প্রাচীন ভারতবর্ষের ধর্মকর্মানুষ্ঠানের সঙ্গে যাঁহারা পরিচিত তাঁহারা জানেন, গরুড়ধ্বজা, মীনধ্বজা, ইন্দ্রধ্বজা, ময়ূরধ্বজা, কপিধ্বজা প্রভৃতি নানাপ্রকারের ধ্বজাপূজা ও উৎসব এক সময় আমাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। প্রাচীন বাঙলাদেশেও তাহার ব্যতিক্রম ছিল না; ঐতিহাসিক প্রমাণও কিছু কিছু আছে।
শত্রুধ্বজা বা ইন্দ্রধ্বজের পূজা যে একাদশ শতকের আগে প্রচলিত ছিল তাহার প্রমাণ তো গোবর্ধন আচার্যই রাখিয়া গিয়াছেন। শত্রোত্থান বা শত্রুধ্বজা পূজার কথা জীমূতবাহনের কালবিবেক-গ্রন্থেও পাওয়া যায়। তাহা ছাড়া, তাম্রধ্বজ, ময়ূরধ্বজ, হংসধ্বজ প্রভৃতি নাম প্রাচীন কালের রাজ-রাজড়ার ভিতর একেবারে অপ্রতুল নয়।
এক এক কোম বা গোষ্ঠীর এক এক পশু বা পক্ষীলাঞ্ছিত ধ্বজা; সেই ধ্বজার পূজাই বিশেষ গোষ্ঠীর বিশিষ্ট কোমগত পূজা এবং তাহাই তাঁহাদের পরিচয়; সেই কোমের যিনি নায়ক বিশেষ বিশেষ লাঞ্ছন অনুযায়ী তাঁহার নাম তাম্রধ্ব, ময়ূরধ্বজ, বা হংসধ্বজ। এই ধরনের পশু বা পক্ষীলাঞ্ছিত পতাকার পূজা আদিম পশুপক্ষী হইতে উদ্ভূতল বহু পরবর্তী ব্রাহ্মণ্য পৌরাণিক দেবদেবীর রূপকল্পনায় তাহা পরিত্যাগ করা সম্ভব হয় নাই। প্রমাণ, আমাদের বিভিন্ন দেবদেবীর বাহন, দেবীর বাহন সিংহ, কার্তিকের বাহন ময়ূর, বিষ্ণুর বাহন গরুড়, শিবের বাহন নন্দী, লক্ষ্মীর বাহন পেঁচক, সরস্বতীর বাহন হংস, ব্রহ্মার বাহন হংস, গঙ্গার বাহন মকর, যমুনার বাহন কূর্ম, সমস্তই সেই আদিম পশুপক্ষী পূজার অবশেষ।
আদিম কোমগত পূজার উপর ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর সঙ্গে এই সব পশুপক্ষীরাও আজও আমাদের পূজা লাভ করে সন্দেহ কী? দেবদেবীর মূর্তিপূজার সঙ্গে এই সব ধ্বজাপূজার প্রচলন সুপ্রাচীন। দেবী বা মন্দিরের সম্মুখে স্তম্ভের উপর বা মন্দিরের চূড়ায় উড্ডীয়মান ধ্বজা বা কেতনের পূজা খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতক বেশনগরের (মান্দাশোর, মধ্যভারত) সেই গরুড়ধ্বজ, তালধ্বজ, মকরকেতন প্রভৃতির পূজা হইতে আরম্ভ করিয়া আজিকার চড়কপূজা, ধর্মপূজা, অশ্বত্থ ও অন্যান্য বৃক্ষপূজা পর্যন্ত সর্বত্রই বর্তমান। সাঁওতাল, মুণ্ডা, খাসিয়া, রাজবংশী, গারো প্রভৃতি আদিবাসী কোম এবং বাঙালীর তথাকথিত অন্ত্যজ বা নিম্নস্তরের জনসাধারণের মধ্যে কোনও ধর্মকর্ম ধ্বজা এবং ধ্বজাপূজা ছাড়া অনুষ্ঠিতই হয় না প্রায় বলা চলে। সমস্ত উত্তর ও দক্ষিণ-ভারত জুড়িয়া ধর্মস্থান বা ‘থানে’র সঙ্গে ধ্বজা এবং ধ্বজাপূজার সম্বন্ধ অবিচ্ছেদ্য।