গাছপূজা, নানা প্রকারের মাতৃতন্ত্রীয় দেবীর পূজা, ক্ষেত্রপালের পূজা, নানা লৌকিক দেবতা-উপদেবতার পূজার কথা আগেই বলিয়াছি। গ্রামের উপান্তে বসতির বাহিরে যে-সব জায়গায় এই সব অনুষ্ঠান হইত এবং এখনও হয় সে সব পূজাস্থানকে আশ্রয় করিয়া বাঙলার নানাজায়গায় নানা-তীর্থস্থান গড়িয়া উঠিয়াছে। এই ধরনের গাছ বা অন্যান্য গ্রাম্য লৌকিক দেবদেবীর পূজার কিছু কিছু বিবরণ বাঙালীর প্রাচীনতম সাহিত্যে বিবৃত হইয়া আছে। বটগাছের পূজা সম্বন্ধে কবি গোবর্ধন-আচার্যের একটি শ্লোক আছে:
ত্বয়ি কুগ্রাম বটদ্রুম বৈশ্রবণো বসতু বা লক্ষ্মৌঃ।
পামরকুঠারপাতাৎ কাসরশিরসৈব তে রক্ষা।।
হে কুগ্রামের বটগাছ, তোমার মধ্যে বৈশ্রবণের (কুবের) অথবা লক্ষ্মীর অধিষ্ঠান থাকুক বা না থাকুক, মূর্খ গ্রাম্য লোকের কুঠারাঘাত হইতে তোমাকে রক্ষা করে শুধু মহিষের শৃঙ্গ তাড়না।
সদুক্তিকর্ণামৃতের একটি শ্লোকে গ্রাম্য লৌকিক দেবদেবী পূজার একটি ভালো বিবরণ পাওয়া যায়।
তৈস্তৈর্জীরোপহারৈগিরি কুহরশিলা সংশ্রয়ামর্চয়িত্বা।
দেবীং কান্তারদুর্গাং রুধিরমুপতরু ক্ষেত্রপালায় দত্বা।
তুম্বীবীণা বিনোদ ব্যবহৃত সরকামহ্নি জীর্ণে পুরাণীং
হালাং মালুরকৌষের্যুবতি সহচরা বর্বরাঃ শীলয়ন্তি।।
বর্বর [গ্রাম্যলোকেরা] নানা জীববলি দিয়া পাথরের পূজা করে, রক্ত দিয়া কান্তারদুর্গার পূজা করে, গাছতলায় ক্ষেত্রপালের পূজা করে, এবং দিনের শেষে তাহাদের যুবতী সহচরীদের লইয়া তুম্বীবীণা বাজাইয়া নাচগান করিতে বেলের খোলায় মদ্যপান করিয়া আনন্দে মত্ত হয়।
কৃষিকর্ম সংক্রান্ত নানাপ্রকার দেবদেবীর পূজার কথাও আগেই বলিয়াছি। আখমাড়াই ঘরের (বা যন্ত্রের?) যিনি ছিলেন দেবতা তিনি পণ্ডাসুর (পুণ্ড্রাসুর) নামে খ্যাত, আর পুণ্ড্র বা পুঁড় যে একপ্রকারের আখ তাহা তো অন্য প্রসঙ্গে একাধিকবার বলিয়াছি। উত্তর ও পশ্চিম-বঙ্গে এই পণ্ডাসুরের পূজা এখনও প্রচলিত; সেখানে তিনি পড়াসর (সংস্কৃতিকরণ পরাশর) নামে খ্যাত। এর পূজার অর্বাচীন একটি মন্ত্র এইরূপ :
পণ্ডাসুর ইহাগচ্ছ ক্ষেত্রপাল শুভপ্রদ।
পাহি মামিক্ষুযত্রৈস্ত্বং তুভ্যং নিত্যং নিত্যং নমো নমঃ।।
পণ্ডাসুর নমস্তুভ্যামিক্ষুবাটি নিবাসিনে।
যজমান হিতার্থাং গুড়বৃদ্ধিপ্রদায়িনো।।