ভালবাসার অন্ধকারে – ৭

০৭.

কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বাইনোকুলারে বুনোহাঁসের একটা ঝাক দেখছিলেন। মরসুমী পারিযায়ী পাখিদেরও এই স্বভাব আছে। যুদ্ধে অগ্রগামী রক্ষীদের ছোট্ট দল শত্রুপক্ষের অবস্থান বুঝে নিতে গোপনে এগিয়ে যায়। বুঝে নিতে চায় পরিবেশের হালচাল। পরিযায়ী পাখিদেরও তাই। অক্টোবর শেষ হয়ে এসেছে। এখনই হিমালয় ডিঙিয়ে গাঙ্গেয় অববাহিকায় বিক্ষিপ্ত কিছু ঝাঁক আগাম এসে পড়েছে।

কয়েক মাইল জুড়ে বিশাল এই জলা পশ্চিমে রেলব্রিজের কাছে কিছুটা অপরিসর। তারপর গঙ্গা অব্দি ছড়িয়ে গেছে চওড়া হয়ে। জলজ দামের আড়ালে হাঁসের ঝাঁকটা লুকোচুরি খেলছে। মাঝে মাঝে উড়ে গিয়ে অন্যখানে বসছে। হাঁসগুলোকে অনুসরণ করতে গিয়ে দক্ষিণের জঙ্গলটা বাইনোকুলারে ধরা দিল। জলার ধারে গাছপালা থাকলে সারসজাতীয় পাখিদের আড্ডা থাকা স্বাভাবিক। সাদা একঝাঁক বক একটা ঝুঁকেপড়া গাছে ফুলের মতো ফুটে আছে। আর একটা গাছের ওপর একলা শামুকখোল ধ্যানে বসেছে। হঠাৎ একটা উড্ডাক দেখতে পেলেন। অত্যন্ত বিরল প্রজাতির এই পাখি। দেখতে অবিকল ছোট্ট হাঁসের মতো। কিন্তু এরা স্থলচর। কর্নেল জলার উত্তর দিকে ধানক্ষেত আর ঝোঁপঝাড়ের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার ধারে বাঁধে পৌঁছুলেন।

বিকেলের নরম গোলাপী আলো ছড়িয়ে আছে সবখানে। বাঁধে হন্তদন্ত হাঁটছিলেন কর্নেল। উড্ডাকটার ছবি তুলবেন। সুইস গেটের কাছে পৌঁছে টেলিলেন্স পরালেন ক্যামেরায়। সুইস গেটটা খোলা আছে। তলা দিয়ে জেলেদের নৌকো যাতায়াত করে। জলাটা ফিসারিজ কো-অপারেটিভের।

কর্নেল দুপুরের ট্রেনে কাঁটালিয়াঘাটে এসেছেন আজ। রেললাইনের কাছাকাছি ফরেস্ট বাংলোয় উঠেছেন। একসময় কাঁটালিয়াঘাটের উত্তরে ওই জঙ্গলটা সত্যিকার জঙ্গল ছিল। বাঘের উপদ্রবও ছিল। এখন আর বাঘের নামগন্ধ নেই। সরকারের বনদফতর ছিন্নভিন্ন পুরনো জঙ্গল নতুন করে গাছ লাগিয়ে জমজমাট করেছেন। রেললাইনের দিকটায় পিকনিক স্পট। কিন্তু এদিকটায় অবাধ নির্জনতা।

একটু অস্বাভাবিক মনে হলো এই নির্জনতাকে। কোথাও কোনও লোক নেই। হঠাৎ মনে পড়ে গেল বাংলোর চৌকিদার হারাধন তাঁকে সকাল সকাল ফিরতে বলছিল। সন্ধ্যার পর নাকি চোরাগোপ্তা খুনখারাপি শুরু হয়েছে। কাঁটালিয়াঘাটে। প্রচণ্ড সন্ত্রাস চলেছে। সন্ধ্যার আগেই লোকেরা বাড়ি ঢুকে পড়ে।

তবে খুনোখুনিটা দুই দলের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থেকে। চৌকিদার হারাধন আরও একটা অদ্ভুত কথা বলছিল। প্রকাশ্যে নাকি পোস্টার লটকে দিয়েছিল কোনও এক ব্রতীনবাবুদের দল। হিটলিস্ট কথাটাও বলছিল স্বল্পশিক্ষিত চৌকিদার “ক খ গ ঘ দিয়ে চারটে নাম স্যার।” রসিক হারাধন হাসতে হাসতে বলছিল, “ও-তে নাম হয় না বলেই হয়তো হিটলিস্টে নেই। তবে ক খ ফিনিশ হয়েছে। কয়ে করালী কবরেজ। খ-য়ে খয়রুল হাজি। এবার গ-য়ে কে ফিনিশ হয় দেখা যাক।

উড্ডাকটা হঠাৎ উড়ল। কর্নেল বাইনোকুলারে তাকে অনুসরণ করলেন। পুবদিকে সোজা উড়ে গিয়ে গঙ্গার ধারে একটা তরুণ আকাশিয়া গাছের ডালে বসল। কিন্তু তাকে আর দেখতে পেলেন না। বেলা পড়ে আসছে। মিনিট কুড়ি পঁচিশের মধ্যে সূর্য ডুবে যাবে এবং টেলিলেন্সে ছবি আসবে না। বাঁধটা গঙ্গার সমান্তরালে বাঁক নিয়েছে। এখান থেকে বাইনোকুলারে আকাশিয়া গাছটা দেখা যাচ্ছে না। বাঁক পেরিয়ে চোখে পড়ল ডানদিকে একটা পোড়ো ইটভাটা। এক মুহূর্তের জন্য কাকে ঝোঁপের আড়ালে বসে পড়তে দেখলেন কর্নেল। ভাবলেন, মফস্বলি গ্রাম্য স্বভাব। কেউ জৈবকর্মে বসল নিশ্চয়।

মন পড়ে আছে পাখিটার দিকে। আকাশিয়া গাছটা আর চিনতে পারলেন না কর্নেল। আরও অনেক ছোট-বড় আকাশিয়া অসংখ্য গাছের ভিড়ে মিশে আছে। গঙ্গাতীরের ভূমিক্ষয়বোধে ঘন করে গাছ লাগানো হয়েছে। ডাইনে এবার বসতি এলাকা শুরু। সরকারি একতলা স্টাফ কোয়ার্টার বলে মনে হলো। একটু এগিয়ে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন কর্নেল। চমকে উঠলেন।

একজন মানুষ আরেকজন মানুষের ওপর পড়ে আছে।

তলার জন যুবক। সে একপাশে কাত হয়ে আছে ওপরের জন যুবতী। সে। যুবকটির পেটের ওপর চিত হয়ে পড়ে আছে। মুখটা রক্তাক্ত।

কর্নেল বাঁধ থেমে নেমে গেলেন। একটু ঝুঁকে দেখেই সোজা হলেন। দুজনেরই কপালে বুলেটের ক্ষত। এখনও রক্ত জমাট বাঁধেনি। তিনি এসে পড়ার বেশ কিছুক্ষণ আগেই কেউ এদের গুলি করেছে।

হারাধন চৌকিদারের কথা যদি সত্যি হয়, এদের একজন সম্ভবত গ।

কর্নেলের মস্তিষ্ক দ্রুত কাজ করে। যুবকটির নামের আদ্যক্ষর গ হওয়া সম্ভব। যুবতীটি নিশ্চয় ঘাতককে দেখেছিল, তাই তাকেও মরতে হয়েছে। যুবতীর সিঁথিতে সিঁদুরকি রক্ত? আবার একটু ঝুঁকে দেখে নিলেন, সিঁদুরই বটে। এরা স্বামী-স্ত্রী হওয়াই সম্ভব। চেহারায় মফস্বলী ছাপ নেই। এরা কি এখানে নবাগত?

কর্নেল চারদিকে ঘুরে দেখলেন, কোথাও কোনও লোক নেই। বাঁধে গিয়ে উঠলেন। মুহূর্তের জন্য নিজের নিয়তির প্রতি ক্ষুব্ধ হলেন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। বরাবর এমনটা হয়ে আছে। তিনি যেখানেই যান, কোন অদৃশ্য প্রতিপক্ষ তাঁর সামনে রক্তাক্ত মৃতদেহ ছুঁড়ে দিয়ে তাঁকে যেন চ্যালেঞ্জ করে। সেই চ্যালেঞ্জ তাঁকে নিতে হয়।

আগাছার জঙ্গলের ভেতরে সংকীর্ণ পায়ে চলা পথ দিয়ে হন্তদন্ত এগিয়ে গেলেন কর্নেল। সামনে প্রথমে যে বাড়িটা পড়ল, সেটার দরজা-জানালা বন্ধ। বাড়িটা ঘুরে গিয়ে পিচের একফালি পথ। দুধারে সারবন্দি একতলা কোয়ার্টার। একটা বারান্দার গ্রিলের ভিতর এক প্রৌঢ় ভদ্রলোককে দেখতে পেলেন। বললেন, “শুনুন প্লিজ একটু বাইরে আসবেন?”

ভদ্রলোক ভুরু কুঁচকে কর্নেলকে দেখছিলেন। বললেন, “আপনি কাকে চান?”

“আপাতত আপনাকে। একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটেছে।”

 “ঘটনা? সাংঘাতিক? মানে মামা-মার্ডার নাকি?”

“হ্যাঁ। ওখানে দুটো ডেডবডি পড়ে থাকতে দেখলুম। আপনি অন্যদের ডেকে নিয়ে–”।

“ওরে বাবা! আমি ওতে নেই মশাই। আপনি কে? কোথায় থাকেন?”

কর্নেল বিরক্ত হয়ে বললেন, “আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। কলকাতায় থাকি। প্লিজ আপনি”।

“চেপে যান মশাই! কার ডেডবডি কোথায় পড়ে আছে, ওসব নিয়ে মাথা ঘামাতে যাবেন না। এ সব এখানে হরদম হচ্ছে।”

এক ভদ্রমহিলা আর, দুটি মেয়ে বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। ভদ্রলোক বললেন, “শুনছ? আবার বডি পড়েছে। এই ভদ্রলোক দেখেছেন।”

কর্নেল বললেন, “একটা নয়, দুটো। দুজন যুবক-যুবতী!”

একটি মেয়ে চমকে উঠে বলল, “তাহলে ঘনাবাবুর বউ আর মেন্টাল হসপিটালের অরু ডাক্তারের ছেলে। কী যেন নাম, মা?”

ভদ্রমহিলা নাকমুখ কুঁচকে বললেন, “গৌতম। জানতুম”

ভদ্রলোক বাধা দিয়ে বললেন, “ছাড়ো তো! আমাদের পাঁচকথায় কাজ কী? আপনি মশাই থানায় খবর দিন গে। এসব ঝামেলায় আমাদের জড়াবেন না!”

সাইকেলে এক ভদ্রলোক আসছিলেন। কর্নেল তাঁকে ডাকলেন। প্রৌঢ় ভদ্রলোক চেঁচিয়ে বললেন, “সন্টুবাবু! আবার বডি পড়েছে। এবার কে জানো? গ-য়ে গৌতম। অরু ডাক্তারের ছেলে। সেইসঙ্গে ঘনাবাবুর ব্যাডক্যারেক্টার বউটাও”—

সাইকেলের ভদ্রলোক বললেন, “ওরে বাবা!” বলেই ওপাশের কোয়ার্টারে ঢুকে গেলেন।

প্রৌঢ় ভদ্রলোকের সেই কন্যাটি বলল, “ও মা! গ-য়ে গার্গী। দুজনেই গ!”

আশেপাশের কোয়ার্টারের বারান্দায় ইতিমধ্যে পুরুষ ও মেয়েরা বেরিয়েছে। কেউ বাইরে বেরুতে রাজি নয় যেন। কর্নেল হন্তদন্ত এগিয়ে গেলেন সামনে চওড়া রাস্তাটার দিকে।

দিনশেষের ধূসরতা চারদিকে। সব আলো জ্বলে উঠল। চওড়া রাস্তা ধরে কিছু দূর চলার পর টাউনশিপের ছড়ানো-ছিটানো বাজার এলাকা। বাঁ-দিকে পুরনো বসতি। সেখানে একটা সাইকেল রিকশা পেলেন কর্নেল। সে কিছুতেই যাবে না। দশ টাকা ভাড়ার লোভে এবং গন্তব্য থানা শুনে সে শেষপর্যন্ত রাজি হলো।…

.

রাত নটার ঘণ্টা বাজল থানার ঘড়িতে। অফিসার ইনচার্জ তারক মুখার্জির ঘরে বসেছিলেন কর্নেল। দাঁতে কামড়ানো চুরুট। সামনে কফির পেয়ালা। একপাশে ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর তাপস রুদ্র, অন্যপাশে সাব-ইন্সপেক্টর রঞ্জিত মিত্র। দুটো বডি মর্গে চলে গেছে। গৌতমের বাবা ডাঃ অরিন্দম চৌধুরী একটু আগে চলে গেছেন। তার কাছে জানা গেছে, ওয়েলফেয়ার অফিসার ঘনশ্যাম রায় সকালের ট্রেনে কলকাতা গেছেন। তিনি বারাসাতের লোক। ওখানে এক আত্মীয়ের বাড়ি আজকের দিনটা কাটিয়ে আগামীকাল রাইটার্সে যাবেন। ফেরার কথা সন্ধ্যা নাগাদ। অরিন্দমবাবু বলেছেন, গৌতম ছুটিতে এসেছিল। তপনদের তরুণ সংঘ ক্লাবে যাতায়াত করত। এই মাত্র। তাকে কে মারতে পারে, তার মাথায় আসছে না। হ্যাঁ, ঘনশ্যামের স্ত্রীর সঙ্গে তার মেলামেশার কথা কানে এসেছে তার। কিন্তু নিজের ছেলেকে তিনি চেনেন। তার দৃঢ় বিশ্বাস, ভুল করে গৌতমকে মারা হয়েছে এবং দৈবাৎ একটা গুলি ঘনশ্যামের স্ত্রীকে লেগে সে-ও মারা পড়েছে। কিংবা ঘনশ্যামের স্ত্রী হয়তো খুনীকে চিনতে পেরেছিল বা চিনে রাখবে ভেবেও তাকে খুন করা হতেও পারে।

কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে হেলান দিলেন। অভ্যাসমতো চোখ বুজে সাদা দাড়িতে হাত বুলোতে থাকলেন। টুপিটি টেবিলে রাখা। টাকে আলো পড়ে চকচক করছিল।

ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর তাপস রুদ্র একটু হেসে বললে, “আমার ঘোরতর সন্দেহ, গোপেশ্বরবাবু কর্নেল সায়েবকে এখানে ডেকে এনেছেন।”

কর্নেল চোখ খুলে মাথা নাড়লেন। “নাহ্ মিঃ রুদ্র! আমি কাঁটালিয়াঘাটে এমনি এসে পড়েছি। ট্রেনে যেতে যেতে ওই জলা আর জঙ্গলটা একবার চোখে পড়েছিল। তা ছাড়া ফরেস্ট বাংলোটাও অসাধারণ সুন্দর।”

ও সি তারক মুখার্জি বললেন, “যাই হোক, এতদিন বড়কর্তাদের মুখে আপনার অনেক নাম শুনেছি। কাগজেও কত খবর পড়েছি। আমার সৌভাগ্য, আপনার সঙ্গে মুখোমুখি আলাপ হলো।”

তাপসবাবু বললেন, “আমরা একটা অ্যাঙ্গল থেকে দেখছিলুম ব্যাপারটা। এবার সব ঘুলিয়ে গেল। অবকোর্স, ডাঃ চৌধুরী মে বি কারেক্ট। আই মিন, ঘনশ্যামবাবুর স্ত্রীর মৃত্যুটা দুটি কারণেই হতে পারে। স্পটে যা দেখলুম, উত্তরের ঝোঁপের আড়াল থেকে গুলি করেছে! দূরত্ব প্রায় কুড়ি ফুট। আগের দুটো ছিল পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জে গুলি। এ ক্ষেত্রে কুড়ি ফুট দূর থেকে গৌতমবাবুর কপালে গুলি ছোঁড়ায় বোঝা যাচ্ছে, খুনীর হাতের টিপ চমৎকার। পজিশন দেখে মনে হলো, ভদ্রমহিলা মুখ ঘুরিয়ে ছিলেন গৌতমবাবুকে গুলি করার সঙ্গে সঙ্গে।”

কর্নেল বললেন, “দ্যাটস রাইট।”

“তার মানে এ-ও হতে পারে কিলারকে উনি দেখতে পেয়েছিলেন।”

তারক মুখার্জি বললেন, “কেন? পরপর গুলি ছুঁড়ে থাকবে কিলার। কারণ, কুড়ি ফুট দূর থেকে গুলি করলে একটা গুলিতে ভিকটিম না মরতেও পারে। আমার ধারণা, ঘনশ্যামবাবুর স্ত্রীকে গুলিটা লেগেছে দৈবাৎ!”

কর্নেল বললেন, “আগের দুটো ভিকটিমের মাথায় পয়েন্ট ২২ রিভলভারের গুলি পাওয়া গেছে?”

“হ্যাঁ।” তারক মুখার্জি জোর দিয়ে বললেন, “সেজন্যই মনে হচ্ছে পর-পর দুবার গুলি করে নিশ্চিত হতে চেয়েছে কিলার। পয়েন্ট ৩৮ রিভলভার হলে ওই ডিসট্যান্সে একটা বুলেটই এনাফ। পয়েন্ট থ্রি-নট-থ্রি বুলেট।”

তাপস রুদ্র বললেন, “ডাঃ চৌধুরী ছেলের সম্পর্কে ক্লিন সার্টিফিকেট দিলেন বটে, আমার ধারণা ওঁর ছেলে দলাদলিতে জড়িয়ে পড়েছিল। কাজেই গৌতমবাবুর ব্যাকগ্রাউন্ড তদন্ত করা জরুরি।”

“কারেক্ট।” কর্নেল বললেন। “কিন্তু নেক্সট টার্গেট ঘ। ঘ দিয়ে কতগুলো নাম আছে এখানে, খোঁজ নেওয়া দরকার।”

এস আই রঞ্জিতবাবু হাসলেন। “একজন ঘ-এর স্ত্রী মারা পড়ল। ঘনশ্যাম রায়। কিছু বলা যায় না, ভদ্রলোকও ভেতর ভেতর ইনভলজ্ঞ কি না। কিছুদিন আগে ওঁর বাড়িতে একটা অদ্ভুত চুরি হয়েছিল।”

কর্নেল বললেন, “অদ্ভুত চুরি মানে?”

“স্ট্রেঞ্জ! কোয়ার্টারটা শেষদিকে। সে তো দেখলেন স্যার!” রঞ্জিতবাবু বললেন, “ঘনশ্যামবাবু সেদিন বাড়ি ফিরতে দেরি করেছিলেন। ওদিকে তাঁর স্ত্রী আর গৌতমবাবু বেড়াতে গিয়েছিলেন। সন্ধ্যায় লোডশেডিং। সেই ফাঁকে চোর তালা ভেঙে ঢুকেছিল। ঘরের তালাও ভাঙা। একটা সুটকেস আর বারান্দায় রাখা সাইকেলটা নিয়ে যায় চোর। আলমারির তালা ভাঙতে চেষ্টা করে পারেনি। আমিই গিয়েছিলাম ইনভেস্টিগেশনে। আশ্চর্য ব্যাপার, স্যুটকেসে তেমন কিছু ছিল না। কাজেই সেটা বাড়ির পেছনে ঝোঁপের ভেতর না হয় ফেলে পালায় চোর। কিন্তু সাইকেলটা গঙ্গায় ফেলে দিয়েছিল। মাইলদেড়েক দূরে জেলেদের জালে আটকে যায়। সাইকেলটা অবশ্য পুরনো। প্রথমে ভেবেছিলেন, ঘনশ্যামবাবুর খনখনে বাজে সাইকেলটা রাগ করে ফেলে দিয়েছে। পরে মনে হয়েছিল, ঘনশ্যামবাবুর ওপর কারও রাগ-টাগ আছে।”

তাপস রুদ্র বললেন, “দ্যাটস আ পয়েন্ট। ঘনশ্যামবাবুর ওপর কারও রাগ আছে।”

সায় দিয়ে তারক মুখার্জি বললেন, “ভদ্রলোককে সাবধান করে দেওয়া উচিত। সেই সঙ্গে তাপসবাবু ওকে আচ্ছাসে জেরা করে দেখুন, কিছু বেরোয় নাকি। লেট হিম কাম ব্যাক। আমার মনে হয়, স্ত্রীর মৃত্যুর দরুন ভদ্রলোক শকড অ্যান্ড নার্ভাস হয়ে কিছু কবুল করে ফেলবেন।”

“সেই পোস্টারটা!” কর্নেল বললেন। “সেটা একটু দেখতে চাই।”

“দেখাচ্ছি।” বলে ওসি তারক মুখার্জি ও যাল-চেস্টের তালা খুললেন। “আমরা পৌঁছুনোর আগে কারা ওটা ছিঁড়ে ক্লোর চেষ্টা করেছিল। একটু অংশ জল দিয়ে ভিজিয়ে তুলে এনেছিলুম।”

ছেঁড়া পোস্টারের একটা টুকরো টেবিলে রাখলেন তিনি। ওপরে ভুলব না’ এবং তলার দিকে ক খ গ ঘ চারটে অক্ষরের অর্ধেকটা টিকে আছে। কর্নেল বললেন, “কত বড় পোস্টার আন্দাজ করেছিলেন?”

“ছোট। এক ফুট চওড়া, ফুট দেড়েক লম্বা হবে।”

তাপস রুদ্র বললেন, “না মিঃ মুখার্জি! আরও একটু বড় হবে মনে হচ্ছে। কারণ এটা লোকাল বাংলা উইকলি কোনও কাগজেরই একটা পাতা।”

তারক মুখার্জি বললেন, “এনিওয়ে, ছোট পোস্টার। লেটারগুলো দেখুন, বেশ বড়। লাল কালিতে লেখা। তুলি দিয়ে লেখা মনে হয় না। শক্ত কাঠি-ফাটি দিয়ে লেখা।”

কর্নেল বললেন, “দু একদিনের জন্য এটা রাখতে পারি? ইফ য়ু প্লিজ–”

 “অবশ্যই। আপনার কো-অপারেশন আমরা চাই।”

কর্নেল ভাঁজ করে জ্যাকেটের ভেত্বর চালান করে বললেন, “উঠি এবার। বাংলোয় ফিরতে হবে।”

“জিপে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করছি! হাইওয়ে দিয়ে ঘুরে একটু দূর হবে। সো হোয়াট?”

একজন কনস্টেবল ঢুকে সেলাম টুকে বলল, “উও ডাক্টরবাবু আয়া স্যার!”

 “ডঃ চৌধুরী?”

 “জি।”

 “নিয়ে এস।”

ডাঃ অরিন্দম চৌধুরী হন্তদন্ত ঘরে ঢুকলেন। পকেট থেকে একটা খাম বের করে বললেন, “এটা দিনে কখন লেটার বক্সে কে ফেলে গিয়েছিল। গৌতমের পার্সোনাল চিঠি ভেবে খোলেনি ওর মা! এইমাত্র শুনে খামটা খুললাম। বাই পোস্টে আসেনি, এই দেখুন।”

তারক মুখার্জি চিঠিটা পড়ে কর্নেলকে দিলেন। তাপর রুদ্র ঝুঁকে গেলেন কর্নেলের দিকে। আঁকাবাঁকা জড়ানো হরফে লেখা আছে :

“জুতোর বাক্স শীঘ্র ফেরত দাও। শ্মশানকালীর মন্দিরের পেছনে কল্কেফুলের ঝোপে ইটচাপা দিয়ে রেখে আসবে।”

তাপস রুদ্র বললেন, “জুতোর বাক্স! হোয়াট ডাজ ইট মিন?”

ডাঃ চৌধুরী বললেন, “আমি তো এর মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছি না।”

তারক মুখার্জি গম্ভীরমুখে বললেন, “বোঝা খুব সহজ ডাঃ চৌধুরী। আপনার ছেলে কেলোর গ্যাংয়ের সঙ্গে ইনভলভড ছিল। জুতোর বাক্স ওদেরই কোনও সিম্বলিক টার্ম। একালের ছেলেদের চেনা কঠিন।”

“ইমপসিবল!” বলে ডাঃ চৌধুরী রাগ করে বেরিয়ে গেলেন।…

.

সেদিনই সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার ট্রেন বহরমপুর থেকে ফিরছিলেন ঘটহরি ভটচার্য। হাঁপকাশের রুগী। কাঁটালিয়াঘাটের সরকারি হাসপাতালে অনেকদিন চিকিৎসা করিয়েও সারেনি। বহরমপুরে প্রাইভেট ক্লিনিকে দেখাতে গিয়েছিলেন। তিনটে থেকে বসে থেকে নাম লিখিয়ে ডাক পড়ল পাঁচটার সময়। বেরিয়ে ওষুধপত্তর কিনে বাসে চাপতে গিয়ে ভয় পেলেন। আগাপাছতলা ভিড় লাস্ট বাসে। হাঁপের রুগীর পক্ষে বাসে ঢোকা অসম্ভব। অগত্যা ট্রেন।

তা-ও ভাগ্যিস ডাউন ট্রেন লেট করেছিল। লোকাল ট্রেন কাটোয়া অব্দি যাবে। তত ভিড় নেই। কাঁটালিয়াঘাট রোড স্টেশনে নেমে দেখলেন প্লাটফর্ম প্রায় খাঁ খাঁ। দুর্গাপুজোর আগে থেকে এই অবস্থা চলেছে। জনাকতক যাত্রী অবশ্য মেনেছিল। তারা দল বেঁধে লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল। নাগাল পেলেন না ভটচামশাই।

সেই যাত্রীরা সাইকেল রিকশাগুলোয় চেপে ঝাঁক বেঁধে চলে গেল। একটা রিকশা দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু রিকশাওয়ালাকে দেখতে পেলেন না। স্টেশনের পেছনে দোকানপাট খাঁ খাঁ করছে। হরেনের দোকানে বসে মাটির ভাঁড়ে চা খেলেন ভটচামশাই। হরেন বলল, “ভটচামশাই যাবেন কী করে?”

ভটচায ক্লান্তভাবে হাসলেন। “কষ্ট করে হেঁটেই যাই। পথে যদি রিকশা পাই–”

 “পাবেন বলে মনে হয় না।” হরেন বলল। “সাংঘাতিক অবস্থা। আজও দুটো বডি পড়েছে।”

“বলো কী!”

হরেন ঘটনাটা বলল। ভটচাষ মনে মনে সন্ত্রস্ত, কিন্তু মুখে বললেন, “কর্মফল! আমি কারও সাতে-পাঁচে থাকি না। আমার আর কী? যাই।”

স্টেশনরোড জনহীন। দু’ধারে উঁচু সারিবদ্ধ গাছ। ল্যাম্পপোস্টের আলো চকরাবকরা হয়ে পড়েছে। কিছুদূর এগিয়ে দম নেওয়ার জন্য দাঁড়ালেন। সেই সময় মনে হলো, কে পেছনে আসছে। ঘুরে বললেন, “কে গো?”

লোকটা কাছাকাছি এল। মুখটা চেনা লাগছিল ভটচাযের। কিন্তু আর কিছু বলার সুযোগই পেলেন না। তীক্ষ্ণ তীব্র একটা শব্দ এবং মাথার ভেতরটা জ্বলে গেল ঘটহরি ভটচাযের। টলতে টলতে উপুড় হয়ে পড়ে গেলেন পিচের ওপর। তখন আততায়ী তাকে টানতে টানতে পাশের খালে ফেলে দিল।

.