স্টোনম্যান – ৩

০৩.

 যে কোনও খুনের ঘটনায় পুলিশের কিছু ধরাবাঁধা ছক আছে, যেগুলি আইনের সূত্র ধরে তৈরি। পুলিশ দলটির সঙ্গে একজন ডাক্তার এবং একজন ফোটোগ্রাফার ছিলেন। ডাক্তার বাঙালি। রণধীর অধিকারি নাম। সুপর্ণের বডি পরীক্ষা করে তাকে মৃত ঘোষণা করলেন তিনি। ফোটোগ্রাফার সুরেন্দ্র সিং নানা অ্যাংগলে কয়েকটি ছবি তুললেন ক্যামেরায়। সেই ফাঁকে কর্নেলও ছবি তুললেন। পুলিশ ইনসপেক্টর হরিশ পাণ্ডে চটপটে মানুষ। বেলা পড়ে এসেছিল। অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে দুজন ডোম এসেছিল। তাদের বডি উঠিয়ে নিয়ে যেতে হুকুম দিলেন। বললেন, “বডি রেখে এসে এই পাথরটাও নিয়ে যাও।”

চন্দ্রকান্ত, রাতুল, কিংশুক, দীপিতা, বিনীতা পুলিশের সঙ্গে রাস্তা থেকে আবার ঘটনাস্থলে এসেছিল। হরিশ পাণ্ডে পুলিশি হাসি হেসে বললেন, “রায় সায়েব! এঁদের স্টেটমেন্ট নিতে হবে। সেটা এখানে সম্ভব নয়। থানায় যেতে হবে।”

চন্দ্রকান্ত গম্ভীর মুখে বললেন, “হ্যাঁ। চলো সব! কর্নেল সরকার! আপনি কি আমাদের গাড়িতে আসবেন?”

কর্নেল একটু হেসে বললেন, “জায়গা হবে না মিঃ রায়। আমি একা দুজনের জায়গা নেব।”

মিঃ পাণ্ডে বললেন, “কর্নেল সরকার আমার জিপে যাবেন। আপনারা চলুন।

“থ্যাংকস্ মিঃ পাণ্ডে!” কর্নেল বললেন। “ধারিয়া ফল্‌সের ধারে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত না দেখে আমি যাচ্ছি না। আপনারা চলুন!”

রোমেনা বলল, “আমি কর্নেল সায়েবের সঙ্গে গেলে আপত্তি আছে মিঃ পাণ্ডে?”

চন্দ্রকান্ত বললেন, “তোমার থাকার কি কোনও বিশেষ কারণ আছে রুমু?”

“কর্নেল সায়েবের সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।”

চন্দ্রকান্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, “কথা পরে বললেও চলবে। থানায় যাওয়াটা আগে দরকার।”

রাতুল বলল, “শি ইজ ম্যাড।”

 “শাট আপ!” রোমেনা প্রায় চেঁচিয়ে উঠল।

দীপিতা এসে ওর হাত ধরল। “প্লিজ রুমু! মাথা ঠাণ্ডা রাখো! সিন ক্রিয়েট করো না!”

মিঃ পাণ্ডে বাঁকা হেসে বললেন, “আপনারা সবাই আন্ডার সাসপিসন। চলুন! রায়সায়েব! প্লিজ, এদের বুঝিয়ে দিন আইনত আমাকে যা করার করতেই হবে।”

চন্দ্রকান্ত তাড়া দিলেন, “চলো সব।”

রোমেনা গোঁ ধরে বলল, “আমাকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে চলুন তা হলে বাই ফোর্স। কিন্তু আমি বলছি, থানায় নিশ্চয় যাব। যা বলার বলব। এখন কর্নেল সায়েবের সঙ্গে আগে কিছু কথা বলা আমার খুবই দরকার। প্লিজ আন্ডারস্ট্যান্ড ইট, মিঃ পাণ্ডে!”

কর্নেলের দিকে তাকালেন হরিশ পাণ্ডে। বর্নেল আস্তে বললেন, “আমি রোমেনার সিওরিটি, মিঃ পাণ্ডে। আমি ওকে থানায় নিয়ে যাব। যদি আমার ওপর আপনার আস্থা থাকে”।

মিঃ পাণ্ডে হাসলেন। “দ্যাটস ওক্কে কর্নেল সরকার!”

 কিংশুক রোমেনাকে কিছু বলবে বলে ঠোঁট ফাঁক করেছিল। বলল না। হন হন করে এগিয়ে গেল। ডোম দুজন ফিরে এসে মিঃ পাণ্ডের কথামতো রক্তমাখা পাথরটা নিয়ে গেল। পাথরটা কুড়ি কেজি হওয়া আশ্চর্য নয়, কর্নেলের মনে হল। একটু পরে গাড়িগুলো চলে যাওয়ার পর আসন্ন সন্ধ্যার বনভূমিতে শুধু বাতাসের শব্দ। পাখিদের চ্যাঁচামেচি কমে যাচ্ছিল। কর্নেল বেদির একটা পাশে ঘাসের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ হাঁটু গেড়ে বসে ঘাস সরালেন। তারপর আরও দু পা এগিয়ে গেলেন। রোমেনা কাছে গিয়ে বলল, “কী দেখছেন?”

কর্নেল একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, “রাবর দেখে আসছি, বিশেষ করে আজকাল পুলিশ রুটিন ওয়ার্কসের বাইরে কিছু করে না। আসলে খুনোখুনি প্রচণ্ড বেড়ে যাচ্ছে। তাই একটা খুনের পেছনে বেশি সময় দেওয়ার সুযোগও পুলিশের কম।”

রোমেনা ঝাঁঝালো গলায় বললো, “আপনি কি দেখলেন অমন করে?”

“স্টোনম্যানের পায়ের রক্তের ছাপ।”

রোমেনা তাকিয়ে রইল।

শেষ রোদের লালচে ছটা ক্ৰমে ফিকে হতে হতে ধূসর হচ্ছে। কর্নেল আবার দু পা এগিয়ে পায়ের জুতোয় ঘাস সরিয়ে বললেন, “এই পথে স্টোনম্যান ফিরে গেছে।”

আরও খানিকটা এগিয়ে ছোট্ট একটা ডোবা। কিছু জল জমে আছে। রোমেনার চোখে পড়ল, জলের ধারে বালিতে জুতোর খুব আবছা ছাপ। কর্নেল জুতোর ছাপের কাছে গিয়ে বললেন, “সাবধানী স্টোনম্যান এখানে রক্ত ধুয়েছে জুতোর। ছাপটা দেখে মনে হচ্ছে সে একজন বেঁটে মানুষ।”

দুটো উঁচু পাথরের মাঝখান দিয়ে কিছুটা এগিয়ে ঢালু ঘাসের জমি। জমিটার নীচেই ধারিয়া ফসের ওপরের অংশ। রোমেনা বিস্ময়ে বলে উঠল, “এটা শর্টকাট দেখছি!”

 “হ্যাঁ। সুপর্ণ এই শর্টকাটে এসে লুকিয়ে ছিল থানের কাছে। জানি না স্টোনম্যানও শর্টকার্ট করে একই পথে এসেছিল, নাকি টিলা বেয়ে নেমেছিল।”

রোমেনা চমকে উঠল। “কিন্তু ফল্‌সের মাথায় আমরা ছিলুম! দেখতে পেতুম তাকে।”

“তখন ছিলে না। তোমার বর্ণনা অনুসারে সবাই ব্যস্তভাবে সুপর্ণকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলে।”

“মামাবাবু ছিলেন!”

“মিঃ রায় সম্ভবত অন্য দিকে ঘুরে বসে ছিলেন। তাই দেখতে পাননি স্টোনম্যানকে।”

কর্নেল ফল্‌সের মাথায় গিয়ে দাঁড়ালেন। রোমেনা একটু ইতস্তত করে বলল, “আমার কিছু কথা বলার ছিল!”

“হু, তুমি বলেছিলে বটে। এবার বলতে পারো!” কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুটটা ধরালেন।

রোমেনা চারদিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল, “এখানে আমার কেন কে জানে অস্বস্তি হচ্ছে। বরং চলুন রাস্তায় যেতে যেতে বলব।”

কর্নেল হাসলেন। পাঁচ মাইল রাস্তা। তোমার হাঁটার অভ্যাস নেই। শর্টকাটে দু মাইল নাক বরাবর। কিন্তু চড়াই ভাঙতে হবে। জঙ্গল আর পাথর প্রচুর।

রোমেনা একটু ভেবে নিয়ে ধরা গলায় বলল, “আজ আমি সব কষ্ট সহ্য করত পারব। আমার জীবন শূন্য হয়ে গেছে কর্নেল!”

“বুঝতে পারছি।” বলে হঠাৎ কর্নেল এগিয়ে গেলেন সেই পাথরের ফাঁকে ঝোঁপটার দিকে, যেখানে রোমেনা লুকিয়ে ছিল এবং ঝোঁপটায় সাদা ফুলের ঝক।

রোমেনা দেখল, কর্নেল পিঠের কিটব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট স্টিক বের করলেন। স্টিকটা টেনে বড় করলেন। তারপর স্টিকের ডগায় একটা সূক্ষ্ম সবুজ রঙের জাল ছাতার মতো ছড়িয়ে গেল। ঝোঁপের ফুলে একটা প্রজাপতি অবেলায় ছটফট করে উড়ছিল। সেটা জালে আটকানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু ধূর্ত প্রজাপতিটা পালিয়ে গেল। জালটা গুটিয়ে স্টিকটা ছোট করে পিঠের কিটব্যাগে ভরে কর্নেল বললেন, “এস!”

দুজনে একটা খাত ধরে এগিয়ে একটা ঢালু টিলায় উঠলেন। রোমেনা টিলার মাথায় ওঠার পর থমকে দাঁড়াল। টিলার মাথায় এখনও দিনের আলো আছে। সে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, “আপনি দা হুইল অব লাভের কথা বলছিলেন?”

কর্নেল বাইনোকুলারে দূরে কিছু দেখতে দেখতে বললেন, “হু।”

“কিংশুক সুপর্ণকে ফসের পাশ দিয়ে নিচে নামার জন্য মাউন্টেনিয়ারিং অ্যাডভেঞ্চারে ডাকছিল। সুপর্ণ গেল না। কিন্তু আমার কানে কিংশুকের এই কথাটা ধাক্কা দিয়েছিল। মনে হচ্ছিল, সে সুপর্ণকে হয়তো”

রোমেনা থেমে গেলে কর্নেল বললেন, “বুঝেছি।”

রোমেনা মুখ নিচু করে আস্তে বলল, “তারপর হাইড অ্যান্ড সিক গেমের সময় একটা ঝোঁপের আড়ালে ঝাঁপিয়ে পড়ে হঠাৎ রাতুল আমাকে আমাকে কিস করল। আমি বাধা দেওয়ার সুযোগ পেলাম না। কিংশুক হয়তো ব্যাপারটা দেখেছিল। কিংশুক রাতুলের ওপর প্রচণ্ড ইর্ষায় তাকে সুপর্ণের মার্ডারের জন্য যেন দায়ী করতে চায় মনে হচ্ছিল।” রোমেনা বিহ্বলতার মধ্যে বলতে থাকল, “কিংশুকের সঙ্গে দীপিতার প্রেম আছে। দীপিতা গতরাতে সুপর্ণের সঙ্গে লনের গাছপালার ভেতর দাঁড়িয়ে ছিল লক্ষ্য করেছি। কিংশুক তাই সুপর্ণকে মেরে রাতুলের কাঁধে দায় চাপাতে চায়।”

কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন, “তোমার থিওরিতে–আমাকে ক্ষমা করো ডার্লিং ফেমিনিন লজিক কাজ করছে। তুমি হয়তো কেসটাকে জটিল করে ফেলছ।”

রোমেনা হাঁটতে হাঁটতে বলল, “আপনি যা-ই বলুন, সুপর্ণকে রাতুল মেরেছে। কলকাতার স্টোনম্যানের মোডাস অপারেন্ডি অনুসারে কাজটা সেই-ই করেছে।”

আবার ঢাল বেয়ে নেমে জঙ্গলে আদিবাসীদের পায়ে চলা একফালি পথে পৌঁছলেন কর্নেল। তারপর বললেন, “সুপর্ণ এবং তোমার মধ্যে গভীর এমোশনাল সম্পর্ক ছিল। অথচ তোমরা বিয়ে করোনি কেন?”

“সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারছিলুম না।” রোমেনা একটু চুপ করে থাকার পর ফের বলল, “সুপর্ণও পারছিল না। তবে আমার বাবা-মা সুপর্ণকে পছন্দ করতেন না। সুপর্ণ তা জানত।”

“সুপর্ণের বাবা-মা?”

 “ওর বাবা-মা বেঁচে নেই। দাদা-বউদির সঙ্গে থাকত।”

 “কিংশুকের বাবা-মাকে চেনো?”

রোমেনা ঝাঁঝালো স্বরে বলল, “কিংশুকের বাবার ইমপোর্ট-এক্সপোর্টের কারবার আছে। একবার ওঁদের বাড়িতে রেভেনিউ ইনটেলিজেন্স থেকে রেড হয়েছিল। কালো টাকার যখ। জেল খাটতে হত। আমার বাবা তখন হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করতেন। বাঁচিয়ে দেন। লোকটার অডাসিটি! আমার সঙ্গে কিংশুকের বিয়ের প্রোপোজাল দিয়েছিল। বাবা রাজি হননি।”

“ক্ষমা করো এ প্রশ্নের জন্য। কিংশুক কি তোমার সঙ্গে–”

রোমেনা দ্রুত বলল, “হি ইজ আ লোফার! আমাকে অ্যাপ্রোচ করেছিল। আই হেট হিম!”

“তবু তুমি কিংশুক যে দলে আসছে, সেই দলে এসেছ?”

“সুপর্ণের এবং দীপিতার টানে।” রোমেনা হাঁটতে হাঁটতে থমকে দাঁড়াল। “আপনাকে বলা হয়নি, কিংশুকের সঙ্গে দীপিতার বিয়ের কথা হয়েছে। দীপিতার বাবা স্কুলটিচার। প্রোপোজাল পেয়ে বর্তে গেছেন।”

“কিংশুক ও দীপিতার মধ্যে এমোশনাল সম্পর্ক আছে?”

একটু পরে রোমেনা বলল, “আছে–মানে ছিল। এখানে এসে লক্ষ্য করেছি, কিংশুক ওর ছোট বোন বিনীতার সঙ্গে ভাব জমাতে চাইছে। এদিকে দীপিতা সুপর্ণের সঙ্গে গতরাতের কথা তো বলেছি আপনাকে।”

এতক্ষণে টর্চ জ্বালাতে হল। আবার একটা চড়াই। কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে না তো?”

রোমেনা বলল, “নাহ্।”

কুড়ি মিনিট চড়াই ভেঙে উত্রাই শুরু হল। উত্রাইয়ের শেষে পিচের রাস্তা। কিছু দোকানপাট। সেখানে একটা সাইকেলরিকশো নিলেন কর্নেল। ল্যাক রিসার্চ সেন্টারের গেস্টহাউসে পৌঁছে বললেন, “কফি খেয়ে একটু বিশ্রাম করা যাক। তারপর তোমাকে থানায় পৌঁছে দেব।”

রোমেনা লনে হাঁটতে হাঁটতে দ্বিধাজড়ানো গলায় বলল, “থানায় যেতেই হবে আমাকে?” 

“হ্যাঁ ডার্লিং! তোমার স্টেটমেন্ট পুলিশ নেবে। আমি কথা দিয়েছি।”

রোমেনা আস্তে বলল, “আমি স্ট্রেটকাট বলব, কিংশুক মার্ডার করেছে সুপর্ণকে।”

“কিন্তু তুমি দেখনি!”

 “দেখিনি বাট আই সাসপেক্ট হি ইজ দ্য কিলার।”

“না রোমেনা। যা যা ঘটেছে–মানে যা-যা দেখেছে, তা-ই বলবে পুলিশকে। তোমার কী ধারণা বা সন্দেহ, তা বলবে না। তাতে পুলিশ বিভ্রান্ত হবে।”

রোমেনা চুপ করে থাকল।

গেস্টহাউসের দোতলায় নিজের রুমে ঢুকে কর্নেল কিটব্যাগ, ক্যামেরা ও বাইনোকুলার রাখলেন। বোতাম টিপে বেয়ারাকে ডেকে ক্যান্টিন থেকে কফি আর কিছু স্ন্যাক্স আনতে বললেন। তারপর রোমেনাকে বললেন, “বাথরুমে যাও। মুখে-হাতে জল দিয়ে এস। পা ধুয়ে ফেলো, ক্লান্তি চলে যাবে।”

রোমেনা বাধ্য মেয়ের মতো কথা শুনল। তাকে এবার একটু ফ্রেশ দেখাচ্ছিল। কফি আর স্ন্যাক্স দিয়ে গেল বেয়ারা। কর্নেল বললেন, “কফি নার্ভকে চাঙ্গা করে। কফি খেয়ে নাও।”

কফি খেতে খেতে রোমেনা বলল, “আমার ধারণা, কিংশুককে আপনি মার্ডারার বলে সন্দেহ করছেন না।”

কর্নেল একটু হেসে সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, “নাহ্। করছি না।”

 “কেন?”

“প্রথম কারণ, এই পাথর তুলে এক ঘায়ে সুপর্ণের মতো শক্তিমান যুবককে মেরে ফেলার জন্য যা শারীরিক ক্ষমতা দরকার, তা রোগা কিংশুকের নেই। দ্বিতীয় কারণ, সে ফিল্ম অনুরাগী। ডকু মুভি-মেকার। কাজেই আর্টিস্ট। কোনও আর্টিস্ট যত এমোশনাল হোক, সে খুনের ব্যাপারে রিস্ক নিতে চাইবে না। ব্যতিক্রম থাকতে পারে। তৃতীয় এবং ভাইটাল কারণ, তার খুনের মোটিভ অত্যন্ত অস্পষ্ট। শুধু তাই নয়, যথেষ্ট জোরালো নয়। ডার্লিং! নরহত্যা–অন্তত এই বিশেষ ক্ষেত্রে একটা দুঃসাহসী কাজ।”

রোমেনা মুখ নামিয়ে কফিতে চুমুক দিল। তারপর আস্তে বলল, “তা হলে রাতুল ফিট করে যায় আপনার থিওরির সঙ্গে। হি কিম্ভু মি সাডনলি। আই ওয়াজ সো মাচ শন্ড আই কুডষ্ট রেসিস্ট হিম। আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলুম। বাধা দিতে পারিনি। ভীষণ ভীষণ লজ্জা আর অবাক” সে থেমে গেল। মুখ লাল হয়ে উঠল। নাসারন্ধ্র স্ফীত হল রোমেনার।

কর্নেল প্রায় অট্টহাসি হাসলেন। “নাহ্ রোমেনা! রাতুল তোমাকে পেতে চাইলে সুপর্ণকে তার খুন করার দরকার হবে কেন? তুমি তার এমোশনাল অ্যাটাচমেন্টে বাধা দাওনি। চুপ করে ছিলে। সে এ থেকে ভেবেছে, তোমার সম্মতি আছে। কাজেই সে যত দুঃসাহসী বা গোঁয়ার হোক, কিংবা সুপর্ণকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করুক, তাকে তার খুন করার প্রয়োজন হবে কেন?”

রোমেনা ভাঙা গলায় বলল, “তা হলে কে মারল সুপর্ণকে?”

“আমি ঘটনাস্থল দেখে এবং তোমার মুখে শুনে জাস্ট একটা থিওরি গড়ে তুলেছি–সেটা আপাতত মোডাস অপারেন্ডি সংক্রান্ত। খুনীর চেহারা এখনও তাতে অস্পষ্ট। আমাকে স্ট্রং মোটিভ খুঁজে বার করতে হবে আগে।” কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, “সাইকিক খুনীদের প্রশ্ন উঠছে না। কারণ এই এলাকায় তেমন কোনও খুনখারাপি ঘটেনি। খুনের প্রধানত দুটো উদ্দেশ্য। থাকে — ব্যক্তিগত লাভ এবং প্রতিহিংসা চরিতার্থ। আরেক ধরনের খুন আছে। দৈবাৎ আঘাতে মৃত্যু। ধরো তুমি রাগের বশে কাউকে আঘাত করলে। সে মারা পড়ল। একে বলে ম্যানস্লটার। আবার এমনও হতে পারে, তোমার একটা অসতর্ক কাজের ফলে কেউ মারা পড়ল।”

কর্নেল কফি শেষ করে চুরুট ধরিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। “চলো, থানায় ওঁরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।”

সাইকেলরিকশোয় থানার দিকে যেতে-যেতে রোমেনা বলল, আমাদের সবাইকে পুলিশ অ্যারেস্ট করবে তাই না?”

কর্নেল বললেন, “দ্যাট ডিপেন্ডস। পুলিশ নিজের পদ্ধতিতে কাজ করে।”

 “মামাবাবুকেও কি অ্যারেস্ট করবে?”

“পুলিশের ইচ্ছা। তবে উনি এলাকার প্রভাবশালী মানুষ। কর্নেল রোমেনার দিকে ঘুরলেন। “কেন এ কথা জিজ্ঞেস করছ?”

রোমেনা আস্তে বলল, “এমনি।”

“ওঁর সঙ্গে তোমার আগে পরিচয় ছিল?”

“নাহ্। এই প্রথম দীপিতার সঙ্গে এসে পরিচয় হল। জলি মানুষ। শিগগির আপন করে নিতে পারেন। তা ছাড়া মডার্ন-মাইন্ডেড।”

“হ্যাঁ চন্দ্রকান্ত রায় চমৎকার মানুষ। এক সময় নামকরা শিকারি ছিলেন। বাই দ্য বাই, সুপর্ণের সঙ্গে ওঁর পরিচয় ছিল?”

“নাহ্। থাকলে আমি জানতে পারতুম।”

থানায় পৌঁছলে পুলিশ ইন্সপেক্টার হরিশ পাণ্ডে সহাস্যে বললেন, “সরি। কর্নেল সরকার! আপনি এ কেসে কোনও রহস্য খুঁজতে গেলে ব্যর্থ হবেন। আই বি থেকে ইনফরমেশন আছে, ধারিয়া এলাকায় আদিবাসীরা আউটসাইডারদের বরদাস্ত করছে না। বিশেষ করে ওদের সম্প্রতি একটা গোপন মিটিং হয়েছে। ধারিয়া ফসের কাছে ওদের দেবতার থানে কোনও নন-ট্রাইবালকে পেলেই ওরা বলি দেবে। অফ কোর্স, মিস চৌধুরী এবং আপনার স্টেটমেন্ট ফরম্যালি নেব। মিস চৌধুরী, চলুন। পাশের ঘরে গিয়ে স্টেটমেন্ট দেবেন। তারপর আপনারা ফ্রি। তবে দরকার হলেই আমরা ডাকব। আপনাদের আসতে হবে।”…

.