টাইম মেশিন, ফান পোয়া ও ঝন্টুমামা
হাতের লেখার ওপর নজর দেওয়ার দরকার নেই। বড় বড় হরফ-ছাপা খামটাই বলে। দিচ্ছে, চিঠিটা কার কাছ থেকে আসছে। সায়েন্স ফিকশন সিনে ক্লাব উঠে যাওয়ার পর বোধহয় তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রী চেঞ্জ হয়ে গেছে। এ খাম এখনও একমাত্র থাকতে পারে…
ব্যাপারটা ঝন্টুমামারও না-বোঝার কোনও কারণ নেই। কিন্তু ভাবখানা এমন করছে যেন কী না-জানি কাণ্ড ঘটে গেছে। কপাল খারাপ না হলে চিঠিটা কি আর ঝন্টুমামার হাতে পড়ে?
সিনে ক্লাবের খামে নিতান্ত ব্যক্তিগত প্রেমপত্র আছে বলে দাবি করা সম্ভব নয়। অগত্যা খুলতেই হল।
জুলাই মাস পড়ার পর লেখককে লেখা সম্পাদকের চিঠি এরকম সংক্ষিপ্তই হয়। ঝন্টুমামা ঘাড়ের পাশ দিয়ে ঝুঁকে সদ্য-বর্ণজ্ঞানসম্পন্ন বালকের মতো মহা আনন্দে নিজের বিদ্যা জাহির করতে শুরু করল–টেলিফোনে না পেয়ে এই চিঠি। ঝন্টুমামার গল্প একনিমেষে এখুনি একটা নামাও। সাত দিনেই পাঠাও। পুজোয় ঝন্টুকেই চাই।
হাহাকার না হুংকার, ঠিক বোঝা গেল না। কিন্তু প্রশ্নটা পরিষ্কার। কত দিন ধরে চলছে এসব কাণ্ড?
বাংলা বা ইংরেজি গল্পের বইয়ের সঙ্গে কোনও খাতির নেই বলেই ঝন্টুমামা জানতে পারেনি যে, সাহিত্যেও তার নাম কীরকম ছড়িয়ে পড়েছে।
বোঝাবার চেষ্টা করলাম। প্রায় চোখ বুজে শুনল। খুব ধৈর্য ধরে। তারপর নম্রভাবে বলল, তোকে আর কষ্ট করতে হবে না। এখন থেকে আমার ডিমান্ড আমিই মেটাব।
কে কাকে বোঝাবে যে, সম্পাদক যে ঝন্টুকে চায়, স্বয়ং ঝন্টুও তা সরবরাহ করতে পারবে না। তা পারে শুধু লেখক। সাহিত্যিক।
শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করলাম, ঝন্টুমামা, তুমি লিখলে যে আত্মজীবনী হয়ে যাবে। চেয়েছে তোমায় নিয়ে গল্প।
আমি যদি সত্যিই ফেমাস হই, আমি করে লিখলে আরও কাটতি বেশি হবে। দেখে নিস–
দেখে নেওয়ার কিছু ছিল না। ঝন্টুমামার সাহিত্য-প্রচেষ্টা যথাবিধি সাত দিনের মধ্যেই নাকচ হয়ে ফিরে এল। শুধু তা-ই নয়, সম্পাদকের চিঠি পড়ে মনে হল, তিনি ভেবেছেন, আমিই বুঝি এই স্টান্টটা মারার চেষ্টা করেছি। নাম ভাঁড়িয়ে। না হলে এই উক্তির কী মানে হয়, লেখাটা তো উতরোনো চাই, তার পরে চমক।
ঝন্টুমামাকে বললাম, দেখলে তো, শুধু তোমার লেখাটাই বাতিল হল না, লেখক হিসেবে আমার সম্বন্ধেও তুমি সন্দেহের কালো মেঘ জমিয়ে দিলে। এর মোদ্দা ফলটা হল একটাই। ফি-বছর একবার অন্তত তোমার নামটা ছাপার হরফে লোকে পড়ত…
চারমিনারের ধোঁয়ার আড়াল থেকে ঝন্টুমামা অবহেলা ছুঁড়ে দিল, ক-টা লোক এখন পড়ে? ছাপা হরফে নাম বেরোলেই লোকে আর বিখ্যাত হয় না।
তা বিখ্যাত হওয়ার জন্য এখন তোমার পরবর্তী কার্যক্রমটা কী? জিজ্ঞেস করতে পারি?
স্বচ্ছন্দে। পুজোসংখ্যায় লেখাটা বেরোল না বলেই প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মহাসপ্তমী বেছে নিয়েছি। রাত আটটা পঞ্চাশ। চ্যানেল এ। অল ইন্ডিয়া নেটওয়ার্ক।
অনেক প্রশ্ন করেও একটিবারের জন্যও মুখ খোলাতে পারিনি। কী কুক্ষণে যে ঝন্টুমামাকে জনপ্রিয় করেছি। এবার কোনও পুজোসংখ্যায় একটাও লেখা ছাপা হল না। সারাক্ষণ শকুনের মতো শুধু পাহারা দিয়েছে, যাতে ঝন্টু-চরিত্র আমার লেখায় না আসে।
একটা জিঘাংসা নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম সপ্তমীর জন্য। খবরের কাগজ থেকে টেলি নিউজ, সাপ্তাহিক সব বারবার উলটে দেখেছি, ওই আটটা পঞ্চাশের প্রোগ্রামের কোনও হদিশ মেলেনি। সবটাই কি ধাপ্পা?
আটটা পঞ্চাশ। স্মিত হাসিতে পর্দা ভরিয়ে ঘোষক জানাল, এখন আরম্ভ হচ্ছে। বিজ্ঞাপনদাতার ধারাবাহিক অনুষ্ঠান কালান্তরের যাত্রী। স্যাটেলাইটের মধ্যস্থতায় একটি জীবন্ত অনুষ্ঠান।
পর্দার ওপর কে যেন নানা ধরনের কয়েক বোতল রং উপুড় করে দিয়ে ঘেঁটে চলেছে। ভাষ্যকারের গলা শোনা যায়। সন্দেহ নেই, ঝন্টুমামাই!
সময়ের সমুদ্র পেরিয়ে ছুটে চলেছি। শুধু অন্ধকার। এখানে অন্ধকারের শব্দ নেই, কিন্তু রং আছে। সময়ের অন্ধকার বড় এলোমেলোভাবে রঙিন। কিন্তু কোথায় চলেছি আমি? সামনে না পেছনে? কোথায় গিয়ে থামব? মাপ চেয়ে নিচ্ছি। আমার টাইম মেশিন এখনও নিখুঁত নয়। প্রথম মোটরগাড়ি যখন তৈরি হয়, তখন কি তার ব্যাক গিয়ার ছিল? আমার কালান্তরের যন্ত্রযানেরও নেই। কাজেই আমি শুধু এগোতে পারি। ভবিষ্যৎ যাত্রা। প্রথম যুগের মোটরগাড়ির না ছিল গতি মাপার, না ফেলে-আসা পথের হদিশ নেওয়ার যন্ত্র। স্পিডো বা মাইলোমিটার। আমারও একই অবস্থা। কী বেগে ভবিষ্যৎ পেরিয়ে চলেছি বা ব্রেক কষার পর ঠিক কোন কালে এসে থামব, জানি না। তবে এটা ঠিক যে, যেকালেই এসে মেশিন ভিড়োই, তার ভৌগোলিক অবস্থান ওই ১৯৯১-এর ভবানীপুরের কাঁসারিপাড়া, যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছি।
আমার মেশিনের সঙ্গে লাগানো একটা ছোট্ট স্ক্রিন আমায় বলে দিচ্ছে, আপনারা ঠিক কী দেখছেন এখন। নিজেকে আপনাদের আসনে বসিয়ে এটাও বুঝতে পারছি যে, এলোপাথাড়ি ওই রঙের তাণ্ডব ইতিমধ্যেই আপনাদের কাছে বোরিং ঠেকছে। বেশ। এই ব্রেকের প্যাডেলে পা রাখছি। তিন ইঞ্চি পা নামালেই ভবিষ্যতের দুনিয়ায় গাড়ি থামবে। আমি নেমে আসব। শুধু একটাই অনুরোধ। আপনারা জানেন এটা লাইভ প্রোগ্রাম। অর্থাৎ আমার প্রথম অভিজ্ঞতালাভের মুহূর্তে আপনারাও তার শরিক হবেন। আমি যা প্রথম দেখব, জানব, একই সঙ্গে আপনারাও তা-ই দেখবেন, জানবেন। বুঝতে পারছেন, কোনও প্রতিশ্রুতি দিতে পারব না। চমক কি বিপদ। আনন্দ কি আতঙ্ক! আমি গাড়ি দাঁড় করাচ্ছি।
গলা ঝন্টুমামার, কিন্তু এই ভাষা কখনও নয়। তাহলে আর তার সাহিত্য প্রচেষ্টা অমনোনীত মার্কা নিয়ে রিটার্ন-পোস্টে ফেরত আসত না। পর্দার রঙের খেলাও ইলেকট্রনিক্সের কৌশলে গবেষণাগারেই তৈরি হওয়া সম্ভব। সব বুঝেও একটা কৌতূহল ক্রমশ মাথাচাড়া দিচ্ছে।
হঠাৎ ফিল্ম ছিঁড়ে যাওয়ায় মতো পর্দায় কিছু হিজিবিজি। ছবি আবার ফিরে এসেছে, কিন্তু শব্দ নেই। রংও নেই। নির্বাক যুগের সাদা-কালো প্রোজেকশন। ফোকাসেরও গণ্ডগোল।
তা হোক, কাঁসারিপাড়ার আগামী যুগের ছবির টানে ঝুঁকে বসেছি। পেল্লায় সব স্কাইস্ক্র্যাপারে ঠাসা। তারই ফাঁকে ফাঁকে বেশ সাজানো এক-একটি দ্বীপ। ডালপালায় ভরা। চোখে পড়ার মতো পান্থপাদপের ছড়াছড়ি। বাড়িগুলো সবই ছ-কোনা, মৌমাছির চাকের মতো। কিন্তু ছবি একটুও নড়ছে না। ক্যামেরা একেবারে স্থির। দর্শকদের সইয়ে নেওয়ার জন্য ব্যবস্থা?
স্থিরচিত্র হয়ে থাকার জন্যই চোখে পড়ল, এই ছ-কোনা সব অট্টালিকার চেয়েও কিন্তু উন্নতমস্তকে কলশি মাথায় একটি গম্বুজ। সন্দেহ নেই, মন্দিরের চূড়া।
কিন্তু মন্দিরের চূড়াই যদি হবে, তবে অমন পিসার টাওয়ারের মতো কাত হয়ে রয়েছে কেন? সর্বনাশ! মন্দির কেন, এবার বোঝা যাচ্ছে, ছবির ফ্রেমে পুরো ল্যান্ডস্কেপটাই ত্যারচা হয়ে রয়েছে। সব বাড়িই ঠিক ওই অ্যাঙ্গলে রয়েছে। ব্যাখ্যা খুবই সরল। ক্যামেরাটাই কাত হয়ে আছে। শুধু তা-ই নয়, ক্যামেরাটা ঝন্টুমামার হাতেও নেই। না হলে ছবি কখনও এরকম স্থবির হতে পারে না।
অ্যাক্সিডেন্ট? ঝন্টুমামার হাত থেকে ক্যামেরা ছিটকে পড়েছে? শব্দ ও রঙের হানির কারণও নিশ্চয় এই আঘাত। কিন্তু ঝন্টুমামাও কি আহত? না হলে নিশ্চয়…
বুকের মধ্যে একটা ব্যথা। সুদূর ভবিষ্যতে ঝন্টুমামার দুর্ঘটনাজনিত প্রাণত্যাগের সাক্ষী হতে হবে, সেটা দুঃখজনক ঠিকই, কিন্তু তার চেয়েও আপশোশের কথা, গাছে তুলে এভাবে মই কেড়ে নেওয়া ভবিষ্যতের এই নির্বাক একঝলক দৃশ্যই কি প্রথম এবং শেষ? প্রতিশ্রুতির সঙ্গেই পরিণতি?
কিন্তু একটা লোক হঠাৎ আছড়ে পড়েছে রাস্তার মধ্যে, তাকে উদ্ধার করতে কেউ এগিয়ে আসছে না কেন?
সরি ফর ইনটারাপশনটিভির বাঁধা বুলিটা একঝলক জ্বলেই নিবে গেল। একটা কিছু ঘটেছে। মানে ছবি নড়ছে। বলা ভুল হল। ছবি নড়েনি, কিন্তু ক্যামেরায় চোখের খুব কাছ দিয়ে একজন হেঁটে গেছে বলে ছবিটা ব্ল্যাক-আউট হয়ে গিয়েছিল মুহূর্তের জন্য, তারপরে আবার সেই একই দৃশ্য।
ভবিষ্যতে কোনও মানুষ কি তাহলে ঝন্টুমামার সাহায্যে এগিয়ে এল?
উত্তর পেতে দেরি হয়নি। উচ্চ-আধুনিকা এক কিশোরী। পরনে খাটো স্কার্ট। পনিটেল। কোনও অলংকারের চিহ্ন নেই। হাত তুলে মুখ ঢাকা দেওয়ার আগেই কিন্তু তার দু-চোখের আতঙ্ক আমরা দেখেছি। সে কি ক্যামেরার ভীতি? নাকি অতীত যুগের প্রাণী হিসেবে ঝন্টুমামা একনজরেই চিনে ফেলেছে?
ঝন্টুমামা ক্যামেরা না সরিয়েই বলে উঠল, ধন্যবাদ। তুমি আমাকে টেনে বার না করলে এমনভাবে গাড়ি উলটে পড়েছিল যে, বোধহয় দম বন্ধ হয়েই…
ঝন্টুমামা কথা শেষ করার আগেই মেয়েটা মুখের সামনে থেকে হাত সরিয়ে ঠোঁটের কাছে ডান হাতের আঙুল তুলে ইঙ্গিত করল, চুপ চুপ! তার আতঙ্কের সঙ্গে এবার মিনতি যুক্ত হয়েছে। ঘন ঘন এপাশ-ওপাশ তাকাচ্ছে। এখুনি ছুটে না পালালে যেন প্রাণসংশয় হবে, তবু সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।
ঝন্টুমামা ফিশফিশ করে বলল, কী সাংঘাতিক! এরা কথা না বলেই মনের ভাব প্রচার করতে পারে। শুধু তা-ই নয়, এখানে কথা বলা, মানে শব্দ করে কথা বলা গহিত অপরাধ। একমাত্র মন্দিরের পুরোহিতরাই শুধু মন্ত্রপাঠের সময় শব্দ উচ্চারণের অধিকারী।
ক্যামেরার চোখ জুম করে মন্দিরের চুড়ো ধরেছে। এই প্রথম শোনা গেল ভাবীকালের শব্দ। ঘণ্টা বাজছে মন্দিরে।
মেয়েটি প্রচণ্ড বিপদে পড়েছে। ওর প্রেমিককে পুরোহিতরা ধরে নিয়ে গেছে। কন্সক্রিপশন। কারণ তার ডান হাতের কড়ে আঙুলে একটি তিল আছে আর উজ্জয়ন্ত সংহিতার মতে এই তিলধারীরাই ভবিষ্যতে যাজ্ঞিক পদগ্রহণের উপযুক্ত। মেয়েটিকে ধরার জন্য ওরা এখন হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি বিদেশি, শুধু এইটুকু বুঝেই ও আমার সাহায্য চেয়েছে।
ক্যামেরা আবার নড়েছে। ঝন্টুমামা জানাল, এখন কিছুক্ষণ আমার পক্ষে ক্যামেরা অপারেট করা সম্ভব নয়। আমি সুবিধেমতো জায়গায় এটাকে বসিয়ে দিচ্ছি। রিংকিরই শুধু আমাকে প্রয়োজন নয়, ওর হেল্প ছাড়া আমার পক্ষেও এই গাড়ি মেরামত করা সম্ভব নয়। যেটা এই মুহূর্তে আপনাদের মনোরঞ্জনের চেয়ে অনেক জরুরি।
অটো স্ট্যান্ডে বসানো ক্যামেরা তিন সেকেন্ড অন্তর আপনা থেকে পঁচিশ ডিগ্রি পাক খেয়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়ছে। ঝন্টুমামার কথা বিশ্বাস করতে হলে আমরা সুদূর ভবিষ্যতের কাঁসারিপাড়ার ভিউ দেখছি ঘুরে ঘুরে।
ঝন্টুমামার টাইম মেশিনও ধরা দিয়েছে। সিনেমায় দেখা ওয়েলসের গল্পের সঙ্গে কোনওই মিল নেই। অনেকটা হোভারক্র্যাফটের মতো চেহারা। ঝন্টুমামাকেও এই প্রথম। দেখলাম। ডান হাতটা বুকের কাছে চেপে রয়েছে। টি-শার্টটা রক্তে লাল। বেশ ভালো জখম হয়েছে। রিংকি হাতে রেঞ্জ বাগিয়ে কী সব টানাটানি করছে। ঝন্টুমামা ঝুঁকে পড়ে নির্দেশ দিচ্ছে।
সুন্দরীদের সাধারণত কাশ্মীরের বাগানে গাছের গুঁড়ি পাকড়ে হেলাদোলা করতে দেখা যায়। এরকম মেহনতের কাজের মধ্যে দিয়ে যৌবনের চার্ম কিন্তু আরও বেশি ধরা দিচ্ছে। প্রাণের আশঙ্কা না থাকলে ঝন্টুমামা অনেক বেশি উপভোগ করতে পারত।
ক্যামেরার চোখ ঘুরে যায়। আর একটা উঁচ যেন তরল নাইট্রোজেনের শীতলতা ঢুকিয়ে দেয় মনের মধ্যে। কয়েকশো লোকের একটি নির্বাক বাহিনী জমা হয়েছে ঝন্টুমামাদের একপাশে। দুটো মাল্টিস্টোরির মাঝখানের প্যাসেজে। ঝন্টুমামারা ঘাড় ফিরিয়েও ওদের দেখতে পাবে না। আমরাও শুধু ওদের শরীরের আধখানা দেখতে পাচ্ছি। কোমরের তলার অংশ। বাকিটা ক্যামেরার ফ্রেমের বাইরে। গেরুয়া রঙের ঢোলা পাতলুন আর কালো বুটজুতো।
নির্বোধ ক্যামেরা বেশ কয়েক মিনিট ধরে অপ্রয়োজনীয় দৃশ্যাবলি দেখিয়ে উৎকণ্ঠার আগুনে ইন্ধন জোগাচ্ছে।
ঝন্টুমামা আর রিংকি এখনও বিপদের আঁচ পায়নি। গাড়ি সারানো নিয়ে হিমশিম। বোঝাও মুশকিল, আর কতক্ষণ লাগবে। গেরুয়া সৈন্যরা ছুটে এলে দু-মিনিটও সময় পাবে না। তা ছাড়া ওদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র আছে কি না তা-ই বা কে জানে।
গেরুয়া সৈন্যরা একভাবে দাঁড়িয়ে। শুধু নজর রাখছে। হঠাৎ ময়ূরের মতো পেখমওয়ালা একটা পাখি কোত্থেকে যেন সামনের গাছের ডালে এসে বসল। অদ্ভুত চেহারা। কিন্তু তারিফ করার সময় পাওয়া গেল না। তার সুরেলা কণ্ঠ একবার ডেকেই থেমে গেছে চিরতরে। ডাল থেকে লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে। ছোট্ট একটা তির এসে বিঁধেছে তাকে। গেরুয়া সৈন্যদের নিশ্চয় টেলিস্কোপিক ধনুক আছে। না হলে এভাবে একবারে ওখান থেকে লক্ষ্যভেদ করতে পারত না।
আর আহাম্মুক ক্যামেরার নির্ভুল গতিবিধির জন্য ঘড়ি ধরে প্রতীক্ষা। অস্ত্র কোনও শব্দ না করলেও একটি শব্দকে আচমকা নিহত করেছে। সেই সুবাদে ঝন্টুমামারাও বিপদের গন্ধ পেয়েছে। রিংকি আর ঝন্টুমামা দু-জনে টাইম মেশিনটা ঠেলে নিয়ে চলেছে সবচেয়ে কাছের বাড়িটার দরজার দিকে। বারবার পেছনে তাকাচ্ছে রিংকি। দরজার ঠিক মুখে দাঁড়িয়ে সে বোধহয় ফেলে-আসা ক্যামেরাটার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিল। ঝন্টুমামা বাঁ হাতে সুন্দরীর কোমর জড়িয়ে টেনে নিল। আগে পরিবহনব্যবস্থা সামলাও…
ক্যামেরার চোখ ফেরাল, আর সেই মুহূর্তে আর-একটি তির ছুটে এসে তাকে চূর্ণ করে দিল। প্রচণ্ড শব্দে যেন আমার টেলিভিশন পর্দাটাই গুঁড়ো-গুড়ো হয়ে গেল, এমনই এফেক্ট শব্দ আর রঙের তাণ্ডবে।
তবে কি এখানেই দি এন্ড! সিঁদুররাঙা টিভি ঘোষকের মুখে ডাকটিকিটের হাসি বলল, টেলি-সংযোগ ছিন্ন হয়নি পুরোপুরি, ঝন্টু সেন জানিয়েছেন, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই তিনি দ্বিতীয় ক্যামেরা চালু করবেন। তার আগে আপনাদের কাছে বিশেষ একটি অনুরোধ। এই অনুষ্ঠান শুধু সাবালকদের জন্য। এই মুহূর্তে সেই মর্মে সেন্সর বোর্ড আমাদের নির্দেশ পাঠিয়েছেন। ছোট ছেলেমেয়েদের পক্ষে এই বিভীষিকার স্বাদ না-পাওয়াই ভালো। বিশেষ করে তার পরিণতি যখন আমাদের সকলেরই অজানা।
একটি মন-চনচনে হাসি দিয়ে রিংকি আমাদের অভ্যর্থনা জানাল। সেই সঙ্গে ঝন্টুমামার গলা, আমরা এখন ডি টোয়েন্টি সেভেন বিল্ডিং-এর দু-হাজার সাতাশ নম্বর ফ্ল্যাটে। সাতাত্তরতলায়। টাইম মেশিন রেডি। আর কেউ আমাদের ছুঁতে পারবে না। কয়েকশো বছর চোখের পলকে পেরিয়ে যাব। রিংকিই আমাকে পথ দেখিয়ে এলিভেটরে করে এই আপাতত-ফাঁকা ফ্ল্যাটে নিয়ে এসেছে।
এই প্রথম রিংকির গলা শোনা গেল। বেশ আদুরে-আদুরে ব্যাপার। কথা বলার অভ্যাস নেই বলেই কি এরকম শোনাচ্ছে? আর রিস্ক নেওয়ার কী দরকার বিদেশি? চলোনা, আমরা কোথাও চলে যাই!
যাব তো নিশ্চয়। তার আগে একটু দেখে নিই। সবাইকে যতটা পারি দেখিয়ে দিই এ যুগের হালচাল।
আর কিন্তু সময় বেশি নেই। ঘরগুলো সব সাউন্ডপ্রুফ, কিন্তু সেই সঙ্গে ভয়েস ডিটেক্টর আছে। কথা বললেই লালবাজারের কন্ট্রোলরুমে ধরা পড়বে। বড়জোর মিনিট পাঁচেক…
-কী বললে, লালবাজার? পুলিশের হেড কোয়ার্টার? এখনও আছে?
–হ্যাঁ। আছেই তো!
–আর কী আছে? আর এরকম কী আছে? ঝন্টুমামা এত উত্তেজিত যে, খেয়ালই করেনি রিংকির পক্ষে এই প্রশ্নের মর্ম অনুমান করা সম্ভব নয়।
ঝন্টুমামা ক্যামেরা হাতে ফ্ল্যাটের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে পরবর্তী প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়, এটা কোন সাল বলতে পারেন?
–মাচ বেটার। এটার তবু মানে হয়।
রিংকি বলল, ম. ম. তিন হাজার সতেরো।
-কী বললে? ম. ম.–তার মানে?
-ম. ম. মানে মহামন্দির। মহামন্দির প্রতিষ্ঠা থেকে আমাদের কালগণনা হয়। বলতে বলতেই রিংকি ঘরের কোণে দাঁড়-করানো একটা যন্ত্রের সুইচ টিপে ধরতেই একফালি কাগজ বেরিয়ে এল। আজকের খবর। প্রিন্ট আউট।
ঝন্টুমামা ছোঁ মেরে তুলে নিল কাগজটা। ক্যামেরায় চোখ দিয়ে আমরা এবার টেলিভিশন স্ক্রিনেই খবর পড়ছি। যাক, বাংলা ভাষাটা তখনও টিকে আছে?
নবজাতক
সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের ইনটেলেকচুয়াল অফিসার গুহলাহিড়ির তৎপরতায় কলকাতায় মাল্টিস্টোরি থেকে এক পুরুষ ও এক মহিলাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এরা প্রায় তিন বছর ধরে সবার চোখ এড়িয়ে এখানে বাস করেছে। শুধু তা-ই নয়, একটি সন্তানের বাবা-মা-ও হয়েছে…
ঝন্টুমামার হাতে রিংকির হ্যাঁচকা টান লাগার জন্যই নিশ্চয় খবরের কাগজের হরফগুলো অমন লাফিয়ে উঠে আউট অব ফোকাস হয়ে গেল।
ওরা উঠছে এলিভেটর দিয়ে…
ঝন্টুমামা নিরাসক্ত–উঠুক। দরজা ভাঙতে কতক্ষণ লাগবে?
–ওদের মাস্টার চাবি আছে।
–ঠিক আছে, তুমি তাহলে উঠে বোসো। আমি একবার ঝট করে ডাইনিং রুমটা দেখে নিই। দেখিয়েও দিই।
ডাইনিং রুমে টেবিল নেই। মেঝের তিনটি আসন পাতা। কিন্তু তা ছাড়া সবই রীতিমতো চকচকে ও আধুনিক। কাবার্ড থেকে কয়েকটা টিল্ড ফুটের কৌটো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে হঠাৎ ঝন্টুমামা যেন ইলেকট্রিক শক খেল।
ক্যামেরাটাকে কৌটোর লেবেলে ফোকাস করতেই আমরা সারস পাখির ছবিওয়ালা পরিচিত লেবেলটা আবিষ্কার করেছি। সুইস টেকনোলজিতে তৈরি মালপোয়া। ফান-পোয়া। গত সাত দিন ধরে খবরের কাগজ আর টিভি-র বিজ্ঞাপনের দৌলতে এমন কেউ নেই, যে ফান-পোয়র নাম শোনেনি। ফান-পোয়ার দৌলতে আর-একটা তথ্য আমরা আবিষ্কার করেছি।
ঝন্টুমামা যে ফান-পোয়া টিনটা ক্যামেরায় সামনে তুলে ধরছে, তাতে ছোট ছোট হরফে, কিন্তু ব্রাইট রঙে, মানে লাল রঙে ঘোষণা করা আছে :
তিন হাজার সতেরো বছর ধরে এই রসালো মিষ্টান্ন বাঙালিদের অতি আদরের বস্তু।
ঝপ করে ছবি নিবে গেল। পর্দা অন্ধকার। তারপরেই আবার সেই সুন্দরী হাসি। স্যাটেলাইট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য আমরা দুঃখিত। এখন দেখবেন…
ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করার সময় দেয়নি কলিং বেল। নিলয় আর তার বউ এসে পড়েছে।
–শেমফুল!–ঘরের মধ্যে পা দেওয়ার আগেই ঘোষণা করল নিলয়।–ঝন্টুমামার এই অধঃপতন কল্পনাতীত। শেষে একটা বিজ্ঞাপন এজেন্সির হয়ে তাদের পণ্যকে বাজারে চালু করার জন্য এইরকম কমার্শিয়াল উদ্যোগে নিজে নাম জড়ানো!
সুজাতা বাধা দিল, তোমার সবেতেই বাড়াবাড়ি। আমি তো দম বন্ধ করে দেখছিলাম—
সব ধাপ্পাই ওইরকম থ্রিলিং হয়। এই কলকাতারই কোনও স্টুডিয়োয় বসে পুরোটা ফিলম করেছে। টাইম মেশিনের কারবার বলে চালিয়ে দিলেই হল! আর টিভি কর্তৃপক্ষেরও বলিহারি! কিছু না বুঝে…
আমি বললাম, তাহলে ওই ফান-পোয়র বিজ্ঞাপন করা হচ্ছে বলে টনক নড়েছে বলেই কি প্রোগ্রামটা হেঁটে দিল?
-সার্টেনলি। কিন্তু তার আগেই ওরা ব্যাবসা গুছিয়ে নিয়েছে ভাই!
সুজাতা বলল, তোমরা যা-ই বলল, আমি কিন্তু একটা কথা কিছুতেই ভুলতে পারছি না। ফান-পোয়া তিন হাজার সতেরো বছর ধরে চালু, আবার ঝন্টুমামা যেকালে গিয়েছিলেন, সেটাও ম. ম. তিন হাজার সতেরো! তার মানেটা কী দাঁড়াচ্ছে, তোমরা কি খেয়াল করেছ?
আমি আর নিলয় রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়ে এ ওর মুখের দিকে দেখছি, সুজাতা বলে উঠল, তার মানে ম. ম. অর্থাৎ মহামন্দির এই বছরেই স্থাপন হতে চলেছে। মহামন্দির সত্যিই যদি স্থাপিত হয়, তাহলে আর ঝন্টুমামাকে তোমরা ধাপ্পাবাজ বলতে পারবে না।
[ফ্যানট্যাসটিক বার্ষিকী, ১৯৯১]