উপন্যাস
গল্প

টাইম মেশিন, কবিতা ও গোলপোস্ট

টাইম মেশিন, কবিতা ও গোলপোস্ট

নির্ঘাত টাইম মেশিন চুরি গেছে। না হলে গ্যারেজ ঘরের দরজা খোলা হাট কেন? আমি, নিলয় আর রীতা বর্তমানে ঝন্টুমামার ট্রাস্টেড কাছের মানুষ। কিন্তু আমাদের জন্মেও আজ অবধি কোনও দিন এই গ্যারেজ ঘরে ঢুকে টাইম মেশিনটার ধারেকাছে ঘেঁষার সুযোগ হয়নি। আর সেই গ্যারেজ ঘরের…

রীতা বলল, হল তো? কতবার বলেছি, একটা পেটেন্ট ফাইল করে রাখুন! সবাইকে অত অবিশ্বাস করার ফলটা বুঝুন। এবার তো আস্ত মালটাই লোপাট–শুধু ডিজাইন বা আইডিয়া চুরি নয়।

চল, আগে থানায় গিয়ে একটা ডায়েরি লিখিয়ে আসি৷ নিলয় সিগারেটের প্যাকেট বার করে ফেলেছে।

আমি আর রীতা একই সঙ্গে ধমক দিয়েছি–মোটেই সেটা উচিত নয়। টাইম মেশিনের কথাটা তাহলে আরও পাঁচকান হবে।

ওহ, পাঁচকান হতে যেন বাকি আছে। ঝন্টুমামা নিজেই তো ঢাকঢোল পিটিয়ে…

নিলয় এখনও যুক্তি দেখাবার চেষ্টা করছে।

রীতা কয়েক পা এগিয়ে গিয়েছিল, তার ডাক শুনে চমকে গেলাম, শিগগির! ঝন্টুমামাও নেই।

ঝন্টুমামা কিডন্যাণ্ড? নিলয় বলল। মানতে পারলাম না, টাইম মেশিন সমেত লোপাট করে দেওয়া মানে হাইজ্যাকিং।

সব সন্দেহ ও আশঙ্কা নিজে হাতে দূর করে দিলেন ঝন্টুমামা। নিজে হাতে মানে নিজের হস্তাক্ষরে। বাড়ির দরজায় তালা ঝুলছে। তার ওপরে একটি, কাগজ সাঁটা। ঝন্টুমামার নোটিশ :

শরীরটা বেজায় মিসফায়ার করছিল। মনটাকে বাঁচাতে তাই বেরিয়ে পড়েছি। ইতিহাসের কোনও এক নিরালা কোণে সময় বদল করতে চাই। সরি, তোদের খবর দেওয়ার সময় পাইনি।

যাক, টাইম মেশিন তাহলে খোয়া যায়নি।

কী মশাই, এত মনেযোগ দিয়ে কী পড়ছেন? আদালতের সমন মনে হচ্ছে! শেষে এত বড় বিজ্ঞানীর দরজায় সমন লটকে দিল!

পেছন ফিরে তাকালাম। অবশ্য মুখ দেখার দরকার ছিল না। এ পাড়ায় ঝন্টুমামাকে নিয়ে এমন বেঁকা কথা ওই একজনই বলতে পারে।

উত্তর দিল রীতা, ঝন্টুমামা আপনার মতো সরকারি স্নেহধন্য হলে নিশ্চয় এ কথা আপনার মনে হত না।

নিলয় আবার একটা সিগারেট ধরিয়ে চাপা গলায় বলল, একেই বলে ডাবল উৎপাত। পাড়ার প্রথম মাল্টিস্টোরিটি যেমন, তেমনি তার এই বিজ্ঞানী বাসিন্দা।

পদার্থবিদ্যার নবীন অধ্যাপক কিন্তু অপ্রতিরোধ্য। এরই ফাঁকে ঠেলেঠুলে দরজার সামনে। এসে ঝন্টুমামার নোটিশ পড়তে শুরু করেছে। তার চেয়েও আপত্তিকর, সরবে পড়ছে।

সিগারেট শেষ হওয়ার আগেই নিলয় সেটাকে পায়ে পিষছে দেখে সঙ্গে সঙ্গে রীতা তার জামাটা খিমচে ধরেছে, হচ্ছে কী!

রীতা বাধা না দিলে…

আমি বললাম, এসবের মানে বোঝার জন্যে সৎসঙ্গ করতে হয়। কেন খামকা মাথা ঘামাচ্ছেন? শিগগির বাজারে ছুটুন, পটোলের দাম মিনিটে মিনিটে বাড়ছে। তা ছাড়া কলেজে লেট করে হাজিরা দিলে স্টুডেন্টরা নাকি কাফি দাওয়াই দিচ্ছে।

প্রফেসার নবীনের ঠোঁটের কোণে পাকামিটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে ফেলেছে। অবজ্ঞার সুরে বলল, টাইম মেশিনটা তৈরি করে ফেলেছেন প্রমাণ করার জন্য। এসব চমক না দিয়ে আপনাদের ঝন্টুমামাকে বলুন কবিতা লিখতে। এমন খাসা হাত।

এরপরেও প্রফেসার নবীন সাত মিনিট বোর করল, তার উক্তির পেছনে যুক্তি দাঁড় করাতে। নবীনের মতে বাঙালির অধঃপতনের মূল কারণ এইটাই। কেউ নিজের আত্মসমীক্ষা করতে পারে না। বিজ্ঞানীরা কবি হতে চায়, খেলোয়াড় চায় গায়ক হতে, গায়করা রাজনীতির নায়ক হলে ধন্য ইত্যাদি৷

শেষ পর্যন্ত দাঁড়িটা টানল রীতা, এরকম কাফি অ্যানালিসিস অনেকদিন বাদে শুনলাম। আপনি কিন্তু এই প্রতিভা, প্লিজ, অপচয় করবেন না। এখুনি ল কলেজে ভরতি হয়ে যান। ওখানে বয়স কোনও ফ্যাক্টর নয়। আলিপুরে অদূর ভবিষ্যতে আপনার প্র্যাকটিস যা জমবে না, মালাই বরফকে হার মানাবে।

প্রফেসার নবীনের পক্ষে আর রসিকতার জের টানা সম্ভব হল না এরপরে। রীতার দিকে কয়েক হাজার কিলোওয়াট পাওয়ারের দৃষ্টিরশ্মি নিক্ষেপ করে সে জগুবাজারের পথে পা বাড়িয়েছে।

ঝন্টুমামার বাড়ির সামনে রোয়াকে বসে তখুনি আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ঝন্টুমামা ফেরামাত্র এই চালবাজটাকে একটা বৈজ্ঞানিক লেঙ্গি মারতে হবে। এই ধরনের স্পর্ধা সহ্য করা যায় না। কোথায় টাইম মেশিনের উদ্ভাবক ঝন্টুমামা আর কোথায় নিউটনের থার্ড ল কপচানো অধ্যাপক!

পৃথিবীর হিসেব অনুসারে সাত দিন পনেরো ঘণ্টা পরে ঝন্টুমামা প্রত্যাবর্তন করেন। মাঝরাত্তিরে। সওয়া দুটো নাগাদ। ঝন্টুমামাও প্রথমে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন নিলয়কে দেখে। ঝন্টুমামা ফেরার পনেরো মিনিটের মধ্যে বাঘাকে নিয়ে সে হানা দিয়েছিল তাঁর বাড়িতে। তারপরে অবশ্য বাঘা প্রায় হাফ কেজি ভিন গ্রহের বিস্কুট খেয়েছে ঝন্টুমামার হাত থেকে।

বাঘা আসলে ঝন্টুমামার ভীষণ ভক্ত এবং সে-ই প্রথম টের পায় ঝন্টুমামার প্রত্যাবর্তন। রাত সওয়া দুটো থেকে প্রচণ্ড ঘেউ ঘেউ। নিলয়ের ঘুম ভাঙিয়ে, হাত কামড়ে প্রায় টেনে। এনেছিল ঝন্টুমামার বাড়িতে।

ঝন্টুমামা কোনও ক্লান্তি বোধ করছিলেন না, কিন্তু মাঝরাতে তাঁর অপূর্ব ভ্রমণবৃত্তান্ত শোনার কোনও বাসনা ছিল না নিলয়ের। পরের দিন রবিবার, কাজেই সবাই মিলে সকালে জমা হবে। একসঙ্গেই শুনবে শুধু আমরা তিনজন নয়, চরম অবিশ্বাসী অবিনীত প্রফেসার নবীনকে ডেকে আনারও অনুমতি দিয়েছেন ঝন্টুমামা। নিলয়ের বুঝতে অসুবিধে নেই যে, ঝন্টুমামার মেজাজ অতি শরিফ।

রবিবার সকাল ন-টা। তিনটি ভক্ত ও একটি নাস্তিকের সামনে তিন নম্বর বেগুনিটা টেনে নিয়ে ঝন্টুমামা জানালেন, সতেরো কোটি আলোকবর্ষের ওপারে একটি বুদ্ধিমান জীববাহী গ্রহে তাঁর নামে দুটি পুরস্কার প্রবর্তিত হয়েছে।

প্রফেসার নবীনের তেলেভাজা সহ্য হয় না, সে আগেই চায়ের কাপ টেনে নিয়েছিল। ঝন্টুমামার কথা শুনে তার হাত কেঁপে প্যান্টের ওপর কয়েক ফোঁটা চা পড়ে গেল, আপনার নামে পুরস্কার… অ্যালিয়েন প্ল্যানেট…

আজ্ঞে হ্যাঁ–দুটি পুরস্কার। একটা জেএম স্মৃতি পুরস্কার আর অন্যটা জেএম শিল্ড। প্রথমটা সাহিত্য পুরস্কার। দ্বিতীয়টা বল খেলার জন্য।

বল-খেলা শুনেই নবীন অধ্যাপকের ঠোঁটের কোণে আবার বেঁকা হাসি জমা হয়েছিল। সে বললে, আজকের ছেলেছোকরারা বল-খেলা বললে আপনাকে একেবারে যাচ্ছেতাই গালি দেবে। বল মানে কী, রাগবি, ফুটবল না অন্য কিছু? ক্রিকেটও তো বল-খেলা। টেনিসেও বল লাগে। পিং পিং খেলাতেও বল দরকার।

চার নম্বর বেগুনি মুখে ভরে ঝন্টুমামা বললেন, ধরেছেন ঠিকই। কিন্তু আমি নিজেও এখনও জানি না, ওদের বল-খেলাটাকে ঠিক কী নামে ডাকা যায়। হয়তো আমার বিবরণটা জানার পরে আপনিই সেটা ভালো বলতে পারবেন…।

তা তো পারবই। কারণ আপনি ভিন গ্রহের বাসিন্দাদের বল-খেলা দেখে আসছেন, কিন্তু নিজের গ্রহে কোনও দিন বলে পা ঠেকিয়েছেন কি না সন্দেহ।

রীতার উত্তেজনাকে হাতের ইঙ্গিতে থামিয়ে দিয়ে ঝন্টুমামা বলল, আপনি ঠিকই ধরেছেন। ছেলেবেলায় পোলিয়ো হয়েছিল আমার। এখনও লক্ষ করে দেখবেন, একটা টান আছে বাঁ পায়ে। কিন্তু বল খেলিনি, আর জন্মেও কবিতা লিখিনি বলেই জ্যান্ত ফিরে এসেছি। না হলে যে কী হত…

ঝন্টুমামা যেন শিউরে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে থালার শেষ বেগুনিটা হাতিয়ে নিলয় ধমকে উঠল, ঝন্টুমামার মুখে তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্ত শেষ হওয়ার আগে কেউ যদি একটাও আলফাল প্রশ্ন করে তাহলে কিন্তু…।

ঝন্টুমামা শুরু করলেন…

কথায় বলে, চেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে। এটাকে একটু মডিফাই করা দরকার। এ যুগে আমরা, মানে সমাজবিজ্ঞানীদের এলিয়েন বা অজানা গ্রহে গিয়েও নিস্তার নেই। অবসর নেই। ভেবেছিলাম, নির্ভেজাল বিশ্রাম নেব। সময় বদল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হল? বিশ্রাম দূরের কথা, প্রচণ্ড টেনশন, ছোটাছুটি–আর সবই দূরত্বর স্বার্থে…

দূরত্বর মানে?

বৃহত্তর বলতে পারছি না বলেই দূরত্বর বলছি। কেননা ওই গ্রহে মাত্র আড়াইশো প্রাণীর বাস। কন্তু যত দূরেই থাক তারা, কারও উপকার করার লোভটা সমাজবিজ্ঞানীরা ছাড়তে পারে না। আর সেই জন্যই ফেঁসে গেলাম। সবই ঠিক ছিল। ছোটখাটো গ্রহ বেছেছিলাম, কমসম লোক, আবহাওয়া সুন্দর মানুষ হিসেবে কোনও বিশেষ প্রোটেকশন নিতে হবে না। সবই জানতাম, কিন্তু তা বলে আড়াইশো লোকই সারাক্ষণ হয় কবিতা বানাচ্ছে, আবৃত্তি করছে আয় নয়তো বল নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে-অকল্পনীয়।

ওদের ভাষাটা আয়ত্ত করতে দিন দুয়েক লেগেছিল, কিন্তু তার আগেই টের পেয়ে গেছি যে, মক্কেলরা যা-ই বলে, তার মধ্যে সুর ও ছন্দ আছে। অন্ত্যমিল আছে। ওরাও বাংলা ভাষা আয়ত্ত করে ফেলল সহজেই, আর তারপরেই প্রশ্ন, এত সুন্দর ধ্বনি তোমাদের, কিন্তু গদ্য কেন?

বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম, আমরাও পদ্য লিখি, কিন্তু সারাক্ষণ পদ্য নিয়ে থাকি না।

 এবার নতুন আবদার, কবিতা শোনাও।

বন্ধুত্ব পাতাবার তাগিদে দড়াম করে বলে ফেললাম—

তাল গাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে ইত্যাদি।

আসলে ঠিক তালগাছের মতো একটা এলিয়েন বৃক্ষ চোখের সামনেই ছিল। ফুটনোট দিতে তাই সুবিধে হয়েছিল।

প্রচুর হাততালি। আরেকটা বলতে হবে।

কী যে মাথায় ঢুকল, শুরু করে দিলাম—

 ধান কাটা হয়ে গেছে কবে যেন

খেতে মাঠে পড়ে আছে খড়
পাতা কুটো ভাঙা ডিম–সাপের খোলস নীড় শীত।

এবারে কিন্তু হাততালি পড়ল না। সবাই গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে। ভুরু কুঁচকে গেছে। কী সর্বনাশ! রবি ঠাকুরের কবিতাটা চিনতে পারল না আর। জীবনানন্দ বলতেই ধরা পড়ে গেলাম।

না, ব্যাপারটা তা নয়। ওদের মতে, এই দুটো কবিতা কোনও একজন কবির পক্ষে লেখা সম্ভব নয়। এইবার ব্যাপারটা বুঝে শুরু হল লড়াই। একবার শক্তির কবিতার চার লাইন, তারপরেই কালিদাস রায়ের তিন পাতা। একবার নজরুল আর তারপরেই জয়।

এইসব কাণ্ডের মধ্যেই আমি মোক্ষম একটা জিনিস বুঝে ফেলেছি–এরা সব স্বভাবকবি, ব্যক্তিগত স্টাইল যতই স্বতন্ত্র হোক, শাস্ত্র বা ব্যাকরণ বলে কোনও বিজ্ঞান এখানে জন্ম নেয়নি। অথচ ইচ্ছে করলেই এদের মধ্যে কিছু গোত্র বিভাগ করা যায়। যেমন, জনা তিনেকের ঝোঁক অমিত্রাক্ষরের ওপর। কয়েকজন এখনও পয়ারে রয়েছে। গদ্যকবিতার ঝোঁকটা কম।

এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, নিজে কবি হলে আমি কখনও এমন সুযোগ ছাড়তে পারতাম না। নিজের কবিতাই আওড়াতাম। ওদের সীমাবদ্ধতাটাও অজানা থেকে যেত।

কবিতার আসর হঠাৎই ভেঙে গেল। একজন কবি দড়াম করে একটা বল কিক। করলেন আর সঙ্গে সঙ্গে সবাই ছুটল বল খেলতে। আমাকে বেশ কয়েকবার খেলায় যোগ দেওয়ার জন্যে বলেওছিল। কিন্তু ওই ভাঙা পায়ের দোহাই দিয়ে রেহাই পেলাম।

খাওয়াদাওয়ার অভাব নেই। প্রচুর আপ্যায়ন। এটা স্পষ্ট যে, কোনও এককালে বিজ্ঞান ও কারিগরিতে এরা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। এখন চাষবাস কিছুই করে না। তবে ফলমূল পেড়ে খায়। মাছও ধরে। এইরকম দু-তিনটি ব্যাবহারিক কর্মে শুধু তারা নিযুক্ত। এবং সেখানেও পায়ে পায়ে চলে কবিতা। কবিতা না বলে অবশ্য শুভংকরীর আর‍্যা বলাই ভালো।

এইরকম সরল আর গোল্লায় যাওয়া প্রাণীদের জন্য কিছু একটা করতেই হয়। কী করি ভাবছি, হঠাৎ চোখে পড়ল, ওরা বল নিয়ে নিজেদের মধ্যে বেজায় ছোটাছুটি গোঁত্তাগুত্তি করছে, কিন্তু গোল করার জন্য কোনও চেষ্টা নেই। কীরকম যেন বিশৃঙ্খল আচরণ। ভালো করে তাকিয়ে দেখি, গোল করবে কী, গোলপোস্টই বসায়নি৷

নিজে হাতে বাঁশ কেটে দুটো গোলপোস্ট বানিয়ে দিলাম। তারপরেও দেখি কিছুই ঘটছে না। না। এবার বুঝেছি, দলের কনসেপ্টটাও নেই। বাইশজন পেলে মিলে একটা বল নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। সঙ্গে সঙ্গে দুটো দল বানাতে হল। একটার নাম পয়ার আর অন্যটা অমিত্রাক্ষর। জমে গেল খেলা।

আরও বহু কবি মাঠের একপাশে বসে খেলা দেখছিল। তাদের মধ্যে গিয়ে আরও চার পাঁচটা দল বানিয়ে দিলাম। আর এই দল বানাবার পরেই মনে হল, একটা শিল্ড চাই। না হলে কী নিয়ে লড়বে ওরা? আমার মহাকাশযানের একটার পাখনা–এক টুকরো অ্যালুমিনিয়ম নিয়ে এসে বললাম, এখন থেকে চ্যাম্পিয়নদের প্রাপ্য। ওরাই নাম দিয়েছে তারপরে জেএম শিল্ড। জেএম মানে ঝন্টুমামা।

ফেরার সময় হয়ে আসছে। আরও একটা কাজ বাকি। ওদের কাব্যচর্চার জন্যও একটা গোলপোস্ট খাড়া করা। আগেই দেখেছি, ওরা নিজেদের কবিতা ছাপানোর জন্য একটুও আগ্রহী নয়। অথচ আধুনিকতম প্রিন্টিং ব্যবস্থা ওদের হাতের নাগালে। একদিনের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, শঙ্খ, জয় ও কালিদাসের একগুচ্ছ কবিতার একটা সংকলন ছেপে ফেললাম ডেক্সটপ প্রিন্টারের সাহায্যে। সোনালি ফিতেয় বইটি মুড়ে তার ওপরে একটা কার্ড গুঁজে দিলাম। একটা শর্তও ছিল সেই সঙ্গে–শুধু মুদ্রিত কাব্যগ্রন্থের জন্যই এই পুরস্কার এখন থেকে প্রতি বছর অর্পণ করা হবে।

দুঃখ শুধু একটাই। আমার বিদায় নেওয়ার সময়ে কেউ উপস্থিত ছিল না। একদল খেলার মাঠে জেএম শিল্ড বিজয়ের প্রস্তুতি নিয়ে লড়ে যাচ্ছে, বাকি সকলে কবিতার প্রিন্ট আউট নিতে ব্যস্ত।

যাক গে, আমার কাজ আমি করেছি, কী বল?…

 ঝন্টুমামা থামলেন।

এবার প্রশ্নের পালা। নিলয় বলল, কিন্তু এত কাণ্ডের পরেও আপনি যে ওদের কী উপকার করলেন, তা তো কিছুই আমার খুপরিতে রেজিস্টার করছে না। বরং আপনি তো মনে হচ্ছে, ওদের বাঁশ দিয়ে এলেন!

দুর বোকা। ওদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাবটাই চলে গিয়েছিল। আর প্রতিযোগিতার ব্যাপারটা ছাড়া যে কারিগরি উন্নতি বন্ধ হয়ে যায়, তার প্রমাণ তো তোরা জানিসই। গ্যাট বা ইন্টেলেকচুয়াল প্রপাটি রাইট চালু না হলে ভারতের কী অবস্থা হত, ভেবে দেখেছিস কখনও!

রীতা বলল, তা না-হয় বুঝলাম। কবিতার বই ছাপানো থেকে শুরু করে আরেকবার কারিগরির দিকে নজর পড়বে। কিন্তু ফুটবল শিল্ড…

খবরের কাগজের জন্ম দেবে। দেবেই দেবে। ঝন্টুমামা কনফিডেন্ট।

এবার আমার প্রশ্ন, জেএম স্মৃতি পুরস্কার নির্বাচনের কমিটিও কি আপনি করে দিয়ে এসেছেন?

বাহ্-সুন্দর প্রশ্ন। না, কমিটি করিনি, কিন্তু কিছু আইডিয়া দিয়ে এসেছি। নির্বাচকমণ্ডলীর কোন কোন দিকে নজর দেওয়া উচিত। তারই সঙ্গে ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস-এর ব্যাপারটাও বোঝাতে হয়েছে। যেমন কে প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দে কবিতা বানিয়েছে, সেটা যদি জানা যায়, তবে সে এবং তার ডাইরেক্ট চ্যালা ছাড়া আর কেউ ওই ছন্দে কবিতা লিখে পুরস্কার পেতে পারে না। এর থেকে তিনটে উপকার হবে– এক, সাহিত্য সমালোচকদের আবির্ভাব। দুই, ঐতিহাসিকদের আবির্ভাব। তিন, উপরোক্ত দুই পণ্ডিতবর্গের ঝগড়াঝাঁটির মীমাংসা করার জন্য আইনজ্ঞদের আবির্ভাব।

প্রফেসার নবীন লাফিয়ে উঠল, ব্যাস ব্যাস, অনেক হয়েছে। সারাটা দিন ঝন্টুমামার বোগাস গুলগল্প শুনে সময় নষ্ট করতে আমার কোনও ইচ্ছে নেই। আপনারা চালিয়ে যান। আমি চললুম।

নিলয় চোখের পলকে লাফিয়ে উঠে নবীনের কুঁটির কাছে জামাটা চেপে তাঁকে প্রায় শুন্যে টেনে তুলেছে। আমরা হাঁ হাঁ করে উঠেছি, ঝন্টুমামা নিরুদবিগ্ন, তবু অনুরোধ করেছেন নির্বোধ অধ্যাপককে শারীরিক নির্যাতন না-করার জন্য। কিন্তু নিলয় অ্যাডামেন্ট। তার একটাই প্রশ্ন, অধ্যাপক নবীনকে বলতেই হবে, কেন ঝন্টুমামার কাহিনিকে সে বোগাস এবং গুলগল্প বলছে।

বলছি–ছাড়ুন–বলছি– নবীন কোনওক্রমে মাটিতে আবার পা রাখার সুযোগ করে নিয়েছে।

বলুন–শিগগির বলুন– ধমক দেয় নিলয়।

আপনাদের ঝন্টুমামা নিজের উদ্ভাবিত টাইম মেশিনে চড়ে সময় বদল করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে, হাজার হাজার আলোকবর্ষ দূরত্বের একটি ভিন গ্রহ পরিদর্শন করে এসেছেন তিনি রকেটে চড়ে। টাইম মেশিন আর রকেট কি একই জিনিস?

শুধু নিলয় নয়, রীতা আর আমিও মুহূর্তের জন্য সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিলাম বোধহয়। ঝন্টুমামাকে শেষ পর্যন্ত ঘনাদা বা টেনিদার পর্যায়ে ফেলতে হবে, এটা আমাদের কাছে দুঃসহনীয়। আমরা সবাই চেয়ে আছি ঝন্টুমামার মুখের দিকে। আর তিনি দু-হাতে মাথা চেপে মুখ নিচু করে বসে আছেন। আমাদের মানসম্মান না ডোবাতে পারলে যেন শান্তি নেই।

কী হল, বলুন– প্রফেসার নবীন কৈফিয়ত তলব করার ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠল।

ঝন্টুমামা ক্লান্ত ভঙ্গিতে মাথা তুললেন, একটা স্যারিডন দিবি বাছা? তোদের মতো গণ্ডমূর্থের সঙ্গে কথা বলার এই একটা খেসারত। মাথা ধরে যায়। আরে মূর্খ, টাইম মেশিন নিয়ে আমি হিঞ্চেপুকুরের পাশে নামি। বট গাছের পাশে সেটাকে পার্ক করে দিই। তারপরে পাঁচ ক্রোশ হেঁটে পঞ্চবিংশ শতাব্দীর আয়ন-রকেট ধরি। ফেরার কথাটাও বলতে হবে, রকেটে করেই ফিরি। তারপর আবার ওই পাঁচ ক্রোশ হেঁটে হিঞ্চেপুকুরের পাশ থেকে টাইম মেশিনে চড়ে তোদের কাছে ফিরেছি।

 [কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান, পূজাবার্ষিকী ১৯৯৪]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *