৭. সেন-বর্মণ-দেবপর্ব

৭. সেন-বর্মণ-দেবপর্ব

পাল-পর্বের অব্যবহিত আগেকার সমতটের খড়া বংশ বা চট্টগ্রামের কান্তিদেবের বংশ, পাল-পর্বে পাল, চন্দ্র ও কাম্বোজ রাজবংশ এঁরা সকলেই ছিলেন বৌদ্ধ; আর সেন-পর্বে সেন, বর্মণ ও দেববংশ এঁরা সকেলই ছিলেন ব্রাহ্মণ্যধর্মাশ্রয়ী। এই দুই তথ্যের মধ্যে বাঙলার ইতিহাস ও সংস্কৃতির গভীরতর অর্থ নিহিত। সেন-পর্বে ধর্ম ও সমাজচক্র কোনদিকে ঘুরিতেছে, এই দুই তথ্যের মধ্যে তাহার কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যাইবে। সে-ইঙ্গিত বর্ণ-বিন্যাস অধ্যায়ে সবিস্তারে ফুটাইয়া তুলিতে চেষ্টা করিয়াছি, এখানে আর পুনরুক্তি করিয়া লাভ নাই। আশা করি, কৌতূহলী পাঠক তাহা এই প্রসঙ্গে পাঠ করিয়া লইবেন। এইখানে এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, এই পর্বের বাঙলার সর্বব্যাপী, সর্বগ্রাসী ধর্মই হইতেছে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম এবং সেই ব্রাহ্মণ্য ধর্ম বেদ ও পুরাণ, শ্রুতি ও স্মৃতিদ্বারা শাসিত ও নিয়ন্ত্রিত এবং তন্ত্রদ্বারা উদ্বুদ্ধ। এই দেড়শত বৎসরের বাঙলার আকাশ একান্তই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আকাশ। জৈনধর্মের কোনও চিহ্নমাত্র কোথাও দেখা যাইতেছে না, একমাত্র বাঁকড়া-পুরুলিয়া অঞ্চল ছাড়া। বজ্রযানী সহজযানী কালচক্রযানী বৌদ্ধরা নাই, কিংবা তাঁহাদের ধর্মাচরণানুষ্ঠান তাঁহারা করিতেছেন না, এমন নয়, কিন্তু তাঁহাদের কণ্ঠ ক্ষীণ, শিথিল এবং কোথাও কোথাও নিরুদ্ধপ্রায়। বৌদ্ধ দেবদেবীর মূর্তি বিরল। সিদ্ধাচার্যদের খবর কোথাও কোথাও শুনা যাইতেছে, সন্দেহ নাই, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁহাদের গুহ্য সাধনা গুহ্যতর পথ অনুসন্ধান করিতেছে, অথবা ব্রাহ্মণ্যধর্মের গুহ্য সাম্প্রদায়িক সাধনায় আত্মগোপন করিতেছে। বৌদ্ধ বিহার ইত্যাদির খবরও দু’চার জায়গায় পাইতেছি, কিন্তু তাঁহাদের সেই অতীত গৌরব ও সমৃদ্ধি আর নাই। অন্যদিকে বৈদিক যাগযজ্ঞের আকাশ বিস্তৃত হইতেছে, পৌরাণিক দেবদেবী ও বিশেষ বিশেষ তিথি-নক্ষত্রে স্নান দান-ধ্যান ক্রিয়াকর্ম প্রভৃতির ভিড় বাড়িতেছে, মধ্যদেশ হইতে ব্রাহ্মণাভিযান বাড়িতেছে, রাষ্ট্রে ও সমাজে ব্রাহ্মণাধিপত্য বিস্তৃত হইতেছে। কেন হইতেছে, কী ভাবে হইতেছে তাহা পূর্ববর্তী অনেক অধ্যায়ে বিশেষ ভাবে বর্ণ-বিন্যাস শ্রেণী-বিন্যাস ও রাজবৃত্ত অধ্যায়ে বারবার বলিয়াছি।

যাহা হউক, এই বিবর্তনের সূচনা পাল বংশের এবং কাম্বোজ বংশের শেষের দিকে সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছিল। ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সমাজব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষক তো সমস্ত বাঙালী বৌদ্ধ-রাজারাই ছিলেন, কথাটা তাহা নয়; লক্ষণীয় হইল এই যে, বৌদ্ধ রাজার বংশধরেরাও (একাদশ শতকের শেষার্ধ হইতেই) ক্রমশ ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ছত্রছায়ায় আশ্রয় লইতেছেন। সে-সব কথা বর্ণ বিন্যাস অধ্যায়ে বলিয়াছি এবং দৃষ্টান্তও উদ্ধার করিয়াছি।

বর্মণ, সেন ও দেব বংশের ধর্মগত আদর্শের কিছু ইঙ্গিত এখানে রাখা যাইতে পারে। বর্মণ বংশের রাজারা সকলেই পরমবিষ্ণুভক্ত। এই রাজবংশের যে বংশাবলী ভোজবর্মার বেলাব-লিপিতে পাওয়া যাইতেছে তাহার গোড়াতেই ঋষি অভি হইতে আরম্ভ করিয়া বৈদিক ও পৌরাণিক নামের ছড়াছড়ি; ইহাদেরই বংশে বর্মণ পরিবারের জন্ম! রাজা সামলবর্মার পুত্র ভোজবর্মা সাবর্ণ গোত্রীয়, ভৃগু-চাবন-আপ্লুবান ঔর্ব জামদগ্নি প্রবর, বাজসনেয় চরণ এবং যজুর্বেদীয় কাণ্বশাখ ব্রাহ্মণ রামদেব-শর্মাকে পুণ্ড্রবর্ধনে কিছু ভূমিদান করিয়াছিলেন। রামদেব-শর্মার দেবজ্ঞ পূর্বপুরুষেরা মধ্যদেশ হইতে আসিয়া উত্তর-রাঢ়ার সিদ্ধল গ্রামে বসতি স্থাপন করিয়াছিলেন। এই বর্মণ রাষ্ট্রেরই অন্যতম মন্ত্রী স্মার্ত ভট্ট-ভবদের অগস্ত্যের মতো বৌদ্ধ সমুদ্রকে গ্রাস করিয়াছিলেন এবং পাষণ্ড-বৈতণ্ডিকদের যুক্তিতর্ক খণ্ডনে অতিশয় দক্ষ ছিলেন বলিয়া গর্ব অনুভব করিয়াছিলেন। তিনি ছিলেন ব্রহ্মবিদ্যাবিদ, সিদ্ধান্ত – তন্ত্র- -গণিত-ফলসংহিতায় সুপণ্ডিত, হোরাশাস্ত্রের একটি গ্রন্থের লেখক, কুমারিল ভট্টের মীমাংসা-গ্রন্থের টীকাকার, স্মৃতিগ্রন্থের প্রখ্যাত লেখক, অর্থশাস্ত্র, আয়ুর্বেদ, আগমশাস্ত্র এবং অস্ত্রবেদে সুপণ্ডিত। রাঢ়দেশে তিনি একটি নারায়ণ মন্দির স্থাপন করিয়া তাহাতে নারায়ণ, অনন্ত এবং নৃসিংহের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। ভট্ট-ভবদেবের লিপিতে সাবর্ণগোত্রীয় বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণাধ্যুষিত একশত গ্রামের খবর পাওয়া যাইতেছে। ভোজবর্মার বেলাব-লিপিতে বলা হইয়াছে, মানুষের অজ্ঞতার উলঙ্গতাকে ঢাকিবার একমাত্র উপায় হইতেছে ত্রি-বেদের চর্চা; এই চর্চার প্রসারের জন্য ধর্ষণ-পরিবারের চেষ্টার সীমা ছিল না। বর্মণ-রাষ্ট্রে যাহার সূচনা। সেন-রাষ্ট্রে তাহার বিস্তার। বস্তুত, বাঙলার স্মৃতি ও ব্যবহার-শাসন সেন-পর্বেরই সৃষ্টি। এই যুগে রচিত অসংখ্য স্মৃতি ও ব্যবহার-গ্রন্থাদিতে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অমোঘ ও সুনির্দিষ্ট আদর্শ সক্রিয়। বিজয়সেন ও বল্লালসেন উভয়েই ছিলেন পরম মাহেশ্বর অর্থাৎ শৈব; লক্ষ্মণসেন পরম বৈষ্ণব, পরম নারসিংহ; লক্ষ্মণসেনের দুই পুত্র বিশ্বরূপ ও কেশবসেন উভয়েই নারায়ণ এবং সূর্যভক্ত। সেন বংশের আদিপুরুষ সামন্তসেন শেষ বয়সে গঙ্গাতীরস্থ আশ্রমে বানপ্রস্থে কাটাইয়াছিলেন। এই সব আশ্রম- তপোবন ঋষি-সন্ন্যাসী দ্বারা অধ্যুষিত এবং যজ্ঞাগ্নিসেবিত ঘৃত-ধূপের সুগন্ধে পরিপূরিত থাকিত; সেখানে মৃগশিশুরা তপোবন-নারীদের স্তন্যদুগ্ধ পান করিত এবং শুকপাখিরা সমস্ত বেদ, আবৃত্তি করিত!! সামন্তসেনের পৌত্র বিজয়সেন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের উপর প্রচুর কৃপাবর্ষণ করিয়াছিলেন এবং তাহার ফলে তাঁহারা প্রচুর ধনের অধিকারী হইয়াছিলেন। একবার তাঁহার মহিষী বিলাসদেবী চন্দ্রগ্রহণোপলক্ষে কনকতুলাপুরুষ অনুষ্ঠানের হোমকার্যের দক্ষিণাস্বরূপ মধ্যদেশাগত, বৎসগোত্রীয়, ভার্গব-চাবন-আম্বুবান-ঔর্ব জামদগ্ন্য প্রবর, ঋগ্বেদীয় আশ্বলায়ন শাখার ষড়অধ্যায়ী ব্রাহ্মণ উদয়কর দেবশর্মাকে কিছু ভূমিদান করিয়াছিলেন। বল্লালসেনের নৈহাটি-লিপি আরম্ভ হইয়াছে অর্ধনারীকে বন্দনা করিয়া। তাঁহার মাতা বিলাসদেবী একবার সূর্যগ্রহণ উপলক্ষে গঙ্গাতীরে হেমাশ্বমহাদান অনুষ্ঠানের দক্ষিণাস্বরূপ ভরদ্বাজ গোত্রীয়, ভরদ্বাজ-আঙ্গিরস-বার্হস্পত্য প্রবর, সামবেদীয় কৌঠুমশাখাচরণানুষ্ঠায়ী ব্রাহ্মণ শ্রীশুবাসু দেবশর্মাকে ভূমিদান করিয়াছিলেন। লক্ষ্মণসেনের আনুলিয়া-লিপির দানগ্রহীতা হইতেছেন কৌশিক গোত্রীয়, বিশ্বামিত্র-বন্ধুল কৌশিক প্রবর, যজুর্বেদীয় কান্বশাখাধায়ী ব্রাহ্মণ-পণ্ডিত রঘুদেবশর্মা। এই রাজারই গোবিন্দপুর-পট্রোলীর ভূমিদান-গ্রহীতাও একজন ব্রাহ্মণ, উপাধ্যায় ব্যাসদেব শর্মা বসগোত্রীয় এবং কৌঠুমশাখাচরণানুষ্ঠায়ী। সামবেদীয় কৌঠুমশাখাচরণানুষ্ঠায়ী, ভরদ্বাজগোত্রীয় আর এক ব্রাহ্মণ ঈশ্বর দেবশর্মাও কিছু ভূমিদান লাভ করিয়াছিলেন রাজা কর্তৃক হেমাশ্বরথমহাদান যজ্ঞানুষ্ঠানে আচার্য-ক্রিয়ার দক্ষিণাস্বরূপ। লক্ষ্মণসেনের মাধাইনগর-লিপি হইতে জানা যায়, রাজা তাঁহার মূল অভিষেকের সময় ঐন্দ্রীমহাশান্তি যজ্ঞানুষ্ঠান উপলক্ষে কৌশিক গোত্রীয়, অথর্ববেদীয় পৈপ্পলাদশাখাধ্যায়ী ব্রাহ্মণকে ভূমিদান করিয়াছিলেন। লক্ষ্মণসেনের পুত্র কেশবসেন কর্তৃক অনুষ্ঠিত যজ্ঞাগ্নির ধূম চারিদিকে এমন বিকীর্ণ হইত যেন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হইয়া যাইত। তিনি একবার তাঁহার জন্মদিনে দীর্ঘজীবন কামনা করিয়া একটি গ্রাম বাস্য গোত্রীয় ব্রাহ্মণ ঈশ্বর দেবশর্মাকে দান করিয়াছিলেন। লক্ষ্মণসেনের আর এক পুত্র বিশ্বরূপ সেন শিবপুরাণোক্ত ভূমিদানের ফললাভের আকাঙ্ক্ষায় বাৎস্যগোত্রীয় নীতিপাঠক ব্রাহ্মণ বিশ্বরূপ দেবশর্মাকে কিছু ভূমি দান করিয়াছিলেন। এই রাজারই অন্য আর একটি লিপিতে দেখিতেছি, হলায়ুধ নামে বাৎস্যগোত্রীয় যজুর্বেদীয়, কান্নশাখাধ্যায়ী জনৈক ব্রাহ্মণ আবল্লিক পণ্ডিত রাজপরিবারে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান রাজকর্মচারীদের নিকট হইতে প্রচুর ভূমিদান লাভ করিতেছেন—উত্তরায়ণ সংক্রান্তি, চন্দ্রগ্রহণ, উত্থানদ্বাদশী তিথি, জন্মতিথি ইত্যাদি বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে।

ত্রিপুরা-নোয়াখালি-চট্টগ্রাম অঞ্চলের দেব-বংশের লিপিতেও অনুরূপ সংবাদ পাওয়া যাইতেছে। এই রাজবংশ ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কারাশ্রয়ী এবং বিষ্ণুভক্ত। এই বংশের অন্যতম রাজা দামোদর একবার একজন যজুর্বেদীয় ব্রাহ্মণ পৃথ্বীধর শর্মাকে কিছু ভূমিদান করিয়াছিলেন।

বস্তুত, এই তিন রাজবংশের সচেতন চেষ্টাই যেন ছিল বৈদিক ও পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের আকাশ বাঙলাদেশে বিস্তৃত করা। রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ-কালিদাস যে প্রাচীন ব্রাহ্মণ্য আদর্শের কথা বলিয়াছেন সেই ব্রাহ্মণ্য আদর্শ সমাজ ও ধর্মজীবনে সঞ্চার করিবার প্রয়াস লিপিগুলিতে এবং সমসাময়িক সাহিত্যে সুস্পষ্ট। লিপিগুলিতে কনকতুলাপুরুষ মহাদান, ঐন্দ্রীমহাশান্তি, হেমাশ্বমহাদান, হেমাশ্বরথদান প্রভৃতি যাগযজ্ঞ; সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ, উত্থানদ্বাদশীতিথি, উত্তরায়ণ-সংক্রান্তি প্রভৃতি উপলক্ষে স্নান, তর্পণ, পূজানুষ্ঠান; শিবপুরাণোক্ত ভূমিদানের ফলাকাঙ্ক্ষা; বিভিন্ন বেদাধ্যায়ী ব্রাহ্মণের পুঙ্খানুপুঙ্খ উল্লেখ প্রভৃতিই তাহার সুস্পষ্ট প্রমাণ।

এই যুগের ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও সংস্কৃতির অন্যতম প্রতিনিধি হলায়ুধ, সন্দেহ নাই। তাঁহার ব্রাহ্মণসর্বস্ব-গ্রন্থের গোড়াতেই আত্মপ্রশস্তিমূলক কয়েকটি শ্লোক আছে; তাহার অর্থ এইরূপ : “(হলায়ুধের নিজের গৃহে) কোথাও কাঠের (যজ্ঞ) পাত্র (ছড়াইয়া আছে); কোথাও বা স্বর্ণপাত্র (ইত্যাদি)। কোথাও ইন্দুধবল দুকুলবন্ধু : কোথাও কৃষ্ণমৃগচর্ম। কোথাও ধূপের (গন্ধময় ধূম); বর্ষার ধ্বনিময় আহুতির ধূম। (এই ভাবে তাঁহার গৃহে অগ্নির এবং (তাঁহার নিজের) কর্মফল যুগপৎ জাগ্রত।”

ইহাই ব্রাহ্মণ্য সেন-পর্বের ভাবপরিমণ্ডল; হলায়ুধ গৃহের ভাব-কল্পনাই সমসাময়িক ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির ভাব-কল্পনা।

বৈদিক ধর্ম ও সংস্কারের বিস্তার

হলায়ুধের ব্রাহ্মণ-সর্বস্ব হইতে যে শ্লোকটির অনুবাদ উল্লেখ করিলাম তাহার ইঙ্গিত যে ঔপনিষদিক তপোবনাদর্শের দিকে, এ-কথা বোধ হয় আর স্পষ্ট করিয়া বলিবার প্রয়োজন নাই। সামন্তসেনের বানপ্রস্থ যে আশ্রমে কাটিয়াছিল সে আশ্রমের আকাশ-পরিবেশও ঔপনিষদিক। কবিকল্পনা সন্দেহ নাই, তবু, যে-দেশের কল্পনাশ্রমে শুকপাখিরাও বেদ আবৃত্তি করে সে-দেশে বেদের চর্চা ছিল, বৈদিক যাগযজ্ঞ ক্রিয়াকর্মের প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল তাহা তো সহজেই অনুমেয়। বর্মণ ও সেন রাজাদের লিপিগুলিতে সমানেই দেখিতেছি চতুর্বেদের বিভিন্ন শাখাধ্যায়ী ব্রাহ্মণেরাই হোমযাগযজ্ঞ ইত্যাদি করাইতেছেন এবং ভূমিদক্ষিণা লাভ করিতেছেন। ঋগ্বেদ, যর্জুবেদ, সামবেদ এবং অথর্ববেদ এই চারিবেদই ব্রাহ্মণদের মধ্যে সুপরিচিত ছিল, এবং ঋগ্বেদীয় আশ্বলায়ন শাখার ষড়ঙ্গ, যজুর্বেদীয় কান্নশাখা, সামবেদীয় কৌঠুমশাখা এবং অথর্ববেদীয় পৈপ্পলাদ শাখার চর্চাই ছিল বেশি, বিশেষভাবে যজুর্বেদীয় কান্নশাখা এবং সামবেদীয় কৌঠুমশাখা। ভট্ট-ভবদেব ছিলেন ব্রহ্মবিদ্যাবিদ। ছান্দোগ্য মন্ত্রভাষ্য রচয়িতা গুণবিষ্ণুও তো এই যুগেরই লোক। বিজয়সেনের অজস্র কৃপা বর্ষিত হইয়াছিল যাঁহাদের উপর তাঁহারা তো অনেকেই বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ। দামোদরদেবের নিকট হইতে যে-ব্রাহ্মণ পৃথ্বীধরশর্মা কিছু ভূমিদান গ্রহণ করিয়াছিলেন তিনি ছিলেন যজুর্বেদীয়। এই পর্বে বৈদিক ধর্ম, ক্রিয়াকর্ম, যাগযজ্ঞ, সংস্কার প্রভৃতি যে আরও বিস্তারিত হইয়াছিল, সন্দেহ নাই। কনকতুলাপুরুষ দান, ঐন্দ্রীমহাশান্তি, হেমাশ্বমহাদান, হেমাশ্বরথদান প্রভৃতি যাগযজ্ঞ তো শ্রৌত-সংস্কারের জয়জয়কারই ঘোষণা করে।

অথচ হলায়ুধ দুঃখ প্রকাশ করিয়াছেন (ব্রাহ্মণসর্বস্ব-গ্রন্থ), রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণেরা যথার্থ বেদবিদ ছিলেন না; তাঁহার মতে, ব্রাহ্মণদের বেদচর্চার সমধিক প্রসিদ্ধি ছিল নাকি উৎকল ও পাশ্চাত্য দেশ সমূহে। রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণেরা নাকি বৈদিক যাগযজ্ঞানুষ্ঠানের রীতিপদ্ধতিও জানিতেন না। হলায়ুধের আগে বল্লালগুরু অনিরুদ্ধ-ভট্টও তাঁহার পিতৃদয়িতা-গ্রন্থে বাঙলাদেশে বেদচর্চার অবহেলা দেখিয়া দুঃখ করিয়াছেন। এই অবস্থারই বোধ হয় দূর প্রতিধ্বনি শুনা যাইতেছে কুলজী-গ্রন্থমালা-কথিত পাশ্চাত্য ও দাক্ষিণাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণদের বাঙলায় আগমন-কাহিনীতে। সেন-বর্মণ পর্বে বৈদিক ধর্ম ও সংস্কারের ক্রমবর্ধমান প্রসার দেখিয়া মনে হয়, বাহির হইতে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ আনিয়া বেদচর্চা, বৈদিকানুষ্ঠান প্রভৃতি সুপ্রতিষ্ঠিত করিবার একটা সচেতন চেষ্টা বোধ হয় সত্যই করা হইয়াছিল। অনিরুদ্ধ-ভট্ট ও হলায়ুধ যে অবস্থাটা দেখিয়াছিলেন তাহা তাঁহাদের ভালো লাগে নাই। কজেই, ব্রাহ্মণ্য এবং দক্ষিণাগত সেন-বৰ্মণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে এ-ধরনের একটা চেষ্টা হওয়া কিছু বিচিত্র নয়, অস্বাভাবিকও নয়। বর্ণ-বিন্যাস অধ্যায়ে আমি দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি, সেন-বর্মণ আমলেই বাঙলায় বৈদিক শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের উদ্ভব দেখা দেয়।

আগেই বলিয়াছি, বাঙলার শ্রৌত ও স্মৃতিশাসন এই পর্বেরই সৃষ্টি। ভট্ট-ভবদেব, জীমূতবাহন, অনিরুদ্ধ-ভট্ট, বল্লালসেন, লক্ষ্মণসেন, হলায়ুধ প্রভৃতি সকলেই এই পর্বেরই লোক এবং ইহারা প্রত্যেকেই স্বনামখ্যাত শ্রৌত ও স্মৃতিপণ্ডিত। এই পর্বেই বাঙলার ব্রাহ্মণ্য জীবন সর্বভারতীয় শ্রৌত ও স্মৃতিবন্ধনে সম্পূর্ণ বাঁধা পড়িল। সদ্যোক্ত শ্রৌত ও স্মৃতিকারদের গ্রন্থে শ্রৌত ও গৃহা সংস্কারগুলির পূর্ণ পরিচয় পাওয়া কঠিন নয়। গর্ভাধান, পুংসবন, সীমান্তোন্নয়ন, শোষান্তীহোম, জাতকর্ম, নিষ্ক্রমণ, নামকরণ, পৌষ্টিককর্ম, অন্নপ্রাশন, নৈমিত্তিক-পুত্র-মূর্দ্ধাভিঘ্রাণ, চূড়াকরণ, উপনয়ন, সাবিত্র-চরু হোম, সমাবর্তন, বিবাহ, শালাকর্ম (গৃহপ্রবেশ) প্রভৃতি দ্বিজবর্ণের যত কিছু সংস্কার প্রত্যেকটি এই সব গ্রন্থে বিস্তৃত বর্ণিত ও ব্যাখ্যাত হইয়াছে। এই সব সংস্কার পালনের অপরিহার্য অঙ্গ হইতেছে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করিয়া কুশণ্ডিকানুষ্ঠান এবং মহাব্যাহৃতি বা শাট্যায়ন বা সমিধহোম বা অন্য কোনও হোমানুষ্ঠানপূর্বক গৃহাগ্নি শোধন বা প্রতিষ্ঠা। এই সব হোমানুষ্ঠান কী করিয়া করিতে হয় তাহার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনাও দেওয়া হইয়াছে। অনিরুদ্ধ-ভট্টের পিতৃদয়িতা ও হারলতা গ্রন্থে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান সংক্রান্ত ক্রিয়াকর্মেরও বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া আছে। এই সব বিবরণ ও ব্যাখ্যান পাঠ করিলে বুঝিতে দেরি হয় না যে, শ্রৌত ও স্মার্ত সংস্কার এই পর্বের বাঙালী ব্রাহ্মণ্য সমাজে সুবিস্তার লাভ করিয়াছিল। রাষ্ট্রের সহায়তায় এই বিস্তারের ভার লইয়াছিলেন ব্রাহ্মণেরা।

পৌরাণিক ধর্ম ও সংস্কারের বিস্তৃতি

পৌরাণিক ধর্ম ও সংস্কারের বিস্তার তো পাল-পর্বেই দেখিয়াছি। এই পর্বে তাহা বর্ধমান। পুরাণ-কাহিনীর পরিচয় এই পর্বের লিপিগুলিতে সমানেই পাওয়া যাইতেছে। বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতারের কথা শুনিতেছি ভোজবর্মার বেলাব ও লক্ষ্মণসেনের তর্পণদীঘি-শাসনে। বামনাবতারের কথা বলিতে গিয়া বিষ্ণু কী করিয়া দৈত্যরাজ এবং ইন্দ্রজয়ী বলিকে পরাভূত করিয়াছিলেন, বলিরাজার অপরিমেয় ত্যাগের খ্যাতি কতদূর ছিল তাহার ইঙ্গিত করা হইয়াছে। কৃষ্ণের প্রেমলীলা এবং বিষ্ণুর কৃষ্ণ, নরসিংহ এবং পরশুরামাবতারের কথাও বাদ পড়ে নাই। বিজয়সেনের দেওপাড়া-লিপিতে সূর্যদেব অগস্ত্যের সাহায্যে কী করিয়া বিন্ধ্যকে অবনত করিয়াছিলেন, তাহার ইঙ্গিত আছে। বেলাব-লিপিতে চন্দ্রকে বলা হইয়াছে অত্রির অন্যতম বংশধর। শিব যে অর্ধনারীশ্বর এবং শম্ভু, ধূর্জটি ও মহেশ্বর যে তাঁহার অন্য তিনটি নাম এবং কার্তিকেয় ও গণেশ যে তাঁহার দুই পুত্র, এ-কথার উল্লেখ আছে দেওপাড়া, নৈহাটি ও বারাকপুর লিপিতে। সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ, উত্থানদ্বাদশী তিথি, উত্তরায়ণ-সংক্রান্তি প্রভৃতি উপলক্ষে স্নান, তর্পণ ও পূজা, শিবপুরাণোক্ত ভূমিদানের ফলাকাঙ্ক্ষা, দুর্বাত্বণ জলসিক্ত করিয়া দানকার্য সমাপন, নীতিপাঠের অনুষ্ঠান, লিপি-উল্লিখিত এই সব ক্রিয়াকর্ম সমস্তই পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মের জয়-ঘোষণা করে। সুখরাত্রি ব্রত, শত্রুত্থান পূজা, কামমহোৎসব, হোলাক উৎসব, পাষাণ-চতুর্দশী, দ্যুত-প্রতিপদ, কোজাগর- পূর্ণিমা, ভ্রাতৃদ্বিতীয়া, আকাশ-প্রদীপ, দীপান্বিতা, জন্মাষ্টমী, অশোকাষ্টমী, অক্ষয়-তৃতীয়া, অগস্ত্যার্ঘ্য্য, মাঘীসপ্তমী-স্নান প্রভৃতি পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যধর্মানুমোদিত যে-সব ক্রিয়াকর্মের বিস্তৃত উল্লেখ ও বিবরণ এই পর্বের কালবিবেক, দায়ভাগ প্রভৃতি গ্রন্থে পাওয়া যায়, ইহাদের মধ্যেও একই ইঙ্গিত।

এই পর্বের বৈষ্ণব, শৈব, শাক্ত প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক ধর্ম ও দেবদেবী সম্বন্ধে বিশদ ভাবে বলিবার কিছু নাই। পাল চন্দ্র পর্বে এই সব ধর্ম ও দেবায়তনের যে রূপ ও প্রকৃতি আমরা দেখিয়াছি, এ-পর্বে তাহা আরও বিস্তৃত হইয়াছে, প্রভাব-প্রতিপত্তি আরও বাড়িয়াছে। কাজেই একই কথা আবার বলিয়া লাভ নাই; যে-সব ক্ষেত্রে নূতন তথ্যের, নূতন রূপ ও প্রকৃতির ইঙ্গিত পাওয়া যাইতেছে শুধু তাহারই উল্লেখ করিতেছি।

বৈষ্ণব ধর্ম

পাল-পর্বের কোনও কোনও স্থানক বিষ্ণুমূর্তিতে মহাযানী মূর্তি-কল্পনার প্রভাবের কথা আগেই বলিয়াছি। এই পর্বেও তেমন দুই একটি মূর্তি পাওয়া গিয়াছে। দিনাজপুর জেলার সুরোহর গ্রামে প্রাপ্ত (রাজশাহী-চিত্রশালা) একটি ত্রিবিক্রম প্রকরণের বিষ্ণুর স্থানক প্রতিমায় এই মহাযানী প্রভাব সুস্পষ্ট। পাল-পর্বের মহাযানী লোকেশ্বর-বিষ্ণু প্রতিমাগুলির (ঘিয়াসবাদ, সোনারঙ্গ ও সাগরদীঘিতে প্রাপ্ত) মতো এ-ক্ষেত্রেও বিষ্ণু একটি নাগের ফণাছত্রের নীচে দণ্ডায়মান; তাঁহার চক্র ও গদা এবং দুই পার্শ্বের চক্র ও শঙ্খপুরুষ নীলোৎপলের উপরে স্থিত; ফণাছত্রের উপরেই অমিতাভসদৃশ একটি উপবিষ্ট মূর্তি এবং পাদপীঠে যড়ভুজ নৃত্যপরায়ণ এক শিব-প্রতিকৃতি উৎকীর্ণ। কালন্দরপুরে প্রাপ্ত একটি স্থানক বিষ্ণুমূর্তিতেও অনুরূপ লক্ষ্মণ দৃষ্টিগোচর হয়। বিষ্ণুর গরুড়াসন প্রতিমার একটি নিদর্শন পাওয়া গিয়াছে বগুড়া জেলার দেওড়া গ্রামে। কিন্তু বিষ্ণুর লক্ষ্মী-নারায়ণ রূপই বোধ হয় এই পর্বে বৈষ্ণব দেবদেবী রূপ-কল্পনার অন্যতম প্রধান দান। পূর্ব-বাঙলা ও উত্তর-বাঙলার কোনও কোনও স্থান হইতে লক্ষ্মী-নারায়ণের কয়েকটি প্রতিমা পাওয়া গিয়াছে; তন্মধ্যে ঢাকা জেলার বাস্তা গ্রামে প্রাপ্ত (ঢাকা-চিত্রশালা) একটি এবং দিনাজপুর জেলার এষ্ণাইল গ্রামে প্রাপ্ত আর একটি প্রতিমা এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। বিষ্ণুর বাম ঊরুর উপর উপবিষ্টা লক্ষ্মীকে দেখিলে সহজেই সমসাময়িক শৈব উমা-মহেশ্বরের প্রতিমার কথা মনে পড়ে। লক্ষ্মী-নারায়ণের পূজা ও রূপ-কল্পনার প্রসার দক্ষিণ ভারতেই ছিল বেশি এবং খুব সম্ভব সেন-বর্মণ-পর্বে দক্ষিণদেশ হইতেই এই পূজা ও রূপ-কল্পনা বাঙলাদেশে প্রবর্তিত হইয়াছিল। কবি ধোয়ী তাঁহার পবনদূত কাব্যে যেন ইঙ্গিত করিয়াছেন, লক্ষ্মী-নারায়ণ ছিলেন সেন-রাজাদের কুলদেবতা বাররামাদের নৃত্যগীত সহযোগে তাঁহার অর্চনা হইত।

অস্মিন সেনান্বয়নৃপতিনা দেবরাজ্যাভিষিক্তো
দেবঃ সুহ্মে বসতি কমলাকেলিকারো মুরারিঃ।
পাণৌ লীলাকমলসমকৃৎ যৎসমীপে বহস্ত্যো
লক্ষ্মীশঙ্কাং প্রকৃতিসুভগাঃ কুর্বতে বাররামাঃ।।

এই পর্বের কয়েকটি অবতার-মূর্তিও বাঙলাদেশের নানা জায়গায় পাওয়া গিয়াছে; ইহাদের মধ্যে বরাহ ও নরসিংহ অবতারই প্রধান। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, লক্ষ্মণসেন নিজের পরিচয় দিতেন পরমনারসিংহ বলিয়া। তিনি ছিলেন পরমবৈষ্ণব। বর্মণ বংশের রাজারা তো সকলেই পরমবৈষ্ণব : দেব-বংশের রাজারাও তাহাই। বিজয়সেন যদিও ছিলেন সদাশিবের ভক্ত, তবু প্রদ্যুম্নেশ্বরের এক মন্দিরে ভূমিদান করিতে তাঁহার বাধে নাই। প্রদ্যুম্নেশ্বর তো হরিহরেরই এক বিশিষ্ট রূপ। বিশ্বরূপ ও কেশবসেন তাঁহাদের রাজপট্ট আরম্ভ করিয়াছিলেন নারায়ণকে আবাহন করিয়া। কামদেবের একাধিক প্রতিমা এ-পর্যন্ত পাওয়া গিয়াছে, এবং তাহা উত্তরবঙ্গ হইতে। তাঁহার হাতে ইক্ষুদণ্ডের ধনু এবং বাণ, মুখে চতুর হাসি, গলায় ফুলের মালা; ত্রিভঙ্গ হইয়া তিনি দণ্ডায়মান। রাজশাহী-চিত্রশালার দুইটি প্রতিমাই বোধ হয় এই পর্বের।

সেন-বর্মণ পর্বের বাঙলাদেশ বৈষ্ণব ধর্মের ইতিহাসকে দুইটি দিকে সমৃদ্ধ করিয়াছে বলিয়া মনে হয়; একটি বিষ্ণুর দশাবতারের সমন্বিত ও রীতিবদ্ধ রূপ, আর একটি রাধাকৃষ্ণের ধ্যান ও রূপ-কল্পনা। বরাহ, বামন ইত্যাদি দুই চারিটি অবতারের নাম গুপ্ত লিপিমালাতেই দেখা যায়; পুরাণমালায় এবং মহাভারতেও বিষ্ণুর নানা অবতাররূপের পরিচয় বিধৃত। কিন্তু বিধিবদ্ধ সমন্বিত রূপের চেষ্টা বোধ হয় প্রথম দেখিতেছি ভাগবত পুরাণে। এই পুরাণে অবতাররূপের তিনটি তালিকা আছে, একটিতে বিষ্ণুর তেইশটি অবতার, একটিতে বাইশটি, একটিতে ষোলটি দেখা যাইতেছে, তখনও দশাবতাররূপ সমন্বিত ও বিধিবদ্ধ হয় নাই। পাল-পর্ব ও সেন-পর্বের লিপিমালায়ও কয়েকজন অবতারের খবর পাইতেছি। কিন্তু মধ্যযুগের এবং আজিকার ভারতবর্ষের প্রায় সর্বত্র যে দশাবতারের ঐতিহ্য সুপরিচিত, সেই দশাবতারের (মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নরসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, বলরাম, বুদ্ধ, কল্কি) প্রথম বিধিবদ্ধ সমন্বিত উল্লেখ পাইতেছি কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ-কাব্যে। শ্রীধরদাসের সদুক্তিকর্ণামৃত-গ্রন্থেও অবতার-বিষয়ক শ্লোকাবলীর মধ্যে দশাবতারের উল্লেখই প্রধান এবং তাহার মধ্যে আবার কৃষ্ণাবতার সম্বন্ধেই ষাটটি শ্লোক। পরবর্তীকালে চৈতন্য ও চৈতন্যোত্তর বাঙলায় বিষ্ণু-কৃষ্ণধর্মের যে-রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি তাহার আদি সংস্কৃতিত রূপ এই শ্লোকগুলির মধ্যেই নিবদ্ধ, এ-সম্বন্ধে সন্দেহ করিবার কারণ নাই। এ-অনুমানও অনৈতিহাসিক নয় যে, এই শ্লোকাবলীর অধিকাংশই পরমভাগবত বিষ্ণুকৃষ্ণভক্ত কবি মহারাজ লক্ষ্মণসেনের সভায় রচিত ও গীত হইয়াছিল। উপরোক্ত দশাবতারের তালিকা দীর্ঘতর তালিকার সঙ্গে সঙ্গে মহাভারত এবং বিষ্ণুপুরাণেও আছে; কিন্তু এই দুই গ্রন্থেই সংক্ষিপ্ত তালিকাটি দশাবতারের স্বীকৃতির পরবর্তীকালের সংযোজন। শেষোক্ত অবতার দুইটি বুদ্ধ ও কল্কি–তো বৌদ্ধদের ঐতিহ্য হইতেই গৃহীত।

হরিভক্তি বা স্তুতি সম্বন্ধে সদুক্তিকর্ণামৃতে অনেকগুলি শ্লোক আছে। একটি মাত্র শ্লোক উদ্ধার করিতেছি শ্লোকটি অজ্ঞাতনামা কোনও কবির রচনা। ইনি বাঙালী ছিলেন কিনা বলা কঠিন; তবে এই শ্লোকটি, কবি কুলশেখর-রচিত একটি শ্লোক এবং আরও দুই একটি শ্লোক বিশুদ্ধ ভক্তিধর্ম ও হৃদয়াবেগের যে-পরিচয় পাওয়া যায় তাহাতে মনে হয়, ইহাদের মধ্যে যেন চৈতন্যোত্তর বাঙলার একান্ত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ভক্তি ও হৃদয়াবেগ প্রত্যক্ষ করিতেছি।

যানি ত্বচ্চরিতামৃতানি রশনা লেহ্যানি ধন্যাত্মনাং
যে বা শৈশবচাপলব্যতিকরা রাধানুবন্ধোন্মুখাঃ।
যা বা ভাবিতবেণুগীত গতয়ো লীলসুখাম্ভোরুহে
ধারাবাহিতয়া বহন্তু হৃদয়ে তান্যেব তানোর মে।।

রাধাকৃষ্ণের ধ্যান-কল্পনাও বোধ হয় এই পর্বের বাঙলাদেশেরই সৃষ্টি এবং কবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ-গ্রন্থেই বোধ হয় প্রথম এই ধ্যান-কল্পনার সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুপ্রচলিত রূপ আমরা দেখিতেছি। হালের সপ্তশতীর একটি শ্লোকে রাধার উল্লেখ আছে, কিন্তু তাহার তারিখ সঠিক নির্ণয় করা দুঃসাধ্য। ভাসের বালচরিতে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও ভাগবত পুরাণে গোপীগণের সঙ্গে কৃষ্ণের প্রেমলীলার উল্লেখ আছে, কিন্তু তাহার মধ্যে রাধার উল্লেখ কোথাও নাই। ভোজবর্মার বেলাব-লিপিতেও শত গোপিনীর সঙ্গে কৃষ্ণের বিচিত্র লীলার ইঙ্গিত আছে কিন্তু সেখানেও রাধা নাই। সেন-পর্বের কোনও সময়ে বোধ হয় অন্যতমা গোপিনী রাধা কল্পিতা হইয়া থাকিবেন এবং খুব সম্ভব তাহা ক্রমবর্ধমান শক্তিধর্মের প্রভাবে। এই শক্তিধর্মের প্রভাব বৈষ্ণবধর্মেও লাগিয়াছিল, সন্দেহ নাই। সাধারণ ভাবে বলিতে গেলে বৈষ্ণবের কৃষ্ণ শাক্তের শিব, সাংখ্যের পুরুষ, আরও শিথিল ভাবে বলা যায়, বজ্রযানীর বোধিচিত্ত, সহজযানীর করুণা, কালচক্রযানীর কালচক্র; আর রাধা হইতেছেন শাক্তের শক্তি, সাংখ্যের প্রকৃতি, শিথিল ভাবে বজ্রযানীর নিরাত্মা, সহজযানীর শূন্যতা, কালচক্রযানীর প্রজ্ঞা। সমসাময়িক কালের এই চেতনার স্পর্শ বৈষ্ণবধর্মেও লাগিবে, ইহা কিছুই বিচিত্র নয়। পরবর্তী সহজিয়া বৈষ্ণব ধর্মের কৃষ্ণ-রাধা যে পুরুষ প্রকৃতি ও শিব-শক্তি ধ্যান-কল্পনার এক পরিবারভুক্ত, এ সম্বন্ধে তো কোনোই সন্দেহ নাই।

শৈব ধর্ম ও শাক্ত ধর্ম

সেন বংশের পারিবারিক দেবতা বোধ হয় ছিলেন সদাশিব। বিজয়সেন শিবের আবাহন করিয়াছিলেন শম্ভু নামে, বল্লালসেন করিয়াছেন ধুর্জটি এবং অর্ধনারীশ্বর নামে। লক্ষ্মণসেন এবং তাঁহার পুত্রদ্বয় লিপিতে নারায়ণের আবাহন করিলেও সদাশিবকে শ্রদ্ধা জানাইতে ভোলেন নাই। সেন-বর্মণ লিপিমালায় তন্ত্রোক্ত শিব-শক্তি ধ্যান-কল্পনার পরিচয় কিছু নাই, আগমান্ত শৈব-শাক্ত ধর্মেরও নয়। কিন্তু শেষোক্ত ধর্মের ধ্যান-কল্পনা যে গুপ্তোত্তর এবং পাল-পর্বের বাঙলায় সুপ্রচারিত হইয়াছিল তাহাতে সন্দেহ করিবার কারণ নাই। তাহার কিছু কিছু প্রমাণ আগেই উল্লেখ করিয়াছি। মধ্যযুগে যে সুবিস্তৃত তন্ত্র-সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের পরিচয় সেই তন্ত্র-সাহিত্যের কোনো গ্রন্থই বোধ হয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের আগে রচিত হয় নাই; তবে এ-কথা অনস্বীকার্য যে, অধিকাংশ তন্ত্রগ্রন্থই রচিত হইয়াছিল বাঙলাদেশে এবং এই দেশেই তান্ত্রিক ধ্যান কল্পনার এক সমন্বিত রূপ গড়িয়া উঠিয়াছিল। তাহা ছাড়া, এই সেন-বর্মন পর্বের লিপিতে ও সমসাময়িক সাহিত্যে আগম ও তন্ত্রশাস্ত্রের চর্চার কিছু কিছু উল্লেখ বর্তমান। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, ভবদেব ভট্ট দাবি করিয়াছেন, অন্যান্য অনেক শাস্ত্রের সঙ্গে তিনি তন্ত্র ও আগম-শাস্ত্রেও অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করিয়াছিলেন। আগমশাস্ত্রের প্রচলন পাল-পর্বেই দেখিতেছি; কেদার মিশ্রের পুত্র মন্ত্রী গুরুবমিশ্র আগমশাস্ত্রে পরম ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়াছেন, কিন্তু তন্ত্রের উল্লেখ এ-ক্ষেত্রে দেখিতেছি না। আগমশাস্ত্রের ইতিহাস সুপ্রাচীন এবং তাহা সর্বভারতীয়; কিন্তু তন্ত্র বলিতে পরবর্তীকালে আমরা যাহা বুঝিয়াছি তাহা বোধ হয় পূর্ব-ভারত, বিশেষ ভাবে বাঙলাদেশেই সৃষ্টি ও পুষ্টিলাভ করিয়াছিল। আগেই দেখিয়াছি, দেবীপুরাণ মতে বামাচারী দেবী-পূজার প্রচলন ছিল রাঢ়, কামরূপ, কামাখ্যা ও ভোট্টদেশে। তন্ত্রোক্ত দেবদেবীর লিপি-উল্লেখ বোধ হয় দুইটি ক্ষেত্রে আমরা পাইতেছি; একটি নয়পালের গয়ালিপিতে মহানীল-সরস্বতীর আর একটি হরিকালদেবের লিপিতে দুর্গোত্তারা নামে এক দেবীর উল্লেখ। বৌদ্ধ বজ্রযানী সহজযানী-কালচক্রযানী সাধনার মতোই তন্ত্রোক্ত বামা সাধনা একান্ত গুহ্য ব্যক্তিগত সাধনা; সেই জন্যই লিপিমালায় তাহার উল্লেখ বা আনুষ্ঠানিক ব্রাহ্মণ্য প্রতিমাপূজায় তাহার মূর্তি-প্রতীকের প্রমাণ না থাকা কিছু বিচিত্র নয়। তবে, পাল-পর্বের বৌদ্ধ গুহ্যসাধনা এবং ব্রাহ্মণ্য শক্তিসাধনা একে অন্যকে প্রভাবান্বিত করিয়াছিল এবং উভয়েই তান্ত্রিক ধ্যান-কল্পনার গভীর স্পর্শ লাভ করিয়াছিল, এ-সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ কোথাও নাই।

শিবের ঈশানরূপের চতুর্ভুজ ত্রিভঙ্গ একটি প্রতিমা পাওয়া গিয়াছে রাজশাহী জেলার গণেশপুর গ্রামে (রাজশাহী-চিত্রশালা)। সাধারণত ঈশানরূপী স্থানক শিবের যে ধরনের প্রতিমা বাঙলাদেশে সুপ্রাপ্য তাহা হইতে এই মূর্তিটি একটু ভিন্ন! কিন্তু এই ভিন্নতা এই পর্বেরই সৃষ্টি কিনা, নিঃসন্দেহে বলা কঠিন। কিন্তু নৃত্যপর শিবের যে দুই রূপ কল্পনার প্রতিমা বাঙলাদেশে পাওয়া গিয়াছে তাহার একটি নিঃসন্দেহে এই পর্বের সৃষ্টি এবং তাহা দক্ষিণ ভারতীয় প্রভাবের ফল। পাল-পর্বে একটি রূপের কথা আগেই বলিয়াছি; এই রূপটি অবিকল মৎস্যপুরাণের ধ্যান-কল্পনানুযায়ী। এই রূপটি দশ ভুজ। আর একটি রূপ দ্বাদশভুজ; দুই ভুজে একটি বীণা ধৃত, দুই ভাজ একটি নাগফণাছত্র এবং দুই ভুজে করতাল লক্ষণ। এই নটরাজ শিব যথার্থ নৃত্যগীতপটু এবং প্রতিমায় তাহাই ফুটাইয়া তুলিবার চেষ্টা করা হইয়াছে। দক্ষিণ ভারতে বীণাধরা দাক্ষিণ্যমূর্তি শিবের যে ধ্যান-কল্পনা সুপরিচিত, তাহার সঙ্গে এই প্রতিমাগুলির আত্মীয়তা সুস্পষ্ট।

শিবের সদাশিব রূপ-কল্পনাও বোধ হয় দক্ষিণ ভারতের দান। বাঙলাদেশে সদাশিব মূর্তি নানা জায়গা হইতেই পাওয়া গিয়াছে এবং ইহাদের মধ্যে সর্বপ্রাচীন মূর্তি বোধ হয় তৃতীয় গোপালের রাজত্বকালের (কলিকাতা-চিত্রশালা)। কিন্তু তৃতীয় গোপালদেবের রাজ্যকালের হইলেও এই রূপ-কল্পনা মোটামুটি সেন-পর্বেরই রচনা এবং তাহাও কতকটা বোধ হয় দক্ষিণ ভারতীয় প্রভাবে। বাঙলার সদাশিব প্রতিমাগুলির সঙ্গে দক্ষিণ ভারতীয় শিল্পশাস্ত্রের সদাশিব রূপ-কল্পনার আত্মীয়তা ঘনিষ্ঠ। সেন বংশের পারিবারিক দেবতা ছিলেন সদাশিব এবং তাঁহারা হয়ত উত্তর-ভারতীয় আগমান্ত সদাশিব ধ্যান-কল্পনার দক্ষিণ ভারতীয় রূপ বাঙলাদেশে প্রবর্তিত করিয়া থাকিবে।

শিবের উমা-মহেশ্বরের মূর্তিও এই পর্বে সুপ্রচুর। তন্ত্রধর্মের কেন্দ্র বাঙলাদেশে শিবউরুতে সুখসীনা, শিবকণ্ঠবিলগ্না উমার এবং মহেশ্বরের যুগল মূর্তির ধ্যান-কল্পনা সমাদৃত হইবে বিচিত্র কী : উত্তরবঙ্গে প্রাপ্ত (কলিকাতা-চিত্রশালা) উমা-মহেশ্বরের একটি প্রতিমা দ্বাদশ শতকীয় ভাস্কর-শিল্পের একটি সুন্দর নিদর্শন।

বাঙলাদেশে গাণপত্য ধর্ম ও সম্প্রদায়ের প্রসারের কোনও প্রমাণ এ-পর্যন্ত পাওয়া যায় নাই তবে, ঢাকা জেলায় মুন্সীগঞ্জের একটি পঞ্চমুখ দশভুজ, গর্জমান সিংহোপরি উপবিষ্ট গণেশের প্রতিমা পূজিত হয়। মূর্তিটি পাওয়া গিয়াছিল রামপালের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে। এই মূর্তিটি বোধ হয় গাণপত্য সম্প্রদায়-কল্পিত ধ্যানানুযায়ী রচিত এবং ইহার রূপ একান্তই দক্ষিণ ভারতীয় প্রতিমা শাস্ত্রের অনুমোদিত। প্রতিমাটির প্রভাবলীতে ছয়টি ছোট ছোট মূর্তি রূপায়িত; এই ছয়টি মূর্তি গাণপত্য সম্প্রদায়ের ছয়টি শাখার প্রতীক।

কার্তিকেয়ের স্বতন্ত্রমূর্তি দুর্লভ; কিন্তু এই পর্বের একটি স্বতন্ত্র কার্তিকেয় প্রতিমা কলিকাতা-চিত্রশালায় রক্ষিত আছে (উত্তরবঙ্গে প্রাপ্ত); ময়ূর-বাহনের উপর মহারাজ লীলায় কার্তিকেয় উপবিষ্ট, দুইপাশে দেবসেনা ও বল্লীনামে পত্নীদ্বয়। এই প্রতিমাটি দ্বাদশ শতকীয় ভাস্করশিল্পের সুন্দর অভিজ্ঞান।

শক্তি প্রতিমার মধ্যে এই পর্বের কয়েকটি প্রতিমা খুব উল্লেখযোগ্য। উত্তরবঙ্গে প্রাপ্ত এবং বর্তমানে কলিকাতা-চিত্রশালায় রক্ষিত একটি চতুর্ভুজা দেবীপ্রতিমার এক হাতে পদ্ম, এক হাতে দর্পণ; তাঁহার দক্ষিণে গণেশ, বামে পদ্মকলিধৃতা একটি নারী; প্রতিমার পাদপীঠে গোধিকার প্রতিকৃতি। লক্ষ্মণসেনের তৃতীয় রাজ্যাঙ্কে প্রতিষ্ঠিতা একটি দেবীপ্রতিমাকে উৎকীর্ণ লিপিতে বলা হইয়াছে চণ্ডী। দেবী চতুর্ভূজা এবং সিংহবাহিনী। প্রতিমাটিকে চণ্ডী যে কেন বলা হইয়াছে, বলা কঠিন, কারণ চণ্ডীর যে রূপ-বর্ণনা প্রতিমাশাস্ত্রে সচরাচর দেখা যায় তাহার সঙ্গে এই প্রতিমাটির কোনও মিল নাই। শারদাতিলকতন্ত্রে এই ধরনের প্রতিমার নামকরণ করা হইয়াছে ভুবনেশ্বরী। পাল-পর্বের শক্তি প্রতিমা প্রসঙ্গে ঢাকা জেলার শক্ত গ্রামে প্রাপ্ত (ঢাকা-চিত্রশালা) একটি মহিষমর্দিনী প্রতিমার কথা বলিয়াছি; মূর্তিটি দ্বাদশ শতকীয় শিল্পের নিদর্শন এবং সেই হেতু সেন-পর্বের বলাই সঙ্গত। কিন্তু লক্ষণীয় হইতেছে এই যে, পাদপীঠে উৎকীর্ণ লিপিটিতে প্রতিমাটিকে বলা হইয়াছে, “শ্ৰী মাসিক-চণ্ডী।” এই যুগে সব দেবী মূর্তিকেই কি চণ্ডী বলা হইত? পাল-পর্বে আলোচিত, বাখরগঞ্জ জেলার শিকারপুর গ্রামের উগ্রতারার প্রতিমাটিও বোধ হয় এই পর্বেরই এবং তান্ত্রিক শক্তিধর্মের নিদর্শন।

দেবীর চামুণ্ডারূপের দুই চারিটি প্রতিমাও পাওয়া গিয়াছে এই পর্বের বাঙলাদেশে। কিন্তু ইহাদের নূতন করিয়া উল্লেখের কিছু নাই।

একাধিকবার বলিয়াছি, বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেন ছিলেন সূর্যভক্ত, পরমসৌর। সূর্যদেবের পূজা আরও প্রসার লাভ করিয়াছিল এই পর্বে, এ সম্বন্ধে সন্দেহ করিবার কারণ নাই। কুলজী গ্রন্থমালার ঐতিহ্য স্বীকার করিলে মানিতে হয়, বাঙলাদেশে শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণেরা শশাঙ্কের আমলেই আসিয়া আবির্ভূত হইয়াছিলেন; কিন্তু গয়া-জেলার গোবিন্দপুর লিপি এবং বৃহদ্ধর্মপুরাণের সাক্ষ্য একত্র করিলে মনে হয়, তাঁহাদের প্রসার ঘটিয়াছিল সেন-বৰ্মণ পর্বেই। কিন্তু যখনই হউক, এ তথ্য সুবিদিত যে, শাকদ্বীপী মগ ব্রাহ্মণেরাই উদীচ্যবেশী সূর্য-প্রতিমা ও তাহার পূজা ভারতবর্ষে প্রবর্তন করিয়াছিলেন এবং ক্রমশ পূর্ব-ভারতে তাহা প্রচারিত ও প্রসারিত হইয়াছিল। এই পর্বের একাধিক সূর্য প্রতিমা বিদ্যমান, কিন্তু একটি প্রতিমা ছাড়া অন্যগুলি সম্বন্ধে নূতন করিয়া বলিবার কিছু নাই। এই ত্রি-শির দশভুজা সূর্য-প্রতিমাটি পাওয়া গিয়াছে রাজশাহী জেলার মান্দা গ্রামে। তিনটি মুখের দুই পাশের দুটি উগ্ররূপের এবং দশ হাতের আটটিতে পদ্ম, শক্তি, খট্টাঙ্গ, নীলোৎপল এবং ডমরু। সারদাতিলকমন্ত্র মতে এই ধরনের সূর্যমূর্তিকে বলা হয় মার্তণ্ড-ভৈরব, অর্থাৎ সূর্য এবং ভৈরবের মিশ্ররূপ। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, এই উদীচ্যবেশী সূর্য-প্রতিমা ও তাহার পূজা বোধ হয় সেন-বর্মণ পর্বের পরে বেশি দিন আর প্রচলিত থাকে নাই; অন্তত মধ্যযুগীয় সুবিস্তৃত সাহিত্যে তাহার পরিচয় কিছু পাইতেছি না। পদ্মোপরি স্থানক ভঙ্গিতে দণ্ডায়মান চতুর্ভুজ সূর্যদেব, দুইপাশে ঊষা ও প্রত্যূষা দুই স্ত্রী এবং পায়ের কাছে সম্মুখেই অরুণ-সারথি; রূপ-কল্পনার দিকে হইতে এই প্রতিমার সঙ্গে স্থানক ভঙ্গিতে দণ্ডায়মান চতুর্ভূজ বিষ্ণু, দুই পাশে লক্ষ্মী ও সরস্বতী নামে দুই স্ত্রী এবং পায়ের কাছে সম্মুখেই বাহন গরুড়, এই প্রতিমার পার্থক্য কিছু বিশেষ নাই। তাহা ছাড়া বিষ্ণুর সঙ্গে সূর্যের একটা সুপ্রাচীন বৈদিক সম্পর্ক তো ছিলই। কাজেই, অন্তত বাঙলাদেশে বিষ্ণুর পক্ষে সূর্যকে গ্রাস করিয়া ফেলা কিছু কঠিন হয় নাই।

অন্যান্য দেবদেবীর প্রতিমার মধ্যে মনসার কথা আগেই বলিয়াছি। হারীতী ও যষ্ঠী দেবীর কথাও বলা হইয়াছে। রাজশাহী জেলার মীরপুর গ্রামে একটি এবং বগুড়া জেলার সাম্ভ গ্রামে একটি ষষ্ঠী-প্রতিমা পাওয়া গিয়াছে; উভয় ক্ষেত্রেই দেবীর ক্রোড়ে একটি মানবশিশু এবং দোল্যমান দক্ষিণপদের নীচেই একটি মার্জার। দিকপালদের দুই চারিটি প্রতিমার খবরও পাওয়া যায়।

গীতগোবিন্দ রচয়িতা কবি ও সংগীতকার জয়দেবের বিষ্ণু বা হরিভক্তি বিষয়ক কয়েকটি শ্লোক সদুক্তিকর্ণামৃত গ্রন্থে উদ্ধার করা হইয়াছে; কবি শরণদেব রচিত শ্লোকও আছে। কিন্তু জয়দেব শুধু রাধা মাধব স্তুতিই রচনা করেন নাই; তিনি নিজে একান্তভাবে বৈষ্ণবও ছিলেন না, ছিলেন পঞ্চদেবতার উপাসক স্মার্ত ব্রাহ্মণ গৃহস্থ। তাঁহার রচিত মহাদেব-স্তুতি বিষয়ক শ্লোক সদুক্তিকর্ণামৃতে উদ্ধৃত আছে (১৪৪)। শিব-গৌরীর বিবাহ-প্রসঙ্গ লইয়া মধ্যযুগীয় বাঙলা সাহিত্যে যে ধরনের চিত্র ও কল্পনা বিস্তৃত ঠিক সেই ধরনের চিত্র ও কল্পনার সাক্ষাৎ পাইতেছি এক অজ্ঞাতনামা কবি রচিত সদুক্তিকর্ণামৃত-ধৃত নিম্নোক্ত শ্লোকটিতে :

ব্রহ্মায়ং—বিষ্ণুরের–ত্রিদশপতিরসৌ–লোকপালাস্তুথৈতে
জামাতা কোহন? সোহসৌ ভুজগপরিবৃত্তো ভূস্মরূক্ষ্মঃ কপালী!
হা বৎসে বঞ্চিতাসীত্যনভিমতবর প্রার্থনাব্রীড়িভির
দেবীভিঃ শোষ্যমানাপাপচিত পুলকা শ্রেয়সে বোহস্তু গৌরী!!

শ্লোকটি পড়িলে মনে হয়, ভারতচন্দ্রের শিব-গৌরীর বিবাহ-বর্ণনা পড়িতেছি। এই অজ্ঞানতামা কবিটি কি বাঙালী ছিলেন?

সদুক্তিকর্ণামৃতে কালী সম্বন্ধেও কয়েকটি শ্লোক আছে, এবং ইহাদের কয়েকটি বাঙালী কবি বিরচিত, সন্দেহ নাই। কিন্তু এই সব শ্লোকে কালীর যে চিত্র বা ধ্যান, তাহা আমাদের মধ্যযুগীয় বা বর্তমান ধ্যান-কল্পনা হইতে পৃথক। মুসলমানাধিকারের পর বাঙালীর কালী ধ্যান-কল্পনায় পরিবর্তন সাধিত হইয়াছে বলিয়া মনে হইতেছে। কী কারণে কী উপায়ে তাহা হইয়াছে তাহা অনুসন্ধানের বস্তু।

উমাপতিধরের একটি শ্লোকে কার্তিকের শিশুলীলার বর্ণনা আছে; পিতা শিবের বেশভূষা অনুকরণ করিয়া শিশু কার্তিক খুব কৌতুক অনুভব করিতেছেন। জলচন্দ্র নামে আর একজন কবি (বোধ হয় বাঙালীই হইবেন) অন্য আর একটি শ্লোকে শিশু কার্তিকের একটি ছবি আঁকিয়াছেন; সে চিত্রে কার্তিক পিতা শিবের জটাজুট লইয়া ক্রীড়ারত।

সদুক্তিকর্ণামৃতের অনেকগুলি শ্লোকে দরিদ্র ভিখারী শিবের গৃহস্থালির বর্ণনা আছে। এই সব ছবি মধ্যযুগীয় বাঙলা সাহিত্যে এত সুপ্রচুর এবং সাধারণ পল্লীবাসী গৃহস্থ বাঙালীর চিত্তের এত নিকট যে, মনে হয়, ইহাদের রচয়িতারা বুঝি-বা বাঙালীই ছিলেন। যাহা হউক, এ তথ্য নিঃসংশয় যে, এই ধরনের কার্তিক বা শিব-কল্পনার সূচনা মুসলমানাধিকাররের আগেই দেখা গিয়াছিল।

গঙ্গাভক্তি বাঙালীর সুপ্রাচীন; সদুক্তিকর্ণামৃতে গঙ্গা সম্বন্ধে অনেকগুলি শ্লোক আছে। তাহার মধ্যে একটি বাঙালী কেবট বা কেওট কবি পপীপের রচনা :

বদ্ধাঞ্জলি নৌর্মি—কুরু প্রসাদম্, অপূর্বমাতা ভব, দেবি গঙ্গে!
অন্তে বয়স্যঙ্কগতায় মহ্যম অদেয়বন্ধায় পয়ঃ প্রযচ্ছ।

আর একটি বঙ্গালদেশীয় অজ্ঞাতনামা এক কবির রচনা : তিনি নিজের বাণী বা ভাষাকে গঙ্গার সঙ্গে তুলনা করিয়াছেন। প্রচুর জল বিশিষ্ট, গভীর, বঙ্কিম, মনোহর এবং কবিদের দ্বারা কীর্তিত বা উপজীবিত গঙ্গায় অবগাহন করিলে (দেহ মন) যেমন পবিত্র হয়, তেমনই ঘনরসময়, গভীর অর্থবহ, ব্যঞ্জনাযুক্ত, মনোহর এবং কবিদের দ্বারা উপজীবিত বঙ্গালবাণী বা ভাষায় অবগাহন করিলে পবিত্র হওয়া যায়। শ্লোকটি অন্যত্র উদ্ধার করিয়াছি, পুনরুক্তিভয়ে এখানে আর করিলাম না।