ভালবাসার অন্ধকারে – ৩

০৩.

 দুপুরে খেতে এসে ঘনশ্যাম বলল, “আজ ফিরতে দেরি হবে। আর্জেন্ট ব্যাপার। বহরমপুর যেতে হবে। ডি এম ও অফিস থেকে খবর এসেছে। আগামী পরশু থেকে পুজোর জন্য চারদিন ডি এম ও অফিস বন্ধ। ওদিকে ট্রেজারি ব্যাংক সবই বন্ধ। রিকুইজিশন ফাইল আর পে-বিল আজই চারটের মধ্যে সাবমিট করে আসতে হবে। নইলে কাল মাইনে-টাইনে হবে না। এদিকে আমাদের অফিস শুধু বিসর্জনের দিনটা বন্ধ।” সে হাতমুখ সাবান দিয়ে রগড়ে ধুয়ে এল অন্যদিনের মতো। স্নান করল না। খেতে বসে অভ্যাসমতো বকবক করতে লাগল। “ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো পেয়েছে আমাকে। ক্ল্যারিক্যাল কাজকর্মও করিয়ে ছাড়ে। কি না আমার সঙ্গে ডি এম ও অফিসের খুব খাতির। যখন ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ে ছিলুম, বেশ ছিলুম। ওয়েলফেয়ার অফিসার করে আমার বারোটা বাজালে। যত রাজ্যের পাগল নিয়ে কারবার। আজকাল ভয় করে, আমিও না পাগল হয়ে যাই।” হাসতে গিয়ে তার মুখের ভাত ছিটকে পড়ল।

গার্গী চুপচাপ শুনছিল। কোনও কথা বলল না।

খাওয়া শেষ হলে ঘনশ্যাম বাথরুমে আঁচাতে গেল। গার্গী এঁটো কুড়িয়ে থালা বাটি গেলাস সংলগ্ন কিচেনের ছোট্ট বারান্দায় রাখল। ঘনশ্যাম তোয়ালেতে হাত-মুখ মুছে সিগারেট ধরিয়ে বলল, “দুটো পাঁচে ট্রেন। কিন্তু এ লাইনের কোনও টাইমের বালাই নেই। ট্রেনে গেলে একটু আরামে যাওয়া যেত। বাসেই যাই। বড্ড ঝুলো ঝুলি ভিড়। দেখি।”

গার্গী এতক্ষণে বলল, “কখন ফিরবে?”

“ট্রেনে ফিরলে সাড়ে আটটা-নটা হয়ে যাবে। লাস্ট বাস অবিশ্যি ছটায়। পৌঁছুতে পঁয়তাল্লিশ মিনিট।” বলে সে ঘরে ঢুকে পোশাক বদলাতে গেল।

গার্গী স্বামীকে দেখছিল। ঘরে ভেতর শুধু আন্ডারওয়্যার পরা ঘনশ্যামের শরীর যেন মানুষের নয়। পুরুষ অবয়বেরই একটা বিকৃতি। পরমুহূর্তে গার্গীর মনে হলো, শরীর সম্পর্কে তার এই অনুভূতি নতুন আর আকস্মিক। এতদিন তো সে তার স্বামীর শরীর সম্পর্কে এমন সচেতন ছিল না! পলকের জন্য গৌতমের সুঠাম শরীরের লাবণ্য তার চেতনায় এসে আছড়ে পড়ল। একটু বিব্রত বোধ করল সে।

প্যান্টশার্ট পরে সব্যভব্য হয়ে ঘনশ্যাম বেরিয়ে এল। বলল, তোমাকে অমন দেখাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ নাকি? খেয়ে নাও।”

গার্গী বলল, “খাচ্ছি।”

ঘনশ্যাম সাইকেলটা বারান্দায় নিয়ে এল। ব্যাকসিট থেকে ব্রিফকেসটা খুলে নিয়ে একটু ইতস্তত করে বলল, “জুতোর বাক্সটা আছে, না গৌতম নিয়ে গেছে?”

“আছে।”

“থাক। ও নিয়ে ভেবো না। গৌতম যা করার করবে। তুমি খেয়ে নাও।” বলে ঘড়ি দেখে ঘনশ্যাম তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল।

গার্গী ছোট্ট উঠোনটুকু পেরিয়ে আজ স্বামীকে বিদায় দেওয়ার ভঙ্গিতে সদর দরজায় গেল। ঘনশ্যাম পিছু ফিরল না। সংকীর্ণ পিচ রাস্তা ধরে হনহন করে হাঁটছিল সে। একটু দূরে পার্ক। পার্কের পাশ দিয়ে বড় রাস্তায় অদৃশ্য হলে শ্বাস ছেড়ে গার্গী দরজা বন্ধ করল।

তারপর তার বুক ধড়াস করে উঠল। শরীর ভারী বোধ হলো। আজ দুপুরে যদি গৌতম আসে?

ভাল করে খেতে পারল না গার্গী। এঁটো থালাবাসন রোজকার মতো ধুয়ে রাখল না। ঘনশ্যাম মুখে অবশ্য একটা কাজের মেয়ে রাখতে চেয়েছিল। গার্গীই রাখতে দেয়নি। ছোট্ট একটা সংসারে কী এমন কাজ? বহরমপুরে থাকার সময়ও কাজের মেয়ে ছিল না। গার্গী বারান্দায় কিছুক্ষণ আনমনে দাঁড়িয়ে থাকার পর ঘরে ঢুকল। আয়নার সামনে নিজেকে দেখতে গেল। আর সহসা তাকে একটা উন্মাদনা ভর করল। সে মুখে একটু স্নো ঘষল। কপালে নতুন করে টিপ পরল। তারপর কবে বহরমপুরে কেনা সেন্টের শিশি খুলে গলায় বুকে কাঁধে ছড়াল। তার হাত কাঁপছিল।

সে বিছানায় বসে বালিশে হেলান দিয়ে একটা পুরনো সিনেমা পত্রিকা পড়ার চেষ্টা করল। মন বসল না। সেই দুরুদুরু বুকের প্রতীক্ষা তাকে অস্থির করছিল। ট্রানজিস্টারটা আস্তে বাজছিল। সে মাঝে মাঝে জানলায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছিল। ভয়াল ছাতিম গাছটা আজ জৈব হয়ে উঠেছে এবং তার দিকে কেমন চোখে তাকাচ্ছে। আজ বাতাস বন্ধ। গঙ্গার ধারের বনভূমি শ্বাস বন্ধ করে কী যেন ঘটবার প্রতীক্ষা করছে। আকাশ গনগনে নীল। আর সেই ব্যাপক শূন্যতা বেয়ে কী একটা পাখি ওঠানামা করছে। গার্গীর মতো–ঠিক যেন গার্গীর মতোই কোথাও পৌঁছুনোর ব্যাকুলতা।

গৌতম এল যখন, তখন প্রায় সাড়ে তিনটে বাজে। বলল, “ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। শোনো, শ্যামদা ফিরলে নৌকো করে পঞ্চমুখী শিবের মন্দিরে বেড়াতে যাব। দারুণ লাগবে। মাত্র মাইল তিনেকের নৌকোযাত্রা। ফেরার সময় কারেন্টের টানে পনের মিনিটের বেশি লাগবে না।”

গার্গী আস্তে বলল, “আমি যাব না।”

গৌতম তার গাল টিপে দিয়ে বলল, “ব্যাপার কী? শ্যামদার সঙ্গে ঝামেলা হয়ে গেছে নাকি?” বলেই সে হাসল। “সেন্টের গন্ধে জ্বালিয়ে দিলে যে! তার মানে, হাজব্যান্ডের সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করেছ।”

গার্গী চোখ পাকিয়ে বলল, “শট আপ! বাজে কথা বোলো না।”

“মাই গুডনেস!” গৌতম নড়ে বসল। “বারান্দায় সাইকেলও দেখলুম। নাহ্, কেটে পড়ি। শ্যামদা কোথাও সুঁই ফোঁটাতে গেছে নিশ্চয়।”

গার্গী তার হাত ধরে টেনে বসাল। তারপর স্বাভাবিক কণ্ঠস্বরে বলল, “ও অফিসের আর্জেন্ট কাজে বহরমপুর গেল। ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।”

গৌতম মিটিমিটি হেসে বলল, “বাহ্! তাহলে তো আমরা অনায়াসে নৌকোভ্রমণ করে আসতে পারি। নৌকো বলা আছে। বিলিভ মি, পাঁচটাকা অ্যাডভান্সও করেছি। ওই ছাতিমতলার ঘাটে চারটেয় অপেক্ষা করে ঝাব্বুলাল। ছই দেওয়া নৌকো। রোদ লাগলে ভেতরে বসব।” সে গার্গীকে দু’হাতে টেনে চুমু খেল। গার্গী বাধা দেওয়ার ভান করল মাত্র। গৌতম বলল, “নাও! ঝটপট শাড়ি বদলে নাও। আর শোনো, কক্ষণো ওসব সেন্টফেন্ট মাখবে না। তোমার শরীরের একটা আশ্চর্য সুন্দর গন্ধ আছে। তুমি জানো না।

গার্গীর মনে একটা আবেগ এসেছিল। যৌবন যখন যৌবনকে ছোঁয়, তখন এই আবেগটা আসে একটা বিস্ফোরণের মতো। সে বলল, “তুমি বাইরে যাও।”

“কেন? আমার সামনে শাড়ি বদলাতে লজ্জা! ঠিক আছে। আমি চোখ বন্ধ করছি।”

“না।“

গৌতম হাসল। “কিন্তু জানালা খোলা। অন্য কেউ দেখে ফেলতে পারে।”

গার্গী উঠে গিয়ে জানলাটা বন্ধ করল। বলল, “যাও! বেরোও।”

 গৌতম প্রেমিকের গলায় বলল, “না। প্লিজ গার্গী! আমাকে দেখতে দাও।”

 “কী দেখবে?”

“তোমাকে।”

 “শুধু অসভ্যতা!”

“না গার্গী! তোমার শরীর–ডোন্ট ফরগেট, আমি হাফ ডাক্তার তোমার মতো এমন মিনিংফুল বডি আমি আর দেখিনি। তুমি তো জানো, আমাকে কত ডেডবডি ঘাঁটতে হয়েছে ইভন, তোমার বয়সী কত সুন্দর মেয়ের বডি! সব বডিই নিছক বডি।”

গার্গী চোখে হেসে বলল, “আমার ডেডবডি দেখো!”

গৌতম উঠে গিয়ে তার মুখ চেপে ধরল। “না! ও কথা বোলো না!” তারপর বারবার চুমুতে তার সারা মুখ, গলা, কাঁধ ভরিয়ে দিল। গার্গী জড়ানো গলায় বলল, “আহ্! কী করছ? দরজা খোলা।”

গৌতম দরজা বন্ধ করল। তারপর কালকের মতোই সে ঝাঁপিয়ে পড়ল গার্গীর ওপর। দু’হাতে তাকে তুলে নিয়ে খাটে শুইয়ে দিল। গার্গী বাধা দিতে পারল না। যৌবন যৌবনের মধ্যে ডুবে যাচ্ছিল।

কিছুক্ষণ পরে গৌতম আস্তে বলল, “নৌকো ওয়েট করছে। ছাড়ো!”

গার্গী অস্ফুটস্বরে বলল, “করুক।”

“প্লিজ! ছাড়ো!”

“না। তোমাকে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না।”

গৌতম তার কপালে চুমু দিয়ে বলল, “হঠাৎ কেউ এসে পড়তে পারে। ছাড়ো লক্ষ্মীটি!”

“আমার ঘুম পাচ্ছে।”

গৌতম হাসল। “সর্বনাশ! এই অবস্থায় ঘুমোবে নাকি?”

“হুঁউ।“

“আয়নায় দেখ, আমরা কী অবস্থায় আছি।”

গার্গী মুখটা একটু ঘুরিয়ে আয়নার প্রতিবিম্বিত দুটি নগ্ন শরীর দেখেই প্রচণ্ড লজ্জায় গৌতমকৈ ঠেলে দিল। তারপর হাত বাড়িয়ে সায়া কুড়িয়ে নিজেকে ঢাকল।…

.

ছাতিমতলার ঘাটে ঝাঝুলাল মাঝি নৌকো বেঁধে বিড়ি টানছিল। এখানটা পুরনো দহ। তাই স্রোত নেই। গৌতম নৌকোয় উঠে হাত বাড়িয়ে গার্গীকে উঠতে সাহায্য করল। নৌকো চলতে থাকল তীর ঘেঁষে। স্রোতের উজানে হলেও তীরের কাছে স্রোতের গতি মন্থর। বিকেলেও শরৎকালের রোদটা চড়া। কিন্তু গার্গী ছইয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এতদিনের আনন্দহীন একঘেয়ে জীবন এমন করে স্বর্গের দরজা খুলে যাবে সে কল্পনা করেনি। সে মুগ্ধ চোখে আর আবিষ্ট মনে নিসর্গ দেখছিল।

গৌতম পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিল। চাপা স্বরে বলল, ভাবতে খারাপ লাগছে, আবার কলকাতা ফিরে যেতে হবে। আবার সেই ন্যাস্টি পরিবেশ, রোগীর ভিড়, যত রকমের কদর্য সব অসুখ। নেচার মানুষকে একটা বডি দিয়েছে। অথচ সেই বডির মধ্যেই যেন হেল অ্যান্ড হেভেন। আনন্দ আর যন্ত্রণা।”

গার্গী বলল, “তোমাকেও দেখছি ওর স্বভাব পেয়েছে। খালি বকবক।”

 “তুমিই হয়তো শ্যামদার মতো আমাকেও ফিলোজফার বানিয়ে ছেড়েছ!”

“তার মানে?”

“তোমাকে লক্ষ্য করে বড় কথা বলতে ইচ্ছে করে। নাকি তুমি প্রতিবাদ করো না বলে?”

“আমি ওসব বুঝি না।”

কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর গৌতম বলল, “তখন একটা কথা ভাবছিলাম।”

“কী?”

“আমার ভবিষ্যৎ পেশা ডাক্তারি। আমি মানুষের বডি সম্পর্কে পড়াশুনা করছি ছ’বছর ধরে। এটা শেষ বছর। কিন্তু মানুষের বডির একটা মিনিংফুল সাইড আছে–তখন যা বলছিলুম, এটা এমন করে বুঝিনি। তুমি আমাকে এই জ্ঞানটা দিয়েছ।”

সে হাসতে লাগল। গার্গী বলল, “চুপ! লোকটা ওভারহিয়ার করছে।”

“নাহ। ও এসব বোঝে না।”

 “বোঝে না। তোমার মত ন্যাকা।”

 “দারুণ বলেছ, আমি এতদিন সত্যি ন্যাকা ছিলুম।”

 “হুঁ, গাল টিপলে দুধ বেরুত। ওসব চালাকি ছাড়ো তো।”

“কেন চালাকি বলছ?”

 গার্গী মুখ ঘুরিয়ে খুব আস্তে এবং চোখে হেসে বলল, “তুমি ওসব ব্যাপারে এত এক্সপার্ট হলে কী করে? নিশ্চয় এক্সপিরিয়েন্স আছে।”

গৌতম দ্রুত বলল, “বিলিভ মি। থিওরিটিক্যাল নলেজ। তাছাড়া ডাক্তারদের সেক্সোলজি পড়তে হয়। পুরো সিস্টেমটা জানা হয়ে যায় কম বয়সেই। তাছাড়া আমাদের কাজটা তো পোশাকের ভেতরকার হিউম্যান বডি নিয়েই। সার্জারির প্রোফেসর চন্দ বলতেন মানুষের সঙ্গে অন্য প্রাণীর প্রথম তফাতটা হলো পোশাকের। এটাই কিন্তু ফান্ডামেন্টাল ডিফারেন্স বিটুইন ম্যান অ্যান্ড অ্যানিম্যাল।”

“আহ্! আবার বকবক?”

“না গার্গী! ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা কর। নেচারে সব কিছু নেকেড। ওই গাছগুলো দেখ।”

“এদিকটা এত জঙ্গল কেন?”

“গভর্মেন্ট প্রজেক্ট। ফরেস্ট ডিপার্টের কীর্তি আর কী?”

 “ওটা কি লেক নাকি?”

গৌতম হাসল। “বলতে পারো। লোক্যাল ল্যাঙ্গুয়েজে বিল বলে। প্রচুর বুনোহাঁস আসে শীতের সময়।”

ঝাব্বুলাল বলল, “এখোনো কুছু কুছু হাঁস দেখতে পাবেন বাবু। সরকার কানুন করল কী, উও হাঁস মারলে জেল হোবে। লেকিন বন্দুকবাজি কৌন রোখেগা? শিকারিলোক দুড়ুম উড়ুম করে বন্দুক মারে।”

গার্গী বলল, “সিনেমায় ঠিক এমনি সিনারি দেখেছি। আচ্ছা, এখানে শুটিং করে না?”

গৌতম হাসতে হাসতে বলল, “তোমার নায়িকা হতে ইচ্ছা করছে বুঝি? ঠিক আছে। আমি নায়ক হব। গান গাইব, আ যা আ যা”

গান থামিয়ে দিয়ে গার্গী বলল, “ওখানে নৌকো যায় না?”

“কেন? ওই তো পঞ্চমুখী শিবের মন্দির দেখা যাচ্ছে। অসাধারণ সাজানো বিউটিস্পট!”

গার্গী গম্ভীর হয়ে বলল, “নাহ্। বরং লেকে চলো!”

 “কী আশ্চর্য! ওটা লেক নয়।”

 “আমি মন্দিরে যাব না।”

 “কেন?”

গার্গী আস্তে এবং ঝাঁঝাল স্বরে বলল, “ন্যাকামি কোরো না। স্নান না করে–”

“আই সি!” গৌতম ওর চোখে চোখ রেখে বলল, “ওসব সুপারস্টিশন ছাড়ো তো! পাপ-টাপ বোগাস ব্যাপার! আমরা তো ধম্ম করতে যাচ্ছি না। জাস্ট সাইটসিইং!”

“না।” গার্গী গোঁ ধরে বলল। “আমি নৌকো থেকে মন্দিরে উঠব না। তুমি একা যেও।”

গৌতম মনে মনে চটে গিয়ে বলল, “সেটা আগে ভাবনি। এতদূর এসে ঠিক আছে ঝাব্বুলাল! বিলে ঢোকা যায় না নৌকো নিয়ে?”

ঝাব্বুলাল বলল, “নেহি বাবু। সুলুইস্ গেটের তলায় নাও ঢুকতে তকলিফ হবে। আউর বহত দাম-উম আছে পানির তলায়। পানিকি জঙ্গল।”

“তাহলে এক কাজ করো। ওখানে ভেড়াও। আমরা বরং ফরেস্টের কাছে একটু বেড়িয়ে আসি।”

ঝাব্বুলাল অবশ্য খাটুনি থেকে রেহাই পেল। সামনের উজানে আধ মাইল প্রচণ্ড স্রোত। সে বাঁ-দিকে ঘাসে ঢাকা জমিতে নৌকো ভেড়াল! জমিটা ঢালু। ওপরে বাঁধ। বাঁধ থেকে বন দফতরের জঙ্গল বিলের সমান্তরালে এগিয়ে গেছে। রেল লাইন অব্দি। রেললাইনের ব্রিজটা শেষ বিকেলের গোলাপি রোদে ঝকমক করছিল।

জঙ্গলের ভেতরটা ফাঁকা। কোনও ঝোঁপঝাড় নেই। বাঁধ থেকে দুজনে হাত ধরাধরি করে নেমে গেল। জঙ্গলের ভেতর হাঁটতে হাঁটতে গৌতম চাপা হেসে বলল, “তোমাকে আবার যদি অশুচি করে দিই?”

গার্গী চমকে উঠে বিষমুখে বলল, “না গৌতম! প্লিজ। আর ওসব কথা নয়।”…,

এখানে প্রকৃতি। নগ্ন নির্জন নিসর্গভূমি। এখানে যৌবন যৌবনকে কাছে পেলে সময়ের চেতনা মুছে যায়। গার্গী তার পরিবার, তার ছোটবেলা, দুঃখদুর্দশায় বেড়ে ওঠা জীবন আর তার সব গোপন আশা-আকাঙ্ক্ষার ব্যর্থতার কাহিনী মন থেকে উজাড় করে শোনাচ্ছিল গৌতমকে। এতদিন পরে মনকেও প্রকৃতিক নগ্নতার মতো অবাধে নগ্ন করে দিয়ে গার্গী তৃপ্তি পাচ্ছিল। ..

আর এই ভাবেই কখন পঞ্চমীর চাঁদের ফালি আকাশে আঁকা হলো। ঝাবুলালের ডাক শুনে দুজনে নৌকোয় ফিরল। গৌতমের সঙ্গে টর্চ ছিল।

ছাতিমতলায় তাদের নামিয়ে দিয়ে বখসিস নিয়ে ঝাব্বুলাল সদরঘাটের দিকে। চলে গেল।

পৌনে সাতটা বাজে। এখনও ঘনশ্যামের ফেরার সময় হয়নি। সরকারি কোয়ার্টার এলাকা নির্জন। শুধু টিভির চাপা শব্দ শোনা যাচ্ছে। তিনদিক থেকে আবছা আলো পড়েছে ঘনশ্যামের এল টাইপ একতলা কোয়ার্টারের ওপর। নীচের অংশটা অন্ধকার। প্রত্যেকটা কোয়ার্টারের চারপাশে খানিকটা করে ফাঁকা জমি। কোথাও কিছু গাছ। সদর দরজার ওপর টর্চের আলো ফেলেই গৌতম চমকে উঠল। “এ কী! তালাটা–”

গার্গী দেখল, তালাটা খুলে একটা কড়ায় ঝুলছে। গৌতম ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল। তারপর টর্চের আলো ফেলে চমকানো গলায় বলল, “সর্বনাশ হয়েছে গার্গী!”

শোবার ঘরের দরজার তালা খোলা এবং ঝুলছে। গার্গী মাথা ঠাণ্ডা রেখে ঘরে ঢুকে সুইচ টিপে আলো জ্বালতে গেল। আলো জ্বলল না। গৌতম টর্চের আলো ফেলে বলল, “এক মিনিট। মেন সুইচ অফ করে গেছে চোর!” সে মেন সুইচ অন করে দিলে আলো জ্বলল। বারান্দায় সাইকেলটা নেই। গৌতম বলল, “আহা! হাঁ করে দাঁড়িয়ে কী দেখছো? আর কী চুরি গেছে দেখবে তো?”

কমদামি স্টিলের আলমারির তালার কাছে কয়েকটা আঁচড়। চোর আলমারিটা খোলার চেষ্টা করেছে। পারেনি। গার্গী কোণে রাখা বাক্স আর সুটকেসের কাছে গিয়ে ভাঙা গলায় বলল, “আমার সুটকেসটা নেই।”

“দামি কিছু ছিল?”

 “না।”

“আর কিছু নিয়েছে নাকি দেখ।”

গার্গী খাটের তলায় উঁকি দিল। গৌতম টর্চ জ্বালল। সেই জুতোর বাক্সটা নেই।…  

.