতিকৃতি বাঙলার নানা জায়গা হইতে পাওয়া গিয়াছে। রূপবিদ্যার একটি প্রতিমা পাওয়া গিয়াছে দিনাজপুর জেলার বেতনা গ্রামে; দ্বিহস্ত দস্তুরার একটি মূর্তি উদ্ধার করা হইয়াছে বর্ধমান জেলায়, একান্ন শক্তিপীঠের অন্যতম পীঠস্থান অট্টহাস গ্রাম হইতে। রাজশাহী-চিত্রশালায় দস্তুরার আরও কয়েকটি প্রতিমা রক্ষিত আছে। দ্বাদশভুজা সিদ্ধ-যোগেশ্বরীর দণ্ডায়মান ও নৃত্যপরায়ণা একাধিক প্রতিমা রক্ষিত আছে ঢাকা-চিত্রশালায়। রাজশাহী-চিত্রশালায় আরও দুইটি মূর্তি আছে; একটির পাদপীঠে উৎকীর্ণ “পিসিতাসনা” (পিশিতাসনা), এবং আরও একটির পাদপীঠে “চর্চিকা”। শেষোক্তটিতে দেবী শবাসনের উপর এক বৃক্ষের নীচে উপবিষ্টা; প্রথমোক্তটিতে দেবী গর্দভের উপর আসীনা। বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষদ চিত্রশালার একটি চতুর্ভুজা ব্রাহ্মণী মূর্তি (নদীয়া জেলার দেবগ্রামে প্রাপ্ত), রাজশাহী-চিত্রশালার কয়েকটি বরাহী এবং একটি ইন্দ্রাণী প্রতিমা প্রত্যেকটিই এই পর্বের মাতৃকা মূর্তির সুপরিচিত নিদর্শন। ক্ষমা-চামুণ্ডার একটি মূর্তি পাওয়া গিয়াছে যশোহর জেলার অমাদি গ্রামে; রুদ্রচামুণ্ডার এবং সিদ্ধচামুণ্ডার দুইটি প্রতিমার পরিচয় দিতেছেন বীরভূম-বিবরণের লেখক।

মন্দির-দ্বারের দুইপাশে গঙ্গা ও যমুনার প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ করা তো গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর পর্বের স্থাপত্যরীতির অন্যতম লক্ষণ। যমুনার স্বতন্ত্র মূর্তি বাঙলাদেশে বড় একটা পাওয়া যায় নাই; কিন্তু মকরবাহিনী গঙ্গার একাধিক মূর্তি বিদ্যমান। রাজশাহী-চিত্রশালার মূর্তি দুইটি সুন্দর। খুলনা জেলার যশোরেশ্বরী মন্দিরে একটি গঙ্গা-মূর্তি আছে। দিনাজপুর জেলার ভদ্রশিলা গ্রামে এখনও একটি গঙ্গা-প্রতিমার পূজা হইয়া থাকে, দক্ষিণা কালিকা নামে! হুগলী জেলার ত্রিবেণীতে একটি চতুর্ভুজা গঙ্গামূর্তি পাওয়া গিয়াছে।

সৌরধর্ম

সাম্প্রতিক বাঙলায় এমন কি মধ্যযুগীয় বাঙলায়ও সূর্য-প্রতিমার স্বাধীন স্বতন্ত্র পূজার প্রমাণ কিছু দেখিতে পাওয়া যায় না। অথচ গুপ্ত পর্ব হইতেই উদীচ্যবেশী ঈরাণী ধ্যান-কল্পনার সূর্যপূজা বাঙলাদেশে সুপ্রচারিত হইয়াছিল এবং আদিপর্বের শেষ পর্যন্ত তাহার প্রচার ও প্রসার বাড়িয়াই গিয়াছিল। বাঙলাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্ত অসংখ্য সূর্য-প্রতিমাই তাহার প্রমাণ। সেন-পর্বে তো এই ধর্ম রাজবংশের পোষকতাই লাভ করিয়াছিল, বিশ্বরূপ ও কেশবসেন ছিলেন পরমসৌর। সূর্য-প্রতিমা পূজার এত প্রসারের কারণ বোধ হয়, সূর্যদেব সকল প্রকার রোগের আরোগ্যকর্তা বলিয়া গণ্য হইতেন। দিনাজপুর জেলার বৈরহাট্টা গ্রামে প্রাপ্ত একটি আসীন সূর্য-প্রতিমার (একাদশ-দ্বাদশ শতক) পাদপীঠে সুস্পষ্ট উৎকীর্ণ আছে : “সমস্ত রোগানাম্‌ হর্তা”। পাল ও সেন-পর্বের সূর্য-প্রতিমায় উদীচ্য-ঈরাণী ধ্যান-কল্পনা অবিচল, কিন্তু সূর্য-দেবতার ধ্যানে ও ব্যাখ্যায় বোধ হয় বৈদিক ও ব্রাহ্মণ্য ধ্যান-কল্পনা মিলিয়া মিশিয়া এক হইয়া গিয়াছিল। সেন-লিপিতে সূর্যের যে ব্যাখ্যা আছে তাহাতে দেখিতেছি, তিনি কমলবনের সখা, তিমিরকারাবদ্ধ ত্রিলোকের মুক্তিদাতা, এবং বেদবৃক্ষের আশ্চর্য পক্ষী।

পাল-পর্বের সূর্য-প্রতিমা সপরিবারে বিদ্যমান এবং সমস্ত লক্ষণ ও লাঞ্ছন সুপরিস্ফুট। আসীন সূর্যমূর্তি দুর্লভ; বৈরহাট্টার উপবিষ্ট প্রতিমাটির কথা আগেই উল্লেখ করিয়াছি। বাঙলাদেশে প্রাপ্ত প্রায় সমস্ত সূর্যমূর্তিই স্থানক বা দণ্ডায়মান মূর্তি। লন্ডনের সাউথ-কেনসিংটন চিত্রশালার সূর্যমূর্তিটি ও ফরিদপুর-কোটালিপাড়ায় প্রাপ্ত (বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষদ চিত্রশালা) একটি প্রতিমা সূর্যমূর্তির দ্বিহস্ত দণ্ডায়মান সূর্যমূর্তির বিশিষ্ট উদাহরণ। দিনাজপুর জেলার মহেন্দ্র গ্রামে একটি ষড়ভুজ সূর্যমূর্তি পাওয়া গিয়াছে; এ-ধরনের মূর্তি দুর্লভ। রাজশাহী জেলার মান্দা গ্রামে একটি ত্রিমুণ্ড, দশহস্ত মূর্তি পাওয়া গিয়াছে। মূর্তিটির প্রায় সমস্ত লক্ষণই সূর্যের; কিন্তু ইহার তিনটি মুখ, দশটি হাত, উগ্রমূর্তির পার্শ্ব-দেবতারা এবং কেন্দ্র মূর্তিটির হস্তধৃত আয়ুধগুলি সূর্যের লক্ষণ বলিয়া মনে হইতেছে না। জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় বলিতেছেন, মূর্তিটি মার্তণ্ড-ভৈরবের। বাঙলার সমস্ত সূর্যমূর্তিই উদীচ্য পদাবরণ পরিহিত; কিন্তু মালদহ-চিত্রশালায় দুইটি প্রস্তর ফলকে যে সূর্যমূর্তি উৎকীর্ণ তাঁহাদের কোনো পদাবরণ নাই। এ-ক্ষেত্রে দক্ষিণী প্রতিমা-শাস্ত্রের প্রভাব অনস্বীকার্য।

পুরাণ-কাহিনী অনুসারে অশ্বারূঢ় এবং পরিজনসহ মৃগয়াবিহারী রেবস্তু দেবতার সঙ্গে সূর্যের সম্বন্ধ ঘনিষ্ঠ। এই রেবস্ত-দেবতার কয়েকটি মূর্তি বাঙলার নানাস্থানে আবিষ্কৃত হইয়াছে। দিনাজপুর জেলার ঘাটনগরে প্রাপ্ত (রাজশাহী-চিত্রশালা) রেবন্ত মূর্তিটি নানা কারণে উল্লেখযোগ্য। এই প্রতিমাটিতে পরিজনসহ মৃগয়ারত রেবস্তু তো আছেনই, কিন্তু দুইজন দস্যুর প্রতিকৃতিও দেখা যাইতেছে; একজন বৃক্ষশীর্যে লুক্কায়িত থাকিয়া রেবস্তুকে প্রহারোদ্যত। পাদপীঠে একটি নারী দণ্ডায়মানা ও একটি পুরুষ বঁটিতে মৎস্যকর্তনরতা একটি নারীকে প্রহারে উদ্যত। ফলকটির উপরের দক্ষিণ কোণে একটি বাড়ি এবং তাহার ভিতরে একটি নারী ও পুরুষ। এই ফলকটির সমগ্র রূপ বিশ্লেষণ করিলে মনে হয়, রেবন্ত আদিতে পশুজীবী শিকারী কোমের লোকায়ত দেবতা ছিলেন এবং লোকায়ত জীবনের সঙ্গেই ছিল তাঁহার সম্বন্ধ। কিন্তু পরবর্তীকালে কোনো সময়ে তিনি ব্রাহ্মণ্যধর্মে স্বীকৃতি লাভ করেন এবং অশ্বারূঢ় বলিয়া সূর্যের সঙ্গে আত্মীয়তাবদ্ধ হন।

বাঙলাদেশে প্রাপ্ত অসংখ্য নবগ্রহ প্রতিমাগুলি সৌরধর্মের সঙ্গেই যুক্ত। বাঙলার শিল্পে নয়টি গ্রহের প্রতিকৃতি সর্বদাই একত্র পাশাপাশি রূপায়িত হইয়াছে, হয় কোনও মন্দিরের গর্ভগৃহের প্রবেশদ্বারের উপরে, না হয় কোনও প্রতিমা-ফলকের ঊর্ধ্বভাগে। ২৪ পরগণা জেলার কঙ্কনদীঘিতে প্রাপ্ত সুন্দর নবগ্রহ-প্রতিমাটি বোধ হয় গ্রহযাগ বা স্বস্ত্যয়নোদ্দেশ্যে স্বাধীন স্বতন্ত্র পূজালাভ করিত। নবগ্রহের কোনো একটি গ্রহের পৃথক স্বতন্ত্র মূর্তি সুদুর্লভ। এ পর্যন্ত যে-দু’টি মূর্তির পরিচয় আমরা পাইয়াছি তাহা পাহাড়পুর মন্দিরের ভিত্তিগাত্রের দুইটি ফলকে; একটি চন্দ্রের ও অপরটি বৃহস্পতির।

বৈষ্ণব, শৈব, শাক্ত ও সৌর সম্প্রদায়ের দেবদেবী ছাড়া আরও নানাপ্রকারের এমন দেবদেবী প্রতিমা পাওয়া গিয়াছে যাঁহারা কোনও বিশেষ সম্প্রদায়ের ধ্যান-কল্পনার সৃষ্টি নহেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইহারা লোকায়ত ধর্মেরই সৃষ্টি, কিন্তু পরবর্তীকালে ক্রমশ ব্রাহ্মণ্য ধর্মে স্বীকৃতি লাভ করিয়াছিলেন। ইহাদের মধ্যে মনসার কথা আগেই বলিয়াছি। গঙ্গা-যমুনার রূপ-কল্পনার মূলেও লোকায়ত ধর্মের প্রভাব সক্রিয়। বৌদ্ধ হারীতী এবং ব্রাহ্মণ্য ষষ্ঠী সম্বন্ধেও একই উক্তি প্রযোজ্য। রাজশাহী জেলার ক্ষীরহর গ্রামে প্রাপ্ত (রাজশাহী-চিত্রশালা) একটি চতুর্ভুজা উপবিষ্টা দেবী-প্রতিমার ক্রোড়ে একটি শিশু, দেবীর দোল্যমান দক্ষিণ পদটি ঊর্ধ্বমুখী একটি বিড়ালের উপর স্থাপিত। মূর্তিটি ষষ্ঠী দেবীর, সন্দেহ নাই এবং বোধ হয় ইহাই ষষ্ঠীর প্রাচীনতম প্রতিমা। হারীতী দেবীর অন্তত দুইটি প্রতিমার সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে, একটি ঢাকা-চিত্রশালায় (বিক্রমপুর-পাইকপাড়া গ্রামে প্রাপ্ত) এবং আর একটি সুন্দরবনের এক গ্রামে এখনও অন্য নামে পূজা পাইতেছেন। দুইটি মূর্তিরই ক্রোড়ে মানবশিশু এবং চারিহস্তের দুই হস্তে মাছ ও ভাণ্ড। পাল-পর্বের বাঙলার অনেকগুলি মনসামূর্তি ঢাকা, রাজশাহী ও কলিকাতার চিত্রশালায় রক্ষিত আছে।

বাঙলার নানাস্থান হইতে এক ধরনের মাতা-পুত্ৰ যুগ্মমূর্তি আবিষ্কৃত হইয়াছে। শয্যায় শায়িতা একটি নারীর প্রায় বক্ষলগ্ন হইয়া একটি শিশুপুত্র শয়ান; একাধিক পরিচারিকা শায়িতা নারীর পরিচর্যায় নিযুক্তা। শয্যার একপাশে উপরের দিক গণেশ, কার্তিকেয়, শিবলিঙ্গ এবং নবগ্রহের মূর্তি উৎকীর্ণ। ভট্টশালী মহাশয় বলিয়াছেন, এই প্রতিমাগুলি শিবের সদ্যোজাত রূপের অভিব্যক্তি। এরূপ মনে করিবার খুব সঙ্গত কারণ কিছু নাই এবং কেহ কেহ যে বলিয়াছেন, কৃষ্ণের জন্মবৃত্তান্ত এই ফলকগুলিতে রূপায়িত তাহাই যেন অধিকতর যুক্তিসহ।

ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ, যম, কুবের প্রভৃতি দিকপাল দেবতাদের স্বাধীন স্বতন্ত্র মূর্তিও বাঙলাদেশে কয়েকটি পাওয়া গিয়াছে। আদিতে ইহারা অনেকেই ছিলেন মর্যাদাসম্পন্ন বৈদিক দেবতা, কিন্তু সাম্প্রদায়িক ধর্মের উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে ইহাদের মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠা কমিতে আরম্ভ করে এবং স্বতন্ত্র পূজা প্রায় উঠিয়াই যায়। পাহাড়পুর মন্দিরের ভিত্তি-গাত্রে ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ এবং কুবেরের একাধিক প্রতিমা-প্রমাণ বিদ্যমান। বৃষবাহন যম, নরবাহন নিরঋতি এবং মকরবাহন, ললিতাসনোপবিষ্ট বরুণের তিনটি সুন্দর প্রতিমা রাজশাহী-চিত্রশালায় রক্ষিত আছে। বাঙলার নানা জায়গা হইতেই এই ধরনের দিক্‌পাল-প্রতিমা আবিষ্কৃত হইয়াছে।