যুধিষ্ঠির
চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়াল সর্বজিৎ। আশপাশে কোনও পুকুর নেই, তবু বকগুলো এই ঘোরতর শহরে চাঁপা গাছের ডালে বাসা বেঁধেছে। রোজ সকালে তাদের কীর্তি দেখতে দেখতেই ক-দিন চা খাচ্ছে সর্বজিৎ। মা-বকটা কেবলই খোঁচা মারছে বাচ্চাটাকে। মতলবটা কী? বাচ্চাটা নীচের ডালে নেমেছে। তবু রেহাই নেই। ডানা ঝাঁপটে তাকে উড়িয়ে তবে ছাড়ল।
চা শেষ না করেই কাপটা নামিয়ে রেখে সর্বজিৎ পেছন ফিরে হাঁক ছাড়ল, যুবো, এই যুধো!
বার পাঁচেক ডাকাডাকির পর সাড়া মিলল, সাতসকালে ডাকছ কেন?
কথার পিঠে কথা বলাটা বেশ রপ্ত করে ফেলেছে। শুনলে মনে হবে যেন কাঁচা ঘুম ভাঙানো হল। যুধে পর্দা ফাঁক করে ঘরের ভেতর থেকে শুধু মাথাটা বের করেছে।
যুধোর এইসব ছোটখাটো ভঙ্গিমা দেখতেই সবচেয়ে মজা লাগে সর্বজিতের। মনটা সঙ্গে সঙ্গে খুশি হয়ে যায়। তার পরিশ্রম সার্থক হয়েছে।
কী হল, ডাকছিলে কেন?
তুই বেজায় ঘরকুনো হয়ে যাচ্ছিস। আজ তোকে একটা বাইরের কাজ দেব। একা যেতে হবে।
আজকেই বেরোতে হবে? কাল গেলে চলবে না?
এই তো, বলামাত্র অমনই শুরু হয়ে গেল। কী রাজকার্য আছে যে, বাড়ি ছেড়ে নড়তে বললেই…
ব্যাপারটা তা নয়। নিম্নচাপ ঘনীভূত হয়েছে বলেই…
কী!
খবরের কাগজটা খুললেই বুঝতে পারবে। বঙ্গোপসাগরের সন্নিহিত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে। ঝড়ের কেন্দ্র উত্তর-পশ্চিমদিকে এগোবার সময় তার ল্যাজের ঝাপটাও যদি পড়ে, কলকাতার অবস্থা ঢিলে হয়ে যাবে।
খবরের কাগজের ভাষাটা হুবহু মুখস্থ আওড়ায়নি যুধো। আর যা-ই হোক, কোনও প্রতিবেদনে ঢিলে শব্দটা ব্যবহার করা হয়নি। সর্বজিতের শেখানো প্রতিশব্দের ফর্দ থেকেই এটিকে ও বেছে নিয়েছে। প্রয়োগেও ভুল হয়নি। সর্বজিতের গর্ব হওয়ার কথা, কিন্তু হল রাগ।
তোর তাতে কী? ঝড়ই হোক বা বন্যা, বেরোতে আজকে তোকে হবেই।
ঠিক আছে, যাব। কিন্তু আমার ক্ষতি মানে তোমারই লোকসান। বৃষ্টির ঝাপটা খেয়ে আমার ইলেকট্রনিক সার্কিট যদি বেগরবাই করে, তখন? এরকম কোনও টেস্ট তো এখনও করা হয়নি। তাই বলছিলাম…।
কী বলছিলে, ভালো করেই বুঝছি। সব ব্যাপার নিয়ে তোমার মাথা ঘামাবার দরকার নেই। এখন ঘরে চলো, কাজটা ভালো করে বুঝিয়ে দিই।
এয়ারমেলের খামটা বন্ধ করতে গিয়ে গ্লু স্টিকটা খুঁজে পাওয়া গেল না। মুখের কাছে তুলে সবে জিবটা বের করেছে, যুবধা পাশ থেকে ছোঁ মেরে খামটা হাতিয়ে নিল। আপত্তি করার সুযোগ হয়নি। তার আগেই যুদ্ধে জিব দিয়ে আঙুল ভিজিয়ে নিয়ে আঠা-লাগা জায়গাটাকে একবার স্পর্শ করল। তারপর আঙুলটাকে সন্তর্পণে আর-একবার ঠেকাল জিবে। শিউরে উঠল যুথো, না না! খুব অস্বাস্থ্যকর। এই আঠার মধ্যে তিনটি অস্বাস্থ্যকর কেমিক্যাল কম্পাউন্ড আছে। প্রথমত…
ব্যাস, ব্যাস। জল নিয়ে আয়।
চিঠিটা পকেটে ভরার পর যুধোর দিকে। কুড়ি টাকার একটা নোট বাড়িয়ে ধরল সর্বজিৎ, মিনিবাসে যেতে-আসতে চার টাকা কুড়ির বেশি লাগার কথা নয়। তবু এটা রেখে দে। কাজ হোক বা না হোক, বারোটার মধ্যে তুমি বাড়ি ফিরে আসবে। তার জন্য…
তাহলে আরও দশটা টাকা দাও। বিবিডি বাগ থেকে যাদবপুরের এক পিঠের ট্যাক্সি ভাড়া তেইশ-চব্বিশ টাকা হবে।
দশটা টাকা বাড়িয়ে দিয়ে সর্বজিৎ বলল, এই নাও, কিন্তু এমার্জেন্সি না হলে ট্যাক্সি ধরবে না।
যুধো টাকাটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, খুচরো করে দিলে ভালো হয়। রিকশাওয়ালার কাছে দশ টাকার চেঞ্জ পাওয়া মুশকিল।
তুই মিনিবাস স্ট্যান্ড অবধিও হেঁটে যাবি না?
তুমি গেছ কি কোনও দিন? কোনও তাড়া না থাকলেও তো এক টাকা পঁচিশ করে রেগুলার খরচ করো।
সর্বজিতের কিছু বলার নেই। যুধিষ্ঠিরের কাছে সর্বজিৎই আদর্শ! প্রভু সৃষ্টিকর্তা।
দশটার সময়ে বেরোতে বলেছিল যুধিষ্ঠিরকে। সওয়া ন-টায় জুতোর ফিতে বাঁধছে দেখে সর্বজিৎ জিজ্ঞেস করল, এখনও তো দেরি আছে..
একটু আগেই বেরোব ভাবছি। আজকাল সাড়ে নটার পর থেকে মিনিবাসের লাইনটা বেজায় লম্বা হয়ে যায়!
যুধিষ্ঠির সিট না পেলে মিনিবাসে উঠবে না। সর্বজিতের ভুরু কুঁচকে যায়। প্রোগ্রামিং-এর কিছু পরিবর্তন দরকার। এত আয়েশি হলে তো চলবে না।
জুতোর ফিতে বেঁধে উঠে দাঁড়িয়ে যুধিষ্ঠির বলল, দাও। লাইসেন্সটা নিয়ে যাব।
লাইসেন্স! তার মানে? সর্বজিতেরই এখন ধাঁধা লাগার উপক্রম।
কী আশ্চর্য! লাইসেন্স নেই। মানুষ ছাড়া যে-কোনও চলমান বস্তুরই তো লাইসেন্স লাগে। গাড়ি, ট্যাক্সি, মিনিবাস… লাগে না? আমি তো আর মানুষ নই। হিউম্যানয়েড। দেখতে যতই মানুষের মতো হই।
বদমাশ। আপদটা। শয়তান। অনেকরকম বিশেষণ ও বিশেষ্য সর্বজিতের জিবের ডগায় এসেছিল। কোনওরকমে নিজেকে সামলেছে। এখন বুঝতে পারছে তার অনুমানটা খুব ভুল নয়। যুধিষ্ঠিরের যত আস্ফালন এই চার দেওয়ালের মধ্যে। একা একটা দায়িত্ব নিয়ে বেরোতে হবে শুনেই নানাভাবে সেটাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
সর্বজিৎ উঠে দাঁড়িয়ে কড়া গলায় বলল, যুবধা! বাড়াবাড়ি ভালো নয়। তোমার জানা উচিত, মানুষ এবং যন্ত্র ছাড়াও অনেক বুদ্ধিমান প্রাণী আছে। যেমন কুকুর…
আপত্তিকর। প্রতিবাদ করতে বাধ্য হচ্ছি। পোষা কুকুরের কথা ধরলেও আমার সঙ্গে মিলের মধ্যে শুধু প্রভুভক্তি। মানুষের সঙ্গে যুক্তিপূর্ণ মৌখিক সরাসরি আলোচনায়…
হয়েছে। হয়েছে। লাইসেন্স নিয়ে তোমার মাথা ঘামাবার দরকার নেই। দয়া করে কোনও অমানুষিক কাণ্ড বাধিয়ো না। তাহলেই হবে। কেউ ধরতেই পারবে না।
মিনিবাসের স্ট্যান্ডে পৌঁছেও লাইনে দাঁড়ায়নি যুধিষ্ঠির। একপাশে সরে অপেক্ষা করছে। আরও বারোজন যাত্রী জড়ো হওয়ার পর লাইনে যোগ দিল। জানলার পাশের সিট চাই তার। সেই জন্যই প্রথম বাসটা ধরতে চায়নি।
মিনিট পনেরোর মধ্যেই ড্রাইভার তার আসন দখল করেছে। খুব একটা সময় নষ্ট হয়নি। সেলফ স্টার্টার মারতেই যুধিষ্ঠিরের ভুরু কুঁচকে গেল। ইঞ্জিন স্টার্ট হতেই সে কান খাড়া করে ঝুঁকে বসেছে। ক্লাচ টিপে ড্রাইভার গিয়ারে সবে হাত রেখেছে, যুধিষ্ঠির উঠে দাঁড়াল। বেঁধে, বেঁধে, বলে আচমকা পা চালিয়ে নেমে পড়েছে।
আবার লাইনে এসে দাঁড়িয়েছে। এবার আর জানলা দখল করার জন্য লোক গোনেনি। মিনিট তিনেকের মধ্যে হইচই করে আগের বাসের লোকেরা ফিরে এল। বাস খারাপ। এরোপ্লেনের মতো গর্জন ছাড়ছে। যুথোকে কেউ প্রশ্ন করলেই কারণটা জানতে পারত। ফুয়েল ইনজেক্টর গড়বড় করছে। ওর কানকে ফাঁকি দিতে পারেনি।
ডালহৌসিতে নামার আগে ছোট্ট একটা বচসা হয়ে গেল কনডাক্টরের সঙ্গে। লাল বাতিতে বাস দাঁড়িয়েছে। সেখানেই ঠেলেঠুলে সবাইকে নামিয়ে দিতে চায়। মাঝরাস্তায়।
সবাই নামছে বলেই আমাকেও নামতে হবে! যুধোর যুক্তি চড়ছিল। কিন্তু পেছনের লোকেরা রীতিমতো অসহিষ্ণু, কী ঝামেলা বাড়াচ্ছেন মশাই! নামুন তো! এরপর একেবারে টেনে নিয়ে যাবে…।
যুধো নেমে পড়ল। বাসও প্রায় ফাঁকা। তার মানে যাত্রীরা নিজেরাই এখানটায় নামতে চায়।
জিপিও। এনকোয়ারি কাউন্টারের সামনে খাম হাতে এসে দাঁড়িয়েছে। লন্ডনের চিঠি। ওজন করিয়ে নিতে হবে। তারপর টিকিট কেনা। কাউন্টারে কোনও লোক নেই। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, বিরাট হলঘরের মাঝখানে গোলাকার অঞ্চলটায় কিন্তু ক্রমেই লোকের ভিড় বাড়ছে।
যুধো পকেট থেকে কয়েন বের করে ঠুকতে লাগল। পাশের কাউন্টার থেকে একজন পার্টিশনের ওপর দিয়ে মাথা উঁচু করে বলল, হলটা কী? দেখছেন তো লোক নেই।
লোক নেই মানে? কাউন্টার বন্ধ হয়ে গেছে?
রসিকতা হচ্ছে! জিপিও কখনও বন্ধ হয়!
তাহলে লোক নেই কেন?
বলছে তো এসে পৌঁছায়নি। একটু দাঁড়ান কষ্ট করে…।
এদিকে তো পৌঁছোল না, ওদিকে তো টিকিট বিক্রি শুরু হয়ে গেছে। লাইনও চড়চড় করে বাড়ছে। আমি যে দৌড়োতে দৌড়োতে এলাম, তার কী হবে?
খড়াত করে চেয়ার ঠেলে পাশের কাউন্টার থেকে ভদ্রলোক উঠে এলেন, দিন, দেখি কী আছে! একটু যদি ধৈর্য না থাকে মানুষের…
ওজন করে খামের কোণে টিকিটের দাম লিখে দিয়েছেন। যুবো হাত বাড়িয়ে বলল, ধন্যবাদ। কিন্তু একটা কথা না বলে পারছি না। একটু আগেই আপনি বললেন, লোক নেই, আবার এখন দেখছি আপনিই সেই লোক, আপনি ছিলেন না বলেই কাজটা হচ্ছিল না। তা-ই না?
লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে যুথোর মনে হল, আর কথা বাড়ানো ঠিক হবে না। এটা আর তার জানতে বাকি নেই যে, কোনও প্রশ্নের ঠিকমতো জবাব জানা না থাকলেই মানুষ সবচেয়ে বেশি চটে যায়।
পাঁচ টাকার চেয়ে বেশি দামের টিকিট বিক্রির দুটো খুপরি। একটার সামনে লাইনে। অন্তত তিরিশজন দাঁড়িয়ে। পাশেরটা একেবারে ফাঁকা। সেটার সামনেই গিয়ে দাঁড়িয়েছে সে। এটাও নিশ্চয় লোক নেই কেস। ডাকাডাকি করলে তবে কাজ শুরু হবে।
দু-একবার আওয়াজ করতেই পাশের কাউন্টার রীতিমতো ধমকে উঠল, এরকম বিরক্ত করলে আমি কিন্তু টিকিট বিক্রি বন্ধ করে দেব। কালকেও সাত টাকা শর্ট হয়েছে।
পাশের সারির কয়েকজন লোকও যুধোর ওপর বিরক্ত, দেখছে এত বড় লাইন, তবু ওই কাউন্টারে গিয়ে হইচই। আমরা এত লোক কি সাধ করে লাইন দিয়েছি?
যুধিষ্ঠির বলল, এখান থেকে টিকিট বিক্রি হবে না এমন কথা তো লেখা নেই!
সবই কি লেখা থাকে নাকি! দেখছেন না, ঘুলঘুলির মুখে কাগজ চাপা রয়েছে!
সেই লাইনে এসেই দাঁড়াতে হল।
টিকিট মারতে গিয়ে আবার সমস্যা। এবার আর চেখে দেখতে হয়নি। দেখেই বুঝে নিয়েছে পদার্থটি কী। খুব ঘেন্না করেই আঠা লাগাল। খামটা যথাস্থানে অর্পণ করে এধার ওধার তাকিয়ে আবার যুধাকে ফিরে আসতে হল এনকোয়ারিতে। এবার অবশ্য লোকের সমস্যা নেই।
একটু জল কোথায় পাওয়া যাবে?
কী? জল? বাবা! এটা তো কাশী বিশ্বনাথ সেবা সমিতির হেড অফিস নয় ভাই…
আঠা লাগিয়েছি, হাতটা ধোয়ার জন্য…
লালদিঘিতে চলে যান। ওই তো সামনেই। লক্ষ লক্ষ লোক আঠা ব্যবহার করছে। এই প্রথম শুনলাম…
পোস্টমাস্টারের কাছে অভিযোগ করবে, ঠিক করল যুধিষ্ঠির। একে বলে লাভ হবে না। কারণ জলের ব্যবস্থাই যদি না থাকে, তার জন্য নিশ্চয় এই চুনোপুঁটি দায়ী নয়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অবশ্য মত পালটাতে হল যুধিষ্ঠিরকে। আজ আর সময় নেই।
মিনিবাস ধরতে রাস্তা পার হতে হবে। গাড়ির অফুরন্ত স্রোত। এত পুলিশ দাঁড়িয়ে রয়েছে, কিন্তু কেউই সাহায্য করছে না। লোকেরা ফুড়ত ফুড়ত করে পেরিয়ে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু প্রাণের রিস্ক নিয়ে যুধো কোনও কাজ করতে রাজি নয়। প্রায় মিনিট চারেক দাঁড়াবার পর সুযোগ এল।
সাদা অ্যাম্বাসাডরটার নাম্বার প্লেটের ওপরে লাল হরফে লেখা গভর্নমেন্ট অব ওয়েস্ট বেঙ্গল। সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। চোখ পড়ল পেছনের সিটের যাত্রীর ওপর। অবাক হল যুধা। রাস্তা না পেরিয়ে গাড়িটার পেছনের জানলার কাছে এসে দাঁড়াল। মাথা নামিয়ে ঝুঁকে দেখল। কোনও ভুল নেই। বারো-তেরো বছরের বেশি বয়স হবে না।
যুথোকে এইভাবে উঁকি মারতে দেখে ছেলেটা ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে। ড্রাইভার ঘাড় ফিরিয়ে বলল, যাও, যাও। কিছু হবে না।
তোমার বয়স কত ভাই? যুবধা ড্রাইভারের কথা কানে তোলেনি। ছেলেটা তাড়াতাড়ি হাতল ঘুরিয়ে কাঁচ তুলে দিয়েছে। বুঝল, এদের মুখ দিয়ে কথা বের করা যাবে না। সে গাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে নোটবুক বের করে নম্বরটা লিখতে শুরু করল।
ট্রাফিক ছেড়ে দিয়েছিল। অসংখ্য গাড়ির অধৈর্য হর্নের শব্দে কান পাতা যায় না। বাঁ হাতে ওয়াকি-টকি বাজিয়ে সার্জেন্ট ছুটে এসে যুথোর কলার ধরে পাশে টেনে আনল, কী হে, পুলিশ হওয়ার আবার শখ চাপল কেন?
পুলিশ নয়। চাইল্ড লেবার। চোখ নেই!
তার মানে?
দেখলেন না! পশ্চিমবঙ্গ সরকার একজন নাবালককে চাকরিতে নিযুক্ত করেছে। কিছুতেই বয়স বলল না। তাই তো নাম্বারটা নিতে হল।
সার্জেন্টের মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে গেছে। ব্যাপারটা মোটেই পাগলের কেস নয়। ওই গাড়িতে কার ছেলে ইস্কুলে যাচ্ছে, সেটা সার্জেন্ট ভালোই জানে।
কোন কাগজ থেকে? সার্জেন্ট প্রশ্ন করে।
কাগজ আবার কী!
টহলদারি একটা পুলিশের ভ্যানকে হাতের ইঙ্গিতে দাঁড় করিয়ে সার্জেন্ট বলল, লর্ড সিনহা। রিপোর্টার বলে যখন কবুল করছে না, একটু খোঁজখবর নেওয়া দরকার।
যুথো বাধা দেয়নি। লর্ড সিনহা রোড অবধি লিফট পাওয়া গেলে মন্দ কী! সেপাইজির সঙ্গে দু-একটা কথা বলার পরেই যুথোর ভুল ভাঙল। সহজে অব্যাহতি পাবে বলে মনে হচ্ছে না।
ঘড়ির দিকে তাকাল যুথো। সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বারোটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হলে একটা অমানুষিক কাণ্ড না বাধালেই নয়। কোনটা ভালো? দেরি করে ফেরা, না…।
ভিক্টোরিয়ার সামনে গাড়িটা সিগন্যালে আটকেছিল। সেপাইজি তার বাঁ হাতটা ধরে বসে ছিল। যুথো তার শরীরের ভঙ্গি এতটুকু না পালটে সেপাইজির হাতটাকেই আরও শক্ত করে চেপে ধরল। একটা ছোট্ট গোঙানি। যুদ্ধে হাত ছেড়ে দিতেই সে তিন পাক খেয়ে উলটে পড়ল সিটের নীচে।
লাফ মেরে নেমেই যুধো ছুট লাগাল। রাস্তা পার হয়ে সোজা ভিক্টোরিয়ার বাগানে। এখানে লোকজনের বেশ ভিড়। গা-ঢাকা দেওয়ার সুবিধে।
বারকয়েক পেছন ফিরে লক্ষ করেছে। না, কেউ তাকে অনুসরণ করছে না। খুব রক্ষা পেয়েছে এ যাত্রা। এখন হেলেদুলে একটা মিনিবাস ধরলেও ঠিক পৌঁছে যাবে সময়মতো।
নুড়ি-বিছোনো পথের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পেল্লায় সিঁড়ির কাছে পৌঁছে যুথো ভাবল, হাতে একটু সময় থাকলে মিউজিয়ামটা দেখা হয়ে যেত। ইতিহাসটা তার এখনও বেশ কাঁচা। এখানে পলাশির আমবাগানের একটা গোলা আছে। সে কথা দিব্যি মনে আছে। অথচ পলাশির যুদ্ধের সালটা মনে পড়ছে না।
আপনা থেকেই সিঁড়ির দিকে চোখ পড়েছিল। যুদ্ধে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। ঠিক দেখছে তো? লাল বুটি-বুটি স্কার্ট-পরা একটা মেয়ে পেছন ফিরে নামছে সিঁড়ি দিয়ে। ক্লাস টু কি বড়জোর থ্রি।
আট-দশ ধাপ নামার পর মেয়েটা আবার ছুটে উঠে গেল সিঁড়ি দিয়ে। স্বাভাবিকভাবেই। তারপর আবার সেই কাণ্ড। মুখটা সামনের দিকে করে এক-এক পা নেমে আসছে।
কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখে ঝাপসা দ্যাখে যুবো। তন্নতন্ন করে অনুসন্ধান চালিয়েও সে তার স্মৃতিভাণ্ডারে এই খেলার নাম খুঁজে পায়নি। হচ্ছে কী ব্যাপারটা? তা-ও যদি একা না হত তো একরকম। কয়েকজনে মিলে যদি দৌড় প্রতিযোগিতা চালাত। কিন্তু সঙ্গে তো কেউ নেই।
যুধিষ্ঠির উঠে এল কয়েক ধাপ। একটা লোক তাকে লক্ষ করছে দেখতে পেয়েই মেয়েটা হেসে বলল, কেউ পারবে না আমার সঙ্গে। আমি না তাকিয়েই ব্যাক করতে পারি।
বাহ। তা-ই তো দেখছি। কিন্তু এরকম করছ কেন?
ভালো লাগে।
ভালো লাগে? কেন?
মজা হয়। বাপি বকে। মা বলে, পড়ে যাবি। খেলা।
কী নাম খেলাটার?
নাম আবার কী? এমনি।
নাম নেই? শিখলে কী করে তাহলে?
শিখলুম মানে? নিজেই করি। কেউ তো করতে বলেনি।
নীচ থেকে মায়ের ডাক শোনা যায়। শিগগির নেমে এসো পম্পু। আর নয়।
যুধিষ্ঠিরকে দেখিয়ে দেখিয়ে পম্পু নিজস্ব কায়দায় নীচে নেমে গেল। সারাদিনে এরকম জটিল সমস্যার সামনে পড়তে হয়নি। এখন অবশ্য আর ভাববার সময় নেই।
বাড়ি ফেরার পর দু-জনের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল। হিসেবনিকেশ। একটা কথা সর্বজিৎ প্রথমেই সাফ জানিয়ে দিয়েছে। তাতে যুধিষ্ঠির যতই দুঃখ পাক। মানুষের তৈরি কোনও বুদ্ধিমান যন্ত্রের পক্ষে যা-ই করা সম্ভব হোক, বাচ্চাদের নাগাল পাওয়া মুশকিল। কার্যকারণ মেপে ওদের মতিগতির হদিশ লাভ করা সম্ভর নয়।
সর্বজিৎ বলল, পশুর কথা বাদ দিলে আমি দেখছি আর সবই ঠিক আছে। শুধু অন্যের ব্যাপারে নাক গলানোর অভ্যাসটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সেটা খুব জটিল কিছু নয়। একটা ট্রায়োড আর…
নাক গলানো বলছ কেন? যুথোর আত্মসম্মানে লেগেছে। বরং বলল, আমার সত্যবাদিতার জন্যই মাঝে মাঝে অসুবিধে হচ্ছে।
সে তো হবেই। তা না হলে তোর নাম যুধিষ্ঠির রাখব কেন বল!
তার মানে, যুধিষ্ঠির বলতে তুমি জ্যেষ্ঠ পাণ্ডবকেই মিন করো? মহাভারত?
নিশ্চয়। তা ছাড়া আর কী?
আশ্চর্য ব্যাপার। কখনও বলোনি তো আগে। তাহলে তো আগেই জানতে চাইতাম। সত্যি বলতে ওই ইতি গজর ব্যাপারটা এখনও আমি ধরতে পারিনি। এদিকে বলছে, সত্যবাদী অবার ইতি গজ করতেও ছাড়ছে না।
সর্বজিৎ বুঝতে পারে, যুধো এখন তার নিজস্ব প্রবলেমগুলোকেও শনাক্ত করতে পারছে। কখন এবং কেন ইতি গজ বললেও মিথ্যেবাদী হতে হয় না, সেটাই এখন তার জানা দরকার।
[আনন্দমেলা, ২১ আগস্ট ১৯৯১]