গোয়েন্দা হলেন যন্ত্রভুষণ
চক্ষুস্থির। এটা কার নাম? যত দূর জানি, এই ৫৬ নম্বর বিভূতি বড়াল স্ট্রিটের বাড়িটা আমার ঠাকুরদার আমলে তৈরি। কখনও কোনও ভাড়াটেও ছিল না। সকালে বেরোই যখন, স্পষ্ট মনে আছে যে, লেটার বক্সের সামনে আমার নামটাই শুধু লেখা ছিল। তার মানে, আট ঘণ্টার মধ্যে আমার বাড়িতে এক অতিথি এসেছেন এবং এসেই আমার নামের নীচে গোটা গোটা ইংরেজি হরফে নিজের নামটি লিখে ফেলেছেন। জে বি বিদ্যাবাগীশ। বিদ্যাবাগীশ ছেড়ে বিদ্যারত্ন, বিদ্যাভূষণ কি বিদ্যাশিরোমণি–বিদ্যাবিভূষিত পদবিধারী একটাও চেনাজানা লোকের কথা মনে পড়ছে না। জবরদখল হয়ে গেল নাকি বাড়িটা? চাবিটা লকে খুঁজেও, এখন ঘোরাতে ভয় হচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকালাম। সন্ধে সাড়ে ছটা। তাহলে যুথো ফিরে এসেছে। কলিং বেলটাই আগে টেপা যাক।
যুধোর পায়ের আওয়াজ পেয়ে হাঁপ ছাড়লাম।
স্নিগ্ধ কণ্ঠে যুধো বলল, আবার চাবি হারিয়েছ বুঝি?
মোটেই না। কিন্তু লেটার বক্সের গায়ে এসব কী? কে এসেছে?
কে আবার আসবে! ওটা আমার ছদ্মনাম। আজই লিখেছি।
পরশুর ঘটনাটা মনে পড়ে গেল। এবার নির্ভয়ে নিজ গৃহে প্রবেশ করা যেতে পারে।
যুধোর মগজে দিন দিন শয়তানি বুদ্ধি গজাচ্ছে, সেটা বুঝতে পেরেছি আগেই, কিন্তু এতটা আশা করিনি। অভ্যাসবশত, যুদ্ধে যুধো বলেই হাঁক পেড়েছিলাম পরশু। যুদ্ধে সাড়া দিতে দেরি করেনি, কিন্তু আপত্তি জানিয়েছিল, কেন যে যুদ্ধে নাম রেখেছিলে, জানি না। যুধিষ্ঠিরের অপভ্রংশ ছাড়া তো কিছুই না। টিভি সিরিয়ালের পর থেকে রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদির কোনও চরিত্রের সঙ্গে নিজেকে জড়াতে ইচ্ছে করে না।
যুধোর চোখে চোখ রেখে চাপা বিরক্তির স্বরে বললাম, ছদ্মনাম নেওয়ার ব্যাপারটা কি আগে থেকে আমাকে জানিয়ে রাখলে ভালো হত না?
সুযোগ পেলাম কোথায়! আজই ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে বসে ছদ্মনামটা গ্রহণ করেছি। নিজের নাম লিখে একটা চিঠিও পোস্ট করে দিয়েছি। দেখা দরকার, আমার নামে চিঠিপত্র এলে ঠিকমতো ডেলিভারি হয় কি না।
ঠিক বোঝা গেল না।
অতি সরল। দু-সপ্তাহের মধ্যে আমার একটা গবেষণামূলক প্রবন্ধ পাঠাব প্রভা বা অনুপম পত্রিকার দফতরে। সম্পাদকরা হয়তো তারপরে লেখকের সঙ্গে যোগস্থাপনের চেষ্টা করবেন। এরকম জরুরি চিঠি সময়মতো আমার হাতে না পৌঁছেলে খুব ক্ষতি হয়ে যাবে।
বেশ, বেশ। তা বিদ্যাভূষণ মহাশয়, একটা কথা জিজ্ঞেস করব? নামের আগে ওই জে বি অক্ষর দুটি…।
যন্ত্রভূষণ। যন্ত্রভূষণ বিদ্যাবাগীশ। ভালো হয়নি?
এখন বুঝতে পারছি সব ঝাটের মূলে আমি। যুধো অথবা যুধিষ্ঠির আমার হাতে গড়া যন্ত্রমানব। কিন্তু তাতে কোনও ক্ষতি হয়নি। ভুল হয়েছে যুধোকে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে পাঠিয়ে। নিজের গবেষণার কাজে যুথোকে ব্যবহার করতে গিয়ে।
এটা অবশ্য স্বীকার করতেই হবে যে, যুথো, বলতে গেলে প্রায় লড়াই করে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। ন্যাশনাল লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে রিডিং রুম কার্ড আদায় করার আগে অনেক পরীক্ষা দিতে হয়েছে। লেখক বা বইয়ের নাম ধরিয়ে দিলে, পুস্তক তালিকার কার্ড ঘেঁটে ঠিকমতো কল-নম্বর বের করা, রিকুইজিশন স্লিপ ভরা এবং শেষ পর্যন্ত কাউন্টার থেকে বই সংগ্রহ করা। নানাভাবে বাজিয়ে নিয়ে তবেই জাতীয় গ্রন্থাগার প্রথম যন্ত্রমানবকে সভ্যপত্র দিয়েছে। মাস ছয়েক তাকে দুষ্প্রাপ্য বা জীর্ণ বইপত্র ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়নি। কিন্তু বই নাড়াচাড়া বা পাতা ওলটানোর ব্যাপারে যুধোর দক্ষতা মানুষ-পড়ুয়াদের চেয়ে ঢের বেশি। অসতর্কতার জন্য তার হাতে বইয়ের পাতার একটি কোনা অবধি ভাঙার অবকাশ নেই। এখন যুধোর অবাধ গতি। রেয়ার বুক, মাইক্রোফিলম, এমনকী এসপ্ল্যানেডের সংবাদপত্র পাঠকক্ষেও প্রয়োজনমতো কাজ করছে।
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের কয়েকটা খবরের কাগজের পাঁপড় ভাজার মতো হলদেটে পাতা ওলটাতে ওলটাতেই আমার ধারণা, যুথোর মনে প্রথম স্বাধীন চেতনা জেগে উঠেছিল। ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের এই বছরটার কিছু খবরাখবর সংগ্রহের জন্য একদিন নির্দেশ দিয়েছিলাম যুধোকে। সে দিন সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরে দেখি তার চোখ-মুখের চেহারাই অন্যরকম। বেজায় উত্তেজিত। এর আগে একবারই যুধোর এরকম চেহারা দেখেছি। যে দিন ও সত্যজিৎ রায়ের লেখা প্রথম দুটি গল্প উদ্ধার করে এনেছিল অমৃতবাজার থেকে। নিশ্চয় আজও চমকে দেওয়ার মতো কিছু সংগ্রহ করেছে।
.
যুবধা চমকে দিয়েছিল ঠিকই, তবে তার সঙ্গে আমার গবেষণার কোনও সংস্রব নেই। ১৮৫৭-র বিভিন্ন সংবাদপত্র উলটে-পালটে দেখার চেষ্টা করেছিল যুধো। অধিকাংশেরই অবস্থা শোচনীয়, প্রায় চুরচুর। পত্রিকার ফাইল হাতে পেয়েও মলাট বন্ধ করে ফেরত দিতে হয়েছে। পাতা ওলটানোর বিশেষ সুযোগ ছিল না। যুথোর মতে, এক বা একাধিক গবেষকের ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃত দুর্ব্যবহারের জন্যই এই বছরের কাগজগুলির এই হাল। সন্দেহ নিরসনের জন্য সে ১৮৫৫ এবং ১৮৫৬ সালের বিভিন্ন সংবাদপত্রও নেড়েচেড়ে দেখেছে। তাদের অবস্থা কিন্তু বেশ ভালো। প্রায় যুদ্ধ ঘোষণার মতো চেঁচিয়ে উঠেছিল যুবধা, তুমি অনুমতি দিলে দিন তিনেকের মধ্যেই অপরাধীদের আমি শনাক্ত করতে পারি।
কীভাবে?
প্রথম দেখতে হবে, সিপাই অভ্যুত্থান নিয়ে এ অবধি কারা গবেষণা করেছেন, আর তারপরে খোঁজ নিতে হবে, তাঁদের মধ্যে কে কে এসপ্ল্যানেড রিডিং রুম ব্যবহার করেছেন। এলিমেন্টারি। আমি জানি, যুথো শার্লক হোমসের ফ্যান। কিন্তু তা বলে সে নিজেকে হোমসের আসনে বসিয়ে আমায় ওয়াটসন বানাবে? বেজায় বাড়াবাড়ি।
দেখ যুবো, ভুলে যাসনি, তুই সামান্য এক জুনিয়র রিসার্চ স্কলার। গোয়েন্দাগিরি করার জন্য তোকে…
সরি। আমারই ভুল হয়েছে। আসলে জাতীয় সম্পত্তির ক্ষতি হচ্ছে দেখলে আমার মাথা খারাপ হয়ে যায়। আর অন্যদিকে, গবেষণার কাজের মধ্যেও একটা গোয়েন্দাগিরির ব্যাপার আছে। অনুসন্ধান। ক্ল। ঠিক আছে, বলছ যখন, অপরাধী খুঁজে বের করার জন্য আর সময় নষ্ট করব না। কিন্তু একটা কথা এখনই জানিয়ে রাখি। পরে তুমি আপত্তি করতে পারবে না। তোমার কাজ করার ফাঁকে, আমি যদি নতুন কোনও তথ্য বা তত্ত্বের সন্ধান পাই, তাহলে কিন্তু সেই অজানা বিষয় নিয়ে আমি নিজেই লিখব। সারাজীবন শুধু কর্তার ইচ্ছায় কর্ম করে কাটাতে হবে ভাবলেই… তা ছাড়া তোমারও তাতে বদনামই হবে।
যুধোর কথাগুলো তখন এক কান দিয়ে ঢুকে আর-একটা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। যন্ত্রমানুষ হিসেবে ওর মনটা সাধারণ মানুষের চেয়ে ঢের বেশি যুক্তিনির্ভর পথে চলাফেরা করে। স্বাভাবিকভাবেই নির্ভরতাকে সে কখনওই গ্রহণযোগ্য বলে স্বীকার করবে না। যা-ই হোক, এখন বুঝতে পারছি, বেশ কিছু দিন ধরে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে যুবধা।
রাত্রে খাওয়ার টেবিলে রুমালি রুটি ও কষা মাংসও বিস্বাদ ঠেকল। যুদ্ধে নিজের ঘরে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। ঘুম বললাম না, কারণ যন্ত্রমানুষ স্বপ্ন দেখে না। অনেক কষ্টে নিজেকে ঠেকিয়েছি। ইচ্ছে করলে, বেতার তরঙ্গ পাঠিয়ে যুবধাকে এমন নির্দেশ দিতে পারি, যাতে ও গড়গড় করে সব কবুল করে দেবে। আমাকে না জানিয়ে কী খবর সংগ্রহ করেছে, কী লিখেছে বা লিখবে বলে ভাবছে, সব জেনে নিতে পারি। কিন্তু বিবেক বাধা দিচ্ছে। যতই হোক, আমার হাতেই তো তার জন্ম।
বারান্দায় বসে তৃতীয় সিগারেটটা ধরানোর পর বুদ্ধিটা এল। প্রভা ও অনুপম পত্রিকার সম্পাদকরা আমার অচেনা নয়। ভারতের জাতীয় আন্দোলন বিষয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ জমা পড়লে, অনেক সময় আমার মতামতও চেয়ে পাঠায়। বিশেষ করে অচেনা বা নবীন লেখকের লেখা হলে। আর এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত যে, যুধো ওরফে জে বি বিদ্যাবাগীশ, বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী পর্বেরই কোনও দুর্লভ মণিমুক্তোর হদিশ পেয়েছে। কারণ, গত তিন মাস ওকে দিয়ে আমি ১৯০৫ ও ১৯০৬ সালের খবরের কাগজগুলো পড়াচ্ছিলাম।
ভাগ্য প্রসন্ন। লাইন পেতে অসুবিধে হয়নি। দুই সম্পাদকের কাছে একই আর্জি পেশ করেছি। যন্ত্রভূষণ নামে একজন গবেষণামূলক প্রবন্ধ পাঠাতে পারে। অপরিচিত নাম ও লেখার স্টাইলের দুর্বলতা দেখে সঙ্গে সঙ্গে সম্পাদকরা যেন বাতিল কাগজের ঝুড়ির মধ্যে কর্তব্য সম্পাদন না করেন। আমার কাছে পাঠালে, লেখাটা মেরামত করার দায়িত্ব গ্রহণ করতে রাজি। অনুপম পত্রিকার সম্পাদক কোনও প্রশ্ন করেননি, কিন্তু প্রভার কর্ণধার আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অগত্যা তার ন্যায্য প্রশ্নের উত্তরে জানাতেই হল, যন্ত্রভূষণ অত্যন্ত লাজুক স্বভাবের তরুণ। আমার কাছে বছরকয়েক শিক্ষানবিশি করেছে। দোষের মধ্যে একটি। টনটনে আত্মসম্মানবোধ। প্রথম লেখা জমা দিচ্ছে, তা-ও আমাকে দেখিয়ে নিতে আপত্তি।
.
প্রভার শারদীয় সংখ্যায় যন্ত্রভূষণের লেখা ছাপা হয়েছে। নাম সই করে রেজিস্টার্ড পোস্ট ছাড়িয়ে নিল যন্ত্রভূষণ। প্যাকেট খোলার আগেই ছুটে এল আমার ঘরে। ওর চোখে-মুখে শিশুর উচ্ছ্বাস।
অস্বস্তি লাগছে। গম্ভীর মুখে বললাম, প্রভার শারদীয় সংখ্যা? আমি আগেই দেখেছি।
লেখা নেই? আমার লেখা ছাপা হয়নি? তাহলে কপি পাঠাল কেন?
ছাপা হয়েছে।
প্যাকেট খুলে সুচিপত্রের পাতায় চোখ রেখেই যন্ত্রভূষণের ভুরু কুঁচকে গেল, তুমিও লিখেছ?
পাতা ওলটাচ্ছে যন্ত্রভূষণ। শুধু লিখেছি বলা ঠিক হবে না। একই বিষয় নিয়ে লিখেছি। আমার প্রবন্ধের নাম, বঙ্গ ব্যবচ্ছেদ পর্বের স্বদেশি গুপ্তচর আর তারই সংযোজন হিসেবে ছাপা হয়েছে যন্ত্রভূষণের প্রবন্ধের অংশবিশেষ, টীকারূপে। অবশ্য বিনা স্বীকৃতিতে নয়।
পত্রিকা হাতে নিয়ে যন্ত্রভূষণ চেয়ারে বসে পড়ল। মাঝে মাঝে চোখ তুলে তাকাচ্ছে। আমি ওর দৃষ্টি পড়তে পারি। চরম অবিশ্বাস। ওর কৃতিত্ব আত্মসাৎ করেছি, এমন একটা ভাব। কিন্তু আমি জানি, আর কয়েক পাতা পড়ার পরে ওর মনোভাবের পরিবর্তন হবে। কালীচরণ সমাদ্দার সম্বন্ধে ও শুধু তথ্য আহরণ করেছে খবরের কাগজের প্রতিবেদন থেকে, আর ওর লেখাপড়ার পর আমি সশরীরে হানা দিয়েছি সমাদ্দারের বাড়িতে। বংশধরদের সিন্দুক ঘেঁটে উদ্ধার করেছি অপ্রকাশিত ডায়েরি ও চিঠির গোছা। যন্ত্রভূষণের অভিযোগ করার কোনও উপায় নেই।
পুরো লেখাটা পড়ার পরে পাশের টেবিলে পত্রিকাটি নামিয়ে রেখে, চেয়ারে ঠেস দিয়ে বসল যন্ত্রভূষণ। হেসে বলল, গুরু হিসেবে ছাত্রের কাছে ঋণ স্বীকার না করলেও চলে। কিন্তু করলেই যখন, আসল কথাটা চেপে গেলে কেন? সমাদ্দারের তো নামও শোনোনি কস্মিনকালে। তার বাড়ির ঠিকানার হদিশও তো আমার লেখাতেই পেয়েছ? তা-ই না?
ব্যাপারটাকে ও হালকাভাবে নিতে পেরেছে দেখে হাঁপ ছেড়েছি। ঘাড় নেড়ে বললাম, সে তো সত্যিই। পেয়েছিই তো। তোর মাথায় কিন্তু বাড়ি-বাড়ি ঘুরে অনুসন্ধানের ব্যাপারটা…
দাঁড়াও। দাঁড়াও। উত্তেজিতভাবে যন্ত্রভূষণ আমাকে থামিয়ে দিল। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কোমরে হাত রেখে বলল, একেই বলে স্বীকারোক্তি। সেলফ কনফেশন। তুমি নিজেই স্বীকার করেছ যে, আমার পাণ্ডুলিপিটা তুমি প্রভার দফতর থেকে হাতিয়েছিলে। না হলে, আমার লেখা ছাপা হওয়ার আগে এই কেরামতি দেখানোর সুযোগ পেতে না।
গবেষক যন্ত্রভূষণ কিঞ্চিৎ নাকাল হলেও গোয়েন্দা হিসেবে সে শোধ তুলে নিয়েছে।
[আনন্দমেলা, ৮ ডিসেম্বর ১৯৯৩]