বিজ্ঞাপনের আড়ালে

বিজ্ঞাপনের আড়ালে

কর্নেল নীলাদ্রি সরকার তার ড্রয়িংরুমে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। দাঁতে কামড়ানো জ্বলন্ত চুরুট থেকে সুতোর মতো নীল ধোঁয়া তাঁর টাকের কয়েক ইঞ্চি ওপরে গিয়ে সিলিং ফ্যানের হাওয়ায় ছত্রখান হয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ কাগজ নামিয়ে আমার দিকে ঘুরে বললেন, “আচ্ছা জয়ন্ত, আজকাল রঙিন বাংলা ফিচার ফিল্ম তুলতে কত টাকা লাগে?”

বললুম, “কেন? ফিল্ম মেকার হতে চান নাকি?”

আমার বৃদ্ধ বন্ধু গম্ভীর মুখে সাদা দাড়ি নেড়ে বললেন, “নাহ্! এমনি জানতে ইচ্ছে করছে। ফিল্ম লাইনে তোমার তো জানাশোনা আছে। তাই”

“সঠিক জানি না। তবে আমার ধারণা, পনের লাখ টাকার কমে আজকাল রঙিন ছবি হয় না। হিন্দি করলে সম্ভবত মিনিমাম এর দ্বিগুণ।”

কর্নেল চোখ বুজে ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন। বললেন, হুঁ লক্ষ লক্ষ টাকার ব্যাপার। কাজেই মাসের পর মাসঅভিনেতা চেয়ে কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে অসুবিধে নেই। কিন্তু মাত্র একজন অভিনেতার জন্য ঠিক এই ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছি না। একজন বয়স্ক অভিনেতা। নায়িকার বাবার চরিত্রে তাঁকে নামানো হবে। বয়স্ক অভিনেতার কি আকাল পড়ে গেছে দেশে?”

স্বগতোক্তির মতো কথাগুলো চোখ বুজে আওড়ালেন কর্নেল। তারপর টাকে হাত বুলোতে থাকলেন। একটু অবাক হয়ে বললুম, “এত আপনার চিন্তা ভাবনার কী আছে, বুঝতে পারছি না।”

“আছে। গত দু’মাস ধরে প্রতি রবিবার চোখে পড়ার মতো জায়গায় প্রত্যেকটি কাগজে বিজ্ঞাপন ইংরেজি এবং বাংলায়।”

কর্নেলকে এই সাধারণ ব্যাপারে চিন্তাকুল হতে দেখে একটু হেসে বললুম, “আশাকরি কোনও রহস্যের আঁচ পেয়েছেন। বিজ্ঞাপনটা দেখি!”

কর্নেলের সামনে টেবিলের ওপর কয়েকটা বাংলা আর ইংরেজি কাগজ ভাঁজ করা আছে। তার কোলের বাংলা কাগজটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। বললেন, “তোমাদের দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকা। যতদূর জানি, এই কাগজটা সারা দেশের সমস্ত আঞ্চলিক ভাষার কাগজের চেয়ে বেশি বিক্রি হয়। এতেও দু’মাস ধরে বিজ্ঞাপন! তুমি এই কাগজের স্পেশাল রিপোর্টার। কাজেই ভালোই জানো, তোমাদের কাগজে বিজ্ঞাপনের দর সবচেয়ে বেশি।”…

কর্নেল আবার তেমনি চোখ বুজে আপন মনে এইসব কথা বলছিলেন। ততক্ষণে বিজ্ঞাপনটা দেখা হয়ে গেছে আমার। কর্নেল লাল ডউপেনে ডাব কলম বিজ্ঞাপনটার চারদিকে রেখা টেনে বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু বিজ্ঞাপনটা পড়ে আমার একটুও খটকা লাগল না। এ ধনের বিজ্ঞাপন প্রায়ই কাগজে থাকে।

‘বয়স্ক অভিনেতা চাই

 জয় মা কালী পিকচার্সের নির্মীয়মান বাংলা কাহিনীচিত্রে নায়িকার পিতার ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য একজন বয়স্ক অভিনেতা চাই। ফটোসহ পূর্ব অক্ষিজ্ঞতার উল্লেখ করে লিখুন।
বক্স নং ৮৮৭৩’

সিগারেট ধরিয়ে হাসতে হাসতে বললুম, “রহস্যের পেছনে সারাজীবন ছোটাছুটি করে আপনাকে রহস্যের ভূতে পেয়েছে। এখন সবকিছুতেই রহস্য দেখছেন।”

কর্নেল সোজা হয়ে বসে হাঁকলেন, “ষষ্ঠী! কফি।” তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বিজ্ঞাপনটা স্বাভাবিক মনে হবে–মানে, বিজ্ঞাপনের ম্যাটারটার কথা বলছি। কিন্তু কেন একই বিজ্ঞাপন গত দুমাস ধরে প্রায় আটবার? আবার সেই কথাটাই বলছি, জয়ন্ত! দেশে কি প্রবীণ অভিনেতার অভাব আছে?”

“প্রবীণ নয়, বয়স্ক?”

“একই কথা। তা ছাড়া বয়স্ক চরিত্রে অভিনয়ের জন্য যখন এতদিন উপযুক্ত লোক পাওয়া যাচ্ছে না এখনও বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে বলেই কথাটা উঠছে, তখন একজন যুবক অভিনেতাই যথেষ্ট। মেক-আপ করে তাকে বয়স্ক মানুষ সাজানো কত সহজ।”

“হয়তো পরিচালক অত্যন্ত আধুনিকমনা। মেকআপের চেয়ে স্বাভাবিকতার পক্ষপাতী।”

কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুটটা অ্যাশট্রেতে রেখে বললেন, ঠিক বলেছে ডার্লিং! স্বাভাবিকতার পক্ষপাতী।” এটাই একটা মূল্যবান পয়েন্ট। কিন্তু কেন এই দুমাসে তেমন কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না?”

“কী মুশকিল!” একটু বিরক্ত হয়ে বললুম। “লোক পছন্দ হচ্ছে না। কিংবা চেহারার পছন্দ হলেও অভিনয়ে কঁচা। অজস্র কারণ থাকতে পারে।”

ষষ্টীচরণ এসে কফির ট্রে রেখে ব্যস্তভাবে বলল, “জোর বৃষ্টি আসছে, বাবামশাই! আপনি বলছিলেন নতুন টবগুলো পলিথিনে ঢেকে দিতে। দেব?”

কর্নেল গম্ভীরমুখে কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, “হু”, দ্যাটস দা পয়েন্ট, ডার্লিং! অজস্র কারণ থাকতে পারে। কিন্তু বলে জানালার দিকে ঘুরলেন। “ষষ্ঠী! বৃষ্টি! শিগগির ছাদে যা!”

ষষ্ঠী বেজার মুখে বলল, “সেটাই তো আমি বলছিলাম। আপনি কানই করছেন না।”

কর্নেল চোখ কটমট করে তাকালেন। সে চলে গেল। বললুম, “জোর বৃষ্টি মনে হচ্ছে। আপনাদের এই রাস্তাটায় একপশলা বৃষ্টিতেই এককোমর জল জমে যায়। কফিটা শেষ করে কেটে পড়ি।”

কর্নেল আমার কথায় কান করলেন না। কফির পেয়ালা হাতে উঠে জানালায় গিয়ে বৃষ্টি দেখে আমার দিকে ঘুরলেন। বললেন, “আজস্র কারণ, নাকি একটা কারণ? সেই বিশেষ কারণের জন্য এখনও নায়িকার বাবার চরিত্রে লোক পাওয়া যাচ্ছে না।”

ওঁর কথার ওপর বললুম, “আপনি নিজের ফটোসহ চিঠি লিখুন বরং। আমি চলি।”

এই সময় ডোর বেল বাজল। কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে বললেন, “ষষ্ঠী ছাদে। জয়ন্ত, কিছু যদি মনে না করো, দেখ তো কে এলেন?”

একটু হেসে চাপা স্বরে বললুম, “নিশ্চয় জয় মা কালী পিকচার্সের পরিচালক।”

কর্নেল গম্ভীর হয়েই বললেন, “কিছু বলা যায় না। ওই শোনো, লিন্ডাদের কুকুর চ্যাঁচামেচি করছে। তার মানে কেউ এই প্রথম আমার অ্যাপার্টমেন্টে আসছেন।

উঠে গিয়ে সংলগ্ন ছোট ওয়েটিংরুমের দরজা খুলে দিলুম। ঝোড়ো কাকের মতো এক ভদ্রলোক জড়োসড়ো দাঁড়িয়েছিলেন। বৃষ্টিতে পোশাক একটু ভিজেছে। হাতে ভিজে ছাতি। লম্বাটে গড়নের অমায়িক চেহারা। প্যান্টের পকেট থেকে স্টেথিস্কোপ উঁকি মেরে আছে! অতএব হতের গাব্দাগোব্দা ব্যাগটা নিঃসন্দেহে ডাক্তারি ব্যাগ এবং ভদ্রলোক একজন ডাক্তার। নমস্কার করে আড়ষ্টভাবে বললেন, “আমি কর্নেলসায়েবের সঙ্গে একটা বিশেষ জরুরি ব্যাপারে দেখা করতে চাই।”

ওঁকে ড্রয়িংরুমে নিয়ে এলুম। উনি কর্নেলকে নমস্কার করে একটা নেমকার্ড দিলেন। তারপর সোফায় ধপাস করে বসলেন। বললেন, “কাগজে আপনার অনেক কীর্তিকলাপ পড়েছি। আমার এক আত্মীয় পুলিশ অফিসার। তিনি বললেন, এ ব্যাপারে পুলিশের কিছু করার নেই। বরং কর্নেলসায়েবের কাছে যান। তাঁর কাছে আপনার ঠিকানা পেয়ে সোজা চলে এলুম।”

কর্নেল কার্ডটায় চোখ বুলিয়ে বললেন, “বলুন।”

“ভবানীপুর এরিয়ায় আমার চেম্বার। খুলে বলাই উচিত, ডিগ্রি থাকলেও ডাক্তারিতে আমি বিশেষ সুবিধা করতে পারিনি। চেম্বারে বসে মাছি তাড়াই।” করুণ হেসে ডাক্তার বললেন, “যাই হোক, মাসখানেক আগে লেকভিউ রোডের এক অসুস্থ ভদ্রলোককে চিকিৎসার জন্য কল পেয়েছিলুম। বনেদী বড়লোক। রোগীর বয়স প্রায় ৬৫ বছর। অনেক পরীক্ষা করেও কোনও শারীরিক গণ্ডগোল টের পাইনি। মনসিক অসুখ বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, নেহাত টাকার জন্য এমন শাঁসালো রোগীকে হাতছাড়া করতে ইচ্ছে ছিল না! ভাবুন, প্রতিবার কল অ্যাটেন্ড করি আর পাঁচশো করে টাকা পাই। এক সপ্তাহে পাঁচটা কল! তার মানে আড়াই হাজার টাকা! এদিকে রোগীর সেই একই অবস্থা! প্রেসক্রিপসানে টনিক আর ঘুমের ওষুধ লিখে দিই। এভাবেই চলছিল। শেষবার কল অ্যাটেন্ড করতে গিয়ে দেখি, রোগীর অবস্থা সাংঘাতিক খারাপ। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। দেখেই বুঝলুম, অন্তিমকাল ঘনিয়ে এসেছে। তখন আমার খুব অনুতাপ জাগল। ডাক্তার হিসেবে যে এথিক্স মেনে চলা উচিত ছিল, আমি টাকার লোভে তা মানিনি। আসলে ওই যে বললুম, নিছক মানসিক অসুখ বলেই মনে হয়েছিল। বড়লোকদের বুড়োবয়সে অনেক বাতিক উপসর্গের মতো দেখা যায়। সেটাই ভেবেছিলুম।”

ডাক্তার শ্বাস ফেলে চুপ করলেন। কর্নেল বললেন, “রোগী মারা গেল?”

 “হ্যাঁ! আমারই ভুলে–”

 “আপনি ডেথ সার্টিফিকেট দিলেন নিশ্চয়?”

“দিলুম। না দিয়ে তো উপায় ছিল না। আমার সামনেই মৃত্যু হলো। তা ছাড়া অতদিন ধরে দেখছি।”

“মৃত্যুর কী কারণ দেখালেন?”

“করোনারি থ্রম্বসিস।”

কর্নেল হাঁকলেন, “ষষ্ঠী! কফি।” তারপর বললেন, “রোগী মারা গেল কোন তারিখে?”

“আজ সতের জুলাই। রোগী মারা গেছে ২৭ জুন।”

 “হুঁ, তা এ ব্যাপারে আমার কাছে আসার কারণ কী?”

 ডাক্তার নড়ে বসলেন। মুখে উত্তেজনার ছাপ। চাপা স্বরে বললেন, “কিছুদিন আগে সন্ধ্যায় চেম্বারে একা বসে আছি। হঠাৎ এক ভদ্রলোক এলেন। দেখেই ভীষণ চমকে উঠলুম। সেই রোগী! একই চেহারা। আমার ভুল হতেই পারে না। মুখে কেমন ভুতুড়ে হাসি। আমি ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলুম। উনি বললেন, কী ডাক্তারবাবু খেলাটা ধরতে পারেননি? আসুন, আমরা একটা রফা করি। আমার অবস্থা তখন শোচনীয়। মাথা খারাপ হয়ে গেছে। চেঁচিয়ে উঠলুম, ‘বেরিয়ে যান বলছি। বেরিয়ে যান! ভদ্রলোক সেইরকম ভুতুড়ে হেসে বেরিয়ে গেলেন।”

ডাক্তার পকেট থেকে ইনল্যান্ড লেটার বের করে বললেন, “এই চিঠিটা গত পরশু ডাকে এসেছে। পড়ে দেখুন।”

কর্নেল চিঠি পড়ে আমার হাতে দিলেন। চিঠিটা এই :

“ডাক্তারবাবু,
আমি জানি, আপনার আর্থিক অবস্থা ভাল নয়। যদি বাড়ি গাড়ি করার মতো টাকাকড়ি পান, ছাড়বেন কেন? সেদিন আপনার সঙ্গে রফা করতে গিয়েছিলুম। আপনি ভয় পেয়ে চাচামেচি শুরু করলেন। আপনার ভয়ের কোনও কারণ নেই। আপনি আগামী রবিবার ১৭ই জুলাই সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ দেশপ্রিয় পার্কে অবশ্য করে আসুন। আপনাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলব। আমি আপনার হিতৈষী।”

চিঠির তলায় কোনও নাম নেই। চিঠিটা পড়ে কর্নেলকে ফেরত দিলুম! কর্নেল বললেন, “আমিও আপনাকে বলছি, আপনি আজ সন্ধ্যায় দেশপ্রিয় পার্কে। ওঁর সঙ্গে দেখা করুন। উনি কী বলছেন শুনুন।”

ডাক্তার করুণ মুখে বললেন, “যদি কোনও বিপদে পড়ি?”

 “আমরা দুজনে আপনার কাছাকাছি থাকব। আপনার চিন্তার কারণ নেই।”

ষষ্ঠী কফি আনল। বাইরে বৃষ্টিটা কমেছে। কফির পেয়ালা ডাক্তারের হাতে এগিয়ে দিয়ে কর্নেল বললেন, “এবার আমার কিছু প্রশ্নের জবাব দিন।”

ডাক্তার কফিতে চুমুক দিয়ে তেমনি করুণ মুখে বললেন, “একটা কেন, যত খুশি প্রশ্ন করুন। আমার বুদ্ধিসুদ্ধি ঘুলিয়ে গেছে।”

টেবিলে ওঁর নেমকার্ডটা রাখা ছিল। এতক্ষণে হাতে নিয়ে দেখলুম, ওঁর নাম ডাঃ বি বি পাত্র। ডিগ্রির লেজুড়টি বেশ লম্বা অথচ পসার করতে পারেননি, এর কারণ বোধহয় ওঁর হাব-ভাব ব্যক্তিত্ব। ডাক্তারি পেশায় স্মার্ট না হলে চলে না। ডঃ পাত্রের এই জিনিসটার অভাব আছে। সর্বদা কেমন আড়ষ্ট এবং করুণ হাবভাব। ডাক্তারকে দেখে যদি রোগীরই মায়া হয়, তাহলে সমস্যা।

কর্নেল বললেন, “লেকভিউ রোডে সেই বাড়ির নম্বর কত?”

ডাঃ পাত্র বললেন, “১৭/২ নম্বর। গেট আছে। বনেদী পুরনো বাড়ি। চারদিকে উঁচু দেয়াল ঘেরা। দেখলে পোডড়া বাড়ি মনে হয়। জঙ্গল গজিয়ে আছে লনে।”

“রোগীর নাম কী ছিল?

 “দেবপ্রসাদ রায়।”

 “বাড়িতে লোকজন কেমন দেখেছেন?”

“কয়েকজন লোক দেখেছি। দেবপ্রসাদবাবুর মেয়ে চৈতী পরমাসুন্দরী। আর একজন ভদ্রলোক চৈতীর মামা। পুরো নাম জানি না। ওঁকে গোপালবাবু বলে ডাকতে শুনেছি। গোপালবাবুই গাড়ি করে আমাকে চেম্বার থেকে নিয়ে যেতেন।”

“রোগীকে দেখার সময় কোনও বিশেষ ব্যাপার আপনার চোখে পড়ত?”

ডঃ পাত্র একটু ভেবে বললেন, “ঘরে শুধু চৈতী আর গোপালবাবু থাকতেন। চৈতী তার বাবার পায়ের কাছে। গোপালবাবু মাথার কাছে।… হ্যাঁ, একটা ব্যাপার”।

“বলুন!”

“ঘরে প্রচণ্ড আলো। আমার চোখ ধাঁধিয়ে যেতে। কিন্তু রোগী নাকি উজ্জ্বল আলো ছাড়া থাকতে পারেন না।”

“আর কিছু?”

“হ্যাঁ, আলোর আড়ালে কারা সব ফিসফিস করে কথা বলত। ভাবতুম, আত্মীয়স্বজন।”

“দেবপ্রসাদবাবু মৃত্যুর দিন বিশেষ কিছু চোখে পড়েছিল?”

 “নাহ।”

 “আলো?”

ডঃ পাত্র নড়ে বসলেন। বললেন, “সে রাতে আলো অত বেশি ছিল না। শুধু একপাশে মাথার দিকে একটা টেবিলল্যাম্প জ্বলছিল। সম্ভবত অন্তিম অবস্থা দেখেই আলো কমানো ছিল।”

কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে বলল, “কেসটা করোনারি থ্রম্বসিস বলে মনে হয়েছিল আপনার?”

ডঃ পাত্র একটু ইতস্তত করে বললেন, “নাকেমুখে রক্ত, একটু ফেনা এসব দেখেই…তবে গোপালবাবু বলেছিলেন, থ্রম্বসিস লিখে দিন। আমি তাই লিখেছিলুম ডেথ সার্টিফিকেটে।”

“আর একটা প্রশ্ন। সবগুলো কলই কি রাতে অ্যাটেন্ড করেছিলেন?”

 “হ্যাঁ। রাত আটটা থেকে নটার মধ্যে।”

 “প্রতিবার গোপালবাবু এসে গাড়ি করে আপনাকে নিয়ে যেতেন?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।”

কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, “ঠিক আছে। আপনি আজ সন্ধ্যায় ঠিক সময়ে দেশপ্রিয় পার্কে উপস্থিত থাকবেন। ভয়ের কারণ নেই। আমার মনে হচ্ছে, আপনার কোনও ক্ষতি হবে না। তাছাড়া আমরা আড়ালে থেকে লক্ষ্য রাখব।”…

ডাঃ বি বি পাত্র চলে যাওয়ার পর কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, “কী বুঝলে বলো জয়ন্ত?”

বললুম, “মাথামুণ্ডু কিস্যু বুঝিনি।”

“বরং চলো লেকভিউ রোডে ঘুরে আসি। বৃষ্টি ছেড়ে বেশ রোদ্দুর উঠেছে।”

 “ আমি গাড়ি আনিনি। কর্নেলের লাল টুকটুকে ল্যান্ডরোভারে চেপে লেকভিউ রোডে গিয়ে পৌঁছুলুম। ১৭/২ নম্বরের বাড়িটা ডঃ পাত্রের বর্ণনা অনুযায়ী বনেদী এবং পুরনো। গেটে কোনও দারোয়ান নেই। লনে একসময় সুদৃশ্য ফুলবাগান ছিল বোঝা যায়। এখন জঙ্গল হয়ে আছে। কর্নেল ও আমি গাড়ি থেকে নেমে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ভেতরটা দেখছিলুম। পোর্টিকোর দিক থেকে একজন সাদাসিধে চেহারার লোক এসে জিজ্ঞেস করল, “কাকে চাই স্যার?”

কর্নেল আমায়িক হেসে বললেন, “গোপালবাবু আছেন?”

“উনি তো সকালে বেরিয়ে গেছেন।”

 “তোমার নাম কী ভাই?”

লোকটা কর্নেলকে দেখে নিশ্চয় অভিভূত। একটু হেসে বলল, “আজ্ঞে স্যার, আমি গোবিন্দ। এ বাড়িতে থাকি।”

“তোমাদের বুড়োকর্তা দেবপ্রসাদবাবু”

কথা শেষ করার আগেই গোবিন্দ বলল, “উনি তো মারা গেছেন স্যার। ও মাসে আমাকে নিয়ে নৈনিতাল বেড়াতে গিয়েছিলেন। বাড়ি ফিরেই রাত্তিরে হঠাৎ স্ট্রোক হয়ে মারা গেলেন।”

“দেবপ্রসাদবাবুর মেয়ের নাম চৈতী। তাই না? ওকে একবার ডেকে দাও না! একটু কথা আছে।”

গোবিন্দ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল, “বুড়োকর্তার তো কোনও মেয়ে নেই স্যার! উনি একা মানুষ।”

“তাহলে চৈতী নামে সুন্দরী মেয়েটি কে? এ বাড়িতেই গতমাসে ওকে দেখেছি গোপালবাবুর সঙ্গে।”

গোবিন্দ হাসল। “বুঝেছি। গোপালবাবু সিনেমা করেন। ওঁর ছবিতে পার্ট করে যে মেয়েটি, আপনি তার কথাই বলছে।”

এবার আমার ফ্যালফ্যাল করে তাকানোর পালা। কর্নেল বললেন, “গোপালবাবু দেবপ্রসাদবাবুর কে হন?”

“দূরসম্পর্কের মামাতো ভাই।”

“বুড়োকর্তার সব সম্পত্তি উনিই পেয়েছেন তাই না?”

“আজ্ঞে। গোপালবাবুর নামে উইল করা ছিল।”

“তুমি কিছু পাওনি?”

 “আজ্ঞে স্যার, পাইনি বললে মিথ্যা বলা হবে। নগদ ভালই পেয়েছি।”

 “দেবপ্রসাদবাবু কবে মারা যান?”

 “নৈনিতাল থেকে দুপুরে ফিরলুম ওঁর সঙ্গে। শরীরটা এমনিতেই ভাল ছিল না। সকাল সকাল খেয়ে শুয়ে পড়েছিলেন। ট্রেন জার্নির ধকল। তো হঠাৎ শুনি গোপালবাবু ডাকাডাকি করছে আমাকে। আমি নিচের তলায় থাকি। ওপরে গিয়ে দেখি কর্তামশাই ধড়ফড় করছেন। গোপালবাবু তখনই ডাক্তার ডাকতে গেলেন। গোপালবাবুর ছবির মেয়েটি আর আমি কর্তামশাইয়ের সেবাযত্ন করলুম। কিন্তু বাঁচানো গেল না। ডাক্তার আসার একটু পরেই মারা গেলেন।

“তোমার কর্তামশাই কোনও কথা বলেননি তোমাকে? কী হয়েছে বা হঠাৎ কেন–”

গোবিন্দ বলল, “মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছিল না। গোঁ-গোঁ করছিলেন। মুখে ফেনা বেরুচ্ছিল।”

কর্নেল বললেন, “আচ্ছা, চলি গোবিন্দ। পরে আসব’খন। গোপালবাবুর সঙ্গে দরকার ছিল।”

“টালিগঞ্জে মায়াপুরী স্টুডিওতে ওঁকে এখন পেতে পারেন।”

কর্নেল ডাকলেন, “এস জয়ন্ত।”

গাড়ি লেকভিউ রোড ধরে এগোচ্ছিল টালিগঞ্জের দিকে। আমি চুপচাপ বসে আছি। কর্নেল বললেন, “এবার আশা করি কিছু বুঝতে পেরেছ জয়ন্ত।”

বললুম, “পারছি, আবার পারছি না। সেই বিজ্ঞাপনটা–”

“হ্যাঁ ডার্লিং, সেই বিজ্ঞাপনটাই এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত।”

“কিন্তু ঘটনাটা কী?”

নৈনিতালে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে এসে হঠাৎ দেবপ্রসাদবাবুর মৃত্যু এবং তার মামাতোভাই ফিল্মমেকার গোপালবাবুর সম্পত্তি লাভ। ফিল্ম করার জন্য যত টাকার দরকার, এবার পেয়ে গেছেন।”

“আর বলবেন না প্লিজ! মাথা ভোঁ ভোঁ করছে।”

টালিগঞ্জের কাছাকাছি গিয়ে কর্নেল বললেন, “নাঃ। থাক। অকারণ জল এখনই ঘোলা করে লাভ নেই। চলো, তোমাকে পৌঁছে দিই। কিন্তু ঠিক সন্ধ্যা ছটা নাগাদ তুমি আসতে ভুলো না।”…

.

কথামতো কর্নেল ও আমি সন্ধ্যা সাড়ে ছটা নাগাদ দেশপ্রিয় পার্কে পৌঁছেছিলুম। গাড়ি বাইরে রেখে পার্কের ভেতরে ঢুকে একটা বেঞ্চে দুজনে বসলুম। সময় কাটতে চায় না। পার্কে এখানে ওখানে লোকজন আছে। কিছুক্ষণ পরে কর্নেল চাপা স্বরে বললেন, “ডঃ পাত্র এসে গেছেন। ওই দ্যাখো।”

কিছুটা তফাতে একটা ঝোঁপের কাছে ডঃ পাত্রকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলুম। উনি এদিক-ওদিকে তাকাচ্ছিলেন। একটু পরে একটা লোক এসে ওঁর সামনে দাঁড়াল। আবছা আলোয় দেখতে পাচ্ছিলুম, লোকটির পরনে প্যান্ট-শার্ট। মাথার চুল শাদা। অথচ কাঠামোটি মজবুত। বয়স্ক লোক বলেই মনে হলো।

ডাঃ পাত্রের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সে ছায়ার আড়ালে চলে গেল। কর্নেল আমাকে ইশারা করলেন। দুজনে এগিয়ে গেলুম। কিছুটা এগিয়েছি, হঠাৎ পর-পর তিনবার গুলির শব্দ শোনা গেল। তারপর একটা শোরগোল পড়ে গেল। লোকেরা এদিকে-ওদিকে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে। পালানোর হিড়িক পড়ে গেছে। কর্নেল হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে ঝোঁপের পেছন থেকে যাকে টানতে টানতে নিয়ে এলেন, তিনি ডাঃ পাত্র।

কর্নেল চাপা স্বরে বললেন, “চলে আসুন আমাদের সঙ্গে।”

 তিনজনে গিয়ে গাড়িতে উঠলুম। ডাঃ পাত্র দম আটকানো গলায় বললেন, “ও! আর একটু হলেই কি সাংঘাতিক কাণ্ড! এজন্যই আমি আসতে চাইছিলুম না।”

কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, “গোপালবাবু অসম্ভব ধূর্ত লোক। সম্ভাব্য ব্ল্যাকমেলারকে শেষ করে দিলেন। আমার ধারণা ভদ্রলোক ওঁর ফিল্ম ইউনিটেরই লোক। যাই হোক, ডাঃ পাত্র! ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আপনাকে দিয়ে আমি ফাঁদ পাততে চাই।”

ডাঃ পাত্র ভয় পাওয়া গলায় বললেন, “ওরে বাবা! আমি আর এসবের মধ্যে নেই।”

কর্নেল একটু হাসলেন। “ভয়ের কিছু নেই। আসলে ওই সম্ভাবনাটা আমি আঁচ করতে পারিনি। তবে ডাঃ পাত্র, আপনি এবং দেবপ্রসাদবাবুর পুরাতন ভৃত্য গোবিন্দ গোপালবাবুর পক্ষে বিপজ্জনক। এখনই গোবিন্দকেও বাড়ি থেকে সরানো দরকার। অবশ্য জানি না, এখন সে জীবিত, না মৃত।”

শিউরে উঠে বললুম, “বলেন কী!”

কর্নেল সারা পথ চুপচাপ গাড়ি চালিয়ে এলেন। ডাঃ পাত্রকে মনে হচ্ছিল ভিজে কাকতাড়ুয়া। তেতলায় কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্ট। ড্রয়িংরুমে ঢুকেই কর্নেল ষষ্ঠীকে কড়া কফির হুকুম দিলেন। তারপর টেলিফোনের কাছে গেলেন। ডায়াল করার পর কথাবার্তা শুনে বুঝলুম, লালবাজারে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টে ডেপুটি কমিশনার অরিজিৎ লাহিড়ীর সঙ্গে কথা বলছেন।

ফোন করে কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে বললেন, “আপনার প্যাডে একটা চিঠি লিখবেন ডাঃ পাত্র! গোপালবাবুকে লিখবেন।”

ডাঃ পাত্র করুণমুখে বললেন, “প্যাড তো সঙ্গে নেই।”

“কফি খেয়ে চাঙ্গা হয়ে আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দেব’খন। তবে কী লিখবেন, শুনুন।” কর্নেল একটু ভেবে নিয়ে বললেন, “লিখবেন : প্রিয় গোপালবাবু, আগামীকার সোমবার রাত আটটায় আমার চেম্বারে অবশ্যই দেখা করবেন। জরুরি কথা আছে। আপনি দেখা না করলে সমস্ত ঘটনা পুলিশকে জানাব। দেবপ্রসাদবাবু যখন নৈনিতালে ছিলেন, তখন আপনি ওঁর বাড়িতে একজন লোককে দেবপ্রসাদবাবু সাজিয়ে আমাকে ডেকেছিলেন। সেই লোকটি ভাবত, সে অভিনয় করছে। আপনার বিজ্ঞাপনের গোপন কথা, আমি জানতে পেরেছি।… বিজ্ঞাপন কথাটা আন্ডারলাইন করে দেবেন।”

ডাঃ পাত্র অবাক হয়ে বললেন, “কিসের বিজ্ঞাপন?”

“অবিকল দেবপ্রসাদবাবুর মতো দেখতে এমন একজন বয়স্ক অভিনেতা চাই। বিজ্ঞাপনটা গত দু’মাস ধরে বেরুচ্ছে।” কর্নেল একটু হাসলেন। “জয়ন্তদের কাগজের বিজ্ঞাপন দফতরে খোঁজ করলে নিশ্চয় দেখা যাবে, বিজ্ঞাপনদাতা কে? কাল সেটা জেনে নেব’খন। যাই হোক, ডাঃ পাত্র, আপনি চিঠিটা লিখে আমাকে দেবেন। আমি আজ রাতেই ওটা গোপালবাবুর বাড়ির লেটার বক্সে রেখে আসব।”

এতক্ষণে আমার বুদ্ধির দরজা খুলে গেল। বললুম, “কর্নেল! রহস্য ক্লিয়ার।”

 “বলো শুনি।”

ষষ্ঠী কফি রেখে গেল। কফি খেতে খেতে বললুম, “ডাঃ পাত্র বলেছেন মোট পাঁচটা কল অ্যাটেন্ড করেছিলেন। চারটে কলের সময় নকল দেবপ্রসাদবাবু রোগী সেজে ছিলেন এবং ২৭ জুন শেষ কলের সময় সত্যিকার দেবপ্রসাদবাবুকে দেখেছেন। নিশ্চয় তাঁকে বিষ-টিষ খাওয়ানো হয়েছিল। গোপালবাবুর দরকার ছিল একটা ডেথ সার্টিফিকেটের। পাছে কোনওভাবে ব্যাপারটা ফঁস হয়ে যায়, তাই ডাঃ পাত্রের সাহায্য নিয়েছিলেন। ডাঃ পাত্র বরাবর দেবপ্রসাদবাবুর চিকিৎসা করেছেন। তার কোনও সন্দেহ হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া কোনও ঝামেলা হলে তিনি সাক্ষী দেবেন। অসাধারণ প্ল্যান। শুধু বোঝা যাচ্ছে না, কাজ হয়ে যাওয়ার পরও কেন বিজ্ঞাপন দিচ্ছে লোকটা?”

কর্নেল বললেন, “ঘটনাটা চাপা দেওয়ার জন্য। এখনও বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে, তার মানে এখনও লোক পাওয়া যায়নি। খুব সহজ হিসেব। এতে গোপালচন্দ্র নিরাপদ থাকছে। কিন্তু যেভাবে হোক নকল দেবপ্রসাদ রহস্যটা আঁচ করেছিলেন। দুঃখের বিষয়, তাকে খুন করা হলো, তার কাছে আর কিছু জানার উপায় রইল না। অভিনেতা ভদ্রলোক প্রথমে ভেবেছিলেন, শুটিং করা হচ্ছে। পরে সব টের পান।”…

.

 পরদিন দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার কাজে আমাকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাইরে যেতে হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী আসছেন। দুর্গাপুরে। তারই কভারেজ। কলকাতা ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছিল। অফিসে খবরটা লিখে-টিখে বাড়ি ফিরলুম, তখন রাত এগারোটা। কর্নেলকে ফোন করলুম।

কর্নেল সাড়া দিয়ে বললেন, “নাটকের শেষ দৃশ্য মিস্ করলে ডার্লিং!”

“কী ব্যাপার বলুন।”

“ব্যাপার খুব সামান্য। গতরাতে অরিজিৎকে বলেছিলুম গোবিন্দকে একটা অজুহাতে অ্যারেস্ট করতে। গোবিন্দ এখন তাই নিরাপদ। গোপালবাবু আমার ফঁদে পা দিতে গিয়েছিলেন ডাঃ পাত্রের চেম্বারে। পুলিশ আড়ালে তৈরি ছিল। আমিও ছিলুম। গোপালচন্দ্র ঢুকেই পিস্তল বের করেছিল। এক সেকেন্ড দেরি হলে ডাঃ পাত্রের অবস্থা হতো সেই বয়স্ক অভিনেতা নারাণবাবুর মতো।”

“ওঁর পরিচয় পাওয়া গেছে?”

“হ্যাঁ। যাত্রায় অভিনয় করতেন ভদ্রলোক। বিজ্ঞাপন দেখে ফটো পাঠিয়েছিলেন।”

“গোপালবাবু এখন কোথায়?”

 “পুলিশের হাজতে। গোবিন্দ সাক্ষী, ডাঃ পাত্রও সাক্ষী। কাজেই–”

টেলিফোনের লাইনটা কেটে গেল। ট্রেন জার্নিতে ক্লান্ত। শুয়ে পড়া দরকার।…