ইগুয়ানোডনের পিকনিক
অপ্রত্যাশিত একটা ঘটনা নতুন গ্রহে পা দেওয়ার ঠিক দেড় দিনের মধ্যেই সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিল।
চায়ের মগ হাতে মধুমিতার প্রথম প্রভাতের স্বাদ নিচ্ছে তখন দু-জনে। সাদা-নীল ডোরাকাটা পোর্টেবল ছাউনির সামনে দুটো ফোল্ডিং চেয়ার। সামনে একশো মিটারের মধ্যেই শুরু হয়েছে বিশাল নীল-সবুজ হ্রদের কিনারা। হ্রদের ওপারে গহন অরণ্য। ডানদিকে ঘাড় ফেরালেই চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে বরফের টুপি-পরা মাঝারি উচ্চতার পর্বতশ্রেণি।
কিন্তু যে জায়গাটায় ওরা মহাকাশফেরি নামিয়ে আস্তানা গেড়েছে, সেখানে সবুজের চিহ্ন নেই। রুক্ষ, ধূসর, পাথুরে জমি। মাঝে মাঝে আবার গোড়ালি ডুবে যাওয়ার মতো সূক্ষ্ম নরম বালি। আস্তানা গাড়ার জায়গা নির্বাচন নিয়ে মতবিরোধ হয়েছিল। হ্রদের অন্য পারে অরণ্যের সীমানাটাই পছন্দ ছিল নিনার।
রাজি হয়নি অয়ন। মধুমিডায় এর আগে মাত্র দুটি অভিযাত্রীদল এসেছে। তারা কখনওই অরণ্যের ধারে ক্যাম্প পাতেনি। ঝুঁকির কথা ভাবেনি অয়ন। নির্দেশ অমান্য করতে চায়নি। কলকবজা বিকল হওয়ার এমন কোনও অজুহাত খাড়া করা যাবে না, যাতে পরিকল্পনা বিরোধী অবতরণ ব্যাখ্যা করা সম্ভব।
নিনার অবশ্য আপশোশের কোনও কারণ নেই এখন। হ্রদের জল থেকে উঠে এসে একটি ইগুয়ানোডন ইতিমধ্যেই তার সঙ্গে ভাব করে নিয়েছে। পোষা কুকুরের চেয়েও অনুগত ভঙ্গি তার। ইগলু বলে কয়েকবার সম্বোধন করার পর এখন তার নামটাও চিনে ফেলেছে। ডাকলেই চোখে চোখ রাখে। আধশোয়া অবস্থায় ল্যাজ নাড়ে। সারারাত ছাউনির দরজার পাশে পাহারা দিয়েছে। এখন ওদের পায়ের কাছে শুয়ে রাতের ঘুমটাকে পুষিয়ে নিচ্ছে।
নিনা চায়ে চুমুক দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে গলায় ঝোলানো ক্যামেরাটা টেনে নিয়ে ক্লিক ক্লিক করে চলেছে। কর্তব্যে ত্রুটি নেই। ফোটোগ্রাফার হিসেবেই এসেছে সে।
তুই শুধু ইগলুর ছবি তুলেই রোল শেষ করে ফেলবি মনে হচ্ছে। অয়ন বলল।
সেটা করতে পারলেই বেশি খুশি হতুম। তোর পেছনে পেছনে পাথরের নমুনা আর তেলের সন্ধানে ঘুরে সময় নষ্ট করার মোটেই ইচ্ছে নেই।
স্বাভাবিক। অপ্রকৃতিস্থ লোকেরা নিজের কাজে, মানে চাকরিতে কখনও আনন্দ পায় না।
তুই নিজে কী! ডাক্তারি ছেড়ে মহাকাশ অভিযানে কারা যোগ দেয়?
উচ্চাকাঙ্ক্ষীরা। তবে ডাক্তারি বিদ্যেটাও…
কথা শেষ না করেই থেমে গেল অয়ন। চায়ের মগটাকে ঠোঁটের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে গেছে তার ডান হাত।
নিনা অয়নের দিকে একবার তাকিয়েই তারপরে তার দৃষ্টি অনুসরণ করল। হ্রদের ধারে জল ফাঁক করে একটি পাহাড়ের মাথা জেগে উঠছে।
নিনা উঠে দাঁড়াতেই অয়ন বলে, ভয় পেলি নাকি? তোর ইগলুরই বড়দা বলে মনে হচ্ছে।
না বললেও চলত। ইগুয়ানোডন বলে চিনতে এক নিমেষের বেশি লাগেনি। কিন্তু জন্তুটার চোখের চাউনির মধ্যে ভয়ংকর একটা কিছু আছে। ব্যাখ্যা করতে পারবে না অবশ্য। বোঝাই যাচ্ছে, অয়ন সেরকম কিছু লক্ষ করেনি। বিচলিত হয়নি। সত্যিই তো, ইগলুও কাল ঠিক একইভাবে জল থেকে উঠে এসেছিল।
মিনিটকয়েক চোখ পাকিয়ে সব দেখে-শুনে নিয়ে নবীন আগন্তুক গলা অবধি উঁচু করে অত্যন্ত মিহি সুরে একটি দীর্ঘ-ঊ-কার উচ্চারণ করল। স্কেলটা খুব চড়া।
অয়ন একাই চমকে যায়নি। তাদের অনুগত ইগলুরও তন্দ্রা ভেঙে গেছে। সে-ও এখন তটস্থ। পেছনের দু-পা ও ল্যাজের ওপর ভর রেখে শিরদাঁড়া সোজা করেছে। সামনের ছোট্ট হাত দুটো প্রার্থনার ভঙ্গিতে বুকের কাছে জড়ো।
ঘন ঘন দীর্ঘ-ঊ-কারের সঙ্গে ক্রোধভরা নিশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে ইগুয়ানোডন তীরের ওপর উঠে এল। ইগলুরই জাতভাই, কিন্তু আকারে দেড়গুণ। ইগলুর দিকেই এখন তার দৃষ্টি। আকাশ-কাঁপানো হুংকার ছাড়ল ইগলু। কিন্তু সেটা ভয়ে, প্রতিবাদে নয়।
ক্রুদ্ধ জন্তুটা তেড়ে গেল ইগলুর দিকে। ইগলু পাশ কাটিয়ে ছুটে চলেছে জলে ঝাঁপ দেওয়ার জন্য। অভ্যাসবশত চোখের সামনে ক্যামেরা তুলে স্বয়ংক্রিয় শাটার চেপে রেখেছিল নিনা।
অয়নের হ্যাঁচকা টানে ক্যামেরাটা ছিটকে পড়ত, ভাগ্যিস স্ট্র্যাপটা গলায় পরানো ছিল। ক্যাম্পের পেছনে প্রায় দেড়শো মিটার দূরে দাঁড়িয়ে আছে তাদের পরিবহন। মধুমিডার আকাশে মূল মহাকাশযান ক্রমাগত পাক খাচ্ছে। সেখানে ফিরে যেতে হলে ওই ফেরিযানই ভরসা। মহাকাশফেরির দিকেই ছুটছে তারা।
ইগলু জলে ঝাঁপ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষিপ্ত ডাইনোসর ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। সত্যি যদি তাড়া করত, গতিতে হার মানানো সম্ভব হত কি না বলা যাবে না। কিন্তু ওদের ভয়। দেখানো ছাড়া অন্য কোনও উদ্দেশ্য বোধহয় ছিল না। খানিকটা দূরত্ব তৈরি হওয়ার পরে নিনা দাঁড়িয়ে পড়ে, পেছন ফিরে তাকায়। ক্যামেরাটা তুলতে যাবে, আবার কয়েক পা ধাওয়া করে এল ভয়ংকর।
তিন পা-বিশিষ্ট ফেরিযানের ঝোলানো সিঁড়িতে পা রাখার আগে আর পেছন ফিরে তাকানোর সাহস হয়নি। নীল-সাদা তাঁবুটা ছিন্নভিন্ন। যাবতীয় আসবাব, টিনে ভরা খাবার, অয়নের যন্ত্রপাতি, এমনকী নিনার ভিডিয়ো ক্যামেরা নিয়ে নয়-ছয় করছে জন্তুটা।
ছবি তোলার জন্য আর সময় দিতে রাজি নয় অয়ন। ইগুয়ানোডনের মতিগতি ভালো নয়। ইচ্ছে করলে দু-হাতে বুকে চেপে এই ইস্পাতের খোলটাকে সে টুথপেস্টের টিউব করে দিতে পারে।
ফেরি-রকেট নিয়ে মূল যানে ফিরে এসেছে ওরা। অয়ন কন্ট্রোল রুমে। মধুমিতার আরও নীচের আকাশ দিয়ে পরিক্রমা করছে এখন মহাকাশযান। ইতিমধ্যে দু-বার তারা পরিত্যক্ত আস্তানার ওপর দিয়ে উড়ে গেছে। ইগুয়ানোডন এখনও খাবারের টিন নিয়ে কামড়াকামড়ি করছে।
নিনা বলল, আশ্চর্য! শুধু নষ্ট করছে। খাওয়ার কোনও ইচ্ছে দেখছি না।
তুই কি এতক্ষণ ওর আচরণের ব্যাখ্যা খুঁজছিলি?
ভেবেছিলাম, ক্ষুধার্ত। তাই আক্রমণ করেছে।
তোর মতো পশুপ্রেমিকদের উৎপাতেই আমাদের অভিযানটা ব্যর্থ হয়ে গেল। আত্মরক্ষার জন্য একটা অস্ত্র থাকলে পালাতে হত না। তার আগে ইগুয়ানোডনকেই মরতে হত।
ভুল কিছু বলেনি অয়ন। তাদের আগে এই গ্রহে দুটি অভিযাত্রীদল এসেছিল। প্রত্যেকেই এখানকার নিরীহ ডাইনোসরদের প্রশংসা করে রিপোর্ট পেশ করেছে। সেই জন্যই কোনওরকম প্রস্তুতি ছাড়াই তারা…
এর পেছনে অবশ্য একটা চক্রান্তও থাকতে পারে। অয়ন বলল, আমরা যাতে হিংস্র জন্তুর মুখে পড়ি, তার ব্যবস্থা করার জন্যই ওইভাবে রিপোর্ট দেওয়া হয়েছিল। মহাকাশ অভিযানও তো প্রতিযোগিতা!
আর-একবার নামার চেষ্টা করা যায় না? নিনা জিজ্ঞেস করে।
লাভ কী! টেন্ট নেই, টিনের খাবারও প্রায় শেষ।
কিন্তু ঘণ্টা তিন-চারের জন্য তো নামা সম্ভব?
এবার প্রস্তুত হয়েই নেমেছে। অয়নের হাতে অটোমেটিক রাইফেল। রেঞ্জ-ফাইন্ডার লাগানো। পরিচিত হদটার ধারেই নেমেছে, তবে আগের জায়গাটা থেকে আন্দাজ পাঁচ কিলোমিটার দূরে। এখান থেকে খ্যাপা ইগুয়ানোডনকে দেখা যাচ্ছে না। তবে তিনি নিশ্চয় আকাশ থেকে ওদের নামতে দেখেছেন।
জমির ওপর পা ফেলেই নিনার মনে হল, একটা শুকনো পাতা উড়ে এসে পড়ল পায়ের কাছে। নিচু হয়ে হাতে তুলে নিয়ে দেখল, গাছের পাতা নয়, পপকর্নের ফাঁকা ঠোঙা। দোমড়ানো।
অয়নও লক্ষ করেছে। বলল, পপকর্ন তো আমরা আনিনি।
কয়েক পা এগোতেই বোঝা গেল, তাদের পূর্ববর্তী একটি অভিযাত্রীদল এই জায়গায় আস্তানা গেড়েছিল। কোল্ড ড্রিঙ্কের বোতল, টিন ও নানা ধরনের কাগজ, অ্যালুমিনিয়ম ফয়েল ও পলিথিনের মোড়ক ছড়িয়ে রয়েছে। মৃদু হাওয়া হালকা আবর্জনাগুলোকে ছিটিয়ে দিয়েছে অনেকখানি জায়গা জুড়ে।
ভিন গ্রহে মানুষের পিকনিকের ছবি তুলতে শুরু করে নিনা। দূর থেকে কয়েকটা শট নেওয়ার পর হাঁটু গেড়ে বসেছে।
নিনা! অয়নের চাপা গলার ডাকে চমকে উঠে দাঁড়ায়। হ্রদের দিকে ফিরে রাইফেল উঁচু করে পজিশন নিয়েছে অয়ন। ইগুয়ানোডন উঠে আসছে জল থেকে। একটা হুংকার ছেড়ে থমকে দাঁড়িয়েছে।
রিফ্লেক্স ক্যামেরার টেলিফোটো লেন্সে চোখ রেখেই চেঁচিয়ে ওঠে নিনা, শুট ইট! কুইক! আক্রমণ করার সুযোগ দিসনি।
দুটোর বেশি বুলেট খরচ করতে হয়নি অয়নকে। রাইফেলের নল নিচু করে ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকাল নিনার দিকে। নিনা বলল, কিচ্ছু করার ছিল না। আমি কনভিন্সড যে জন্তুটা অসুস্থ।
নিনাকে অনুসরণ করে অয়ন। মনে হচ্ছে, নিনার অনুমান ভুল নয়। জন্তুটার ঠোঁটের দু ধারে ফেনার মতো জমে রয়েছে। নাক থেকে গড়াচ্ছে রক্তের ধারা। এটা বুলেটের ক্ষত নয়।
অয়ন আপত্তি করেছিল, কিন্তু নিনা ছাড়েনি৷ কোমরে ঝোলানো এমার্জেন্সি কিট থেকে ছুরি-কাঁচি বের করে তুলে দিয়েছে অয়নের হাতে। ইগুয়ানোডনের শবব্যবচ্ছেদের জন্য ডাক্তারি বিদ্যাকে কাজে লাগাতে বাধ্য হল অয়ন। কিছুতেই বোঝাতে পারেনি যে, কোনও জীবের রোগ বা অসুস্থতার কারণ খুঁজে বের করা অত সহজ নয়। আনাড়ি চিকিৎসক ও ডাইনোসরের এমন কম্বিনেশনও ইতিহাসে বেনজির।
ইতিমধ্যে ইগলুও এসে হাজির হয়েছে। তার গন্ধ শোঁকার ভঙ্গি দেখে প্রথমে দু-জনেই একটু শঙ্কিত হয়েছিল। কিন্তু মৃত ইগুয়ানোডনকে পর্যবেক্ষণ সেরে সে নিশ্চিন্ত মনে গা এলিয়ে দিয়েছে। নিনা একটু একটু করে তার কাছে এগিয়ে এসেছে। এখন তার গলায় হাত বোলাচ্ছে।
এই দেখ, দেখে যা! হরিবল! অয়ন খুব উত্তেজিত।
ইগুয়ানোডনের শ্বাসনলির মধ্যে আটকে ছিল রবারজাতীয় একটা আঠালো ড্যালা। শ্বাসকষ্টই খেপিয়ে তুলেছিল তাকে। রং পালটে গেলেও, ওরা দু-জনেই নিঃসন্দেহ যে এটা বাবুল গাম। একচিলতে কাগজের ফালিও পাওয়া গেছে বাবুল গামের ড্যালার মধ্যে। এই ব্র্যান্ডের বাবুল গামের প্যাকেট একটু আগেই পরিত্যক্ত আবর্জনার মধ্যে দেখেছে নিনা। ছবিও তুলেছে। নিশ্চয় এক-আধ প্যাকেট নয়, কার্টন ভরতি বাবুল গাম চিবিয়েছিল ইগুয়ানোডন।
.
পৃথিবীতে ফেরার পাঁচ দিন পরে।
ইন্টার স্পেস প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির কনফারেন্স রুমে অয়ন ও নিনা তাদের সচিত্র রিপোর্ট পেশ করল। কেন চটপট পাততাড়ি গুটোতে বাধ্য হয়েছে, তারই ব্যাখ্যা।
ওরা জানত, শুধু এইটুকুতে কেউই সন্তুষ্ট হবে না। মহাকাশ অভিযানের লোকসান। পুষিয়ে নেওয়ার জন্য তারা একটি প্রস্তাব দিল। ভিন গ্রহের পরিবেশদূষণের জন্য পূর্ববর্তী অভিযানকারী সংস্থার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করা, ক্ষতিপূরণ দাবি।
রিপোর্ট পেশ করার পর এক সপ্তাহও পেরোয়নি, খবরের কাগজে আধ পাতাজোড়া বিজ্ঞাপনটা আরও অনেকের মতো ওদেরও চোখে পড়েছে। মধুমিডার ডাইনোসর কেন আক্রমণ করেছিল? এই শিরোনামে আজই একটি বিজ্ঞাপনদাতা প্রযোজিত অনুষ্ঠান। প্রচারিত হবে। সময়, রাত আটটা তিরিশ। প্রাইম টাইম।
ইগলুর বড়দার অসুস্থতার কোনও ইঙ্গিত দেয়নি টেলিভিশন। শবব্যবচ্ছেদের ছবিগুলোও পুরো বাদ। দেখানো হল শুধু ডাইনোসরের আক্রমণের দৃশ্য। ভাষ্যকার তখন বলছেন, ইগুয়ানোডন তার প্রিয় বাবল গামের তল্লাশেই হানা দিয়েছিল এবং পায়নি বলেই খেপে গেছে। তারপরেই নিনার তোলা ছবি, মধুমিডার প্রান্তরে পিকনিকের পর পরিত্যক্ত জিনিসের মধ্যে রেনবো বাবুল গামের খোলস। ডাইনোসরও যোগ দিয়েছিল মানুষের পিকনিকে।
রেনবো বাবুল গাম কোম্পানি মোটা টাকা দিয়ে নিনার তোলা ছবি আর তাদের রিপোর্ট ব্যবহারের স্বত্ব কিনে নিয়েছে।
[আনন্দমেলা, ২০ জুলাই ১৯৯৩]