৬. পাল-পর্বের বৌদ্ধ ধর্ম ও দেবদেবী

৬. পাল-পর্বের বৌদ্ধ ধর্ম ও দেবদেবী

পাল-চন্দ্র পর্বের ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা অর্থবহ তথ্য এই যে, এই পর্বের প্রত্যেকটি রাজবংশ মহাযানী বৌদ্ধ। মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বাঙলার অনুরাগ কিছুদিন আগে হইতেই সুস্পষ্ট হইয়া উঠিতেছিল। সপ্তম শতকের খড়গ-বংশীয় রাজারা ছিলেন “সর্বলোকবন্দ্য ত্রৈলোক্যখ্যাতকীর্তি ভগবান সুগত এবং তাঁহার শান্ত ভববিভবভেদকারী যোগীগণের যোগগম্য ধর্ম এবং অপ্রমেয় বিবিধ গুণসম্পন্ন সত্ত্বের পরম ভক্তিমান উপাসক।” মহাযানী বৌদ্ধ অর্থদের বাহন বৃষ ছিল এই বংশের রাজাদের লাঞ্ছন। পাল রাজারা সকলেই ছিলেন পরম সৌগত। অধিকাংশ পাল-লিপির প্রারম্ভেই যে বন্দনা-শ্লোকটি দেখিতে পাওয়া যায় তাহা এইরূপ :

“যিনি কারুণারত্ন-প্রমূদিত হৃদয়ে মৈত্রীকে প্রিয়তমা রূপে ধারণ করিয়াছিলেন, যিনি তত্ত্বজ্ঞানতরঙ্গিনীর সুবিমল সলিলধারায় অজ্ঞানপঙ্ক প্রক্ষালিত করিয়াছিলেন, যিনি কামক অরির পরাক্রমসঞ্জাত আক্রমণ পরাভূত করিয়া শাশ্বতী শান্তি লাভ করিয়াছিলেন, সেই শ্রীমান দশবল লোকনাথের জয় হোক।”

ধর্মপালের খালিমপুর-লিপির প্রথম শ্লোকেই আছে :

“যিনি সর্বজ্ঞতাকেই রাজশ্রীর ন্যায় স্থিরভাবে ধারণ করিয়াছিলেন, সেই বজ্রাসনের (বুদ্ধদেবের) বিপুল-করুণা-প্রতিপালিত বহুমারসেনা-সমাকুল-দিমণ্ডল-বিজয়-সাধনকারী দশবল তোমাদিগকে রক্ষা করুন।”

দেবপালের নালন্দা ও মুঙ্গের লিপিদ্বয়ের প্রথমেই যে বুদ্ধ-ধ্যান আছে তাহা এইরূপ :

“যে সর্বার্থভূমীশ্বর সুগত (বুদ্ধদেব) প্রবল (অধ্যাত্ম) শক্তি সমূহের আবির্ভাব-প্রভাবে ত্রিলোকনিবাসী প্রাণীবর্গের (সুপরিচিত) সিদ্ধিপথ অতিক্রম করিয়া নবৃতি (নির্বাণলোক ) লাভ করিয়াছিলেন, সেই পরপ্রয়োজন-সম্পাদন-স্থিরচেতা সৎপথপ্রবর্তক ভগবান সিদ্ধার্থদেবের সিদ্ধি “প্রজাবর্গের সর্বোত্তম সিদ্ধিবিধান করুক।”

দশম শতকের পূর্বার্ধে পূর্ববঙ্গে মহারাজাধিরাজ কান্তিদেব নামে এক নরপতির রাজত্বের খবর পাওয়া যায়; তিনিও ছিলেন বৌদ্ধ। এই শতকেরই শেষার্ধে পূর্ববঙ্গেই আর একটি বৌদ্ধ রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল; এই চন্দ্র-বংশীয় নৃপতিরাও সকলেই ছিলেন বৌদ্ধ, পরমসৌগত। পাল রাজাদের মতো ইঁহাদেরও শাসনাবলীতে যুগল মৃগমূর্তি এবং ধর্মচক্র-লাঞ্ছন উৎকীর্ণ। এই বংশের অন্যতম রাজা শ্রীচন্দ্রের পট্রোলী তিনটির প্রত্যেকটিতেই প্রথম শ্লোকেই বুদ্ধ-বন্দনা :

“করুণার একমাত্র আধার, বন্দনাই সেই ভগবান জিন (বুদ্ধ) এবং জগতের একমাত্র দীপসদৃশ তাঁহার ধর্ম (উভয়েই) জয়লাভ করুন। সকল মহানুভব ভিক্ষুসংঘই বুদ্ধ ও ধর্মের সেবা করিয়া সংসার (সাগর) পারে উপস্থিত হন।”

এই শতকেরই কাম্বোজান্বয় গৌড়পতিরাও ছিলেন পরমসৌগত এবং ইহাদের রাজকীয় পট্টে মৃগমূর্তিলাঞ্ছিত ধর্মচক্র। বস্তুত, অষ্টম হইতে একাদশ শতক পর্যন্ত বাঙলায় বৌদ্ধধর্মের জয়জয়কার এবং তাহার প্রভাব শুধু বাঙলা-বিহারেই সীমাবদ্ধ নয়; সমসাময়িক বৌদ্ধ ধর্মের আন্তর্জাতিক মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠা এই সব রাজবংশের সক্রিয় পোষকতার ফলেই।

উপরে যে ধ্যান ও বন্দনা শ্লোকগুলি উদ্ধার করা হইয়াছে তাহা হইতে পূর্ণ বিবর্তিত মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের ধ্যান-কল্পনার রূপ কতকটা ধরিতে পারা কঠিন নয়, কিন্তু এই পর্বের বাঙলাদেশে মহাযান ধর্ম ধ্যান-ধারণায় ও আচারানুষ্ঠানে কী ভাবে আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল এবং প্রতিবেশী ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতি তাহার দৃষ্টি ও মনোভাব কিরূপ ছিল, তাহা বুঝিতে পারা যায় না। সে-পরিচয় কতকটা পাওয়া যায় সমসাময়িক বৌদ্ধ রাজাদের সামাজিক ও ধর্মকর্মগত ব্যবহারে, অসংখ্য বৌদ্ধ দেবদেবীর মূর্তিতে, বজ্রযান-মন্ত্রযান – কালচক্রযান-সহজযান প্রভৃতি মতবাদে, সিদ্ধাচার্যদের গানে ও দোহায়, বৌদ্ধশাস্ত্রগ্রন্থাদিতে।

বৌদ্ধ রাজাদের সামাজিক ব্যবহার

পাল বংশীয় নরপতিরা অনেকেই পত্নীরূপে গ্রহণ করিয়াছিলেন ব্রাহ্মণ্য রাজবংশীয়া রাজকুমারীদের। রাজা কান্তিদেবের পিতা বৌদ্ধ-ধনদত্ত বিবাহ করিয়াছিলেন একটি শৈব রাজকুমারীকে; এই রাজপুত্রী রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণে ছিলেন পারঙ্গম। পরমসৌগত কান্তিদেবের এই জননী ছিলেন ‘শিবপ্রিয়া’। কম্বোজাম্বয় গৌড়পতি রাজপালের প্রথম পুত্র নারায়ণপাল ‘বাসুদেব-পাদাজ-পূজা-নিরত মানসঃ’ এবং দ্বিতীয় পুত্র নয়পাল এক পুণ্য নবমী তিথিতে স্নানাদিপূর্বক শঙ্কর ভট্টারকের (মহাদেবের) উদ্দেশ্যে তাঁহার বৌদ্ধ পিতামাতার ও নিজের পুণ্য ও যশোবৃদ্ধির জন্য ধর্মচক্রমুদ্রা দ্বারা পট্টীকৃত করিয়া ব্রাহ্মণকে ভূমিদান করিয়াছিলেন। প্রায় আড়াই শত তিন শত বৎসর আগে বৌদ্ধ দেবখড়্গোর মহিষী রানী প্রভাবতী একটি সর্বাণী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পরস্পর সম্বন্ধের ইঙ্গিত এই সব দৃষ্টান্তের মধ্যে পাওয়া যাইবে। পাল-রাজারা তো সকলেই ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ্য মূর্তি ও মন্দিরের পরম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন; রাজা কর্তৃক ভূমিদান সব তো ইহাদেরই উদ্দেশ্যে। ধর্মপাল তাঁহার মহাসামন্তাধিপতি নারায়ণবর্মা প্রতিষ্ঠিত নারায়ণ মন্দিরের জন্য ভূমিদান করিয়াছিলেন; নারায়ণপাল শুধু এক সহস্র দেবায়তন প্রতিষ্ঠার দাবিই করেন নাই, তাঁহার প্রতিষ্ঠিত কর্ণসপোতের শিবমন্দিরে পূজা, বলি, চরু, সত্র প্রভৃতির জন্য এবং মন্দিরের পশুপত-আচার্যপরিষদের শয়নাসন-ভৈষজের জন্য ‘ভগবন্তং শিবভট্টারকমুদ্দিশ্য’ ভূমিদান ও করিয়াছিলেন। বিষুব-সংক্রান্তি উপলক্ষে মহীপাল গঙ্গাস্নান করিয়া এক ব্রাহ্মণকে ভূমিদান করিয়াছিলেন। রামপাল রামাবতী নগরীতে শিবের তিনটি মন্দির, একাদশ রুদ্রের একটি দেউল এবং সূর্য, স্কন্দ ও গণপতির তিনটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। মদনপালের মহিষী চিত্রমতিকা বেদব্যাস-প্রোক্ত মহাভারত পাঠ করিয়া শুনাইবার দক্ষিণাস্বরূপ রাজাকে দিয়া ব্রাহ্মণ বটেশ্বর শর্মাকে কিছু ভূমিদান করাইয়াছিলেন এবং দানকার্য সমাপন করা হইয়াছিল ‘বুদ্ধভট্টারকমুদ্দিশ্য’। সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতে মদনপালকে বলা হইয়াছে “চণ্ডীচরণ সরোজ-প্রসাদ–সম্পন্ন বিগ্রহশ্রী”। প্রথম বিগ্রহপাল তাঁহার মন্ত্রী কেদারমিশ্রের যজ্ঞস্থলে উপস্থিত থাকিয়া অনেকবার শ্রদ্ধা সলিলাপ্লুত হৃদয়ে নতশিরে পবিত্র শান্তিবারি গ্রহণ করিয়াছিলেন। শ্রীচন্দ্রদেবও ভগবান বুদ্ধ-ভট্টারককে উদ্দেশ করিয়া ধর্মচক্রমুদ্রাদ্বারা পট্টীকৃত করিয়া কোটি-হোম-সম্পাদনকারী শান্তিবারিক শ্রীপীতবাসগুপ্ত শর্মাকে এবং অন্য এক উপলক্ষে অদ্ভুতশান্তি হোমসম্পাদনকারী শান্তিবারিক ব্যাসগঙ্গা-শর্মাকে কিছু ভূমিদান করিয়াছিলেন। ধর্মপালের ভ্রাতা বাকপালের মৃত্যুর পর পুত্র জয়পাল যে শ্রাদ্ধ করিয়াছিলেন তাহা তো ব্রাহ্মণ্যধর্মানুমোদিত শ্রাদ্ধানুষ্ঠান বলিয়াই মনে হইতেছে; সেই শ্রাদ্ধে মহাদান লাভ করিয়াছিলেন উমাপতি নামে এক ব্রাহ্মণ। মাতুল মর্থনের মৃত্যুসংবাদে রামপাল ব্রাহ্মণদের প্রচুর ধনৈশ্বর্য দান করিয়া গঙ্গায় আত্মবিসর্জন করিয়াছিলেন। ধর্মপালকে পুত্ররূপে লাভ করিয়া গোপানাদের প্রতি পিতৃপুরুষদের ঋণ হইতে মুক্তিলাভ করিয়াছিলেন। এই সব ক্রিয়া-কর্মের পশ্চাতে যে ধ্যান-কল্পনার আকাশ বিস্তৃত তাহা তো ব্রাহ্মণ্য ধর্মেরই আকাশ। ধর্মপাল এবং পরবর্তী আর একজন পালরাজ শাস্ত্রশাসন হইতে বিচলিত বর্ণসমূহকে নিজ নিজ ধর্ম ও বর্ণসীমায় প্রতিস্থাপিত করিয়া ব্রাহ্মণ্য-সমাজ সংস্কারেও আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন। কাম্বোজবংশীয় রাজ্যপাল ছিলেন সৌগত বা বৌদ্ধ, কিন্তু তাহার এক পুত্র নারায়ণপাল ছিলেন বাসুদেবভক্ত এবং আর এক পুত্র নয়পাল ছিলেন শৈব।

অথচ, পাল, চন্দ্র ও কাম্বোজ-বংশীয় নরপতিরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া একাগ্রচিত্তে বৌদ্ধ ধর্ম ও সংঘের সেবায় ও প্রভাব বিস্তারে যে পরম প্রচেষ্টা করিয়াছিলেন, বৌদ্ধ ধর্ম ও ধ্যানধারণাকে যেভাবে দিগ্বিদিকে প্রসারিত করিয়াছিলেন তাহার তুলনা ইতিহাসে বিরল। ধর্মপালের সময়ে তাঁহারই চেষ্টায় প্রাচীন নালন্দা মহাবিহারের নূতনতর সমৃদ্ধি দেখা দিয়াছিল। সোমপুর মহাবিহারের প্রতিষ্ঠা তাঁহারই সক্রিয় আনুকূল্যে এবং এই মহা-বিহারের নামই ছিল শ্রীধর্মপালদেব-মহাবিহার। ধর্মপালেরই আনুকূল্যে ত্রৈকূটক-বিহারের নিভৃতকক্ষে বসিয়া আচার্য হরিভদ্র তাঁহার অভিসময়ালংকারের সুপ্রসিদ্ধ টীকা রচনা করিয়াছিলেন। যবদ্বীপের কেলুরক-লিপিতে জানা যায়, শৈলেন্দ্ররাজ শ্রীসংগ্রাম-ধনঞ্জয়ের গুরু ছিলেন গৌড়ীয় কুমার ঘোষ। এই ‘গৌড়ীদ্বীপগুরু’ ৭৭৮ খ্রীষ্ট শতকে একটি মঞ্জুশ্রী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন; ধর্মপাল বোধ হয় তখনও গৌড়েশ্বর। অষ্টম শতকের দ্বিতীয় পাদে শৈলেন্দ্রবংশসম্ভূত বালপুত্রদেব নালন্দায় একটি বিহার নির্মাণ করিয়াছিলেন এবং তাহার অনুরোধে পাল-সম্রাট দেবপাল ঐ বিহারের ব্যয় নির্বাহের জন্য পাঁচটি গ্রাম দান করিয়াছিলেন। নগরাহারের অধিবাসী ব্রাহ্মণ ইন্দ্রদেবের পুত্র বীরদের বেদাদি শাস্ত্র পাঠ শেষ করিয়া বৌদ্ধমতের অনুরাগী হইয়া প্ৰথম কনিষ্ক-বিহারে গমন করেন এবং আচার্য সর্বজ্ঞশান্তির নিকট শিক্ষাদীক্ষা লাভ করিয়া পরে বুদ্ধগয়ার যশোধর্মপুর বিহারে আসেন। সেইখানে তিনি দেবপালের নিকট শ্রদ্ধা ও সম্মাননা লাভ করেন। দেবপাল তাঁহাকে নালন্দার অন্যতম আচার্যরূপেও নিয়োগ করিয়াছিলেন। বোধ হয় দেবপালের রাজত্বকালেই (৮৫১ খ্রী) গোমিন অবিঘ্নাকর নামে গৌড়ের একজন বৌদ্ধ শিলাহার-রাজ কর্পদিনের রাজত্বে কঙ্কনদেশে গিয়া সেখানে কৃষ্ণগিরি-মহাবিহারের ভিক্ষুদের জন্য একটি বিরাট উপাসনাগৃহ নির্মাণ করাইয়া দিয়াছিলেন এবং ভিক্ষুকের চীবর সংস্থানের জন্য একশত দক্ষ দান করিয়াছিলেন। মহীপাল ও জয়পালের কালে বিক্রমশীল ও সোমপুর মহাবিহার ভারতবর্ষে ও ভারতের বাহিরে জ্ঞানমর্যাদায় বৌদ্ধ জগতের শীর্ষস্থান অধিকার করিয়াছিল। কাশ্মীর, তিব্বত ও ভারতের অন্যান্য স্থানের বৌদ্ধ শ্রমণ ও অন্যান্য জ্ঞানপিপাসু ব্যক্তিরা এই সময়ই এই দুই মহাবিহারে বসিয়া বহু গ্রন্থ রচনা, অনুবাদ ও অনুলিপি প্রস্তুত করিয়াছিলেন। অতীশ দীপঙ্কর, রত্নাকর শাস্তি প্রভৃতি আচার্যদের আবির্ভাবও এই সময়েই। ১০২৬ খ্রীষ্ট শতকে পৌ-সি বা কো-লিন-নৈ নামে জনৈক বাঙালী শ্রমণ অনেক সংস্কৃত পুঁথি লইয়া গিয়াছিলেন চীনদেশে। বরেন্দ্রীর জগদ্দল মহাবিহারের প্রতিষ্ঠাতা বোধ হয় ছিলেন রামপাল নিজেই।

বস্তুত, এই পর্বের বৌদ্ধধর্মের এবং বৌদ্ধজ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচয় বহুখ্যাত বৌদ্ধ মহাবিহারগুলি। এই বিহারগুলির বিস্তৃত সংবাদ তিব্বতী সাহিত্যে এবং কিছু কিছু তথ্য সমসাময়িক লিপিতে বিধৃত। তিব্বতী ঐতিহ্যে বিক্রমশীল-মহাবিহারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাজা ধর্মপাল। মগধের উত্তরে গঙ্গার তীরবর্তী এবং সীমাপ্রাচীরবদ্ধ এই বিহারে ১০৮টি মন্দির ছিল। ছয়টি ছিল বিদ্যায়তন এবং ১১৪ জন ছিলেন জ্ঞান ও বিদ্যার বিভিন্ন ক্ষেত্রের আচার্য। তিব্বত হইতে অগণিত বৌদ্ধ জ্ঞানপিপাসুরা আসিতেন এই মহাবিহারে। এখানে যত সংস্কৃত গ্রন্থের তিব্বতী অনুবাদ রচিত হইয়াছিল তাহার তালিকা সুদীর্ঘ। ধর্মপালের অন্য একটি নামই ছিল শ্রীবিক্রমশীলদের এবং এই নাম হইতে বিহারটির নামকরণ হইয়াছিল শ্রীমদ্ বিক্রমশীল- দেব-মহাবিহার। তিব্বতী ঐতিহো ওদন্তপুরীবিহারও ধর্মপালেরই সৃষ্টি, যদিও তারনাথ বলেন, এই বিহারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন দেবপাল। এই বিহার ছিল নালন্দার সন্নিকটেই, বর্তমান বিহার-শরিফের অনতিদূরে।

সোমপুর (পাহাড়পুর) মহাবিহারের কথা তো আগেই বলিয়াছি। মহাপণ্ডিতাচার্য বোধিভদ্র (অন্য দুই নাম, ভিক্ষু আরণ্যক এবং কালম্বলপাদ) এই বিহারেই বাস করিতেন। তাঁহার অনেক গ্রন্থ তিব্বতীতে অনূদিত হইয়াছিল; একটি গ্রন্থের অনুবাদ করিয়াছিলেন (১০০০ খ্রী) অদ্বয়বজ্র বা অতুল্যপাদ। আচার্য অতীশ দীপঙ্করও কিছুকাল এই বিহারে বাস করিয়াছিলেন এবং ভাববিবেকের মধ্যমকরত্নপ্রদীপ নামে একটি গ্রন্থ তিব্বতী ভাষায় অনুবাদ করিয়াছিলেন। সমতটবাসী এবং এই বিহারের আবাসিক, মহাযানী এবং বিনয়পারঙ্গম বীর্যেন্দ্র নামে জনৈক বৃদ্ধ স্থবির খ্রীষ্ট দশম শতকে বুদ্ধগয়ায় একটি সুবৃহৎ বুদ্ধ-প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। সোমপুর মহাবিহারের পরিণতির কিছু উল্লেখ একটি লিপিতে আছে। একাদশ শতকের শেষপাদ বা দ্বাদশ শতকের প্রথমার্ধে উৎকীর্ণ, নালন্দায় প্রাপ্ত, ‘বিপুল-বিমল-কীর্তি, সজ্জন-আনন্দকন্দ বৌদ্ধযতি বিপুলশ্রীমিত্রের একটি প্রশস্তিলিপি হইতে জানা যায়, বিপুলশ্রীমিত্রের পরম গুরুর গুরু করুণাশ্রীমিত্র নামক আচার্য সোমপুর বিহারে বাস করিতেন; বঙ্গাল-সৈন্যরা আসিয়া সোমপুর অগ্নিদগ্ধ করে এবং সেই আগুনে করুণাশ্ৰীমিত্র জীবন্ত দগ্ধ হইয়া মৃত্যু আলিঙ্গন করেন। জগতের অষ্টমহাভয় নির্মূল করিবার উদ্দেশ্যে বিপুলশ্রীমিত্র সোমপুরে এক তারা মন্দির প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন এবং অগ্নিদাহে বিনষ্ট মহাবিহারের সংস্কার সাধন করাইয়া দিয়াছিলেন। তিনি সোমপুরের বুদ্ধমূর্তির জন্য বিচিত্র হেমাভরণ দান করিয়াছিলেন এবং দীর্ঘকাল সোমপুরীতে বশীর মতো বাস করিয়াছিলেন।

বৌদ্ধ বিহার-মহাবিহার

তারনাথের মতে ধর্মপাল ৫০টি ধর্মবিদ্যায়তন প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। তিব্বতী ঐতিহ্যে এই পর্বের বাঙলাদেশে আরও অনেকগুলি বৌদ্ধবিহারের যায়। ত্রৈকূটক-বিহার, দেবীকোট বিহার, পণ্ডিত-বিহার, সন্নগর-বিহার, ফুল্লহরি-বিহার, পট্টিকেরক-বিহার, বিক্রমপুরী-বিহার ও জগদ্দল মহাবিহার প্রভৃতির সম্বন্ধে সংবাদ তিব্বতী প্রাচীন সাহিত্যে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। ত্রৈকূটক-বিহার বোধ হয় ছিল পশ্চিমবঙ্গে, রাঢ় দেশের ত্রৈকূটক-দেবালয়ের সন্নিকটেই। দেবীকোট-বিহার নিশ্চয়ই ছিল উত্তরবঙ্গে, দিনাজপুর জেলার বানগড়ের অদরবর্তী। আচার্য অদ্বয়বজ্র, উধিলিপা, ভিক্ষুণী মেখলা প্রভৃতি এই বিহারেই বাস করিতেন। পণ্ডিত-বিহার ছিল চট্টগ্রামে। ফুল্লহরি-বিহার ছিল বোধ হয় বিহারে; এই বিহারে অনেক বৌদ্ধ আচার্য বাস করিতেন এবং তিব্বতী পণ্ডিতদের সঙ্গে একযোগে তাঁহারা অনেক সংস্কৃত গ্রন্থের তিব্বতী অনুবাদ রচনা করিয়াছিলেন। পট্টিকেরক ও সন্নগর মহাবিহার দুইই ছিল পূর্ববঙ্গে এবং বোধ হয় উভয়ই ত্রিপুরা জেলায়। ময়নামতী পাহাড়ের উপর পট্টিকেরক-বিহারের ধ্বংসাবশেষ সম্প্রতি আবিষ্কৃত হইয়াছে। রাজা হরিকালদেব রণবঙ্কমল্লের (১২২০ খ্রীষ্ট শতক) লিপিতে দুর্গোত্তারার নামে উৎসর্গীকৃত যে-বিহারের উল্লেখ আছে তাহারও অবস্থান ছিল পট্টিকেরক নগরীতে। বনরত্ন নামে জনৈক বৌদ্ধ আচার্য বাস করিতেন সন্নগর-বিহারে এবং সেইখানে বসিয়া তিনি অনেক সংস্কৃত গ্রন্থের তিব্বতী অনুবাদ রচনা করিয়াছিলেন। বিক্রমপুরী-বিহার তো বিক্রমপুরেই ছিল; এই বিহারে বসিয়া অবধূতাচার্য কুমারচন্দ্র একটি তান্ত্রিক টীকা-গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন এবং ইন্দ্রভূতির কন্যা লীলাবজ্র ও তিব্বতী শ্রমণ পুণ্যধ্বজ ঐ টীকা তিব্বতীতে অনুবাদ করিয়াছিলেন। জগদ্দল মহাবিহারের কথা আগেও বলিয়াছি। এই মহাবিহার ছিল উত্তরবঙ্গের বরেন্দ্রীতে এবং বিহারের অধিষ্ঠাতা দেবতা ছিলেন অবলোকিতেশ্বর, অধিষ্ঠাত্রী দেবী ছিলেন মহত্তারা। এই বিহারের কক্ষে কক্ষে বসিয়াই বিভূতিচন্দ্র, দানশীল, শুভাকর গুপ্ত, মোক্ষাকরগুপ্ত, ধর্মাকর প্রভৃতি আচার্যরা বহু সংস্কৃত গ্রন্থ তিব্বতীতে অনুবাদ করিয়াছিলেন।

এই সব প্রসিদ্ধ মহাবিহার ছাড়া আরও কয়েকটি ছোট ছোট বিহার বাঙলা ও বিহারের ইতস্তত প্রতিষ্ঠিত ছিল। তিব্বতী গ্রন্থাদি এবং প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ হইতে এই জাতীয় দু’চারিটি বিহারের নামও জানা যায়। পাহাড়পুরের ২৮ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে দীপগঙ্গে হলুদ-বিহার নামে একটি স্তূপ এখনও বর্তমান। পট্টিকেরক নগরীতে আর একটি বিহারের নাম ছিল কনকস্তূপ-বিহার; এই বিহারে আচার্য বিনয়শ্রীমিত্র এবং আরও কয়েকজন কাশ্মীরী ভিক্ষু বাস করিতেন। ইহাদেরই অনুরোধে সিদ্ধাচার্য নাড়পাদ বজ্রপাদ-সারসংগ্রহ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন। নাড়পাদের গুরু ছিলেন প্রসিদ্ধ তন্ত্রাচার্য তৈলপাদ; তিনি বাস করিতেন চট্টগ্রাম অঞ্চলের পণ্ডিত-বিহারে। এই বিহার ছিল বৌদ্ধ তান্ত্রিক জ্ঞান ও সাধনার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। বগুড়ার নিকটে শীলবর্ষে একটি বিহারের এবং নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের নিকটে সুবর্ণ-বিহারের ধ্বংসাবশেষও হয়তো এই পর্বেরই বৌদ্ধ সাধনার অন্য দুইটি কেন্দ্রের স্মৃতি বহন করে। বালাণ্ডা নামক স্থানে অনুলিখিত একটি অষ্টসাহসিকা-প্রজ্ঞাপারমিতার পুঁথি নেপালের রাজকীয় গ্রন্থাগারেও এখন রক্ষিত; হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় বলেন, বালাণ্ডায় একটি বৌদ্ধ বিহার ছিল। আচার্য প্রজ্ঞাবর্মা ও তাহার গুরু বোধিবৰ্মা তিব্বতী ঐতিহ্যে কাপট্য-নিবাসী বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন; ইহাদের রচিত কয়েকটি সংস্কৃত গ্রন্থ তিব্বতী ভাষায় অনূদিতও হইয়াছিল। এই ‘কাপট্য’ কি কোনও বৌদ্ধ বিহারের নাম?

এই সব মহাবিহারে বসিয়া অগণিত খ্যাত ও বিস্মৃতনামা আচার্যরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া যে অক্লান্ত-জ্ঞান সাধনা করিয়াছিলেন, অসংখ্য যে-সব গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন তাহার কিছু আভাস পরবর্তী এক অধ্যায়ে ধরিতে চেষ্টা করিয়াছি। কিন্তু ধর্মের যে-সাধনা ছিল এই জ্ঞান-সাধনার আশ্রয় তাহার স্বরূপের পরিচয় পাল চন্দ্র কম্বোজ লিপিমালায় ধরিতে পারা যায় না; তাহা বিধৃত হইয়া আছে সদ্যোক্ত গ্রন্থরাজির মধ্যে এবং এই পর্বের অসংখ্য নয়নাভিরাম প্রস্তর ও ধাতব দেবদেবী-মূর্তির অবহেলিত আয়তনে। এই সব গ্রন্থের সংস্কৃত মূল কমই পাওয়া গিয়াছে; অধিকাংশই তিব্বতী অনুবাদ। কিছুই বাঁচিয়া থাকিয়া আমাদের কালে আসিয়া পৌঁছিবার কথা নয় : তিব্বতী পণ্ডিতেরা ও ভারতীয় গুরুরা যে-সব গ্রন্থের অনুলিপি ও অনুবাদ তিব্বত, কাশ্মীর, নেপাল, চীন প্রভৃতি দেশে লইয়া গিয়াছিলেন, এবং মুসলমান অভিযাত্রীদের আগমনে ও বিহারগুলি ধ্বংস হইবার অব্যবহিত আগে যে অল্পসংখ্যক ভিক্ষু আপনাপন স্কন্ধে ঝুলাইয়া যে ক’টি পুঁথি ঝুলিতে ভরিয়া নেপালে, তিব্বতে, চীনে, কাশ্মীরে, আসানে, ব্রহ্মদেশে পলাইয়া যাইতে পারিয়াছিলেন তাহারই কিছু কিছু অংশ শতাব্দী অতিক্রম করিয়া আমাদের কালে আসিয়া পৌঁছিয়াছে। এই সব খুব সুস্পষ্ট নয়। মহাযানী বৌদ্ধ ধর্মের যে বৈপ্লবিক বিবর্তন এবং বিভিন্ন ধারায় তাহার যে বিস্তার এই গ্রন্থরাজির মধ্যে অনুসরণ করা যায় তাহা লইয়া সাম্প্রতিক কালে আলোচনা-গবেষণা কিছু কিছু হইয়াছে এবং প্রধানত ভারতীয় পণ্ডিতেরাই তাহা করিয়াছেন। এই আলোচনা-গবেষণার সার-সংগ্রহ ছাড়া এখানে আর কিছু করা সম্ভব নয়।

মহাযানের বিবর্তন

সম্মতীয়বাদ, সর্বাস্তিবাদ, মহাসাংঘিকবাদ প্রভৃতি লইয়া যে মহাযান বৌদ্ধধর্মের প্রসার সপ্তম শতকীয় বাঙলায় য়ুয়ান্-চোয়াঙ্‌, ইৎ-সিঙ্ প্রভৃতি চীনা শ্রমণেরা দেখিয়া গিয়াছিলেন, কিংবা এই পর্বের লিপিমালার পূর্বোদ্ধৃত ধ্যান ও বন্দনা শ্লোকে যে মহাযানাদর্শের পরিচয় আমরা পাই তাহার সঙ্গে অষ্টম হইতে দ্বাদশ শতক এই চারি শত বৎসরের বাঙলার বৌদ্ধধর্মের সম্বন্ধ অত্যন্ত ক্ষীণ ও শিথিল। অষ্টম ও নবম শতকে মহাযান বৌদ্ধধর্মে নূতনতর তান্ত্রিক ধ্যান-কল্পনার স্পর্শ লাগিয়াছিল এবং তাহার ফলে দশম শতক হইতেই বৌদ্ধ ধর্মে গুহ্য সাধনতত্ত্ব, নীতিপদ্ধতি ও পূজাচারের প্রসার দেখা দিয়াছিল। এই গুহ্য সাধনার ব্যান-কল্পনা কোথা হইতে কী করিয়া মহাযান-দেহে প্রবেশ করিয়া বৌদ্ধ ধর্মের রূপান্তর ঘটাইল এবং বিভিন্ন ধারার সৃষ্টি করিল বলা কঠিন। মহাযানের মধ্যে তাহার বীজ সুপ্ত ছিল কিনা তাহাও নিঃসংশয়ে বলা যায় না। বৌদ্ধ ঐতিহ্যে আচার্য অসঙ্গ সম্বন্ধে বলা হইয়াছে, পর্বত-কাম্ভারবাসী সুবৃহৎ কৌম-সমাজকে বৌদ্ধধর্মের সীমার মধ্যে আকর্ষণ করিবার জন্য ভূত, প্রেত, যক্ষ, রক্ষ, যোগিনী, ডাকিনী, পিশাচ ও মাতৃকাতন্ত্রের নানা দেবী প্রভৃতিকে অসঙ্গ মহাযান-দেবায়তনে স্থান দান করিয়াছিলেন। নানা গুহ্য, মন্ত্র, যন্ত্র, ধারণী (গূঢ়ার্থক অক্ষর) প্রভৃতিও প্রবেশ করিয়াছিল মহাযান ধ্যান-কল্পনায়, পূজাচারে, আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্মে এবং তাহাও অসঙ্গেরই অনুমোদনে। এই ঐতিহ্য কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য, বলা কঠিন। তবে, বলা বাহুল্য, এই সব গুহ্য, রহস্যময়, গূঢ়ার্থক মন্ত্র, যন্ত্র, ধারণী বীজ, মণ্ডল প্রভৃতি সমস্তই আদিম কৌম সমাজের যাদুশক্তিতে বিশ্বাস হইতেই উদ্ভূত। সহজ সমাজতান্ত্রিক যুক্তিতেই বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যধর্ম উভয়েরই ভাব-কল্পনায় ও ধর্মগত আচারানুষ্ঠানে ইহাদের প্রবেশ লাভ কিছু অস্বাভাবিক নয়। উভয়কেই নিজ নিজ প্রভাবের সীমা বিস্তৃত করিবার চেষ্টায় আদিম কৌম সমাজের সম্মুখীন হইতে হইয়াছিল; তাহা ছাড়া উভয় ধর্ম সম্প্রদায়েরই নিম্নতর স্তরগুলিতে যে সুবৃহৎ মানবগোষ্ঠী ক্রমশ আসিয়া ভিড় করিতেছিল তাঁহারা তো ক্রমহ্রস্বায়মান আদিবাসী সমাজেরই জনসাধারণ। তাঁহারা তো নিজ নিজ ধর্মবিশ্বাস, ধ্যান ধারণা, দেবদেবী লইয়াই বৌদ্ধ বা ব্রাহ্মণ্য ধর্মে আসিয়া আশ্রয় লইতেছিলেন। অন্যদিকে, বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মেরও চেষ্টা ছিল নিজ নিজ ধ্যান-ধারণা ও ভাব-কল্পনা অনুযায়ী, নিজ নিজ শক্তি ও প্রয়োজনানুযায়ী সদ্যোক্ত আদিম ধর্মবিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা, দেবদেবী ইত্যাদির রূপ ও মর্ম কিছু রাখিয়া কিছু ছাড়িয়া, শোধিত ও রূপান্তরিত করিয়া লওয়া। অসঙ্গের সময় হইতেই হয়তো বৌদ্ধধর্মে এই রূপান্তরের সূচনা দেখা দিয়াছিল। কিন্তু তাহা হউক বা না হউক, সন্দেহ নাই যে, বাঙলা-বিহারের, এক কথায় পূর্ব-ভারতের বৌদ্ধ ধর্মে এই ধরনের রূপান্তরের একটা গতি অষ্টম-নবম শতকেই ধরা পড়িয়াছিল। ইহার মূলে ঐতিহাসিক একটা কার্যকারণ সম্বন্ধ নিশ্চয়ই ছিল; সে-কারণ এখনও আমরা খুঁজিয়া পাই নাই, এই মাত্র। তবু এই পর্বের বাঙলা-বিহারে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য উভয় ধর্মেরই এই বিরাট বিবর্তনের (যাহাকে সাধারণ কথায় তান্ত্রিক বিবর্তন বলা চলে) কারণ সম্বন্ধে একটু অনুমান বোধ হয় করা চলে।

খ্রীষ্টোত্তর সপ্তম শতকের মাঝামাঝি হইতেই হিমালয়ক্রোড়স্থিত পার্বত্য-কান্তারময় দেশগুলির সঙ্গে গাঙ্গেয় প্রদেশের প্রথম ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ স্থাপিত হয় এবং কাশ্মীর, তিব্বত, নেপাল, ভোটান প্রভৃতি দেশগুলির সঙ্গে মধ্য ও পূর্ব-ভারতের আদান-প্রদান বাড়িয়া যায়। ব্যাবসা-বাণিজ্যে, রাষ্ট্রীয় দৌত্যবিনিময়, সমরাভিযান প্রভৃতি আশ্রয় করিয়া এই সব পার্বত্য দেশের আদিম সংস্কার ও সংস্কৃতির স্রোত বাঙলা-বিহারে প্রবাহিত হইতে আরম্ভ করে। তাহার কিছু কিছু ঐতিহাসিক প্রমাণও বিদ্যমান। সপ্তম শতকের পূর্ব-বাঙলার খড়গ – রাজবংশ বোধ হয় এই স্রোতেরই দান। ধর্মপাল ও দেবপালের কালে এই যোগাযোগ আরও বাড়িয়াই গিয়াছিল। পরবর্তীকালে আমরা যাহাকে বলিয়াছি তান্ত্রিক ধর্ম তাহার একটা দিক এই যোগাযোগের ফল হওয়া একেবারে অস্বাভাবিক হয়তো নয়। তন্ত্রধর্মের প্রসারের ভৌগোলিক লীলাক্ষেত্রের দিকে তাকাইলে এ-অনুমান একেবারে অযৌক্তিক বলিয়া মনে হয় না।

মন্ত্রযান

যাহাই হউক, এ-তথ্য অনস্বীকার্য যে, শূন্যবাদ ও বিজ্ঞানবাদ, যোগাচার ও মধ্যমিকবার প্রভৃতি প্রাচীনতর মহাযানী ধ্যান ও চিন্তা একেবারে বিদায় না লইলেও স্বল্পসংখ্যক পণ্ডিতদের চর্চার মধ্যেই আবদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিল; সর্বাস্তিবাদ বা মহাসাংঘিক-বাদের বিনয়-শাসনের স্থান ও সুযোগ দীক্ষা গ্রহণের সময় ছাড়া আর কোথাও ছিল না। বৌদ্ধ জনসাধারণ শূন্যবাদ বা বিজ্ঞানবাদ, যোগাচার বা মধ্যমিকবাদের গভীর পরমার্থিক তত্ত্ব ও সাধনমার্গের বিচিত্র স্তরের কিছুই বুঝিত না, বুঝিতে পারা সহজও ছিল না। তাঁহাদের কাছে যাদুশক্তিমূল মন্ত্র ও মণ্ডল, ধারণী ও বীজ অনেক বেশি সত্য ও সহজ বলিয়া ধরা দিল এবং ক্রমবর্ধমান ধর্ম-সমাজের জন্য এক শ্রেণীর বৌদ্ধ আচার্যরা মহাযানের নতন ধ্যান-কল্পনা গড়িয়া তুলিবার দিকে মনোনিবেশ করিলেন। মন্ত্রই হইল তাঁহাদের মূল প্রেরণা এবং মন্ত্রের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ ধারণী ও বীজ। ইহাদের রচিত নয়ই মন্ত্র নয়, ইহাদের প্রদর্শিত যান বা পথই মন্ত্ৰ-যান। এই মন্ত্রযানই মহাযানের বিবর্তনের প্রথম স্তর।

বজ্রযান

দ্বিতীয় স্তরে বজ্রযান। বজ্রযানের ধ্যান-কল্পনা গভীর ও জটিল! বজ্রযানীদের মতে নির্বাণের পর তিন অবস্থা : শূন্য, বিজ্ঞান ও মহাসুখ। শূন্যতত্ত্বের সৃষ্টিকর্তা নাগার্জুন; তাঁহার মতে দুঃখ, কর্ম, কর্মফল, সংসার সমস্তই শূন্য, শূন্যতার এই পরম জ্ঞানই নির্বাণ। বজ্রযানীরা এই নির্বিকল্প জ্ঞানের নামকরণ করিলেন নিরাত্মা; বলিলেন, জীবের আত্মা নির্বাণ লাভ করিলে এই নিরাত্মাতেই বিলীন হয়। নিরাত্মা কল্পিতা হইলেন দেবীরূপে এবং বলা হইল, বোধিচিত্ত যখন নিরাত্মার আলিঙ্গনবদ্ধ হইয়া নিরাত্মাতেই বিলীন হন তখনই উৎপত্তি হয় মহাসুখের। বোধিচিত্তের অর্থ হইতেছে চিত্তের এক বিশেষ বৃত্তি বা অবস্থা যাহাতে সম্যক জ্ঞান – বা বোধিলাভের সংকল্প বর্তমান। বজ্রযানীরা বলেন, মৈথুনযোগে চিত্তের যে পরম আনন্দময় ভাব, যে এককেন্দ্রিক ধ্যান তাহাই বোধিচিত্ত। এই বোধিচিত্তই বজ্র, কারণ কঠোর যোগসাধনার ফলে ইন্দ্রিয়শক্তি সম্পূর্ণ দমিত চিত্র বজ্রের মতো দৃঢ় ও কঠিন হয়। বোধিচিত্তের বজ্ৰভব লাভ ঘটিলে তবে বোধিজ্ঞান লাভ হয়। চিত্তের এই বজ্রভাবকে আশ্রয় করিয়া সাধনার যে পথ তাহাই বজ্রযান। ইন্দ্রিয়শক্তিকে, কামনা-বাসনাকে সম্পূর্ণ দমিত করিবার কথা এই মাত্র বলা হইল। বজ্রযানীরা বলেন, ইন্দ্রিয় দমন করিতে হইলে আগে সেগুলিকে জাগরিত করিতে হয়; মিথুন সেই জাগরণের উপায়। মিথুনজাত আনন্দকে অর্থাৎ বোধিচিত্তকে স্থায়ী করা যায় মন্ত্রশক্তির সাহায্যে এবং সেই অবস্থাতেই ইন্দ্রিয়শক্তি দমিত হয়। সাধকের সাধনার শক্তিতে মন্ত্ৰ বা ধ্যান অর্থাৎ তাহার ধ্বনি রূপমূর্তি লাভ করে; এই রূপমূর্তিরাই বিভিন্ন দেবদেবী। মিথুনাবস্থার আনন্দোদ্ভূত বিভিন্ন দেবদেবী সাধকের মনশ্চক্ষুর সম্মুখে নিজ নিজ স্থানে আসিয়া অধিষ্ঠিত হইয়া এক একটি মণ্ডল সৃষ্টি করেন। এই মণ্ডলের নিঃশব্দ ধ্যান করিতে করিতেই বোধিচিত্ত স্থায়ী ও স্থির হইয়া বজ্রের মতো কঠিন হয় এবং ক্রমে বোধিজ্ঞান লাভ ঘটে। বলা বাহুল্য, অত্যন্ত স্বাভাবিক কারণেই বজ্রযানের এই সমস্ত সাধন-পদ্ধতিটাই অত্যন্ত গুহ্য এবং যে-ভাষায় ও শব্দে এই পদ্ধতি ব্যাখ্যাত হয় তাহাও গুহ্য। গুরুদীক্ষিত-সাধক ছাড়া সে শব্দ ও ভাষার গূঢ়ার্থ আর কেহ বুঝিতে পারেন না এবং গুরুর নির্দেশ ও উপদেশ ছাড়া আর কাহারও পক্ষে এই সাধন-পদ্ধতি অনুসরণ করাও প্রায় অসম্ভব বলিলেই চলে। বজ্রযানে গুরু অপরিহার্য। বজ্রযানে প্রজ্ঞার সার যে বোধিচিত্ত, ব্রাহ্মণ্য তন্ত্রের ভাষায় তাহাই শক্তি।

সহজযান

বজ্রযান গুহ্য সাধনারই সূক্ষ্মতর স্তর সহজযান নামে খ্যাত। বজ্রযানে মন্ত্রের মূর্তি রূপের ছড়াছড়ি সুতরাং তাহার দেবায়তনও সুপ্রশস্ত : মন্ত্র-মুদ্রা-পূজা-আচার-অনুষ্ঠানে বজ্রযানের সাধনমার্গ আকীর্ণ। সহজযানে দেবদেবীর

দেবদেবীর স্বীকৃতি যেমন নাই, তেমনই নাই মন্ত্র-মুদ্রা-পূজা-আচার-অনুষ্ঠানের স্বীকৃতি। সহজযানীরা বলেন, কাঠ, মাটি বা পাথরের তৈরি দেবদেবীর কাছে প্রণত হওয়া বৃথা। বাহ্যানুষ্ঠানের কোনো মূলাই তাহাদের কাছে ছিল না। ব্রাহ্মণদের নিন্দা তো তাঁহারা করিতেনই; যে-সব বৌদ্ধ মন্ত্রজপ, পূজার্চনা, কৃচ্ছসাধন প্রব্রজ্যা ইত্যাদি করিতেন তাঁহাদেরও নিন্দা করিতেন : বলিতেন সিদ্ধিলাভ, বৌদ্ধত্বলাভ তাঁহাদের ঘটে না। সহজযানী সিদ্ধাচার্যদের ধ্যান-ধারণা ও মতবাদ দোহাকোষের অনেকগুলি দোহায় স্পষ্ট ধরা পড়িয়াছে। দুইটি মাত্র দৃষ্টান্ত উদ্ধার করিতেছি।

কিং তো দীবেঁ কিং তো নিবেজ্জঁ
কিং তো কিজ্জই মন্তহ সেব্বঁ।
কিং তো তিত্থ তপোবন জাই
মোক্‌খ কি লব্ ভই পানী হ্নাই।।

কী (হইবে) তোর দীপে, কী (হইবে) তোর নৈবেদ্যে, কী করা হইবে তোর মন্ত্রের সেবায়, কী তোর (হইবে) তীর্থ-তপোবনে যাইয়া! জলে নাহিলেই কি মোক্ষ লাভ হয়?

এস জপহোমে মণ্ডল কম্মে
অনুদিন আচ্ছসি বাহিউ ধৰ্ম্মে।
তো বিনু তরুণি নিরস্তর ণেহে
বোধি কি লব্‌ ভই প্ৰণ বি দেহেঁ।

এই জপ-হোম-মণ্ডল কর্ম লইয়া অনুদিন বাহ্যধর্মে (লিপ্ত) আছিস্। তোর নিরন্তর স্নেহ বিনা, হে তরুণি, এই দেহে কি বোধিলাভ হয়?

.

সহজযানী বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের গূঢ় সাধন-পদ্ধতি ও ধ্যান-ধারণার সূক্ষ্ম গভীর পরিচয় দোহাকোষের দোহা এবং চর্যাগীতির গীতগুলিতে বিধৃত হইয়া আছে। সহজযানীরা বলেন, বোধি বা পরমজ্ঞান লাভের খবর অন্য সাধারণ লোকের তো দূরের কথা, বুদ্ধদেবও জানিতেন না–বুদ্ধোঽপি ন তথা বেত্তি যথায়মিতরো নরঃ। ঐতিহাসিক বা লৌকিক বুদ্ধের স্থানই বা কোথায়? সকলেই তো বুদ্ধত্ব লাভের অধিকারী এবং এই বুদ্ধত্বের অধিষ্ঠান দেহের মধ্যে- দেহস্থিতং বুদ্ধত্ব; দেহহি বুদ্ধ বসন্ত ণ জাণই। কোথায় কতদূরে গেলে শূন্যতাবাদ, কতদূরে সরিয়া গেল বিজ্ঞানবাদ! জাগিয়া রহিল শুধু দেহবাদ, শুধু কায়সাধন। সহজিয়াদের মতে শূন্যতা হইল প্রকৃতি, করুণা হইল পুরুষ; শূন্যতা ও করুণা অর্থাৎ প্রকৃতি ও পুরুষের মিলনে, অর্থাৎ নারী ও নরের মিথুন-মিলনযোগে বোধিচিত্তের যে পরমানন্দময় অবস্থার সৃষ্টি লাভ হয় তাহাই মহাসুখ। এই মহাসুখই ধ্রুবসত্য; এই ধ্রুবসত্যের উপলব্ধি ঘটিলে ইন্দ্রিয়গ্রাম বিলুপ্ত হইয়া যায়, সংসারজ্ঞান তিরোহিত হয়, আত্মপরভেদ লোপ পায়, সংস্কার বিনষ্ট হয়। ইহাই সহজ অবস্থা। রাজা হরিকালদেব রণবঙ্কমল্লের ত্রয়োদশ শতকীয় একটি লিপিতে দেখিতেছি, জনৈক প্রধান রাজকর্মচারী পট্টিকেরক নগরীতে সহজধর্মকর্মে লিপ্ত ছিলেন।

কালচক্রযান

বজ্রযানেরই অপর আর এক সাধনপন্থার নাম কালচক্রযান। কালচক্রযানীদের মতে শূন্যতা ও কালচক্র এক এবং অভিন্ন। ভূত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ লইয়া অবিরাম প্রবহমান কালস্রোত চক্রাকারে ঘূর্ণমান। এই কালচক্র সর্বদর্শী, সর্বজ্ঞ; এই কালচক্রই আদিবুদ্ধ ও সকল বুদ্ধের জন্মদাতা। কালচক্র প্রজ্ঞার সঙ্গে মিলিত হইয়া এই জন্মদান কার্যটি সম্পন্ন করেন। কালচক্রযানীদের উদ্দেশ্যই হইতেছে কালচক্রের এই অবিরাম গতিকে নিরস্ত করা অর্থাৎ নিজেদের সেই কাল- প্রভাবের ঊর্ধের উন্নীত করা। কিন্তু কালকে নিরস্ত করা যায় কিরূপে? কালের গতির লক্ষণ হইতেছে একের পর এক কার্যের মালা; কার্যপরম্পরা অর্থাৎ গতির বিবর্তন দেখিয়াই আমরা কালের ধারণায় উপনীত হই। ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই কার্যপরম্পরা মূলত প্রাণক্রিয়ার পরম্পরা ছাড়া আর কিছুই নয়। কাজেই, প্রাণক্রিয়াকে নিরুদ্ধ করিতে পারিলেই কালকে নিরস্ত করা যায়। কালচক্রযানীরা বলেন, যোগসাধনার বলে দেহাভ্যন্তরস্থ নাড়ী ও নাড়ীকেন্দ্রগুলিকে পারলেই পঞ্চবায়ুকে আয়ত্ত করিতে পারিলেই প্রাণক্রিয়া নিরুদ্ধ করা যায় এবং তাহাতেই কাল নিরস্ত হয়। কাল নিরস্ত করাই যেখানে উদ্দেশ্য, সেখানে কালচক্রযানীদের সাধন-পদ্ধতিতে তিথি, বার, নক্ষত্র, রাশি, যোগ প্রভৃতি একটা বড় স্থান অধিকার করিয়া থাকিবে ইহা কিছু বিচিত্র নয়! এই জনাই কালচক্রযানীদের মধ্যে গণিত ও জোতির্বিদ্যার প্রচলন ছিল খুব বেশি। তিব্বতী ঐতিহ্যানুসারে কালচক্রযানের উদ্ভব ভারতবর্ষের বাহিরে, সম্ভল নামক কোনো স্থানে। পাল-পর্বের কোনও সময়ে নাকি তাহা বাঙলাদেশে প্রবেশ লাভ করে। প্রসিদ্ধ কালচক্রযানী অভয়াকরগুপ্ত এই মতবাদ সম্বন্ধে কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি ছিলেন রামপালের সমসাময়িক।

বজ্রযান, সহজযান, কালচক্রযান সকলেরই নির্ভর যোগ-সাধনার উপর। বলা বাহুল্য, ইহাদের সকলেরই মূল যোগাচার ও মধ্যমিক দর্শনে। এই তিন যান একই ধ্যান-কল্পনা হইতে উদ্ভুত; ব্যবহারিক সাধনার ক্ষেত্রে এই তিন যানের মধ্যে পার্থক্যও খুব বেশি ছিল না। ইহাদের মধ্যে সূক্ষ্ম সীমারেখা টানা বস্তুতই কঠিন। একই সিদ্ধাচার্য একাধিক যানের উপর পুস্তক রচনা করিয়াছেন, এমন প্রমাণও দুর্লভ নয়। এই তিন যানের উদ্ভব যেখানেই হউক, বাঙলাদেশেই ইহারা লালিত ও বর্ধিত হইয়াছিল; প্রধানত এ ত্ৰিযানপন্থী বাঙালী সিদ্ধাচার্যরাই এই বিভিন্ন গুহা সাধনার গ্রন্থাদি রচনা ও দেবদেবীর ধ্যান-কল্পনা গড়িয়া তুলিয়াছিলেন। বস্তুত, এই তিন যানের ইতিহাসই পাল-চন্দ্ৰ-কম্বোজ-পর্বের বাঙলার বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস।

যে-যোগের উপর এই তিন যানের নির্ভর সেই যোগ হঠযোগ নামে পরিচিত এবং মানবদেহের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শারীর-জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত। শরীরের নাড়ীপ্রবাহ ও তাহাদের ঊর্ধ্বমুখী গতি, বিভিন্ন নাড়ীর সংযোগ কেন্দ্র, তাহাদের উৎপত্তিস্থল, নাড়ীচক্র প্রভৃতি সমস্তই এই শারীর-জ্ঞানের অন্তর্গত। ললনা, রসনা ও অবধূতী এই তিনটিই প্রধান নাড়ীপ্রবাহ; ইহাদের মধ্যে অবধূতীর ঊর্ধ্বমুখী গতি ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত। নাড়ীপ্রবাহের গতিকে সাধক স্বেচ্ছায় চালনা করিতে পারেন এবং সেই চালনার শক্তি অনুযায়ী বোধিচিত্তের ধ্যান-দৃষ্টি উন্মীলিত ও প্রকাশিত হয়। ব্রাহ্মণ্য-তন্ত্রের যোগ সাধনায় উপরোক্ত ললনা-রসনা-অবধূতীই ইড়া-পিঙ্গলা সুষুমাতে বিবর্তিত।

পূর্বেই বলিয়াছি, বজ্রযান সাধন-পদ্ধতিতে গুরু অপরিহার্য। কিন্তু গুরুর পক্ষে শিষ্য নির্বাচন এবং তাহাকে যথার্থ সাধনপন্থায় চালনা করিয়া লইয়া যাওয়া খুব সহজ ছিল না। সাধনমার্গের কোন পথে শিষ্যের স্বাভাবিক প্রবণতা গভীর বিচার করিয়া তাহা স্থির করিতে হইত। এই বিচার-বিশ্লেষণের অভিনব একটি পদ্ধতি তাঁহারা আবিস্কার করিয়াছিলেন; এই পদ্ধতির নাম ছিল কুলনির্ণয়-পদ্ধতি। ডোম্বী, নটী, রজকী, চণ্ডালী ও ব্রাহ্মণী এই পাঁচ রকমের কুল। এই পাঁচটি কুল প্রজ্ঞার পাঁচটি রূপ। যে পঞ্চস্কন্ধ বা পঞ্চবায়ুর সারোত্তম দ্বারা এই ভৌতিক মানবদেহ গঠিত, ব্যক্তি বিশেষের দেহে তাহাদের মধ্যে যে স্কন্ধটি অধিকতর সক্রিয়, সেই অনুযায়ী তাহার কুল নির্ণীত হয় এবং তদনুযায়ী সাধনপন্থাও স্থিরীকৃত হয়। বৈষ্ণব পদকর্তা ও সাধক চণ্ডীদাসের রজকী বা রজকিনী বজ্রযান-সহজযান মতে চণ্ডীদাসের কুলেরই সূচক, আর কিছুর নহে।

বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যকুল

মহাযান ধর্মের যে বিরাট বিবর্তনের কথা এতক্ষণ বলিলাম এই বিবর্তনের নেতৃত্ব যাঁহারা গ্রহণ করিয়াছিলেন, সমসাময়িক বৌদ্ধ ঐতিহ্যে তাঁহাদের বলা হইয়াছে সিদ্ধ বা সিদ্ধাচার্য। চুরাশি জন সিদ্ধাচার্যের সকলেই ঐতিহাসিক ব্যক্তি কিনা বলা কঠিন, তবে ইহাদের অনেকেই যে ঐতিহাসিক ব্যক্তি এবং নবম হইতে দ্বাদশ শতকের মধ্যে ইহারা জীবিত ছিলেন সে সম্বন্ধে সন্দেহের কোনো কারণ নাই। অনেকে অনেক গ্রন্থও রচনা করিয়াছিলেন এবং তাহাদের তিব্বতী অনুবাদ আজও বিদ্যমান। ইহাদের মধ্যে সরহপাদ বা সরহবজ্র, নাগার্জুন, লুইপাদ, তিল্লোপাদ, নাড়ো পাদ, শবরপাদ, অদ্বয়বজ্র, কাহ্নপাদ, ভুসুকু, কুক্কুরিপাদ প্রভৃতি সিদ্ধাচার্যেরাই প্রধান। বৌদ্ধ ঐতিহ্যানুযায়ী সরহের বাড়ি ছিল পূর্ব-ভারতের রাষ্ট্রী শহরে; তিনি ছিলেন রত্নপালের সমসাময়িক। উড্ডিয়ানে তাঁহার তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা এবং আচার্যের পদ অধিকার করিয়াছিলেন নালন্দা মহাবিহারে। নাগার্জন ছিলেন সরহপাদের শিষ্য এবং নালন্দায় তাঁহার দীক্ষা হইয়াছিল। তিল্লোপাদের বা তৈলিকপাদের বাড়ি ছিল চট্টগ্রামে, তাঁহার বংশ ব্রাহ্মণ বংশ; তিনি ছিলেন মহীপালের সমসাময়িক এবং পণ্ডিত-বিহারের অধিবাসী। নাড়োপাদ জয়পালের সমসাময়িক ছিলেন, বাড়ি ছিল বরেন্দ্রীতে এবং প্রসিদ্ধ নৈয়ায়িক জেতারির তিনি শিষ্য ছিলেন। নাড়োপাদ প্রথমে ছিলেন ফুল্লহরি-বিহারে; পরে বিক্রমশীল-বিহারের অধিবাসী হন। ভুসুকুর বাড়ি ছিল বিক্রমপুরে এবং তিনি ছিলেন অতীশ দীপঙ্করের শিষ্য। লুইপাদও বোধ হয় বাঙালী ছিলেন, যদিও পাগ সাম জোন-জাং-গ্রন্থে তাহাকে বলা হইয়াছে ‘উড্ডিয়ান-বিনির্গত’। অবধূতপাদ অদ্বয়বজ্র সম্বন্ধেও প্রায় একই কথা বলা চলে। কুক্কুরিপাদ ছিলেন বাঙলার এক ব্রাহ্মণ-পরিবার হইতে উদ্ভত, পরে বৌদ্ধতন্ত্রে দীক্ষিত হইয়া ডাকিনীদের দেশ হইতে মহাযানতন্ত্র উদ্ধার করিয়া আনেন। শবরপাদ ছিলেন সরহপাদের শিষ্য; সিদ্ধপূর্বজীবনে তিনি ছিলেন বঙ্গালদেশের পার্বত্যভূমির একজন শবর। ত্যাঙ্গুরে অবশ্য শবরীপাদের বাড়ি যেন ইঙ্গিত করা হইয়াছে মগধে। এই সব সিদ্ধাচার্যদের এবং আরও অনেক বজ্রযান-সহজযান কালচক্রযানপন্থী পণ্ডিতদের বিস্তৃত বিবরণ পরবর্তী অধ্যায়ে পাওয়া যাইবে; এখানে আর পুনরুক্তি করিলাম না।

পরিণতি

বজ্রযান ও কালচক্রযানে ব্যবহারিক ধর্মানুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ক্ষীণ হইলেও শ্রাবকযান ও মহাযান বৌদ্ধধর্মের কিছু আভাস তবু বিদ্যমান ছিল, কিন্তু ক্রমশ এই ধর্মের ব্যবহারিক অনুষ্ঠান কমিয়া আসিতে থাকে এবং সঙ্গে সঙ্গে গুহ্য সাধনা বাড়িতে আরম্ভ করিয়া অবশেষে গুহ্য সাধনাটাই প্রবল ও প্রধান হইয়া দেখা দিল। তাহার উপর, সহজযান আবার লৌকিক বা লোকোত্তর কোনো বুদ্ধকেই স্বীকার করিল না; প্রব্রজ্যা বিনয়-শাসন, বজ্রযানের দেবদেবী প্রভৃতি সমস্ত কিছুই হইল নিন্দিত ও পরিত্যক্ত। রহিল শুধু কায়সাধন এবং দেহাশ্রয়ী হঠযোগ। বাঙলার ব্রাহ্মণ্য শক্তি-ধর্মেও অনুরূপ এক বিবর্তন ঘটিতেছিল এবং সেখানেও ক্রমশ শক্তিধর্মের বাহ্য আচারানুষ্ঠান পরিত্যক্ত হইয়া সূক্ষ্ম মিথুনযোগের গুহ্য সাধনাপন্থাই প্ৰধান হইয়া উঠিল। উভয় ক্ষেত্রেই অবস্থাটা যখন এক তখন বৌদ্ধ মহাসুখবাদ ও গুহ্য সাধনপন্থার সঙ্গে শক্তি বা ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক মোক্ষ ও গুহ্য সাধনপন্থার পার্থক্য আর বিশেষ কিছু রহিল না, দু’য়ের মিলনও খুব সহজ হইয়া উঠিল। এই মিলন পাল-পর্বের শেষের দিকেই আরম্ভ হইয়াছিল এবং চতুর্দশ শতক নাগাদ পূর্ণ পরিণতি লাভ করিয়াছিল। এই সময়ের মধ্যে তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্ম একেবারে তান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও শক্তিধর্মের কুক্ষিগত হইয়া গেল।

কৌলমার্গ

তান্ত্রিক ব্রাহ্মণ্য ও শক্তি ধর্ম এবং নব বৌদ্ধ ধর্মের গুহ্য সাধনবাদের একত্র মিলনে শক্তিধর্মের যে সব নূতন রূপ দেখা দিল তাহার মধ্যে কৌলধর্মই প্রধান। কৌলধর্মের কয়েকটি প্রাচীন গ্রন্থ কিছুদিন হইল নেপাল রাজকীয় গ্রন্থসংগ্রহে আবিষ্কৃত হইয়াছে। কৌলধর্মীরা বলেন, তাঁহাদের ধর্মের মূল সূত্রগুলি গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথের শিক্ষা হইতে পাওয়া। মৎস্যেন্দ্রনাথকে অনেকে চুরাশি সিদ্ধাচার্যের অন্যতম লুইপাদের সঙ্গে অভিন্ন বলিয়া মনে করেন। যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে কৌলধর্ম নব বৌদ্ধ গুহ্য সাধনবাদ হইতেই উদ্ভূত, এ-কথা অস্বীকার করা যায় না। তাহা ছাড়া পূর্বেই দেখিয়াছি, কুল বৌদ্ধ গুহ্য সাধনপন্থার একটি বিশেষ অঙ্গ; পঞ্চকুল প্রজ্ঞা বা শক্তির পাঁচটি রূপ; তাঁহাদের কর্তা হইতেছেন পঞ্চতথাগত। এই কুলতত্ত্ব যাঁহারা মানিয়া চলেন তাঁহারাই কৌল বা কুলপুত্র। কৌলমার্গীদের মতে কুল হইতেছেন শক্তি, কুলের বিপরীত অকুল হইতেছেন শিব এবং দেহের অভান্তরে যে শক্তি কুণ্ডলাকারে সুপ্ত তিনি হইতেছেন কুলকুণ্ডলিনী। এই কুলকুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করিয়া শিবের সঙ্গে পরিপূর্ণ এক করাই কৌলমার্গীর সাধনা।

কৌলমার্গীরা ব্রাহ্মণ্য বর্ণাশ্রম স্বীকার করিতেন। কিন্তু একই গুহ্য সাধনবাদ হইতে উদ্ভূত নাথধর্ম, অবধৃত ধর্ম ও সহজিয়া ধর্ম বৌদ্ধ সহজযানীদের মতো বর্ণাশ্রমকে একেবারে অস্বীকার করিত। প্রথমোক্ত দুইটি ধর্ম ও সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব পাল-পর্বেই জানা যায়, আর সহজিয়া ধর্মের প্রথম সংবাদ পাওয়া যায় ত্রয়োদশ শতকে রাজা হরিকালদেবের একটি লিপিতে; হরিকালদেবের এক প্রধান রাজপুরুষ পট্টিকেরক নগরে সহজ-ধর্মকর্মে লিপ্ত ছিলেন। এই সব ধর্ম ও সম্প্রদায় কখন কীভাবে উদ্ভূত হইয়াছিল আজ তাহা বলা কঠিন; সূচনায় এই মতবাদের মধ্যে পার্থক্যও কিছু ছিল না। তবে মনে হয় দ্বাদশ শতকের মধ্যেই নিজস্ব মতামত ধ্যান-ধারণা লইয়া প্রত্যেকটি ধর্ম ও সম্প্রদায় নিজস্ব সীমারেখায় বিভক্ত হইয়া গিয়াছিল।

নাথধর্ম

নাথধর্মের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মৎস্যেন্দ্রনাথ। কৌলমার্গীরাও মৎস্যেন্দ্রনাথকে গুরু বলিয়া মানিতেন। মৎস্যেন্দ্রনাথ ও লুইপাদ যদি এক এবং অভিন্ন হন তাহা হইলে নাথধর্মত সিদ্ধাচার্যদেরই প্রবর্তিত ধর্মের অন্যতম। নাথধর্মীদের গুরুদের মধ্যে মীননাথ, গোরক্ষনাথ, চৌরঙ্গীনাথ, জালন্ধরীপাদ প্রভৃতি নাথযোগীরা প্রসিদ্ধ। ত্যাঙ্গুর-গ্রন্থ অনুযায়ী মীননাথ ছিলেন মৎস্যেন্দ্রনাথের পিতা। তাঁহার অন্য নাম বজ্রপাদ ও অচিন্ত্য। মৎস্যেন্দ্রনাথ ছিলেন চন্দ্রদ্বীপের একজন ধীবর। তাঁহার রচিত গ্রন্থাদির মধ্যে পাঁচখানি নেপালে পাওয়া গিয়াছে; তাহারই একখানির নাম কৌলজ্ঞাননির্ণয়। এই গ্রন্থের মতে মৎস্যেন্দ্রনাথ ছিলেন সিদ্ধ’ বা সিদ্ধামৃত সম্প্রদায়ভুক্ত। মৎস্যেন্দ্রনাথের শিষ্য গোরক্ষনাথ ছিলেন ময়নামতীর রাজা গোপীচন্দ্রের (বঙ্গাল-দেশের রাজা গোবিন্দচন্দ্রের?) সমসাময়িক। গোপীচাঁদ বা গোপীচন্দ্রের মাতা সিদ্ধ গোরক্ষনাথের শিষ্যা মদনাবতী বা ময়নামতীর যোগশক্তি সম্বন্ধে নানা কাহিনী আজও বাঙলাদেশে প্রচলিত। ত্যাঙ্গুরে জালন্ধরীপাদকে বলা হইয়াছে আদিনাথ। এই জালন্ধরীপাদই বোধ হয় রাজা গোপীচাদের শুরু হাড়িপা বা হাড়িপাদ : হাড়িপাদ ছিলেন গোরক্ষনাথের শিষ্য। নাথপন্থা যে সূচনায় বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের মতবাদ দ্বারা প্রভাবান্বিত হইয়াছিল, এ-সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নাই। বস্তুত, কোনও কোনও সিদ্ধাচার্যকে নাথপন্থীরা নিজেদের আচার্য বলিয়া স্বীকার করিতেন। নানাপ্রকার যোগে, বিশেষভাবে হঠযোগে, নাথপন্থীদের প্রসিদ্ধি ছিল। মানুষের যত দুঃখ শোক তাহার হেতু এই অপক্ক দেহ; যোগরূপ অগ্নিদ্বারা এই দেহকে পক্ক করিয়া সিদ্ধদেহ বা দিব্যদেহের অধিকারী হইয়া সিদ্ধি বা শিবত্ব বা অমরত্ব লাভ করাই নাথপন্থার উদ্দেশ্য। উত্তর ও পূর্ব-বঙ্গে নাথপন্থীদের মর্যাদা ও প্রতিপত্তি ছিল যথেষ্ট; ব্রাহ্মণ্য তান্ত্রিক শক্তিধর্মের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় ও সমাজিক কারণে নাথধর্ম ও সম্প্রদায় টিকিয়া থাকিতে পারে নাই। ক্রমশ ব্রাহ্মণ সমাজের নিম্নস্তরে কোনও রকমে তাঁহারা নিজের স্থান করিয়া লইতে বাধ্য হইয়াছিলেন। নাথ যোগীদের জাত হইল ‘যুগী’ (!); বৃত্তি হইল কাপড় বোনা এবং নাথপন্থার শেষ চিহ্ন বাঁচিয়া রহিল শুধু নামের পদবীতে বা অন্তানামে!

অবধূত-মার্গ

অবধূত মার্গীদের সাধনপন্থাও সিদ্ধাচার্যদের গুহ্য সাধনা হইতে উদ্ভুত। যে তিনটি প্রধান নাড়ীর উপর সিদ্ধাচার্যদের যোগ-সাধন প্রক্রিয়ার নির্ভর, তাহার প্রধানতমটির নাম অবধূতী, এ-কথা আগেই বলিয়াছি। অবধূত-যোগ এই অবধূতী নাড়ীর গতি প্রকৃতির সম্যক জ্ঞানের উপর নির্ভর করিত। অবধূত-মার্গীরা সকলেই কঠোর সন্ন্যাস-জীবন যাপন করিতেন; এ-বিষয়েও প্রাচীনতর বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের সন্ন্যাসাদর্শের সঙ্গে ইহাদের যোগ ছিল ঘনিষ্ঠ। নিষ্ঠাবান বৌদ্ধ ও জৈন ভিক্ষুদের যে সব ধূতাঙ্গ আচরণ করিবার কথা অবধূতরাও তাহাই করিতেন। এই ধৃত বা ধৃতাঙ্গ আচরণের জন্যও হয়তো তাঁহাদের নামকরণ হইয়াছিল অরধৃত। লোকালয় হইতে দূরে বনের মধ্যে গাছের নীচে তাঁহারা বাস করিতেন, ভিক্ষান্নে জীবনধারণ করিতেন, জীর্ণ চীবর পরিধান করিতেন। জৈনদের ধৃতাচরণের তালিকাও ঠিক এইরূপ; দেবদত্ত ও আজীবিক সম্প্রদায়ের লোকেরাও তাহাই করিতেন। বহু শতাব্দী পর অবধৃত-মার্গীরা আবার এই সব ধৃতসাধন পুনঃপ্রবর্তিত করেন। তাঁহারা বর্ণাশ্রম স্বীকার করিতেন না, শাস্ত্র, তীর্থ কিছুই মানিতেন না। কোনও বস্তুতেই তাঁহাদের কোনও আসক্তি ছিল না; উন্মাদের মতো ছিল তাঁহাদের আচরণ। প্রসিদ্ধ সিদ্ধাচার্য অদ্বয়বজ্রের আর এক নাম অবধূতী-পাদ; নিঃসংশয়ে তিনি অবধৃত-মার্গী ছিলেন। চৈতন্য-সহচর নিত্যানন্দও ছিলেন অবধূত; চৈতন্য ভাগবতে অবধূতদের জীবনাচরণের খুব সুন্দর বর্ণনা আছে।

সহজিয়া ধর্ম

সহজযানের কথা আগেই বলিয়াছি। বলা বাহুল্য, পরবর্তী বাঙলার সহজিয়া-ধর্ম সিদ্ধাচার্যদের সহজযান হইতেই উদ্ভূত। মধ্যযুগীয় বাঙলার সহজিয়া ধর্মের আদি ও শ্রেষ্ঠ কবি ও লেখক হইতেছেন বড় চণ্ডীদাস। তাঁহার শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে বৌদ্ধ সহজযানের মূলসূত্রগুলি ধরিতে পারা কঠিন নয়।

বাউল-মার্গ

প্ররোচন্দ্র বাগচী মহাশয় মনে করেন, বাঙলার বাউলরা নাথধর্মী বা অবধূত-মার্গী বা সহজিয়াদের চেয়ে অনেক বেশি বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের ধ্যান-কল্পনা ও সাধনপন্থা বাঁচাইয়া রাখিয়াছেন। বাঙলাদেশে নাথধর্ম বিলুপ্ত, অবধূতবাদও তাই, আর, বৈষ্ণবধর্ম ও চিন্তার প্রভাবে পড়িয়া সহজিয়াদের ধ্যান-কল্পনা অনেক গিয়াছে বদলাইয়া; কিন্তু বাউলরা কাহারও প্রভাবে পড়েন নাই; শাক্ত প্রকৃতি-পুরুষ কল্পনা বা বৈষ্ণব কৃষ্ণ-রাধা কল্পনা তাঁহাদের নিকট কোনও অর্থই বহন করে না। অথচ, বজ্রযানী সহজযানীদের নাড়ী, শক্তি প্রভৃতি বাউল ধর্মে অপরিহার্য। সহজযানীদের মতো সহজসুখ বা মহাসুখ ইহাদেরও উদ্দেশ্য।

বৌদ্ধ দেবদেবী

বজ্রযানের দেবদেবীর আয়তন বহু বিস্তৃত, এ কথা আগেই বলিয়াছি। নবম হইতে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত বাঙালী সিদ্ধাচার্য ও বৌদ্ধ পণ্ডিতেরা যে অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন তাহার স্বল্পমাত্র অংশই আমাদের কালে আসিয়া পৌঁছিয়াছে। বিশ্লেষণ করিলে দেখা যায়, তাহারা বহু দেবদেবীর স্তুতি ও অর্চনা করিয়া এই সব গ্রন্থাদি রচনা করিয়াছেন। ইহাদের মধ্যে বজ্রসত্ত্ব, হেবজু, হেরুক, মহামায়া, ত্ৰৈলোক্যরশঙ্কর, নীলাম্বরধর-বজ্রপাণি, যমারি, কৃষ্ণমারি, জম্ভল, হয়গ্রীব, সম্বর, নীলাম্বরধর-বজ্রপাণি, চক্রসম্বর, চক্রেশ্বরালী, কালি, মহামায়া, বজ্রযোগিনী, সিদ্ধবজ্রযোগিনী, কুলুকুল্লা, বজ্রভৈরব, বজ্রধর, হেবড্রোদ্ভব, কুরুকুল্লা, সিতাতপত্রা-অপরাজিতা, উষ্ণীষ-বিজয়া প্রভৃতিরাই প্রধান। উল্লিখিত সকল দেবদেবীর মূর্তি-প্রমাণ যেমন বাঙলাদেশে পাওয়া যায় নাই তেমনই আবার এমন অনেক বজ্রযানী দেবাদের প্রতিমা পাওয়া গিয়াছে যাঁহাদের উল্লেখ এই সব গ্রন্থে দেখিতেছি না। যাহা হউক যথার্থ বজ্রযানী দেবদেবীদের কথা বলিবার আগে মহাযানী ও সাধারণভাবে বুদ্ধযানী দুই চারিটি মূর্তি যাহা পাওয়া গিয়াছে তাহাদের কথা বলিয়া লই।

গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর পর্বের বিহারৈলে (রাজশাহী) প্রাপ্ত বুদ্ধমূর্তি এবং মহাস্থানের বলাইধাপ-স্তূপের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে প্রাপ্ত মঞ্জুশ্রী মূর্তির কথা আগেই বলিয়াছি।

এই পর্বের প্রায় সব বৌদ্ধ-প্রতিমাই মহাযান- বজ্রযান তন্ত্রের সন্দেহ নাই; তবে সাধারণ বুদ্ধযানী প্রতিমাও কয়েকটি আবিষ্কৃত হইয়াছে। এই ধরনের প্রতিমার কেন্দ্রে অধিকাংশ স্থান জুড়িয়া শাক্যসিংহ বা বোধিসত্ত্ব গৌতম বা বুদ্ধ ভূমিস্পর্শ বা ধ্যান বা ধর্মচক্র প্রবর্তন মুদ্রায় উপবিষ্ট; এবং তাঁহার চারিদিক ঘিরিয়া বুদ্ধায়নের (অর্থাৎ বুদ্ধের জীবনের) প্রধান প্রধান কয়েকটি কাহিনীর প্রতিকৃতি রূপায়িত। খুলনা জেলার শিববাটি গ্রামে ভূমি স্পর্শমুদ্রায় উপবিষ্ট একটি বুদ্ধমূর্তি আজও শিবের নামে পূজা পাইতেছেন। ভূমিস্পর্শ মূদ্রা বুদ্ধগয়ায় বোধিদ্রুমের নীচে বজ্রাসনে বসিয়া ধ্যানরত বুদ্ধের উপর মার-সৈন্যের আক্রমণ, বুদ্ধদেব কর্তৃক পৃথিবী মাতাকে সাক্ষীরূপে আহ্বান এবং বোধিলাভের দ্যোতক। বোধিলাভের এই ঘটনাটি ছাড়া মূর্তিটির প্রভাবলীর উপর সিদ্ধার্থ বোধিসত্ত্বের জন্ম, ধর্মচক্রমুদ্রায় ধর্মচক্র প্রবর্তন, মহাপরিনির্বাণ, রাজগৃহে অভয় মুদ্রায় নালগিরি বা রত্নপাল নামীয় হস্তীর বশীকরণ, শাংকাস্য নামক স্থানে বরদ-মুদ্রায় ত্রয়স্ত্রিংশ-স্বর্গ হইতে অবতরণ, ব্যাখ্যান-মুদ্রায় শ্রাবন্তীতে অলৌকিক সংঘটন এবং বৈশালীতে বানর কর্তৃক মধু অর্ঘ্যদান, এই সাতটি ঘটনার প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ।

এই ধরনের বুদ্ধায়ন-স্তবক সম্বলিত প্রতিমা বাঙলাদেশে পাওয়া যায় নাই। সদ্যোক্ত কাহিনীগুলি ছাড়া আরও কয়েকটি কাহিনীর স্বতন্ত্র, বিচ্ছিন্ন প্রতিকৃতি সম্বলিত বুদ্ধায়নী প্রতিমাও বাঙলাদেশে পাওয়া গিয়াছে; কিন্তু প্রাচীন বাঙলায় এই ধরনের মূর্তির প্রচলন খুব বেশি ছিল বলিয়া মনে হয় না। যতগুলি বুদ্ধমূর্তি বাঙলায় পাওয়া গিয়াছে তাহার মধ্যে অভয়, ব্যাখ্যান, ভূমিস্পর্শ ও ধর্মচক্র-মুদ্রায় উপবিষ্ট প্রতিমাই বেশি। ফরিদপুর জেলার উজানী গ্রামে প্রাপ্ত (ঢাকা-চিত্রশালা) একাদশ শতকীয় একটি ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় উপবিষ্ট বুদ্ধ-প্রতিমার পাদপীঠে বজ্র ও সপ্তরত্ন উৎকীর্ণ দেখিতে পাওয়া যায়; এই দুইটি লক্ষণই যেন গভীর অর্থবহ।

মহাযানী দেবায়তন আদিবুদ্ধ ও তাঁহার শক্তি (?) আদিপ্রজ্ঞা বা প্রজ্ঞাপারমিতার ধ্যান-কল্পনার উপর প্রতিষ্ঠিত। বৈরোচন, অক্ষোভ্য, রত্নসম্ভার, অমিতাভ এবং অমোঘসিদ্ধি এই পাঁচটি ধ্যানীবুদ্ধ বা পঞ্চ তথাগত এবং ষষ্ঠ আর একটি দেবতা বজ্রসত্ত্ব এই আদিবুদ্ধ ও আদিপ্রজ্ঞা হইতে উদ্ভূত। ধ্যানীবুদ্ধরা সকলেই যোগরত; কিন্তু তাঁহাদের প্রত্যেকেরই এক এক জন সক্রিয় বোধিসত্ত্ব এবং এক একজন মানুষীবুদ্ধ বিরাজমান। মহাযানীদের মতে বর্তমান কাল ধ্যানীবুদ্ধ অমিতাভের কাল; তাঁহার বোধিসত্ত্ব হইতেছেন অবলোকিতেশ্বর লোকনাথ এবং মানুষীবুদ্ধ হইতেছেন বুদ্ধ গৌতম। অবলোকিতেশ্বর ছাড়া মহাযান দেবায়তনে পঞ্চ বোধিসত্ত্বের মধ্যে আরও দুইটি বোধিসত্ত্বের মঞ্জুশ্রী এবং মৈত্রেয়ের প্রতিপত্তি প্রবল। তাঁহাদের প্রত্যেকের এক একটি শক্তি; এই শক্তিময়ীরা সকলেই তারা নামে খ্যাতা এবং তাঁহাদের প্রত্যেকেরই দেশকালপ্রভেদে বিভিন্ন রূপ ও প্রকৃতি। বোধিসত্ত্বদের সম্বন্ধেও একই উক্তি প্রযোজ্য; বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন তাহাদের নাম।

ধ্যানীবুদ্ধদের দুই একটি মূর্তি বাঙলাদেশে পাওয়া গিয়াছে। ধ্যানীবুদ্ধ রত্নসম্ভবের একটি মূর্তি পাওয়া গিয়াছে বিক্রমপুরে, এখন তাহা রাজশাহী-চিত্রশালায়। ঢাকা জেলার সুখবাসপুর গ্রামে একটি লিপি-উৎকীর্ণ দশম শতকীয় বজ্রধারী বজ্রসত্ত্ব মূর্তি পাওয়া গিয়াছে। দুইটি প্রতিমাই উল্লেখযোগ্য। প্রাচীন ধ্যানীবুদ্ধের প্রতিমা খুব সহজলভ্য নয়। আদিবুদ্ধের কোনো প্রতিমাও এ-পর্যন্ত পাওয়া যায় নাই, কিন্তু দুই একটি প্রতিমা পাওয়া গিয়াছে যাহাদের আদিপ্রজ্ঞা বা প্রজ্ঞাপারমিতার প্রতিমা বলা যাইতে পারে; একটি ঢাকা-চিত্রশালায় ও আর একটি রাজশাহী-চিত্রশালায় রক্ষিত। ধর্মত্রীপাল নামক এক ভিক্ষু বনবাসী (কর্ণাট দেশ) হইতে উত্তরবঙ্গে আসিয়া একটি প্রজ্ঞাপারমিতার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন; এই মূর্তিটি এখন কলিকাতা চিত্রশালায়।

বাঙলাদেশে যত মহাযানী-বজ্রযানী মূর্তি পাওয়া গিয়াছে তাহাদের মধ্যে নানা রূপের অবলোকিতেশ্বর লোকনাথের প্রতিমাই সবচেয়ে বেশি। প্রতিমা প্রমাণ হইতে মনে হয়, বৌদ্ধ বাঙালীর তিনিই ছিলেন সবচেয়ে প্রিয় দেবতা। ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরের এবং সূর্যের রূপ ও গুণ লইয়া বৌদ্ধ অবলোকিতেশ্বর লোকনাথ এবং তাহার বিচিত্র রূপ ও গুণাবলী লইয়া অসংখ্য, বিচিত্র তাঁহার প্রতিমারূপ। কিন্তু বাঙলাদেশে তাঁহার যত রূপ দেখিতেছি তাহার মধ্যে পদ্মপাণি, সিংহনাদ, যড়ক্ষরী ও খসর্পণ রূপই প্রধান। আসন ও স্থানক দুই রকমের পদ্মপাণি-মূর্তিই গোচর। চট্টগ্রামের একটি লিপিযুক্ত ধাতব আসন-পদ্মপাণি প্রতিমা, পাহাড়পুর-মন্দিরের একাধিক প্রতিমা, বোস্টন-চিত্রশালার ললিতাসনোপবিষ্ট একটি প্রতিমা, রাজশাহী-চিত্রশালার তিন-চারিটি প্রতিমা এবং কলিকাতা আলিপুরে প্রাপ্ত একটি প্রতিমা এ-প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।

কুষ্ঠব্যাধির আরোগ্যকর্তা সিংহনাদ-লোকেশ্বরের দুইটি মূর্তি আছে রাজশাহী-চিত্রশালায়; একটি মূর্তি পাওয়া গিয়াছিল বীরভূম জেলায়। ঢাকা এবং কলিকাতা-চিত্রশালায়ও দুই একটি করিয়া সিংহনাদ-অবলোকিতেশ্বরের প্রতিমা বিদ্যমান। খসর্পণ-লোকনাথের, আনুমানিক একাদশ শতকীয়, সবচেয়ে সুন্দর একটি প্রতিমা পাওয়া গিয়াছে ঢাকা জেলার মহাকালী গ্রামে। সপ্তরথ পাদপীঠের উপর ললিতাসনোপবিষ্ট সনালপদ্মধৃত সপরিবার এই দেব-প্রতিমাটি পাল-শিল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। ঢাকা, ত্রিপুরা ও রাজশাহী অঞ্চল হইতে এই দেবতার আরও কয়েকটি মূর্তি পাওয়া গিয়াছে। খসপর্ণ-লোকনাথের আদি রূপ-কল্পনা না হোক, অন্তত খসর্পণ- লোকনাথ এই নামকরণটি বোধ হয় হইয়াছিল দক্ষিণবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার খসর্পণ- নামক স্থান হইতে; অথবা এমন হইতে পারে যে, খসম্পূর্ণ লোকনাথের পূজার সমধিক প্রচলন এই স্থানে ছিল বলিয়াই স্থানটির নাম হইয়াছিল খসর্পণ। মালদহ জেলার রাণীপুর গ্রামে একটি একাদশ শতকীয় ষড়ক্ষরী লোকেশ্বরের মূর্তি পাওয়া গিয়াছে, কিন্তু এ ধরনের মূর্তি অত্যন্ত বিরল। রাজশাহী-চিত্রশালায় আর একটি বিরলরূপ অবলোকিতেশ্বরের মূর্তি রক্ষিত আছে; মূর্তিতাত্ত্বিকেরা মনে করেন এই রূপটি সুগতিসন্দর্শনরূপী অবলোকিতেশ্বরের। দ্বাদশভুজ লোকনাথ অবলোকিতেশ্বরের আসন ও স্থানক উভয় রূপের প্রতিমার একাধিক দৃষ্টান্ত বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষদ ও রাজশাহী-চিত্রশালায় রক্ষিত আছে। মুর্শিদাবাদ জেলার ঘিয়াসবাদে প্রাপ্ত (কলিকাতা-চিত্রশালা) একটি প্রতিমা, রাজশাহী-চিত্রশালায় রক্ষিত একটি প্রতিমা এবং ঢাকা জেলার সোনারঙ্গে প্রাপ্ত আর একটি প্রতিমা এই অবলোকিতেশ্বর-প্রসঙ্গে আলোচা। ঘিয়াসবাদের মূর্তিটি বিস্তৃত এক সর্পফনাছত্রের নীচে নযপদস্থানক ভঙ্গিতে দণ্ডায়মান এবং তাঁহার দ্বাদশ হস্তের সাতটিতে গরুড়, মূষিক, লাঙ্গল, শঙ্খ, পুস্তক, বৃষ এবং পাত্র লক্ষণ; ইহাদের প্রত্যেকটিই সনাল নীলোৎপলের উপর স্থাপিত মূর্তিটির কণ্ঠে জানু পর্যন্ত লম্বিত বৈজয়ন্তী বা বনমালা। অন্য দুইটি হাত বিষ্ণুর আয়ুধপুরুষের মতো দুইটি মূর্তির উপর স্থাপিত। রাজশাহী-চিত্রশালার মূর্তিটি প্রায় অবিকল এইরূপ, অধিকন্তু ইহার পাদপীঠে অবলোকিতেশ্বরের অনুচর প্রেত সূচীমুখের মূর্তি উৎকীর্ণ। সোনারঙ্গে প্রাপ্ত মূর্তিটিও একই লক্ষণযুক্ত এবং একই প্রকারের; এ-ক্ষেত্রে প্রভাবলীর উপরের অংশটি অক্ষত থাকায় সেখানে দেখিতেছি বোধিসত্ত্ব অমিতাভের মূর্তি উৎকীর্ণ। সন্দেহ নাই যে, এই তিনটি প্রতিমাই অবলোকিতিশ্বরের বিশিষ্ট এক রূপ। দিনাজপুর জেলার সাগরদীঘি গ্রামে প্রাপ্ত ছয়হাতযুক্ত একটি মূর্তিও (বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ-চিত্রশালা) তাহাই। সঙ্গে সঙ্গে এ তথ্যও অনস্বীকার্য যে, এই প্রত্যেকটি মূর্তিতেই ব্রাহ্মণ্য দেবতা বিষ্ণুর ধ্যান-কল্পনাও সক্রিয় কয়েকটি লক্ষণই স্থানক বিষ্ণুমূর্তির লক্ষণ। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় বলেন, এই প্রতিমাগুলিতে ভাগবত বিষ্ণুমূর্তির সঙ্গে মহাযানী লোকেশ্বরের ধ্যান-কল্পনার একটা সমন্বয়ের চেষ্টা করা হইয়াছে।

অবলোকিতশ্বরের পরই যে-রোধিসত্ত্ব বাঙালীর প্রিয় ছিলেন তিনি ধ্যানীবৃদ্ধ অক্ষোভ্যের অধ্যাত্মপুত্র, জ্ঞান-বিদ্যা-বুদ্ধি-প্রতিভার দেবতা বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রী। মঞ্জুশ্রীরও বিচিত্র রূপ। গর্জমান সিংহের উপর ললিতাসনোপবিষ্ট তাঁহার মঞ্জুবর রূপের কয়েকটি প্রতিমা পাওয়া গিয়াছে; তাঁহাদের মধ্যে রাজশাহী-চিত্রশালার একটি প্রতিমা অতি সুদর্শন। নাগধৃতপদ্মের উপর বজ্রপর্যঙ্কাসনে উপবিষ্ট অরপচন মঞ্জুশ্রীর একটি মূর্তি পাওয়া গিয়াছে ঢাকা জেলার জালকুণ্ডি গ্রামে (ঢাকা-চিত্রশালা)। মালদহ জেলার প্রাপ্ত, অধুনা বঙ্গীয় সাহিত্য-পরিষৎ চিত্রশালায় রক্ষিত স্থিরচক্র-মঞ্জুশ্রীর একটি মূর্তিও উল্লেখযোগ্য। যে কোনো রূপের মঞ্জুশ্রী-প্রতিমায় প্রধান লক্ষণ হস্তধৃত পুস্তক ও তরবারী। শক্তি ও বৃষ্টির দেবতা বজ্রপাণির মূর্তি বাঙলাদেশে একটিও এ-যাবৎ পাওয়া যায় নাই, ত্রিপুরা জেলার শুভপুরে প্রাপ্ত মাত্র একটি মূর্তি-প্রমাণ ছাড়া। বোধিসত্ত্ব মৈত্রেয়ের মূর্তি পাওয়া যায় নাই বলিলেই চলে।

মহাযান-বজ্রযানের আরও যে কয়েকটি নিম্নস্তরের দেবতা বাঙলাদেশে খুব জনপ্রিয়তা লাভ করিয়াছিলেন তাঁহাদের মধ্যে জন্তুল, হেরুক ও হেবজ্রই প্রধান। জণ্ডল ধ্যানীবুদ্ধ রত্নসম্ভবের সঙ্গে যুক্ত, হেরুক অক্ষোভ্য হইতে উদ্ভূত এবং হেবজ্র স্পষ্টতই তান্ত্রিক বৌদ্ধ দেবতা। জন্তল ব্রাহ্মণ্য কুবেরের বৌদ্ধ প্রতিরূপ এবং তাঁহার প্রতিমা বাঙলাদেশের, বিশেষত পূর্ব ও উত্তর-বাঙলার, নানা জায়গা হইতেই আবিষ্কৃত হইয়াছে। ধন ও ঐশ্বর্যের এই দেবতা যে জনসাধারণের খুব প্রিয় ছিলেন, অসংখ্য মূর্তি-প্রমাণেই তাহা সুস্পষ্ট। জম্ভলের দক্ষিণ হস্তে বীজপূরক, বাম হস্তে ধনরত্ন উদ্‌গীরণরত একটি নকুলের গ্রীবাদেশ। জন্তলের তুলনায় হেরুকের মূর্তি কিন্তু কমই পাওয়া গিয়াছে। ত্রিপুরা জেলার বড়কামতায় প্রাপ্ত, মুণ্ডমালা-পরিহিত, বজ্রকপালধৃত, নৃত্যপরায়ণ হেরুক মূর্তিটি সুপরিচিত। উত্তর-বাঙলায় প্রাপ্ত (কলিকাতা-চিত্রশালা) একটি হেরুক মূর্তির বিচিত্র লক্ষণ হইতে মূর্তিতাত্ত্বিকেরা অনুমান করেন, মূর্তিটি সম্বররূপী হেরুক। শক্তির দৃঢ়ালিঙ্গনবদ্ধ হেবজ্রের মূর্তি একাধিক পাওয়া গিয়াছে। পাহাড়পুরে প্রাপ্ত একটি ও মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রাপ্ত আর একটি মূর্তি এই ধরনের হেবজ্রের সুন্দর নিদর্শন। শক্তি-বিরহিত হেবজ্রের একটি মূর্তি পাওয়া গিয়াছে ত্রিপুরা জেলার ধর্মনগরে। বজ্রযানী কৃষ্ণ-যমারীর একটি প্রতিমা রাজশাহী-চিত্রশালায় (বিক্রমপুরে প্রাপ্ত) রক্ষিত। ত্রিমুখ, চতুর্ভুজ, করালদর্শন ত্রৈলোক্যবশঙ্করের অন্তত একটি মূর্তি বাঙলাদেশে পাওয়া গিয়াছে ঢাকা জেলার পশ্চিমপাড়া গ্রামে (রাজশাহী-চিত্রশালায় )। মূর্তিটি দেখিলে স্বতই মনে হয়, বৌদ্ধ ত্রৈলোক্যবশঙ্কর এবং ব্রাহ্মণ্য ভৈরব একই ধ্যান-কল্পনার সৃষ্টি।

দেবতাদের কথা শেষ হইল; এইবার মহাযান -বজ্রযান আয়তনের দেবীদের কথা বলা যাইতে পারে। এই দেবীদের মধ্যে তারা সর্বশ্রেষ্ঠা। তারার অনেক রূপভেদ : বিভিন্নরূপ বিভিন্ন ধ্যানীবুদ্ধ হইতে উৎপন্ন। বাঙলাদেশে যত প্রকারের তারামূর্তি আবিষ্কৃত হইয়াছে তাহার মধ্যে খদিরবনী-তারা (খয়ের বনের তারা?) বজ্র-তারা এবং ভুকুটী-তারাই প্রধান। খদিরবনী-তারার অপর নাম শ্যাম-তারা; তাঁহার ধ্যানীবুদ্ধ হইতেছেন অমোঘসিদ্ধি; বজ্র-তারার ধ্যানীবুদ্ধ রত্নসম্ভব এবং ভূকুটী-তারার, অমিতাভ। অশোককাত্তা (মারীচী) ও একজটাসহ খদিরবনী বা শ্যাম-তারার মূর্তিই সবচেয়ে বেশি পাওয়া গিয়াছে। নীলোৎপলধৃতা এই দেবী কখনও উপবিষ্টা, কখনও দণ্ডায়মানা। ঢাকা জেলার সোমপাড়া গ্রামে প্রাপ্ত (ঢাকা-চিত্রশালা) একটি মূর্তি, বগুড়া জেলার গুণীগ্রামে প্রাপ্ত অপর একটি মূর্তি (রাজশাহী-চিত্রশালা) এবং ঢাকা-চিত্রশালার আরও একটি শ্যামতারা-প্রতিমা এই প্রতিমার নিদর্শন। ফরিদপুর জেলার মাঝবাড়ী গ্রামে একটি ধাতব বজ্র-তারার মূর্তি পাওয়া গিয়াছে (ঢাকা-চিত্রশালা)। ঢাকা জেলার ভবানীপুর গ্রামে ত্রি-শির, অষ্টহস্ত, বীরাসনোপবিষ্ট, পাদপীঠে গণেশের মূর্তি উৎকীর্ণ এবং মৌলিতে অমিতাভ মূর্তিযুক্ত একটি দেবীমূর্তি পাওয়া গিয়াছে। ভট্টশালী-মহাশয় বলিয়াছেন, প্রতিমাটি ভূকুটী-তারার। কিন্তু এই প্রতিমাটির সঙ্গে ঢাকা-চিত্রশালার আর একটি প্রতিমার সম্বন্ধ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় বলেন, শেষোক্ত প্রতিমাটি পঞ্চরক্ষামণ্ডলভুক্ত দেবী মহাপ্রতিসরার। প্রথমোক্ত প্রতিমাটির বাম দিকে ঝাঁটা ও কুলা হস্তে যে দেবীটি দাঁড়াইয়া আছেন তিনি তো একটি গ্রাম্য দেবী (বোধ হয় শীতলা বলিয়াই মনে হইতেছে)। ত্রিপুরা জেলায় প্রাপ্ত (ঢাকা চিত্রশালা) একটি অষ্টভুজা বজ্রযানী দেবী-প্রতিমাকে সিতাতপত্রা বা সিততারা বলিয়া অনুমান করা হইয়াছে। অষ্টভূজা সিতাতপত্রার একটি ধাতব মূর্তি ঢাকা-চিত্রশালায়ও আছে। পাহাড়পুরে প্রাপ্ত একটি মাটির ফলকে উৎকীর্ণ অষ্টভুজা একটি তারা-প্রতিমা, বগুড়ায় প্রাপ্ত (রাজশাহী-চিত্রশালা) একটি ধাতব তারা প্রতিমা (সপ্তম-অষ্টম শতক) এবং দিনাজপুর জেলার অগ্রদিগুণে প্রাপ্ত (আশুতোষ-চিত্রশালা) একাদশ শতকীয় আর একটি প্রতিমা এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।

বজ্রযানী অন্যান্য দেবী মূর্তির মধ্যে মারীচী, পূর্ণশবরী, হারীতী এবং চুঙাই প্রধান। ধ্যানীবুদ্ধ বৈরোচন-সম্ভূত মারীচীর কয়েকটি প্রতিমা বাঙলাদেশে পাওয়া গিয়াছে। ত্রিমুখ (বাম মুখ শঙ্করীর), সপ্তশূকরবাহিত এবং রাহুসারথি, রথে প্রত্যালীঢ়ভঙ্গিতে দণ্ডায়মানা এই দেবীটি ব্রাহ্মণ্য সূর্যেরই বৌদ্ধ প্রতিরূপ। ফরিদপুরের উজানী গ্রামে প্রাপ্ত (ঢাকা-চিত্রশালা) মারীচী প্রতিমাটি এই ধরনের মূর্তি এবং পালোত্তরপর্বের ভাস্কর শিল্পের সুন্দর নিদর্শন। পর্ণশবরী তাহার অন্যতম অনুচর। ইঁহার কথা অধ্যায়ারম্ভে বিশদভাবে বলিয়াছি। পর্ণশবরীর ধ্যানীবুদ্ধ বোধ হয় অমোঘসিদ্ধি। ঢাকা জেলার বিক্রমপুরে দুইটি ত্রি-শির, ষড়ভুজা, পর্ণাচ্ছাদন-পরিহিতা। পর্ণশবরী প্রতিমা পাওয়া গিয়াছে। ধ্যানে তাঁহাকে বলা হইয়াছে ‘পিশাচী। রাজশাহী জেলার নিয়ামতপুরে অষ্টাদশভুজা চুণ্ডা দেবীর একটি নবম শতকীয় প্রতিমা আবিষ্কৃত হইয়াছে (রাজশাহী-চিত্রশালা)। ত্রিপুরা জেলার পট্টিকেরক রাজ্যে চুণ্ডাবর ভবনে যে একটি ষোড়শভুজা চুণ্ডা-দেবী প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, তাহার প্রমাণ বিদ্যমান। বজ্রযানী দেবী উষ্ণীষ-বিজয়ার একটি ভগ্ন মূর্তি পাওয়া গিয়াছে বীরভূম জেলায়। হারীতী জম্ভলের শক্তি, তিনি ধনৈশ্বর্যের দেবী এবং ব্রাহ্মণ্য ষষ্ঠীর বৌদ্ধ প্রতিরূপ। ঢাকা ও রাজশাহী-চিত্রশালায় চার পাঁচটি হারীতীর প্রতিমা রক্ষিত আছে।

এই সব অসংখ্য মহাযানী দেবদেবীর পূজার্চনার জন্য মন্দিরও অবশ্যই অসংখ্য রচিত হইয়াছিল বাঙলার নানা জায়গায়। বিভিন্ন বিহারগুলির সঙ্গে সঙ্গেও মন্দির নিশ্চয়ই প্রতিষ্ঠিত হইয়া থাকিবে। কিন্তু বাঙলার কোন্ প্রান্তে কোথায় কোন্ দেবদেবীর মন্দির ছিল, কোথায় কে পূজা পাইতেন, আজ আর তাহা বলিবার উপায় নাই। তবে, একাদশ শতকের অষ্টসাহসিকা প্রজ্ঞাপারমিতার একটি পাণ্ডুলিপিতে বাঙলাদেশের কয়েকটি মহাযানী বজ্রযানী বৌদ্ধ মন্দিরের এবং কোন্ মন্দিরে কাহার পূজা হইত তাহার একটু ইঙ্গিত আছে। তাহা হইতে বুঝা যায়, চন্দ্রদ্বীপে (নিম্নবঙ্গের খুলনা-বরিশাল অঞ্চলে) ভগবতী-তারার একটি মন্দির, সমতটে লোকনাথের দুইটি এবং বুদ্ধধি-তারার একটি পট্টিকেরক রাজ্যে চুণ্ডাবর ভবনে চুণ্ডা-দেবীর একটি এবং হরিকেলদেশে লোকনাথের একটি মন্দির ছিল।

এ-পর্যন্ত যত মূর্তি ও মন্দির ইত্যাদির কথা বলিলাম সেগুলির প্রাপ্তিস্থান ইত্যাদি বিশ্লেষণ করিলে দেখা যাইবে, উত্তর ও পূর্ব-বাঙলা (গঙ্গার পূর্বতীর হইতে), বিশেষভাবে রাজশাহী-দিনাজপুর-বগুড়া জেলায় এবং ফরিদপুর-ঢাকা-ত্রিপুরা জেলায় যত মূর্তি পাওয়া গিয়াছে বাঙলার অন্যত্র কোথাও তেমন নয়। গঙ্গার পশ্চিম তীরে বজ্রযানী-তন্ত্রের প্রতিমা পাওয়া প্রায় যায় নাই বলিলেই চলে, এক

বাঁকুড়া-বীরভূমের কিয়দংশ ছাড়া। মনে হয়, মহাযান-বজ্রযান তন্ত্রের প্রসার ও প্রতিপত্তি উত্তর ও পূর্ব-বাঙলায় যতটা ছিল ভাগীরথীর পশ্চিমে ততটা ছিল না, দক্ষিণ-রাঢ়ে তো নয়ই। প্রায় দশম শতক হইতেই নালন্দার প্রতিপত্তি ও সমৃদ্ধি হ্রাস পাইতে থাকে এবং বিক্রমশীল-সোমপুর প্রভৃতি তাহার স্থান অধিকার করে। বিক্রমশীল-বিহার এবং ফুল্লহরি-বিহার বাঙলাদেশে না হওয়াই সম্ভব। কিন্তু সোমপুর, জগদ্দল এবং দেবীকোট বিহার ছিল নিঃসংশয়ে উত্তরবঙ্গে; পণ্ডিত-বিহার, পট্টিকেরক-বিহার ও বিক্রমপুরী-বিহার নিঃসংশয়ে পূর্ববঙ্গে। রাঢ়দেশের একটি মাত্র বিহারের নাম পাইতেছি, ত্রৈকূটক বিহার, কিন্তু তাহাও নিঃসংশয়ে রাঢ়দেশে কিনা বলা যায় না। সিদ্ধাচার্যদের জন্মস্থান ও আদি পরিবেশ বিশ্লেষণ করিলেও দেখা যায়, তাঁহারা অধিকাংশই উত্তর ও পূর্ববঙ্গের লোক। অথচ, গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর পর্ব হইতে আরম্ভ করিয়া উত্তর ও দক্ষিণ-রাঢ়ে সর্বত্রই ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর প্রতিমা মিলিতেছে প্রচুর। মনে হয়, এক বাঁকুড়া-বীরভূমের কিয়দংশ ছাড়া রাঢ়ের অন্যত্র বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব-প্রতিপত্তি তেমন ছিল না। এই তথ্য সমসাময়িক ও মধ্যযুগীয় বাঙলার ইতিহাস ও সংস্কৃতির দিক হইতে গভীর অর্থবহ। ইহাও লক্ষণীয় যে, বাঁকুড়া-বীরভূমের যে অংশে মহাযান-বজ্রযান সক্রিয় সেই অংশেই পরবর্তীকালে বৈষ্ণব সহজিয়া এবং তান্ত্রিক শক্তিধর্মের প্রসার, প্রভাব ও প্রতিপত্তি।

লিপি-প্রমাণ ও শৈলী-প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া বৌদ্ধ প্রতিমাগুলির তারিখ বিশ্লেষণ করিলে দেখা যায়, পাল-পূর্ব যুগের বৌদ্ধ মূর্তি খুব বেশি পাওয়া যায় নাই; যত মূর্তি পাওয়া গিয়াছে তাহার অধিকাংশই—দুই চারিটি বিক্ষিপ্ত মূর্তি ছাড়া মোটামুটি নবম হইতে একাদশ শতকের এবং এই তিনশত বৎসরই বাঙলায় বৌদ্ধধর্মের সুবর্ণযুগ। কিন্তু সংখ্যায় ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর প্রতিমার সঙ্গে বৌদ্ধ দেবদেবীর প্রতিমার তুলনাই চলিতে পারে না, এবং এই ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর মধ্যে আবার বিষ্ণু ও সৌর দেবায়তনের মূর্তিই বেশি। মহাযানী বজ্রযানী দেবদেবীর যে-পরিচয় মূর্তি প্রমাণের সাহায্যে পাওয়া যায় সে তুলনায় সমসাময়িক সিদ্ধাচার্য ও বৌদ্ধ পণ্ডিতদের রচিত গ্রন্থমালায় উল্লিখিত দেবদেবীর পরিচয় অনেক বেশি বিস্তৃত। এমন অনেক দেবদেবীর পরিচয় সেখানে পাওয়া যায় যাঁহাদের একটি প্রতিমা-প্রমাণও বাঙলাদেশে আবিষ্কৃত হয় নাই। তাহার কারণ হয়তো এই যে, বজ্রযানীদের সাধনপন্থা ছিল গুহা এবং সেই গুহ্যসাধনার ধ্যান-কল্পনায় যে মূর্তি-মণ্ডল রচিত হইত তাঁহাদের সকলেরই মূর্তিরূপ প্রতিমায় রূপায়িত করা প্রয়োজন হইত না। বেশ কিছু রচিত হইত চিত্রে, অর্থাৎ রঙ ও রেখায়। সেগুলির উল্লেখ এখানে করিতেছি না।

এইমাত্র বলিয়াছি, ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর সংখ্যা ছিল এই পর্বে বৌদ্ধ প্রতিমার চেয়ে অনেক বেশি। কিন্তু ধর্মগত ধ্যান-কল্পনায় বোধ হয় মহাযানী বজ্রযানী প্রভাবই ছিল অধিকতর সক্রিয়, এবং তাহার কারণ বোধ হয় মহাযান-বজ্রযানের সাধন-দর্শন। এই সাধন-দর্শন সমসাময়িক ও পরবর্তী ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে বৈষ্ণব ও শৈব, উভয় ধর্মকেই—গভীরভাবে স্পর্শ করিয়াছিল।

জৈনধর্ম

য়ুয়ান্-চোয়াঙের পর বাঙলায় জৈন বা নির্গ্রন্থ ধর্মের অবস্থা জানিবার ও বুঝিবার মতো কোনও গ্রন্থ-প্রমাণ বা লিপি-প্রমাণ কিছু উপস্থিত নাই। তবে গুপ্তোত্তর মূর্তি-প্রমাণ কিছু আছে এবং তাহা সমস্তই পাল ও সেন-পর্বের। য়ুয়ান্-চোয়াঙের পর হইতেই নির্গ্রন্থ ধর্ম যে বাঙলাদেশ হইতে বিলুপ্ত হইয়া যায় নাই, এই জৈন-প্রতিমাগুলিই তাহার প্রমাণ। গত কয়েক বৎসরের মধ্যে এক সুন্দরবন অঞ্চল হইতেই প্রায় দশ-বারোটি জৈন মূর্তি পাওয়া গিয়াছে; বাঁকুড়া, বীরভূম ও পুরুলিয়া অঞ্চল হইতেও কিছু জৈন মূর্তি আবিষ্কৃত হইয়াছে। মূর্তিগ

। সাধারণত ঋষভনাথ, আদিনাথ, নেমিনাথ শান্তিনাথ এবং পার্শ্বনাথের পার্শ্বনাথের প্রতিমাই সকলের চেয়ে বেশি। মূর্তিগুলি প্রায় সমস্তই দিগম্বর জৈন সম্প্রদায়ের। ইহাদের মধ্যে দিনাজপুর জেলার সুরাহার গ্রামে প্রাপ্ত ঋষভনাথের মূর্তিটি এই ধরনের মূর্তির প্রতিনিধি বলিয়া ধরা যাইতে পারে। মূর্তিটি ধ্যানাসনে উপবিষ্ট, বৃক্ষ-লাঞ্ছনটি বিদ্যমান এবং ২৪ জন জৈন তীর্থংকর ঋষভনাথকে শ্রদ্ধা-নিবেদনের জন্য উপস্থিত। বসন্তবিলাস গ্রন্থের দশম সর্গে দেখিতেছি, চালুক্যরাজ বীরবলের মন্ত্রী বস্তুপাল (১২১৯ – ১২৩৩ খ্রী) যখন একবার জৈন তীর্থ-পরিক্রমায় বাহির হন তখন তাঁহার সঙ্গে গিয়াছিলেন লাট, গৌড়, মরু, ধারা, অবস্তি এবং বঙ্গের সংঘপতিগণ। মনে হয়, ত্রয়োদশ-দ্বাদশ শতকেও গৌড়ে, বঙ্গে এবং পশ্চিম রাঢ়ে নির্গ্রন্থ সংঘের কিছু অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। তবে, পাল-পর্বেই তাঁহাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি হ্রাস পাইতেছিল; স্বল্পসংখ্যক মূর্তিই তাহার প্ৰমাণ।

মহাযানী বৌদ্ধ ধর্মের দীর্ঘ ও গভীর রূপান্তর বর্ণনা-প্রসঙ্গে সহজযান ধর্ম এবং মহাযানী সিদ্ধাচার্যদের মতামত কিছু কিছু উল্লেখ করিয়াছি। কিন্তু ইহাদের সম্বন্ধে একটু বিশদতর ভাবে বলা প্রয়োজন, কারণ ইহাদের ধর্মগত ভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির মানবিক আবেদনের সঙ্গে মধ্যযুগীয় বাঙলা ও ভারতবর্ষের সংস্কৃতির অন্তত একটি ধারার আত্মীয়তা অত্যন্ত গভীর সেইজন্য পৃথকভাবে ইহাদের কথা আবার বলিতেছি।

প্রাচীন বাঙলার কায়াসাধন : সহজযান

একাদশ-দ্বাদশ শতকের সহজযানী সাহিত্যে, অর্থাৎ চর্যাগীতি ও দোহাকোষের অনেক গান ও শ্লোকে সমসাময়িক অন্যান্য ধর্মমত ও পথ সম্বন্ধে খবরাখবর যেমন পাওয়া যায়, তেমনই সিদ্ধাচার্যদের স্বকীয় ধর্মমত সম্বন্ধে পাঠকের ধারণাও স্পষ্টতর হয়। আগেই বলিয়াছি, ইহারা বেদ-বিরোধী ছিলেন, কিন্তু তাঁহারা যে বেদ-আগমের কথা বলিয়াছেন তাহা শুধু বেদ বা আগম মাত্র নয়, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রামাণিক শাস্ত্র মাত্রই ইহাদের দৃষ্টিতে বেদ, আগম প্রভৃতি। বাঙলাদেশে যে যথার্থ বেদচর্চা, বৈদিক অনুষ্ঠান প্রভৃতি খুব বেশি প্রচলিত ছিল না সে-কথা খুব বিশদভাবে বলিবার প্রয়োজন নাই। সেন-বর্মণ আমলে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রসার যখন খুব বেশি, তখনও হলায়ুধ, জীমূতবাহন প্রভৃতি স্মৃতিকারেরা বেদচর্চার অবহেলা দেখিয়া দুঃখ প্রকাশ করিয়াছেন; সে-কথা পরে বলিবার সুযোগ হইবে, আগেও বলিয়াছি অন্য প্রসঙ্গে। তবু, উচ্চকোটির বর্ণ-হিন্দুরা বৈদিক যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান কিছু কিছু করাইতেন, বেদপাঠ যে করাইতেন, সন্দেহ নাই এবং তাহা প্রধানত পশ্চিমাগত ক্রিয়াত্বিত ব্রাহ্মণদেরই সাহায্যে ও প্রেরণায়। ইঁহাদের লক্ষ্য করিয়া সিদ্ধাচার্য সরহপাদ বলিয়াছেন,

বহ্মণো হিম জানন্ত হি ভেউ।
এবই পড়িঅউ এ চউ বেউ!!
মট্টী (পাণী) কুস লই পড়ন্ত
ঘরহিঁ [বইসী] অগগি হুণন্তঁ।।
কাজ্জ বিরহিঅ হুঅবহ হোমেঁ।
অক্‌খি উহাবিঅ কুড় এ’ ধুর্মেঁ।।

ব্রাহ্মণেরা তো যথার্থ ভেদ জানেনা; চতুর্বেদ এই ভাবেই পড়া হয়। তাঁহারা মাটি, জল, কুশ লইয়া (মন্ত্র) পড়ে, ঘরে বসিয়া আগুনে আহুতি দেয়; কার্যবিরহিত (অর্থাৎ ফলহীন) অগ্নিহোমের কটু ধোঁয়ায় চোখ শুধু পীড়িত হয়।

সরহপাদ অন্যত্র বলিতেছেন দণ্ডী সন্ন্যাসীদের সম্বন্ধে,

একদণ্ডী ত্রিদণ্ডী ভঅবঁবেসেঁ।
বিণুআ হোই হংহউএসেঁ।।
 মিচ্ছেহিঁ জগে বাহিঅ ভুল্লে।
ধম্মাধম্ম ণ জানিঅ তুলে।।

একদণ্ডী ত্রিদণ্ডী প্রভৃতি ভগবানের বেশে (সকলেই) ঘুরিয়া বেড়ায়; হংসের উপদেশে জ্ঞানী হয়। মিথ্যাই জগৎ ভুলে বহিয়া চলে; তাহারা ধর্মাধর্ম তুলারূপেই জানে না (অর্থাৎ ধর্মাধর্মের মূলা তাহাদের কাছে সমান)।

দোহাকোষে শাস্ত্রজ্ঞ ও শাস্ত্রাভিমানী এবং ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর প্রভৃতি দেবপূজক ব্রাহ্মণদের উল্লেখ সুপ্রচুর, কিন্তু সহজযানী সিদ্ধাচার্যেরা ইঁহাদের শ্রদ্ধার চোখে দেখিতেন না।

জাহের বাণচিহ্ন রুব ণ জানী।
সে কোইসে আগম বেএঁ বখানী!

যাঁহার বর্ণ, চিহ্ন ও রূপ কিছুই জানা যায় না, তাহা আগমে বেদে কিরূপে ব্যাখ্যাত হইবে?

সমসাময়িক অন্যান্য ধর্মের ভিতর থেরবাদী, মহাযানী, কালচক্রযানী ও বজ্রযানী বৌদ্ধধর্ম, দিগম্বর জৈনধর্ম, কাপালিকধর্ম, রসসিদ্ধ তথা নাথসিদ্ধ ধর্ম প্রভৃতি কিছু কিছু উল্লেখ চর্যাগীতি ও দোহাকোষে পাওয়া যায়। সহজযানীরা প্রাচীনতর থেরবাদ বা সমসাময়িক বাঙলাদেশে সুপ্রচলিত মহাযান ও তদোদ্ভূত অন্যান্য বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধেও খুব শঙ্কিত ছিলেন না, অন্যান্য ধর্মের প্রতি তো নয়ই। থেরবাদীদের সম্বন্ধে বলা হইয়াছে :

চেল্লু ভিক্‌খু জে স্থবির-উএসেঁ।
বন্দেহিঅ পরবজিউ বেসে।
কোই সুতম্ভবকখাণ বইটঠো।
কোবি চিন্তে কর সোসই দিটঠো ॥

চেল্ল (চেলা বা সমণের, অর্থাৎ শিক্ষার্থী) এবং ভিক্ষু যাঁহারা স্থবির বা আচার্যের উপদেশ প্রব্রজ্যার বেশ বন্দনা করে (বা গ্রহণ করে); কেহ কেহ বসিয়া বসিয়া (শুধু) সূত্রান্ত ব্যাখ্যা করে; কেহ কেহ বা দেখিয়া দেখিয়া সর্ব ধর্ম চিন্তা করে।

চর্যাগীতিতে মহাযানীদের সম্বন্ধে বলা হইয়াছে :

সঅল সমাহিঅ কাহি করি অই।
সুখ দুখেতেঁ নিচিত মরি অই ॥

সরল (ধ্যান) সমাধি দ্বারা কী করিবে? সুখ দুঃখের হাত হইতে তাহাতে মুক্তি পাওয়া যায় না।

মহাযানী-বজ্রযানী কালচক্রযানী প্রভৃতিদের সম্বন্ধে দোহাকোষে আছে :

অণ্ণ তহি মহাজাণহিঁ ধাবই।
তহিঁ সুখন্তু তক্কসত্থ হই
কোই মণ্ডলচক্ক ভাবই।
অন্ন চউত্থতত্ত দীসই ॥

অন্যেরা ধাবিত হইতেছে মহাযানের দিকে, সেখানে আছে সূত্রান্ত ও তর্কশাস্ত্র। কেহ কেহ ভাবিতেছে মণ্ডল ও চক্র; দিশা দিতেছে চতুর্থ তত্ত্বে।

ছবির মতন বর্ণনা পড়িতেছি দোহাকোষে জৈন-সন্ন্যাসীদের; সরহপাদ বলিতেছেন :

দীহণক্‌থ জই মলিণেঁ বেসেঁ।
ণগ্‌গল হোই উপাড়ি অ কেসেঁ ॥
খবণেহি জান বিড়ংবিা বেসেঁ।
অপ্পণ বাহিঅ মোক্‌খ উবেসেঁ ॥

দীঘনখ যোগী মলিন বেশে নগ্ন হইয়া কেশ উপড়ায়। ক্ষপণকেরা (জৈন-সন্ন্যাসীরা) বিড়ম্বিত বেশে মোক্ষের উদ্দেশ্যে নিজেদের বাহিয়া লইয়া চলে।

জই নগ্‌গা বিঅ হোই মুক্তি তা সুণহ সিআলহ।
লোমুপাড়ণো অত্থি সিদ্ধি তা জুবই নিতম্বহ ॥
পিচ্ছী গণহে দিঠ্‌ঠ মোক্‌খ [তা মোরহ চমরহ]।
উঞ্জেঁ ভো অণোঁ হোই জান তা করিহ তুরঙ্গাহ ॥

নগ্ন হইলেই যদি মুক্তি হইত, তাহা হইলে কুকুর-শেয়ালেরও হইত; লোম উপড়াইলেই যদি সিদ্ধি আসিত তাহা হইলে যুবতীর নিতম্বেরও সিদ্ধিলাভ ঘটিত; পুচ্ছ গ্রহণেই যদি মোক্ষ দেখা যাইত, তাহা হইলে ময়ূর-চামরেরও মোক্ষ দেখা হইত; উচ্ছিষ্ট ভোজনে যদি জ্ঞান হইত, তাহা হইলে হাতি ঘোড়ারও হইত।

চর্যাগীতিতে সমসাময়িক কাপালিকদের কথাও আছে; ইহাদের সঙ্গে সহজযানী সিদ্ধাচার্যদের একটু আত্মিক যোগও ছিল। সহজিয়ারা কেহ কেহ কাপালী যোগী হইতে চাহিয়াছেন; কাহ্নপাদ তো নিজেকেই কাপালী যোগী বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন।

আ লো ডোম্বী তোএ সম করিবে ম সাঙ্গ।
নিঘিণ কাহ্ন কাপালি জোই লাগ ॥

তুলো ডোম্বী হাউঁ কপালী।
তোহোর অন্তরে মোএ ঘলিলি হাড়ের মালী ॥

ওলো ডোম্বী, তোর সহিত আমি করিব সঙ্গ; (সেই জন্য) নিঘুণ কাহ্ন নগ্ন কাপালী যোগী (হইয়াছে)। … তুই (হইয়াছিস) ডোম্বী, আমি (হইয়াছি) কাপালী তোকে অন্তরে (লইয়া) আমি গ্রহণ করিয়াছি হাড়ের মালা।

কাপালী যোগীরা নগ্ন থাকিতেন, হাড়ের মালাও পরিতেন; অধিকন্তু বীরনাদে ডমরু বাজাইতেন, একা একা ঘুরিয়া বেড়াইতেন, পায়ে বাঁধিতেন ঘণ্টা নূপুর, কানে পরিতেন কুণ্ডল, গায়ে মাখিতেন ছাই : শাশুড়ী, ননদ, শালী, মাতা, আত্মীয়-পরিজন সকলকে ত্যাগ করিয়া কাপালী যোগী হইতেন। পুরুষ ও নারী কাহারও কোনও বাধা ছিল না যোগী হইবার পথে। চর্যাগীতি কাহ্নপাদের একটি গীতে এই সব আছে :

নাড়ি শক্তি দিঢ় ধরিঅ খট্টে।
অনহা ডমরু বাজই বীরনাদে।
কাহ্ন কাপালী যোগী প‍ইঠ অচারে।
দেহ নারী বিহরই একাকারে।
আলিকালি ঘণ্টা নেউর চরণে।
রবিশশী কুণ্ডল কিউ আভরণে ॥
রাগদ্বেষ মোহ লাইঅ ছার।
পরম মোখ লব এ মুক্তহার!
মারিঅ সাসু নন্দন ঘরে শালী।
মাত্র মারিআ কাহ্ন ভইল করালী।

প্রাচীন বাঙলায় দশম-একাদশ-দ্বাদশ শতকে এক শ্রেণীর সাধক ছিলেন যাঁহারা মৃত্যুর পর মুক্তি লাভে বিশ্বাস করিতেন না; তাঁহারা ছিলেন জীবন্মুক্তির সাধক। রস-রসায়নের সাহায্যে কায়সিদ্ধি লাভ করিয়া এই স্থুল জড়দেহকেই সিদ্ধদেহ এবং সিদ্ধদেহকে দিব্যদেহে রূপান্তরিত করা সম্ভব এবং তাহা হইলেই শিবত্ব লাভ ঘটে—এই মতে ইঁহারা বিশ্বাস করিতেন। ইহাদের বলা হইত রসসিদ্ধ যোগী। শশিভূষণ দাশগুপ্ত মহাশয় সুস্পষ্ট প্রমাণ করিয়াছেন যে, এই রসসিদ্ধ সম্প্রদায়ই পরবর্তী নাথসিদ্ধ যোগী সম্প্রদায়ের প্রাচীনতর রূপ। যাহা হউক, ইহাদের সম্বন্ধেও সহজযানী সিদ্ধাচার্যরা শ্রদ্ধিতচিত্ত ছিলেন না, বরং কঠোর সমালোচনাই করিতেন। সরহপাদ বলিতেছেন :

অহ্মে ণ জাণহু অচিন্ত জোই।
জামমরণভব কইসণ হোই।
জাইসো জাম মরণ বি তোইসো।
জীবন্তে মইলে নাহি বিশেসো।
জা এথু জাম মরণে বিসঙ্কা
সো করউ রস রসানেরে কঙ্ক্ষা।।

অচিন্তযোগী আমরা, জানি না জন্ম মরণ সংসার কিরূপে হয়। জন্ম যেমন মরণও তেমনই; জীবিতে ও মৃত বিশেষ ( কোনো পার্থক্য নাই। এখানে (এই সংসারে) যাহারা জন্ম-মরণে বিশঙ্কিত (ভীত), তাহারাই রস রসায়নের আকাঙ্ক্ষা করুন। সাধারণ যোগী-সন্ন্যাসীদের সম্বন্ধেও সহজযানীদের ছিল নিদারুণ অবজ্ঞা। সরহপাদের একটি দোহায় আছে :

অহরি এহি উদ্দলিঅ চ্ছারেঁ।
সীসসু বাহিঅ এ জড়ভারে ॥
ঘরহী বইসী দীবা জালী!
কোনহিঁ বইসী ঘণ্টা চালী ॥
অকখি ণিবেসী আসণ বন্ধী।
করেহি খুসখুসাই জণ ধন্ধী।।

আর্য যোগীরা ছাই মাখে দেহে, শিরে বহন করে জটাভার; ঘরে বসিয়া দীপ জ্বালে, কোণে বসিয়া ঘণ্টা চালে চোখ বুজিয়া আসন বাঁধে, আর কান খুসখুস করিয়া জনসাধারণকে ধাঁধা লাগায়!

সহজ সমরস, অর্থাৎ সাম্যভাবনা, আর ‘অসম’ অর্থাৎ আকাশের মতো শুন্য চিত্ত, ইহাই সহজযানের আদর্শ। তীর্থ, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, পূজা, আশ্রম সমস্তই ব্যর্থ। ধ্যানের মধ্যে মোক্ষ নাই, সহজ ছাড়া নির্বাণ নাই, কায়সাধন’ ছাড়া পথ নাই। যেখানে মন-পবন সঞ্চারিত হয় না, রবিশশীর প্রবেশ নাই সেইখানেই একমাত্র বিশ্রাম, সহজের মধ্যেই অশরীরী গুপ্তলীলা— অসরির কোই সরীরহি লুক্কো’। ঘরে পরমানন্দ। শরীরের মধ্যে থাকিও না, বনেও যাইও না— ‘ঘরহি মা থক্কু ম জাহি বণে’। আগম, বেদ পুরাণ সবই বৃথা নিষ্কলুষ নিস্তরঙ্গ হইতেছে সহজের রূপ, তাহার মধ্যে পাপ পুণ্যের প্রবেশ নাই। সহজে মন নিশ্চল করিয়া যে সমরসসিদ্ধ হইয়াছে সেই তো একমাত্র সিদ্ধ; তাঁহার জরামরণ দূর হইয়াছে। শূন্য নিরঞ্জনই পরম মহাসুখ, সেখানে না আছে পাপ, না আছে পুণ্য –’সুন্ন নিরঞ্জন পরম মহাসুহ তহি পুণ ন পাব।’ সরহপাদ, কাহ্নপাদ প্রভৃতি আচার্যরা দোহার পর দোহায় এই সব মত কীৰ্ত্তন করিয়াছেন। বৈরাগ্য তাঁহারা সাধন করিতেন না, বলিতেন, বিরাগাপেক্ষা পাপ আর কিছু নাই, সুখ অপেক্ষা পুণ্য কিছু নাই।

উদ্ধৃত গীত ও দোহাগুলি হইতে সহজযানী সাধকদের ধর্মমতের যে আভাস পাওয়া যায়, ব্রাহ্মণ্য ও অন্যান্য ধর্মের বাহ্য আচারানুষ্ঠানের প্রতি যে অবজ্ঞা দৃষ্টিগোচর হয়, তাহা হইতে একটি তথ্য সুস্পষ্ট। সে-তথ্যটি এই যে, মধ্যযুগে উত্তর-ভারতে ও বাঙলাদেশে যে মানবধর্মী মরমীয়া সাধক-কবিদের সাক্ষাৎ আমরা পাই—বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস হইতে আরম্ভ করিয়া কবীর, দা, রজ্জব, তুলসীদাস, সুরদাস, মীরাবাই, হরিদাস প্রভৃতি পর্যন্ত—ইহারা সকলেই ভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির দিক হইতে একাদশ-দ্বাদশ শতকের এই সহজযানী সাধক কবিদেরই বংশধর। প্রাচীন সহজযানী সাধকেরা এবং মধ্যযুগীয় মরমীয়া সাধকেরা তাঁহাদের ধ্যান-ধারণাগুলি জনসাধারণের কাছে প্রচার করিবার জন্য যে মাধ্যম অবলম্বন করিয়াছিলেন তাহাও এক সে মাধ্যম হইতেছে গীত ও দোহার মাধ্যম