বৈশম্পায়ন রায়

অপারেশান রেড হেরিং

বৈশম্পায়ন রায়

এক সন্ধ্যায় অনেকদিন পরে মুনলাইট বারে ঢুকেছিলাম। আজকাল আর আগের মতো নিয়মিত মদ্যপান করি না। কোনও কোনও দিন মন খারাপ থাকলে বড় জোর তিন পেগ টানি। বিকেলে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। জানি না, বৃষ্টি আমার মন খারাপের কারণ কিনা।

চৌরঙ্গিপাড়ার এই বারটা ছোট হলেও ছিমছাম, ভদ্র, শান্ত। দরদাম অন্যান্য বারের তুলনায় অনেক বেশি। আসলে যাঁরা নিরিবিলি নিঝুম পরিবেশে এবং শালীনতার মধ্যে থেকে মদ্যপানের অনাবিল আনন্দ পেতে চান, তাদের জন্য! মুনলাইট চমৎকার।

দৈত্যের মতো প্রকাণ্ড একজন লোক কাউন্টারের কাছে দাঁড়িয়ে নজর রাখে। মাতলামির সূচনা দেখলেই সে সামনে এসে দাঁড়ায়। নিচু গলায় চলে যেতে বলে। না গেলে সে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে গিয়ে রাস্তায় ফেলে দেয়। অ্যাংলোইন্ডিয়ান এই লোকটির নাম চাংকো।

কয়েক চুমুকের পর সিগারেট ধরিয়েছি, কেউ আমার টেবিলের সামনে এসে বসল। আস্তে বলল, “এক্সকিউজ মি! যদি আমি ভুল করে থাকি, তুমি বাসু না?”

ওকে দেখামাত্র চিনতে পারলাম। সমীর রুদ্র। পঁচিশটা বছর সামান্য সময় নয়। পঁচিশ বছরে পৃথিবীতে অনেকরকম ঘটনা ঘটে গেছে। অনেক কিছু ওলটপালট হয়েছে। সমীরকে শেষবার দেখেছি কবে? ভাবতে গিয়ে মাথার ভেতর ঠাণ্ডাহিম চিল গড়িয়ে গেল। মুখ নামিয়ে গেলাসে চুমুক দিয়ে বললাম, “সরি! আপনি ভুল করেছেন!”

সমীর আমার মুখের দিকে তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাকানোর চেষ্টা করল। কিন্তু ওর দু’চোখে নেশার ঘোলাটে ছাপ দেখতে পেলাম। সে হঠাৎ হাসল। “নাহ্! আমি ভুল করিনি। তুমি বাসু। আরে বাবা! এই তো সেদিনকার কথা। তুমি দাড়ি-ফাড়ি রেখে মোটকু হয়েছ। চোখে চশমা-টশমা এঁটেছ! তাই বলে কি আমি চিনতে পারব না? হুঁ, ফরেনের সায়েবি খাদ্য খেয়ে হেথ ফিরিয়েছ। ক’বছর ছিলে যেন? সেভেন অর এইট ইয়ার্স?”

তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। এই বারে ঢোকার সময় ওকে লক্ষ করিনি কেন? এখন আর কিছু করার নেই। এই সন্ধ্যায় নিয়তি আমাকে মুনলাইটে টেনে এনেছে।

“বাসু! পাস্ট ইজ পাস্ট। ডেড ইজ ডেড”। সমীর আরও হাসল। “আজকাল অবশ্য শেক্সপিয়ারের ভাষায় ‘ফেয়ার ইজ ফাউল অ্যান্ড ফাউল ইজ ফেয়ার। যাই হোক, কাম টু দা পয়েন্ট! অনি! অনিকে নিয়েই তো ব্যাপার। সো হোয়াট? আরে বাবা, আমি কি তোমাকে”

হেঁচকি তার কথা বন্ধ করল। বেশ কয়েক পেগ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় দুটো কাজ আমি করতে পারি। তাকে অনর্গল কথা বলতে দিতে পারি। তা হলে চাংকো ওকে বাইরে নিয়ে যাবে। কিংবা আমি উঠে যেতে পারি।

কিন্তু গেলাস শেষ না করে উঠে গেলে কে কী ভাববে! বললাম, “প্লিজ ডোন্ট ডিসটার্ব মিস্টার!”

সমীর বলল, “তুমি সুখে আছ। আমিও মন্দ নেই। আমার বউ পালিয়ে গেছে। তোমার হয়তো যায়নি। এই তো ডিফারেন্স। ফ্রেইলটি! দাই নেম ইজ উওম্যান। মেয়ে নিয়েই রামায়ণ-মহাভারত-ট্রয়ের যুদ্ধ। ওক্কে বাসু! অনির সঙ্গে আমার বিয়ের পিঁড়িতে বসার কথা ছিল। ফস্কে গেল। যাক্। তার জন্য দুঃখ করিনি। তো তুমি মাইরি”

গেলাস শেষ করে উঠে দাঁড়ালা। আমার শরীরের ওজন বেড়ে গিয়েছিল। বললাম, “এগেন সরি মিস্টার! য়ু আর টকিং টু আ রং পার্সন।”

“যা বাবা!” সমীরও উঠে দাঁড়াল। “রং পার্সন? মে বি। অনি আমাকে বলত, তুমি রং পার্সন! তা হলে রাইট পার্সন কে? প্রশান্ত? হ্যাঁ। কিন্তু শেষে প্রশান্তও রাইট পার্সন হতে পারল না। বাসু, উই দা থ্রি মাস্কেটিয়ার্স আর অল রংও রাইট পান। তা হলে রাহুরং পার্সন

‘চাংকো এগিয়ে এল। তাকে বললাম, “ইট ইজ অল রাইট চাংকো!” তারপর কাউন্টারে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট রেখে দ্রুত বেরিয়ে গেলাম।

কালো অ্যাম্বাসাডার আস্তে ড্রাইভ করছিলাম। মনে হচ্ছিল একটা অচেনা শহরের রাস্তায় হারিয়ে যাচ্ছি।

একটু পরে দেখি, মৌলালি পেরিয়ে, সি আই টি রোড ধরে চলেছি। নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেললাম। কোথায় যাচ্ছি আমি? নিয়তি আমাকে তুলে নিয়েছে।

পঁচিশ বছর আগে আমার বয়স ছিল পঁচিশ। অনির বয়স বড়জোর ঊনিশ বা কুড়ি। অনি আমাকে বলেছিল, “কলেজ থেকে বেরিয়েই বিয়ের মুখে পড়ার মানে হয় না। আমার মা তত সেকেলে মানুষ নন; কিন্তু আমার মামাটি একেবারে শকুনিমামা।”

অনি আমার কাছে কি পরামর্শ চেয়েছিল? জানি না। তখন আমি পরামর্শ বিশেষজ্ঞও ছিলাম না এখনকার মতো। এখন আমি ফরেন ট্রেডিং কনসালট্যান্সি খুলেছি। সারা পৃথিবী চক্কর খেয়ে কলকাতায় ফিরেছি গত জানুয়ারিতে। এখন অনেক লোককে পরামর্শ দিতে পারি। তখন আমি প্রায় নিঃসম্বল এক আনাড়ি যুবক।

আসলে হয়তো অনিকে আমি এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম। তার ওপর একটা চাপা ক্ষোভই এর কারণ।

তার আগের বছর দীঘা বেড়াতে গিয়ে সে এক কেলেঙ্কারি।

দীঘার হোটেল দা শার্কের ১৭ নম্বর ঘরের এপিসোডটি আমার খুব ভেতরকার একটি যন্ত্রণাদায়ক ক্ষত। কতকাল তার যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে। ব্যর্থতার যন্ত্রণা যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে, আমি জানি।

অনির প্রেমে তখন আমি এত অস্থির যে কোনও হঠকারিতায় পিছ-পা ছিলাম না। সব রকমের ঝুঁকি নিয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম।

দীঘা যাওয়ার প্রস্তাবটা যখন অনিকে দিই, ধরেই নিয়েছিলাম অনি সরাসরি না করে দেবে।

কিন্তু আমার বুক কাঁপিয়ে সে এক কথায় রাজি হয়ে গেল। কথাটা সে ঠিক বুঝেছে কিনা যাচাই করার জন্য বললাম, “তুমি আর আমি একা যাচ্ছি কিন্তু।”

অনি আমাকে আরও অস্থির করে বলল, “হ্যাঁ, একাই তো ভাল। দল থাকলে বড্ড বেশি হইচই হয়। তুমি তো জানো বাসুদা, আমি ওসব একেবারে পছন্দ করি না।”

“কিন্তু মাসিমা তোমাকে একা যেতে দেবেন তো?”

 “কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে এক্সকারসনে যাচ্ছি বলব।”

হোটেল দা শার্কের সতের নম্বর ঘরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যার সমুদ্র দেখছিল অনি। ব্যালকনির আলোটা নিভিয়ে দিয়ে ওকে আদর করতে গেলাম। অনি চমকে উঠে সরে গেল। “এ কী করছ বাসুদা! তুমি এত অসভ্য তা তো জানতাম না?”

“অনি, আমি তোমাকে ভালবাসি।”

“আশ্চর্য! ভালবাসলে অসভ্যতা করতে হয় বুঝি?”

 “তুমি একে অসভ্যতা ভাবছ কেন? এটাই তো ভালবাসার ভাষা, অনি!”

 “আমি ওসব ভাষাটাষা বুঝি না। তুমি আমাকে ওভাবে ছোঁবে না।”

রাগ হল। বললাম, “তুমি-আমি এই হোটেলে স্বামী-স্ত্রী বলে নাম লিখিয়েছি। তোমার সিঁথিতে সিঁদুর।”

অনি ফুঁসে উঠল। “তুমি বললে এটা ট্রিকস। স্বামী-স্ত্রী না হলে রুম পাওয়া। যাবে না।”

আমার মেজাজ চড়ে গেল। “তুমি নেকি! তুমি আমার সঙ্গে একা চলে এলে। তুমি জানো না–জানতে না এভাবে আসার কী মানে?”

অনি হঠাৎ কেঁদে ফেলল। “কিন্তু আমি তো সমুদ্র দেখতে এসেছিলাম। আমি কখনও সমুদ্র দেখিনি। সমুদ্র দেখার জন্য তুমি আমার কাছে দাম চাইছ বাসুদা? আমি তোমাকে এমন খারাপ তো ভাবিনি!”

সে একটা অসহ্য রাত। অনি কিছু খেল না। সারা রাত ব্যালকনিতে বসে কাটিয়ে দিল।

পরে এই এপিসোড়টা খুঁটিয়ে সারণ করতাম আর বুঝতে চাইতাম, অনি কি সত্যি নিছক সমুদ্র দেখার জন্য এই ঝুঁকি নিয়েছিল, নাকি হঠকারিতার পর নিজেকে সামলে নিয়েছিল ওভাবে? অনির মধ্যে একটা রহস্য ছিল। অথবা অনি সেই দলের মেয়ে, যারা জানে না কী করতে কী করে বসছে?

শিজোফ্রেনিয়ার রোগীদের কাছে বাস্তব-অবাস্তবের সীমানা মুছে যায়। অনি হয়তো জন্ম-শিজোফ্রেনিক ছিল। সে জানত না, সে কী করছে।

অনির মায়ের ইচ্ছা ছিল আমিই অনিকে বিয়ে করি। কথাটা আমার কানে এলে সঙ্গে সঙ্গে না করে দিয়েছিলাম। তাই সমীর রুদ্র অনির কাছাকাছি এসে পড়ে। সমীরকে সামনাসামনি খুব পাত্তা দিত অনি; কিন্তু পেছনে আমার কাছে ওর বদনাম গাইত। কারণ সমীর ছিল দুর্ধর্ষ প্রকৃতির মস্তানটাইপ ছেলে। ওকে সে ভীষণ ভয় পেত। দীঘার এপিসোড সম্পর্কে অনি নিজেই একদিন আমাকে বলেছিল, “ভাগ্যিস তুমি! অন্য কেউ হলে আমার সাংঘাতিক সর্বনাশ হয়ে যেত। তোমার বিবেক আছে, বাসুদা!”

অনি আমার বিবেক থাকার কথা বলেছিল। আমি জানতাম না, আমার মধ্যে বিবেক আছে। তারপর থেকে সেই বিবেক আমাকে যখন-তখন চিমটি কাটে।

ডানদিকে গলির মুখে গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে গেলাম। এই তো সেই গোড়াবাঁধানো বটগাছটা; তার পাশে একতলা বাড়ি ছিল। সেখানে পাঁচতলা বিশাল একটি বাড়ি। গেট বন্ধ। বটতলার কাছে একটা টালির ঘরে জামা-কাপড় ইস্ত্রি করছিল একটা লোক। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “ইয়ে মকান কিসকা হ্যায়?”

“কৈ আগরওয়ালসাবকা।”

“হেঁয়া এক ছোটা মকান থি। এক মা আউর এক লড়কি থি। খেয়াল হ্যায়?”

 “জি। উও মাইজি তো বহত সাল আগে মর গেয়ি।”

“লড়কিকি খবর?”

 “মুঝে নেহি মালুম, সাব! আউর কিসিকো পুছিয়ে!”

বাড়ি ফেরার পথে নিজেকে চড় মেরে সায়েস্তা করতে ইচ্ছা হচ্ছিল। এটাই তো নিয়ম। সবকিছু বদলে ওলট-পালট হয়ে গেছে। আবার কেন পিছু ফিরে খোঁজা?

অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে কতক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম। সারারাত ঘুমোতে পারলাম না। পরদিন সব বড় ইংরেজি বাংলা দৈনিক পত্রিকার অফিসে গিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে এলাম। অতিরিক্ত চার্জ দিয়ে জরুরি বিজ্ঞাপন। দুদিন পরে বিজ্ঞাপনটা বেরুল।

‘অনামিকা সেন, তুমি যেখানেই থাকো সাড়া দাও।
–বাসুদা।
বক্স নং…’

 প্রায় এক সপ্তাহ পরে কাগজগুলো থেকে কয়েকটা চিঠি দিয়ে গেল। প্রত্যেকটি কাগজ থেকে একটি করে খাম। খামের ভেতর একটি করে চিঠি।  প্রত্যেকটি চিঠিতে লালকালিতে লেখা আছে :

‘বৈশম্পায়ন রায় ওরফে বাসুকে সাবধান করা যাইতেছে, সে যেন অনামিকা সেন সম্পর্কে এতটুকু কৌতূহল প্রকাশ না করে। করিলে তাহার সাংঘাতিক বিপদ হইবে।‘

 ছ’খানা খামের ভেতর একই কাগজে একই কালিতে লেখা একই চিঠি। কিছুক্ষণ আচ্ছন্ন অবস্থায় বসে রইলাম। সমীর রুদ্রের সঙ্গে দৈবাৎ যোগাযোগ। হয়ে গিয়েছিল। তাকে পাত্তা না দিয়ে ভুল করেছি। তাকেই এখন সবচেয়ে বেশি দরকার। মুনলাইটে গিয়ে চাংকোর কাছে শুনলাম, সে তাকে সেদিন সন্ধ্যায় বের। করে দিয়েছিল। কাজেই এ বারে তার আসার চান্স নেই।

এলাকার প্রায় প্রত্যেকটা বারে অনেকগুলো সন্ধ্যা কাটিয়েও সমীরকে আর খুঁজে বের করতে পারলাম না। প্রতি সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে অনির কথা ভাবি আর মাথার ভেতর আগুন ধরে যায়। জীবনে অনেক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করেছি। এই চ্যালেঞ্জটার সামনে দাঁড়াতে পারব না?

গতরাতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল, আমার এক পুরনো বন্ধু অরিজিৎ লাহিড়ির কথা। সে পুলিশ অফিসার! সম্ভবত আই পি এস। এখন কোথায় আছে সে? টেলিফোন ডাইরেক্টরি খুলে বসলাম।

লাহিড়ি এ। ডি সি ডি ডি।

 কিন্তু একই নম্বরে অনেকগুলো নাম। আগে রিং করে জেনে নেওয়া যাক পুরো নামটা অরিজিৎ লাহিড়ি কিনা।

অনেকক্ষণ রিং হল। কেউ সাড়া দিল না। তখন ১০০ নম্বরে লালবাজারে ডায়াল করলাম। সাড়া এল। হ্যাঁ, এ লাহিড়ি অরিজিৎ লাহিড়ি। তবে এখন তাকে পাওয়া যাবে না।….

.

জয়ন্ত চৌধুরী

প্রাইভেট ডিটেকটিভ কে কে হালদার খবরের কাগজ পড়ছিলেন। হঠাৎ খি খি করে হেসে উঠলেন।

জিজ্ঞেস করলাম, “কী হল হালদার মশাই? হাসছেন কেন?”

“হাসব না?” হালদারমশাই কাগজের পাতায় লম্বা তর্জনী রেখে বললেন, “লিখছে, মশার কয়টি দাঁত আছে? ৪৭টি। হঃ! গুনল কেডা? মশয়! আইজকাইল এই কুইজ কুইজ ধান্দা পোলাপানগো সর্বনাশ কইরা ছাড়ব। আবার লিখছে, মাকড়সার জাল লম্বা করলে কত মাইল হয়? ৫০০ মাইল। কেডা লম্বা করল? খালি ধান্দাবাজি।”

হালদারমশাই কাগজ ভাঁজ করে সোফার কোণের দিকে ছুঁড়ে দিলেন। তারপর একটিপ নস্যি নিলেন। মনে হল, হাঁচবার চেষ্টা করছেন। কিন্তু হাঁচি এল না। রুমাল বের করে নাক মুছে আপনমনে বললেন, “চাইরদিকে খালি ধান্দাবাজি।”

কর্নেল নীলাদ্রি সরকার একটা ঘাসফড়িংয়ের রঙিন ছবির ওপর আতস কাঁচ রেখে কী সব দেখছিলেন। বললেন, “হালদারমশাই ঠিকই বলেছেন। তবে–”

ওঁর কথার ওপর বললাম, “তবে ধান্দাবাজির অনেক ডাইমেনশন আছে। যেমন, প্রায় আধঘণ্টা ধরে একটা গ্লাসহপারের চিত্ৰদৰ্শন!”

“ডার্লিং! এটা সিস্টেসার্কা গ্রেগরিয়া প্রজাতির ফড়িং। এদেরই পঙ্গপাল বলা হয়। এরা মূর্তিমান সর্বনাশ।” কর্নেল ছবিটা টেবিলে রেখে আতসকাঁচ চাপা দিলেন। “যাই হোক, হালদারমশাই আজকের কাগজের একটা সেরা ধান্দাবাজি মিস করেছেন।”

কথাটা শুনেই গোয়েন্দা ভদ্রলোক সিধে হয়ে বসলেন, উত্তেজিতভাবে বললেন, “মিস করছি?”

“হ্যাঃ।” কর্নেল সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন। “এডিটোরিয়্যাল পেজের চিঠিপত্রের কলামে একটা চিঠি আপনার চোখ এড়িয়ে গেছে।”

হালদারমশাই বাঘের থাবায় কাগজটা তুলে নিলেন। একটু পরে দেখলাম, ওঁর চোখদুটো গোল হয়ে গেছে। গোঁফের ডগা তিরতির করে কাঁপছে। বিড়বিড় করে বললেন, “মড়া সিগারেট টানবে? মানে, ডেডবডি! কয় কী!”

কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট ধরিয়ে ওঁকে তাতিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, “চ্যালেঞ্জ হালদারমশাই, পাল্টা চ্যালেঞ্জ করেছে।”

হালদারমশাই নিজের বুকে আঙুল রেখে বললেন, “আমারে?”

কর্নেল হাসলেন। “না, না! আপনাকে চ্যালেঞ্জ করবে কেন? আমার মনে হচ্ছে, আপনি খুঁটিয়ে চিঠিটা পড়েননি।”

হালদারমশাই ফের কাগজে চোখ রাখলেন। প্রায় বানান করার মতো বিড়বিড় করে পড়ে মুখ তুললেন। বাঁকা হেসে বললেন, “ম্যাজিক! ম্যাজিক!”

“কিন্তু অবধূতমশাই পাল্টা চ্যালেঞ্জ করেছেন। বিজ্ঞান প্রচার সমিতির প্রদীপ মিত্রকে যেন ডুয়েল লড়তে ডেকেছেন। ওঁর তন্ত্রশক্তি বুজরুকি প্রমাণ করতে পারলে আশ্রম ভেঙে দিয়ে সেখানে মুলোর চাষ করবেন।” কর্নেল গম্ভীর মুখে মাথার টাকে হাত রাখলেন। “শুধু তাই নয়, উনি সন্ন্যাসধর্ম ছেড়ে দিয়ে বাকি জীবন প্রদীপ মিত্রের চাকর হয়ে থাকবেন। বুঝুন তা হলে?”

“হঃ! বুঝছি।” হালদারমশাই আরেকটিপ নস্যি নিলেন।

জিজ্ঞেস করলাম, “কী বুঝলেন, বলুন শুনি?”

“কর্নেলস্যার তো অলরেডি কইয়া দিলেন। ধান্দাবাজি।”

কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বললেন, “হ্যাঁ, ধান্দাবাজি। কারণ অবধূতমশাইয়ের দ্বিতীয় শর্ত হল, প্রদীপ মিত্র হেরে গেলে নিজের চ্যালেঞ্জ অনুসারে তাকে একলক্ষ টাকা দিতে হবে।”

গোয়েন্দা কে কে হালদার নড়ে বসলেন। “প্রদীপ মিত্র কইছিল লক্ষ টাকা দেবে ওনারে?”

“চিঠিতে তো তা-ই দেখছি। তার মানে, প্রদীপ মিত্রের চিঠিটা আমি মিস করছি।” কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানতে টানতে বললেন। “মিস করার একটাই কারণ। আমি গত সেপ্টেম্বরে প্রায় পুরো মাসটাই নাইজেরিয়ায় ছিলাম। তবে জয়ন্তের চোখে পড়া উচিত ছিল। চিঠিটা ওদের দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকায় বেরিয়েছে।”

বললাম, “নিজের লেখা রিপোর্ট বাদে সত্যসেবকের আমি কিছুই পড়ি না।”

 হালদারমশাই ভুরু কুঁচকে বললেন, “ক্যান?”

“হিন্দিতে একটা প্রবাদ আছে, ঘরকি রোটি তিতা/পরকে রোটি মিঠা। আমি অন্য কাগজ পড়ি।”

গোয়েন্দা ভদ্রলোক খি-খি করে খুব হাসলেন। তারপর গম্ভীর হয়ে বললেন, “এই যে কাঁটালিয়াঘাট লিখছে, হোয়্যার ইজ দ্যাট প্লেস কর্নেল স্যার?”

কর্নেল বললেন, “কেন? আপনি কি প্রদীপ মিত্রের হয়ে চ্যালেঞ্জটা নিতেন ভাবছেন?”

“নাহ্। এমনি জিগাই।”

“হাওড়া-আজিমগঞ্জ লুপলাইনে গঙ্গার ধারে কাঁটালিয়াঘাট রোড স্টেশন। কাটোয়ার কাছে উদ্ধারণপুর মহাশ্মশানের পর অমন শ্মশান আর গঙ্গার ধারে নেই–অন্তত পশ্চিমবঙ্গে।” কর্নেল এতক্ষণে চোখ খুলে সোজা হলেন। “ও তল্লাটে কাটালঘাটের মড়া’ বলে একটা কথা চালু আছে। কোনও-কোনও মড়া নাকি চিতা থেকে উঠে পালিয়ে যায়। কাজেই বলা যায় না, অবধূতমশাইয়ের যে-মড়াটা সিগারেট টানবে, সেটা তেমন কোনও চিতা-পালানো মড়া কি না।”

কর্নেলের কথার ভঙ্গিতে হেসে ফেললাম। হালদারমশাই কিন্তু হাসলেন না। হাই তুলে ঘড়ি দেখে উঠে দাঁড়ালেন। আপনমনে বললেন, “যাই গিয়া।” তারপর পর্দা তুলে জোরে বেরিয়ে গেলেন। এই ড্রয়িং রুম থেকে বেরিয়ে একটা ছোট্ট ওয়েটিং রুম। তারপর বাইরে বেরুনোর দরজা। দরজায় ইন্টারলকিং সিস্টেম আছে। ভেতর থেকে ভোলা যায়। কিন্তু বাইরে থেকে খোলা যায় না। সেই দরজায় বেশ জোরালো শব্দ হল।

বললাম, “হালদারমশাইকে খুব উত্তেজিত মনে হচ্ছে। সোজা হাওড়া স্টেশনে ট্রেন ধরতে গেলেন না তো?”

কর্নেল বললেন, “গেলে একটা এক্সপিরিয়েন্স হতেও পারে। পুলিশের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের রিটায়ার্ড ইন্সপেক্টর আমি অনেক দেখেছি, জয়ন্ত! কিন্তু আমাদের এই হালদারমশাইয়ের মতো কাউকে দেখিনি; সবসময় রহস্যের গন্ধ শুঁকে বেড়ানো ওঁর বাতিক হতে পারে। তবে এটা খারাপ বাতিক নয়। এতে সৎ মানুষদের উপকার করা হয়। ওঁর প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি, খোলার পেছনে–”

বাধা দিয়ে বললাম, “বাতিক আপনারও কিছু কম নয়। তবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটা পাখি বা প্রজাপতির পেছনে ছুটোছুটি করে বেড়ানোতে কৃদি কারও কোনও উপকার হয় না।”

“হয় জয়ন্ত, নিশ্চয় হয়। এই যে দেখছ, এই পঙ্গপালটা! নাইজেরিয়ায় এটার পেছনে অনেক ছুটোছুটি করে ছবি তুলে এনেছি। তুমি জানো না, এরা সারা আফ্রিকার কী সাংঘাতিক শত্রু। লক্ষ লক্ষ টন ফসল মাঠ থেকেই এদের পেটে চলে যায়। গাছপালা পর্যন্ত মুড়িয়ে খেয়ে ফেলে। মরুভূমি ডেকে আনে এরা। সাহারা মরুভূমির অন্যতম স্রষ্টা এরাও, জয়ন্ত। এই সিস্টেসার্কা গ্রেগরিয়া প্রজাতির ফড়িংকে তুমি নিরীহ জীব ভেবো না।”

আমার প্রকৃতিবিদ বন্ধুর ভাবাবেগ লক্ষ করে অবাক হয়েছিলাম। ওঁর আবেগপূর্ণ বক্তৃতা আরও কিছুক্ষণ চলত। থামিয়ে দিল ডোরবেলের টুংটাং বাজনা। বললাম, “হালদারমশাই কিছু ফেলে গেছেন হয়তো।”

কর্নেল বললেন, “যদি কিছু না মনে করো, ভদ্রলোককে নিয়ে এসো ডার্লিং!”

 “কোন ভদ্রলোককে?”

“যিনি এসেছেন। দেখবে, মুখে সুন্দর দাড়ি আছে। আমার মতো লম্বাচওড়া।”

অবাক হয়ে বললাম, “আপনার কি দেয়াল ফুড়ে দৃষ্টি যায়?”

কর্নেল হাসলেন। “জয়ন্ত! ডোরবেলের শব্দ আমাকে বলে দিয়েছে কে এসেছেন। তা ছাড়া ঠিক সাড়ে দশটায় ওঁর পৌঁছুনোর কথা।”

বেরিয়ে গিয়ে দরজার আইহোলে চোখ রাখলাম। কঁচাপাকা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। মুখে পোড়খাওয়া ভাব। চোখে সরু সোনালি ফ্রেমের চশমা। লম্বায় প্রায় কর্নেলের মতোই। দরজা খুলে একটু সমীহ করে বললাম, “আসুন!”

ভদ্রলোক বললেন, “আপনি কি কর্নেল সায়েবের অ্যাসিস্ট্যান্ট?”

“নাহ্। আমি জয়ন্ত চৌধুরি। নিছক একজন সাংবাদিক।”

 “আমার নাম ভি রায়। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং কনসালট্যান্ট।”

 “ভেতরে আসুন। কর্নেল আপনার অপেক্ষা করছেন।”

ভি রায় ড্রয়িং রুমে ঢুকে কর্নেলকে দেখে যেন একটু নিরাশ হলেন। নমস্কার করে বললেন, “আপনি কর্নেল সরকার?”

“আপনি বসুন মিঃ রায়! সকালে আমাকে অরিজিৎ ফোনে আপনার কথা বলেছে।”

রায়সায়েব সোফায় বসলেন। ব্রিফকেসটা পাশে রেখে বললেন, “অরিজিৎ প্রেসিডেন্সিতে আমার বন্ধু ছিল। আমি অবশ্যি ওর সিনিয়র ছিলাম। এনিওয়ে, ও আপনাকে কী বলেছে জানি না।”

কর্নেল হাঁকলেন, “ষষ্ঠী! কফি।” তারপর বললেন, “অরিজিৎ বলেছে, আমার পক্ষে সম্ভব হলে যেন আপনাকে সাহায্য করি। কী একটা মিসটিরিয়াস ঘটনার মধ্যে নাকি আপনি জড়িয়ে গেছেন। তো আমি ওকে বললাম, বরং প্রাইভেট ড্রিটেকটিভ মিঃ কে কে হালদারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলো। অরিজিৎ আসলে হালদার মশাইকে পছন্দ করে না। আপনি আসার জাস্ট দু-তিন মিনিট আগে ডিটেকটিভদ্রলোক বেরিয়ে গেলেন। সম্ভবত নীচে আপনি এঁকে দেখে থাকবেন।”

“আপনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ নন?”

 কর্নেল গম্ভীরমুখে কথা পাড়লেন। “সরি মিঃ রায়! আমি ডিটেকটিভ নই। অরিজিৎ কি আপনাকে বলেছে আমি–”

রায়সায়েব তার কথার ওপর বললেন, “না। অরিজিৎ বলল, আপনি ছাড়া এই মিস্ট্রি কেউ সলভ করতে পারবে না।”

“মিস্ট্রি কী, সংক্ষেপে বলুন।”

রায়সায়েব একটু ইতস্তত করে বললেন, “বাট দিস ইজ প্রাইভেট অ্যান্ড কনফিডেন্সিয়াল!”

কর্নেল আমাকে দেখিয়ে বললেন, “জয়ন্ত চৌধুরি। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক।”

“আলাপ হয়েছে। কিন্তু–

“ওর কাছে আমার কিছু গোপন থাকে না। যদি ওর সামনে বলতে আপত্তি থাকে, তা হলে সরি মিঃ রায়, আমাকে ক্ষমা করবেন, আমারও গোপনে শুনতে আপত্তি আছে।”

রায়সায়েব আমাকে দেখে নিয়ে একটু হাসবার চেষ্টা করলেন। “তাই বুঝি। তবে খবরের কাগজের লোক বলেই–ঠিক আছে! অরিজিৎ যখন আপনার কথা বলেছে, তখন আই মাস্ট ফলো হিম।”

রায়সায়েব ব্রিফকেস খুলতে ব্যস্ত হলেন। ষষ্ঠীচরণ কফির ট্রে রেখে গেল। কর্নেল একটু হেসে বললেন, “কফি খেতে খেতে বলুন মিঃ রায়। কফি নার্ভকে চাঙ্গা করে। আমার ধারণা, আপনি খুব ডিস্টার্বড়।”

কয়েকটা খাম এবং বিজ্ঞাপনের কাটিং কর্নেলের হাতে তুলে দিয়ে রায় সায়েব কফির পেয়ালা নিলেন। চুমুক দিয়ে বললেন, “থ্যাংকস! সত্যিই আমি ভীষণ ডিস্টাবড়। আমার জীবনটা অনেকগুলো অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যে কেটেছে। অনেক সাংঘাতিক অবস্থার মধ্যে পড়েছি। কিন্তু এবারকারটা একেবারে অন্যরকম। আমি ভাল করে খেতে বা ঘুমোতে পারছি না। কোনও কাজকর্মে মন বসছে না। এ একটা অদ্ভুত চ্যালেঞ্জ।”

কর্নেল কাগজগুলো দেখতে দেখতে বললেন, “অনামিকা সেনের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কী?”

“পুরো ব্যাকগ্রাউন্ডটা আপনি শুনুন আগে।”

“বলুন।”

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকার পাতায় চোখ রেখে একটা অদ্ভুত কাহিনী, শুনছিলাম! পঁচিশ বছর আগে সমীর রুদ্র নামে একজনের সঙ্গে অনামিকা সেনের বিয়ের সম্পর্ক হয়েছিল। বিয়ের আগের রাতে অনামিকা নিখোঁজ হয়ে যায়। রায় সায়েব তখন একটা কোম্পানিতে চাকরি করতেন। জামশেদপুরে ছিলেন। ঘটনাচক্রে সঙ্গীর রুদ্রের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর পুরনো কথা মনে পড়ে। তারপর অনামিকাদের বাড়ি গিয়ে দেখেন, সেখানে একটা বিশাল বাড়ি উঠেছে। অনামিকার মা বহুবছর আগে মারা গেছেন। অনামিকার খোঁজে রায়সায়েব কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। তার জবাবে হুমকি দিয়ে চিঠি এসেছে, অনামিকার খোঁজ করলে তার সাংঘাতিক বিপদ ববে।

কর্নেল বললেন, “অনামিকার সঙ্গে আপনার এমোশনাল সম্পর্ক ছিল?”

“একসময় আমার দিক থেকে ছিল। এটুকু বলতে পারি। তবে সেটাও সাময়িক।”

‘অনামিকার খোঁজ নিতে এতকাল পরে আপনি আগ্রহী। কেন?”

রায়সায়েব একটু উত্তেজিতভাবে বললেন, “বিয়ের আগে সে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল। সে কথা তো বললাম আপনাকে। তবে এটা ঠিক যে, এই হুমকি না এলে আমি এ নিয়ে এতটুকু মাথা ঘামাতাম না।”

 “এমন তো হতে পারে, অনামিকা নিজেই হুমকি দিয়ে চিঠি লিখেছেন?”

রায়সায়েব একটু চুপ করে থেকে বললেন, “হুমকির কোনও দরকার তো ছিল না। সে জানাতে পারত, ভাল আছে এবং তার জন্য আমাকে চিন্তা করতে হবে না।”

 “ওঁর হাতের লেখা আপনার কাছে আছে?”

“নাহ্। তবে এই লেখাগুলো কিছুতেই ওর নয়। মেয়েদের লেখা বলে মনে হয় না।”

“কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছেন। কোনও পুরুষ মানুষকে। এমন তো হতেই পারে। তিনিই এখন অনামিকার স্বামী।”

“স্বীকার করছি। কিন্তু অনি তো আমাকে পছন্দ করত না। পরে আমিও ওকে আর পছন্দ করতাম না। ওর সঙ্গে বিয়ের কথা উঠেছিল। আমিই না করে দিয়েছিলাম। কাজেই অনি ভালই জানে যে, আমি এই বয়সে ওর পেছনে লাগতে যাব না।”

কর্নেল ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি কি সন্দেহ করছেন, অনামিকা–”

 “আমার সন্দেহ, অনামিকা বেঁচে নেই। সি ওয়জ কিচ্ছ। তাই তার কিলার চাইছে আমি যেন তার খোঁজে পা না বাড়াই। ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড কর্নেল সরকার?”

আমি চমকে উঠেছিলাম। কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে চুরুট ধরালেন।

“সমস্যা হল মিঃ রায়, খুব পুরনো কোনও মার্ডারের খোঁজখবর করা আমাদের দেশে বস্তুত অসম্ভব।”

“মার্ডারের নয়, মার্ডারারের খোঁজ পেতেই আমার আগ্রহ কর্নেল সরকার!” রায়সায়েব ডানহিল সিগারেট ধরালেন। “যদি সত্যিই অনিকে কেউ খুন করে থাকে, সে আমার বিজ্ঞাপন দেখেই ভয় পেয়ে গেছে বলে আমার সন্দেহ।”

“ইউ আর ভেরি ইনটেলিজেন্ট ম্যান, মিঃ রায়।”

“একটা বোকামি আমি করে ফেলেছি। সমীর রুদ্র যখন মুনলাইট বারে আমাকে দেখে চিনতে পেরেছিল, আমি তাকে না চেনার ভাণ করে কেটে পড়েছিলাম। এখন আপনি বলুন, ওকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে বিজ্ঞাপন দেব কি না?”

“দিয়ে দেখতে পারেন। কর্নেল লালকালিতে লেখা চিঠিগুলোর ওপর আতস কাঁচ রেখে খুঁটিয়ে দেখতে থাকলেন।

রায়সায়েব বুকপকেট থেকে একটা খাম বের করে বললেন, “সরি! ভুলে গিয়েছিলাম। অরিজিৎ বলছিল, অনির কোনও ফটো আছে কি না। অনেক খুঁজে এই ফটোটা পেয়েছি। পুরনো ফোটো। নষ্ট হয়ে গেছে। দেখুন, যদি দরকার হয়–

কর্নেল স্যাঁতলাধরা আবছা পোস্টকার্ড সাইজ ছবিটা নিয়ে বললেন, “সত্যিই অনামিকা খুন হয়ে থাকলে ওই সময়ের পুলিশ রেকর্ড বা খবরের কাগজে তার ছবি থাকা সম্ভব। অবশ্য বডি যদি কেউ সঙ্গে সঙ্গে শনাক্ত করতে না পারে, তবেই। কিন্তু বডি নিখোঁজ হলে কিছু করার নেই। তার চেয়ে বড় কথা, অনামিকার বডি শনাক্ত করার জন্য তখন তার আত্মীয়স্বজন বা পরিচিত লোকেরা ছিলেন। আপনার বন্ধু সমীর রুদ্র ছিলেন। অথচ সমীরবাবুর কাছে। আপনি তেমন কিছু শোনেননি?”

“না।”

“তাহলে যদি আপনার সন্দেহমতো অনামিকা খুন হয়েই থাকেন, তার বডিও নিখোঁজ হয়েছিল।”

“ইউ আর হান্ড্রেড পার্সেন্ট কারেক্ট, কর্নেল সরকার!”

কর্নেল হাসলেন। “সেক্ষেত্রে ছবি আমাদের কোনও সাহায্য করছে না।”

 রায়সায়েব আস্তে বললেন, “কিন্তু যদি সে বেঁচে থাকে?”

কর্নেল দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, “হ্যাঁ। দেন ইটস্ আ রিয়্যাল মিস্ট্রি।”

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের পাতা থেকে মুখ তুলে বললাম, “মিঃ রায়, যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা বলতে চাই।”

রায়সাহেব আমার দিকে তাকালেন। “বলুন!”

একটু ইতস্তত করে বললাম, “অনামিকা সেন বিয়ের আগে নিখোঁজ হয়েছিলেন। কোনও মেয়ে ওইভাবে নিখোঁজ হয়ে গেলে তার আত্মীয়স্বজন চুপচাপ বসে থাকতে পারেন না। পুলিশকে জানাবেন। কাগজে ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপনও দেওয়া হবে। এমন কি, কেউ তাকে এলোপ করেছে বা কিডন্যাপ করেছে বলে সন্দেহ হবে এবং তার নামে পুলিশের কাছে”।

কর্নেল প্রায় একটা অট্টহাসি হেসে আমাকে থামিয়ে দিলেন। “স্ক্যান্ডাল জয়ন্ত, স্ক্যান্ডালকে শিক্ষিত বাঙালি পরিবার যমের মতো ভয় পায়। বিশেষ করে অনামিকাদের মতো পরিবার মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত যাঁরা। বরং এসব পরিবারকে বাঙালি ভদ্রলোক পরিবার বলাই উচিত। এঁরা বাড়ির মেয়ে পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা সচরাচর চেপে রাখতেই চান। ব্যতিক্রম থাকতে পারে। সেটা ধর্তব্য নয়। তার চেয়ে বড় কথা, অনামিকা বিয়ের প্রাক্কালে নিখোঁজ হয়েছিলেন। কাজেই এ ক্ষেত্রে স্ক্যান্ডালের ভয়টা ছিল সাংঘাতিক।”

আবার ব্রিফকেস খুললেন রায়সাহেব। তারপর ব্যাঙ্কের একটা চেকবই বের করলেন। কর্নেল আস্তে বললেন, “আপনি আবার একটা ভুল করছেন মিঃ রায়!”

রায়সাহেব ভুরু কুঁচকে বললেন, “কী ভুল?”

“আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ নই।”

 “আপনি আমার এই কেস নিচ্ছেন না?”

“কেস হিসেবে নিচ্ছি না। বড় জোর বলতে পারি, আই অ্যাম ভেরি মাচ ইন্টারেস্টেড।” কর্নেল চোখ বুজে হেলান দিলেন। “আই শুড ট্রাই মাই বেস্ট টু সলভ দা মিস্ট্রি।”

“কিন্তু এতে আপনার সময় লাগবে। পরিশ্রম হবে। এমন কি কোথাও যেতে হলে–কিংবা কোনও কোনও ক্ষেত্রে টাকাকড়িও খরচ হতে পারে।”

“দ্যাটস্ মাই হবি, মিঃ রায়।”

 রায়সাহেবের কণ্ঠস্বরে চাপা উত্তেজনা ফুটে উঠল। “কিন্তু এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কাজেই আইনের দিক থেকে আপনার অধিকারের প্রশ্ন ওঠারও তে চান্স আছে। সে জন্য অন্তত একটা লেটার অব অথরিটি দরকার। কিংবা দুজনের সই করা একটা লেটার অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং–”

“দরকার হবে না। আপনি শুধু ওই কাগজগুলো আর আপনার নেমকার্ড রেখে যান।”

ভি রায় অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার পর পকেট থেকে একটা নেমকার্ড বের করে টেবিলে রাখলেন। বললেন, “তা হলে আমি উঠি, কর্নেল সরকার! যখনই দরকার হবে, আমাকে রিং করবেন।”

উনি নমস্কার করে দরজার কাছে গেছেন, কর্নেল বললেন, “একটা কথা মিঃ রায়!”

রায়সাহেব ঘুরে দাঁড়ালেন।

 “আপনি কি অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস করেন?”

“বুঝলাম না।”

 “কোনও মানুষের অলৌকিক শক্তি থাকা সম্ভব মনে করেন?”

 “কেন এ প্রশ্ন করছেন?”

 “আপনার গলার চেনে ওই লকেটটা–”।

রায়সাহেব হাসলেন। “তাই বলুন। দু বছর আগে একটা এক্সপোর্ট ডিলে প্রায় ফতুর হয়ে গিয়েছিলাম। তখন এক বন্ধু এটা আমাকে ধারণ করতে দেন। লকেটে একজন সন্ন্যাসীর ছবি আছে। তিনি কে, তা আমি জানি না। তবে এটা ধারণ করার পর পায়ের তলায় মাটি পেয়েছিলাম। সংস্কার বা কুসংস্কার যা-ই বলুন, লকেট সবসময় পরে থাকি।”

ভি রায় চলে যাওয়ার পর কর্নেল বললেন, “জয়ন্ত, তুমি ওইরকম একটা অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন লকেট ধারণ করছ না কেন?”

বললাম, “আমি ওসব বুজরুকিতে বিশ্বাস করি না।”

“ডার্লিং! বিশ্বাস করে দেখলে ক্ষতি কী? কত বছর ধরে তুমি দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার নিছক ক্রাইম রিপোর্টার থেকে গেলে।” কর্নেল হাত বাড়িয়ে টেলিফোন তুলে ডায়াল করতে থাকলেন। “বরং তুমি কাঁটালিয়াঘাটে চলে যাও। অবধূতজির কাছে গিয়ে সটান লুটিয়ে পড়ো..হ্যালো! অরিজিৎ?…হ্যাঁ, এসেছিলেন।..হা ডার্লিং, এটা একটা রিয়্যাল মিস্ট্রি। তো শোনো! তোমাদের সেই আর্টিস্ট ভদ্রলোক–কী নাম যেন?..হা, সুমিত গুপ্ত। তার ঠিকানাটা চাই…জাস্ট আধ মিনিট। লিখে নিচ্ছি। বলো…”

কর্নেল একটা কাগজে নাম-ঠিকানা লিখে নিয়ে ফোন রেখে দিলেন। জিজ্ঞেস করলাম, “পুলিশের আর্টিস্ট, ব্যাপারটা কী?”

“ছি ছি! এটা তোমার জানা উচিত ছিল, জয়ন্ত!”

“কী মুশকিল! জানি। প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখে বর্ণনা শুনে ক্রিমিনালদের ছবি আঁকা হয়। কিন্তু আপনি পুলিশের আর্টিস্টকে কী কাজে লাগাবেন?”

কর্নেল একটা খাম থেকে অনামিকা সেনের সেই ধূসর বিবর্ণ ছবিটা বের করে বললেন, “সুমিতবাবুর সাহায্যে ছবিটি পুনরুদ্ধার করতে চাই। ভদ্রলোক শুধু পোর্ট্রেট আঁকিয়ে নন, একজন দক্ষ ফটোগ্রাফারও। তাছাড়া ওঁর অ্যানাটমি-জ্ঞানও অসাধারণ। এক মিনিট। ওঁর সঙ্গে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে নিই।”

আবার টেলিফোন করে কর্নেল সুমিতবাবুর সঙ্গে কথা বললেন। তারপর উঠে দাঁড়ালেন। “চলো ডার্লিং! বেরিয়ে পড়া যাক। ফিরে এসে তুমি এখানেই লাঞ্চ খাবে। ষষ্ঠী!”

হাঁক ছেড়ে উনি পোশাক বদলাতে ভেতরে গেলেন।

অনামিকা সেনের অস্পষ্ট এবং রঙছুট সাদা-কালো ছবিটার দিকে তাকিয়ে তাকে খুঁজছিলাম। পঁচিশ বছর আগে সে নিখোঁজ হয়েছে। এই ছবিটা সেই সময়কার বলে মনে হয় না। একটি কিশোরীমুখের আদল আঁচ করা যাচ্ছে। তা যদি হয়, তা হলে এখন তাকে দেখলে কী করে চেনা সম্ভব হবে?

আবার, অনামিকা সেন যদি সত্যি খুন হয়ে থাকে, তা হলেই বা এই ছবি কোন কাজে লাগবে? কর্নেলের মাথায় একটা লোক উদ্ভট একটা বাতিক ঢুকিয়ে দিয়ে গেল। এখন এই নিয়ে কিছুদিন ছুটোছুটি করে বেড়াবেন। আমাকেও ছাড়বেন বলে মনে হচ্ছে না। অতএব সুমিতবাবুর বাড়ি থেকে ফিরে লাঞ্চটা খেয়েই কাট করব। আপাতত কিছুদিন গা-ঢাকা দিয়ে থাকব বরং।

কিন্তু কর্নেল এসে খামগুলো গোছাতে গোছাতে বললেন, “লাঞ্চের পর একটু জিরিয়ে নিয়ে আমরা আরেক জায়গায় যাব, জয়ন্ত! তুমি আজ ক্যাজুয়াল লিভ নিচ্ছ। তার মানে, আপিসে যাচ্ছ না।”

ফোঁস করে একটা শ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।…

.

কর্নেল নীলাদ্রি সরকার

চিত্রকর সুমিত গুপ্ত ছবিটা অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করে দেখার পর বললেন, “ক্রিমিন্যাল?”

বললাম, “না।”

 “তা হলে লুনাটিক।”

“তা-ও না।”

সুমিতবাবু আবার আতস কাঁচ দিয়ে ছবিটা দেখতে দেখতে বললেন, “কিন্তু মেয়েটির মুখে আমি অস্বাভাবিকতার কিছু লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি। আপনি বলতে পারেন, পুলিশের অর্ডারি ছবি আঁকতে আঁকতে আমার কোনও মানসিক বৈকল্য : ঘটে গেছে কি না।” চিত্রকর সকৌতুকে হাসলেন। “জানেন? লোকেরা আজকাল আমার কাছে পোর্ট্রেট আঁকাতে আসে না। আমি নাকি নিরীহ সজ্জন মানুষের মুখেও ক্রিমিন্যালের আদল এনে ফেলি! গত মাসে এক কোটিপতি ব্যবসায়ীর– ছেলে তার মরা বাপের ফটো দেখে অয়েলকালার পোর্ট্রেট আঁকতে ফরমাস করে গেল। বিশ হাজার টাকা দাবি করলাম। তাতেই রাজি। তারপর ব্যাটাচ্ছেলে ছবি নিতে এসে চটে আগুন। বলে, আমার বাবার ছবি না চম্বলের ডাকাতের ছবি এঁকেছেন মশাই? ছবি নিল না। ওই দেখুন ছবিটা। আসলে প্রতিকৃতির মধ্যে ব্যক্তির নিজস্ব রূপ কেউ দেখতে চায় না। সবাই চায় সুন্দর চেহারা। ফটোর বেলাতেও একই ব্যাপার। ফটোর চেহারা দেখতে সুন্দর হওয়া চাই। আমার নীতি হল, যা ঠিক, তাকে ঠিক তা-ই করতে হবে। কারণ প্রতিটি ব্যক্তির মধ্যে তার শারীরিক রূপের একটা করে নিজস্ব স্বাতন্ত্র্য বলুন বা আইডেন্টিটি বলুন, থাকতে বাধ্য।”

দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে বললাম, “খাঁটি কথা বলেছেন সুমিতবাবু! এই ছবিটা ঠিক যা ছিল, তা-ই আমি চাইছি।”

 “চেষ্টা করব। জায়গায় জায়গায় অ্যানাটমি-লাইন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তবে আউটলাইনটা অনুমান করা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ভালরকমের সাহায্য পাব একটা অক্ষত চোখ থেকে। আর হ্যাঁ, ঠোঁট দুটোর আদল স্পষ্ট। কপালের ডানদিক, ভুরু, ডান কান–” সুমিতবাবু আমার দিকে ঘুরলেন। “আপনি বললেন বছর পঁচিশ আগে নিখোঁজ হয়েছে?”

“হ্যাঁ। কিন্তু এ-ও বলেছি, ছবিটা তারও আগে তোলা।”

“কত বছর আগে?” বলেই সুমিতবাবু মাথা নাড়লেন। “নাহ্! আমার ওসব জানার প্রয়োজন নেই। আপনি আমাকে ইতিমধ্যেই একটু অসুবিধায় ফেলে দিয়েছেন।”

অবাক হয়ে বললাম, “কেন বলুন তো?”

 “এ ধরনের ছবি পুনরুদ্ধারের কোনও আগাম ইনফরমেশন ক্ষতিকর। আমি নিজের অজ্ঞাতসারে কিছু এমোশনাল অনুভূতিতে বায়াল্ড হয়ে যেতে পারি। থাক, আর কিছু বলবেন না। বললেও আমি শুনব না।” সুমিতবাবু উঠে গেলেন একটা টেবিলের কাছে। অগোছাল স্টুডিওর এক কোনায় টেবিলটা জঞ্জালের মতো দেখাচ্ছে। ছবিটা ড্রয়ারে ঢুকিয়ে বললেন, “পুলিশকেও আমি ঠিক এই কথা বলি। ওঁরা বিরক্ত হন। লোকটা কী করেছে, আমার জানার দরকার নেই। আমার দরকার তার চেহারার মোটামুটি একটা বর্ণনা–অবজেকটিভ ডেসক্রিপশন ওলি।”

কথাগুলো যুক্তিপূর্ণ। বেশ কয়েকবার এই চিত্রকরের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে। কিন্তু তখনও ওঁর বাড়িতে আসিনি। আসার দরকার হয়নি। তবে আজ এসে বুঝতে পারলাম, উনি এক অনন্যসাধারণ প্রতিভাবান মানুষ। অনেক বিষয় খুব তলিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন।

জয়ন্ত বারবার আমার দিকে কেমন চোখে তাকাচ্ছিল। বুঝতে পারছিলাম, সে সুমিতবাবুর কথাবার্তা হাবভাবে খুব মজা পেয়েছে। এবার দেখলাম, তার ঠোঁটের কোনায় বাঁকা হাসি। কিছু বলার জন্য সে ঠোঁট ফাঁক করামাত্র তার দিকে চোখ কটমটিয়ে তাকালাম। অমনি সে গম্ভীর হয়ে সেই ব্যবসায়ীর বাতিল ছবিটা দেখতে মন দিল। ছবিটা সত্যিই চম্বলের ডাকাতের বলে মনে হবে।

সুমিতবাবুর বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি। রোগা বেঁটে মানুষ। লম্বা নাক। দাড়িগোঁফ পরিষ্কার করে কামানো। মাথায় লম্বা মেয়েলি চুল। চুলে কলপ মাখেন বলে মনে হল। অবশ্য কারও কারও চুল ষাট পেরিয়েও পাকে না। ওঁর পরনে বেজায় ঢোলা চকরাবকরা লম্বাটে কুর্তা আর চোঙা জিনস্। দু’হাতে প্রচুর রঙ মেখে আছে। আমার ভয় হচ্ছিল, ছবিটাতে রঙ মেখে না যায়। কিন্তু সে ব্যাপারে উনি সচেতন দেখে আশ্বস্ত হয়েছিলাম।

ছবিটা রেখে হঠাৎ উনি ইজেলের দিকে এগিয়ে গেলেন। ইজেলে-আঁটা ক্যানভাসে কয়েকটা এলোমেলো রঙিন রেখা থেকে কিছু অনুমান করা কঠিন। বিমূর্ত চিত্রকলারও চর্চা করেন কি সুমিত গুপ্ত? ঘষঘষ করে সরু ব্রাসে একদলা লাল রঙ বুলিয়ে একটু পিছিয়ে এলেন। তারপর ব্রাসটা রেখে আমাদের কাছে ফিরে এলেন। “কবে চাই বলুন?”

বললাম, “যত শিগগির পারেন।”

“আগামী পরশু বিকেলে আসুন। তবে বলে রাখা দরকার, এ ক্ষেত্রে ওয়াটার-কালারই ভাল হবে। কারণ আপনি নিশ্চয় এ ছবি ঘর সাজানোর জন্য রাখবেন। ধরুন, আট বাই বারো ইঞ্চিই যথেষ্ট। নাকি”।

“নাহ্। ওই যথেষ্ট। কিন্তু কত দিতে হবে বলুন?”

সুমিতবাবু নড়ে বসলেন। “আমার মাথা খারাপ? আপনার মতো বিশ্বখ্যাত মানুষের কাছে টাকা নেব?”

হেসে ফেললাম। “আমাকে বিশ্বখ্যাত করে ফেললেন সুমিতবাবু!”

“নিশ্চয়। লাহিড়িসায়েবের কাছে শুনেছি আপনি ফরেন ম্যাগাজিনে আর্টিকেল লেখেন। বড় বড় ইন্টারন্যাশন্যাল সেমিনারে আপনার ডাক পড়ে। তাছাড়া কত সাংঘাতিক ক্রাইম আপনি ফঁস করেছেন। বাব্বা! কর্নেল নীলাদ্রি সরকারকে একটা ছবি এঁকে দিয়ে আমি টাকা নেব? আমার চৌদ্দপুরুষ ধন্য হয়ে যাবে! এই যে আপনি আমার স্টুডিওতে পায়ের ধুলো দিয়েছেন–”

“প্লিজ সুমিতবাবু!”

সুমিত গুপ্ত হাসলেন। “পরশু পেয়ে যাবেন। বাড়িতে বসেই পেয়ে যাবেন। আপনাকে কষ্ট করে আর আসতে হবে না। আমি নিজে গিয়ে দিয়ে আসব।”

ঘড়ি দেখে বললাম, “তা হলে উঠি। আপনার খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে।” একটু রসিকতা না করে পারলাম না। “আমার যদি ভুল না হয়ে থাকে, ওই দরজার পর্দার নীচে সম্ভবত মিসেস গুপ্তের পা দেখেছি।”

সুমিতবাবু চোখ বড় করে বললেন, “এই হল গিয়ে রহস্যভেদীর চোখ! তবে স্যার, একটু ভুল হয়েছে। আমি আপনার মতোই ব্যাচেলার। যার পা দেখেছেন, সে আমার বোন জয়িতা।”

“সরি সুমিতবাবু!”

সুমিতবাবু গলা চড়িয়ে ডাকলেন, “জয়ি! একবার এস। একজন ফেমাস ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।”

যে কাজের ছেলেটি কফি দিয়ে গিয়েছিল, সে পর্দা তুলে বলল, “দিদি বাথরুমে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।” সুমিতবাবু উঠে গিয়ে আবার ইজেলের ক্যানভাসে একদলা রঙ বুলিয়ে দিলেন।

এবার একটা মুখের আভাস টের পেলাম। উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, “তা হলে চলি সুমিতবাবু!”

জয়ন্ত উঠে দাঁড়িয়েছিল। ইজেলের ছবিটার দিকে তার দৃষ্টি। “আচ্ছা সুমিতবাবু, যে ছবিটা আঁকছেন, সেটা কি কোনও ক্রিমিনাল কিংবা লুনাটিকের?” বলে সে আমার দিকে ঘুরে বাঁকা হাসল।

বুঝলাম অনামিকা সম্পর্কে জয়ন্তের ইতিমধ্যে একটা সেন্টিমেন্ট গড়ে উঠেছে। যৌবনের ধর্ম! সুমিতবাবু অনামিকা সম্পর্কে ক্রিমিন্যাল বা লুনাটিক বলায় সে চটে গেছে সম্ভবত।

সুমিতবাবু ঘুরে দাঁড়িয়ে বা তর্জনী ঠোঁটে লম্বালম্বি রেখে এবং চোখে হেসে চাপাস্বরে বললেন, “চুপ! চুপ! জয়িতার কানে গেলে কেলেঙ্কারি হবে। এটা ওর গুরুদেবের পোর্ট্রেট।” চিত্রকর সামনের দেয়ালে কার্ডবোর্ডে পিন দিয়ে আঁটা একটা ছোট্ট সাদা-কালো ফটো দেখালেন। “দেখতে পাচ্ছেন তো?

গুরুদেব এই ক্যনভাসে এসে বিশাল হবেন–উইদ অল হিজ গ্রেটনেস অ্যান্ড গড়লি গ্র্যাঞ্জার।”

জয়ন্তকে অনেক সময় বাগ মানাতে পারি না। সে বলল, “উনি কাঁটালিয়াঘাটের সেই অবধূত নন তো?”

সুমিত গুপ্ত আগের মতো চাপাস্বরে এবং চোখে হেসে বললেন, “কাগজের লোক আপনি ঠিকই ধরেছেন। আর বলবেন না মশাই! আজকাল এই এক হুজুগ উঠেছে। লোকে মিরাকলের ভক্ত। আসলে অনিশ্চয়তা, কালচারাল শক, কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুঃখশোকঘটিত চিত্তবিকার–চলুন, নীচে অব্দি এগিয়ে দিই আপনাদের।”

সিঁড়িতে নামতে নামতে সুমিতবাবু বললেন, “মাস ছয়েক আগে আমার ভগ্নীপতি ট্রেন অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছেন। তারপর মেয়েদের যা হয়। আসলে জয়িতা বরাবর একটু কনজারভেটিভ প্রকৃতির। আমার মায়ের স্বভাবটি পুরোপুরি পেয়েছে। বাবা কিন্তু একেবারে উল্টো ছিলেন। আমার মতো খোলামনের মানুষ। সংস্কারমুক্ত, যুক্তিবাদী। যাই হোক, কর্নেলসায়েব! আগামী পরশু বিকেলে আপনি ছবি পেয়ে যাচ্ছেন।”…

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে জয়ন্ত বলল, “আমরা আজ সকাল থেকে মিরাকলের পাল্লায় পড়েছি, কর্নেল! আমার কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে।”

“সর্বনাশ, ডার্লিং!” আঁতকে ওঠার ভঙ্গি করে বললাম। “এ অবস্থায় তোমার গাড়ি চালানো উচিত হবে না। বরং আমি ড্রাইভ করি।”

জয়ন্ত হাসল। “না, না। কথাটা সে-অর্থে বলিনি। ব্যাপারটা আপনি ভেবে দেখুন। আজ কাগজে যে গডম্যানের চ্যালেঞ্জ বেরুল, ঘটনাচক্রে এতক্ষণে তার দর্শনও পাওয়া গেল। এদিকে আপনার ক্লায়েন্ট ভি রায়ের গলায় একটা লকেটে কোনও গডম্যানের ছবি ছিল। তিনিও সম্ভবত একই গডম্যান।”

গাড়ি বড়রাস্তায় পৌঁছুলে বললাম, “তুমি ঠিকই ধরেছ, জয়ন্ত! মিঃ রায়ের গলার লকেটের ছবিটা ছোট হলেও আমার দৃষ্টি এড়ায়নি। ফুট তিনেক দূরত্ব থেকে দেখা এক বর্গইঞ্চি লকেটের রঙিন ছবি। এ বুড়োবয়সেও আমার দৃষ্টিশক্তি কেমন, তা তুমি বিলক্ষণ জানো।”

 “কিন্তু আপনি নিজেই আক্ষেপ করেন, আপনার ভীমরতি ধরেছে। বাহাত্ত্বরে ধরেছে!”

“হ্যাঁ, তা করি। তো তোমার বক্তব্যটা কী?”

“সুমিতবাবুর স্টুডিওতে ওই ছবিটা আপনার চোখ এড়িয়ে গেল কী করে? নেহাত আমি কথাটা না তুললে–”।

ওর কথার ওপর বললাম, “চোখ এড়িয়ে যায়নি। একজন চিত্রকরের ডেরায় নানারকম মানুষ, এমন কি দেবদেবী তো বটেই, কিন্তু অদ্ভুত সবরকম বস্তু বা প্রাণীর ছবি থাকা স্বাভাবিক। ভূতপেত্নী, যক্ষরক্ষ, পিশাচ-ডাকিনীদেরও দেখা পাওয়া যাবে। কাজেই কাঁটালিয়াঘাটের অবধূতজির ছবি নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কী?”

“ব্যাপারটা কেমন যেন গোলমেলে ঠেকছে আমার।”

 “তার মানে তুমি সত্যিই মিরাকলে বিশ্বাস করছ!” জয়ন্ত একটু ক্ষুব্ধ হল।

 “কী আশ্চর্য, আমার কথাটা আপনি বুঝতে পারছেন না?”

হাসতে হাসতে বললাম, “এতে কোনও অস্বাভাবিকতা নেই, ডার্লিং! একেক সময় একেকজন গডম্যান খুব হিড়িক ফেলে দেন। তখন অনেকের বাড়িতে তুমি তার ছবি দেখবে। অনেকের লকেটে বা আংটিতেও তার ছবি থাকবে। সম্প্রতি কটালিয়াঘাটের শ্রীশ্রীভূতানন্দ অবধূত মিরাক দেখিয়ে তোক বা যেভাবে হোক, একটা বড় রকমের হিড়িক ফেলতে পেরেছেন। কাজেই এখন অনেকের কাছেই তার ছবি দেখতে পাওয়া স্বাভাবিক।

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর জয়ন্ত বলল, “সুমিতবাবু অনামিকার ছবিতে কেন একজন ক্রিমিন্যাল কিংবা লুনাটিককে দেখতে পেলেন? আমার এটা খুব খারাপ লেগেছে।”

“ডার্লিং! তুমি রোমান্টিক—

 “কী মুশকিল! আমি আপনার মতামত জানতে চাইছি।”

“মানুষের মুখে কিছু লেখা থাকে না।”

“সুমিতবাবু কিন্তু অনামিকা সেনের ঝাপসা ছবি দেখেই বুঝে গেছেন, কী একটা অস্বাভাবিকতা ছিল।”

“থাকতে পারে। হয়তো উনি অ্যানাটমির কোনও গণ্ডগোলই বোঝাতে চেয়েছেন।”

জয়ন্ত জোর দিয়ে বলল, “ওঁর প্রথম ইম্প্রেসন অ্যানাটমি সংক্রান্ত নয়। চরিত্র সংক্রান্ত।”

কোনও মন্তব্য করলাম না। চোখ বুজে ঘটনাটা সাজানোর চেষ্টা করছিলাম। পঁচিশ বছর আগে অনামিকা সেন নামে একটি মেয়ে বিয়ের আগের দিন নিখোঁজ হয়ে যায়। পঁচিশ বছর পরে তার এক প্রাক্তন প্রেমিক তার নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার কথা শুনে কাগজে বিজ্ঞাপন দিল। বিজ্ঞাপনের জবাবে এল হুমকি দেওয়া লাল কালিতে লেখা চিঠি। কিন্তু এর মধ্যে কোথাও যেন একটা তথ্যগত ফাঁক থেকে যাচ্ছে। কী সেটা?

মিঃ রায় অনামিকার নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার কথা শুনে কেন এতকাল পরে অমন ব্যস্ত হয়ে উঠলেন এবং কাগজে কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে বসলেন?

অনামিকা তাঁর সঙ্গেই পালিয়েছে বলে রটেছিল কি? অনামিকা যে তার সঙ্গে পালায়নি, সেটা প্রমাণ করতেই কি এই তৎপরতা?

কিন্তু কেন? পঁচিশ বছর কম সময় নয়। তা ছাড়া অনামিকার মা বেঁচে নেই। তা হলে কার কাছে জবাবদিহির প্রয়োজন হল? এ-ও গুরুত্বপূর্ণ, সমীর রুদ্র তাকে চিনতে পারা সত্ত্বেও কেন এড়িয়ে গেলেন বৈশম্পায়ন রায়? সমীরবাবুকে বলতে পারতেন, গুজবটা মিথ্যা।

মিঃ রায়ের দুটি আচরণের ব্যাখ্যা দরকার। এক : কেন কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন? দুই : কেন সমীর রুদ্রকে এড়িয়ে গেলেন? প্রথম প্রশ্নের উত্তর যদি হয় ‘নিছক কৌতূহল’ এবং দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর যদি হয় ‘অপছন্দ লোককে এড়িয়ে যাওয়া’, তা হলে রহস্যের কেন্দ্র গিয়ে পড়ে লাল কালিতে লেখা। হুমকিতে।

এ দিকে মিঃ রায় সন্দেহ করছেন, কেউ অনামিকাকে খুন করতেও পারে। তাই সে চাইছে না কেউ অনামিকা সম্পর্কে তদন্ত করুক। এক্ষেত্রে একটা সিদ্ধান্ত সহজেই করা চলে। অনামিকা তা হলে এমন সময়ের মধ্যে খুন হয়েছে, যাতে এখনও খুনীর বিরুদ্ধে মামলা করা চলে।

কিন্তু যদি অনামিকা বেঁচে থাকে?

আবার লাল চিঠির হুমকিতে ফিরে আসতে হচ্ছে। কেন এই হুমকি? মিঃ রায় বলছেন, অনামিকার প্রতি তার নিছক সাময়িক আসক্তি ছিল। কাজেই এই পরিণত বয়সে তিনি অনামিকার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ার মানুষ নন।

তা নন। তা হলে কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন কেন? ‘নিছক কৌতূহল’! নাকি কিছু গোপন করছেন? মোট কথা, একটা তথ্যগত গণ্ডগোল থেকেই যাচ্ছে।

“কর্নেল!”

চোখ খুলে দেখলাম, পৌঁছে গেছি। গাড়ি থেকে নেমে বললাম, “তুমি সুমিতবাবুর ফার্স্ট ইম্প্রেসনের কথা বলছিলে জয়ন্ত! আই এগ্রি। অনামিকার মধ্যে সত্যি একটা অস্বাভাবিকতা ছিল। সেটা খুঁজে বের করতে পারলেই এ সহস্যের সমাধান সম্ভব।”

জয়ন্ত গাড়ি লনের পার্কিং জোনে রেখে এল। তারপর সিঁড়িতে পা রেখে বলল, “খিদের মুখে এখন রহস্য-টহস্য ফালতু হয়ে গেছে, বস! কবিতায় আছে না? ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়–”

“অনামিকা সেন যেন ঝলসানো রুটি।”

জয়ন্ত হেসে ফেলল। “সত্যি! আপনি এ বয়সেও এত রস ধারণ করে আছেন, ভাবা যায় না!”

“ডার্লিং, অবধূতজির মিরাকলের মতো আজ আরও একটি মিরাকল তোমার চোখ এড়িয়ে গেছে।

“কী বলুন তো?”

 “আমি ব্যাচেলার। মিঃ রায় ব্যাচেলার। সুমিতবাবু ব্যাচেলার।”

“আমাকে হাফ-ব্যাচেলার বলতে পারেন। তবে ফুল ব্যাচেলারের ত্র্যহস্পর্শ সত্যি একটি মিরাক। এখন দেখা যাক, কী ঘটে।”

ডোরবেলের সুইচ টেপার সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে গেল। ষষ্ঠী বলল, “নাহিড়িসায়েব তিনবার ফোং করেছিলেন। বললেন, বাবামশাই ফিরলেই ফোং করতে বলবে। শিগগির এঁকে ফোং করুন।”

চোখ কটমটিয়ে বললাম, “ফোং করছি। তুই খাবার রেডি কর।”

ষষ্ঠীকে আজ অব্দি কিছুতেই ফোন বলানো গেল না। নাকি ও ইচ্ছে করেই ফোং বলে? আমার এই প্রিয় মধ্যবয়সী পরিচারকটি এত বছরেও শহুরে হয়ে উঠতে পারল না। ল এবং ন-এ সবসময় গণ্ডগোল করে।

টেলিফোনে অরিজিৎকে তখনই পেলাম। বললাম, “এনিথিং রং, ডার্লিং?”

“হাই ওল্ড বস্! সুমিতবাবুর লাইন কি ডেড?”

 “জানি না। কেন?”

“আপনার সঙ্গে কথা বলার জন্য বহুক্ষণ চেষ্টা করেও লাইন পেলাম না। এদিকে এক সাংঘাতিক ব্যাপার।”

“বৈশম্পায়ন রায়–”

“নাহ্। সমীর রুদ্র ইজ ডেড। বৈশম্পায়নের কাছে তার নাম শুনে থাকবেন।”

 “মাই গড! ডেড, মানে মার্ডার্ড?”

“নাহ। সুইসাইড বলেই মনে হয়েছে। ডান কানের ওপর কপালের ডান দিকে রিভলভারের নল ঠেকিয়ে ট্রিগার টেনেছেন। রিভলভারটা পয়েন্ট বাইশ ক্যালিবারের। পাশেই পড়ে ছিল।”

“কোনও সুইসাইডাল নোট পাওয়া গেছে?”

“নাহ। তবে একটা হুইস্কির বোতল আর গ্লাস পাওয়া গেছে। বোতল অর্ধেকের বেশি খালি। মনে হচ্ছে, মাতাল অবস্থায় হঠাৎই ঝোঁকের বশে সুইসাইড করেছেন। ওঁর অফিসের কলিগ্র বলছেন, কিছুদিন থেকে হতাশায় ভুগছিলেন। ওঁর বিরুদ্ধে কোম্পানির একটা অ্যালিগেশন ছিল। তদন্ত চলছিল। কাজেই–”।

“কিন্তু কোথায় সুইসাইড করেছেন ভদ্রলোক?”

“শেক্সপিয়ার সরণিতে ওঁর এক বন্ধুর ফ্ল্যাটে। তিনি নাকি ওয়াশিংটনে থাকেন। ফ্ল্যাটটা দেখাশোনার জন্য সমীরবাবুকে চাবি দিয়ে গেছেন। গত রাত্রে ওখানেই ছিলেন উনি। দরজায় ইন্টারলকিং সিস্টেম আছে। বাইরে থেকে খোলা যায় না। সকাল আটটায় নীচের একটা রেস্তোরাঁ থেকে ব্রেকফাস্ট নিয়ে যায় একজন। রাত্রেই বলা ছিল। অ্যান্ড দ্যাট ওয়াজ আ রেগুলার অ্যারেঞ্জমেন্ট। যাই হোক, সে সাড়া না পেয়ে ফিরে আসে। নাও ইটস্ আ পয়েন্ট, সে ভেতরে ট্যাপ থেকে জল পড়ার শব্দ শুনেছিল।”

 “মেক ইট ব্রিফ, অরিজিৎ! আমি ক্ষুধার্ত।”

 “ওক্কে বস! বরং আমি যাচ্ছি।”

“এস। শুধু বলো, হাউ দা বডি ওয়জ ডিস্কভার্ড?”

“সমীরবাবু মা একটা জরুরি দরকারে ওঁর অপিসে ফোন করেন। তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা। উনি অফিস যাননি শুনে ভদ্রমহিলা এই ফ্ল্যাটে চলে আসেন। উনিও জল পড়ার শব্দ শোনেন। তারপর–”

“দ্যাটস এনাফ। তুমি চলে এস। ছাড়ছি।”

ফোন রেখে দেখলাম, জয়ন্ত হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চমকানো গলায় বলল, “মিঃ রায় সুইসাইড করেছেন?”

“নাহ্। ওঁর সেই বন্ধু সমীর রুদ্র।” ওর হাত ধরে টানলাম। “ক্ষুধার রাজ্যে এখন পৃথিবী অন্যরকম হয়ে গেছে। দুটো বাজে। তুমি কি স্নান করবে? কী দরকার? আমি সপ্তাহে একদিন স্নান করি। আর শোনো ডার্লিং! খাওয়ার টেবিলে বসে খাদ্য ছাড়া অন্য কোনও আলোচনা চলবে না।”….

তিনটেয় অরিজিৎ এল।

জয়ন্তকে দেখে বলল, “জয়ন্তবাবু যে! গন্ধ পেয়েই ছুটে এসেছেন? তবে এই স্টোরিতে রোমহর্ষক বা রুদ্ধশ্বাস কিছু নেই, সো মাচ আই ক্যান টেল ইউ!”

বললুম, “জয়ন্তকে আজ সকাল থেকে আমিই আটকে রেখেছি।”

অরিজিৎ হাসতে লাগল। “তা হলে আপনার স্নেহবন্ধনে পড়ে ভদ্রলোকের খুব দুর্ভোগ হচ্ছে! ঠিক আছে। দেখুন, অন্তত বৈশম্পায়নের ব্যাপারটা থেকে একটা জমকালো স্টোরি ওঁকে দিতে পারেন নাকি।”

জয়ন্ত বলল, “মিঃ লাহিড়ি! আমার ধারণা, দা স্টোরি অলরেডি ইজ দেয়ার। এখন শুধু একটুখানি লিংক-আপ দরকার। বিটুইন এ অ্যান্ড বি।”

“সর্বনাশ!” অরিজিৎ চোখ বড় করে বলল। “প্রবাদ আছে, আমরা পুলিশেরা নাকি ছাইয়েরও দড়ি তৈরি করতে পারি। সাংবাদিকরা দেখছি আরও এককাঠি সরেস। গন্ধ দিয়েও দড়ি তৈরি করতে পারেন। আপনি সম্ভবত বৈশম্পায়নের সঙ্গে সমীর রুদ্রকে লিংক-আপ করার কথা ভাবছেন? কর্নেল হোয়াট ডু ইউ থিংক অব ইট?”

চোখ বুজে চুরুট টানছিলাম। বললাম, “একটা লিংক তো আছেই। পঁচিশ বছর পরে মিঃ রায় একটা বারে তার এক সময়ের বন্ধু মিঃ রুদ্রের দেখা পান। মিঃ রুদ্র ওঁকে চিনতে পারেন। অ্যান্ড ইউ নো হোয়াট হ্যাঁপড়। অনামিকা সেনের এপিসোড এসে যায় স্বভাবত। মিঃ রায় তার বন্ধুকে এড়িয়ে চলে আসেন। তারপর বিজ্ঞাপন, হুমকি দেওয়া লাল চিঠি। তারপর মিঃ রুদ্রের সুইসাইড। তো এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। মিঃ রায় বলছিলেন, অনামিকা রহস্যের ব্যাপারে মিঃ রুদ্রকে ওঁর খুব দরকার হয়ে উঠেছে। কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে তাকে যোগাযোগ করতে বলবেন।”

অরিজিৎ বলল, “বাসুকে আমি ওর অফিসে কন্ট্যাক্ট করেছিলাম। ও যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছুল, তখন বডি মর্গে পাঠানো হয়ে গেছে। বাসু সমীরবাবুর মাকে নিয়ে কসবায় পৌঁছে দিতে গেছে।”

বললাম, “ওঁর রিঅ্যাকশন কী?”

“ভীষণ আপসেট।”

 “মিঃ রুদ্রের স্ত্রী?”

“স্ত্রীর সঙ্গে ক’বছর আগে ডিভোর্স হয়ে গেছে। ভদ্রমহিলা আবার বিয়ে করেছেন। এখন মাদ্রাজে থাকেন। সমীরবাবুর হ্যাপিলাইফ ছিল না।”

একটু চুপ করে থাকার পর বললাম, “পাশের ফ্ল্যাটের কেউ গুলির শব্দ শোনেনি?”

“শুনে থাকতে পারে। বলছে না।” অরিজিৎ সিগারেটের প্যাকেট বের করে জয়ন্তকে দিল। নিজে একটা ধরাল। তারপর বলল, “পার্ক স্ট্রিট থানা থেকে লালবাজারে ও সি হোমিসাইডকে ঘটনাটা জানানো হয়েছিল। কারণ প্রথমে ওটা মার্ডার মনে হয়েছিল। যাই হোক, ওই সময় আমি সি পির ঘরে কনফারেন্সে ছিলাম। খবরটা দৈবাৎ পেয়েছিলাম। তবে সমীর রুদ্র নামটা শুনেই আমি ইন্টারেস্টেড হয়েছিলাম। বাসুকে ফোন করে আমি ঘটনাস্থলে গেলাম। ততক্ষণে বডি সরানো হয়ে গেছে। বডির পজিশন–একটা কাগজ দিন। এঁকে দেখাচ্ছি।”

টেবিল থেকে প্যাড দিলাম। অরিজিৎ চমৎকার একটা স্কেচ করল। দেখার পর বললাম, “বডি বাঁ পাশে কাত হয়ে পড়েছিল?”

‘ইনভেস্টিগেটিং অফিসারের বর্ণনা। শোবার ঘরের মেঝেয় কার্পেটের ওপর বাঁ পাশে কাত হয়ে–”

“বাঁ পাশে?”

অরিজিৎ তাকাল। “এনিথিং রং?”

 “নাহ্। রিভলভারটা দেখছি ডান হাতের বুড়ো আঙুলের কাছে!”

“ফটো তোলা হয়েছে। এক কপি প্রিন্ট পেয়ে যাবেন ইফ ইউ আর ইন্টারেস্টেড!”

“হ্যাঁ। তো রিভলভারটা ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়েছে?”

“অবশ্যই। আঙুলের ছাপ কালকের মধ্যেই পাওয়া যাবে। গুলিটা ওই রিভলভারের কি না, সেটাও দেখা দরকার। ছটা গুলির মধ্যে পাঁচটা আছে।”

“জল পড়ার ব্যাপারটা কী?”

 “ডাইনিংয়ের বেসিন খোলা ছিল।”

 “হুইস্কির বোতল আর গ্লাস কোথায় ছিল?”

“সরি। এঁকে দেখাচ্ছি।”

“থাক। মুখে বলো। পরে ফটোতে দেখে নেব।”

“শোবার ঘরেরই একটা গোল নিচু টেবিলে। টেবিলের তিনদিকে তিনটে কুশন। বডি থেকে জাস্ট দেড়-দু মিটার দূরে।”

“অ্যাশট্রে ছিল টেবিলে?”

অরিজিৎ হাসল। “অবশ্যই ছিল এবং একটা চারমিনারের প্যাকেটও ছিল। একটা লাইটার ছিল। প্যাকেটে একটামাত্র সিগারেট ছিল। অ্যাশট্রেতে অন্য ব্র্যান্ডের সিগারেটের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। আর কিছু?”

“ঘর থেকে শুধু বডি আর রিভলভার ছাড়া আর কিছু নিয়ে যাওয়া হয়নি?”

“নাহ্। আমাদের অফিসাররা অভিজ্ঞ এবং দক্ষ। তারা কনভিন্সড যে এটা সুইসাইড কেস।”

একটু হেসে বললাম, “কিন্তু তুমি কি কনভিন্সড?”

অরিজিৎ আস্তে বলল, “না হওয়ার কী আছে?”

 “ডার্লিং! তুমি আমাকে তিনবার রিং করেছিলে। তারপর তুমি ছুটে এসেছ। তুমি নিজের উৎসাহেই এসেছ। তোমার মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা লক্ষ করছি। হোয়াই ইট ইজ, অরিজিৎ? তুমি সিগারেটটাও এত শিগগির শেষ করে ফেললে!”

অরিজিৎ শুকনো হেসে সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিল। “মে বিবাসু আমার পুরনো বন্ধু এবং ওর এক পুরনো প্রেমিকার ব্যাপারটা আমাকে হল্ট করছে। এমনও হতে পারে, জয়ন্তবাবুর মতো আমিও নিজের অজ্ঞাতসারে একটা লিংক-আপ করে ফেলেছি। তবে সেটা বাসুর সঙ্গে নয়, অন্য কিছুর সঙ্গে। কিন্তু সেই অন্য কিছুটা এখনও আমার কাছেই স্পষ্ট নয়।”

“দেখ অরিজিৎ! অনেকসময় আমরা জানি না যে, আমরা কী জানি!”

অরিজিৎ একটু চুপ করে থাকার পর বলল, “বেসিন থেকে জল পড়ার ব্যাপারটাতে আমার একটা খটকা লেগেছে। একটা সহজ ব্যাখ্যা আমাকে দেওয়া হয়েছে : মাতাল সমীরবাবু বেসিন বন্ধ করেননি। এদিকে ডাক্তারের মতে, সমীরবাবুর মৃত্যু হয়েছে রাত দশটা থেকে বারোটার মধ্যে। কারণ বডির রাইগর মর্টিস শুরু হয়ে গিয়েছিল। তার মানে, প্রায় বারো ঘণ্টা ধরে বেসিনে জল পড়া উচিত।”

জয়ন্ত বলল, “পড়তেই পারে।”

অরিজিৎ বলল, “ওই ফ্ল্যাটের ডাইনিং রুমের সংলগ্ন মিসেস কাপাড়িয়ার ফ্ল্যাট। ভদ্রমহিলা জোর গলায় বলছিলেন, ভোর ছটা থেকে সাড়ে ছটার মধ্যে কোনও একসময় উনি জলপড়ার শব্দ শুনতে পান। রাত্রে তেমন কোনও শব্দ তিনি নাকি শোনেননি। ওঁর স্বামী বললেন, শি ইজ আ মেন্টাল পেশ্যান্ট। আমি ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি গুলির শব্দ শুনেছিলেন নাকি? উনি বললেন, নাহ্। দুপুর রাত্রি অব্দি নীচের রাস্তায় প্রচণ্ড গাড়ির শব্দ হয়। বিশেষ করে কয়েকটি মোটরসাইকেল আছে ওই বাড়িরই যুবকদের। তারা নাকি ইচ্ছে করেই যখন-তখন আওয়াজ দেয়। ফ্ল্যাটটা দোতলায়। কাজেই গুলির শব্দ মোটরসাইকেলের ব্যাকফায়ারের সঙ্গে মিশে যেতেই পারে। কিন্তু মিসেস কাপাড়িয়ার জলপড়ার শব্দ শোনাটা সন্দেহজনক। হ্যাঁ, মেন্টাল পেশ্যান্ট উনি। ওঁর স্বামী রিটায়ার্ড ডক অফিসার। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন দেখালেন আমাকে। ওঁর স্ত্রী ততক্ষণে হিস্টেরিক হয়ে উঠেছেন। এ নিয়ে, তখন ব্যাপারটাকে আর গুরুত্ব দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু”।

অরিজিৎ হঠাৎ চুপ করল। বললাম, “মেন্টাল পেশ্যান্ট হলেই যে মিথ্যা বলবেন, তার মানে নেই। তবে মেন্টাল পেশ্যান্টদের সমস্যা হল, ওঁদের কাছে রিয়্যাল-আনরিয়্যাল একাকার হয়ে যায়। মানসিক দিক থেকে সুস্থদের কছে যা অবাস্তব, মানসিক রোগীদের কাছে তা বাস্তব। নাহ্-সবসময় নয়, অন্তত কোনও কোনও সময়! কাজেই জলপড়ার ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই।”

জয়ন্ত বলল, “মিঃ রায় কিন্তু এখনও আপনার সঙ্গে যোগাযযাগ করছেন না, কর্নেল!”

অরিজিৎ বলল, “হি ইজ আপসেট। পরে করবেন নিশ্চয়।”

জয়ন্ত উত্তেজিত হয়ে উঠল। “ভুলে যাবেন না, একটা বারে সমীর রুদ্রের সঙ্গে রায়সায়েবের হঠাৎ দেখা হয়ে যাবার পর থেকেই এই ড্রামার শুরু। কর্নেল, বলুন তা-ই কি না?”

বললাম, “তুমি ড্রামা বলছ?”

“নিশ্চয় ড্রামা। রায়সায়েব সমীরবাবুর সঙ্গে যোগায়োগ করার জন্য ব্যস্ত। হয়ে উঠেছেন মনে হচ্ছিল কি না বলুন? কাগজে বিজ্ঞাপন দৈবার কথাও বলছিলেন। মনে করে দেখুন।”

“হুঁ।” সায় দিয়ে বললাম। “তোমার কথায় যুক্তি আছে।”

“হুমকি দেওয়া চিঠির পর রায়সায়েষের সমীরবাবুকে দরকার হল। কেন হল, এটা একটা পয়েন্ট।”

অরিজিৎ বলল, “আজ সকালে বাসু আমার ঠিকানা যোগাড় করে আমার কোয়ার্টারে গিয়ে দেখা করে। সবটা শোনার পর আমিও ওকে এই প্রশ্নটা করেছিলাম। ও বলল, অনামিকা কীভাবে নিখোঁজ হয়েছিল এবং তারপর কী কী ঘটেছিল, ও জানতে চায়। সেইসঙ্গে লালচিঠির হুমকি সম্পর্কেও সমীরবাবুর সঙ্গে বাসুর আলোচনা করার ইচ্ছা ছিল। ওর ধারণা, সমীর ওকে সাহায্য করতে পারবে। কোনও ইনফরমেশনও দিতে পারবে। কাজেই এ পয়েন্টটাতে কোনও গণ্ডগোল আমি অন্তত দেখছি না জয়ন্তবাবু!”

চুরুটটা নিভে গিয়েছিল। ধরাতে যাচ্ছি, ষষ্ঠী কফি আনল। সে নালবাজারের নাহিড়িসায়েব’-কে স্যালুট ঠুকতে ভুলল না। অনেক ছোটখাটো ব্যাপার আমাকে অবাক করে। ষষ্ঠী এমন চমৎকার স্যালুট ঠোকা কোথায় শিখল? চারটে বাজে। ওকে বললাম, “ছাদে যা শিগগির। দেখবি কয়েকটা টব ঢাকা দেওয়া আছে। খুলে দিয়ে আয়।”

ষষ্ঠী চলে গেলে অরিজিৎ বলল, “আপনার শূন্যোদ্যানের খবর কী?”

 “মোটামুটি ভাল।”

 “মোটামুটি কেন?”

“নাইজেরিয়ান অক্টোপাস প্ল্যান্টটা এখনও কলকাতার ক্লাইমেটের ধকল সামলাতে পারছে না।”

অরিজিৎ এবং জয়ন্ত খুব হাসতে লাগল। তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ কফি খাওয়ার পর অরিজিৎ বলল, “আমার একটা ব্যক্তিগত অনুরোধ, কর্নেল। শেকস্‌পিয়ার সরণির ওই ফ্ল্যাটটা আপনি গিয়ে একবার দেখুন। বহু কেসে– অফিসিয়ালি আপনার সাহায্য পুলিশ নিয়েছে। কিন্তু এটা আঅফিসিয়ালি। কারণ বাসু আমার পুরনো বন্ধু।”

“আচ্ছা অরিজিৎ! রিভলভারটার কি লাইসেন্স আছে? থাকলে কার নামে আছে?”

“সুইডিশ রিভলভার। সমীর রুদ্রকে কখনও কোনও ফায়ারআর্মসের লাইসেন্স দেওয়া হয়নি। কাজেই ওটা বেআইনি এবং চোরাচালানি জিনিস।”

“ফ্ল্যাটের চাবি পাওয়া গেছে?”

“হ্যাঁ। বালিশের তলায় ছিল। তবে একটা কথা জানিয়ে রাখা দরকার। ফ্ল্যাটের ওনারের শুধু ফার্নিচার ছাড়া কোনও কাগজপত্র নেই। সমীরবাবুরও নেই। তন্নতন্ন খোঁজা হয়েছে। আগেই বলেছি, সমীরবাবু মাঝেমাঝে গিয়ে থাকতেন। ওবাড়ির লোকেরা ওঁর সঙ্গে কখনও কোনও লোককে দেখেননি। একা যেতেন এবং একা থাকতেন। কাজেই কেসটি সুইসাইড।”

“কিন্তু তোমার মনে প্রশ্ন জেগেছে কেন?”

“বেসিনে জল পড়ার ব্যাপারটা আমার মাথায় ঢুকে গেছে।” অরিজিৎ হাসল। “মাথার ভেতর জলের শব্দ–”

অরিজিতের কথার ওপর বললাম, “চলো, বেরুনো যাক।”…