উপন্যাস
গল্প

জ্যাকি, মিকি ও একটা অপদার্থ

জ্যাকি, মিকি ও একটা অপদার্থ

রাজর্ষি ফ্ল্যাটের দরজায় চাবি ঘোরাতেই ভেতর থেকে জ্যাকি তাকে সশব্দে অভ্যর্থনা জানাল। ডান হাতের ওপর দিয়ে ব্যাগের একটা ফিতে ছাড়িয়ে নিয়ে রাজর্ষি শরীরে একটা ঝাঁকানি দিল। পিঠ থেকে স্কুলের ব্যাগটা ছিটকে পড়ল মেঝেয়। চমকে দু-পা পিছিয়ে গেল জ্যাকি। আর-একটু হলেই ওর মাথার ওপরে খসে পড়ত।

সোফায় বসে রাজর্ষি জুতোর ফিতে খুলতে শুরু করে। পাশে বসে জ্যাকি অল্প অল্প। ল্যাজ নাড়াচ্ছে। মুখ উঁচু করে তাকিয়ে আছে। দু-পাটি জুতো ঘরের দু-কোণে ছুঁড়ে দিল। জ্যাকি ছুটেছে। একে একে জুতো, মোজা সব দরজার পাশে জুতোর র‍্যাকে পৌঁছে দিয়েছে। জ্যাকি৷ পিসি-র সুইচটা টিপতেই ভিডিয়ো স্ক্রিনে মায়ের মুখ, রাজর্ষি, ফ্রিজে হ্যামবার্গার রেখেছি। আগে খেয়ে নিয়ো।

ধ্যাত৷ রাজর্ষি মোটরকার রেসিং-এর খেলাটা বেছে নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিতে শুরু করে কম্পিউটারকে।

উফ। জোর কামড় লাগিয়েছে জ্যাকি। থাপ্পড় দেওয়ার জন্য হাতটা উঁচু করতেই জ্যাকি প্রতিবাদ জানাল, ঘউ!

ইশ, আবার আমাকে ধমক।

জ্যাকি বেজায় বিরক্ত করছে। কিছুতেই খেলতে দেবে না। ফ্রিজ খুলে নিজের ভাগ থেকে কিছুটা জ্যাকিকে খাইয়ে দিল। এইটাই যদি বক্তব্য হয়… এবার পা ধরে ঝুলে পড়েছে জ্যাকি৷ রীতিমতো টানাটানি। রাজর্ষিকেও খেতে বসতে হবে।

রাজর্ষি নিচু হয়ে ওর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতেই জ্যাকির গলার তলায় সুইচটা টিপে দিল। ইলেকট্রনিক কুকুর সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়েছে।

মাটির সঙ্গে পেট-ঠেকানো বিশাল আকারের চ্যাপটা রেসিং গাড়ির চালকের আসনে বসেছে রাজর্ষি। তার ডান হাতে স্টিয়ারিং লিভার, বাঁ হাতে গতি বাড়ানো-কমানোর অ্যাকসিলারেটর। পায়ে ব্রেক। রাজর্ষির লাল-কালো সতেরো নম্বরের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে আরও চারটে গাড়ি। রাজর্ষির শরীর টানটান। ঝুঁকে বসেছে। গুলি ছোঁড়ার ঝলসানি আর শব্দের সংকেত পাওয়ামাত্র যেন মুহূর্তের দেরি না হয়।

অ্যাকসিলারেটর ঠেলে দিয়েই রাজর্ষি বুঝল আজ লাক খারাপ। তিন আর তেইশ নম্বর বেটার স্টার্ট নিয়েছে। এখন অনেক বেশি ঝুঁকি নিতে হবে। দৌড়ের প্রথম পর্বটা শুধু গতি আর গতি। কে কত জোরে ছোটাতে পারে। কিন্তু তার মানে শুধু অ্যাকসিলারেটর চেপে ধরা নয়। ভিডিয়ো পর্দার নির্দেশ মানতে হবে। স্পিডোমিটারের কাঁটা লক্ষ করে গিয়ার চেঞ্জ করে তবে ধাপে ধাপে বাড়বে গতি। না হলে হয়তো প্রথম গিয়ারে সবাইকে টেক্কা দিয়েও দেরিতে গিয়ার চেঞ্জের সময়ে সুযোগ হারাবে। তিনটে গাড়ি পাশাপাশি চলে এসেছে। প্রায় গায়ে গা ঠেকিয়ে ছুটছে। প্রায় ঠেকিয়ে, কিন্তু সত্যি ঠেকে গেলে… দু-জনের মাঝখানে পড়ে গেছে রাজর্ষি। একজনও যদি একটু চেপে দেয়, বাঁ বা ডান পারে, সেই ভয়ে ওভারটেক করাটা ঠিক এই মুহূর্তে উচিত নয়।

রাস্তার সামনেই লাল ফলকের নির্দেশ চিহ্ন একটা ওলটানো ইউ। হেয়ারপিন কার্ভ। ডানদিকে বাঁক নিয়েছে রাস্তা। ঠোঁটে ঠোঁট টিপে ধরে রাজর্ষি। এখনও ব্রেকে চাপ দেয়নি। অন্য দুটো গাড়ি স্পিড কমিয়ে দিয়েছে। দমকা চাপে দু-দফায় ব্রেক কষেই স্টিয়ারিং-এ মোচড় দিল। ভিডিয়ো স্ক্রিনের সামনে টুলের ওপরে রাজর্ষির শরীরটা ডানদিকে কাত হয়ে গেছে।

গ্রেট! গ্রেট! চেঁচিয়ে উঠল রাজর্ষি। তার সতেরো নম্বর টার্বো-স্পিডস্টার এই প্রথম বাঁদিকের দু-চাকা শূন্যে তুলে মোটর সাইকেলের মতো কাত হয়ে টার্ন নিয়েছে। এতটা উত্তেজিত না হলে নিশ্চয় দুর্ঘটনাটা এড়াতে পারত রেসিং কারের ওস্তাদ ড্রাইভার। সোজা রাস্তায় পড়ার পরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে স্কিড করে তিনবার ডিগবাজি খেয়ে শেষ অবধি থামল যখন, তখনই ধোঁয়া বেরোচ্ছে। বিপকালীন নিষ্ক্রমণব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে গাড়ির সিট থেকে লাফিয়ে নেমে ছুট লাগাল রাজর্ষি। তার পরেই একটা আলোর ঝলক। রাজর্ষি মাঠের মধ্যে ডাইভ দিল। প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। মাটির ওপর থেকে মুখ তুলে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, সতেরো নম্বর টুকরো টুকরো হয়ে জ্বলছে। গ্যাসোলিন ট্যাংক ফেটে আগুন লেগে গেছে।

ভিডিয়ো স্ক্রিন রাজর্ষিকে অভিনন্দন জানাল। বীরের সম্মান এবং উপস্থিতবুদ্ধির প্রশংসা। দৌড় থেকে এবারের মতো বাদ পড়লেও গ্রাঁ প্রি প্রতিযোগিতায় আবার নামার সুযোগ পাবে।

রাজর্ষির হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে। না, এই রেসে হেরে যাওয়াটা কোনও ব্যাপারই নয়। এই নিয়ে কতবার চ্যালেঞ্জ হয়েছে বাবার সঙ্গে। বাবাকে বললেও কি বিশ্বাস করবেন?

ওয়্যারলেস টেলিফোনটা তুলে বাবার অফিসের নম্বর চাইল।

হ্যালো, মিস্টার রায়? আমি রাজর্ষি। প্লিজ, রাগ কোরো না। এক মিনিট। কী হয়েছে জানো!

পাঁচ মিনিট ধরে পুরো বিবরণ দেওয়ার পরে রাজর্ষির সন্দেহ হল। বাবা শুনছেন তো?

ঋষু! বাবার গলা শুনে রাজর্ষি নিশ্চিন্ত। আমার আজ একটা মিটিং আছে, কিন্তু খুব দেরি করব না। আর যতই দেরি হোক, আমরা দু-জনে ওটা আর-একবার ট্রাই করব। তুমি কিন্তু মনে রাখার চেষ্টা কোরো, ঠিক কত স্পিডে ব্রেক কষে কীভাবে টানটা নিয়েছিলে। ও.কে.?

ও.কে.!

আর-একটা কথা। খেয়েছ তো?

এক্ষুনি হয়ে যাবে সেটা।

ওয়ার্ড অব অনার তো? বেশ। ওই আজ সকালে বলব-বলব করেও ভুলে গেছি। তোর বন্ধু ফোন করেছিল। মৌ। ওর মিকিটা নাকি হাঁটতে পারছে না। ওকে একটু হেল্প করবি?

ভেবে দেখি। বাই!

 ফ্রিজ খুলে অ্যালুমিনিয়ামের কাগজ-মোড়া হ্যামবার্গার বার করে নিল রাজর্ষি। একটা কামড় দিয়েই বুঝে নিয়েছে। এটা মায়ের কেরামতি নয়। পুরো উইম্পির টেস্ট। প্লেটে সস ঢেলে নিয়েছে রাজর্ষি।

হ্যামবার্গারের শেষ ফালিটা দাঁতে কামড়ে ধরতেই দুটো হাত স্বাধীন। রিসিভার তুলে মৌয়ের নম্বর চাইল।

একবার তো বললাম, আমার নাম রাজর্ষি। মৌ-কে চাই। সেটা যদি অসম্পূর্ণ তথ্য হয়, লাইনটা স্বচ্ছন্দে ডিসকানেক্ট… কথাটা শেষ করার আগে আর-একটা কামড় বসিয়ে নিল রাজর্ষি, হ্যাঁ, রিসিভার নামিয়ে রাখতে পারেন।

মৌয়ের বাবা সুপারকনডাক্টর কর্পোরেশনের এমডি হতে পারেন। কিন্তু রাজর্ষি তো তাঁর কর্মচারী নয়।

হ্যালো, ও, ও, রাজর্ষি তুই! ভেবেছিলাম, ভুলেই মেরে দিয়েছিস। কখন আসছিস বল?

আমাকে আসতে হবে এমন কথা তো শুনিনি। প্রয়োজন তোমার। দরকার মনে হলে চলে এসো। পাঁচটা অবধি আছি।

কিন্তু, মা যে বাড়িতে নেই। আগে থেকে বলেও রাখিনি। বকুনি খেতে হবে।

তাহলে এসো না। তোমার হোভারক্রাফট আছে। আমাকে যেতে হবে টিউবে। তিন ঘণ্টা। বেশি সময় নষ্ট হবে। তা ছাড়া জ্যাকিকে নিয়ে টিউবে ওঠারও অনেক ঝামেলা।

জ্যাকি!

নিশ্চয়। তোমার মিকিকে সারিয়ে দিয়ে তাহলে লাভটা কী? জ্যাকি আর মিকির মধ্যে ফাইট হবে। শোন মৌ, মিকিকে পকেটে ভরে এক্ষুনি চলে আয়। পাঁচটার পর কিন্তু আমায় পাচ্ছিস না। ফোন নামিয়ে রাখল রাজর্ষি।

রাজর্ষি জানত, মৌ আসবে। মিকিকে সারাতে হলে না এসে উপায় কী? নিউ ইয়র্ক বা টোকিয়োয় পাঠিয়ে ওকে সারিয়ে আনার তুলনায় রাজর্ষির সাহায্য নেওয়া সব দিক থেকেই বুদ্ধিমানের কাজ।

দরজা খুলে রাজর্ষি বলল, দারুণ ফাইট হবে আজকে। বুঝলি!

মৌ কোনও উত্তর না দিয়ে ঘরে ঢুকেই দরজাটা বন্ধ করে দিল, আচ্ছা তো মিকিকে ঠিক কর, তবে না ফাইট।

লড়াইয়ের গন্ধ পেলে রাজর্ষির মাথা ঠিক থাকে না, সেই জন্যই কোনও ইঁদুর কেনার অনুমতি পায়নি বাবা বা মায়ের কাছে। একা জ্যাকিই যথেষ্ট। বাবা অতটা খেয়াল না করেই মিকিকে সারানোর কথাটা বলেছেন।

মিকির পেটের নীচে দু-আঙুলে ছোট্ট একটা চাপ। পাতলা ঢাকা খুলল। প্রিন্টেড সার্কিট বার করে নিল। পাশ থেকে ঝুঁকে পড়েছিল মৌ। রাজর্ষি বলল, উঁহু, এখন কিছু দেখতে দেব না। কোনও মেকানিকই এটা অ্যালাউ করতে পারে না।

ট্রেড সিক্রেট?

ঠাট্টা গায়ে মাখল না রাজর্ষি, ঠিক তা-ই।

মৌ উঠে গিয়ে নিজেই টিভি অন করে দিল।

মিনিট পাঁচেক খুব জোর খুটখাট করল রাজর্ষি। ততক্ষণে মিকির কথা ভুলে টিভিতে আটকে গেছে মৌ। মিকি নিঃশব্দে তার কোলে হঠাৎ লাফ মেরে উঠে পড়ল। প্রথমটা চমকে গিয়েছিল, তার পরেই শুরু হল আদর।

জ্যাকির ক্রুদ্ধ কণ্ঠের চাপা গরু- কানে আসতেই সিঁটিয়ে গেছে মৌ। মিকিকে দু-হাতে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে ভয়ে ভয়ে মুখ ফিরিয়ে তাকাল। জ্যাকির চোখ জ্বলজ্বল করছে, লাফ মারার জন্য তৈরি। রাজর্ষির হাত থেকে মুক্তি পেলেই…

প্লিজ রাজর্ষি। মিকি মরে যাবে। ও পারবে না জ্যাকির সঙ্গে।

কিচ্ছু হবে না। তুই মিথ্যে ভয় পাচ্ছিস।

 না, না—

 তাহলে তুই ব্লাফ দিয়েছিস বল! মিকির সঙ্গে ফাইট হবে বলে আমাকে দিয়ে সারিয়ে নিলি। না, এখন আমি কোনও কথা শুনব না। শিগগির নামিয়ে দে মিকিকে। কথা দিচ্ছি, জ্যাকি ওর কোনও ক্ষতি করবে না। শুধু একটু খেলা। তুই ভেবে দেখ, জ্যাকি আজ অবধি একটাও ইঁদুর শিকার করার সুযোগ পায়নি। না না, শিকার মানে কি সত্যি শিকার? শিকার-শিকার খেলা।

কোনও উপায় ছিল না। মিকিকে মেঝেতে নামিয়ে দিয়েই পেছন ফিরে মুখে হাত চাপা দিল মৌ। কিন্তু মৌয়ের এতটা ভয় পাওয়ার কোনও কারণ ছিল না। মিকি মোটেই অসহায় নয়। জ্যাকি যতই গর্জন ছাড়ক আর লম্ফঝম্প করুক, ক্ষিপ্রতায় মিকি কম যায় না। সেই সঙ্গে দুষ্ট বুদ্ধি। ইচ্ছে করলেই কিচেন র‍্যাকের মাথায় চড়তে পারত। জ্যাকির নাগালের বাইরে। কিন্তু সে-ও খেলা জুড়েছে। একা জ্যাকিই শুধু এত দিন খেলার সঙ্গী পায়নি তা নয়।

মিনিট পাঁচ-সাতের মধ্যে দুটো টেল ল্যাম্প, চারটে গ্লাস আর একটা ফুলদানি চুরমার। শেষ পর্যন্ত অ্যাকোয়ারিয়াম ভেঙে রঙিন ইলেকট্রনিক মাছগুলো মেঝের ওপর ছড়িয়ে পড়ল। জ্যাকি এত উত্তেজিত যে, রাজর্ষির প্রথম দুটো ধমক কানেই তোলেনি। জ্যাকিকে জড়িয়ে ধরে মেঝের ওপর বসে রাজর্ষি বলল, মৌ, শিগগির মাছগুলোকে তুলে ডাইনিং টেবিলের জাগের মধ্যে রেখে দে। বেশিক্ষণ হাওয়ায় থাকলে ওদের ব্যাটারিগুলো নষ্ট হয়ে যাবে।

মাছ উদ্ধার করতে করতে মৌ বলল, দেখ, আমার মিকি কিন্তু কোনও জিনিস ভাঙেনি। সব তোর জ্যাকির কাণ্ড। এই জন্যই তোকে মিকি কিনে দেয়নি।

যুদ্ধক্ষেত্রের ধ্বংসস্তূপের ওপর চোখ বুলিয়ে রাজর্ষি বলল, এই, ছাতে যাবি? ওখানে। এসব ঝামেলা নেই।

মিকির পারদর্শিতায় মৌয়ের ভয় কেটে গেছে। বেশ গর্ব বোধ করছে। মৌ আপত্তি করল না। চল্লিশতলা বাড়ি। প্রতিটি তলায় পঁচিশটা ফ্ল্যাট। একটা ঝকঝকে ডিশ অ্যান্টেনা পাপড়ি মেলে বসে আছে, কিন্তু বাতিল অ্যান্টেনার কাঠিগুলো আর সরানো হয়নি। অ্যান্টেনার ঘন জঙ্গলে খেলা জমে গেল। মিকি বেগতিক বুঝলেই চড়ে বসছে একটা-না একটা অ্যান্টেনার মাথায়। জ্যাকি আকাশে মুখ তুলে কয়েকবার আপত্তি জানাবার পর সে আচমকা লাফ মেরে নেমে পড়ে দৌড় লাগাচ্ছে।

ছাতের ওপর সূক্ষ্ম ধুলোর আবরণ। জ্যাকি আর মিকি পায়ে পায়ে বেজায় ধুলো ওড়াচ্ছে। শঙ্কিত বোধ করে রাজর্ষি। ইলেকট্রনিক কোনও জিনিসের পক্ষেই স্বাস্থ্যকর নয়।

জ্যাকি মিকিকে ছেড়ে ছুট লাগিয়েছে ছাতের ডান কোণে। রাজর্ষি আর মৌয়ের সঙ্গে মিকিও অবাক। জ্যাকি ছুট্টে গিয়ে হঠাৎ সামনের দু-পায়ে ব্রেক কষে দাঁড়িয়েছে। ছাতের কাছে নাক ঠেকিয়ে গরগর করছে। শিকার ধরার ভঙ্গি, কিন্তু যেন সাহসে পুরো কুলোচ্ছে। না। ঘেউ করে একবার ডাক দিয়েই এক পা পিছিয়ে এল। তারপরেই হঠাৎ ঝাঁপ দিল সামনে। মুখে করে কী একটা কামড়ে ধরেছে। রাজর্ষিকে ডাকতে হয়নি। জ্যাকি নিজেই অ্যাবাউট টার্ন করে ফিরে এল রাজর্ষির কাছে। পায়ের কাছে বসে ল্যাজ নাড়ছে।

রাজর্ষি নিচু হয়ে বসতেই জ্যাকি মুখ সরিয়ে নিতে চাইল। ধরা দেবে না। কিন্তু পারল না। রাজর্ষি জোর করে ওর মুখ ফাঁক করে টেনে নিল একটা….

লাভলি! কী সুন্দর রে! প্লিজ রাজর্ষি, একবার আমার হাতে দে। মৌ অনুরোধ করে। লম্বা লম্বা সরু পা-ওয়ালা গাঢ় সবুজ রঙের একটা পোকা ধরে এনেছে জ্যাকি। কাদের বাড়ির খেলনা কে জানে, ছাতে পালিয়ে এসেছে।

মৌয়ের হাতে সবুজ পোকাটাকে নামিয়ে দেওয়ামাত্র সেটা তিড়িং করে হাই জাম্প মারল। কিন্তু জ্যাকিকে ঠকাতে পারেনি। আবার ধরে ফেলেছে। এবং রাজর্ষির কাছেই নিয়ে এসেছে।

পোকাটাকে সন্তর্পণে হাতের মুঠোয় পুরে ফেলে রাজর্ষি। জ্যাকি আর মিকিকে নিয়ে ওরা ফিরে এসেছে রাজর্ষিদের ফ্ল্যাটে। জ্যাকি আর মিকি আবার খেলা জুড়তে চেয়েছিল। দু জনেই ধমক খেয়ে যে যার জায়গায় বসে পড়েছে। রাজর্ষি আর মৌ পোকাটাকে নিয়ে। ব্যস্ত। এরকম পতঙ্গ তারা কখনও চোখে দেখেনি। অনেক চেষ্টা করেও পোকাটার শরীরের কোন জায়গায় ট্যাবলেট ব্যাটারি ভরা আছে, খুঁজে পাচ্ছে না রাজর্ষি।

মৌ জিজ্ঞেস করে, তোর কাছে খেলনার ক্যাটালগ নেই?

রাজর্ষি তখনও হাল ছাড়েনি। পোকাটাকে নাড়াচাড়া করতে করতেই বলল, ওই তো, বইয়ের র‍্যাকে রয়েছে।

পঁচিশ হাজার ইলেকট্রনিক খেলনার সচিত্র ক্যাটালগ। বাগ, ইনসেক্ট ইত্যাদি নানা দিক থেকে আধ ঘণ্টা নাড়াচাড়া করেও সবুজ পোকাটার সন্ধান পেল না।

টেলিফোনে তলব এসেছে মৌয়ের বাড়ি থেকে। মিকিকে কোলে নিয়ে উঠে পড়ল মৌ। রাজর্ষি বলল, আমাকে পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে নামিয়ে দিবি? তোর তো গাড়ি আছে।

পোকাটাকে পকেটে ভরে নিল রাজর্ষি। ওটা আর এখন নড়াচড়া করছে না। লাফিয়ে পালাতে পারবে না। কলকাতার সবচেয়ে নামকরা খেলনার দোকান টয় সেন্টারের সামনে নেমে পড়ল রাজর্ষি। ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই মৌয়ের। মৌ-কে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গাড়ি যাবে বাবার অফিসে।

টয় সেন্টারের কাউন্টারের কাচের টেবিলে পোকাটা নামিয়ে রেখে রাজর্ষি বলল, ঠিক এইরকম কোনও বাগ বা ইনসেক্ট আছে আপনাদের কাছে?

সেলসম্যান নেড়েচেড়ে পরীক্ষা করে বলল, ঠিক এইরকম নয়, তবে এই আকারের বেশ কিছু মডেল আছে।

কোনওটাই পছন্দ হল না রাজর্ষির। সবুজ পোকাটার পাশে সব ক-টাই বেমানান রকমের মোটাসোটা গাঁট্টাগোট্টা।

রাজর্ষি পেছন ফিরতে সেলসম্যান জিজ্ঞেস করল, এটা কোত্থেকে কিনেছেন? নিশ্চয় ফরেন?

উত্তর দেয়নি রাজর্ষি। টয় সেন্টার তার কাছে অজানা দোকান নয়। মেরামতির কাজেও এদের যথেষ্ট সুনাম। রিপেয়ারিং কাউন্টারের সামনে এসে রাজর্ষি বলল, এটার ব্যাটারিটা বদলে দিতে হবে। নড়াচড়া পুরো বন্ধ হয়ে গেছে।

পোকাটা হাতে নিয়ে কাউন্টারের লোকটা ভেতরের ঘরে অদৃশ্য হয়ে গেল।

কয়েক মিনিট বাদেই লোকটি ফিরে এল, সরি! এটা নিশ্চয় কোনও ফরেন জিনিস। আমাদের পক্ষে এটার ব্যাটারি পালটানো সম্ভব নয়। তবে আপনি যদি এটার লিটারেচার দিতে পারেন, মানে কীভাবে ব্যাটারি পালটাতে হয়, তার নির্দেশ, তবে…।

কাউন্টারের পাশে এক বৃদ্ধ কর্মচারী নিবিষ্টমনে একটা প্রজাপতি সারাচ্ছিল। ঘাড় ফিরিয়ে সে বেশ ভারী গলায় বলল, জিনিসটা দেখি একবার!

সবুজ পোকাটা হাতে নিয়েই তার ভুরু কুঁচকে গেল। মুখ তুলে বলল, কে এনেছে। এটা?

রাজর্ষি বলল, আমি।

কোত্থেকে পেয়েছ জানতে পারি?

বাড়ির ছাতে। কুড়িয়ে পেয়েছি।

কলকাতায়? তুমি কলকাতায় থাকো?

 নিশ্চয়।

বৃদ্ধ কারিগর হাসতে শুরু করে। তারপর রাজর্ষির মুখের ভাব লক্ষ করে নিজেকে সামলে নেয়, না না, তোমার কোনও দোষ নেই। কলকাতায় যে এখনও কোনও জীবন্ত পোকামাকড় দেখা যায়, সেটা আমার কাছেও একটা নতুন আবিষ্কার। সত্যিই তুমি দারুণ এক কাণ্ড করেছ! আমরা ছেলেবেলায় এরকম গঙ্গাফড়িং এক-আধটা দেখেছি। এখনও ওরা টিকে আছে, ভাবতেও অবাক লাগছে।

রাজর্ষি কিছুক্ষণ কোনও কথা বলতে পারেনি। তারপরে গঙ্গাফড়িংকে হাতে নিয়ে বলল, তার মানে এটা ইলেকট্রনিক খেলনা নয়? ব্যাটারি পালটালেও বাঁচবে না?

সাদা চুল ঝাঁকিয়ে লোকটা বলল, জ্যান্ত গঙ্গাফড়িঙের কি ব্যাটারি লাগে? মরে গেলে ব্যাটারি পুরে তাকে জ্যান্ত করার সুযোগ কোথায়?

[আনন্দমেলা, পূজাবার্ষিকী ১৯৯২]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *