ভালবাসার অন্ধকারে – ১

০১.

জীবনে কোন মুহূর্তে হঠাৎ কী যে ঘটে যায়, আগে থেকে আঁচ করা কঠিন হয়ে পড়ে। মানুষ যেন আজীবন অন্ধকারে পথ হাঁটছে। আশপাশের অস্পষ্টতা থেকে তবু তো কিছু আন্দাজ করে নেওয়া যায় এবং সেইমতো জীবনটাকে গুছিয়ে নেওয়া চলে। কিন্তু সামনে অদূরে কী কাছে, কিছুই জানা নেই। হঠাৎ হয়তো খাদে পড়ে সে তলিয়ে যায় চিরকালের মতো।

গার্গীর জীবনে এক শরৎকালের দুপুরবেলায় সেই রকম একটা পতন ঘটে গেল। এই হটকারিতার জন্য সে এতটুকু প্রস্তুত ছিল না। তই আত্মরক্ষার সহজাত বোধকে সে কাজে লাগাতে পারল না। নিঃসহায় আত্মসমর্পণ করতে হলো তাকে একটা অনিবার্যতার কাছে।

অনিবার্যতা? পরে অবশ্য তাই মনে হয়েছিল গার্গীর। আরও অনেক কিছু মনে হয়েছিল। চোর পালালে গেরস্থের বুদ্ধি বাড়ে বলে একটা কথা আছে। কিন্তু তখন আর পস্তানিতে লাভ নেই। শুধু নিজের ওপর রাগে জ্বলে মরা ছাড়া কিছু করার নেই। অথচ ভালবাসার পথ এমনি পিছল যে আছাড় না খেয়েও নিস্তার নেই যেন।

নতুন টাউনশিপের শেষদিকটায় গঙ্গার ধারে ছড়ানো-ছিটোনো সব সরকারি কোয়ার্টার। নিচু বাঁধের ওপর গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যানের সূত্রে বনদফতর থেকে লাগানো গছপালা জঙ্গল হয়ে আছে। খানিকটা দূরে পুরনো শিবমন্দির আর শ্মশান। গার্গীদের কোয়ার্টারটা বাঁধের কাছাকাছি। পেছনে এলোপাতাড়ি ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে একটা ছাতিম গাছ দাঁড়িয়ে আছে। জানালা থেকে ছাতিম গাছটা দেখা যায়। সেই গাছের তলায় একা গৌতমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে গার্গী একটু অবাক হয়েছিল।

এখানে আসার পর থেকে গার্গী গাছটার অনেক বদনাম শুনেছে। কোন এক পানু চক্কোত্তির বউ কবে ওই গাছে ঝুলে প্রাণ দিয়েছিল। রাতবিরেতে প্রেতিনী ঠাকরুনকে নাকি মাঝেমাঝে দেখা যায়। চাঁদতারণ সিঙ্গির মেয়ে বিনু নাকি দিনদুপুরেই তাকে দেখে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। তারপর থেকে ঠাকরুনের ভূত তাকে পেয়ে বসেছে। অনেক ওঝা-হোমিওপ্যাথি করে শেষে গার্গীর স্বামী ঘনশ্যামের তাগিদ্রে তাকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ঘনশ্যাম এই কাঁটালিয়াঘাটে নতুন মানসিক হাসপাতালের ওয়েলফেয়ার অফিসার! বহরমপুর থেকে মাস তিনেক আগে এখানে বদলি হয়ে এসেছে সে। গার্গীকে সে পইপই করে সাইকোলজি বোঝায়। ভূতপ্রেত বলে কিছু থাকতে পারে না। এই রোগকে বলে হিস্টিরিয়া।

ঘনশ্যাম একটু গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ। শ্যামবর্ণ মাঝারি গড়নের সাধারণ চেহারা। রোগা দেখালেও হাড়ের কাঠামো শক্ত। পঁয়ত্রিশ বছর বয়স। গার্গীর চেয়ে প্রায় বছর দশেকের বড়। গার্গী ছিপছিপে গড়নের যুবতী। গায়ের রঙ ফর্সা। চোখে পড়ার মতো লালিত্য তাকে ঘিরে আছে। সে উত্তর কলকাতায় বড় হয়েছে। বারাসাতের ঘনশ্যামের মতো একজন সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিয়ে এবং এই মফস্বলী জীবনযাত্রা তার স্বপ্নে ছিল না। কিন্তু গরিব স্কুলশিক্ষকের মেয়ের এটাই ভাগ্য। এই ভাগ্যকে সে কালক্রমে মেনে নিয়েছে। বিয়ের পর বহরমপুরে গিয়ে বছরখানেক মোটামুটি মন্দ লাগেনি। শহরের পরিবেশ ছিল। কিন্তু কাঁটালিয়াঘাট নতুন টাউনশিপ। এখনও এর গা থেকে গ্রামের গন্ধ ঘোচেনি। আর এই নিরিবিলি প্রত্যন্ত এলাকা। সরকারি কোয়ার্টারের বাসিন্দাদের মধ্যে পুরস্পর কেমন যেন ঈর্ষা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতার মানসিকতা থাকে। ঘনশ্যামের ডেজিগনেশনে ‘অফিসার’ শব্দটা থাকলেও সে এত সাদাসিধে আর অতিসাধারণ মানুষ, দরকার ছাড়া তাকে কেউ পাত্তা দেয় না বিশেষ। আর গার্গী যে মন খুলে কারও সঙ্গে মিশবে, তাতে বাধা তার নিজেরই স্বভাব। প্রতিবেশিনীদের কথাবার্তা চালচলন তার একটুও পছন্দ হয় না। সবাই টিভি, ফ্রিজ, শাড়ি, গয়না এবং স্বামীদের সরকারি গাড়ির গৌরবে আটখানা। গার্গীর গোপন দুঃখ এখানেই। ঘনশ্যাম একটু কিপটে স্বভাবের লোক। কিস্তিতেও অন্তত একটা টিভি কিনতে পারত। সে সারাদিন হাসপাতাল অফিসে থাকবে এবং তার বউ কেমন করে সময় কাটাবে, এ নিয়ে তার চিন্তাভাবনা আছে বলে মনে হয় না। ওই একটা ট্রানজিস্টার কবে কিনেছিল। সেটাই জানালার ধারে বসে বাজায় গার্গী। এতেল বেতোল ভাবনা ভাবে।–

এদিন দুপুরে ছাতিমতলায় গৌতমকে দেখে সে ট্রানজিস্টারের শব্দ কমাল। গৌতম অন্যদিকে ঘুরে সিগারেট টানছে। গৌতমকে এতদিন ধরে দেখে আসছে। গার্গী, অথচ যেভাবে দেখল, এটা যেন একটা আবিষ্কার। ফিল্মের হিরোরা ঠিক ওই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে কিন্তু ঠিক এই বোধটা নয়, হঠাৎ মনে হলো গার্গী একটা অপার্থিব সৌন্দর্য দেখছে। প্রকৃতি মানুষকে কাছে পেলে কি এমনি করে বদলে দেয়? গার্গীর মনে একটা চাপা ছটফটানি জাগল। কেন এদিকে তাকাচ্ছে না গৌতম?

গৌতমের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল ঘনশ্যামই। তার হাসপাতালের বস সাইক্রিয়াট্রিস্ট ডাক্তারের একমাত্র ছেলে। কলকাতায় ডাক্তরি পড়ে। এটা তার শেষ বছর। পুজোর ছুটিতে এখানে এসেছে মাত্র দিন পনের আগে। সে এখানে এলেই টো টো করে ঘুরে বেড়ায়। এদিকটা নিরিবিলি এলাকা। কোয়ার্টারের পেছনদিকটায় দৈবাৎ তাকে দেখতে পেয়ে ঘনশ্যাম ডেকেছিল। গৌতম আলাপী স্বভাবের ছেলে। ঘনশ্যাম ভেতরে না ডাকলেও সে সটান ঢুকে পড়েছিল। অগত্যা ঘনশ্যাম বসের ছেলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয় গার্গীর। আর সেই আলাপ থেকেই প্রায়ই গৌতম ঘনশ্যাম থাক বা না থাক কোয়ার্টারে, সোজা চলে আসে। সে প্রথম প্রথম বৌদি বলে ডাকত ঘনশ্যামের অনুপস্থিতিতে। হঠাৎ একদিন একটু হেসে বলে উঠেছিল, “বৌদি বলার মানে হয় না আপনাকে! বয়সে আমার সমান বলেও তো মনেই হয় না। আপনি এইটুকু মেয়ে। আপনি-টাপনিটা বড় বাজে। দূরত্বের সৃষ্টি করে। তুমি বলব– আপত্তি আছে?”

গার্গী আস্তে বলেছিল, “নাহ।”

“এবং শ্যামদার অ্যাবসেন্সে নাম ধরেই ডাকব।”

গার্গী মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে একটু পরে বলেছিল, “ডাকবেন।”

“গার্গী! ডাকবেনটা উইথড্র করো।”

গার্গীর বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল। তারপর সে সামলে নিয়েছিল একটু : নার্ভাস হেসে বলেছিল, “করলুম।”

এমনি করেই গার্গীর জীবনে একটা ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল সেদিন। ঘনশ্যাম কোনও-কোনও দিন দুপুরে খেতে এসে দেখত গৌতম ও গার্গী গল্প করছে। কিন্তু তার হাবভাবে বোঝা যেত না সে কিছু সন্দেহ করছে। কোনওদিন বিকেলে অফিস থেকে ফিরেও দেখত গৌতম ও গার্গী কোয়ার্টারের পেছনে ঘাসে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। গৌতম বলত, “চলুন শ্যামদা, বৌদিকে নিয়ে তিনজনে গঙ্গার ধারে বেড়িয়ে আসি।”

ঘনশ্যাম বলত, “বড় টায়ার্ড ভাই। বরং তোমরা যাও। ঘুরে এস। তোমার বৌদির তো ঘরে বসে থেকে দম আটকে যায়। একটু ঘোরাঘুরি করলে রিলিফ পাবে।”

এভাবে একদিন ঘনশ্যাম তাদের সিনেমা দেখতে যেতেও তাগিদ দিয়েছিল। গার্গী স্বামীর মধ্যে কোনও ভাবান্তর টের পায় না। রাতের শয্যায় একই আদর ভালবাসার তাল কাটে না। অথচ মাঝেমাঝে গার্গীর মনে হয়েছে, কেন তার স্বামী তাকে সন্দেহ করছে না? কেন এমন অবাধ মেলামেশায় বাধা দিচ্ছে না? এ কি চাকরির স্বার্থে বসকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য বসের ছেলেকে এমন প্রশ্রয় দেওয়া? গার্গীর গৌতমকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হতো, তার বাবার কাছে ঘনশ্যাম গৌতমকে কোনও সুপারিশ করতে বলেছে কি না? কিন্তু মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করতে বেধেছে।

তবে এতগুলো দিন অবাধ মেলামেশা সত্ত্বেও গৌতম গার্গীকে ছোঁয়নি বা কোনও ভালবাসার সংলাপও উচ্চারণ করেনি। শুধু দুদিন আগে সন্ধ্যায় গঙ্গার ধার থেকে ফেরার সময় গৌতম আলতোভাবে তার একটা হাত হাতে নিয়েই ছেড়ে দিয়েছিল। গার্গীর বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল। তারপর কতক্ষণ ধরে সঙ্গীতের সুরের মতো একটা সূক্ষ্ম অনুরণন স্নায়ুকোষে ধীরে মিলিয়ে গিয়েছিল। সে রাতে ঘনশ্যাম গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, গার্গী জেগেই ছিল। হঠাৎ মূহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল গৌতম তত সাহসী নয় কেন? অথবা এ তার একটা নিছক খেলা! নাকি সে চাইছে গার্গী তার কাছে আত্মসমর্পণ করবে? নাহ্, গার্গী অত সস্তা নয়। মনে মনে রাগে জ্বলে উঠেছিল গার্গী।

.

এদিন দুপুরে একটু আগে ধনশ্যাম খেয়ে অফিসে ফিরে গেছে। গার্গী খাওয়ার পর ফ্যানের নিচে ভিজে চুল শুকিয়ে কপালে একটা টিপ পরেছে। সিঁথিতে একচিলতে সিঁদুর দিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে তার বুকের ভেতর একটা চাপা যন্ত্রণা টের পেয়েছে। কী নিঃসঙ্গ এই জীবন! এই প্রায়-গ্রাম্য জঙ্গুলে পরিবেশে তাকে কাটাতে হচ্ছে। গৌতম না থাকলে তার জীবনে বেঁচে থাকার মানেটাই হারিয়ে যেত।

কিন্তু গৌতমের ছুটি ফুরিয়ে এলে সে তো কলকাতা চলে যাবে। তারপর? আবার সেই একলা হয়ে থাকা কষ্টকর দিন ও রাতের একঘেয়েমি! ওই ছাতিম গাছে ঝুলে মরতে ইচ্ছে করে গার্গীর পানু চক্কোত্তির সেই বউটার মতো!

জানলার ধারে বসে গৌতমকে দেখে গার্গী নিজের অজ্ঞাতসারে একটা হঠকারিতায় আক্রান্ত হয়েছিল। ট্রানজিস্টারের শব্দ হঠাৎ সে খুব বাড়িয়ে দিল গৌতমের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই।

তখন গৌতম এদিকে তাকাল। তারপর সোজা আগাছার জঙ্গলের ভেতর দিয়ে জানালার ধারে চলে এল। গার্গী ট্রানজিস্টার বন্ধ করে দিল। সে মুখ টিপে হেসে বললস “ওখানে কী করছিলে? কোনও হিরোইনের জন্য ওয়েট করছিলে বুঝি?”

গৌতম হাসল, “আমার হিরোইন তো তুমি!”

 ‘বাজে কথা বলো না!” গার্গী কপট রাগ দেখাল। “নিশ্চয় কারও জন্য ওয়েট করছিলে!”

“করছিলুম সেটা ঠিক। দরজা খোলো বলছি।”

গার্গী বসার ঘরের দরজা খুলে দিলে গৌতম শোবার ঘরে চলে গেল। খাটে বসে রুমালে মুখের ঘাম মুছল। গার্গী দরজা বন্ধ করে এ ঘরে এল। গৌতম বলল, “এক গ্লাস জল দাও।”

গার্গী বাঁকা হাসল। “দিচ্ছি। আগে বলল কার জন্য”

গৌতম তার কথার ওপর বলল, “তোমাকে আজ এত সেক্সি দেখাচ্ছে কেন গার্গী?”

“কী দেখাচ্ছে!”

“অসাধারণ সুন্দরী।”

 “শাট আপ!”

“কী আশ্চর্য! সত্যি কথাটা বললুম, অমনি শাট আপ? যাও, তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গেছে। তপুর জন্য একঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছি। ওর পাত্তা নেই। কে জানে পুলিশের পাল্লায় পড়ল নাকি!”

গার্গী একটু অবাক হয়ে বলল, “তপু কে?”

 “আহ! আগে জল দাও।”

গার্গী রান্নাঘরে যখন জল আনতে গেল, তার শরীর জুড়ে একটা অস্থিরতা। গৌতমের ‘তোমাকে আজ এত সেক্সি দেখাচ্ছে কেন এই কথাটা তানপুরার মতো ঝংকৃত হচ্ছিল মনে। কুঁজো থেকে জল ঢালবার সময় তার হাত কাঁপছিল। খানিকটা জল মেঝেয় ছলকে পড়ল। সে ঠোঁট কামড়ে ধরল। কী এক সাংঘাতিক ঘটনার দিকে যেন তার নিয়তি তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সে রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল।

তার হাত থেকে জলের গ্লাস নিয়ে গৌতম বলল, “তোমাকে অমন দেখাচ্ছে কেন?”

গার্গী কোন জবাব দিল না।

গৌতম জল খেয়ে গ্লাসটা হাত বাড়িয়ে ড্রেসিং টেবিলে রাখল। তারপর গার্গীর হাত ধরে টেনে তাকে খাটে বসিয়ে দিল। আস্তে বলল, “তোমাকে বলা উচিত।” একটু হাসল সে। “আমার ধারণা, তোমার পেটে কথা থাকে। না, না–রাগ কোরো না। বলতে চাইছি, তোমাকে বিশ্বাস করা যায়।”

গার্গী বাঁকা হাসল। “এত ভূমিকার দরকার কী? আমি শুনতে চাইনে।”

“একটু আগে শুনতে চাইছিলে।” গৌতম চাপা স্বরে বলল, “শুনতে না চাইলেও হঠাৎ মনে হলো, তোমাকে বলা উচিত। কারণ তোমার সাহায্য দরকার।”

এবার গার্গী একটু আগ্রহ দেখিয়ে ভুরু কুঁচকে বলল, “কী ব্যাপার?”

“তুমি তপনকে চেনো না বললে, শুনে অবাক লাগছিল। এখানে ওকে সবাই চেনে। এক সময় পলিটিক্স করত। এখন ভোটের পলিটিক্সে মার্সেনারি যোগান দেয়।”

“মার্সেনারি মানে” বলে গার্গী একটু হাসল। “ও! তুমি ওই গুণ্ডাটার কথা– বলছ? তোমার শ্যামদার কাছে শুনেছি, ওদের কাছে হসপিটালের দামি-দামি ওষুধ পাচার করে স্টাফরা। ভয়ে কেউ কিছু বলতে পারে না। পুলিশ নাকি ওদের হাতে।”

গৌতম গম্ভীর হয়ে বলল, “আমি প্রব্লেমে পড়ে গেছি। তপু শত খারাপ ছেলে হোক, খুব আলাপি। ওর মধ্যে বন্ধুত্ব করার মতো অনেক গুণ আছে। তা ছাড়া শিক্ষিত ছেলে। গ্র্যাজুয়েট। বাবা এখানে ট্রান্সফার হয়ে আসার পর তপুর। সঙ্গে আমার আলাপ। এখন মনে হচ্ছে আলাপ না হলেই ভাল ছিল।”

গার্গী অস্থির হয়ে বলল, “আহ্! আসল কথাটা বলবে তো?”

গৌতম আস্তে বলল, “কোন সোর্সে তপু খবর পেয়েছে, ওদের বাড়িতে পুলিশ রেড হবে শিগগির যে-কোনও সময়ে। আসলে ওর কোনো রাজনৈতিক দাদা কী কারণে চটে গেছে! পুলিসকে প্রেশার দিচ্ছেন ভদ্রলোক। তপুর একটা বিদেশী রিভলভার আছে। ক’দিনের জন্য ওটা সে আমার কাছে লুকিয়ে রাখতে চায়। এখন প্রব্লেম হলো, আমি ওকে না করতে পরিনি। আজ দুপুর বারোটা একটার মধ্যে ওটা তার আমাকে ওই ছাতিম গাছটার ওখানে দিয়ে যাবার কথা। একটা বেজে গেছে। তবু এল না। হয় তো কোনও কারণে দেরি করছে। আমি যাই।” গৌতম উঠে দাঁড়াল। “গার্গী, যদি তপু ওটা আমাকে দেয়, আমি তোমার কাছে বরং লুকিয়ে রাখতে চাই। রাখবে লক্ষ্মীটি? আমাদের বাড়ির ব্যাপার তো জানেনা!”

গার্গী ওর হাত ধরে টেনে বসিয়ে দিল খাটে। “ছাড়ো! একটা অব্দি ওয়েট করতে বলেছিল। তুমি করেছ। তোমাকে ও তো আর দোষ দিতে পারবে না।”

“কিন্তু”। বাধা দিয়ে গার্গী বলল, “কিন্তু কিসের? ওসব বাজে ঝামেলায় পড়তে যেও না আর।”

 গৌতম হাসল। “বাজে ঝামেলা তোমার এখানেও কম নয়!”

 “তার মানে?”

 “তোমাকে দেখে ভীষণ লোভ হচ্ছে।”

“একদম অসভ্যতা করবে না বলে দিচ্ছি।”

 “গার্গী, তুমি জানো না তুমি কত সুন্দর।”

 “হুঁ, আমি ডানাকাটা পরী!”

গৌতম হঠাৎ তার দুধ ধরে তাকে কাছে টানল। গার্গী মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ার আগেই সে তাকে চুমু খেল। কয়ে মুহূর্তের আচ্ছন্নতা। গার্গী তারপর আত্মরক্ষার চেষ্টা করল। কিন্তু সেই মুহূর্তে তার আর শরীর যেন আলাদা হয়ে গিয়েছিল। নিবিড় চুম্বনের এই অমর্ত্য স্বাদ তার জীবনে প্রথম। পুরুষের বুকের এই উত্তাপও কখনও এমন করে সে টের পায়নি। এই চুম্বনের উন্মাদনা তাকে অবশ করে দিচ্ছিল। একটু পরে সে জড়ানো গলায় কোনও ক্রমে উচ্চারণ করতে পারল “আহ্! জানলা-দরজা খোলা!”

গৌতম উঠে গিয়ে উত্তরের খোলা জানলাটা বন্ধ করে দিলো। তারপর দরজা বন্ধ করতে গিয়ে শুনল, গার্গী চাপা আর্তস্বরে বলছে, “আহ! ও কী করছ। তুমি?”

দরজা বন্ধ করে গৌতম গার্গীর ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল।

এক শরৎকালের উজ্জ্বল দুপুরে এভাবে যে আকস্মিকতা ঘটে গেল, কিছুক্ষণ গার্গীর কাছে তা পতন বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু মানুষের শরীরে প্রকৃতি কী। ঐশ্বর্য থরেবিথরে সাজিয়ে রেখেছে, এই পঁচিশ বছর বয়সে তার প্রথম অনুভূতি গার্গীকে আবিষ্ট করেছিল। সে বুঝতে পারছিল, স্বামীর কাছে এভাবে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করতে পারেনি। এমন নিঃশেষে চরম আত্মসমর্পণের মধ্যেই যেন নারীর যৌবনের সার্থকতা।

শেষ মুহূর্তে গভীর আশ্লেষে আর দুরন্ত আবেগের ঘোরে সহসা গার্গী অনুভব করল, তার মধ্যে এতদিন ধরে মাতৃত্বের গোপন কাকুতি ছিল। সেই কাকুতিই কি তাকে এই হঠকারিতায় পৌঁছে দিল?

ঘরের ভেতর আবছা আঁধার। গার্গীর নগ্ন শরীরের সবখানে গৌতমের উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শ। জড়ানো গলায় গার্গী স্থলিত ও আর্তস্বরে অতিকষ্টে উচ্চারণ করল, “আমি মরে যাব গৌতম! এবার ছাড়ো!”…

কিছুক্ষণ পরে গৌতম বেরিয়ে গেল।

গার্গী বন্ধ জানলাটা খুলতে সাহস পেল না। সে কাঁপা কাঁপা হাতে চুল আঁচড়ে ঘষে যাওয়া টিপটা মুছে আবার পরল। ফ্যানের স্পিড বাড়িয়ে শরীর শুকিয়ে নিল। তারপর ট্রানজিস্টারটা আস্তে চালিয়ে বারান্দায় গেল। কেউ লক্ষ্য করেনি তো? একটু দ্বিধার সঙ্গে সে বাথরুমে ঢুকল।

গার্গীর মনে হচ্ছিল একটা নতুন শরীর সে পেয়েছে, যার সঙ্গে আগেরটার কোনও মিল নেই। সেই নতুন শরীরের সঙ্গে পুরনো মনকে মেলানো যাচ্ছে না। পুরনো মন বারবার বলছে, গার্গী! এ তুই কী করলি? তার নতুন মুন এসে বলছে, বেশ করেছি। আমার খুশি।

ঘরে ঢুকে সে খাটের বেডকভার নতুন করে পাতল। তারপর শুয়ে পড়বে ভাবল। সেই সময় উত্তরের জানালায় খটখট শব্দ হলো। গার্গী বলল, “কে?”

গৌতমের সাড়া এল। “শিগগির খোলো!”

গার্গী উঠে গিয়ে জানালা খুলে দেখল, গৌতম একটা জুতার বাক্স হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সে বাক্সটা জানালা গলিয়ে ভেতরে ঢোকাল। বলল, “এটা খাটের তলা-টলায় লুকিয়ে রাখো। তপু এসেছিল।”

বলেই সে চলে গেল। গার্গী দড়িবাঁধা বাক্সটা খুলতে গিয়ে খুলল না। খাটের তলায় ঢুকিয়ে রাখল। আজ থেকে নিজেকে তার মরিয়া ও সাহসী লাগছিল। এতক্ষণে সে খেতে গেল কিচেনে।…

.