ভালবাসার অন্ধকারে – ৯

০৯.

কর্নেল নীলাদ্রি সরকার আজ পঞ্চমুখী শিবের মন্দির অব্দি প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। ওদিকে একটা আশ্ৰম আছে। নিসর্গ দৃশ্যও অসাধারণ। ভাবছিলেন, পশ্চিমবঙ্গেই এত সুন্দর সুন্দর জায়গা থাকতে কেন যে লোকে পুজোর সময় বাইরে ছোটে? শরৎকালের বাংলার নিসর্গের কোনও তুলনা হয় না। হয়তো সমতলবাসী বাঙালির সমতলের প্রতি একঘেয়েমি আছে, তা সমতলে যত সুন্দর করে স্বর্গোদ্যান প্রকৃতি সাজাক না কেন! উঁচু জায়গা অর্থাৎ পাহাড়-পর্বত দর্শন একটা বিস্ময়কর বৈচিত্র্যও বটে সমতলবাসীর কাছে।

একটু সকাল সকাল বাংলোয় ফিরলেন আজ। তাঁর কথামতো ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর তাপস রুদ্র বাইরে গেছেন গতকাল। রাত্রে ফিরে থাকলে সকালেই কর্নেলের কাছে চলে আসবেন।

কারও জন্য প্রতীক্ষা মানুষের জীবনে একটা অসহ্য সময়–তা, যার জন্যই প্রতীক্ষা হোক কিংবা যে কারণেই প্রতীক্ষা হোক। নটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে ব্রেকফাস্ট খেলেন কর্নেল। তখনও তাপস রুদ্রের পাত্তা নেই। একটু উদ্বিগ্ন হলেন কর্নেল। অতি উৎসাহে কোনও হঠাকারিতা করে বসেননি তো ডিটেকটিভ অফিসার? খুনী যে-ই হোক, তার বুদ্ধিশুদ্ধি আছে এবং অতিশয় ধূর্ত। যদিও এই কেসে তার কিছু বুদ্ধির বাড়াবাড়ি ঘটে গেছে, এখন সে তা দৈবাৎ আঁচ করতে পারলে সতর্ক হয়ে যাবে। গা ঢাকা দেওয়াও অসম্ভব নয়। তা ছাড়া তাপস রুদ্রকে যেসব তথ্য সংগ্রহের দায়িত্ব দিয়েছেন কর্নেল, সেগুলো এই কেসে ভাইটাল সাক্ষ্যপ্রমাণ নয়। তা শুধু সহায়ক বা সেকেন্ডারি এভিডেন্স মাত্র।

বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ মনে হলো, ছটা বুলেট-নেল পেয়েছেন জঙ্গলের হিজল গাছটার গুঁড়িতে। তার মানে সিক্স রাউন্ডার রিভলভারের ছটা খালি কার্তুজ ফেলে দিতে হয়েছে খুনীকে। কোথায় ফেলেছে এটা খুঁজে দেখা উচিত ছিল। কাল ব্যাপারটা খেলায় হয়নি। এখন মনে হলো, এ-ও একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট। পাঁচজনকে খুন করা হয়েছে পাঁচটা গুলিতে। তাহলে তার কাছে সম্ভবত বারোটা গুলি ছিল। এখনও একটা রয়ে গেছে। তাপসবাবুকে সতর্ক করে দেওয়া উচিত ছিল। অবশ্য একজন ডিটেকটিভ অফিসারের পেশাগত অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধিশুদ্ধির ওপর নির্ভর করা চলে। তবু সব মানুষের মধ্যে কোনও-কোনও মুহূর্তে হঠকারিতার ঝোঁক এসে যায়–আকস্মিক উত্তেজনাবশেও।

সাড়ে নটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়লেন কর্নেল। হারাধনকে বললেন, “কেউ আমার খোঁজে এলে বলবে, লাঞ্চের সময় ফিরব।”

হারাধন বলল, “স্যার, বুনো হাঁসের মাংস খান তো?”

“খেতে আপত্তি নেই।” কর্নেল একটু অবাক হয়ে বললেন, “কোথায় পাবে বুনো হাঁস?”

হারাধন হাসল। “কেন স্যার? ওই জলার জলে ফাঁদ পেতে লোকে হাঁস ধরে। ওই যে দেখছেন পঞ্চমুখী শিবের মন্দিরের কাছে একটা গ্রাম। ওখানে গেলে পাওয়া যায়। রাত্তিরে জালের মতো ফাঁদ পেতে রেখে যায় স্যার।”

 “নাহ্। তুমি বরং কালকের মতো জেলেপাড়া থেকে মাছ এনো।” কর্নেল তাকে টাকা দিয়ে বেরুলেন।

আজ আকাশে টুকরো-টুকরো মেঘ। রোদ-ছায়ার মধ্যে জলার ধার দিয়ে হাঁটতে থাকলেন কর্নেল। মাঝেমাঝে বাইনোকুলারে উড্ডাক পাখিটাকে খুঁজছিলেন। পাখিটা নিপাত্তা হয়ে গেল কেন?

দক্ষিণের জঙ্গলে ঢুকে এগিয়ে গেলেন সেই হিজল গাছটার খোঁজে।

গাছটা থেকে প্রায় কুড়ি ফুট দূরে জলা। চারদিক তন্নতন্ন খুঁজে জলার ধারে গেলেন কর্নেল। জলটা খুব স্বচ্ছ। ঢালু হয়ে নেমে গেছে মাটি। হঠাৎ চোখে পড়ল সোনালি রঙের কী একটা ছোট্ট জিনিস চকচক করছে জলের তলায়। পিঠের কিটব্যাগ থেকে প্রজাপতি ধরা জালের নেট-স্টিকটা বের করলেন। জল হাত দুয়েক গভীর। জিনিসটা টেনে কাছাকাছি এনে আস্তিন গুটিয়ে তুলে নিলেন। যা খুঁজছিলেন, তার একটা পাওয়া গেল।

ছোট্ট বুলেটের নীচের ফাঁপা অংশ। জলে ছুঁড়ে ফেলেছিল লোকটা। দৈবাৎ একটা ধারে পড়ে গিয়েছিল। জাল ফেলার ব্যবস্থা করলে বাকি পাঁচটাও নিশ্চয় পাওয়া যাবে।

সতর্কভাবে বাইনোকুলারে চারদিকে জঙ্গলের ভেতরটা দেখে নিলেন কর্নেল। কেউ লক্ষ্য রাখেনি তাঁর দিকে। এতে খুনী সম্পর্কে একা ধারণা পোক্ত হলো বলা চলে। সে নিজের বুদ্ধিশুদ্ধি সম্পর্কে নিশ্চিন্ত আর আত্মবিশ্বাসী। শুধু তাই নয়, সে জানে, তার পরিকল্পনা নিখুঁত নিচ্ছিদ্র।

অথচ বরাবর দেখে আসছেন কর্নেল, সব খুনীই নিজের অজ্ঞাতসারে কোনও না কোনও একটা ভাইটাল সূত্র রেখে দেয়–একচক্ষু হরিণের গল্পটা সব রহস্যময় হত্যাকাণ্ডের হত্যাকারীর ক্ষেত্রে সত্য। এই কেসে কি তেমন সূত্র আছে?

হুঁ, গৌতমকে লেখা বেনামী চিঠিটা।

একটু চমকে উঠলেন কর্নেল। চুরুট ধরালেন। প্রত্যেকটি খুন একই লোক একই অস্ত্রে করেছে। অথচ চিঠিটা পাওয়া গেছে, যেদিন গৌতম খুন হয়, সেদিনই। কেন তার আগে নয়?

অবশ্য ‘জুতোর বাক্স’ বলতে কী বুঝিয়েছে, এটা জানার ওপর নির্ভর করছে। এই সূত্রটা সত্যি ভাইটাল কি না।

জঙ্গল পেরিয়ে গিয়ে ধানক্ষেত। তারপর বিদ্যুৎকেন্দ্র। কর্নেল বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশের রাস্তা ধরে হাঁটছিলেন। তাপস রুদ্রকে যেসব তথ্য সম্পর্কে খোঁজ নিতে বলেছেন, তার মধ্যে একটা হলো : কলকাতায় গার্গীর বিয়ের সময় কোনও প্রেমিক ছিল কি না। না থাকলে কাঁটালিয়াঘাটেও তেমন কেউ ছিল কি না, খুঁজে দেখা দরকার। একটা চমৎকার পরিকল্পনা আপাতদৃষ্টে লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলেই এই তথ্যটা জানা জরুরি। গার্গীর কোনও প্রেমিক স্থানীয় হাঙ্গামার সুযোগ নিতে পারে।

 আবার কথাটা মাথায় ভেসে এল কর্নেলের : হত্যার অস্ত্র এক। মোস অপারেন্ডি এক। হত্যাকারী ছয় রাউন্ড গুলি ফায়ার করে টার্গেটে হাত পাকিয়েছে। তারপর কাজে নেমেছে। নাহ, ভাড়াটে খুনীর থিওরি টিকছে না। সে এমন, লোক, যে এই প্রথম রিভলভার ব্যবহার করেছে এবং তার হত্যার মোটিভ, প্রতিহিংসা চরিতার্থ।

গার্গীর কোনও প্রেমিক হওয়াই সম্ভব। তার আসল লক্ষ্য ছিল গার্গী ও গৌতম। দুটোই গ। তার ক্ষুরধার বুদ্ধির প্রশংসা করতে হয়। দুই গ-কে হত্যার জন্য সে হিটলিস্টে ক খ গ ঘ সাজিয়েছে। ঘ-কেও মেরেছে। ক খ ঘ তিনজনই বয়স্ক অসুস্থ মানুষ। প্রতিরোধের ক্ষমতা ছিল না। এই তিনটি হত্যার জন্য সে এদের বেছে নিয়েছে যাতে হত্যার কাজটা খুব সহজ হয়। গ-য়ের ক্ষেত্রে সে একটু ঝুঁকি নিয়েছে অবশ্য। কুড়ি ফুট দূর থেকে গুলি করেছে। যদি মোট গুলি বারোটা হয়, তখন তার রিভলভারে চারটে গুলি ছিল। কাজেই ঝুঁকিটা তত কিছু না। কাছে এসে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জেও গুলি করতে পারত–যদি প্রথম দুটো গুলি দৈবাৎ ফস্কে যেত। নির্জন জায়গা। সন্ত্রাসের আবহাওয়ায় এই নির্জনতা স্বাভাবিক।

টাউনশিপের মোড়ে কর্নেল একটা রিকশা নিলেন। বললেন, “থানায় যাব।”

থানায় ও সি নেই। রঞ্জিত মিত্রও নেই। ডিউটি অফিসার জামাল আমেদ কর্নেলকে দেখে অভ্যর্থনা করে ও সির ঘরে বসালেন। বললেন, “জুতোর বাক্সের ব্যাপারটা জানা গেছে কর্নেল সরকার! ঘনশ্যামবাবু সকালে এসে স্টেটমেন্ট দিয়ে গেছেন। দেখাচ্ছি।”

কর্নেল দ্রুত পড়ে নিয়ে একটু হাসলেন। “মিঃ রুদ্রের খবর জানেন?”

 “উনি আউট অব স্টেশন। এখনও ফেরেননি।”

 “আমি উঠি।”

জামালসাহেব তাঁকে গেট অব্দি বিদায় দিতে এলেন। বললেন, “আজ আবার ঘাটবাজারে হাঙ্গামা। ও সি সায়েব ফোর্স নিয়ে গেছেন। এখানে যা অবস্থা চলছে, কহতব্য নয়। কথায় কথায় বোমাবাজি আর খুনজখম!”…

ঘনশ্যাম অফিস যায়নি। যাবে ভেবেছিল, কারণ এই শুন্য ঘরে কাটানো তার পক্ষে কষ্টকর। কিন্তু ডাঃ চৌধুরী এসে তাকে নিষেধ করে গেলেন। এই মানসিক অবস্থায় তার অফিস যাওয়া উচিত নয়। কাজপাগল মানুষ ঘনশ্যাম। এতদিন ধরে তাকে দেখেছেন ডাঃ চৌধুরী। হাসপাতালে সবসময় ছুটোছুটি, রোগীদের খোঁজখবর করা, প্রয়োজনের অতিরিক্ত কাজ–একটুও ফাঁকি দেয় না, সে। এবার তার কয়েকটা দিন বিশ্রাম দরকার। তা না হলে এই সাংঘাতিক মেন্টাল শকে সে নিজেই মানসিক রোগী হয়ে পড়বে।

তাকে রান্না করতেও বারণ করে গেছেন ডাঃ চৌধুরী। বরং ঘাটবাজারের হোটেলে গিয়ে খাবে। নার্ভ শান্ত রাখার জন্য কিছু ট্যাবলেট দিয়ে গেছেন। ঘনশ্যাম খায়নি। চুপচাপ শুয়ে ছিল। দেয়ালে বিয়ের ছবির দিকে তাকাচ্ছিল মাঝেমাঝে। অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল সবকিছু। এখান থেকে চলে যেতে পারলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচত। কিন্তু যাওয়ার উপায় নেই। পুলিশের তদন্ত শেষ না হওয়া অবধি তাকে থাকতে হবে, ও সি বলে দিয়েছেন।

এতক্ষণে অস্থিরতা তীব্র হলে সে একটা ট্যাবলেট খেল। তার কিছুক্ষণ পরে কেউ বাইরের দরজায় কড়া নাড়ল। ঘনশ্যাম চমকে উঠেছিল। একটু পরে বেরিয়ে সে সাড়া দিল, “কে?”

“আমি ঘনশ্যামবাবুর সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই।”

ঘনশ্যাম উঠোনে নেমে গেল। দরজা খুলে একটু অবাক হলো সে। খ্রিস্টান ফাদারের মতো চেহারা, মুখে সাদা দাড়ি, মাথায় টুপি, বুকের ওপর ক্যামেরা আর কী একটা ঝুলছে এবং পিঠে একটা কিটব্যাগ। ঘনশ্যাম বলল, “আপনি কোত্থেকে আসছেন স্যার?”

“কলকাতা। আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে।”

 “আপনাকে তো চিনতে পারলুম না–”

 “আমার নাম কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। এখানে বেড়াতে এসেছি।”

“আপনি ট্যুরিস্ট?”

“বলতে পারেন।” বলে কর্নেল তার পাশ দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলেন। “ভয় পাওয়ার কিছু নেই ঘনশ্যামবাবু! আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা বলেই চলে যাব।”

ঘনশ্যাম খুব অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। কর্নেল বারান্দার চেয়ারে বসে বললেন, “আসুন। আপনাকে সব বলছি। আমি একজন নেচারিস্ট। পাখি দেখা, প্রজাপতি ধরা, কিংবা জঙ্গল খুঁজে অর্কিড কালেকশন আমার হবি। তবে কোথাও কোনও রহস্যময় খুনখারাপি ঘটলে আমি তাতে নাক গলাই। এ-ও হবি বলতে পারেন। এখানে এসে শুনলাম, পর-পর কয়েকটা রহস্যজনক মার্ডার ঘটেছে এবং আপনার স্ত্রীও–যাই হোক, আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাই। আপনি নিশ্চয় চান আপনার স্ত্রীর খুনী ধরা পড়ুক?”

ঘনশ্যাম বারান্দায় উঠে দাঁড়িয়ে রইল। কর্নেলকে দেখতে দেখতে বলল, “কিন্তু পুলিশ–”

কর্নেল হাত তুলে বললে, “পুলিশের ব্যাপার তো আজকাল জানেন! আমার মনে হয়েছে, সমস্ত ব্যাপারটা রহস্যময়। পুলিশের তদন্ত দায়সারা এবং মোটা দাগের। আমি আপনাকে সাহায্য করতে চাই!”

ঘনশ্যাম তার দিকে তাকাল। তারপর পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে সিগারেট ধরাল। একটু পরে সে সন্দিগ্ধভাবে বলল, “আপনি আউটসাইডার। আপনি কী করে–আপনি কি ডিটেকটিভ অফিসার?”

কর্নেল হাসতে হাসতে তার হাতে নিজের নেমকার্ড দিয়ে বললেন, “এই বয়সে আমি অফিসার হব কোন দুঃখে ঘনশ্যামবাবু? তা ছাড়া আমি রিটায়ার্ড কর্নেল।”

“কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না আপনি কী করে–”

 “ঘনশ্যামবাবু, আপনি চান না আপনার স্ত্রীর খুনী ধরা পড়ুক?”

“দেখুন স্যার! আমার স্ত্রী দৈবাৎ মারা পড়েছে বলেই আমার ধারণা। এখন কথা হলো, যে যাবার সে চলে গেছে। আর তো তাকে ফিরে পাব না। মাঝখান থেকে গুণ্ডাগুলো আমাকে ফিনিশ করবে। আপনি আউটসাইডার। কে সারাক্ষণ আমার বডিগার্ড হয়ে আমাকে রক্ষা করবে? ভেবে দেখুন, আমাকে তো বেঁচেফৰ্ত থাকতে হবে। এ বাজারে এই চাকরি খোয়ালে আর পাওয়াও অসম্ভব।” ঘনশ্যাম হাত জোড় করল। “আপনি যেই হোন স্যার! খামোকা আমাকে বিপদে ফেলবেন না! আমি যা বলার সব পুলিশকে বলেছি। কিছু গোপন করিনি। পুলিশ যা করার করুক। আমি এখান থেকে ট্রান্সফারের চেষ্টা করছি।”

“একটা প্রশ্ন ঘনশ্যামবাবু! শুধু একটা প্রশ্নের জবাব দিন।”

“কী?”

গৌতম ছাড়া এখানে আর কারও সঙ্গে আপনার স্ত্রীর কোনও সম্পর্ক ছিল কিনা?”

ঘনশ্যাম ক্ষুব্ধভাবে বলল, “না! এ সব পার্সোনাল স্ক্যান্ডাল লোকে রটাচ্ছে!”

“আপনার স্ত্রীর নামে আসা চিঠিপত্র এখন খুঁজে দেখতে আপত্তি কী ঘনশ্যামবাবু? খুঁজে দেখলে–”

“অ্যাবসার্ড। কী সব বলছেন আপনি?”

“প্লিজ ঘনশ্যামবাবু! উত্তেজিত হবেন না। এমন তো হতে পারে, আপনার বিয়ের আগে আপনার স্ত্রীর কোনও সম্পর্ক ছিল কারও সঙ্গে। প্রতিহিংসাবশে সে এতদিনে তাঁকে খুন করেছে।”

ঘনশ্যাম বিরক্ত হয়ে বলল, “আবার একই কথা! আমার স্ত্রী দৈবাৎ মারা পড়েছে। ডাক্তারবাবুর ছেলের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে পাশাপাশি বসেছিল, কাজেই একটা গুলি তার গায়েও লেগেছে!”

“শুনলুম কপালে লেগেছিল।”

“একই কথা। আমি ট্রাংকুলাইজার খেয়েছি। ঘুম পাচ্ছে। আপনি আসুন স্যার!”

 কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “ঘনশ্যামবাবু! খুনীর রিভলভারে এখনও একটা গুলি আছে।”

ঘনশ্যাম চমকে উঠে বলল, “সো হোয়াট?”

“একটু সাবধানে থাকা উচিত আপনার। কারণ আপনার নামেও ঘ আছে।”

“আই ডোন্ট কেয়ার ফর এনিথিং! মারলে মারবে।” বলে সে রাগ করে সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরো ছুঁড়ে ফেলল উঠোনে।

“কিন্তু আপনি একটু আগে বলছিলেন, আপনি বেঁচেবর্তে থাকতে চান।”

 “কে না চায়?”

“আপনি বুদ্ধিমান, ঘনশ্যামবাবু! আসি। থ্যাংকস!”

 কর্নেল বেরিয়ে গেলেন। দরজা বন্ধ করে ঘরে ফিরল ঘনশ্যাম। ওপরের। জানলা দিয়ে দেখল বৃদ্ধ ভদ্রলোক ছাতিমগাছটার কাছে গিয়ে চোখে দূরবীন রেখে কী দেখছেন। পাগল নয় তো? মানসিক রোগী অনেক রকম আছে। এই ভদ্রলোকের ব্যাপার দেখে তা-ই মনে হচ্ছে। লোকের কাছে শুনে হুট করে তার বাড়িতে এসে ঢুকে পড়লেন! যেচে পড়ে নাক গলানো আর থ্রেটন করা। ঘনশ্যাম দেখল, কর্নেল বাঁধে গিয়ে উঠলেন। তারপর হঠাৎ চলার গতি বাড়িয়ে দিলেন। নির্ঘাত মানসিক রোগী। বুড়ো বয়েসে নানাধরনের উৎকট বাতিক অনেকের মাথায় চাগিয়ে ওঠে। ঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে বৃদ্ধ পাগল হয়ে যায়।…

.

কর্নেল বাইনোকুলারে দেখতে পেয়েছিলেন বাংলোর সামনে একটা জিপগাড়ি। স্লুইস গেটের কাছে গিয়ে আবার দেখলেন, বারান্দায় ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর তাপস রুদ্র বসে আছেন।

মিনিট কুড়ি লাগল বাংলোয় পৌঁছুতে। তাপস রুদ্রকে ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। কর্নেলকে দেখে একটু হেসে বললেন, “ট্রেন লেট করছিল। পৌঁছে স্নানাহার সেরে নিতেও খানিকটা দেরি হলো। এসে শুনলাম, আপনি লাঞ্চের সময় ফিরবেন।”

কর্নেলকে একটা ভাঁজ করা কাগজ এগিয়ে দিলেন তাপসবাবু। কর্নেল কাগজটা খুলে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, “খুব ছোটাছুটি করেছেন দেখা যাচ্ছে। থ্যাংকস মিঃ রুদ্র।”

তাপসবাবু বললেন, “কিন্তু সত্যি বলতে কি, আমার নিজের কাছেও ইনফরমেশনগুলো ভাইটাল মনে হচ্ছে না। যেমন ধরুন, গার্গীদেবীর বাবা-মা দুর্গাপুরে বড় মেয়ের বাড়িতে চলে গেছেন। বাড়িতে নতুন ভাড়াটে। লোকাল থানা যথেষ্ট হেল্প করল। পাড়ার পুরনো বাসিন্দাদের কাছে গার্গীদের সম্পর্কে তেমন কোনও স্ক্যান্ডালের কথা জানা গেল না। বারাসাতে বিয়ের কথা অবশ্য অনেকে জানে। কিন্তু বারাসাতেও একই ব্যাপার। একটা ভাড়াবাড়িতে থাকতেন ঘনশ্যামবাবু। তাঁর স্ত্রীর নামে সেখানেও কোনও স্ক্যান্ডালের খবর নেই। ঘনশ্যামবাবুর দু’কাঠা জমি কেনা আছে ওখানে।”

কর্নেল কাগজটা ভাজ করে পকেটে রেখে বললে, “ইনফরমেশনগুলো সত্যি ভাইটাল, মিঃ রুদ্র!”

“বলেন কী!”

“হ্যাঁ। আমার থিওরি আরও স্ট্রং হলো এবার। কর্নেল চোখ বুজে দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন। “মিঃ রুদ্র, আমার ধারণা, এবার খুনী নিজেই ধরা দেবে।”

তাপসবাবু অবাক হয়ে বললেন, “নিজে ধরা দেবে! কেন?”

“রিভলভারের শেষ গুলিটা–”

“প্লিজ কর্নেল সরকার! আমার কার্ড শো করেছি। আপনারটা এবার শো করুন।”

কর্নেল জঙ্গলের ভেতর টার্গেট প্র্যাকটিসের ঘটনা বর্ণনা করে ছটা গুলির টুকরো এবং একটা ফাঁপা গুলির খোল দেখালেন। জুতোর বাক্স’র ঘটনাও শোনালেন। তাপস রুদ্র বললেন, “আমি থানায় এখনও যাইনি। কাজেই এই এপিসোডটার কথা জানতুম না। যাই হোক, বোঝা যাচ্ছে কিলার তাহলে স্থানীয় লোক। কিন্তু সে নিজে ধরা দেবে কেন বলছেন?”

“শেষ গুলিটা সে নিজের জন্য রেখেছে।”

“ও মাই গড! সুইসাইড করবে নাকি?”

কর্নেল হাসলেন। “যে সুইসাইড করবে, সে পোস্টার সেঁটে ক খ গ ঘ হিটলিস্ট সাজাতে যাবে কেন মিঃ রুদ্র? অপেক্ষা করুন। আমার মনে হচ্ছে, আজ সন্ধ্যার পর যে-কোনও সময় খুনী ধরা দেবে। কোয়ার্টারে ফিরে বিশ্রাম নিন আপনি। যথেষ্ট ছোটাছুটি করেছেন। সন্ধ্যা ছটা নাগাদ থানায় আমার জন্য অপেক্ষা করবেন।”

থানায় ও সি তারক মুখার্জির ঘরে কর্নেল, তাপসবাবু, রঞ্জিত মিত্র ছাড়াও আরও দু’জন অফিসার আড্ডা দেওয়ার মতো বসেছিলেন। আজ আবার ঘাটবাজারে বোমাবাজি হয়েছে। দশ-বারো জনকে গ্রেপ্তার করাও হয়েছে। কুখ্যাত কেলো ধরা পড়েছে। ঘোঁতন একটুর জন্য হাত ফস্কে পালিয়ে গেছে। গল্পে-গল্পে সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেল। অনেক চা কফি-স্ন্যাক্স খাওয়া হলো। তাপস রুদ্র বারবার কর্নেলের দিকে তাকাচ্ছিলেন। সাড়ে সাতটায় তিনি অধৈর্য হয়ে বললেন, “কর্নেল সরকার! আমার মনে হচ্ছে, আপনি”

তাঁর কথায় বাধা পড়ল। কেউ আচমকা ঘরে ঢুকে ভাঙা গলায় পেঁচিয়ে উঠল, “স্যার! স্যার! আমাকে কে গুলি করেছিল! একটুর জন্য বেঁচে গেছি স্যার! জানালা দিয়ে গুলি ছুঁড়েছিল।”

রঞ্জিত মিত্র বললেন, “ঘনশ্যামবাবু! আপনাকে সাবধান করে দিয়েছিলুম?”

ঘনশ্যাম হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, “লোডশেডিং বলে জানালা খুলে রেখেছিলুম। হঠাৎ গুলির শব্দ! দেয়ালের একটা ছবিতে গুলি লেগেছে। আবছা দেখলুম স্যার, একটা বেঁটে রোগামতো কে পালিয়ে যাচ্ছে। পরনে গেঞ্জি আর প্যান্ট!”

কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “চলুন ঘনশ্যামবাবু! গিয়ে ব্যাপারটা দেখি।”

ঘনশ্যাম কর্নেলকে দেখে অবাক হয়ে গেল। তারপর বলল, “আপনি তখন ঠিকই বলেছিলেন, আমি আপনাকে চিনতে পারিনি স্যার!”

“চলুন মিঃ রুদ্র! আসুন। মিঃ মুখার্জি! আর য়ু ইন্টারেস্টেড?”

 “নিশ্চয়!” তারক মুখার্জি উঠলেন।

পাঁচ জন অফিসার আর জনা চারেক আমর্ড কনস্টেবল বেরুলেন। পুলিশ ভ্যান আর একটা জিপে সবাই ব্যস্তভাবে উঠলেন। কর্নেল জিপের সামনে। পাশে ঘনশ্যামকে নিলেন। ঘনশ্যাম বারবার বলছিল, “আপনাকে চিনতে ভুল হয়েছিল স্যার! আপনি ঠিকই বলেছিলেন। তা ছাড়া দেখুন, আমার নামেও ঘ আছে।”

ঘনশ্যামের কোয়ার্টারের কাছাকাছি গিয়ে জিপ থামল। আশেপাশের কোয়ার্টারের বারান্দায় হেরিকেনের আলো আর ভিড় দেখা যাচ্ছিল। সবাই ঘনশ্যামের চ্যাঁচামেচি শুনেছে। কেউ কেউ গুলির শব্দও শুনেছে। কিন্তু বেরুতে সাহস পায়নি।

ঘরের তালা খুলল ঘনশ্যাম। ভেতরে একটা দম কমানো হেরিকেন জ্বলছিল।

দম বাড়িয়ে দিল সে। বলল, “আমি এখানে দাঁড়িয়ে হেরিকেন ধরাচ্ছিলুম। হঠাৎ গুলি। ওই দেখুন, ছবি ভেঙে কাঁচ গুঁড়িয়ে গেছে!”

কর্নেল টর্চের আলোয় দেখে নিয়ে একটু হাসলেন। “আপনাদের বিয়ের পর ছবিটা তোলা হয়েছিল। তাই না ঘনশ্যামবাবু?”

“হ্যাঁ, স্যার!”

“আপনার স্ত্রীর দুর্ভাগ্য! গুলিটা এবার তার ছবির কপাল ছুঁড়ে দেয়ালে ঢুকেছে।” কর্নেল তার চোখে চোখ রেখে বললেন, “রিভলভারটি কি গঙ্গায় ফেলে দিলে ঘনশ্যামবাবু?”

ঘনশ্যাম তাকাল। “আজ্ঞে?”

“রিভলভারটা গঙ্গায় ফেলে দিয়েছেন। তাই না?” বলে কর্নেল তাপস রুদ্রের দিকে ঘুরলেন।

তাপস রুদ্র ঘনশ্যামের শার্টের কলার ধরে বললে, “পাঁচটা মার্ডারের জন্য আপনাকে গ্রেফতার করা হলো ঘনশ্যামবাবু!”

ঘনশ্যাম শক্ত হয়ে গেল। মেঝের দিকে দৃষ্টি। কর্নেল পকেট থেকে একটা চারমিনারের খালি প্যাকেট বের করে বললেন, “খুব সংসারী মানুষ আমাদের এই ঘনশ্যাম রায়। সিগারেটের প্যাকেটে বাজারের হিসেব লেখার অভ্যাস আছে। নিজের বাড়িতে নিজেই চুরি করে চমৎকার অ্যালিবাই সাজিয়েছিলেন। জঙ্গলে টার্গেট প্র্যাকটিস করার সময় অন্যমনস্কতার দরুন এই প্যাকেটটা ফেলে আসাই আপনার কাল হয়েছিল। ঘুড়ির সুতো ছেড়ে দেওয়ার মতো স্ত্রীকে গৌতমবাবুর সঙ্গে মিশতে দিয়ে আড়ালে লক্ষ্য রাখতেন। হ্যাঁ, অন্তত বিশ্বাসঘাতিনী স্ত্রীকে খুন করতেনই। দৈবাৎ রিভলভারটা হাতে এসে গিয়ে নিরাপদে খুন করার প্ল্যান ছকেছিলেন। ব্যাকগ্রাউন্ড চমৎকার। দুই গ্যাংয়ের বিবাদ খুনজখম। কাজেই পোস্টারে হিটলিস্ট মানিয়ে যায়। আপনার টার্গেট ছিলো গার্গীদেবী এবং গৌতম চৌধুরী। কিন্তু পুলিশকে ভুলপথে চালাতে নিরীহ বৃদ্ধ ক খ এবং ঘ-কে মারলেন। সকাল সওয়া দশটার ট্রেনের টিকিট কেটে ট্রেনে চাপলেন না। সারাদিন কোথাও গা-ঢাকা দিয়ে থেকে তিনটে খুন করে ট্রেনে চাপলেন রাত দশটার ডাউনে। অনবদ্য আপনার ঠাণ্ডা মাথার প্ল্যানিং। আমি জানতুম, শেষ গুলিটা খরচ করে নিজেকে একেবারে নির্দোষ প্রমাণ করতেই হবে আপনাকে। কারণ আপনার নামেও ঘ আছে। তাই মিঃ রুদ্রকে বলেছিলুম, খুনী নিজেই ধরা দেবে।”

এইসময় বিদ্যুৎ ফিরে এল। দু’জন কনস্টেবল হ্যান্ডকাপ পরিয়ে দিল ঘনশ্যামের হাতে।…