ফেলে দিলেন ঝন্টুমামা
নেমন্তন্ন খাবার জন্যে বায়না ধরেছে ঝন্টুমামা। বিয়েবাড়ির নেমন্তন্ন। এরই জন্যে রোজ সকাল-সন্ধে একেবারে ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে উদয় হচ্ছেন এবং অস্ত যাচ্ছেন। তাঁর ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে, দিনকয়েকের মধ্যেই একটা ব্যবস্থা করতে না পারলে বাঙালির শুভবিবাহ অনুষ্ঠানে পাত পেড়ে বসার শেষ সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে যাবে। অবশ্য নিজের মুখে ঝন্টুমামা তাঁর ভালোমন্দ ভক্ষণের বাসনার কথা স্বীকার করেননি। বলেছেন, আলো তুলবেন।
আলো তোলা মানে ফোটো তোলা। ভারতে ফোটোগ্রাফারের ছড়াছড়ি, কিন্তু আলোগ্রাফার এই একজন–ঝন্টু সেন। ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিক যাঁর ছবি (বা আলো) ছেপে ধন্য হয়, তাঁর পক্ষে মহাকাশে কি মহাসাগরের অতলে অভিযান চালানো বা দুর্গম জায়গায় ক্ষুদ্রতম কীটের ছবি তোলাই মানায়! বিয়েবাড়ির মামুলি ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ থাকার কোনও কারণই থাকতে পারে না। তা ছাড়া ঝন্টুমামার দৈর্ঘ্যের অভাব বিয়েবাড়ির ভিড়ে ছবি তোলার সময় বাধা হয়ে উঠতে পারে। নিলয়কে বলেছিলাম, একটা ছোট জলচৌকি দেখে রাখিস। মনে করে নিয়ে যেতে হবে।
নিলয়ের মাথায় অন্য ভাবনা। বিয়েবাড়িতে যাওয়ারই যদি এত দরকার, ঝন্টুমামা তো আদিদাসকে বললেই পারতেন। পাড়ার যে-কোনও বিয়েবাড়ি থেকে নেমন্তন্ন আদায় করতে কি তেমন কোনও অসুবিধে…
কিছুদিন যাবৎ আমার মনে হচ্ছে, ঝন্টুমামার চ্যালা হয়ে আদিদাসের বারোটা বেজে গেছে। মানে, আগে তবু মন দিয়ে মস্তানি করে বেড়াত, এখন সেটাও ঘুচেছে আর ডার্করুমের কাজেও অষ্টরম্ভা।
-তুই কিসসু জানিস না। গত সপ্তাহেই গ্রেট ডেঞ্জার থেকে ঝন্টুমামা রক্ষা পেয়েছে ওই আদিদাসের জন্যেই। একটা লোককে দেখে হঠাৎ ঝন্টুমামার ধারণা হয়েছিল, তার মাথার খুলির গঠনে বান্টুদের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সেই কথা জানাজানি হয়ে গেলে অবস্থা এমন জটিল শেপ নিয়েছিল যে…
–আসলে আমার কী মনে হয় জানিস নিলয়, বিয়েবাড়িটা সত্যিই উপলক্ষ। এর পেছনে কোনও বৈজ্ঞানিক অভিযানের ঘটনা আছে। তোকে বা আমায় বাদ দিয়ে ঝন্টুমামা তো কখনওই…
তার মানে, ঝন্টুমামাকে হাজার খোঁচালেও আসল রহস্যটা এখন জানার উপায় নেই। প্রথম প্রথম আমাদের ভয়ানক রাগ হত। এ কেমন কথা! সব কাজে সাহায্য করছি, অথচ কিছু জানানো হচ্ছে না! কিন্তু এখন ওসব দুঃখের কথা আমরা মনের মধ্যেই চেপে রাখি। না হলে ঝন্টুমামা যদি আমাদের ত্যাগ করেন তো কেলেঙ্কারি। মাঝে মাঝে উনি কৃপা করে আমাদের বাড়িতে এসে ওঠেন। ওঁর মস্তিষ্কটা আমাদের ধারে ব্যবহার করতে দেন। অর্থাৎ আমাদের যেটুকু শিক্ষাদীক্ষা (বিজ্ঞানে), তা ওঁর মাথার মধ্যেই তখন নড়েচড়ে বেড়ায়।
সে যা-ই হোক, এখন প্রথম কাজ হল একটা বিয়েবাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে যাবার ব্যবস্থা করা।
.
ছ-টার মধ্যে পৌঁছে গেলাম সন্তুদের বাড়ি। ওর দিদির বিয়ে। না, জোর করে নেমন্তন্ন আদায় করতে হয়নি। ঝন্টুমামা ছবি তুলতে আসবেন শুনে সত্যিই ওরা খুশি।
শুনলাম লগ্ন সাতটায়, এখনও বর পৌঁছোয়নি৷ ঠিক এই আশঙ্কাই করেছিলাম। এত তাড়াতাড়ি কেউ বিয়েবাড়িতে আসে! ঝন্টুমামার সবটাই যেন অদ্ভুত।
ঝন্টুমামা সন্তুকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, খাওয়াদাওয়ার পর কোথায় ময়লা ফেলবে তোমরা?
সন্তুর ঠোঁট দুটো আধ ইঞ্চি হাঁ হয়েই রইল। প্রায় মিনিটখানেক।
–বুঝতে পারলে না? ময়লা-এঁটো বাতিল খাবারদাবার কোথায় ফেলা হবে?
সন্তু একটু সামলে নিয়ে বললে, ওই সামনের লাইটপোস্টটার পাশেই সবাই…
–বেশ বেশ। আচ্ছা, দোতলায় রাস্তার সামনে একটা বারান্দা আছে না? মানে, আমি দোতলা থেকে ওই জায়গাটা ক্যামেরার নজরের মধ্যে পেতে চাই।
–বেশ তো, চলুন-না।
–এখন নয়, খাওয়াদাওয়ার প্রথম ব্যাচ শেষ হোক। না হলে কীসের ছবি তুলব! ভালো কথা, ইলেকট্রিক মিস্ত্রিকে বলে দোতলার বারান্দা থেকে একটা ফ্লাড-আলোর মুখ ঘুরিয়ে রেখো, ওই ময়লা ফেলার জায়গাটায় যাতে ভালো আলো থাকে। এত দূর থেকে ফ্ল্যাশে কাজ হবে না।
সন্তু হেসে চলে গেল। লজ্জায় তখন আমাদের মুখ লুকোবার জায়গা নেই। তখনও কি জানি, এই সবে শুরু!
কোল্ড ড্রিঙ্ক হাতে নিয়ে সন্তু এসেছিল। ঝন্টুমামা যেন ভয়ে সিঁটিয়ে গেলেন, না, না, ওসব হাওয়াই জল আমার একদম সহ্য হয় না।
নিলয় তাড়াতাড়ি বুঝিয়ে দিল, ঝন্টুমামা এয়ারেটেড ওয়াটারের কথা বলছেন।
ঘণ্টাখানেক ধরে দু-জনে বসে আছি। একটার পর একটা সিগারেট ধ্বংস করছি। ঝন্টুমামা বাড়ির ভেতরে ছবি তুলতে সেই যে উধাও হয়েছেন, এখনও পাত্তা নেই।
সন্তু হন্তদন্ত হয়ে কাকে যেন অভ্যর্থনা জানাতে যাচ্ছিল, পেছন থেকে ডাকলাম, ঝন্টুমামা করছেন কী?
–আর বোলো না। আমাদের গজেনভাইকে নিয়ে পড়েছেন। একের পর এক ছবি তুলে যাচ্ছেন।
গজেনভাই মানে?
গজেনভাই আমাদের নাপিত। ছোটবেলা থেকে..
–না, এটা বেজায় বাড়াবাড়ি! বিয়েবাড়িতে ছবি তোলার নাম করে…
থাক থাক, ওই নিয়ে আর কিছু বোলো না। এমন রেগে গেছলেন না! মানুষকে তোমরা মানুষ বলে গণ্য করতে শেখোনি! –এই বলে একেবারে অগ্নিশর্মা। বললেন, গজেনভাইয়ের মতো আলোসম্মত মুখ এমন ব্যক্তিত্ব নাকি বিরল।
প্রথম ব্যাচে খাওয়ার ডাক পড়ল। তেতলার ছাতে উঠে দেখি, ঝন্টুমামা স্টার্ট করে দিয়েছেন।
-আরে, এত দেরি করলে কেন! তাড়াতাড়ি উঠতে হবে না।
ঝন্টুমামা আমাদের তাগাদা দিলেন। নিজের পাশের সিট দুটো আমাদের জন্যে খালি রেখেছেন দেখে কৃতার্থ হলাম। কিন্তু সে আর কতক্ষণ? মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ঝন্টুমামার পাশে বসার বিড়ম্বনা শুরু হয়ে গেল।
-আহাহা, সবটা খেলে চলবে কী করে? রয়ে-সয়ে, রয়ে-সয়ে! ব্যাস ব্যাস, আর নয়! –চাপা গলায় শাসানি দিলেন। চপের অর্ধেক আর খাওয়া হল না।
ফ্রায়েড রাইস, মাংস–সবই প্রায় পড়ে রইল পাতে। মুখে উঠল দু-এক গ্রাস। অবশ্য ঝন্টুমামা নিজেই খাননি।
দই-মিষ্টি আসার আগেই আমাদের টেনে নিয়ে উঠে পড়লেন ঝন্টুমামা। দোতলার বারান্দায় যেতে হবে। নিলয়কে কানে কানে বললাম, গুলি মার বৈজ্ঞানিক অভিযানে! আমি চান্স পেলেই পালাব। এই বেলা গেলে তবু যদি ফাঁড়ির মোড়ের ধাবায় রুটি-তড়কা জোটে।
কিন্তু চান্স দেওয়ার পাত্র নয় ঝন্টুমামা। একটা চোঙার মতো টেলি-লেন্স হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। তিনজনেই এখন দোতলার বারান্দায়।
পাত পরিষ্কার হওয়ার পর এঁটোকাঁটার ড্রামটা দু-জনে মিলে ধরাধরি করে উপুড় করে দিল লাইটপোস্টের নীচে। চার-পাঁচটা বাচ্চা ছেলেমেয়ে তারই অপেক্ষায় বসে ছিল।
দু-পয়সা কামানোর জন্যে ক্ষুধার্ত ভারতবর্ষের ছবি তোলার মতো মানুষ তো নন ঝন্টুমামা! তবে? তাকিয়ে দেখি, ছবি তোলার জন্য এখনও তিনি তৎপর হননি।
হঠাৎ কানে এল ঘড়ঘড় শব্দ। ময়লা ফেলার গাড়ি আসছে। বাচ্চাগুলোকে এক ধমকে হটিয়ে দিয়ে দুটো তাগড়াই লোক বেলচা দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে ভুক্তাবশেষ ভরে নিল তাদের গাড়িতে।
পরপর ছবি তুলে গেলেন ঝন্টুমামা।
ময়লার গাড়ি আবার ঘড়ঘড় শব্দ করে চলে গেল। তার পেছনে পেছনে বাচ্চাগুলো ছুটছে।
ব্যাগের মধ্যে ক্যামেরা ভরে ঝন্টুমামা বললেন, কী বুঝলে? মজাটা লক্ষ করলে তো?
ঝন্টুমামার সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। কিছুই মাথায় ঢোকেনি। ওদিকে পেটে চোয় ডন মারছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ঝন্টুমামা। ইশ, এখানেই আটটা বাজল। পার্ক স্ট্রিট যেতে হবে, তারপর ধর্মতলা।
একটা ট্যাক্সি ডেকে ঝন্টুমামা উঠতে বললেন। ওয়ালডুৰ্কে আমাদের চিনা খাবার খাওয়াবেন। নিলয় অনেক কষ্টে সাহস করে বলল, বিয়েবাড়িতে আরেকটু পেট ভরে খেলেই তো আর…
–বেলচাটা দেখেছিলে ভালো করে? ঝন্টুমামার প্রশ্ন তাকে থামিয়ে দিল।
–বেলচা?
–হ্যাঁ হ্যাঁ, বেলচা। ওই যে ময়লা তুলতে এসেছিল। দেখোনি? অমন বেলচা দেখেছ কোনও দিন? বিদেশি মাল। মাথাটা একটু খাটাও–মাথাটা একটু খাটাও–কলকাতা শহরে ময়লারা যেখানে সপ্তাহের পর সপ্তাহ পড়েই থাকে, হঠাৎ এরকম কুইক সার্ভিস অদ্ভুত লাগছে না।
–অদ্ভুত মানে–ভাবাই যায় না। কিন্তু ভাবা যাক আর না-যাক–বোঝা গেল, এখন আর ঝন্টুমামার মুখ খোলানো যাবে না।
ওয়ালডুর্ফের ঠান্ডা নরম আলোয় সিট দখল করে অর্ডার দিলেন ঝন্টুমামা, দু-প্লেট মিক্সড ফ্রায়েড রাইস, এক প্লেট চিলি চিকেন। বেয়ারা চলে যাচ্ছিল, ঝন্টুমামা তাকে ডেকে একটা টাকা বাড়িয়ে ধরলেন।
–এই নাও টিপস।–বলার পর তবে সে হাত বাড়াল।
খাবার আনল না, বিল দিল না, তার আগেই টিপস!
আমাদের মনের কথাটা বুঝতে এতটুকু অসুবিধে হয়নি ঝন্টুমামার, টিপস কথাটার মানে বোঝো? টি-আই-পি-এস-টু ইনশিয়োর প্রম্পট সার্ভিস। খাবার পর বকশিশ দেওয়াটাকে আমি নীতিগতভাবে বরদাস্ত করতে পারি না।
খাবার এল। মিষ্টি গন্ধওয়ালা ধোঁয়া ছাড়ছে। কিন্তু আবার ঝন্টুমামার সেই নিষ্ঠুর রহস্যময় আচরণ। তিনি আমাদের খাওয়াতে এনেছেন না খাবার ফেলাতে এনেছেন, বোঝা গেল না। বড়জোর সিকি ভাগ না শেষ হতেই তিনি আমাদের টেনে উঠিয়ে নিয়ে গেলেন।
আটটা থেকে এগারোটার মধ্যে ওয়ালডুফ থেকে পেপিং, পেপিং থেক চিংউয়া–চার চারটে রেস্তরাঁয় ও তার আগে একটা বিয়েবাড়িতে খেয়ে খিদে পেটে নিয়ে ফিরে এলাম বাড়িতে।
আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে বোধহয় দয়া হল ঝন্টুমামার। কিছু ভেবো না, পরশু দিন আসব, তখনই পুরো ব্যাপারটা জানতে পারবে। আসলে ইফরো-র সম্বন্ধে আমি একটা তদন্তের ভার নিয়েছি। তোমরা তো জানোই যে, গায়ে পড়ে দয়াদাক্ষিণ্য দেখানোর ব্যাপারটাকে সাধারণভাবে আমি কখনওই সোজা চোখে দেখি না। আচ্ছা, দেখা হবে…
ঝন্টুমামা চলে গেলেন।
ইফরো মানে ইন্টারন্যাশনাল ফুড রিলিফ অর্গানাইজেশন। দুঃস্থ নিঃস্ব মানুষদের তারা দু-বেলা বিনি পয়সায় অন্নদানের ব্যবস্থা করেছে। শুধু শহর কলকাতা নয়, শহরতলিতেও লক্ষ লক্ষ মানুষ এখন দু-বেলা বিলিতি খিচুড়ির আশায় আশায় থাকে। ছোট ছোট ভ্যানে করে সাহেবরা আসে। গাড়ির গায়ে উনুনের ওপর চড়ানো একটা হাঁড়ির ছবি আঁকা। ভাপ উঠছে। লোকে লাইন দিয়ে দাঁড়ায়। প্রত্যেকে বড় বড় দু-হাতা খিচুড়ি পায়। খিচুড়ির রংটা একটু কালচে ধরনের। কিন্তু সুন্দর স্বাদ৷ সাধারণত ত্রাণশিবিরে খিচুড়ির নামে যে হলদে ঝোলের মতো জিনিসটা দেওয়া হয়, তার সঙ্গে কোনও তুলনাই চলে না। এই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের নিঃস্বার্থ সেবাকার্য দারুণ সাড়া ফেলেছিল। কত মানুষ যে স্বেচ্ছায় তার আজীবন সদস্য হয়েছে, ডোনেশন দিয়েছে–তার ইয়ত্তা নেই, কিন্তু কিছু দিন আগে হঠাৎ একদিন যেন বোমা ফাটিয়ে দিল দৈনিক সত্যবার্তা। প্রথম পাতায় তাদের রিপোর্ট বেরোল–ইফতরা কি ডাস্টবিন থেকে পরিত্যক্ত খাদ্য সংগ্রহ করে বিলিতি খিচুড়ি বানাচ্ছে? সঙ্গে সঙ্গে মানহানির মকদ্দমা। শেষ পর্যন্ত ক্ষমা চাইতে হয়েছে সত্যবার্তার সম্পাদককে। কিন্তু তবু কোথায় যেন একটা খুঁত রয়েই গেছে। সত্যবার্তায় প্রকাশিত খবরটি সরবরাহ করেছিল রতনলাল নামে কর্পোরেশনের একজন ঝাড়দার। মানহানির মামলা কোর্টে ওঠার পরের দিনই রতনলালের মৃতদেহ ভেসে উঠেছিল ঢাকুরিয়া লেকে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট জলে ডুবে মৃত্যু। কিন্তু কীরকম মৃত্যু-হত্যা, না আত্মহত্যা? কোনও হদিশ মেলেনি।
এ অবধি সবটাই জানা কথা। কিন্তু আজকে এরকম রাজা-উজিরের মতো নানা জায়গায় ঘুরে খাওয়ার নামে একটু-আধটু চেখে দামি খাদ্য অপচয় করার মানেটা কী? তার থেকে সমস্যাটার কি সুরাহা হবে?
.
পরশু দিন আসবেন বলে কথা দিয়ে গেলেন তাঁরা। তার আগেই জানতে পারলাম। শুধু আমরা নয়, সারা কলকাতা জেনেছে।
সন্ধেবেলা টেলিগ্রাম টেলিগ্রাম হাঁক শুনে কাগজটা কিনেই চক্ষুস্থির।
ছত্রিশ পয়েন্টের বিরাট বিরাট হরফে হেডলাইন: ক্ষুধার্ত মানুষকে নিয়ে চক্রান্ত।
নিলয়ও হুমড়ি খেয়ে পড়ল—
ইফরো-র কর্তাব্যক্তিরা নিরুদ্দেশ। সমস্ত বিমানবন্দর সতর্কিত। আজ মেডিক্যাল কলেজ ও সায়েন্স কলেজের অধ্যাপক ও গবেষকরা এক সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে যৌথ বিবৃতি মারফত জানিয়েছেন, ইফরো যে ডাস্টবিন ও বিভিন্ন হোটেল-রেস্তরাঁর পরিত্যক্ত আবর্জনা থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে তাদের বিলিতি খিচুড়ি বানাত, তার মোক্ষম প্রমাণ এখন তাঁরা দাখিল করতে পারেন। স্পেকট্রোস্কোপ যন্ত্রের সাহায্যে এক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় এক ভয়াবহ অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। গতকাল আলোগ্রাফার ঝন্টু সেন বিভিন্ন রেস্তরাঁয় খাবার ভান করে পরিত্যক্ত খাদ্যের সঙ্গে সামান্য পরিমাণ লিথিয়াম ক্লোরাইড মিশিয়ে দিয়ে আসেন। এই রাসায়নিক বস্তুটির স্বাদ সাধারণ নুনের মতো, খাদ্যের সঙ্গে সামান্য পরিমাণ গ্রহণ করলেও মানুষের কোনও ক্ষতি হবে না। তারপর আজ পুলিশ প্রহরায় ইফরো বিতরিত খিচুড়ির নমুনা সংগ্রহ করা হয় বিভিন্ন স্থান থেকে। সেই নমুনার বর্ণালি বিশ্লেষণে লাল রঙের বিশেষ অবস্থান জানিয়ে দেয়, এর মধ্যে লিথিয়াম ক্লোরাইড রয়েছে। কোত্থেকে এল লিথিয়াম ক্লোরাইড, এমনিতে কোনওভাবেই খাদ্যবস্তুর মধ্যে এটি তো থাকে না! এর থেকেই গবেষকরা নিঃসন্দেহ হয়েছেন, গত রাত্রে ঝন্টু সেন যে লিথিয়াম ক্লোরাইড মিশিয়ে দিয়েছিলেন, তারই রেশ মিলেছে আজকের খিচুড়িতে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, লিথিয়াম ক্লোরাইডকে ট্রেসার বলা হয়, কেননা এটি যেখানে যত সামান্য পরিমাণেই থাকুক, গবেষণাগারে তার হদিশ (ট্রেস) খুঁজে পাওয়া যাবেই। অভিনব বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই চরম অমানবিক কার্যকলাপের কথা জনসাধারণকে জানানোর জন্য শ্রীঝন্টু সেনকে। আমরা আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি।
দেখলি, দেখলি কাণ্ডটা! আমাদের কোনও নামগন্ধ নেই। অথচ, ওই স্পেকট্রোস্কোপের ব্যাপারটা এই সে দিন আমাদের কাছ থেকেই শুনেছেন ঝন্টুমামা। কোনও মানে হয়!
-সত্যিই কোনও মানে হয় না। ঠিক, ঠিকই বলেছ।
ঝন্টুমামার উত্তেজিত কণ্ঠ আমাদের চমকে দিল। এমন নিঃশব্দে চলাফেরা করেন।
–পড়লে, টেলিগ্রামটা পড়লে তো! দেখলে কারবার!
আমাদের নাম বাদ দেওয়ায় ঝন্টুমামা এতটা মর্মাহত হবেন বুঝতে পারিনি। নিলয় বললে, যাক গে, কী আর হবে।
–কী আবার হবে?
ঝন্টুমামা এবার ফেটে পড়লেন, আসল কথাটাই তো লেখেনি। কেন, কেন ইফরো এই কাণ্ড করছিল, সেটাই তো সবার আগে জানানো উচিত ছিল। ঠিক সেই জায়গাটাই চেপে গেছে। তার মানে বুঝতে পারছ?
আমরা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছি।
ইফরো কলকাতা থেকে পাততাড়ি গুটোল বটে, কিন্তু তা বলে যে তারা থামল তা নয়। এবার আবার অন্য নামে অন্য কোনও অনুন্নত দেশে আবার অন্নদাতা হয়ে দেখা দেবে তারা। আবার সেখানে ধরা পড়লে আরও দুরে সরে যাবে। এইভাবেই তারা একদিন তাদের গবেষণার কাজও ঠিক শেষ করে ফেলবে।
–কিন্তু গবেষণাটা কী নিয়ে?
পরিত্যক্ত বাতিল জিনিস পুনর্ব্যবহার করে খাদ্য উৎপাদন। রিসাইক্লিং। খাদ্যসমস্যা সমাধানের জন্য বৃহৎ শক্তিরা এই গবেষণা চালাচ্ছে। কিন্তু পরীক্ষা করবে কাদের ওপর? নিজেদের দেশে তো সম্ভব নয়, তাই আমাদের মতো দেশে এসে মানুষকে গিনিপিগ বানাচ্ছে। আমরা আর কতটুকু জানতে পারি। শুধু খাদ্য নয়, ওষুধ নিয়েও এরকম কারবার কম হচ্ছে না।
[গল্পের চকমকি, ১৯৮৩]