স্টোনম্যান – ১

০১.

ধারিয়া ফলসের মাথায় কয়েকটা পাথরের ওপর ওরা বসেছিল। দীপিতা, বিনীতা, রোমেনা এই তিন যুবতী। কিংশুক, রাতুল, সুপর্ণ এই তিন যুবক। আর ছিলেন তাদের কমন মামাবাবু চন্দ্রকান্ত। এই প্রমোদভ্রমণে তিনিই তাদের গার্জেন।

হুল্লোড়বাজ আমুদে মানুষ চন্দ্রকান্ত। বয়স ষাটের কাছাকাছি। কিন্তু প্রাণচাঞ্চল্যে এই যুবক-যুবতীদের চেয়ে কোনও অংশে কম নন।

‘ধারিয়া ফলস’ নামের জলপ্রপাতটি তত কিছু বিখ্যাত নয়। ধারিয়ার ধারা ক্ষীণ বলা চলে। কিন্তু সত্তর ফুট ওপর থেকে নীচের পাথরে আছড়ে পড়ার সময় সেই ক্ষীণতা গুঁড়ো-গুঁড়ো ছড়িয়ে শেষবেলার রোদে বণাঢ্য রামধনু এঁকেছে। দুধারে শরৎকালের সবুজের ঘোরলাগা বৃক্ষলতাগুল্ম স্তরে স্তরে সাজানো। তার ওপর কোথাও কোথাও ফুল ফুটে অর্মত্যমায়া ছড়িয়ে রেখেছে।

রোমেনা পাথরের ফাঁকে গজিয়ে ওঠা ঝোঁপের দিকে এগিয়ে গেল হঠাৎ। সাদা ফুলের ঝাঁক ঝোঁপটার মাথায়। কেউ তাকে লক্ষ্য না করার কারণ চন্দ্ৰকান্তের একটা বাঘ শিকারের রোমাঞ্চকর গল্প। চন্দ্রকান্ত রাঁচি জেলার নামকরা শিকারি ছিলেন। তাঁর গল্পের বাঘটা ছিল এই ধারিয়া এলাকার সাংঘাতিক এক মানুষখেকো।

রোমেনা কয়েকটা ফুল তুলে চুলে খুঁজল। তারপর ফুলপরী হওয়ার আকস্মিক নেশার মতোই তাকে পেয়ে বসল হারিয়ে যাওয়ার নেশা।

সে পাথরগুলোর আড়ালে গিয়ে বসে পড়ল। নিঝুম পরিবেশে শুধু জলপ্রপাতের শব্দ ছাপিয়ে চন্দ্ৰকান্তের চড়া গলায় গল্প বলার শব্দ ভেসে আসছিল। রোমেনা মুখ টিপে হাসছিল। যখন ওরা দেখবে রোমেনা নেই, ওরা নিশ্চয় ভাববে রোমেনাকে বাঘে তুলে নিয়ে গেছে। কী দারুণ হইচই না হবে!

রোমেনা ভাবছিল, আচ্ছা, সত্যি যদি তাকে এখন বাঘে তুলে নিয়ে যায়, সুপর্ণ কী করবে? সুপর্ণের প্রতিক্রিয়া যাচাই করার এমন সুযোগ রোমেনা আর পাবে না। দেখা যাক না সুপর্ণ কী করে। রাতুল, কিংশুক, দীপিতা, বিনীতা সবাই জানে রোমেনার সঙ্গে সুপর্ণর একটা গোপন সম্পর্ক আছে। চন্দ্রকান্তও টের পেয়েছেন। উনি খোলা মনের মানুষ। চলাবলায় নাগরিকতার পালিশ কম। হাসতে হাসতে বলেছিলেন, “কলকাতা যাওয়া হয়নি অনেকদিন। এবার যাওয়ার একটা চান্স পাব মনে হচ্ছে। সুপু আর রুমুর ঘটকালি না হয় আমিই করলুম।

সবাই হেসে অস্থির। সুপর্ণ ও রোমেনাও। দীপিতা বলছিল, “ভেতরে ভেতরে রেজিস্ট্রেশন হয়ে গেছে মামাবাবু। আপনার ঘটকালির নো হোপ নো চান্স! তবে ইনফরম্যালি এখনই ওদের মালাবদল ঘটিয়ে দিতে পারেন।”

চন্দ্রকান্ত বলেছিলেন, “ওক্কে! ওকে! চলল, আজই বিকেলে ধারিয়া ফলসে গিয়ে বনদেবীকে সাক্ষী রেখে বুনো ফুলের মালা ফালা গেঁথে–হুঁ, তোমরা ঝিম চাক ঝিম চাক নাচবে। ব্রেক ড্যান্স!”

ধারিয়া ফলসের দিকটা পশ্চিম। ওদিকে অনেকদূর পাহাড় নেই। জঙ্গল আছে। তাই বিকেলের আলো এসে সরাসরি পড়ছে প্রপাতের ওপর। কিন্তু উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্বে টিলাপাহাড় উঁচু-নিচু হয়ে ঠেউয়ের মতো চলে গেছে অনেকদূর। উত্তর দিকটায় খোয়া বিছানো রাস্তা। সেখানে সাদা অ্যাম্বাসাডার দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িটা চন্দ্ৰকান্তের।

চন্দ্ৰকান্তের গল্পটা হঠাৎ থেমে গেল। “আরে! রুমুটা গেল কোথা?” বলে হাঁক দিলেন, “রুমু! রুমু! বাঘ আছে! চলে এসো!”

রাতুল বলল, “সুপু! খুঁজে আন ওকে। রুমু তোরই লায়েবিলিটি কিন্তু!”

সুপর্ণ গম্ভীর হয়ে গেল। “ওই সব ফানি কথাবার্তা বন্ধ কর তো তোরা।”

“যা বাবা!” দীপিতা বলল। “ফানি ব্যাপারটা এখানেই তো অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা! সুপুদা! ডোন্ট ফরগেট দ্যাট। মামাবাবু দেখুন সুপু কেমন তুম্বো মুখে তাকাচ্ছে!”

চন্দ্রকান্ত আবার ডাকলেন, “রুমু! রুমু! চলে এস, জঙ্গল জায়গা। পোকামাকড় থাকবে।”

বিনীতা, দীপিতার ছোট বোন। সে হাসতে হাসতে বলল, “ভূত আছে বলুন। মামাবাবু! রুমু ভূতকে ভীষণ ভয় পায়।”

কিংশুক উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “সুপু! তোর হয়ে আমি খুঁজে নিয়ে আসছি। হারিয়ে গেলে আমি বা রাতুল পস্তাব না। তুই পস্তাবি!”

সুপর্ণ বলল, “সব কিছুর একটা সীমা আছে। তোরা বড় বাড়াবাড়ি করছিস!”

কিংশুক লম্বা পা ফেলে সেই ঝোঁপটার কাছে গেল। রোমেনাকে দেখতে পেল। রোমেনা সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ করতে ইশারা করল ওকে। কিংশুক এক লাফে পাথরে উঠে কপট গাম্ভীর্যে ডাকল, “রুমু! ফিরে এসো। সুপু তোমার জন্য কাঁদছে!”

রাতুল কিন্তু লক্ষ্য রেখেছিল কিংশুকের দিকে। সে একটা কিছু আঁচ করে উঠে গেল ওর কাছে। তারপর রোমেনাকে দেখতে পেল। রাতুলও কপট গাম্ভীর্যে ডাকল, “রোমেনা। তুমি যেখানে থাকো, ফিরে এস। সুপর্ণ শয্যাশায়ী।

চন্দ্রকান্ত বুদ্ধিমান মানুষ। হন্তদন্ত হয়ে এসে রোমেনার দিকে আঙুল তুলে বললেন, “পাষাণী অহল্যা হয়ে পড়ে আছিস দেখছি। রামচন্দ্র তো তুম্বো মুখে বসে আছে। কিন্তু ব্যাপারটা হল, পাথরের ফাটলে শঙ্খচূড় সাপ থাকতে পারে জানিস?”

রোমেনা তক্ষুণি লাফ দিয়ে উঠে সরে এল। “যান্! খালি মিথ্যা ভয় দেখাচ্ছেন।” বলে সে হেসে ফেলল।

দীপিতা বলল, “রুমু! সুপু কী স্বার্থপর তাহলে বোঝ। চুপচাপ বসে আছে।”

বিনীতা বলল, “সুপুদা নিশ্চয় দেখেছিল রুমুকে ওখানে যেতে।”

কিংশুক চলে এল। বলল, “মোটে সাড়ে চারটে বাজে। চুপচাপ বসে গেঁজানোর মানে হয় না। আয় সুপু, মাউন্টেনিয়ারিং করি। ফলসের পাশ দিয়ে পাথর বেয়ে নীচে নামি আয়। রাতুল! কাম অন্।”

রাতুল বলল,”নাহ্। বরং চোর-পুলিশ খেলা যাক। রুমু আইডিয়াটা আমার মাথায় এনে দিয়েছে।”

রোমেনা বলল, “হাইড অ্যান্ড সিক গেম, রাতুলদা। পাঁচ মিনিটের মধ্যে খুঁজে বের কর না করতে পারলে ফাইন। ফাইনের রেট ঠিক করে দিন মামাবাবু!”

চন্দ্রকান্ত বললেন, “হাইড অ্যান্ড সিক তো খেলবে! জঙ্গল জায়গা।”

দীপিতা উঠে দাঁড়াল। বলল, “অসাধারণ খেলা হবে। মামাবাবু, দেখেই বুঝেছি স্রেফ নিরিমিষ জঙ্গল। ফাইনের রেট ঠিক করে দিন!”

চন্দ্রকান্ত একটু দ্বিধা দেখিয়ে বললেন, “কিন্তু–আচ্ছা, বেশিক্ষণ নয়। তিনবার খেলবে। পাঁচ মিনিটে চোর খুঁজে না পেলে পাঁচ টাকা ফাইন প্রত্যেকের। আর চোর খুঁজে পেলে চোরের ফাইনও পাঁচ টাকা।”

রাতুল বলল, “আমি চোর হই।”

 রোমেনা বলল, “না আমি।”

 চন্দ্রকান্ত বললেন, “টস করি। আর কেউ চোর হতে চাও?”

রাতুল ও রোমেনা ছাড়া সবাই পুলিশ’ হতে চায়। চন্দ্রকান্ত টস করলেন। রাতুল চোর হল। তারপর শুরু হল এক অদ্ভুত লুকোচুরি খেলা।

রাতুল হনহন করে এগিয়ে একটা পাথরের আড়ালে চলে গেল। চন্দ্রকান্ত বিচারক। পুলিশ হল কিংশুক, সুপর্ণ, দীপিতা, বিনীতা ও রোমেনা। চন্দ্রকান্ত ঘড়ি দেখে পাঁচ মিনিট পরে ঘোষণা করলেন, “সিক অ্যান্ড ক্যাচ হিম!”

‘পাঁচ পুলিশ’ এদিকে-ওদিকে চোর খুঁজতে ছুটে গেল।

ধারিয়া নদী ও প্রপাত পশ্চিম দিকে। ছোট্ট নদী এবং তার বুকে অজস্র পাথর পড়ে আছে। পাথরগুলো পিচ্ছিল। কাজেই নদী পেরিয়ে ওপারের ঘন জঙ্গলে রাতুলের লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনা নেই। বাকি তিন দিকে উঁচু-নিচু টিলা। সমতলে নানা সাইজের পাথর আর ঘন জঙ্গল। পূর্বের জঙ্গল ও পাহাড় ভেদ করে একফালি খোয়া বিছানো রাস্তা প্রপাতের শ’দুই গজ দূরে বাঁক নিয়ে চলে গেছে দক্ষিণে। রোমেনা গেল রাস্তাটার দিকে। সে ভেবেছিল, রাতুল গাড়ির আড়ালে গিয়ে লুকিয়েছে।

দীপিতা গেল উত্তরে ঢালু টিলার দিকে। টিলাটা শালবন এবং গুল্মলতায় ঢাকা। গুল্মলতাগুলো পাথরের চাই ঢেকে সবুজ স্কুপের মতো দেখাচ্ছে। সে ভেবেছিল, এই সব স্কুপের আড়ালে রাতুল লুকিয়ে আছে।

বিনীতা গেল উত্তর-পূর্বে দুই টিলার মাঝখানে শুকনো গিরিখাতের দিকে।

কিংশুক উত্তর-পশ্চিমে নদীর ধারে ঝোঁপঝাড় খুঁজতে গেল।

সুপর্ণের এই খেলার ইচ্ছে তত ছিল না। সে নেহাত দায়সারাভাবে দক্ষিণ পশ্চিমে প্রপাতের কিনারা ধরে এগিয়ে গিয়ে একটা পাথরের ওপর উঠল। অনিচ্ছার দৃষ্টিতে ‘চোর’ খুঁজতে থাকল।

সুপর্ণের মনে গত রাত থেকে একটা দ্বিধা এসে ঢুকেছে। রোমেনার সঙ্গে তার অনেক দিনের সম্পর্ক ঠিকই। কিন্তু রোমেনাকে সে কখনই বিয়ে করার কথা ভাবেনি। রোমেনাও ভেবেছে কি না সে টের পায় না। একথা ঠিক, সে একবার রোমেনাকে চুমু খেয়েছিল। রোমেনা তার চুমুতে সাড়া দিয়েছিল। কিন্তু আজীবন সঙ্গিনী হিসেবে সূপর্ণ তাকে কল্পনা করতে পারে না। রোমেনার মধ্যে কী একটা দূরত্ব আছে বলে তার ধারণা। রোমেনা যেন একটা অদ্ভুত উঁচু বাড়ির মতো, যে-বাড়ির উঁচুতলায় ওঠার কোন সিঁড়ি নেই। সেন্ট পলস কলেজে পড়ার সময় দুজনের মধ্যে ওই সম্পর্কটা গড়ে উঠেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটা ঘনিষ্ঠতর হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে সুপর্ণ একটা কোম্পানির পারচেজ অফিসার হয়েছে এবং রোমেনা হয়েছে একটা খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন বিভাগের সহকারী ম্যানেজার। দুজনেই মোটামুটি সচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। সুপর্ণের বাবা-মা বেঁচে নেই। দাদার সঙ্গে থাকে। রোমেনার বাবা-মা বেঁচে আছেন। তবে রোমেনার বাবা রিটায়ার্ড আইনজীবী এবং মা চিরগৃহিণী। তাদের একমাত্র সন্তান রোমেনা।

গত রাতে দীপিতা হঠাৎ সুপর্ণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছে। চন্দ্ৰকান্তের এক বোনের দুই মেয়ে দীপিতা আর বিনীতা। চন্দ্ৰকান্তের বাড়ির বিশাল লনে কিছু উঁচু বিদেশী গাছ আছে। সুপর্ণ মাঝে মাঝে কেন যেন বিষণ্ণ বোধ করে। সে জ্যোৎস্নায় একটা গাছের ছায়ায় একা দাঁড়িয়েছিল। হঠাৎ দীপিতা পেছন থেকে পা টিপে পা টিপে এগিয়ে তার দুচোখ চেপে ধরেছিল। নিছক কৌতুক? কিন্তু দীপিতার মধ্যে কী একটা টান অনুভব করেছিল সুপর্ণ। দীপিতা যেন রোমেনার কাছ থেকে তাকে কেড়ে নিতে চাইছে।

নাকি মনের ভুল? দীপিতা অবশ্য একটু গায়েপড়া স্বভাবের মেয়ে।

কিংশুক ও দীপিতার মধ্যে আবেগময় সম্পর্ক ছিল বলে সুপর্ণের ধারণা। কিংশুককে আজ সকাল থেকে যেন এড়িয়ে থাকতে চেষ্টা করছে দীপিতা। কিংশুক বিনীতার সঙ্গে বেশি কথা বলছে। কিছু কি ঘটেছে?

এদিকে রাতুল চন্দ্ৰকান্তের দূর সম্পর্কের এক বোনের ছেলে এবং সেই হিসেবে চন্দ্ৰকান্তের ভাগনে। রাতুল কাল থেকে রোমেনার সঙ্গে যেন ভাব জমানোর চেষ্টা করছে। অথচ তাতে সুপর্ণের আর ঈর্ষা হচ্ছে না। নিজের এই আকস্মিক পরিবর্তনে সুপর্ণ নিজেই বিস্মিত।

সে পাথরে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাল। ঠিক এই সময় উত্তরে রোমেনার চিৎকার শোনা গেল, “পেয়েছি! পেয়েছি! রেডহ্যান্ডেড কট।”

সুপর্ণ দেখল, রাতুলের শার্টের কলার ধরে নিয়ে আসছে রোমেনা। দুজনের মুখে উজ্জ্বল হাসি। চন্দ্রকান্ত ঘোষণা করলেন, “রাতুলের পাঁচ টাকা ফাইন!”

সবাই চন্দ্ৰকান্তের কাছে দৌড়ে গেল। এবার রোমেনা আর কিংশুক চোর হতে চায়। কিন্তু টসে জিতল কিংশুক। রোমেনা বাঁকা মুখে বলল, “ভ্যাট। আমার লাকটাই বাজে।”

কিংশুক দৌড়ে গিয়ে উত্তর-পূর্বের টিলার জঙ্গলে গা ঢাকা দিল। পাঁচ মিনিট লুকোনোর সময় চন্দ্রকান্ত আগের মতো হাঁকলেন, “হাইড অ্যান্ড সিক!” রোমেনা, দীপিতা, বিনীতা, সূপর্ণ ও রাতুল খুঁজতে দৌডুল।

রাতুল দক্ষিণ-পশ্চিমে কিছু দূর এগিয়ে একটা গাছের তলায় দাঁড়াল। একটা আশ্চর্য শিহরন খেলে গেল তার শরীরে। রোমেনা একটা ঝোঁপের আড়ালে খুঁড়ি মেরে এগোচ্ছিল। তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল রাতুল। তারপর কী এক হঠকারিতায় রোমেনার মুখটা দুহাতে ধরে সে চুমু খেয়ে ফেলল। আশ্চর্য ব্যাপার! রোমেনা সাড়া দিল। মাত্র আধ মিনিট। অথচ কী দীর্ঘ সময় ধরে যেন .. ওই চুম্বন। রোমেনার শরীরের সুঘ্রাণ এখনও রাতুল টের পাচ্ছে। শরীর কাঁপছে।

দীপিতার চিৎকার শোনা গেল গাড়িটার কাছে। “পেয়েছি! পেয়েছি!”

দীপিতা কিংশুকের হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে এল চন্দ্ৰকান্তের কাছে। চন্দ্রকান্ত ঘোষণা করলেন, “পাঁচ টাকা ফাইন কিংশুকের।”

এবার শেষ খেলা। সুপর্ণ ‘চোর’ হতে চাইল। সবাই কিছুটা ক্লান্ত। রোমেনা এবার ‘চোর’ হতে চাইল না। একটু অবাক হল সুপর্ণ। কিংশুক বলল, “চোর হওয়ার চাইতে পুলিশ হওয়াই ভাল। অসাধারণ অ্যাডভেঞ্চার হয়।”

কি রোমেনা সাড়া দিয়ে বলল, “ঠিক বলেছ কিংশুকদা। ডিসকভারের আনন্দ অনেক বেশি।”

আগের মতো খেলা শুরু হল। সুপর্ণ দক্ষিণে ছুটে গিয়ে অদৃশ্য হল। পাঁচ মিনিট পরে চন্দ্রকান্ত ঘোষণা করলেন, “হাইড অ্যান্ড সিক!” সবাই দৌড়ে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ল জঙ্গল আর পাথরের আড়ালে।

দিনের আলো কমে আসছে। জঙ্গলে পাখিদের ডাক শোনা যাচ্ছে এবার। একটা হাওয়া উঠেছে এতক্ষণে। বৃক্ষলতাগুল্মে আলোড়ন শুরু হয়েছে। প্রপাতের শব্দ অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

পাঁচ মিনিট পর চন্দ্ৰকান্তের চিৎকার শোনা গেল, “কাম ব্যাক! কাম ব্যাক অল দ্য পোলিস ফোর্স। তোমরা হেরে গেছে।”

একে একে এল রাতুল, কিংশুক, দীপিতা, বিনীতা ও রোমেনা। প্রত্যেকটি মুখে ব্যর্থতার কাঁচুমাচু হাসি। চন্দ্রকান্ত হাঁক দিলেন, “সুপু! কাম ব্যাক! তুমি খেলা জিতেছ!”

দীপিতা বলল, “রুমু! রেডি হও। বিজয়ীকে বরমাল্য দিয়ে রিসিভ করবে তুমি!” তারপর সে ঝোঁপটার কাছে গিয়ে উৎসাহে সাদা বুনো ফুল ছিঁড়তে গেল।

কিন্তু সুপর্ণের সাড়া নেই।

চন্দ্রকান্ত চিৎকার করে ডাকলেন, “কী হচ্ছে সুপু, এবার আমরা বাড়ি ফিরব। কাম ব্যাক!”

কোনও সাড়া এল না।

রোমেনা ভুরু কুঁচকে বলল, “কোনও মানে হয়?”

দীপিতা বলল, “নিশ্চয় সুপুদা গাড়িতে বসে আছে। চলুন মামাবাবু, গাড়ির কাছে যাই।”

সবাই গাড়ির কাছে গেল। সেখানে সুপর্ণ নেই। এতক্ষণে মুখগুলি একটু গম্ভীর হল। রোমেনা খাপ্পা হয়ে বলল, “ও বরাবর এমনি। সবটাতে বাড়াবাড়ি করা চাই।”

বিনীতা আস্তে বলল, “সুপুদাকে রাস্তায় পেয়ে যাব। নিশ্চয় রাস্তার ধারে কোথাও বসে আছে।”

চন্দ্রকান্ত গাড়িতে উঠে বললেন, “এস তো দেখি।” সবাই গাড়িতে উঠে। বসল। কিংশুক, বিনীতা, দীপিতা ব্যাক সিটে। সামনে রাতুল, রোমেনা এবং চালক চন্দ্রকান্ত। শ’ চারেক গজ এগিয়ে রাস্তার বাঁ পাশে আদিবাসীদের একটা থান। পাথরের সমতল চৌকো ও চওড় বেদি। তার ওপর একগাদা ছাই। নীচে কবেকার পশুপাখি বলির রক্ত শুকিয়ে কালচে হয়ে আছে।

গাড়ি থামিয়ে চন্দ্রকান্ত বললেন, “আমি থানটা একবার দেখে আসি। তোমরা বসো।”

চন্দ্রকান্ত জঙ্গলের একফালি পায়ে চলা রাস্তা ধরে থানে গেলেন। গাড়ি থেকে রোমেনা বেরুল। থানটা দেখা যাচ্ছে এখান থেকে।

হঠাৎ চন্দ্রকান্ত থানের উল্টোদিকে গিয়ে থমকে দাঁড়ালেন। তারপর চেঁচিয়ে উঠলেন, “কিংশুক! রাতুল! তোমরা এস তো শিগগির!”

কিংশুক ও রাতুল ছুটে গেল। তিন যুবতীও তাদের পিছনে হন্তদন্ত ছুটে গেল।

থানের উল্টোদিকে ঝোঁপের ধারে উপুড় হয়ে পড়ে আছে সুপর্ণ। মাথাটা রক্তাক্ত এবং থ্যাঁতলানো। পাশে এক টুকরো রক্তমাখা কালো পাথর পড়ে আছে। কেউ ওই পাথরটা দিয়ে সুপর্ণের মাথাটা তেঁতলে দিয়েছে। তিন যুবতীই আর্তনাদ করে মুখ ঘুরিয়ে নিল।

চন্দ্রকান্ত সুপর্ণকে চিত করে শোয়ালেন। দুটি চোখ বিস্ফারিত। মুখ রক্তে লাল হয়ে আছে। চন্দ্রকান্ত পরীক্ষা করে দেখে আস্তে বললেন, “হি ইজ ডেড। বাট হু ডিড ইট!”

কিংশুক চেঁচিয়ে উঠল, “স্টোনম্যান! স্টোনম্যান?”

রাতুলও শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, “স্টোনম্যান!”

 চন্দ্রকান্ত ব্যস্তভাবে বললেন, “তোমরা ধরো। গাড়িতে নিয়ে যাই।”

সেই সময় সামনের টিলা থেকে ঝোঁপ ঠেলে বেরিয়ে এলেন এক টুরিস্ট বেশী ভদ্রলোক। মুখে সাদা দাড়ি। মাথায় টুপি। গলায় ঝুলন্ত বাইনোকুলার ও ক্যামেরা। গম্ভীর স্বরে বললেন, “জাস্ট আ মিনিট।”

.