উপন্যাস
গল্প

০৫. চৌরঙ্গি থেকে লিন্ডসে স্ট্রিট

০৫.

চৌরঙ্গি থেকে লিন্ডসে স্ট্রিটে বাঁক নিতেই গোবিন্দ বলল, নিউ মার্কেট। আর সামনের ট্যাক্সিটার বাম্পারের ওপর নাক টুকেই বন্ধ হয়ে গেল লাল মারুতির ইঞ্জিন। সামনে হুমড়ি খেয়ে আর-একটু হলেই গোবিন্দ সিট থেকে পড়ে যেত। ট্যাক্সির ড্রাইভার নিজের ক্ষতি পরীক্ষা করে নিশ্চিন্ত হয়ে দিব্যেন্দুর জানলার পাশে এসে বলল, আপকা দোনো হেডলাইট অউর বাম্পার…। তারপর কথাটা শেষ না করেই দাড়ির ফাঁক দিয়ে হাসল, যার একটাই মানে।

কিন্তু ট্যাক্সি ড্রাইভারের কোনও কথাই কানে ঢোকেনি দিব্যেন্দুর। শুধু শুনছে, গোবিন্দ উত্তেজিত হয়ে বলে চলেছে, অ্যাক্সিডেন্ট! অ্যাক্সিডেন্ট!

নিঃশব্দে একবার গোবিন্দর দিকে তাকিয়ে তারপর চিন্তিত মুখে দরজা খুলে নেমে এল দিব্যেন্দু। আশপাশে কৌতূহল জমতে শুরু করেছে। কিন্তু দিব্যেন্দুর মুখের ভাবটা তাদের নিরাশ করল।

পয়সা, পয়সা! পয়সার গরম!

দেখুন, দিনদুপুরেই হয়তো…

 ছেঁড়া-ছেঁড়া কথার মধ্যেই দিব্যেন্দু দেখে নিয়েছে, রেডিয়েটরের ক্ষতি হয়নি। স্টার্ট দেয়। পার্ক করার জায়গা পাওয়ার জন্য বার দুয়েকের বেশি চক্কর দিতে হয়নি।

.

নিউ মার্কেটের তল্লাটে গোবিন্দ জীবনে কোনও দিন পা দেয়নি। দিব্যেন্দুর তা অজানা নয়। এটা নিউ মার্কেট, কী করে জানলি–প্রশ্নটা করতে গিয়েও নিজেকে সংযত করল। কালকের রাত তার জীবনের মোড় ফিরিয়ে দিয়েছে তা সে জানে। কিন্তু সে ঘটনার ইমপ্যাক্ট কতখানি, তার যদি এই পূর্বাভাস হয়…

গোবিন্দর হাত ধরে দিব্যেন্দু প্রথমে হানা দিল জামা-প্যান্টের দোকানে। একের পর এক দোকানে ঢুকেও কিছুই পছন্দ হয় না দিব্যেন্দুর। উলটে-পালটে দ্যাখে আর সরিয়ে রাখে। খানিক বাদে আগুনে পোড়া অঞ্চলটাকে ঘিরে গাঁথা দেওয়ালটার সামনে পৌঁছে তার হুঁশ হল, এরকম করলে আজ আর কিছুই মার্কেটিং হবে না। এবার সেকেন্ড রাউন্ডে আগের বারের বাতিল-করা জিনিস কিনেই দু-হাত বোঝাই হয়ে গেল। পুরো বাজারটাকেই পারলে উঠিয়ে নিয়ে যায়। ধনী বলে কারও দিকে বাঁকা চোখে দেখার মানে হয় না। টাকা তো দরকার। সমস্যা একটাই, সবাই ধনী নয়। কিন্তু তার জন্য যার আছে, তাকে নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে নিজের কিছু গোছানোর দিকে নজর দেওয়া উচিত।

হরিচাঁদ অ্যান্ড কাজিনের দোকানে ট্রায়ালের সময় শার্টটা খুলে সিন্থেটিক লাল স্ট্রাইপ দেওয়া গেঞ্জিটা পরেছিল, সেটা আর ছাড়েনি। তারপরে রাধেশ্যাম শার্টিং-এ একই কায়দায় প্যান্টটাও বদলে নিয়েছে।

জোড়পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে, এঁকেবেঁকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে থমকে দাঁড়াচ্ছে গোবিন্দ। কখনও ঘাড় ফিরিয়ে দেখে নিচ্ছে দূরত্ব, কখনও হঠাৎ পেছন ফিরে কোমরে হাত রেখে যেন কৈফিয়ত তলব করছে, তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারো না। দিব্যেন্দুর পেছনে ঝাঁকামুটে। দেখলে মনে হবে, গোবিন্দ যেন জ্ঞান হওয়া অবধি নিউ মার্কেটে যাতায়াত করছে।

বইয়ের দোকানের সারির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দিব্যেন্দুর মনে হল, গোবিন্দর জন্য কয়েকটা বই কেনা দরকার। বাড়িতে তো ছোটদের ওলটাবার মতো একটা বই বা ম্যাগাজিনও নেই।

দিব্যেন্দুর সঙ্গে গোবিন্দও ঢুকেছিল। কমিক বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছে। একটা চিলড্রেনস এনসাইক্লোপেডিয়া আর ওয়াইল্ডলাইফের ওপর তিনটে বই বেছে বিল করতে বলল। আনসভজ্ঞ মিস্ট্রিজ নামে অলৌকিক সব ঘটনার ঝলমলে ছবিওয়ালা বইটা হাতে তুলেও নামিয়ে রেখেছে। এই ধরনের বইপত্র গোবিন্দর হাতে পড়ার কী ফল হবে, সেটা আগে ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখা দরকার।

বেছে-রাখা বইগুলোর দু-চার পাতা উলটে-পালটে অবহেলাভারে সেগুলো দেখেই রেখে দিল গোবিন্দ।

এগুলো তুমি আমার জন্য নিচ্ছ?

হ্যাঁ।

 কী লাভ? আমি বাংলাই পড়তে পারি না, ইংরিজি তো…?

দোকানদার ক্যাশমেমো থেকে মুখ তুলে তাকায়। বিব্রত বোধ করে দিব্যেন্দু। একটু হেসে, গোবিন্দ যেন ঠাট্টা করে কথাগুলো বলছে এমনই একটা ভান করতে যাচ্ছিল দিব্যেন্দু৷ গোবিন্দ বলে উঠল, হোয়াট এ ফান!

দোকানদার গোবিন্দর গাল টিপে দিয়ে বলল, ভারী মজার ছেলে তো!

তাড়াতাড়ি দোকানের বিল মিটিয়ে বেরিয়ে এল দিব্যেন্দু৷ ওর নজর এড়ায়নি, গোবিন্দ নিজেও যেন কেমন ঘাবড়ে গেছে।

কাকু! দিব্যেন্দুর হাত চেপে ভুরু কুঁচকে বলল, সত্যি আমি ইংরিজি জানি না। কিন্তু কে যেন আমার কানে কানে মাঝে মাঝেই কথা বলছে। একদম স্পষ্ট।

ঠিক আছে। ঠিক আছে। তাতে ক্ষতি কী? তুমি যা বলছ, তা তো আর ভুলভাল নয়।

আশ্বাসে পুরো ভোলে না গোবিন্দ, কিন্তু এরকম হচ্ছে কী করে?

অত অবাক হওয়ার কিছু নেই। এরকম হয় কারও কারও। কী করে হয়, সেটা তো এক্ষুনি বুঝতে পারবে না। এখন শুধু জেনে রাখো, সবার এরকম ক্ষমতা থাকে না। যাদের থাকে, তারা…

কথাটাকে ঘুরিয়ে দেয় দিব্যেন্দু, যাদের থাকে, তারা চেষ্টা করলে অনেক কিছু করতে পারে। অনেক বড় হতে পারে।

আমি মায়ের জন্য একটা বিরাট বাড়ি তৈরি করব।

নিশ্চয় করবে। আর যত দিন না বাড়ি তৈরি হচ্ছে, মা না-হয় কলকাতাতেই আমাদের ওখানে থাকবেন।

তা হবে না। তুমি ভেবেছ, মা বোদরা ছেড়ে আসবে? তাহলেই হয়েছে।

 স্টেশনারি শপে ঢুকল দিব্যেন্দু৷ সাবান, সোপকেস, টুথব্রাশ, পেস্ট ইত্যাদি৷ পাশ থেকে গোবিন্দ টুথব্রাশটা টেনে দেখছিল। এটার ওপর তার অনেক দিনের লোভ। কিন্তু দিব্যেন্দু ব্রাশটা চেয়ে নিয়ে দোকানদারকে বলল, ব্রাশ আর পেস্টটা নেব না। টুথ-পাউডার দিন।

গোবিন্দ দিব্যেন্দুকে হাত টেনে গলা নামিয়ে বলে, ওইটা নাও-না কাকু! আমার…

 দিব্যেন্দু দু-বার চোখ টিপে ঘাড় নেড়ে ওকে বায়না করতে বারণ করে। তবু শুনতে চায় না।

দিব্যেন্দুর মন গলে না। কদিন আগেই একটা মেডিক্যাল জার্নালে দেখেছে ব্রাশ করাটা দাঁতের স্বাস্থ্যের পক্ষে মোটেই ভালো নয়। বিশেষ করে বাচ্চাদের বেলায়। একসঙ্গে তিনটে টুথ-পাউডার নিয়ে নিল। বাড়িতে ব্রাশের পাটই তুলে দেবে।

গোবিন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে কষ্ট হল। কোনও কিছুতে না শুনে জেদ ধরার প্রথম লক্ষণ।

একটা মাস্ক অয়েল স্প্রে কিনে দেওয়ার পর বারবার টিপে টিপে ফোঁস ফোঁস শব্দে প্রায় তখনই দোকানের মধ্যেই সেটা অর্ধেক খালি করে তবে ব্রাশের দুঃখ ভুলল গোবিন্দ।

বিল মিটিয়ে বেরোবার পথে শোকেসে মরক্কোয় বাঁধানো একটা ডায়েরির সৌন্দর্য দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সঙ্গে সঙ্গেই মনে হল, ডায়েরি লেখার অভ্যাসটা তৈরি করার সময়। বোধহয় এত দিনে তার জীবনে এসেছে। ডায়েরিটা কিনে নিল।

ইতিমধ্যেই দশ মিনিট লেট। রুমা এতক্ষণে আদার রুম-এ পৌঁছে গেছে। কথা ছিল, গোবিন্দকে নিয়ে দিব্যেন্দু সোজা ওখানে চলে যাবে।

.

০৬.

আরও পশ রেস্তরাঁ ইচ্ছে করেই অ্যাভয়েড করেছিল দিব্যেন্দু। মনে হচ্ছে, তা না করলেও পারত। গোবিন্দ যেভাবে নিজেকে অ্যাডজাস্ট করে নিচ্ছে, এই গল্প অন্য কেউ করলে বিশ্বাস করতেও কষ্ট হত।

দোতলায় উঠে দরজা ঠেলতেই বাঁদিকের টেবিল থেকে রুমা হাত উঁচু করল। গোবিন্দর হাত ধরে দিব্যেন্দু ঢুকে এল। ফ্রেশ লাইমের গ্লাসটা নামিয়ে রেখে তাড়াতাড়ি একপাশে সরে গিয়ে রুমা বলল, বোসো এখানে।

দিব্যেন্দু লক্ষ করল, গোবিন্দ ইতস্তত করছে। কাকার কাছে আবদারের জায়গাটা পাকা হয়েছে, কিন্তু তা বলে…।

রুমাও ব্যাপারটা আন্দাজ করে। মিকি মাউসের ছবিওয়ালা গিফট প্যাকটা সোফা থেকে তুলে বলল, না বসলে এটা দেখবি কী করে? কত খুঁজে তোর জন্যে কিনে এনেছি।

আর বলতে হল না। গোবিন্দ হাত বাড়িয়ে দিল। রুমা ওকে টেনে পাশে বসাতে চাইল, আপত্তি করল না। বাক্সটাকে উলটে-পালটে কোন দিক থেকে খুলবে, পরীক্ষা করছে। রুমা বলল, আই অ্যাম সারপ্রাইজড। হি ডাজ নট লুক গ্রিডি।

দিব্যেন্দু সবজান্তার মতো ঠোঁটে হাসি টিপে ঘাড় নাড়ে। এতেই যদি অবাক হয় রুমা, এরপর কী করবে?

কাকিমা, খুলব কী করে?

গোবিন্দ স্টিফ নয় বলে সেন্টিমেন্টাল বিড়ম্বনার অনেক পর্ব সহজেই ওরা পার হয়ে যাচ্ছে।

দাও এদিকে, দেখিয়ে দিচ্ছি।

রুমা প্যাকেটটা নিয়ে ওর পিঠে একবার হাত বুলিয়েই বলে ওঠে, ইশ, ঘামে যে একেবারে ভিজে। এই গরমে কোথায় ঘুরছিলে দু-জনে?

নিউ মার্কেট। গোবিন্দই জানায়। তারপর প্রশ্ন করে, এটাতে কী আছে?

 রুমাকে বাধা দিয়ে দিব্যেন্দু বলে, তুমিই বলো-না।

বলব?

দিব্যেন্দুর দিকে তাকায়। বলো, বলল। এনকারেজ করে দিব্যেন্দু৷

আচ্ছা, ও কী করে জানবে…

রুমা কথা শেষ করার আগেই গোবিন্দ বলে, স্পোর্টস কার? মোটরগাড়ি?

 সে কী রে! জানলি কী করে! তুমি নিশ্চয় আগে বলে দিয়েছ?

আমি? দিব্যেন্দু হাসে, আমি কী করে বলব? তুমি কী কিনবে, আমায় বলেছিলে কি?

তা-ও তো বটে।

 গোবিন্দ বলে, ওরকম আমি বলতে পারি। এর আগেও বলেছি। নিউ মার্কেট, অ্যাক্সিডেন্ট, নতুন নতুন কথা।

রুমা কী বলতে যাচ্ছিল, দিব্যেন্দু ইঙ্গিতে বারণ করে। প্যাকেট খুলে গাড়িটা বার করে তার চালচলন বুঝিয়ে দেয়। রিমোট কন্ট্রোলের সুইচ হাতে গোবিন্দ তার স্পোর্টস কার নিয়ে মেতে ওঠে। দুপুরে রেস্তরাঁ প্রায় ফাঁকা, তাই আরও সুবিধা।

সংক্ষেপে গোবিন্দর অবিশ্বাস্য ক্ষমতার বর্ণনা দেয় দিব্যেন্দু৷ কীভাবে তার আচমকা এক-একটা কথা তাকে অবাক করে দিয়েছে। গাড়ির অ্যাক্সিডেন্টের ঘটনাও বলে। ওর মুখে নিউ মার্কেট শুনে চমকে গিয়ে ব্রেকের বদলে অ্যাক্সিলারেটারটা টিপে ধরেছিল। দিব্যেন্দু সতর্ক করে দিয়ে জানায়, গোবিন্দ নিজে প্রথমটা কিছুই খেয়াল করেনি। কিন্তু আমাকে অবাক হতে দেখেই বোধহয় এখন একটু সচেতন হয়েছে। কী করে এসব ঘটছে, বোঝার চেষ্টাও করছে। আমার মনে হয়, ওর সামনে আমাদের সামলে চলা দরকার। অবাক হলেও সেটা প্রকাশ করা ঠিক হবে না। নিজের ক্ষমতা সম্বন্ধে এই বয়সেই খুব বেশি কনশাসনেস…

আমি আজ দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিতে যাব। চলো-না প্লিজ, তোমরাও…

বিরক্ত বোধ করে দিব্যেন্দু। বিএ, এমএ পাশ করে যে কোনও লাভ হয় না, এই তার আর-এক প্রমাণ। মুখে বলে, দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে পুজো দিলেই পাপ ধুয়ে যায় না। না বুঝে যদি কেউ ভুল কিছু করে, তবে বোঝার পর সেটা শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করাটাই আসল কর্তব্য। আর-একটা কথাও বলি তোমায়, এত দিন তো কই গোবিন্দর মধ্যে এমন কোনও ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়নি, হঠাৎ ভগবানের…

ভর হয়েছে, ভর! বুঝতে পারছ না?

না, পারছি না। এবং বুঝতে চাইছিও না। কারণ আমি নিজে পুরো ঘটনার সাক্ষী। কয়েকটা দিন যাক, প্রমাণও পাবে। পৃথিবীর বাইরে বুদ্ধিমান প্রাণী থাকতে পারে–এ কথা বিজ্ঞানীরাও অস্বীকার করেননি কোনও দিন। কিন্তু কোনও প্রমাণ মেলেনি, তাদের সঙ্গে সংযোগও ঘটেনি। উলটে দু-চারটে ধাপ্পাবাজের জাল, ছবি-টবির দৌলতে ইউএফও, অর্থাৎ আনআইডেন্টিফায়েড ফ্লায়িং অবজেক্ট কি উড়ন্ত চাকি বা ফ্লায়িং সসার এখন ঠাট্টা ইয়ারকির ব্যাপার।

তুমি যতই তোমার গ্রহান্তরের থিয়োরি দাও, ই.টি. আমি মানতে রাজি নই।

 ঠিক আছে, মেনো না। কিন্তু তোমার বিশ্বাসটা তা বলে জোর করে গোবিন্দর ওপর চাপিয়ে দিয়ো না। তাতে ওর ক্ষতি হবে। আমরা তো জানি না, এই ক্ষমতার সত্যিকার পরিচয়, ভবিষ্যতে তার ফল কী হবে!

আমার বেলায় ওটা হল চাপিয়ে দেওয়া। আর তোমার এই আজগুবি সবুজ আলোটা চাপানো নয়? তুমিই বা কেন তোমার থিয়োরি ওর মাথায় ঢোকাবে?

ঢোকাব না বললেও কি ও কিছু বুঝতে পারবে? আগে বোঝার বয়স হোক, তখন ও নিজেই জানতে পারবে। তবে কালকের ঘটনার সাক্ষী তো আমি একা নই, গোবিন্দও সবই দেখেছে। ওর কী ইম্প্রেশন, আদৌ কিছু মনে আছে কি না জানি না। আমি ইচ্ছে করেই জিজ্ঞেস করিনি। থিয়োরি চাপিয়ে দিতে চাই না বলেই প্রশ্ন করিনি। নিজের অদ্ভুত ক্ষমতার পরিচয় ও এখনই পেতে শুরু করেছে। কিন্তু নিজে যখন এই প্রসঙ্গ তোলেনি, এই ক্ষমতা আর গত রাতের ঘটনার মধ্যে কোনও রিলেশনের ইঙ্গিত দেওয়াটা ঠিক নয়।

আচ্ছা, ও তোমায় কিছু জিজ্ঞেস করেনি? আর কিছু না হোক, আমাদের বিহেভিয়ারের এই সাংঘাতিক পরিবর্তন দেখে আশ্চর্য হওয়ারই কথা নয় কি?

হ্যাঁ, সেটা আমারও মনে হয়েছে। এমন নির্লিপ্তভাবে, ক্যাজুয়ালি সব কিছু অ্যাকসেপ্ট করে নেওয়া…

গোবিন্দ গাড়ি কোলে করে সোফায় এসে বসে। গাড়িটা একেবারে সত্যিকারের মতো। এখানে তো জায়গা কম, বাড়িতে আরও ভালো করে চালাব। বড় ধাক্কা খাচ্ছে এখানে, এখনও তো আমার…

একটু থেমে তারপরই ঠিক কথাটা খুঁজে পেল গোবিন্দ, এখনও তো আমার প্র্যাকটিস হয়নি।

রুমা দিব্যেন্দুর দিকে তাকাল।

এই গাড়িটার চেয়ে মারুতি কিন্তু দেখতে অনেক ভালো। তা-ই না? দিব্যেন্দু বলে। তারপর রুমার দিকে তাকিয়ে যোগ করে, জানো তো, কাল ভাগ্যিস গোবিন্দকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। ওর চেনাশোনা দোকানদার…

হাবুদা।

হ্যাঁ, হাবুদা গাড়ি পাহারা না দিলে ঠিক চুরি হয়ে যেত। আমাদের ফিরতে এত দেরি হয়ে গেল।

দেরি করলে কেন? আমিও তো বেশ নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম।

কেন দেরি করলাম? কী রে গোবিন্দ, কেন দেরি হল, একটু বলে দে-না তোর কাকিমাকে।

গোবিন্দ খুব একটা উৎসাহ দেখায় না। গাড়িটা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতেই থেমে থেমে বলে, দেরি… হ্যাঁ, হিঞ্চেপুকুর শ্মশানের পাশে… হঠাৎ আলেয়ার আলো আমাদের ধরেছিল। চোখ ধাঁধিয়ে গেল। আমাকে তুলে ছুঁড়ে ফেলল। ভাগ্যিস বালি ছিল, তাই লাগেনি।

দিব্যেন্দু ওকে যেন কথার ছলে আর-একটু উসকে দেয়, তুই তাহলে ভুলে গেছিস। সবুজ একটা আলো আমাদের ওপর লাফিয়ে পড়ল আকাশ থেকে…

না, না, আকাশ থেকে কোথায়? মাটি খুঁড়ে লাফিয়ে উঠল। আলেয়ার আলো।

কবে কোথায় আলেয়ার গল্প শুনেছে, সেটাকেই এখন চালিয়ে দিচ্ছে।

 দিব্যেন্দু বলে, তোদের বাড়ি গেলাম তারপর, তুই অবশ্য তখন ঘুমিয়ে পড়েছিস।

পুরো ঘুমোইনি। একটু একটু জেগে ছিলাম।

যাঃ।

সত্যি বলছি। তুমি ভেবেছ, আমি বুঝি কিছু শুনিনি। মা তোমাকে কত বকল, বলল আমাকে ভালো করে দেখতে। বাবা নেই বলে আমার মনে যেন কোনও কষ্ট না হয়… তুমি মা-কে কথা দিলে, সব ঠিক হয়ে যাবে…।

গত রাতের আবছা স্মৃতি, আর তারপরেই আজকে তার বিপুল খাতির এইভাবেই নিজের মতো করে বুঝে নিয়েছে গোবিন্দ৷

বেয়ারা এসে ট্রে থেকে একে একে ডিশ নামায় টেবিলে।

 গোবিন্দ বলে, চিকেন বড়া কাবাব, মিক্সড গ্রিল… এবং একটাও ভুল বলেনি।

অর্ডার দেওয়ার সময় গোবিন্দ ধারেকাছে ছিল না।

.

০৭.

বাড়ি ফিরে গোবিন্দকে সঙ্গে নিয়ে রুমা দোতলায় চলে গেল। গোবিন্দর ঘর রেডি, কিন্তু ছোটখাটো সাজসজ্জার কাজ বাকি আছে। কালো নরম কাপড়-মোড়া জলিবোর্ডগুলোয় পোস্টার লাগাতে হবে, টেডি বেয়ার ঢুকবে কাচের আলমারিতে। নাইটল্যাম্প ফিট করা, এয়ারগানটায় স্ট্রিং এঁটে দেওয়ালের গায়ে তরোয়ালের ভঙ্গিতে ঝুলিয়ে দেওয়া, নানা ধরনের মুখোশের মধ্যে কয়েকটা বেছে নেওয়া ইত্যাদি।

ফ্রাঙ্ক ব্রাদারসের কয়েকটা পোস্টারের মধ্যে হাম্পটি ডাম্পটিটা বেছেছে গোবিন্দ৷ আর একটা পোস্টার দরজা ঠেলে ওর ঘরে ঢুকলেই নজরে পড়বে–মাই রুম, লাভ ইট অর লিভ ইট-রুমাই লাগিয়েছে। মানেটাও বুঝিয়ে দিয়েছে। গোবিন্দর সবচেয়ে পছন্দ ছোট্ট একটা স্টিকার। ষাঁড়ের পিঠে উঠে একটা কাক প্রশ্ন করছে, হোয়াট ইজ এ স্লিপিং বুল? ষাঁড় চোখ বুজেই বলছে, এ বুলডোজার।

গোবিন্দর ছোট্ট টেবিলের ওপর ছোট্ট লাল টুপি মাথায় টেল-ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দিয়ে রুমা বলল, আয় গোবিন্দ, তোর বইগুলো আমিও একটু দেখি?

রুমা বসল পাশের খাটে, গোবিন্দ টেবিলের সামনে চেয়ার টেনে।

 কী হচ্ছে? আমায় বাদ দিয়ে?

দিব্যেন্দু উঠে এসেছে। গোবিন্দ মুখ না ফিরিয়েই বলল, আমরা এখন ছবি দেখব। তুমিও দেখবে?

দেখি একটু।

গোবিন্দর পেছনে দাঁড়িয়ে দিব্যেন্দু চেয়ারে হাতের ভর রাখল।

রুমাও বেশ কিছু বই কিনে এনেছে। তার মধ্যে নার্সারি রাইম সহযোগে এ বি সি ডি শিক্ষার বইটা বোধহয় ছবির গুণেই বেশি পছন্দ গোবিন্দর। দু-চারটে বই নাড়াচাড়া করে আবার ওটা টেনে নিয়েছে। অফুরন্ত প্রশ্ন আর কৌতূহলের দাবি মেটাতে রুমা ও দিব্যেন্দু নাজেহাল।

রুমা পাশ থেকে মুখ বাড়িয়ে সুর করে নার্সারি রাইম পড়ছে আর বাংলায় তার মানে বলছে। দিব্যেন্দু দ্যাখে, সামনে খোলা বইটার ওপর মোটাসোটা A হরফটার ওপর এলোমেলো হাত বোলাচ্ছে গোবিন্দ। কিন্তু চোখটা তার বইয়ের ওপর নেই, চেয়ে আছে রুমার দিকে আর বিড়বিড় করে কী যেন বলছে।

কী বলছিস রে?

এ, এ, এ, এ।

রুমার দিকে তাকিয়ে দিব্যেন্দু বলে, বুঝতে পারছ?

কী?

গোবিন্দ, তুই এ বি সি ডি শিখেছিস?

না তো। অ আ হস্বই দিঘাঘই চিনতে পারি, কিন্তু লিখতে পারি না।

তাহলে তুই কেন এ বললি? তুই নিশ্চয় জানিস।

সত্যি বলছি, জানি না। তুমি মা-কে জিজ্ঞেস করো। বোরা থেকে আসার পর তো আর স্লেট-পেনসিল কেনা হয়নি।

না বাবা, এবার একেবারে খাতা, পেনসিল, পেন সব আসবে। সব শিখে ফেলবে তুমি। দ্যাখো-না…

দিব্যেন্দুর মাথায় অন্য চিন্তা ঘোরে। গোবিন্দ সত্যি কথা বলছে কি? একটা টেস্ট করলে কেমন হয়?

আচ্ছা গোবিন্দ, দেখি তো কেমন বলতে পারিস এবার। বইয়ের পাতা উলটে মাঝখান থেকে S-টাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে।

গোবিন্দ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয়, এস।

কী এলোমেলো করে, কী বর্ণানুক্রমিকভাবে একে একে ইংরেজি বর্ণমালার প্রতিটি অক্ষর ঠিক ঠিক চিনে নিতে ও উচ্চারণ করতে তার একটুও আটকায় না।

তবুও বোধহয় সন্দেহ পুরো দূর হয়নি, নানাভাবে টেস্ট করতে চায় দিব্যেন্দু ও রুমা। অধৈর্য হয়ে যায় গোবিন্দ৷

আমি আর বলতে পারব না। খালি এটা দ্যাখো, ওটা দ্যাখো, আর এটা কী, ওটা কী! আমি তো না দেখেও বলে দিতে পারি। দেখার কী আছে!

না দেখেও বলে দিতে পারিস? যাঃ—

 গোবিন্দর অলৌকিক ক্ষমতার এতটা দৌড় দিব্যেন্দুও হজম করতে পারে না।

সত্যি পারি। তুমি জিজ্ঞেস করে দ্যাখো৷

রুমা, ওর চোখে হাত চাপা দাও তো, দেখি কীরকম বলতে পারে।

 দিব্যেন্দু বইটা হাতে তুলে নিয়ে একটা পাতা উলটে বলল, বল তো এটা কী?

গোবিন্দ চুপ করে বসে আছে।

কই, বল?

কোনও উত্তর নেই।

 আর-একটা পাতা খুলল দিব্যেন্দু, এটা পারবি?

কোনও সাড়া নেই।

 তুই যে বললি, না দেখেই বলতে পারিস। কই?

এতক্ষণ তো না দেখেই পারছিলাম, এখন পারছি না।

রুমা ভাবার চেষ্টা করে। গোবিন্দ কি মাঝে মাঝে দিব্যদৃষ্টি-দিব্যশক্তি লাভ করে।

ওর হঠাৎ মনে পড়ে যায়, গোবিন্দ বইটার ওপর হাত বোলাতে বোলাতে প্রথমে এ এ বলে উঠেছিল।

এই শোনো, বইটা একবার দেখি।

 বইটা চেয়ে নিয়ে টেবিলের ওপর রাখে রুমা। তারপর ওর চোখে আঁচল চেপে ধরে।

এইবার আঙুলটা দেখি। হ্যাঁ, এই তো। পাতাটার ওপর হাত রাখ, ব্যাস। তোর আঙুলের নীচেই একটা অক্ষর আছে, ভালো করে হাত বুলিয়ে দ্যাখ তো…।

দিব্যেন্দু সাহায্য করে গোবিন্দকে, কোন জায়গাটায় হাত বোলাবে। মাথার দিক থেকে শুরু করে একটা বর্গক্ষেত্রকে প্যাস্টেলের রং দিয়ে ভরাট করার সময় হাতটা যেভাবে পাশাপাশি নড়তে নড়তে নীচে নামতে থাকে, সেই ধরনেরই মুভমেন্ট গোবিন্দর আঙুলের।

পি৷ গোবিন্দ বলে দেয়।

ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নানাভাবে রুমা আর দিব্যেন্দু পরীক্ষা চালায়।

বাঁ হাতের আঙুল। ডান হাতের আঙুল। বিভিন্ন আঙুল। প্রত্যেকটাই সেন্সিটিভ। অক্ষরের ওপর দিয়ে আঙুলের ডগাটা বুলোলেই কোনটা কোন অক্ষর, সে বলে দিচ্ছে।

গণ্ডগোল হল ছোট ঘোট হরফের বেলায়, গোবিন্দর ছোট্ট আঙুলের নীচেও একসঙ্গে যখন দু-তিনটে করে হরফ চাপা পড়ছিল, বলতে পারছে না। তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, কোনটা ছেড়ে কোনটা বলবে? সব জড়িয়ে যাচ্ছে নিশ্চয়।

গোবিন্দ নিজেও মজা পেয়েছে। একটা করে বলে, আর বেজায় গর্বিত মুখে তাকায়।

 রুমা বলল, ভালোই হয়েছে, আর কিছুক্ষণ খেলাটা চালালে ওর পুরো ইংরেজি অ্যালফাবেট চেনা হয়ে যাবে। কী রে গোবিন্দ, এখন এ বি সি ডি শুনে লিখতে পারবি?

বলতে বলতেই হঠাৎ দেখা গেল গোবিন্দর মুখে আর কথা নেই। আঙুল বুলোচ্ছে, কিন্তু কিছু বলছে না।

কী হল? শঙ্কিত বোধ করে দিব্যেন্দু৷

গোবিন্দ পাগলের মতো এল-এর ওপর আঙুল বুলিয়েই যাচ্ছে। ওর চোখ-মুখের ভাব দেখে ভয় পেয়ে যায় রুমা। দিব্যেন্দুকেই ধমকে বলে, আচ্ছা, তোমার কি মাথা খারাপ? কতক্ষণ ধরে ছেলেটাকে শাস্তি দেবে বলে তো! একদিনেই কি কেউ পণ্ডিত হয়?

গোবিন্দর অস্বাভাবিক ক্ষমতা সবসময় কাজ করে না, এটাও এক নতুন উপলব্ধি। ক্লান্ত হওয়ার সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক আছে কি না, এখনই সে সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। এমনও তো হতে পারে যে, দিনরাতভেদে বা সময়বিশেষে তার এই স্পেশাল পাওয়ার বাড়ে-কমে!

গোবিন্দকে মুক্তি দিয়ে দিব্যেন্দু বলল, শোনো রুমা, নিজের চোখেই তো সব দেখলে। আমাদের কিন্তু এখন অনেক দায়িত্ব। খুব ভেবেচিন্তে চলতে হবে। ওকে ঠিকমতো গাইড করতে পারলে আমার তো মনে হয়, একটা সেনসেশনাল ব্যাপার হবে। আবার এটাও ঠিক যে, এরকম অসাধারণ অনুভূতিসম্পন্ন মানুষকে কীভাবে পরিচালিত করতে হয়, তার কোনও অভিজ্ঞতাই মানুষের নেই। কাজেই নিজেদেরই দেখে-বুঝে বিচার করে নিজেদের কোর্স অব অ্যাকশন স্থির করতে হবে। গোবিন্দ ইজ এ গ্রেট চ্যালেঞ্জ বিফোর আস আর সেই সঙ্গে এটাও সত্যি যে, ইট ক্যান অ্যাজ ওয়েল টার্ন ইনটু সামথিং এক্সক্লসিভ!

রুমা বলল, অজিতকে আমি কয়েকটা স্কুলের অ্যাডমিশনের ফর্ম আনতে বলেছি। এমনিতে বাড়িতে যা দেখার তো দেখবই, সেই সঙ্গে জেনারেল এডুকেশনটাও যাতে প্রপারলি…।

কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, এখনই ওকে স্কুলে ভরতি করাটা ঠিক হবে না। তুমি বাড়িতে টিচার রাখো, যা দরকার, সব করো। কিন্তু স্কুলে–তুমিই বলো-না ওকে কি এক্সপোজ করাটা ঠিক হবে? নিজের আশ্চর্য ক্ষমতার কথা কিছুটা ও জানতে পেরেছে। বাচ্চাদের সাইকোলজিই হচ্ছে নিজেদের জাহির করা। কাজেই স্কুলে ভরতি করা মানেই ধরে নিতে পারো, ইন নো টাইম, ব্যাপারটা রাষ্ট্র হয়ে যাবে। ওয়ান্ডার-বয়, ম্যাজিশিয়ান, জাতিস্মর, টেলিপ্যাথ–নানারকম খেতাব দিয়ে ওর কীর্তিকলাপ পাবলিসাইজড হবে। সত্যিকার ইনভেস্টিগেশন বাদে আর সব কিছুই হবে। আমার তো মনে হয়, ওর এই ক্ষমতার বিকাশ যাতে হয়, সেদিকে যেমন আমাদের নজর রাখা কর্তব্য, তেমনই জরুরি তিন চোখওয়ালা মানুষ, কি দুই ল্যাজবিশিষ্ট গোরুজাতীয় বিলিভ ইট অর নট সংগ্রহকারী ব্যাবসাদারদের খপ্পরে যাতে সে না পড়ে, তার জন্য সতর্ক থাকা।

তা অবশ্য ঠিক।

আমি ভাবছি, এখন তো কয়েকটা দিন চেম্বারে বসব না। ফলে অজিতেরও তেমন কাজ নেই। খুবই বিশ্বাসী ছেলে। ওকে বরং গোবিন্দর এডুকেশনের ব্যাপারে দেখাশোনা করার দায়িত্বটা দেওয়া যেতে পারে। টিচার ঠিক করা, খেলাধুলোর ব্যবস্থা–সবই ও দেখবে। ওকেও আমি এখনই কনফিডেন্সে নিতে চাই না। তবে নিজে থেকেই যদি কিছু আন্দাজ করে, তখনকার কথা পরে ভাবা যাবে। আসলে ওর সবচেয়ে বড় গুণ বিশ্বস্ততা। তার ঢের প্রমাণ আমি পেয়েছি। যা-ই ঘটুক, আমাকে না বলে ও কোনও কথা পাঁচকান করবে না।

.

০৮.

ডিনারের পাট চুকিয়ে দিব্যেন্দু নীচের তলায় তার নিজস্ব বসার ঘরে চলে এল। সমীরের সঙ্গে ফোনে একবার কথা বলা দরকার। পেয়েও গেল প্রথমবারেই।

কী ব্যাপার ড. রায়? শুনলাম বলে গেছেন, নেক্সট উইকে কোনও অপারেশন করবেন না? আমি আপনাকে বার দুয়েক ফোনও করেছি।

হ্যাঁ, আমায় বলেছে। শুধু নেক্সট উইক নয়, সম্ভবত আমি আর কোনও দিনই অপারেশন থিয়েটারে ঢুকব না।

সে কী!

প্লিজ, এই নিয়ে কোনও প্রশ্ন নয়। সার্জন হিসেবে আমি রিটায়ার করছি। অবশ্য ফর্মালি কিছু ঘোষণা করব না। আমি আশা করি, তুমি সহজেই আমার প্র্যাকটিসটা ইনহেরিট করতে পারবে।

কিন্তু…

এর মধ্যে কোনও কিন্তু নেই। আমি জানি, আমার অনুপস্থিতিতে নার্সিং হোমটাকে কেউ যদি ঠিকমতো চালাতে পারে তো সে তুমি। কাজেই সেদিক দিয়ে ভাবলে আমারও একটা ইন্টারেস্ট আছে বইকী। প্র্যাকটিস ছেড়ে দিলে নার্সিং হোমটা থেকেই তো আমাকে পেট চালাতে হবে।

আমি সে কথা ভাবছি না। কিন্তু আপনি এরকম রিজিড একটা ডিসিশন কেন নিচ্ছেন, বুঝতে পারছি না। কয়েকদিন বাইরে থেকে বউদিকে নিয়ে ঘুরে-টুরে আসুন-না। তারপরে…।

থ্যাঙ্ক ইউ সমীর। তুমি ভেবো না যে, স্পার অব দ্য মোমেন্টে কিছু করছি। আজ এই মুহূর্তে সব কথা বলতে পারছি না। কিন্তু সময় হলেই জানতে পারবে, তখন বুঝবে…

তাই বলুন, একটা কিছু আইডিয়া মাথায় এসেছে। আসলে রিটায়ারমেন্ট শব্দটা শুনলেই এমন একটা আধবুড়ো নিষ্কর্মা লোকের কল্পনা করি আমরা… নিশ্চয় কোনও নতুন রিসার্চ শুরু করছেন?

বললাম তো, যথাসময়ে সবই জানতে পারবে।

 একটা গেস করব? যদি পারমিশন দেন..

 গেস মানে?

 আমি জানি, আপনি পেসম্যান নামে বিখ্যাত পেসমেকার এজেন্সির সঙ্গে যুক্ত। নিশ্চয় ইন্ডিয়াতে পেসমেকার তৈরির ব্যাপার…

সমীর! তুমি কোত্থেকে এসব কথা শুনেছ জানি না। ইট ইজ এ গ্রেট লাই এবং শুধু তা-ই নয়, তুমি হয়তো ইমোশনের মাথায় কিছু না ভেবেই বলেছ। কিন্তু… ভেবেই দ্যাখো না, একজন ডাক্তার যদি ড্রাগ ম্যানুফ্যাকচারিং ব্যাবসার সঙ্গে যুক্ত হন, তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়? আমাদের ক্ষেত্রেও তো তা-ই। কাজেই বুঝতেই পারছ, এথিক্যালি আমার পক্ষে কখনওই পেসমেকার সাপ্লায়ারদের সঙ্গে…

আমি ঠিক তা বলতে চাইনি। আসলে আর অ্যান্ড ডি–রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের সুযোগ-সুবিধা অনেক সময় প্রাইভেট অর্গানাইজেশন থেকে যেভাবে পাওয়া যায়, খোদ সরকারি সংস্থাও তার পাশে…।

বুঝেছি, বুঝেছি। তুমি ঠিকই ধরেছ। একটা নতুন এক্সপেরিমেন্ট শুরু করেছি। খুবই সিরিয়াস ব্যাপার। এবং সেটা ওইসব বাঁচিয়ে কখনও-সখনও সময় পেলে টুকটুক করে করা–অ্যামেচারিশ ভেঞ্চার নয়। আমাকে হার্ট অ্যান্ড সোল-এর মধ্যে ডুবে যেতে হবে। এর বেশি কেন বলতে চাইছি না, তার কারণটাও খুব সহজ। এক্সপেরিমেন্টটা গতানুগতিক কিছু নয়। আর তার আউটকাম সম্বন্ধে আমি নিজেও কনফিডেন্ট নই। না, আর প্রশ্ন নয়। তুমি নিশ্চিত থাকো, সামান্য একটু সাকসেসের সম্ভাবনা দেখলেই তোমাকে সব খুলে বলব। এখন তোমার দায়িত্ব হল তত দিন যাতে বেঁচেবর্তে থাকতে পারি, তার জন্য নার্সিং হোমটাকে টিকিয়ে রাখা। কেমন? অনেক রাত হল, ছাড়ি এবার। গুড নাইট।

গুড নাইট স্যার।

সমীরের সব ভালো। কিন্তু বক্তিয়ার খিলজি। স্লাইটেস্ট চান্স পেলেই শুরু করে দেবে, থামানো বেশ শক্ত। শুধু শুধু দেরি করিয়ে দিল। এখন সুরেশকে পেলে হয়।

সুরেশের সঙ্গে কথা সারতে দেরি হয় না দিব্যেন্দুর। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তার ফিরিস্তি শুরু হয়ে যায়। দেওয়াল গাঁথা কমপ্লিট, দরজা ও জানলার কাঠের ফ্রেমও বসে গেছে। এরপরে টালির ছাত করতে ক-দিন আর… চব্বিশ ঘণ্টা, দু-খেপে পাহারাদারও নিযুক্ত হয়েছে। আশুবাবু বলেছেন, গ্রামের লাইব্রেরির জন্য কিছু ডোনেশন হলে ভালো হয়। সুরেশের নামেও একটা চেক পাঠানো দরকার।

ফোন ছেড়ে দিয়ে দিব্যেন্দু চেয়ারে ঠেস দিল। সবচেয়ে ভালো লাগছে, সুরেশ একবারও ওই গর্তটাকে নিয়ে কী-কেন-কবে এসব করেনি বলে। স্যুটস মি৷

টেবিলের ওপর থেকে গ্লাস নিয়ে একবারে পুরো জলটা শেষ করে গ্লাসটা নামিয়ে রাখল দিব্যেন্দু। তারপর চেয়ারটা আরও টেনে, টেবিলের ওপর সে ঝুঁকে পড়ল। আজ সকালে কেনা সুদৃশ্য ডায়েরিটার প্রথম পাতা খুলে নিজের নাম লিখতে গিয়ে কলম সরিয়ে নিল। এক পাতা পিছিয়ে গিয়ে মলাটের ঠিক পরবর্তী পৃষ্ঠায় হালকা জলছাপ দেওয়া এন্ডপেপারের ওপর ওয়াটারম্যানের নিব ছোঁয়াল

শুরু করছি আমার রেজারেকশনের কাহিনি। উনপঞ্চাশটা তুচ্ছ বছর পার হয়ে এসে এই আশাতেই জীবনে প্রথম ডায়েরি লেখা শুরু করছি যে, আজ মেরি ও পিয়ের কুরির ডায়েরির তেজস্ক্রিয়তা আমাদের যতটা বিস্মিত করে, তার চেয়ে হয়তো আমার দিনলিপি বেশি বিস্ময়কর ঠেকবে আমার উত্তরসূরিদের কাছে। এটা আমার কাহিনি, গোবিন্দরও কাহিনি। এবং সবার ওপরে পৃথিবীর বাইরে উন্নততর কোনও সভ্যতার জীব/প্রাণী/সত্তার –অর্থাৎ ই.টি.-র সন্ধানলাভের কাহিনি।

বুধবার দুপুরে নার্সিং হোম থেকে বেরিয়ে পড়া–এখান থেকে দিব্যেন্দু শুরু করে। তারপর বুধ ও বৃহস্পতি, দু-দিনের পূর্ণ বিবরণ–যত দূর মনে পড়ে এবং কোনও ঘটনাকেই তুচ্ছজ্ঞানে বর্জন না করে লিখতে লিখতে তার ডায়েরির দু-মাসের পাতা ভরতি হয়ে গেল। দিব্যেন্দুর ডায়েরি থেকে অবিমিশ্র সেই বিবরণই এতক্ষণ পেশ করা হয়েছে।

দিব্যেন্দু ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত দুটো চেয়ারে ঠেস দিয়ে পা টানটান করে একটা সিগারেট ধরায়। ক্লান্ত তো নয়ই, বরং হালকা লাগছে। সিগারেট শেষ করে উঠে পড়বে ভেবেছিল। কিন্তু সিগারেট শেষ করার আগেই আবার ডায়েরি খুলে ঝুঁকে পড়ল। এতক্ষণ তো শুধু কিছু এপিসোড পরপর লিখে গেছে। একটা সামিং আপ তো দরকার। কিছু সিদ্ধান্তে সে নিশ্চয় পৌঁছেছে, কিছু রয়েছে অনুমানের স্তরে। ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্বন্ধেও চিন্তাগুলো গুছিয়ে নেওয়া চাই।

ঘাড় কাত করে লিখে চলে দিব্যেন্দু—

 সিদ্ধান্ত৷৷ ই.টি. (এক্সট্রা টেরেস্ট্রিয়াল) অর্থাৎ পৃথিবীর বাইরে বুদ্ধিমান জীবের অস্তিত্ব আছে। কারণ আমি তাদের (তাদের শক্তির বা তেজের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এসেছি। ই.টি, শক্তির কিছু অংশ গোবিন্দ অর্জন করেছে। আমি করিনি। আমাকে ইচ্ছাকৃতভাবে তারা বঞ্চিত করেছে। ই.টি. শক্তি শব্দ, ইমেজ বা দৃশ্য-সংকেত ছাড়াই কোনও অজানা উপায়ে ইনফর্মেশন পরিবহন করতে সক্ষম। সবুজ-শীতল তেজের প্রথম পরিচয়ের মুহূর্তেই অনুভব করেছিলাম, ই.টি.-রা আমার আচরণ হাইলি ডিসঅ্যাপ্রুভ করেছে। পরবর্তী পর্বে আমার সংশোধনমূলক কার্যকলাপ (গোবিন্দর ক্ষেত্রে) স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ও সেই সঙ্গে প্রিপ্রোগামড–পূর্বনির্ধারিত।

অনুমান৷৷ গোবিন্দর ওপর ই.টি.-দের বিশেষ পক্ষপাত কোনও ব্যক্তিবিশেষের দুঃখমোচনের বাসনা হিসাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। গোবিন্দর চেয়ে দুঃখী বহু শিশু, কিশোর ও অ্যাডাল্ট এ দেশে, বিদেশে সর্বত্রই আছে। গোবিন্দকে তারা সিম্বলিক্যালি তাদের মিডিয়াম হিসাবে বেছে নিয়েছে। আর তার সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছে আমাকেও। গোবিন্দকে ও তার বিশেষ ক্ষমতাকে প্রচারের দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হবে। গোবিন্দকে এস্টাবলিশ করার অর্থ ই.টি.-দের অস্তিত্ব এস্টাবলিশ করার ফাউন্ডেশন স্থাপন। ইন আদার ওয়ার্ডস–ডক্টর দিব্যেন্দু রায়, যদিও ক্রিটিসাইজড বাই দেম–তাহলেও তার ওপরে অর্পিত হয়েছে যুগান্তকারী দায়িত্ব। গোবিন্দ ফেনোমেনাকে যতক্ষণ না আমিও আমার সূত্রে পৃথিবীর বাসিন্দারা গ্রহণ করতে পারছে, ই.টি.-রা এখানে আত্মপ্রকাশ করবে না।

কোর্স অব অ্যাকশন। স্টাডি, স্টাডি, অ্যান্ড ফারদার স্টাডি। গোবিন্দর স্পেশাল পাওয়ারের চরিত্র এক্সটেন্ট এবং সম্ভব হলে তার প্রয়োগক্ষেত্র ও কার্যকারিতা সম্বন্ধে সব রকমের অনুসন্ধান চালানো। গোবিন্দকে ইটি-দের প্রতিভূ বিচারে ট্রিট করা। সেই সঙ্গে গোবিন্দর মধ্যে যেসব স্পার্ক ধরা পড়ছে, সেগুলোকে চর্চার দ্বারা, আরও পরিশীলনের মধ্য দিয়ে বিকশিত করার চেষ্টা। শিশুদের প্রতি ই.টি.-দের পক্ষপাতিত্ব আছে কি না, সেটাও অনুসন্ধানসাপেক্ষ এবং গোবিন্দর সাহচর্যে অন্যদের মধ্যে ই.টি.-শক্তি বিকাশের (কনটামিনেশন?) প্রকল্প গ্রহণ। অদৃশ্য নিরাকার ই.টি. মহাকাশযান অবতরণের ক্ষেত্রে রাউন্ড-দ্য-ক্লক অবজার্ভেশনের আয়োজন করা। স্টিল ও ভিডিয়ো ক্যামেরার সাহায্যে ভবিষ্যৎ ই.টি.-আগমনের চিত্রগ্রহণের বন্দোবস্ত রাখা।

.

০৯.

তিন মাস পরের কথা। দিব্যেন্দু এখন বুঝতে পারছে, কেন ই.টি.-রা গোবিন্দকে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করেছে। বাড়িতে তিনজন প্রাইভেট টিউটরই অবাক হয়ে গেছেন। গোবিন্দর প্রোগ্রেস দেখে। ইংরেজি ও বাংলার বর্ণপরিচয় ও লিখতে শেখার পাট চুকিয়ে গোবিন্দ দিনরাত বই পড়ছে, আর প্রতিদিন আরও বই কিনে দেওয়ার জন্য দাবি। জানাচ্ছে। ইতিমধ্যেই তার ঘরটা একটা চিলড্রেনস লাইব্রেরির চেহারা নিয়েছে।

রুমা সে দিন দিব্যেন্দুকে বলল, তুমি লক্ষ করেছ কি না জানি না, গোবিন্দ কিন্তু ওর টিউটরদের কাছে কিংবা বাইরের লোকের কাছে কখনও ওর ক্ষমতা প্রকাশ করে না। ইন ফ্যাক্ট, সেটা গোপন করারই চেষ্টা করে। সে দিন বাংলা পড়াচ্ছিল সমরেশ, আমি পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আবোল তাবোল-এর পাতা ওলটাতে ওলটাতে কিছুটা আপন মনেই বলছিল, আজ কোনটা হবে, অ্যাঁ? গোবিন্দ খাতার ওপরে পেনসিল নিয়ে আঁকিবুকি কাটছিল। চোখে পড়ে গেল, ও লিখছে রামগরুড়ের ছানা। সমরেশের চোখ তখনও বইয়ের পাতায়। বলল, না, বোম্বাগড়ের রাজাটা আজ থাক। রামগরুড়ের ব্যাপারটাই দেখা যাক। আমি আর কিছু না বলে চুপ করে সরে এলাম।

আচ্ছা! খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তো। এটা তো আমি কখনও খেয়াল করিনি। এত দিন যেটা আমরা দেখেছি, কখনও কখনও ও আমাদের মনের কথাটা জানতে পেরে যায়।

আমার চেয়ে কিন্তু তোমার সঙ্গে ওর যোগটা বেশি বলে মনে হয়।

সেটা আমিও লক্ষ করিনি তা নয়। আমার মধ্যে দিয়ে ও অনেক কিছু গ্রহণ করে। সে তো আছেই। কিন্তু তুমি এখন যা বললে, তার গুরুত্ব বোধহয় বোঝোনি। শুধু অন্যের মনের চিন্তা ধরে ফেলাই নয়, কে কী ভাবছে তা-ই নয়, লোকে কী ভাববে, সেটাও ধরে ফেলছে গোবিন্দ৷

এমনও তো হতে পারে যে, সমরেশ হয়তো সত্যিই বোম্বাগড়ের রাজা কবিতাটাই পড়ত। কিন্তু গোবিন্দ মুখে কিছু না বললেও মনে মনে রামগরুড়ের ছানা শোনার ইচ্ছে হয়েছিল বলেই শেষ পর্যন্ত…

সমরেশ নিজের অজান্তে গোবিন্দর ইচ্ছা অনুযায়ী পরিচালিত হয়েছে। হতে পারে, হতে পারে। ভালোই হয়েছে, অনেকদিন ধরেই একটা টেস্ট করব ভাবছিলাম, তুমিও থাকবে আমার সঙ্গে, বুঝলে? দুপুরে খাওয়ার পর বসব।

.

আজ আমরা নতুন একটা খেলা শুরু করব।

নতুন খেলা? লুডোর মতো? না, ওয়াটার গেমের মতো?

 এক্কেবারে নতুন খেলা। তোর কাকিমাও জানে না। প্রথমে তোকে শেখাব, তারপর রুমাকে। এই চেয়ারটাতে বসে পড়।

সেন্টার টেবলটার একপাশে দুটো চেয়ারে পাশাপাশি বসে দিব্যেন্দু ও রুমা। উলটোদিকে তাদের মুখোমুখি বসেছে গোবিন্দ।

খেলার নাম কী? কী দিয়ে খেলা হবে? গোবিন্দ অধৈর্য হয়ে পড়েছে।

খেলার নাম তো এখনও ভাবিনি।

 নাম না হলে খেলা হবে কী করে?

 নামটা না-হয় তুইই ঠিক কর।

আমি ঠিক করব?

হ্যাঁ, খেলাটা দেখে নে, তারপর…।

দিব্যেন্দু সিগারেটটা মুখে গুঁজে লাইটারটা উঁচু করেছে, গোবিন্দ বলে উঠল, ফোরকাস্ট!

ই.টি.-পাওয়ার! দিব্যেন্দু মৃদু হেসে ঘাড় নেড়ে বলে, খুব ভালো নাম দিয়েছিস। এবার শুরু করা যাক।

টেবিলের ওপর হাতির দাঁতের ইনলে-করা একটা কাশ্মীরি কাঠের বাক্স খুলে একটা ছক্কা উপুড় করে ফেলল টেবিলের ওপর।

ছক্কা! তাহলে যে বললে লুডো নয়। লুডোর বোর্ড কই?

 বোর্ড লাগবে না।

গোবিন্দ প্রায় দু-ইঞ্চি আকারের বাহারি ছক্কাটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দ্যাখে।

এদিকে দেখ। তুমিও দ্যাখো। জানোই তো, ছক্কা চালালে ছ-টা দানের মধ্যে যে-কোনও একটা পড়ে। এক থেকে ছয়ের মধ্যে যে-কোনও একটা। এবার শোনো। একটা চোর ছেলেবেলা থেকেই লুডো খেলতে খুব ভালোবাসত, আর লুডো খেলায় তার লাকও ছিল খুব ভালো। এমন দান পড়ত যে, বেশির ভাগ সময়েই জিতে যেত। সেই জন্যে চুরি করতে বেরোবার সময়ে সে পকেটে সর্বদাই একটা ছক্কা রাখত। আর যখনই প্রয়োজন মনে করত, ছক্কা চেলে তার দান দেখে সেই অনুযায়ী যা করার করত। একদিন একটা বাড়িতে চুরি করতে ঢুকে তার ধাঁধা লেগে গেল। বাড়িতে ছ-টা ঘর, তার মধ্যে একটাতেই শুধু অনেক টাকাপয়সা আছে। কিন্তু সেটা ও চিনবে কী করে? সব ক-টাই তো দেখতে একরকম। তখন সে ঠিক করল, ছক্কা চেলে যা দান পড়বে, সেটাতেই ঢুকবে।

দারুণ মজার ব্যাপার তো।

দাঁড়াও, এখনও শেষ করিনি। ওই বাড়িতে থাকত দারুণ বুদ্ধিমান একটা ছেলে। তার নাম, এই ধরো, গোবিন্দ…

 না, না, হবে না–

 শোনো আগে। গোবিন্দ কিন্তু চোরকে ঢুকতে দেখেছিল বাড়িতে। চোর যে ছক্কা চেলে কোনও একটা ঘরে ঢুকবে, তা-ও সে জানত। চোরটা ছক্কা চেলে কী দান ফেলছে তা দেখতে না পেলেও, তাকে তাই সেটা আন্দাজ করে নিতে হবে। আজ মিলে গেলে, বোঝাই যাচ্ছে যে, সেই ঘর থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র সে সরিয়ে ফেলবে, চোর ঠকে যাবে। এবার তাহলে খেলা শুরু হোক। আমি চোর আর তুই… রুমা, তুমি জাজ। গোবিন্দ, তুই চেয়ার ঘুরিয়ে উলটোদিকে মুখ করে বোস। স্টার্ট

খটখট করে ছক্কাটাকে নেড়ে টেবিলে ফেলামাত্র গোবিন্দ চেঁচিয়ে উঠল, চার।

রুমা বলল, ঠিক, ঠিক।

 আবার ছক্কা চালল দিব্যেন্দু৷ গোবিন্দ বলল, দুই। এবারেও ঠিক।

পরপর দু-বার ছক্কা চালল দিব্যেন্দু। প্রত্যেকবার গোবিন্দ ঠিক বলেছে।

কোনও চোরই পারবে না আমার সঙ্গে, কী বলো? গোবিন্দ বেজায় গর্বিতভাবে বলল।

তোর কপাল ভালো তাই লেগে গেছে, রুমা বলল।

দিব্যেন্দু বলল, ঠিক ওভাবে ব্যাপারটাকে ব্যাখ্যা করলে তো চলবে না। এটাকে শুধু লাক বা চান্স বলে উড়িয়ে দেওয়া শক্ত। প্রবাবিলিটি বলে একটা শব্দ আছে, জানো তো? ম্যাথামেটিক্সে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্রাঞ্চ। প্রবাবিলিটি অনুসারে, একটা ছক্কা একবার চাললে তার মধ্যে যে-কোনও একটা সংখ্যা ওঠার সম্ভাবনা ছয়ের মধ্যে এক। কথাটা অন্যভাবে বললে, কেউ যদি একটা ছক্কা পরপর ছ-বার চালে তাহলে এক থেকে ছয়ের মধ্যে প্রত্যেকটা সংখ্যা একবার করে পড়ার সম্ভাবনা। এবার ভেবে দ্যাখো, আমাকে যদি না দেখে আন্দাজ করতে বলা হয় এবং প্রত্যেকবারই আমি যদি একই সংখ্যা বলে যাই, ধরো দুই, তাহলে ছ-দান অন্তর আমার মেলার কথা। যাকে বলে ১/৬ চান্স। এখন গোবিন্দ যেভাবে ছ-বার পরপর ছটা ভিন্ন সংখ্যা ঠিক ঠিক আন্দাজ করেছে, সেটা ঘটার সম্ভাবনা প্রবাবলিটির তত্ত্ব অনুযায়ী ১/৬৬ বা ৪৬৬৫৬ বারের মধ্যে একবার। অর্থাৎ ৪৬৬৫৬ বার ভবিষ্যদ্বাণীর মধ্যে একবার মেলার কথা। কাজেই শুধু কাকতালীয় বলে পার পাওয়ার কোনও উপায় নেই।

গোবিন্দ অধৈর্য হয়ে বলে, কী বলছ, খ্যালো-না।

সত্যি তো, খেলাটা বন্ধ করে বকর-বকর করার কোনও মানে হয়?

আবার খেলা শুরু হয় এবং তিরিশবারের মধ্যে মাত্র দু-বার ভুল হয়েছে গোবিন্দর। তা ও গোবিন্দর ধারণা, সে ঠিকই বলেছিল। তাকে ঠকানো হয়েছে।

রুমা গলা নামিয়ে বলে, এবার লটারির টিকিট কাটার সময় গোবিন্দকে সঙ্গে নিয়ে গেলে কেমন হয়?

কথাটা দিব্যেন্দুর পছন্দ হয় না। ঘাড় নেড়ে জানায়, ওর ক্ষমতাকে অপব্যবহার করা উচিত নয়।

অপব্যবহার বলছ কেন? ওটাও তো একটা টেস্ট। দেখাই যাক-না…

আমার মনে হয় না, তাতে খুব সুফল পাওয়া যাবে। ওর যে ক্ষমতার সুস্পষ্ট পরিচয় আমরা পেয়েছি, তার সঙ্গে লটারির টিকিটের নম্বর আগে থেকে প্রেডিক্ট করার পার্থক্য আছে।

গোবিন্দ বলে, দুর, এ খেলা ভালো নয়। স্নেক-ল্যাডার খেলবে?

 রুমার আর খেলার ইচ্ছে নেই। তার ঘুম পাচ্ছিল। দিব্যেন্দু জোর করে বসিয়ে রাখল, একটু স্নেক-ল্যাডার খেলে যাও, মনে হচ্ছে, তোমার প্রশ্নের উত্তর এখনই পেয়ে যাবে।

গোবিন্দ নিজের ঘর থেকে স্নেক-ল্যাডার নিয়ে এল। বোর্ড পেতে খুঁটি ঢেলে বলল, সবাই খেলবে তো?

দু-দানের পরই গোবিন্দর ঘুটি একটা মইয়ের কাছে পৌঁছে গেল। দিব্যেন্দু বলল, তিন পড়লেই মই কিন্তু।

গোবিন্দ মুখ নিচু করে আঙুল দিয়ে গুনে তারপর বেশ কয়েকবার ঝাঁকিয়ে ছক্কা চালল, চার।

ওর মুখের চেহারা দেখে রুমা বলল, ঠিক আছে, প্রত্যেকবারই কি আর মেলে?

আমার তো মেলে। মেলারই তো কথা।

আর এক দান বাদে গোবিন্দ চালার আগে দিব্যেন্দু সতর্ক করে দিল, পাঁচ পড়লেই কিন্তু সাপের মুখে। অনেকবার নাড়াচাড়া করে, একবার দান ফেলতে গিয়েও না ফেলে, আবার নেড়ে গোবিন্দ পাঁচ ফেলল। কিন্তু খুঁটি চাল দেওয়ার সময় দেখা গেল, দিব্যেন্দু ভুল গুনেছিল, চার পড়লে সাপের পেটে যেত।

দিব্যেন্দু লক্ষ করেছিল, গোবিন্দ চাল পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঁ হাত দিয়ে তার খুঁটিটাকে এক ঘর সরিয়ে দিয়েছে, কিন্তু আপত্তি জানায়নি। গোবিন্দ ক্রমেই জয়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে।

দু-তিনবার নিপুণ কারসাজি সত্ত্বেও তার আগে রুমা দৌড় শেষ করল। গোবিন্দ লুডো গুটিয়ে বলল, আমি এবার বারান্দায় সাইকেল চালাতে যাচ্ছি।

দেখলে তো? দিব্যেন্দু যেন বড়াই করে বলল।

কিন্তু একবার যা বলছে তা-ই মিলছে, আবার পরে কিছুই মিলল না–এরকম হবে কেন? ওর যদি অদ্ভুত কোনও ক্ষমতা সত্যিই থাকে, তবে…?

সে ক্ষমতা ওর সত্যিই আছে। কিন্তু তুমি একটা জিনিস মিস করেছ। প্রথমবার খেলার সময় আমি ছক্কার দান ফেলার পর ও সেটা আন্দাজ করছিল, এবং প্রত্যেকবার ঠিক বলছিল। এমন নয় যে, ও একটা সংখ্যা বলছে, আর তার পর দান ফেলে দেখছি, সেটা মিলে যাচ্ছে। ভবিষ্যতের কোনও ঘটনাকে ওর ইচ্ছা অনুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এমন বিশেষ কোনও শক্তির পরিচয় এখনও ওর মধ্যে দেখিনি। স্নেক-ল্যাডার খেলাতেও তার প্রমাণ পেলে। সেই জন্যেই বলছি, লটারির টিকিট কাটা বা বাজি ধরা ইতাদি ব্যাপারে গোবিন্দ খুব ইউজফুল হবে বলে মনে হয় না!

রুমা বলল, এখনই তুমি জোর দিয়ে কিছু বলতে পারো না। যে ছেলে ভালো ছবি আঁকে, তাকেও ট্রেনিং নিতে হয়। শিল্পী হিসাবে নাম করতে হলে শুধু জন্মগত প্রতিভাই যথেষ্ট নয়। আমার দৃঢ় ধারণা, গোবিন্দ এটাও পারবে। না হলে ওই যে টিউটরকে দিয়ে কবিতাটা পড়াল-হল কী করে!

দিব্যেন্দুকে স্বীকার করতে হয়, রুমার বক্তব্য পুরোপুরি অগ্রাহ্য করা যায় না।

.

১০.

পেশাগত সূত্রে পেসমেকার নিয়ে নাড়াচাড়ার সুবাদেই কিছু ইলেকট্রনিক যন্ত্রনির্মাতার সঙ্গে পরিচয় ছিল দিব্যেন্দুর। রোগীর বুকে চামড়ার নীচে বসানো ব্যাটারিচালিত এই যন্ত্র কৃত্রিম পালস সঞ্চারিত করে, হৃদযন্ত্রকে চালু রাখতে সাহায্য করে। যে-কোনও যন্ত্রের মতো পেসমেকারেরও মেরামতি, ব্যাটারি বদলানো ইত্যাদি প্রয়োজন। কিন্তু আপশোশের কথা, তেমন নির্ভরযোগ্য একজন কারিগরকেও আজ পর্যন্ত খুঁজে পায়নি দিব্যেন্দু৷ পেসমেকার শুধু আমদানি নয়, তার বড়রকম কিছু মেরামতি থাকলেও বিদেশের ওপর নির্ভর করা ছাড়া গতি নেই।

আইআইটি-র তরুণ ইঞ্জিনিয়ার অলকেশ মিত্রকে এইসব কথাই বলছিল দিব্যেন্দু। আর দুটো মাস আগেও যদি তার সঙ্গে পরিচয় হত, তাহলে শুধু পেসমেকারের কাজটাই অলকেশের ফুল-টাইম অকুপেশন হতে পারত। দিব্যেন্দু অবশ্য বলেছে, তার পরিচিত কার্ডিক-থোরাসিক সার্জনদের কাছে অলকেশকে ইন্ট্রোডিউস করে দেবে।

অলকেশ নমস্কার জানিয়ে বিদায় নিতে উঠে দাঁড়িয়েছিল। তার দীর্ঘ ছিপছিপে চেহারা, সপ্রতিভ মুখ আর চাপা কনফিডেন্স হঠাৎ প্ররোচিত করল দিব্যেন্দুকে। এমন একটা ছেলেকে ছাড়া যায় না। অলকেশ যখন স্বাধীনভাবে কনসালটেন্সি সার্ভিসের কথা ভাবছে, শুধু পেসমেকার কেন?

দিব্যেন্দু বলল, এক মিনিট বসুন। আমি জানি, আপনি পেসমেকারের ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড বলেই আমার কাছে এসেছেন। কিন্তু এ ছাড়া অন্য কোনও কাজ যদি হয়, আপনার লাইনেই…।

নতুন ধরনের যে-কোনও কাজ, স্টিরিয়োটাইপ না হলে–ডেভেলপমেন্টের স্কোপ থাকলে, আমি খুবই ইন্টারেস্টেড।

গুড। আমার দুটো প্রবলেম আছে। একে একে বলছি। কিন্তু প্রথমেই বলে রাখি, এর মধ্যে সিক্রেসি রাখার…

অলকেশের নীরব ভঙ্গি দিব্যেন্দুকে নিশ্চিন্ত করল।

বোদরার নাম না করে এবং মূল উদ্দেশ্যের কথা বাদ দিয়েই দিব্যেন্দু প্রথমে একটা আনম্যান্ড অবজার্ভেশন সেন্টার স্থাপনের কথা বলল, যেখানে স্বয়ংক্রিয় উপায়ে সারাক্ষণ নজর রাখা হবে আশপাশের ওপর।

আশপাশ ও নজর শব্দ দুটোর ক্ল্যারিফিকেশন চাইল অলকেশ।

ধরুন, একেবারে নির্জন কোনও অঞ্চলে একটা বাড়ির মধ্যে কিছু মূল্যবান জিনিস আছে। সেখানে পাহারাদার একজন সারাক্ষণ থাকে। কিন্তু শুধু তার ভরসায় থাকাটা ঠিক নয়। এমন একটা সিস্টেম, যাতে ওই বাড়ির তল্লাটে, ধরুন, একশো মিটারের মধ্যে কেউ বা কিছু এলেই, এমনকী আকাশপথে এলেও, সঙ্গে সঙ্গে সেটা ডিটেক্টেড হবে, এবং শুধু অ্যালার্ম নয়, তার ছবিও তুলে নেওয়া হবে।

ছবি, মানে স্টিল ফোটোগ্রাফ, না ভিডিয়ো?

না, ভিডিয়োর দরকার নেই। স্টিল হলেও চলবে।

 একশো মিটার বলছেন? করা যাবে–রেঞ্জটা তো খুব বড় নয়। একটা রাডার জাতীয় ইকুইপমেন্টের সঙ্গে সিনক্রোনাইজ করা ক্যামেরা–হবে। তবে একটাই ঝামেলা, সে হচ্ছে। আপনার ওই পাহারাদার। কেউ যদি না থাকত…

কেন? যন্ত্রের চোখ পাহারাদারকে আইসোলেট করতে পারবে না। কাজেই পাহারাদারকে দেখলেও…

ও!

না, উপায় একটা বের করা যাবে না তা নয়। পাহারাদারের চলাফেরার পথটা নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। আর যন্ত্র সেই নির্দিষ্ট পথে কিছু দেখলেও তাকে অগ্রাহ্য করবে।

তার মানে, যদি চোর আসে, তার পক্ষে সবচেয়ে সেফ হল পাহারাদারকে অনুসরণ করা!

তা বলতে পারেন। অবশ্য পাহারাদার ইচ্ছে করলে যে-কোনও জায়গাতেই যেতে পারবে। শুধু একটা সুইচ অফ করে দেবে সাময়িকভাবে। তাহলেই আর কোনও ঝঞ্ঝাট বাধবে না?

আপনি ইমিডিয়েটলি একটা স্কিম দিন আমায়। মোটামুটি কত খরচ, সেটাও…

 কিন্তু সাইটটা তার আগে একবার দেখা দরকার।

আপনি আগে কিছুটা প্রসিড করুন। তারপর যাব একদিন দুজনে।

অলকেশ সোফায় ঠেস দিয়ে বসল। পাতলা ফ্রেমের চশমাটা খুলে বাঁ হাতে নিয়ে মুখ নিচু করে রয়েছে। মাথার মধ্যে নিশ্চয় ডিজাইনের চিন্তা নড়াচড়া শুরু করেছে। দিব্যেন্দু ভাবে, এমন একখানা চেহারা যদি তার থাকত, তবে ডাক্তারি পাশ করার পর প্র্যাকটিস জমাতে দু-বছর লাগত না। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, হ্যান্ডসাম প্রাইভেট প্র্যাকটিশনাররা বাড়তি সুবিধে পায়।

চা-মিষ্টি দিয়ে যাওয়ার পর দিব্যেন্দু বলল, আমার দ্বিতীয় কাজটাও আনকনভেনশনাল। আমার এক আট বছরের ভাইপো আছে। খুব ইন্টেলিজেন্ট। ওর জন্য আমি দু-একটা খেলা তৈরি করতে চাই। ইলেকট্রনিক গেম। না, না, এই ভিডিয়ো গেম নয়।

প্রায় মিনিট কুড়ি দিব্যেন্দুর মুখে নতুন খেলার বিবরণ শোনার পর চশমার ডাঁটিটা দাঁতে চেপে অলকেশ বলল, স্ট্রেঞ্জ! আইডিয়াটা মজার। কিন্তু মনে হচ্ছে যেন এরকম একটা গেম…

সে কী মশাই! এত মাথা-টাথা ঘামিয়ে যদি-বা ভাবলাম, দারুণ একটা আবিষ্কার করে ফেলেছি, আর আপনি কিনা… যাক গে। কেউ যদি এই ধরনের কিছু আগে তৈরি করে থাকে, তাতেই বা কী? তাকে গ্রেট ম্যান বলে স্বীকার করতেও তো আমার আপত্তি নেই। গ্রেট ম্যান না হলে আমার সঙ্গে থিঙ্ক অ্যালাইক করবে কী করে! এখন বলুন, জিনিসটা তৈরি করা যাবে?

যাবে।

গুড। তাহলে লেগে পড়ন।

ড্রয়ার টেনে চেকবুক বার করে দিব্যেন্দু বলল, কস্ট নিয়ে মাথা ঘামাবার কোনও দরকার নেই। এখন দশ হাজার অ্যাডভান্স হিসাবে দিচ্ছি, কেমন?

চেকটা ভাঁজ করে অলকেশ বলল, আপনার এই যন্ত্রটা কিন্তু ছেলেদের চেয়ে গ্যাম্বলার বা জুয়াড়িদের বেশি প্রিয় হবে।

তা জানি না। আমি নিজের ব্যবহারের জন্য তৈরি করছি। তবে আপনি যদি এর ডুপ্লিকেট…

আই হেট গ্যাম্বলিং ডক্টর রায়।

দিব্যেন্দু হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, সো ডু আই! মুশকিল কী জানেন, কাল সকালে বৃষ্টি পড়বে কি না, তার ওপরেও লোকে এখন বাজি ধরে। যে-কোনও খেলাকেই তাই জুয়া খেলার কাজে কনভার্ট করলে তা ঠেকানো অসম্ভব।