উপন্যাস
গল্প

১৬. চম্পাহাটি স্টেশন

১৬.

চম্পাহাটি স্টেশন হয়ে বাস ধরে ওরা বোদয় এসে পৌঁছোল। সকাল সাড়ে নটা। খোঁজখবর করেও বোদরা বা আশপাশের গ্রামে কোনও চেনা লোকের রেফারেন্স জোগাড় করতে পারেনি। বাস রাস্তার পাশেই ছোট্ট চায়ের দোকানে গিয়ে ঢুকল ওরা।

বোদরা এবং আশপাশের অঞ্চলে এখনও ইলেকট্রিসিটি–আসা বেজায় অন্যায়। এই বিষয়টা নিয়েই ওরা তর্কবিতর্কে মশগুল হয়ে গেল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আলোচনায় যোগ দিল স্থানীয় দুই বৃদ্ধ আর দোকানের মালিক।

কাপের চা শেষ হওয়ার আগেই পরিচয় বিনিময়ের পালা শেষ। অপু আর পবন এখন খবরের কাগজের রিপোর্টার। সঙ্গে দু-জন ফোটোগ্রাফার। সন্তু আর অশেষ। ওরা একটা নতুন ফিচার শুরু করছে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বিভিন্ন অঞ্চল ধরে মানুষের দৈনন্দিন জীবন, সংস্কৃতি, সমস্যা–এক-একটি পিকটোরিয়াল কাহিনি।

পুরোনো মন্দির, পাঠাগার, চৌধুরীবাড়ি, পার্বণ, মেলা, কামারপাড়ার ঐতিহ্য ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গে ঘুরে বেড়ায় আলোচনা। বয়োজ্যষ্ঠ জিতেনবাবু ওদের নিশ্চিন্ত করেন। উনি সঙ্গে জনা দুই ছেলে দিয়ে দেবেন, তারাই সব ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেবে।

শুধু তো দেখা নয়, কিছু ইন্টারভিউও নিতে হবে। পবন টেপ রেকর্ডারটার ওপর হাত রাখে। একদিনে শেষ করা যাবে না।

একদিন কেন, যত দিন লাগে, ঘুরুন-না। সত্যিই তো, লোকের সঙ্গে কথা না বললে কি সত্যিকার সমস্যার কথা জানা যায়?

স্থানীয় লোক কথাপ্রসঙ্গে একবারও গোবিন্দর কথা উল্লেখ করে না। সন্তু হঠাৎ কথার মাঝখানে বলে ওঠে, আচ্ছা, শুনেছিলাম, গোবিন্দ নাকি আপনাদেরই গ্রামের ছেলে?

শুধু গোবিন্দ কেন, ওই যে দিব্যেন্দু, সে-ও তো তা-ই। ওদের কয়েক পুরুষের বাস এখানে।

জিতেনবাবু বেশ গর্বিত মুখে বলেন। আচ্ছা! সন্তু বেজায় খুশি। তাহলে তো গোবিন্দর মা-বাবা বা আত্মীয়স্বজন এখানে নিশ্চয় আছেন? এই ব্যাপারটাও আমাদের রিপোর্টের মধ্যে জুড়ে দিলে দারুণ হবে, কী বলো পবনদা? এখন তো লোকের মুখে মুখে

পবন অতটা উৎসাহ দেখায় না, এটা আমাদের আসল কাজ নয়। একটা উল্লেখ থাকতে পারে…

জিতেনবাবু মাথা নাড়েন, গোবিন্দর বাড়িতে কেউ নেই। থাকার মধ্যে একা মা– তাকেও দিব্যেন্দু গত বছর কলকাতায় নিয়ে গেছে। তবে ওর মামার বাড়ি নারকেলবেড়েয় –দুই মামা আছে, কিন্তু তারা কিছু বলতে পারবে বলে মনে হয় না। কোনও যোগাযোগ নেই।

চায়ের দোকানের সন্তোষ হঠাৎ বলে ওঠে, আপনারা ডাক্তারবাবুর রিসার্চ সেন্টার দেখতে পারেন।

যাঃ, রিসার্চ সেন্টার দেখবে কী করে! আশপাশেই কাউকে ঘেঁষতে দেয় না।

 সে তো আমাদের মতো লোককে। খবরের কাগজের লোক শুনলে—

জিতেনবাবু ঘাড় নাড়েন, খবরের কাগজের লোক শুনলে বোধহয় দেবেই না। আশুদার মুখে যেটুকু শুনেছি, দিব্যেন্দু এখনই কিছু জানাজানি হোক, চায় না।

সন্তোষ বলে, তাহলে আপনারা আশুদার সঙ্গে দেখা করুন। ওঁকে যদি বোঝাতে পারেন, ঠিক আপনাদের সব দেখিয়ে দেবেন।

জিতেনবাবু বলেন, সে আমি বলতে পারি না। গ্রামের ওপর কাজ করবে বলে এসেছেন যখন, আশুদার সঙ্গে তো পরিচয় হবেই। তখন বলে দেখবেন।

সারা গ্রাম চষে বেড়ায় চারজনে। বিকেল হয়ে আসে, তবু আশুদার সঙ্গে আর দেখা হয় না। কী একটা কাজে ঘটকপুকুর গেছেন। ফেরার কথা অনেক আগেই, কিন্তু..

ইতিমধ্যে অফার এসেছে, আপনারা রাত্তিরে থেকে যান। স্কুলের ঘরে থাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কোনও অসুবিধে নেই। ওরা রাজি হয়ে যায়।

সন্ধেবেলায় চৌধুরীবাড়ির পুজোর দালানে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলছে, আশুদা সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়ালেন।

জিতেনবাবুর মুখে রিপোর্টারদের আগমনের খবর পেয়েছিলেন, আরও কয়েকজন লোক বলেছে, খবর কাগজের লোক আগেও দু-চারবার দেখেছি, কিন্তু এরা একেবারে অন্যরকম। খুব খুঁটিয়ে দেখছে

বিশেষ করে রাত্রিবাসের ঘটনাটায় সকলেই খুশি। আশুদার বাড়িতে রাত্রে খেতে বসার পর আসল কথাটা উঠল। উনি নিজেই পাড়লেন, আর কয়েকটা মাস যাক, দেখবেন বোদরার এ চেহারা আর নেই। না, না, কোনও সরকারই নয়–পশ্চিমবঙ্গও নয়, কেন্দ্রও নয়! সেসব আশ্বাস অনেক শুনেছি। আমার ঠাকুরদারাও শুনেছেন। এত হইচই করে ওএনজিসি খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করল। এখন তো তল্পিতল্পা গুটোনোর মুখে। বোদরাকে দেখবে। বোদরারই ছেলে।

আশুদার যেটুকু পরিচয় ওরা পেয়েছে, বুঝতে অসুবিধে নেই যে, অনুরোধ তাঁর কাছে নিষ্ফল। সাবেকি আমলের আদর্শবাদী মানুষদের বিরল প্রতিনিধি। নিজের কথাটা বাদে আর সব কিছু নিয়েই চিন্তা করেন। কিন্তু অসম্ভব জেদি। যা মনস্থির করবেন তা থেকে আর তাঁকে নড়ানোর সাধ্য নেই কারও।

আশুদা বললেন, ডক্টর দিব্যেন্দু রায়ের নাম শুনেছেন তো। তার কথাই বলছি। এমন গুণী ছেলে হয় না। শুনলাম, গোবিন্দর কথা জানতে চেয়েছেন। কিন্তু গোবিন্দর যতই ক্ষমতা থাক, আমি সবার আগে নাম করব দিব্যেন্দুর। দিব্যেন্দু না থাকলে কে চিনত আজ তাকে? সবই তো দেখলাম চোখের সামনে। আমি আপনি হলে হয়তো কোনও দিন ঘুণাক্ষরে বুঝতেও পারতাম না যে, ছেলেটার মধ্যে এতখানি আছে। ছোটবেলায় তো আমরা সবাই দেখেছি, কই

পবন বলে, আচ্ছা, ডক্টর রায়ের রিসার্চ সেন্টার…

আশুদা বাধা দেন, জানি জানি, খুব কৌতূহল আপনাদের। স্বাভাবিক। কিন্তু আপনাদের কথা দিতে হবে যে, এই নিয়ে কিছু এখনই লিখতে পারবেন না। ক্যামেরাও রেখে যেতে হবে। আর কিছু দিন যাক, তারপর লিখতে পারেন যা খুশি। তার আগে নয়। দেখবেন, কথার খেলাপ না হয়। তাহলে আমিও কিন্তু দোষী সাব্যস্ত হব। সত্যি বলতে, আপনাদের নিষ্ঠা দেখে আমি সত্যিই খুশি। আজকের ইয়াং ম্যানদের পরিশ্রমে এত ভয়! আপনাদের নিয়ে যাব কাল। তবে ওই একটা কথা…।

হিঞ্চেপুকুর শ্মশান পেরোতেই কাঁটাতারের বেড়া। খানিকটা ঘুরে দারোয়ানের গুমটিঘরের লাগোয়া গ্রিলের গেট। আশুদাকে দেখে কুর্নিশ ঠোকে দারোয়ান। তারপর একটা মেন সুইচের হাতল ঠেলে নীচে নামিয়ে দিয়ে বলে, এবার যেতে পারেন।

আশুদাই জানিয়ে দেন সিকিয়োরিটি অ্যারেঞ্জমেন্টের ব্যবস্থার কথা।

লাল ইটের পয়েন্টিং-করা একতলা বাড়িটার একটা অংশ গম্বুজের মতো মাথা ঠেলে উঁচু হয়ে উঠেছে প্রায় তিরিশ ফুট। এটাই মেন রিসার্চ সেন্টার। কিছু দূরে আর-একটা ছোট্ট দু কামরার বাড়ি। আশুদা জানিয়েছেন, এটা গেস্ট হাউস। সামনের বছর আরও ছ-টা গেস্ট হাউস তৈরি হবে। দেশ-বিদেশ থেকে যেসব বিজ্ঞানী আসবেন, তাঁদের থাকার ব্যবস্থা। স্থানীয় ছেলেদের ওপরেই এখন পুরো কনস্ট্রাকশনের দায়িত্ব।

রিসার্চ সেন্টারের মধ্যে ঢুকেই সবাই থমকে দাঁড়াল। পুরো বাড়ির একতলা জুড়ে একটা হলঘর। মেঝের ওপর একটা নিচু রেলিং গোল হয়ে একটা জায়গা ঘিরে রয়েছে। আর একেবারে ডানদিকের দেওয়াল চেপে একটা কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে অবজার্ভেশন টাওয়ারে।

সবাই রেলিং-এর ওপর দিয়ে ঝুঁকে পড়ে। সামনেই সেই গর্ত, যেখানে বছর পাঁচেক আগে দিব্যেন্দু এক্সট্রা-টেরেস্ট্রিয়ালদের মহাকাশযানের অবতরণ দেখেছিল। একেবারে খাঁটি জিয়োমেট্রিক আকৃতি। হেমিস্ফিয়ার। বিরাট একটা লাট্ট ঘুরতে ঘুরতে মাটির মধ্যে গেঁথে গেলে এরকমই একটা গর্ত তৈরি হতে পারে। আর আশ্চর্য হচ্ছে গর্তের গা-টা দেখে। গ্লেজওয়ালা মাটির বাসনের মতো। চকচকে সবুজ। তার ওপর খুব সূক্ষ্ম কিছু ক্র্যাক।

আশুদা অবশ্য এক্সট্রা-টেরেস্ট্রিয়ালের কাহিনি জানতেন না। ওদের নানা প্রশ্নের উত্তরে একই কথা বলেছেন, আমি এসবের কিছুই বুঝি না। কিছু জানি না। তবে দিব্যেন্দুর ওপর আমার পুরো বিশ্বাস আছে, নিশ্চয় ওর এই গবেষণা খুবই মূল্যবান। বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের পেছনে নিজের পয়সা এরকম অকাতরে ঢালার মতো ক-টা লোক আছে দেশে! বোঝাই যায়, নিজের ওপর তার প্রচুর আস্থা।

আশুদার পিছুপিছু এবার সবাই অবজার্ভেটরি টাওয়ারে গিয়ে ওঠে, সেখানকার স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরা ও টেলিস্কোপ দেখার জন্য। যদিও এসব কর্মকাণ্ডের কোনও ব্যাখ্যাই খুঁজে পায় না।

সবাই টাওয়ারে ওঠে, ব্যতিক্রম শুধু পবন। সে পিছিয়ে পড়ে এবং সিঁড়ির মাথায় আশুদা অদৃশ্য হওয়ামাত্র হাঁটু গেড়ে বসে। গর্তের কিনারায় পকেট-নাইফের ফলা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সবুজ কাঁচজাতীয় আস্তরণের স্যাম্পল সংগ্রহ করে নেয়। তারপরেই নিঃশব্দে পা চালিয়ে ওপরতলার দলের মধ্যে মিশে যায়।

.

১৭.

সায়েন্স ক্লাবের ছোট্ট প্রদর্শনীতে স্থানীয় লোক ভালোই ভিড় করেছিল। গোবিন্দ তথাকথিত অতীন্দ্রিয় ক্ষমতার দৌলতে যেসব খেলা দেখিয়ে বাহবা কুড়িয়েছে, তার কয়েকটা ক্লাব মেম্বাররা হাতেনাতে করে দর্শকদের চমকে দিয়েছে। যেমন, মুখ-বন্ধ-করা খামের ভেতরে রাখা চিঠি পড়ে দিয়েছে তারা। তারপর দেখিয়েছে এর জন্য কোনও অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা নয়, দরকার একটু অ্যালকোহল-জাতীয় উদ্বায়ী তরল, যা লোককে ঠকিয়ে একবার ওই খামের ওপর একটু মাখিয়ে নিতে পারলেই, খামের পুরু কাগজও স্বচ্ছ হয়ে যায়। দু-তিন মিনিটের মধ্যে উদ্বায়ী পদার্থ উড়ে যায়, তখন আর ধরবার কোনও পথ থাকে না। মনঃসংযোগের নাম করে কৌশলে ছুরি ও চাবি ইত্যাদিও বেঁকিয়েছে এবং সেই সঙ্গে এর কৌশল ফাঁসও করে দিয়েছে। তবে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক হয়েছিল টেবল ল্যাম্পের নীচে রেখে দ্বি-ধাতব ছুরি বেঁকানোর খেলা। গত রবিবারের স্মৃতি সবারই মনে ছিল। বেশ কিছু লোকের মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে সায়েন্স ক্লাবের ছেলেমেয়েরা তাতেই খুব সন্তুষ্ট।

কিন্তু যেটুকু সন্দেহ দেখা দিয়েছিল, ধুয়ে-মুছে দিল পরের রবিবারের প্রোগ্রাম।

ডক্টর রায় যেন দর্শকদের সন্দেহের সম্মুখীন হওয়ার জন্য তৈরি হয়ে এসেছে। প্রথমেই সাক্ষী মানল সেই তিন প্রখ্যাত বিজ্ঞানীর। হ্যাঁ, বাইমেটালিক স্ট্রিপের সাহায্যে এইভাবে ছুরি বেঁকানোর খেলা দেখানো সম্ভব। আর সেই জন্যই গত প্রোগ্রামের ওই অংশটিকে তাঁরাও সন্দেহের চোখে দেখেছিলেন। কিন্তু ডক্টর রায় তারপরে বিজ্ঞানীদের পরামর্শমতো কন্ট্রোলড কন্ডিশনেও ওই একই খেলা দেখিয়েছে। অর্থাৎ যেখানে উজ্জ্বল আলো দিয়ে। ধাতুকে উত্তপ্ত করার কোনও সম্ভাবনা নেই, সেইরকম এক পরিবেশে। এবং দর্শকরা এখন। সেই খেলাই দেখবেন। বিজ্ঞানীরা একবাক্যে স্বীকার করছেন, এ ঘটনার কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তাঁরা দিতে অক্ষম।

খেলা শুরু হয়, সেই একই খেলা, তবে খুবই স্তিমিত আলোয়। আর সবারই যেটা চোখে পড়ে, তা হল, এবার কিন্তু টিভি-স্টুডিয়োয় নয়, কারও বাড়িতে, ডক্টর রায়ের বাড়িতেই গোবিন্দ খেলা দেখাচ্ছে।

শংকর বলে, কোনও বিজ্ঞানীর এরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন কথাবার্তা বলা উচিত নয়। বিশেষ করে নিজেদের বাড়ির মধ্যে এরকম খেলা দেখালে নানাভাবেই ম্যানিপুলেট করা সম্ভব এবং তার চেয়েও বড় কথা, সরাসরি তাপ বা আলোর বদলে মাইক্রোওয়েভ সৃষ্টি করেও একটা বস্তুকে তপ্ত করা যায়। দেখে দেখে তা ধরা সম্ভব নয়। আবারও বলছি, মনে বিশ্বাস নিয়ে শুরু করা আর অবিশ্বাস থেকে শুরু করার মধ্যে অনেক ফারাক।

শংকর মুখে যা-ই বলুক, ওরা সবাই স্বীকার করতে বাধ্য, অনুমানের বেশি ওরা এতটুকু এগোতে পারেনি। বোদরার এক্সপিরিয়েন্স ব্যাপারটাকে আরও জটিল করে তুলেছে। ওই কাচের মতো প্রলেপ-দেওয়া গর্তটার সঙ্গে গোবিন্দর কী সম্পর্ক? ওখানে অত কড়াকড়ি, রিমোট সেন্সিং-এর ব্যবস্থা, স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরা–কী এক্সপেরিমেন্ট চালাচ্ছে ওখানে হার্ট সার্জন দিব্যেন্দু রায়?

এদিকে সমীরের খবরও হতাশাজনক। মিসেস সেনের সঙ্গে দেখা হয়েছে, কিন্তু তিনি কিছু বলতে রাজি হননি। রূঢ় ব্যবহার করেছেন তা নয়, শান্তভাবেই শুনেছেন সব কথা। তারপর জানিয়েছেন, তাঁর এ বিষয়ে কিছুই জানা নেই। শুধু সমীরের ধারণা, উনি চেপে গেছেন৷ এমনও মনে হয়েছে, বোধহয় ভয় পাচ্ছেন। কীসের ভয়? শংকর নিজে একবার দেখা করবে ভেবেছে, যদিও মনে হয় না কোনও লাভ হবে।

.

১৮.

পরের রবিবারের অনুষ্ঠানে একটি নতুন মুখ দেখা গেল। অলকেশ মিত্র।

দিব্যেন্দু রায় পরিচয় করিয়ে দিল, ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার। আইআইটি-র ব্রিলিয়ান্ট এক্স-স্টুডেন্ট। অলকেশ মিত্রর ডিজাইন-করা ও তারই তৈরি এক ইলেকট্রনিক যন্ত্র আজ গোবিন্দর ক্ষমতা পরীক্ষা করবে। তার আগে অলকেশ মিত্র স্বয়ং তার এই যন্ত্রের কার্যপ্রণালি ব্যাখ্যা করে।

ছোট্ট নমস্কার সেরে অলকেশ মিত্র বলল, এই যন্ত্রটিকে এককথায় একটি ইলেকট্রনিক খেলা বলা চলে। পুরো যন্ত্রটির ছবি এখনই আপনারা দেখতে পাবেন। তার আগে যন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটি সম্বন্ধে কয়েকটি কথা বলে নিতে চাই।

অলকেশের জায়গায় টিভি পর্দায় এবার একটা টেবিলের ওপর অর্ধচন্দ্রাকারে বসানো কয়েকটি কাঁচ-লাগানো খোপবিশিষ্ট একটা প্যানেল ফুটে উঠল। টেবিলের সামনে আরও দুটি যন্ত্র, কয়েকটি আলো এবং একটি সুইচ।

অলকেশ সুইচে হাত রেখে বলল, এই সুইচটা টিপে খেলা শুরু হয়। এই দেখুন, আমি সুইচটা টিপছি।

সুইচ টিপতেই সুইচের পাশে বসানো একটা বক্সের সামনে কাচের স্ক্রিনের ওপর ইংরেজি হরফে ফুটে উঠল ৭। ইলেকট্রনিক ঘড়ি বা পকেট ক্যালকুলেটারের ধাঁচে।

অলকেশ বলল, লক্ষ করুন, আবার আমি টিপছি সুইচটা।

কিছুক্ষণ অন্তর একবার করে সুইচ টেপে অলকেশ, আর এক-একটা করে অঙ্ক ফুটে ওঠে–৫, ১, ৬, ৪, ৪, ৭, ৮, ২, ২, ৯, ৫, ০, ১ ইত্যাদি।

অলকেশ ব্যাখ্যা করে, বুঝতেই পারছেন, অঙ্কগুলো এলোমেলোভাবে দেখা দিচ্ছে। কোনটার পর কোনটা আসবে তা হিসেব করে বলা সম্ভব নয়। যাঁরা কম্পিউটার বা মাইক্রোপ্রসেসর সম্বন্ধে খোঁজ রাখেন, তাঁরা তো জানেনই যে র‍্যানডামাইজার নামে একটা ব্যবস্থা আছে, যার সাহায্যে এইরকম র‍্যাডাম নাম্বার জেনারেট করা যায়। এই যন্ত্রে ০ থেকে ৯ অবধি দশটা অঙ্ক পাওয়ার ব্যবস্থা আছে।

দিব্যেন্দু অলকেশকে বাধা দিয়ে বলে, মিস্টার মিত্র, আমার মনে হয়, সাধারণ দর্শকদের কথা ভেবে আপনি যদি ব্যাপারটা আর-একটু সোজা করে…

আচ্ছা, তাহলে লুডো খেলার একটা ছক্কার উদাহরণ দিয়ে শুরু করি। ছক্কার ছটা পিঠ। প্রত্যেকবার চাল দেওয়ার পর এই ছ-টা পিঠের মধ্যে যে-কোনও একটা উপুড় হয়, আর এক থেকে ছয়ের মধ্যে যে-কোনও একটা দান পড়ে। কী দান পড়বে, কেউই আগে বলতে পারে না। তবে একটা কথা। একটা চাল দিয়েই সেবারে কী দান পড়বে বলা যায় না ঠিকই, তবে গণিতশাস্ত্রে সম্ভাবনা-তত্ত্ব নামে একটা অধ্যায় আছে…

প্রবাবিলিটি ও চান্স নিয়ে দু-চার কথা সেরে নিয়ে অলকেশ বলল, ছক্কার সঙ্গে এই যন্ত্রের একটাই তফাত। এখানে ছ-টির বদলে ০ থেকে ৯ অবধি দশটি অঙ্ক নিয়ে আমরা নাড়াচাড়া করছি।

এবার টিভি ক্যামেরা পুরো যন্ত্রটার ছবি দেখায়। যন্ত্রটার দুটো অংশ। একটা আগেই দেখানো হয়েছিল, এবার দেখা গেল, প্রায় একই চেহারার তার একটা ডুপ্লিকেট যেন ঘরের আর-একপাশে রাখা হয়েছে। তার সামনে বসে আছে গোবিন্দ।

অলকেশ বলে, আমার সামনে এই প্যানেলের দশটা খোপে দশরকম ছবি রয়েছে। র‍্যানডামাইজারের সুইচ টিপলেই ট্রানাইট বক্সে তার মধ্যে বিশেষ একটা ছবি ফুটে উঠবে। যেমন দেখুন, এই আমি সুইচ দিলাম–তিন। আর এই প্যানেলে দেখুন, একটা সাইকেলের ছবি জ্বলে উঠেছে। এবার গোবিন্দর সামনে রাখা যন্ত্রের প্যানেলটা দেখুন। এখানেও ওই দশটা ছবি রয়েছে। তবে তফাত হচ্ছে এই যে, এখানে সব কটা ছবিই সবসময়ে দেখতে পাচ্ছে গোবিন্দ৷ আরও লক্ষ করুন, প্রত্যেকটা ছবির নীচে রয়েছে। একটা করে সুইচ। আমি এদিককার প্যানেলে র‍্যানডামাইজারের সুইচ টিপলেই গোবিন্দর প্যানেলে একটা আলো জ্বলবে। ও তখন আন্দাজ করার চেষ্টা করবে, আমার এদিকে কোন ছবিটা জ্বলে উঠেছে। এবং গোবিন্দ তার আন্দাজমতো সেই ছবিটার তলার সুইচটা টিপবে। প্রথম যন্ত্রে কী ছবি নম্বর উঠল এবং তারপর গোবিন্দ কী আন্দাজ করল, সবই স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেকর্ড করে নেওয়ারও ব্যবস্থা আছে এই যন্ত্রে। বহুবার বহু বিজ্ঞানীর সামনে এর আগেও পরীক্ষা দিয়েছে গোবিন্দ৷ এবং এ ব্যাপারে কারও দ্বিমত নেই যে, কোনও অলৌকিক ক্ষমতা ছাড়া এভাবে কারও আন্দাজ মিলতে পারে না।

অলকেশ মিত্রর বক্তৃতার পর শুরু হয় আসল খেলা। প্রথমে অলকেশ একদিকে, অন্যদিকে গোবিন্দ৷ তারপর গোবিন্দর জায়গায় টিভি-স্টুডিয়োর একজন। গোবিন্দ যেখানে একশো অনুমানের মধ্যে একানব্বইবার মিলিয়ে দিল, অন্য ভদ্রলোকের মিলল মাত্র সাতবার।

.

১৯.

রোল্যান্ড রোডের গেট পেরিয়ে মুখ বাড়াল লাল মারুতি।

ড্রাইভারের সিটে ডক্টর রায়। পাশে গোবিন্দ। ফার্স্ট শিফটে অ্যান্ডারসন ক্লাবে সাঁতার শিখতে যায় গোবিন্দ। বাইরের জগতের সঙ্গে তার এই একমাত্র সংযোগ।

ভোরের আলো ভালো করে ফোটেনি। ক-দিন ধরে গোবিন্দ বলছে, ড্রাইভিং শিখিয়ে দাও। এখনও মনস্থির করতে পারেনি ডক্টর রায়। একটা লোভ অবশ্য হয়, চোখ বেঁধে গাড়ি চালানোটা যদি ওর আশ্চর্য ক্ষমতার জোরে…

ভাবনা ছেড়ে ব্রেক-পেডালের ওপর প্রায় সমস্ত শরীরের ওজন ছুঁড়ে দেয় ডক্টর রায়। গোবিন্দ ছিটকে পড়ে সামনে। স্টিয়ারিং-এ মোচড় দিয়েও বুঝি শেষরক্ষা হল না…

রিচি রোডে ম্যাডক্স স্কোয়্যারের পাশের রাস্তাটা থেকে বাচ্চা ছেলেটা যেন মরণ-ঝাঁপ দিয়েছে মারুতির চাকা লক্ষ করে। দরজা খুলে নামার আগেই নির্জন রাস্তা ফুড়ে পঁচিশ তিরিশজন লোক উঠে দাঁড়াল। গাড়ি ঘিরে ফেলেছে। হ্যাঁচকা টানে দরজা খুলে টেনে নামিয়েছে ডক্টর রায়কে। আর কোনও কথা নেই। এলোপাথাড়ি চড়চাপড়ের বৃষ্টি। মুহূর্তের মধ্যে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে দিব্যেন্দু৷

ততক্ষণে গোবিন্দকেও ওপাশ থেকে ওরা টেনে নামিয়েছে। জনা চারেক লোক তাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে ছুটছে। মোড়ের ওধারে একটা সাদা ফিয়াট অপেক্ষা করছিল। লোকগুলো গোবিন্দকে গাড়িতে প্রায় ছুঁড়ে দিয়েই বিভিন্ন দিকে পালাল। গোবিন্দকে নিয়ে ফিয়াট ল্যান্সডাউন রোড দিয়ে উধাও হয়ে যায়।

একটা রিকশওয়ালা টেনে তুলল দিব্যেন্দুকে। মিনিট চার-পাঁচও বোধহয় হয়নি। কিন্তু রাস্তা আবার ফাঁকা। দিব্যেন্দু বিহ্বল দৃষ্টিতে চারপাশ দেখেই পকেটে হাত দিল। মানিব্যাগ ঠিকই আছে। এবার আস্তে আস্তে সব মনে পড়ছে। পুরো ব্যপারটাই সাজানো৷ গোবিন্দকে কিডন্যাপ করার জন্য…

রিকশাওয়ালার প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়েই দিব্যেন্দু পকেটের মধ্যে কী যেন খোঁজে। তারপরে রাস্তার ওপর মুখ নিচু করে এপাশ-ওপাশ দেখতে থাকে।

কুছ খো গয়া?

 দিব্যেন্দুর প্রিয় রনসন লাইটারটা পকেট থেকে ছিটকে পড়েছিল। কুড়িয়ে পেয়ে প্যান্টের গায়ে ঘষে ধুলো ঝেড়ে নেয়। রুমাল বার করে কপালের ঘাম মোছে। সোজা লালবাজার, না আগে ভবানীপুর থানা?

.

 ফিয়াটের পেছনের সিটে দু-জনের মাঝখানে ঠেস দিয়ে বসে আছে গোবিন্দ। লোক দুটো তাকে এমনভাবে আড়াল করে বসেছে যে, বাইরের লোকের চোখে পড়ার কথা নয়। ওর চোখ ও মুখ রুমাল দিয়ে বাঁধা।

পেছনের মোটা লোকটা বলল, গোবিন্দকে বহুত জোর মারিয়েছে। আভি তক…

ড্রাইভারের সিট থেকে দাড়িওয়ালা লোকটা বলল, অমনি তুমি সব বুঝে ফেললে। পেটে যেমন চর্বি, মগজেও তা-ই। চোখ-মুখ সব তো বেঁধে রেখেছ, বুঝলে কী করে যে জ্ঞান ফেরেনি?

আরে, মুখার্জিবাবু…

 এই সেরেছে, মোটাটা আমাদের ডোবাবে দেখছি… আবার সেই নাম ধরে…

বহুত ভুল হোয়ে গেছে মেজবাবু।

তুমি আর বেশি মুখ খুলো না, বুঝেছ? খালি মেজবাবু, মেজবাবু…

পেছনের সিটে দ্বিতীয় ব্যক্তি এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিল। গোবিন্দর দিকে একবার তাকিয়েই যেন শঙ্কিত হয়ে তাড়াতাড়ি সিধে হয়ে বসল। মেজবাবুর ঘাড়ের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিশফিশ করে বলল, ছেলেটা বিড়বিড় করে কী যেন বকছে। ডেঞ্জারাস!

কী বলছিস ফিশফিশ করে? গাড়িটা তোরা চালাতে দিবি না?

আরে, শোন-না। আমার মনে হচ্ছে, ছেলেটা বোধহয় টেলিপ্যাথিতে মেসেজ পাঠাচ্ছে।

ওজ্ঞান ওবস্থায় ভি ওহি টেলুপ্যাথি কাম করতে পারে শুনিয়েছি–হাঁ। চোখ বড় বড় করে তাকায় মোটাটা।

মেজবাবুর কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। বলল, পাঠালে পাঠাক। সে কথাটা তো আগেই ভাবা উচিত ছিল। এখন আর মাথার চুল ছিড়লেও কিছু করার নেই।

আমার বেজায় ভয় করছে, তুই যা-ই বল। এই বেলা ব্যাটাকে রাস্তায় কোথাও ফেলে দিয়ে পালালেই বোধহয় ভালো।

বাঃ, চমৎকার। তাতেই যেন সব রক্ষা হবে। ও ব্যাটা যদি কিছু জেনে থাকে, তাহলেও আমাদের কপালে বহুত দুঃখ আছে। লোক লাগিয়ে রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে মারপিট করে ধরে আনা…।

গোবিন্দ যেন হঠাৎ ঘুমের ঘোরে বলে উঠল, নাইন ওয়ান সেভেন সিক্স। মুখের পাতলা ফেট্টিটার জন্যে কথাগুলো জড়িয়ে গেল।

কী বলল? কী বলল রে? ব্যাটা জেগে আছে নাকি?

 গোবিন্দ আবার জড়িত কণ্ঠে বলল, নাইন ওয়ান সেভেন সিক্স।

সেরেছে! ব্যাটা আমাদের গাড়ির নম্বরটা বলছে যে! দেখল কখন? ওরা যখন ধরে নিয়ে এল, তখন তো আমি নিজে দেখেছি পুরো সেন্সলেস। মেজবাবু বলে।

মোটা লোকটা গোবিন্দর মুখের বাঁধনটা খুলে দিয়ে তার পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে বলে, এহি তো গোবিন্দবাবুর ঘুম ভাঙিয়েছে। অচ্ছা লেড়কা। আমি তোমার সব ঠিক করিয়ে দেব। কোই ভাবনা নেই, হামি…

দুর মোটা!

চোখের বাঁধন সত্ত্বেও গোবিন্দ ঠিক লোক চিনে নিয়েছে।

মেজবাবু কঠিন স্বরে সামনের সিট থেকে বলে, দ্যাখো গোবিন্দ, বেশি চালাকির চেষ্টা কোরো না। ওসব কায়দা আমার জানা আছে–

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয় গোবিন্দ, হ্যাঁ, দাড়িওয়ালা লোকেরা একটু বেশিই বোঝে। আমার কোনও ক্ষমতা নেই জানো বলেই না তোমরা এত কাণ্ড করলে…

মেজবাবু ধমকে ওঠে, বাজে বকিসনি। এতই তো জানিস, বল দেখি, কোন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি?

তোমাদের বলব কেন? যাকে যা জানাবার, আমি ঠিকই জানিয়ে যাচ্ছি। রাস্তার নাম চিনি বা না চিনি, আমার কাকুকে আমি সব খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি। তোমরা কিছুতেই আমাকে আটকে রাখতে পারবে না।

গোবিন্দ তার পাশের মোটা লোকটার কোমরে হঠাৎ কনুইয়ের জোর গোঁত্তা মারে। সে কঁক করে ওঠে।

এই মোটা, শিগগির আমার চোখটা খুলে দাও, না হলে তোমার নামেই আমি…

মোটাটা সত্যিই ভয় পেয়ে গোবিন্দর চোখ থেকে রুমাল খুলে দেয়। সামনের সিট থেকে। মেজবাবু কিছু বলতে গিয়েও বলে না।

মোটা লোকটা গোবিন্দর সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাবার ভান করে তার হাতটা ছুঁতেই গোবিন্দ খ্যাঁক করে ওঠে, সরাও এক্ষুনি ঘেমো হাত!

অচেনা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে গাড়িটা। গোবিন্দ একটু বাদে বলে, তোমরা আমায় এত চেপে না ধরলেও পারো। কোনও ভয় নেই, আমি চ্যাঁচাব না, ছুটে পালাবও না। তার কোনও দরকার নেই। ওরা এবার বেরিয়ে পড়েছে। তোমাদের হাতে আর বেশি সময় নেই।

মেজবাবু দাঁতে দাঁত চেপে বলে, যদি দেখি, ওই টেলিপ্যাথিতে খবর পাঠিয়ে আমাদের ধরিয়ে দিচ্ছিস, তবে আর জ্যান্ত ফিরতে হবে…

গোবিন্দ হাসতে শুরু করে, তাতেও তো তোমাদের রক্ষা নেই। এমনিতে জেল তো হবেই, আমায় মারলে একেবারে ফাঁসি।

মোটা লোকটা এবারে রীতিমতো আতঙ্কিত। মেজবাবুর সঙ্গে শুরু হয় তার তুমুল ঝগড়া। বারবার বলে (গোবিন্দকে শুনিয়ে), সে যদি আগে থেকে জানত, এইরকম কাণ্ড করা হবে, তাহলে কিছুতেই এর মধ্যে থাকত না। তার সত্যিই কোনও দোষ নেই।

দেখ, বেশি ট্যান্ডাইম্যান্ডাই করবি তো তোকেও শেষ করে দেব কিন্তু। তা ছাড়া তুই বললেই তো আর কেউ বিশ্বাস করবে না। এই গাড়ি কার? কার টাকায় গুন্ডা ফিট হয়েছিল!

খ্যাকখ্যাক করে হাসে মেজবাবু। কথা-কাটাকাটি চলতে থাকে। গোবিন্দ চুপ করে শুনে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে চোখ বুজে আপন মনে বিড়বিড় করে কী বকছে।

গাড়িটা এবার বড় রাস্তা ছেড়ে নেমে আসে একটা আমবাগানের মধ্যে। তারপরেই সামনে দেখা যায় ইংরেজ আমলের একটা বাংলো ধরনের বাড়ি। দেখে মনে হয় না, বাড়িতে লোক বাস করে।

বাড়ির পেছনের ছোট্ট একটা দরজা দিয়ে গোবিন্দকে নিয়ে ভেতরে ঢোকে তারা। বড় বড় আয়না, পুরোনো ছবি আর বাঘ-ভালুক বসার মতো কেঁদো কেঁদো সোফা-পাতা লম্বা একটা ঘর। ঘরে কোনও জানলা নেই, তার বদলে দরজা রয়েছে দশটা। মুখোমুখি দু সারি। বাইরে থেকে বাড়ির চেহারায় যে অযত্ন চোখে পড়ে, ভেতরে তার চিহ্ন নেই।

একটা সোফায় বসে গোবিন্দ হঠাৎ যেন খুশিতে চেঁচিয়ে উঠল, বড়জোর আধ ঘণ্টা।

কী বলছিস?

 আধ ঘণ্টার মধ্যেই ওরা এসে পড়বে। দ্যাখো, তোমাদের আমি আগেই বলে দিচ্ছি। এরপর আর বোলো না, আমি ধরিয়ে দিয়েছি।

তিনটে লোকই এবার গোবিন্দকে ঘিরে ধরে। এখন আর তারা ভয় দেখাচ্ছে না। মোটা লোকটা একটা কাগজ বাড়িয়ে ধরেছে। মেজবাবু লটারির অনেক টিকিট নিয়ে ঝুঁকে পড়েছে। শেয়ার মার্কেটে কীসের ওপর দাঁও ধরবে আর কোন টিকিটটা ফার্স্ট প্রাইজ পাবে, শুধু এটুকু জেনে নিয়েই তারা চলে যাবে।

গোবিন্দ হাসতে শুরু করে, তা যদি জানতেই পারতাম, তাহলে তো আমিই সবার আগে…

তবু ওরা অনুনয় করে। গোবিন্দ একবার অন্তত চেষ্টা করুক। তৃতীয় ব্যক্তি এতক্ষণ চুপচাপ ছিল, সে এবার নিচু গলায় বলে, আর কিছু না হোক, এটা তুমি নিশ্চয় বলতে পারবে যে, কোন কনস্টিটুয়েন্সিতে দাঁড়ালে আমি ভোটে জিতে যাব। বরানগর না কাশীপুর? প্লিজ গোবিন্দ…

হেড আর টেল করে দেখতে পারেন, গোবিন্দ বিজ্ঞের মতো বলে, তবে আমার ধারণা, কোনওখানেই আপনার চান্স নেই।

.

২০.

রবিবার। সাড়ে নটা।

ওয়ান্ডার-বয়ের প্রোগ্রামের শুরুতেই ঘোষিত হল : আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, আজ ভোরবেলায় অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতকারীরা গোবিন্দকে দুঃসাহসিকভাবে অপহরণ করেছে। কলকাতার পুলিশ কমিশনার জানিয়েছেন, সম্ভাব্য সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এবং তিনি আশা করছেন, গোবিন্দকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই উদ্ধার করতে সক্ষম হবেন। দর্শকদের কাছেও আমাদের অনুরোধ, তাঁরা এ বিষয়ে কোনও খবর দেওয়ার প্রয়োজন। বোধ করলে সরাসরি লালবাজারের কন্ট্রোল-কমে যোগাযোগ করতে পারেন। গোবিন্দর অসংখ্য গুণমুগ্ধের শুভকামনাই নিশ্চয় তাকে নিরাপদে ঘরে ফিরিয়ে আনবে।

হইচই পড়ে গেল মিহিরের ঘরে।

 বিরাট স্টান্ট?

 অপহরণ না করলে কি গ্ল্যামার বাড়ে!

 এ তো ফিল্মস্টারকে হার মানিয়ে দিল।

 শংকর কিন্তু কোনও কথা বলেনি। সবাই তাকে চেপে ধরে, ব্যাপারটা কী?

 এটা স্টান্ট না-ও হতে পারে। এবং আমার মতে, সত্যিই গোবিন্দ কিডন্যান্ড হয়েছে। এ হচ্ছে আগুন নিয়ে খেলা।

শংকরের কথা কারও মনঃপূত হয় না। কিন্তু ততক্ষণে অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। আজই শেষ কিস্তি।

দিব্যেন্দু রায় প্রথমেই জানিয়ে দিল, আজ আপনাদের প্রিয় গোবিন্দকে দেখতে পাবেন না।

সঙ্গে সঙ্গে টিভি স্ক্রিনের তলার দিকে ছোট ছোট হরফের ঘোষণা দেখা গেল, এই অনুষ্ঠান গোবিন্দকে অপহরণের আগেই রেকর্ড করা হয়েছে। কাজেই গোবিন্দর অনুপস্থিতির সঙ্গে তার অপহরণের কোনও সংস্রব নেই।

দিব্যেন্দু রায় বলে চলে, গোবিন্দর অদ্ভুত ক্ষমতা দর্শকদের মধ্যে প্রভূত কৌতূহল সৃষ্টি করেছে। আমরা জানি, তাঁরা তার আরও কীর্তিকলাপের সঙ্গে পরিচিত হতে চান। কিন্তু গোবিন্দকে আমরা কোনও ম্যাজিশিয়ান বা ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করিনি। যে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের অঙ্গ হিসাবে গোবিন্দ তার ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে এত দিন, সেই মূল লক্ষ্য থেকে বিচলিত হয়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে বলেই আমরা এই সিরিয়ালকে আর না বাড়িয়ে এখনকার মতো আজকের প্রোগ্রামের পরই শেষ করে দিতে চাইছি।

আমরা বহু চিঠি পেয়েছি দর্শকদের কাছ থেকে। নিকটজন, আত্মীয়-বন্ধুরা তো আছেনই। নানাজনের নানা প্রশ্ন, নানা অনুমান–প্রত্যেকেই গোবিন্দর অদ্ভুত ক্ষমতার এক একটা ব্যাখ্যা তৈরির চেষ্টা করছেন। ইচ্ছাকৃতভাবেই আমরা এই শেষ অনুষ্ঠানের আগে পর্যন্ত এ বিষয়ে নীরব ছিলাম।

ঐশ্বরিক ক্ষমতার দোহাই দিলে সব সমস্যাই এককথায় মিটে যায়। বিজ্ঞানীর সঙ্গে ঈশ্বর-বিশ্বাসীর প্রধান পার্থক্য এইখানেই। কোনও ঘটনা বা প্রক্রিয়া রহস্যাবৃত থাকলেও বিজ্ঞানীরা তার কার্যকারণ অনুসন্ধানেই আগ্রহী। এবং এই আগ্রহই বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তি। বিশ্বজগতের সৃষ্টির ও প্রাণের বহু রহস্যই আজও উদঘাটিত হয়নি, কিন্তু তার অর্থ বিজ্ঞানের অসামর্থ্য নয়। নিরন্তর অন্বেষণ, যুক্তিসিদ্ধ পথে এগিয়ে চলা–বিজ্ঞানের সার্থকতা সেইখানেই।

গোবিন্দ বিজ্ঞানের জগতের বিস্ময়। শুধু তা-ই নয়, গোবিন্দ বিজ্ঞানীদের এক নতুন পথ দেখাবে–এই বিশ্বাস থেকেই আমরা তাকে সাধারণ মানুষের সামনে উপস্থিত করেছি। এবার সেই বিশ্বাসের উৎপত্তির ইতিহাস সংক্ষেপে পেশ করছি আপনাদের সামনে।

ইজরায়েলের ইউরি গেলার, রাশিয়ার রোজা কুলিশেভা ও নিনেল কুলাগিনা আর বর্তমানে গোবিন্দর আশ্চর্য কীর্তি থেকে এ কথা প্রমাণিত যে, পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের বাইরেও মানুষের অনুভবশক্তি ক্রিয়াশীল। সংখ্যায় নগণ্য হলেও এইসব মানুষের চেতনা এমন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, যখন সেই চেতনা শরীরের অণুগুলোকে যেমন প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করতে পারে, তেমনই প্রভাবিত করতে পারে সক্ষম শরীরের বাইরের জড়জগতের অণুদের। তাই আমরা দেখেছি, এই অসামান্য ক্ষমতাধররা কোনও বস্তুকে হাত দিয়ে না ছুঁয়ে তড়িৎ প্রয়োগ না করে, চৌম্বকধর্মকে কাজে না লাগিয়ে এবং কোনও যন্ত্র ব্যবহার না করেও সংবাদ আদান-প্রদান করতে পারে, অন্যের মনের খবর জানতে পারে, এমনকী বস্তুর গঠনকে পর্যন্ত পরিবর্তিত করতে সক্ষম।

কিন্তু কী এই আশ্চর্য ক্ষমতার স্বরূপ? এই ক্ষমতা কি জন্মগত? নাকি পরিশীলনের মধ্য দিয়ে আয়ত্ত করা সম্ভব? এই বিষয়গুলি আজও বিজ্ঞানীদের কাছে অজ্ঞাত। গোবিন্দর কথায় ফিরে আসি। গোবিন্দ এই ক্ষমতা জন্মসূত্রে লাভ করেনি। করেছে আকস্মিকভাবে এবং সৌভাগ্যবশত, যার সাক্ষী ছিলাম স্বয়ং আমি।

দিব্যেন্দু রায় তার ডায়েরি খুলে কিছু কিছু অংশ পড়তে শুরু করে। পাঁচ বছর আগের সেই দিন–অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরোবার পর যা ঘটেছে। মাঝে মাঝে ফোটোগ্রাফও দেখায়।

বক্তৃতা শেষ হয় হিঞ্চেপুকুরের পাশে রিসার্চ সেন্টারের পুরো কার্যবিধি ব্যাখ্যার পর। আজ পর্যন্ত অবশ্য ই.টি.-দের দ্বিতীয় আগমন ঘটেনি। অর্থাভাব, প্রয়োজনীয় গ্রান্টের অভাব না ঘটলে পর্যবেক্ষণকেন্দ্র কোনও দিন বন্ধ হবে না, ঘোষণা করে দিব্যেন্দু।

 দিব্যেন্দু রায়ের লাস্ট সেন্টেন্স, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, গ্রহান্তরের মানুষ গোবিন্দকে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে পর্যবেক্ষণ করতে চাইছে ই.টি.-র মতো ক্ষমতাধরের প্রতি মানবসমাজের প্রতিক্রিয়া বিরূপ নয়–এটা উপলব্ধি করার পর, তারা নিজেরাই দেখা দেবে।

.

শংকর ছেলেমানুষের মতো খুশিতে হাততালি দেয়, ডক্টর দিব্যেন্দু রায়, ডায়েরি থেকে পাঠ করে অথেনটিসিটি দেবে ভেবেছিলে তোমার বিবরণকে! তোমার সায়েন্টিফিক অ্যাটিচউডের প্রমাণ! কিন্তু টুথ পাউডারটা যে ডোবাবে, ভেবেছিলে কি?

 শংকরদা কি খেপে গেলে? কী বকছ বলো তো আবোল-তাবোল?

 আবোল-তাবোল নয় রে। এর মধ্যে কোনও আবোল-তাবোলও নেই, হযবরল-ও নেই। টুথপেস্ট আর ব্রাশের বদলে টুথ-পাউডার দিয়ে দাঁত মাজা শুরু হল গোবিন্দর। এবং কবে? না, ই.টি.-দর্শনের পরের দিন থেকে। নার্সিং হোম থেকে বেরিয়েই। টুথ পাউডার আর অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা! যাক, তোরা এখনই একটা কাজ কর। বোদরা থেকে ওই যে স্যাম্পলটা এনেছিলি, ওটার ডিটিএ (ডিফারেনশিয়াল থার্মাল অ্যানালিসিস) আর কেমিক্যাল টেস্টের রেজাল্টটা জোগাড় কর। আর মিহির, তুই এখনই ফোনে একবার তোর বন্ধুকে ধর। হ্যাঁ, পুলিশ কমিশনার দীনদয়ালের ভাইটাকে।

বাড়িতে চুরি হলেও শংকর পুলিশে খবর দিতে নারাজ। সে বলে, আরও বেশি লোকসানের আশঙ্কা। সে এখন যেচে পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইছে। শংকরের মতে, গোবিন্দর হদিশ পুলিশ পাবেই। পেলে দিব্যেন্দু রায়কে খবর দেওয়ার আগেই শংকর শুধু পাঁচ মিনিটের জন্য তাকে একবার দেখতে চায়।

.

২১.

 পুলিশ কমিশনারের খাসকামরাতেই ডাক পড়ল শংকরের।

আসুন ডক্টর মিত্র, বসুন।

 গোবিন্দর কোনও…।

 কিচ্ছু না, কিছু না। হি ইজ অ্যাবসোলিউটলি অল রাইট। দেখুন মশাই, ওসব অলৌকিক ক্ষমতা-টমতার ব্যাপার বুঝি না। কিন্তু ছেলেটা একটা জিনিস। আবার বলছি, সত্যি-মিথ্যে যা-ই হোক, ওর বুদ্ধির তারিফ করতে হবে। এমন ঘোল খাইয়েছে না…

বলতে বলতেই পুলিশ কমিশনার হাসতে শুরু করেন।

গোবিন্দ এমন ভয় দেখিয়ে ছিল যে, কিডন্যাপাররা শুধু ওকে ফেলে পালায়নি, তার মধ্যে একজন স্বেচ্ছায় এসে ধরাও দিয়েছে। সব কবুল করেছে। তারই মুখ থেকে বিশদ বিবরণ শুনেছেন মিস্টার দীনদয়াল। গোবিন্দর উপস্থিতবুদ্ধির পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হয়েছেন।

শংকর বলে, আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, গোবিন্দকে যারা ধরে নিয়ে গিয়েছিল, কেউই সিজড ক্রিমিনাল নয়।

না, দু-জন তো নয়ই, লোভে পড়ে ফাঁদে পা দিয়েছে। একজন… শুধু তাকে এখনও ধরা যায়নি–সেটা একটা জুয়াড়ি।

শংকর জিজ্ঞেস করে, গোবিন্দ কোথায়?

 পাশের ঘরেই আছে। কিন্তু ওর সঙ্গে দেখা করার আগে আপনাকে আমি কয়েকটা জিনিস বলে দিতে চাই। আমার ভাইয়ের কাছে আপনার পরিচয় পেয়েছি। আপনার উদ্দেশ্যও অজানা নয়। বাট হি ইজ হার্ড নাট টু ক্র্যাক। কিছুতেই আমি ওর মুখ খোলাতে পারিনি। অসম্ভব জেদি। ওর শুধু এক কথা, আমাকে বাড়ি নিয়ে চলো। তা ছাড়া নিজের অসাধারণ একটা ক্ষমতা সম্বন্ধে ও একেবারে কনভিন্সড। বলে কী, কিডন্যাপারদের ভয় দেখাতে কোনও অভিনয় করেনি। সত্যিই সে মনে মনে নাকি পুলিশের কাছে খবর পাঠিয়েছিল। পুলিশ যা কিছু করেছে, সবই নাকি তারই নির্দেশে! আর ওর কাকা সম্বন্ধে কোনও প্রশ্ন করলেই দেখবেন, একেবারে ফোঁস—

ওর কাকা সম্বন্ধে আবার কী প্রশ্ন করলেন?

চোখ থেকে চশমাটা খুলে মিস্টার দীনদয়াল বোধহয় একটু চিন্তা করার সময় নিলেন, মানে, ব্যাপারটা একটু ডেলিকেট। এটা কিন্তু অফ দ্য রেকর্ড। ঠিক আছে?

শংকর অভয় দিয়ে ঘাড় নাড়ে।

 দীনদয়াল ঝুঁকে পড়েন টেবিলের ওপর। বছর ছয়েক আগে কলকাতায় পেসমেকার ইমপ্ল্যান্ট নিয়ে একটা কেলেঙ্কারি হয়েছিল মনে আছে? খবরের কাগজে লেখালেখিও হয়েছিল। কিছু ডাক্তারের সঙ্গে ইম্পোর্টারদের যোগসাজশ, নিচু মানের যন্ত্র বিক্রি ও রোগীদের দুর্দশা…

কিন্তু কোনও ডাক্তারের নাম তো উল্লেখ করা হয়নি।

 উল্লেখ করার আগে তো প্রমাণ দরকার। উড়ো খবরের ওপর কি কোনও অ্যাকশন নেওয়া যায়? কিন্তু সে যা-ই হোক, সাসপেক্টদের লিস্টে সবার ওপরে নাম ছিল ওই ডক্টর দিব্যেন্দু রায়ের। মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের অনুরোধে আমরা তদন্তও শুরু করেছিলাম। কিন্তু সেই সময়েই লোকটা পুরোপুরি প্র্যাকটিসই ছেড়ে দিল। আমরাও আর সুবিধে করতে পারলাম না।

আচ্ছা, আজ যদি ছ-বছরের পুরোনো কিছু ডকুমেন্ট আপনার হাতে আসে, নতুন করে…

আপনি দিন, একেবারে পুরো ফাঁসিয়ে দেব, যদি সলিড কিছু হয়…

সলিড মানে, ধরুন যদি দেখা যায়, দিব্যেন্দু রায় বেনামে কোনও পেসমেকার কোম্পানির এজেন্সির আংশিক মালিক?

এনাফ! এনাফ!

 তাহলে আপনি এই ভদ্রমহিলার সঙ্গে নিজে একবার যোগাযোগ করুন।

দীনদয়াল প্যাড আর পেন এগিয়ে দিলেন।

 মিসেস সেনের নাম-ঠিকানা লিখে দিয়ে শংকর বলল, ইনি একসময়ে ডক্টর রায়ের নার্সিং হোমে কিছু দিন ছিলেন। রায়ের দুর্ব্যবহারে বিরক্ত হয়ে কাজ ছাড়ার আগে রাগের মাথায় রায়ের পার্সোনাল কাগজপত্র কিছু হাতিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু রায়ও কম নয়। সে নিশ্চয় কিছু সন্দেহ করেছিল। খুঁজেপেতে মিসেস সেনকে ব্ল্যাকমেল করার মতো একটা খবরও সংগ্রহ করে কথাটা তাঁর কানে পৌঁছে দিতে দেরি করেনি। মিসেস সেন ভয় পেয়ে সব চেপে যান। কিন্তু কাগজপত্র দিব্যেন্দু রায়কে ফেরত দেননি। দিব্যেন্দু রায় যে ব্যাপারটা নিয়ে মিসেস সেনকে ব্ল্যাকমেলের ভয় দেখিয়ে আসছে, সেটা কিন্তু মোটেই সিরিয়াস কিছু নয়। আপনি যদি মিসেস সেনকে আশ্বস্ত করতে পারেন যে, পুলিশ এ ব্যাপারে কোনও দিনই মাথা ঘামাবে না, উনি সবই আপনার হাতে তুলে দেবেন।

আপনি বলছেন ব্যাপারটা সিরিয়াস নয়?

 একেবারেই নয়। আপনি নিজে যদি চান, খোঁজ নিতে পারেন।

 না, তার দরকার নেই। দিব্যেন্দু রায়কে ধরবার জন্য এটুকু ইরেগুলারিটি কিছু না। তাহলে গোবিন্দকে নিয়ে আসতে বলি।

এক মিনিট। আরও দুটো রিকোয়েস্ট। আমি একা কথা বলতে চাই গোবিন্দর সঙ্গে। আর গোবিন্দর মা-কে দিব্যেন্দু রায়ের বাড়িতেই পাবেন, তাঁকে একবার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখানে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। আমি থাকতে থাকতেই সেটা করা দরকার।

শংকরের প্রথম দু-তিনটে প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত দু-চার শব্দে উত্তর দেওয়ার পর গোবিন্দ মুখ বুজেছে। যেন প্রতিজ্ঞা করেছে, কথা বলবে না। দীনদয়াল ঠিকই বলেছিলেন, গোবিন্দ তার নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন এবং সিক্রেটিভ–এই বিষয়ে যে-কোনও প্রশ্নকে সন্দেহের চোখে দ্যাখে।

ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নানা দিক থেকে চেষ্টা করে শংকর বুঝল, ছেলেমানুষ বলে সরাসরি আঘাত না-করার ইচ্ছেটাকে বিসর্জন না দিলে এগোতে পারবে না।

শংকর এবার গোবিন্দর লোক-ঠকানো বিভিন্ন চমকের পেছনে কারসাজিগুলো একে একে ব্যাখ্যা করতে শুরু করে। বাইমেটালিক স্ট্রিপ–ছুরি বেঁকানো, চিঠি পড়া ইত্যাদি।

গোবিন্দ চুপ করে শোনে। কিন্তু তার চাপা উত্তেজনা শংকরের চোখে ধরা পড়ে। শংকর আরও বলে, বিভিন্ন দেশের বুজরুকদের কাহিনি। সাইকো কাইনেসিস বা মনোবলের সাহায্যে জড়পদার্থকে সঞ্চালন, টেলিপ্যাথি, ক্লেয়ারভয়েন্স, প্রিকগনিশন ইত্যাদি।

প্রায় আধ ঘণ্টা বাদে বিদ্রোহ ঘোষণা করে গোবিন্দ, তুমি যা-ই বলল, আমার সত্যিই এমন ক্ষমতা আছে, যা কারও নেই। কারও নেই!

ঠিক! খুব সত্যি কথা। অদ্ভুত ক্ষমতাও বলতে তোমার একটাই আছে, যার ব্যাখ্যা সত্যিই আমরা এত দিন করতে পারিনি। তোমার কাকা দিব্যেন্দু রায়ের মনের কথা তুমি ধরতে পারো। যে খবরের কাগজটা দিব্যেন্দু রায় দেখছে, সেটা তুমিও না দেখে পড়তে পারো। রং চেনা-টেনা সবই ওই একই ব্যাপার। এ ছাড়া তোমার আর এমন কোনও ক্ষমতা নেই, যার ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। এইটুকু বাদে বাকিটা সবই ম্যাজিক, লোক ঠকানো। তা-ই না?

প্রচণ্ড রেগে গোবিন্দ বলে, মোটেই না! এ ক্ষমতা কোনও দিনই তোমাদের হবে না– কোনও দিন তোমরা

না, গোবিন্দ। আমরাও পারব। তবে তার আগে টুথব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজাটা আমাদের বন্ধ করতে হবে। শুধু টুথ-পাউডার। না হলে দাঁত তোলার পরে মাড়ির নীচে…।

উন্মাদের মতো গোবিন্দ চিৎকার করে উঠে দাঁড়ায়, না! না! না! তুমি কী করে জানলে? তুমি…।

এ এক অন্য গোবিন্দ। শংকরের একটি কথায় তার আত্মরক্ষার বর্মটা ভেঙে পড়তেই সত্যিকার গোবিন্দর অসহায় চেহারাটা বেরিয়ে পড়েছে। কুঁকড়ে গেছে।

আতঙ্কের কয়েকটা মুহূর্তে, তারপরেই গোবিন্দ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে। আপন মনে সে বলে চলেছে, কাকু আমাদের তাড়িয়ে দেবে। কাকু তাড়িয়ে দেবে।

শংকর বোঝে, তার ধারণা পুরো ঠিক ছিল না। সে ভেবেছিল, গোবিন্দ বুঝি দিব্যেন্দুর সঙ্গে যোগসাজশ করে জেনে-শুনেই এই কাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছিল। আসলে মনের পেছনে অসহায়তার বোধটাই তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, হঠাৎ যে খাতির সে পেয়ে গেছে, সেটাকে টিকিয়ে রাখতে হলে এই অভিনয়ে সফল হতেই হবে। হয়তো একসময় আশ্চর্য ক্ষমতার কথা নিজেও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল।

শংকর গোবিন্দর পিঠে হাত রাখে। মাথায় হাত বুলোত বুলোতে জানায়, দিব্যেন্দু রায়কে এমনিতেই পুলিশ আরেস্ট করবে। না, গোবিন্দকে নিয়ে যে কাণ্ড করেছে, তার চেয়েও অন্যায় কাজের জন্য। অবশ্য, গোবিন্দ যদি বলে যে, জোর করে তার মাড়ির মধ্যে অপারেশন করে ছোট্ট রেডিয়ো-রিসিভার বসিয়েছে, তাহলেও দিব্যেন্দু পার পাবে না।

 গোবিন্দ চোখ মুছতে মুছতে বলে, আমরা এখন কোথায় যাব? মা আর আমি…

মা এখনই আসছে এবং তাদের সব ব্যবস্থা করা হয়েছে শুনে গোবিন্দ নিজেকে সামলে নেয়। গোবিন্দকে এখন আর তার বয়সের তুলনায় অনেক বড় ও বিজ্ঞ মনে হচ্ছে না। তেরো বছরের ছেলের মতোই সে হঠাৎ মহা উৎসাহে মুখ হাঁ করে দেখায়, ডানদিকের মাড়ির কোন জায়গাটায় যন্ত্রটা বসানো আছে। অনর্গল বকে চলে সে৷ বোদরা থেকে ফেরার পর যে রাত্রে নার্সিং হোমে এটা বসানো হয়েছিল, তার কথা কিছু মনে নেই। প্রথমে কিছু বুঝতেও পারেনি। কোত্থেকে কে যেন কানে কানে মাঝে মাঝেই নানা কথা বলতে শুরু করে। ধরতে পারে কয়েকদিন বাদে। হঠাৎই চোখে পড়ে যায় যে, তার কাকা সিগারেট লাইটারটা মুখের কাছে তুলে কথা বললেই সেটা তার কানে এসে পৌঁছোচ্ছে। কিন্তু ধরতে পারলেও ভয়ে সে কথা জানায়নি। তারপর একবার যন্ত্রটা নিশ্চয় খারাপ হয়েছিল। নার্সিং হোমে এনে কাকা তাকে অজ্ঞান করে আবার যখন সেটা ঠিক করে দেয়, বাড়ি ফেরার পর নিজেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আবিষ্কার করে ব্যাপারটা। যদিও কী করে যে কথাগুলো অত দূর থেকে তার কানে এসে পৌঁছেত, তার কোনও ব্যাখ্যা সে জানত না। গোবিন্দর মা ঘরে এসে ঢুকলেন।

.

২২.

সেলিমপুর সায়েন্স ক্লাবে আজ চা-শিঙাড়া আর জিলিপির ভোজ। অল ইন্ডিয়া সায়েন্স ফেয়ারে ভালোভাবে অংশগ্রহণ করতে না-পারার জন্য আর কারও দুঃখ নেই।

শংকর এতক্ষণ ধরে পুরো ঘটনাটাকে গল্পের মতো বলে গেছে।

রীতা জানতে চায়, আপনি কি প্রথম থেকেই আন্দাজ করেছিলেন যে, দিব্যেন্দু একটা ট্রান্সমিটারের সাহায্যে গোবিন্দর সঙ্গে যোগাযোগ রাখে?

তা ঠিক নয়। প্রথমটায় বুঝিনি। প্রথমে লক্ষ করি, গোবিন্দ না দেখে যা-ই বলুক, মানে এই চিঠি পড়ার ব্যাপারটা বাদ দিলে সবসময়েই কিন্তু দিব্যেন্দু রায় সেখানে উপস্থিত। অর্থাৎ গোবিন্দ দেখছে না, কিন্তু দিব্যেন্দু দেখতে পাচ্ছে। সবার লক্ষ গোবিন্দর ওপর। কারণ সে নিজে খেলা দেখাচ্ছে। তাই দিব্যেন্দুর দিকে কারও দৃষ্টি নেই। টিভি-তে খেলা দেখানো তো আরও সহজ। ক্যামেরা তো একবার একে দেখাচ্ছে, একবার ওকে। কাজেই দিব্যেন্দুর পক্ষে ক্যামেরাকে যে ফাঁকি দেওয়া দুঃসাধ্য নয়, বুঝেছিলাম। কিন্তু কীভাবে খবরগুলো পৌঁছে দিচ্ছে, বুঝিনি। প্রথম সন্দেহ হল, সারাক্ষণ ওর মুঠোর মধ্যে লাইটার চেপে রাখা দেখে। রনসন লাইটার আকারেও খুব ছোট নয়। তোমরা হয়তো লক্ষ করোনি, টিভি প্রোগ্রামে কিন্তু দিব্যেন্দু রায় ওই লাইটার দিয়ে একটা সিগারেট ধরায়নি।

রীতা বলে, তা-ই তো, বাড়িতে যে দিন দেখেছিলাম, একটা সিগারেট মুখেই ছিল, তারপর সেটার আগুন দিয়েই আর-একটা ধরিয়ে নিল। চেন-স্মোকার ভেবেছিলাম…

সায়েন্স ক্লাবের ছেলেদের এবার ট্রান্সমিটার-রহস্যটা সংক্ষেপে বুঝিয়ে দেয় শংকর :

কান ছাড়া শব্দ শোনা সম্ভব বললে প্রথমটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না। কিন্তু কানের বদলে দেহের বিশেষ কয়েকটি অংশের স্নায়ুতন্ত্রকে ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারলে তা সম্ভব। এ ব্যাপারে গাল, ঘাড় এবং জিব বেশ সংবেদনশীল। তবে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যায় দাঁতের গোড়ার স্নায়ুতন্ত্র ব্যবহার করলে। বধিরদের শোনার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এরকম কিছু যন্ত্রের পেটেন্টও নিয়েছে কয়েকজন। বেতার-কম্পাঙ্কের তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ গ্রহণের উপযোগী একটা ক্ষুদ্র যান্ত্রিক ব্যবস্থাকে একটি দাঁত তুলে ফেলে সেই জায়গায় বসিয়ে দিয়েছিল দিব্যেন্দু৷ এই ব্যবস্থার দৌলতেই দিব্যেন্দু যখন তার রনসন লাইটার, অর্থাৎ ট্রান্সমিটারের কাছে মুখ রেখে সবার অলক্ষে কিছু বলত, সেই কথা তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গে পরিণত হয়ে এসে ধরা পড়ত গোবিন্দর রিসিভারে। রিসিভার এই তরঙ্গকে শ্রবণযোগ্য তরঙ্গে পরিবর্তিত করে দাঁতের প্রান্তের স্নায়ুর মাধ্যমে পৌঁছে দিত তার মগজে। বিশেষ একটা কম্পাঙ্কের সংকেত গ্রহণের ব্যবস্থা ছিল। তাই সাধারণ রেডিয়ো ব্রডকাস্টের, বিবিধ ভারতীয় প্রোগ্রাম বা এই জাতীয় অন্য কিছু, শুনতে পেত না গোবিন্দ।

শংকর জানায়, দিব্যেন্দু রায় সম্ভবত ইউরি গেলার নামে বিখ্যাত এক বুজরুকের গুরু আন্দ্রেজা পাহারিকের কাছ থেকেই ব্যাটারি-বসানো এই সিস্টেম আনিয়েছে। এবং আনিয়েছে তার ওই নিচু মানের পেসমেকার আমদানির সংস্থার সাহায্যেই। আর কিছু দিনের মধ্যেই সেটা ফাঁস হয়ে যাবে বলে মনে হয়।

মিহির বলে, মজার কথা কী জানো, ওই যে ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারের যন্ত্র, যেটা তখন একেবারে বাজার মাত করে দিয়েছিল, সেটাও নাকি দিব্যেন্দু রায়ের উর্বর মস্তিষ্ক থেকে বেরোয়নি। তারও বেসিক আইডিয়াটা, ওই যারা ইএসপি বা অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা নিয়ে গদগদভাবে চর্চা করে, তাদেরই। ভেরিটাক ও টার্গ মেশিন নামে এই জাতীয় জিনিস নিয়ে। অনেক শোরগোল হয়েছে আমেরিকায়। দিব্যেন্দু রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ হওয়ার পর খোঁজখবর নিতে গিয়ে অলকেশ মিত্রই এই খবর সংগ্রহ করেছে।

অনিন্দ্য বলে, সবই হল। এবার সবুজ ঠান্ডা আলো, মাটির মধ্যে অদ্ভুত গর্ত আর ই.টি.

কেন, তুই ওই গর্তের স্যাম্পল টেস্টের রেজাল্ট শুনিসনি? পবন বলে, স্রেফ ধাপ্পা। গর্তটা তৈরি করে অ্যাসিটিলিন টর্চের আগুনে ওই কাচের আস্তরণ বানিয়েছে। তবে হ্যাঁ, দিব্যেন্দু রায়ের কথামতো গর্তটা মোটেই সেই রাতে গোবিন্দ আর ওর চোখের সামনে হঠাৎ তৈরি হয়নি। তার আগের দিনই করা হয়েছিল। বারীন বলে, একটা লোককে দিয়ে এইসব করিয়েছিল, সে-ই কবুল করেছে। আশুদাই বারীনের সন্ধান দিয়েছেন আমাদের। দিব্যেন্দুর কেলেঙ্কারির কথা জানার পর আশুদা নিজেই আমাদের খবর পাঠান।

সবুজ ঠান্ডা আগুনের মধ্যেও রহস্য নেই কিছু৷ লুসিফারিন ও লুসিফারেজের মিশ্রণ এক ধরনের সাদা পাউডার–সংগ্রহ করা তেমন কঠিন কিছু নয়। জলের সঙ্গে মেশালেই ওটা সঙ্গে সঙ্গে উজ্জ্বল সবুজ আলো ছড়ায়। লক্ষ লক্ষ টিভি দর্শক ও তিনজন বিখ্যাত বিজ্ঞানীর চোখে ধুলো দিয়ে যে ট্রান্সমিটারে গোবিন্দর সঙ্গে কথা বলতে পারে, তার কাছে এটা তো ছেলেখেলা।

রীতা বলে, এখন বুঝতে পারছি, দিব্যেন্দু রায় যখন বলেছিল সেই প্রথম দিন, বোদয় যাবার পথে গাড়ির টায়ার পাংচার হয়ে গেল, সেটাও ধাপ্পা। অন্ধকার না হলে নাটক জমবে না বলেই ইচ্ছে করে দেরি করছিল।

প্রতিম বলল, আমার কিন্তু মনে হয়, দিব্যেন্দু রায়ের স্ত্রী ইনোসেন্ট, মানে…

পবনও একমত প্ৰতিমের সঙ্গে, তা তো নিশ্চয়। উনি গোবিন্দর অদ্ভুত ক্ষমতার কথা শোনামাত্রই ব্যাপারটাকে ঠাকুর-দেবতার কাণ্ড বলে ধরে নিয়েছিলেন।

কিন্তু ওর সেই স্বপ্নের ব্যাপারটা? দিব্যেন্দু রায় যে ডায়েরি থেকে পড়ে শোনাল?

প্রতিম বাধা দেয় অপুকে, এটাও বুঝলি না? যারা ঈশ্বর-বিশ্বাসী, এ ধরনের স্বপ্ন তাদের পক্ষে দেখা অসম্ভব নয়। তারপরে সেটার সঙ্গে গোবিন্দর কেসটাকে জড়িয়ে নেওয়া…

শংকর বলে, একটা কথা তোমরা খেয়াল করেছ কি না জানি না। দিব্যেন্দু রায় তো মুখে বারবার ঘোষণা করেছে যে, বিজ্ঞান ছাড়া আর কিছুতেই তার আস্থা নেই। কিন্তু বৃহস্পতিবার সে যে অপারেশন করত না…

রীতা বলে, ঠিক, ঠিক! ডায়েরি থেকে পড়ে শোনাবার সময়ে এটাও বলে ফেলেছিল। কিন্তু এরকম ঝানু একটা লোকের কাছে…।

প্রতিম হেসে ঘাড় নাড়ে, যতই ঝানু হোক, ভুল না করলে ধরা পড়বে কী করে?

শংকর বলে, ওভারকনফিডেন্স থেকেও এরকম ভুল করে অনেকে। বাঘা বাঘা সব ক্রিমিনাল অনেক বুদ্ধি খাঁটিয়ে, প্যাঁচ মেরে, শেষকালে গর্দভের মতো কাণ্ড করে বসে।

সায়েন্স ক্লাবের সদস্যরা আরও দুটি ঘণ্টা আরও কয়েক রাউন্ড চা সহযোগে দিব্যেন্দু রায়ের শেষ প্রোগ্রাম–তার ডায়েরির বিভিন্ন এপিসোডের চুলচেরা ব্যাখ্যা করে কাটিয়ে দিল।

সেলিমপুর সায়েন্স ক্লাবে প্রথম সচেতন একটি পোস্ট সৃষ্টি হওয়ার পরে বিনা বিজ্ঞাপনে, ইন্টারভিউ পর্যন্ত না নিয়ে যেভাবে গোবিন্দকে নিযুক্ত করা হয়েছে, জানতে পারলে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ নিশ্চয় সমর্থন করত না। গোবিন্দ এখন শংকরের বাড়িতেই থাকে। স্কুলে ভরতি হয়েছে। বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম দশজনের মধ্যে আসতে না পারলেও, অঙ্ক ও বাংলায় ভালো নম্বর পেয়েছে। পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে পুরস্কার না পাক, সে দিন মঞ্চে তার ম্যাজিক শো দেখে সবাই খুব খুশি। কার্ড ট্রিক, পামিং, যাডলিং, দড়ির গিঁট খোলা ইত্যাদি। বিখ্যাত জাদুকর হুডিনি এখন তার হিরো। বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা চলে এমন সব খেলা দেখিয়েও দর্শকদের হুডিনি কীভাবে চমকে দিতেন, সেই কাহিনি এখন তার সবচেয়ে প্রিয়।

[আনন্দমেলা, পূজাবার্ষিকী ১৯৮৮]